Loading AI tools
দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান সম্প্রদায় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
শিয়া ইসলাম, শিয়া মতবাদ বা আহলে তাশাইয়ু (আরবি: شيعة, প্রতিবর্ণীকৃত: Shīʿah; ফার্সি: شیعه; উর্দু: اہل تشیع) হল ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। এই মতবাদ অনুসারে ইসলামের পয়গম্বর মুহম্মদ ﷺ তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আলী ইবনে আবী তালিবকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত (খলিফা) ও পরবর্তী রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা (ইমাম) হিসেবে মনোনীত করে যান,[2] বিশেষত গাদীর খুমের ভাষণে, কিন্তু সকীফায় মুহম্মদের অন্যান্য সাহাবা কর্তৃক অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলস্বরূপ আলীকে তাঁর ন্যায্য খিলাফত থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিকভাবে সুন্নি ইসলামের সঙ্গে বৈপরীত্য ধারণ করে। সুন্নি মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে, মুহম্মদ মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করে যাননি এবং তারা সকীফায় মুসলমানদের একটি প্রবীণ গোষ্ঠীর দ্বারা মনোনীত আবু বকরকে নবীপরবর্তী প্রথম ন্যায়নিষ্ঠ (রাশিদুন) খলিফা হিসেবে বিবেচনা করে।[3] শিয়া ইসলামের অনুসারী ব্যক্তিকে শীʿঈ বলে অভিহিত করা হয়।[4][5]
শিয়া ইসলাম গাদীর খুমে মুহম্মদের ঘোষণা সংক্রান্ত একটি হাদিসের উপর নির্ভরশীল।[4][6] শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, মুহম্মদের চাচাতো ভাই ও জামাতা আলী ইবনে আবী তালিবের ইসলামের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মুহম্মদের মনোনীত স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল।[7] এই বিশ্বাসটি পরবর্তীতে ইমামত তত্ত্বে বিকশিত হয়, এই ধারণা যে মুহম্মদের নির্দিষ্ট কিছু বংশধর তথা আহল আল-বাইত হলেন ন্যায্য শাসক বা ইমাম।[8] শিয়ারা আলীকে ঐশ্বরিকভাবে নিযুক্ত নবীপরবর্তী নেতা ও প্রথম ইমাম গণ্য করে। তারা এই ইমামতকে নবীবংশ বা আহল আল-বাইতের কতিপয় ইমাম পর্যন্ত বিস্তৃত করে। শিয়া বিশ্বাসমতে ইমামগণ মুসলিম উম্মাহের উপর বিশেষ আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি নিষ্কলুষতা ও অভ্রান্ততার মতো ঈশ্বরপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন।[9] যদিও শিয়া ইসলামের অসংখ্য শাখা ও উপদল রয়েছে, আধুনিক যুগে শিয়ারা প্রধানত তিনটি দলে বিভক্ত: ইসনা আশারিয়া, ইসমাইলি ও জায়েদি। ইসনা আশারিয়া বর্তমানকালে সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী শিয়া উপদল।[10][11][12]
শিয়া মতবাদ ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা এবং গোটা মুসলিম বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিয়া।[13] ইসনা আশারিয়া হল শিয়া ইসলামের বৃহত্তম উপদল[14] এবং শিয়া মুসলমানদের প্রায় ৮৫ শতাংশ ইসনা আশারিয়া মতাবলম্বী।[15]
সামগ্রিকভাবে শিয়া ইসলামের অনুসারীদের শীʿআ (আরবি: شِيعَة) বলা হয়। এটি ঐতিহাসিক পরিভাষা শীʿআতু ʿআলীর (আরবি: شِيعَة عَلِيّ) সংক্ষিপ্ত রূপ যার অর্থ “আলীর অনুসারী”, “আলীর সমর্থক” বা “আলীর দল”;[16][17] শীʿঈ (আরবি: شِيعِيّ) বলতে একবাচক বিশেষ্য এবং বিশেষণ উভয়ই বোঝায়, অন্যদিকে শিয়াʿ (আরবি: شِيَاع) শব্দটি দ্বারা বহুবাচক বিশেষ্যকে বোঝানো হয়।[18]
শিয়া শব্দটি হযরত মুহম্মদের সাঃ জীবদ্দশায় প্রথম ব্যবহৃত হয়।[19] বর্তমানে শব্দটি দ্বারা সেইসব মুসলমানদের বোঝানো হয় যারা বিশ্বাস করে যে হযরত মুহম্মদের সাঃ মৃত্যুর পর আলী ও তার বংশধরেরাই মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের একমাত্র দাবিদার। নওবখতীর মতে শিয়া শব্দটি দ্বারা মুসলমানদের একটি গোষ্ঠীকে বোঝানো হত যারা মুহম্মদের সময়ে এবং তার মৃত্যুর পর আলীকে ইমাম ও খলিফা গণ্য করত।[20] আলী শহরস্তানী বলেন যে, শিয়া বলতে তাদেরই বোঝানো হয় যারা আলীকে মুহম্মদের মনোনীত উত্তরাধিকারী, ইমাম ও খলিফা হিসেবে বিবেচনা করে[21] এবং আলীর এই কর্তৃত্ব তার উত্তরসূরীদের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় জারি থাকবে বলে বিশ্বাস করে।[22] শিয়াদের মতে এই প্রতীতি পবিত্র কোরআন ও ইসলামের ইতিহাসে অন্তর্নিহিত। শিয়া পণ্ডিতেরা জোর দিয়ে বলেন যে, কর্তৃত্বের ধারণাটি ইসলামের পয়গম্বরদের পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কারণ কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ৩৩ ও ৩৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম (আঃ) ও নূহ (আঃ)-কে এবং ইবরাহীমের ও ইমরানের গোত্রকে বিশ্বজগতের উপর মনোনীত করেছেন। এরা একে অন্যের বংশধর এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।”[23][24]
শিয়া ইসলামের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অনেক পশ্চিমা পণ্ডিতেরা ধারণা করেন যে শিয়া মতবাদ প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় আন্দোলন আকারে নয় বরং একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল।[25][26] অন্যন্য পণ্ডিতেরা এর সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন যে, এই রাজনৈতিক-ধর্মীয় পৃথকীকরণ মূলত পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের কালাতিক্রমিক প্রয়োগ।[27]
শিয়া মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে, নবীগণ যেমন একমাত্র আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত হন, তেমনি নবীদের উত্তরসূরীদের নিযুক্ত করার বিশেষ ক্ষমতাও একমাত্র আল্লাহরই আছে। তারা বিশ্বাস করে যে স্বয়ং আল্লাহ পাক আলীকে মুহম্মদের উত্তরাধিকারী, অভ্রান্ত ও ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে বাছাই করেছিলেন। শিয়াদের মতে মুহম্মদ আল্লাহর নির্দেশে গাদীর খুমে আলীকে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন।[28][29]
আলী ছিলেন মুহম্মদ এর চাচাতো ভাই, নিকটতম জীবিত পুরুষ আত্মীয় এবং তার জামাতা তথা ফাতিমার স্বামী।[30][31]
মুহম্মদ এর জীবদ্দশাতেই সাহাবিদের মধ্যে অনেকে ছিলেন আলীভক্ত। সালমান আল-ফারসি, আবু যার আল-গিফারী, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ এবং আম্মার ইবনে ইয়াসির ছিলেন আলীর বিশ্বস্ত ও প্রবল সমর্থক।[32][33]
কথিত আছে যে, আনুমানিক ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে কোরআনের ২৬ তম সূরা আশ-শুআরা নাজিলের সময়[34] মুহম্মদ প্রাক-ইসলামি ধর্মীয় অনুশীলনসমূহের বিরুদ্ধে তার পরিবারের সদস্যদের সতর্ক করবার ব্যাপারে নির্দেশনা পেয়েছিলেন। এই সতর্কীকরণের বিভিন্ন বিবরণ রয়েছে। একটি সংস্করণে বলা হয়েছে যে মুহম্মদ তার আত্মীয়দের খাবারের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন (পরবর্তীতে জুল আশীরার উৎসব হিসেবে অভিহিত) যেখানে তিনি একটি বক্তব্য পেশ করেছিলেন।[35] ইবনে ইসহাকের মতে বক্তব্যটির কিছু অংশ নিম্নরূপ:
আল্লাহ আমাকে তার দ্বীনের দিকে তোমাদের আহ্বান করার জন্য এই বলে আদেশ করেছেন: ‘আর আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।’ অতএব, আমি তোমাদের সতর্ক করছি এবং সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আহ্বান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তার রাসূল। হে আব্দুল মুত্তালিবের পুত্রগণ! আমি তোমাদের নিকট যে জিনিস নিয়ে এসেছি এরচেয়ে উত্তম কিছু পূর্বে আর কেউ কখনও তোমাদের কাছে নিয়ে আসেনি। এটি গ্রহণের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। তোমাদের মধ্যে কে এই গুরুদায়িত্ব পালনে আমাকে সমর্থন করবে? কে আমার সাথে এই কাজের বোঝা ভাগ করে নেবে? আমার ডাকে কে সাড়া দেবে? কে আমার প্রতিনিধি, সহকারী ও উজির হবে?[36]
জমায়েত লোকেদের মধ্যে কেবল আলীই তাতে সম্মতি জানান। কিছু সূত্র, যেমন মুসনাদে আহমাদ, এতে মুহম্মদের প্রতিক্রিয়া নথিভুক্ত করেনি। যদিও ইবনে ইসহাকের সূত্রে তিনি এরপর আলীকে তার ভাই, উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন।[37] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে মুহম্মদ আলীর সম্মতি গ্রহণের পর তাঁকে “আলিঙ্গন করেন” এবং বলেন, “তাকিয়ে দেখো, আমার ভাই, আমার উজির, আমার প্রতিনিধি… সবাই যেন তার কথা শোনে ও তাকে মান্য করে।”[38]
এই সংস্করণে নবীর উত্তরাধিকারী হিসেবে আলীর সরাসরি মনোনয়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এটি আলীর প্রতিনিধিত্বের অধিকার মুহাম্মদের নবুওতি কর্মকাণ্ডের একেবারে শুরুতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সপক্ষে যুক্তি দেয়। কোরআনের একটি আয়াত নাজিল হওয়ার সঙ্গে এর সম্পৃক্ততাও প্রামাণিক মনোনয়নের পাশাপাশি ঐশী অনুমোদনের সপক্ষে যৌক্তিকতা প্রদান করে।[39]
গাদীর খুমের হাদিসের অসংখ্য সংস্করণ রয়েছে এবং এটি সুন্নি ও শিয়া উভয় সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনাগুলোতে সাধারণভাবে বলা হয়েছে যে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মুহম্মদ তার বিপুল সংখ্যক অনুসারী ও সাহাবার সঙ্গে বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পথে গাদীর খুম মরুদ্যানে এসে থেমে যান। সেখানে তিনি হজযাত্রীদের সমবেত করে তাদের উদ্দেশ্যে একটি খুৎবা পেশ করেন। খুৎবার এক পর্যায়ে তিনি আলীর হাত উর্ধ্বে তুলে ধরে ঘোষণা করেন, “মান কুনতু মাওলা ফাহাজা আলীউন মাওলা।” অর্থাৎ, “আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা।” কোনো কোনো সূত্রে অতিরিক্ত একটি বাক্য এসেছে যেখানে নবী বলেন, “হে আল্লাহ! যে আলীর সাথে বন্ধুত্ব করে আপনি তার সাথে বন্ধুত্ব করুন, আর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে আপনিও তার সাথে শত্রুতা করুন।”[40]
আরবি ভাষায় মাওলা শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। এখানে শব্দটি মুহম্মদ কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন সে ব্যাপারে সুন্নি ও শিয়াদের ভিন্ন ব্যাখ্যা বিদ্যমান। সুন্নিদের মতে এর অর্থ বন্ধু, বিশ্বস্ত বা ঘনিষ্ঠ এবং শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে মুহম্মদ আলীর প্রাপ্য বন্ধুত্ব ও সম্মানকে সমর্থন করছিলেন।[41] এর বিপরীতে শিয়াদের মতে শব্দটির অর্থ নেতা বা শাসক[42] এবং এই ঘোষণাটি ছিল পরিস্কারভাবে মুহম্মদ কর্তৃক আলীকে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মনোনয়ন। শিয়া সূত্রসমূহ এই ঘটনাটির আরও বিস্তৃত ও বিশদ বর্ণনা প্রদান করে যেখানে উপস্থিত জনতা আলীর প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং তাঁকে আমীরুল মুমিনীন বা বিশ্বাসীদের নেতা সম্বোধনপূর্বক জয়ধ্বনি করেন।[40]
মুহম্মদ ৬৩২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক বৃহস্পতিবার তার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটে। কথিত আছে যে তিনি মুসলিমদের “চিরতরে পথভ্রষ্ট” হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এমন একটি বিবৃতি প্রদান করার করার জন্য তাঁকে লেখার উপকরণ দিতে আদেশ করেন।[43][44]
কিন্তু তার কক্ষে উপস্থিত লোকজন এই আদেশ মানবেন কিনা তা নিয়ে বাদানুবাদ শুরু করেন। ইবনে সা‘দের মতে, যিনি এই ঘটনার একাধিক সংস্করণ সরবরাহ করেছেন, উপস্থিত লোকেদের মধ্যে একজন মুহম্মদ কে বিকারগ্রস্ত বলাতে এই বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করলে মুহম্মদ তাদের তার কক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেন এবং পরবর্তীকালে কিছুই লেখেননি। কিছু সূত্রমতে, মুহম্মদ তার বিবৃতি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর বলেছিলেন যে তিনি এর পরিবর্তে উম্মাহর নিকট তিনটি সুপারিশ জারি করবেন। ইবনে সা’দের একটি সূত্রমতে, এর মধ্যে দুটি ছিল:[45]
তৃতীয় সুপারিশটি অনুপস্থিত। ইবনে সা‘দ বলেন যে, এর কারণ হয় মুহাম্মদ সুপারিশটি উল্লেখ করেননি নতুবা হাদিসটির বর্ণনাকারী তা ভুলে গিয়েছিলেন। আত তাবারি ও ইবনে কাসিরের মতো লেখকেরাও এই ঘটনাটিকে একইভাবে বর্ণনা করেছেন। অন্য একটি বিকল্প সূত্রমতে, সুপারিশ তিনটি ছিল নামাজ, জাকাত এবং মা মালাকাত আইমানুকুম। এই সংস্করণটি মুহম্মদ এর চূড়ান্ত নির্দেশ শাহাদা প্রদানপূর্বক তার মৃত্যুর সঙ্গে সমাপ্ত হয়।[45]
বর্ণনাকারীদের পক্ষপাত অনুসারে হাদিসটির বিভিন্ন পুনরাবৃত্তি উপস্থিত লোকেদের পরিচয়ের, যেমন: জয়নব বিনতে জাহশ, উম্মে সালামা ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের মতো ব্যক্তিত্বদের সন্নিবেশ বা অপসারণ, পাশাপাশি পরিবর্তিত হয়। একটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে মুহাম্মদ আলীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকাবস্থায় এই ঘটনাগুলি ঘটে।[45] প্রসিদ্ধ সুন্নি হাদিসগ্রন্থ সহীহ বুখারী অনুসারে মুহম্মদ কে বাধাদানকারী ব্যক্তি ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব, যিনি বলেছিলেন যে কোরআনের বাইরে অন্য কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন নেই।[43][44]
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন মুহাম্মাদের সা মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এল, তখন ঘরের মধ্যে অনেক মানুষের সমাবেশ ছিল। যাদের মধ্যে উমর ইবনু খাত্তাব-ও ছিলেন। তখন তিনি (রোগ যন্ত্রনায় কাতর অবস্থায়) বললেন, “লও, আমি তোমাদের জন্য কিছু লিখে দেব, যাতে পরবর্তীকালে তোমরা বিভ্রান্ত না হও।” তখন উমর বললেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর বেশি যাতনা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আর তোমাদের নিকট কুরআন বিদ্যমান। আর আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট।” এ সময়ে আহলে বাইতের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হল। তারা বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হলেন। তারপরে কেউ কেউ বলতে লাগলেন, “নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কাগজ পৌঁছিয়ে দাও এবং তিনি আমাদের জন্য কিছু লিখে দেবেন, যাতে পরবর্তীকালে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট না হও।” আবার তাঁদের মধ্যে অন্যরা উমর (রাঃ) যা বললেন তা বলে যেতে লাগলেন। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁদের বাকবিতণ্ডা ও মতানৈক্য বেড়ে চলল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা উঠে যাও।” উবায়দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলতেন, “বড় মুসীবত হল লোকজনের সেই মতানৈক্য ও তর্ক-বিতর্ক, যা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সেই লিখে দেওয়ার মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।” (সহীহ বুখারী, অধ্যায় ৬২/রোগীদের বর্ণনা, পরিচ্ছেদ ২২৬৬, হাদীস ৫২৬৭)[46]
এই নিঃশব্দ আদেশটির প্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী রাজনৈতিক তর্কগুলিতে—বিশেষত মুহম্মদের সা স্থলাভিষেক বিষয়ক সংকটে—ব্যবহৃত হয়েছিল। শেখ মুফীদের মতো শিয়া পণ্ডিতেরা দাবি করেন যে, এর মাধ্যমে মুহম্মদ আলীকে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে সরাসরি নিযুক্ত করতেন। অন্যদিকে আল বালাযুরির মতো সুন্নি পণ্ডিতেরা মনে করেন যে মুহম্মদ এর মাধ্যমে আবু বকরকে মনোনীত করতে চেয়েছিলেন।[45]
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের নবী মুহাম্মদের প্রয়াণের অনতিবিলম্বে বনু সাঈদা গোত্রের সকীফা প্রাঙ্গণে আনসারদের (মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা) একটি জনসভা বসে।[47] তখনকার সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, সভাটির উদ্দেশ্য ছিল মুহাজিরদের (মক্কার অভিবাসী) ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে আনসারদের নিজেদের মধ্যে থেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন নতুন নেতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যদিও এটি তখন থেকেই একটি বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়।[48] তবে নবীর বিশিষ্ট দুই সাহাবি আবু বকর ও উমর বৈঠকটির ব্যাপারে জানতে পেরে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেন এবং তড়িঘড়ি করে সেখানে যান। আংশিক উত্তপ্ত বিতর্কের পর আবু বকর চূড়ান্তভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের নতুন খলিফা হিসেবে সমবেত জনতার দ্বারা নির্বাচিত হন।[49] যদিও আবু বকরের ক্ষমতারোহণ সর্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছিল, বেশ কয়েকজন সাহাবা—যাঁদের মধ্যে আলী ইবনে আবী তালিব ও তার সহচরেরা ছিলেন অন্যতম—প্রাথমিকভাবে আবু বকরের কর্তৃত্বকে মেনে নেননি।[47] নবীর চাচাতো ভাই ও জামাতা হওয়াতে আলী নিজেই সম্ভবত নেতৃত্ব গ্রহণের প্রত্যাশা করেছিলেন। এছাড়া বনু হাশিম গোত্রের লোকেরা তাঁকে খলিফা হিসেবে কামনা করেছিল।[50] সকীফার নির্বাচনে তার প্রার্থিতা উত্থাপিত না হওয়াতে তিনি এবং তার দলের লোকেরা নাখোশ ছিলেন।[51]
অতঃপর উমর ইবনুল খাত্তাব সদলবলে সদ্য নির্বাচিত খলিফা আবু বকরের প্রতি আলী ও তার অনুসারীদের আনুগত্য অর্জনের লক্ষ্যে ফাতিমার ঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন যেখানে আলী, ফাতিমা এবং তাঁদের কিছু সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন।[52] এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বাদানুবাদ তৈরি হয়। সুন্নি, শিয়া এবং পশ্চিমা ঐতিহাসিক গ্রন্থে এই ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে।[53] আত তাবারি ও ইবনে কুতাইবার মতো একাধিক সুন্নি পণ্ডিতেরা বর্ণনা করেছেন যে, আলী আবু বকরের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলে উমর ফাতিমার ঘর পুড়িয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন।[54] আত তাবারির আরও যুক্ত করেন যে, উমরের লোকেরা এরপর আলীর সহচর জুবাইর ইবনুল আওয়ামকে মারধর করে।[55][56][57][58] আল-ইমামা ওয়া আস-সিয়াসা (যা ইবনে কুতাইবার লেখা বলে দাবি করা হয়) অনুসারে,[59] উমরকে যখন ঘরের ভিতরে ফাতিমার উপস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা হয়, তখন তিনি বলেন যে তার উপস্থিতি এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।[60][61] অন্যদিকে ইতিহাসবিদ আল-বালযুরি বলেছেন যে, এই বিবাদটি কখনই হিংসাত্মক হয়ে ওঠেনি এবং আলীর আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি হয়েছিল।[62] তাবারি এই ঘটনায় ফাতিমার জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনও উল্লেখ করেননি।[55] কিছু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ও তার সমর্থকেরা জোর করে ঘরে প্রবেশ করেন এবং এর ফলে ফাতিমার গর্ভস্রাব ঘটে ও তার গর্ভস্থ সন্তান মুহসিন ইবনে আলী মারা যান।[63] দ্বাদশী শিয়া সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর জোরপূর্বক সম্মুখের দরজাটি খুলতে গেলে তা ভেঙে যায় এবং দরজার নিচে চাপা পড়ে ফাতিমার পাঁজর ভেঙে যাওয়ায় এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।[64] মুতাজিলা ধর্মতাত্ত্বিক ইব্রাহিম আল-নজ্জম বর্ণনা করেছেন যে, “উমর ফাতিমার পেটে আঘাত করাতে তার গর্ভের সন্তানটি মারা যায়।”[65] এর বিকল্পস্বরূপ, ইবনে রুস্তম আত-তাবারি বলেছেন যে, কুনফুজ নামক উমরের এক সমর্থক ছিল এই গর্ভপাতের জন্য দায়ী যে তলোয়ারের খাপ দিয়ে ফাতিমাকে আঘাত করেছিল।[66] অন্যান্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে কুনফুজ তাঁকে চাবুক মেরেছিল[67] বা তার মুখে আঘাত করেছিল।[68] কিতাব সুলাইম ইবনে কায়েস (সুলাইম ইবনে কায়েস কর্তৃক লিখিত বলে দাবি করা হয়, তবে সম্ভবত একটি পরবর্তী সৃষ্টি) অনুসারে,[69] আলীকে গলায় রশি বেঁধে ঘর থেকে বের করে আনা হয়েছিল।[70]
শিয়া পণ্ডিত মুহম্মদ বাকির মজলিসী তার বিহারুল আনোয়ারে লিখেছেন যে, বিবাদ চলাকালীন আঘাতের ফলে অসুস্থ হয়ে কয়েকমাস পরেই ফাতিমা মৃত্যুবরণ করেন।[71] পূর্বোক্ত আল-ইমামা ওয়া আস-সিয়াসাতে বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত্যুর পূর্বে ফাতিমা আবু বকর ও উমরকে বলেছিলেন, “আমি আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সাক্ষী মেনে বলছি যে, আপনারা আমাকে সন্তুষ্ট করেননি; বরঞ্চ আমাকে ক্রুদ্ধ করেছেন। যখন আমি আল্লাহর রাসুলের সাথে সাক্ষাত করব, তখন আপনাদের দুজনের নামে অভিযোগ করব।”[72] মোর্তেজা মোতাহারীর মতে, তিনি মৃত্যুর আগে আলীকে রাতেরবেলা তার লাশ দাফন করতে বলেছিলেন যাতে তার বিরোধীদের কেউই তার জানাজায় অংশ নিতে না পারে।[73]
ফাদাক ছিল আরব উপদ্বীপের খাইবার অঞ্চলে অবস্থিত একটি মরূদ্যান যা নবী মুহাম্মদ খায়বারের যুদ্ধের পর ফাই বা বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মদিনা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী ফাদাক উদ্যানটি জলকূপ, খেজুর ও কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।[74] নবীর মৃত্যুর পর ফাদাকের উত্তরাধিকার নিয়ে খলিফা আবু বকর এবং নবীর কন্যা ফাতিমার মধ্যে বাদানুবাদ তৈরি হয়।[75] ফাতিমা মনে করতেন এটি উত্তরাধিকারসূত্রে তার প্রাপ্য। কিন্তু আবু বকর তাঁকে ফাদাকের সম্পত্তি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান কেননা নবী মুহাম্মদ বলেছিলেন যে নবীরা কোনো উত্তরাধিকার রেখে যান না।[76] ফলে ফাতিমা তার মৃত্যু অবধি আবু বকরের প্রতি ক্ষুব্ধ থাকেন। এই ঘটনাটি প্রামাণিক সুন্নি হাদিসগ্রন্থ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে।[77] আয়িশা হতে বর্ণিত:
নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যা ফাতেমাহ (রাঃ) আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিত্যক্ত সম্পত্তি মদিনা ও ফাদাক-এ অবস্থিত ফাই (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ) এবং খাইবারের খুমুসের (পঞ্চমাংশ) অবশিষ্ট থেকে মিরাসী স্বত্ব চেয়ে পাঠালেন। তখন আবূ বাকর (রাঃ) উত্তরে বললেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন, আমাদের (নাবীদের) কোন ওয়ারিশ হয় না, আমরা যা ছেড়ে যাব তা সদাকাহ হিসেবে গণ্য হবে। অবশ্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধরগণ এ সম্পত্তি থেকে ভরণ-পোষণ চালাতে পারবেন। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সদাকাহ তার জীবদ্দশায় যে অবস্থায় ছিল আমি সে অবস্থা থেকে এতটুকুও পরিবর্তন করব না। এ ব্যাপারে তিনি যেভাবে ব্যবহার করে গেছেন আমিও ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করব। এ কথা বলে আবূ বাকর (রাঃ) ফাতেমাহ (রাঃ)-কে এ সম্পদ থেকে কিছু দিতে অস্বীকার করলেন। এতে ফাতিমাহ (রাঃ) (মানবোচিত কারণে) আবূ বাকর (রাঃ)-এর উপর নাখোশ হলেন এবং তার থেকে সম্পর্কহীন থাকলেন। তার মৃত্যু অবধি তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-এর সঙ্গে কথা বলেননি। নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর তিনি ছয় মাস জীবিত ছিলেন। তিনি ইন্তিকাল করলে তার স্বামী ‘আলী (রাঃ) রাতের বেলা তাঁকে দাফন করেন। আবূ বাকর (রাঃ)-কেও এ খবর দিলেন না এবং তিনি তার জানাযার সালাত আদায় করে নেন। […] (সহীহ বুখারী, পরিচ্ছেদ ৬৪/৩৯, হাদীস ৪২৪০–৪২৪১)[78]
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদের প্রয়াণের পর আলী এবং মুহম্মদের নিকটাত্মীয়রা তার জানাজার বন্দোবস্ত করেন। যখন তারা তার লাশের গোসল দিচ্ছিলেন ও জানাজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদাহ ইবন আল-জাররাহ মদিনার গোত্রপতিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আবু বকরকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করেন। আলী আবু বকরের খিলাফত মেনে নেওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে অস্বীকৃতি করেন। এই ঘটনাটি সুন্নি ও শিয়া উভয় সূত্রে সহীহ ও প্রামাণিক হাদিসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। ৯ম শতাব্দীর সুন্নি ইসলামি পণ্ডিত ইবনে কুতাইবা আলী থেকে বর্ণনা করেন যে আলী বলেছিলেন:
“আমি আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রাসূলের ভাই। আমি এই পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিক যোগ্য। আমি আপনাদের [আবু বকর ও উমর] প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করব না, যেখানে আপনাদের উচিত আমার নিকট বায়াত প্রদান করা। নবীর সঙ্গে আপনাদের গোষ্ঠীগত সম্পর্ককে একটি যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আনসারদের কাছ থেকে এই পদাধিকার দখল করেছেন। আপনারা কি এখন জোর করে এই পদাধিকার আমাদের, আহল আল-বাইতের, কাছ থেকে কেড়ে নেবেন? আপনারা কি আনসারদের সামনে এই দাবি করেননি যে খিলাফতের জন্য আপনারা তাদের তুলনায় বেশি যোগ্য কারণ রাসূলুল্লাহ আপনাদের গোত্রের লোক (কিন্তু নবী আবু বকরের গোত্রভুক্ত ছিলেন না) — এবং ফলস্বরূপ তারা কি আপনাদের নিকট নেতৃত্ব ও আজ্ঞা সমর্পণ করেনি? এখন আমি আপনাদের সঙ্গে একই যুক্তির ভিত্তিতে তর্ক করছি… জীবিত বা মৃতদের মধ্যে আমরাই (আহল আল-বাইত) রাসূলের সর্বাধিক নিকটাত্মীয় ও তার যোগ্য উত্তরাধিকারী। যদি আপনারা সত্যিই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখেন তবে আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিন, নতুবা স্বেচ্ছায় অন্যায় করার দায়ভার বহন করুন… হে উমর, আমি আপনার আদেশ মানব না; আমি তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করব না।” অবশেষে আবু বকর বললেন, “হে আলী, যদি আপনি বায়াত দিতে না চান, তবে আমি আপনাকে এ ব্যাপারে জোরাজোরি করব না।”
খিলাফত ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফাতিমার সাথে উমরেরও তর্ক হয় এবং এক পর্যায়ে উমর ফাতিমার গৃহে অগ্নিসংযোগের হুমকি দেন।[79][55][80][57][81][82] কোনো কোনো সূত্রমতে উমর ফাতিমার ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেন।[83][84] মুহম্মদের গোত্র বনু হাশিমের প্রায় সকলে তার মৃত্যুর পর আলীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, অন্যরা আবু বকরের পক্ষে সমর্থনে জানিয়েছিলেন।[85][86][87][88][89][90][91][92][93]
৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফানের হত্যাকাণ্ডের পর মদিনার মুসলমানেরা মরিয়া হয়ে শেষ ভরসাস্থল হিসেবে আলীকে চতুর্থ খলিফা হওয়ার আহ্বান জানায়। আলী খলিফা হবার পর তার রাজধানী কুফায় (অধুনা ইরাক) স্থানান্তর করেন।[16]
মুসলিম উম্মাহর উপর আলীর খিলাফতকাল ছিল প্রায়শই কলহপূর্ণ এবং তার বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। ফলে তাঁকে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যারা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশপূর্বক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বা তার পদচ্যুত করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে প্রথম ফিতনা সংঘটিত হয় যা ছিল ইসলামি খিলাফতের অভ্যন্তরীণ প্রথম বৃহৎ গৃহযুদ্ধ। আলীর রাজনৈতিক পূর্বসূরি উসমান ইবন আফফানের গুপ্তহত্যাকে কেন্দ্র করে আলীর বিরুদ্ধে একাধিক বিদ্রোহ এই ফিতনার সূত্রপাত ঘটায়। উসমানের শাসনামলে যেসব বিদ্রোহী তাঁকে স্বজনপ্রীতির দায়ে অভিযুক্ত করেছিল তারা আলী ইবনে আবী তালিবের খিলাফত মেনে নেয়, কিন্তু পরবর্তীকালে তারাই আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।[30] আলী ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন।[30] তিনি নামাজে সেজদারত অবস্থায় আততায়ীর গুপ্তঘাতের শিকার হন এবং পরবর্তীকালে মৃত্যুবরণ করেন।[31] আলীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান এরপর খিলাফতের দাবি করেন।[94]
আলীর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র হাসান ইবনে আলী কুফায় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কুফার মুসলমান ও মুয়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের সেনাবাহিনীর মধ্যে বেশি কিছু খণ্ডযুদ্ধের পর হাসান মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মুয়াবিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেন। তিনি নির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে মুয়াবিয়ার নিকট খিলাফত হস্তান্তর করতে সম্মত হন:[95][96]
এরপর হাসান কুফা থেকে মদিনায় চলে যান এবং সেখানে ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে তার স্ত্রী জা‘দা বিনতে আল-আশ‘আত ইবনে কায়েস কর্তৃক বিষপ্রয়োগে মৃত্যুবরণ করেন। হাসান হত্যাকাণ্ডে মুয়াবিয়ার ভূমিকা ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা ধারণা করে থাকেন।[lower-alpha 1][lower-alpha 2][98][99][100][101][102]
আলীর কনিষ্ঠ পুত্র ও হাসানের ভাই হোসাইন ইবনে আলী প্রাথমিকভাবে মুয়াবিয়াকে প্রতিহত করতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ও খিলাফত পুনরুদ্ধারের জন্য আহ্বান জানান। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়া মৃত্যুবরণ করেন এবং হাসানের সঙ্গে তার করা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যান। ইয়াজিদ হুসাইনকে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনস্বরূপ বাইয়াত প্রদান করতে বলে।
আলীর দল, যারা প্রত্যাশা করেছিল মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর খিলাফত আলীবংশীয়দের কাছে ফিরে আসবে, এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা ও শান্তিচুক্তির চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখে এবং হুসাইন ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে প্রত্যাখ্যান করেন৷ কুফায় হুসাইনের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন ছিল যেন তিনি সেখানে যান এবং খলিফা ও ইমাম হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। ফলে হোসেন তার পরিবারের সদস্য ও অনুসারীদের নিয়ে মদিনা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে কারবালার প্রান্তরে (অধুনা ইরাক) ইয়াজিদের বাহিনী (যাদের মধ্যে কুফার অধিবাসীরাও ছিল) তাঁদের পথরোধ করে। অতঃপর কারবালার যুদ্ধে হুসাইন এবং তার পরিবার ও অনুসারীদের ৭২ জন শহীদ হন।
শিয়ারা হুসাইনকে একজন শহীদ হিসেবে বিবেচনা করে এবং তাঁকে আহল আল-বাইতের একজন ইমাম গণ্য করে। তারা হুসাইনকে ইসলামের রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখে যিনি ইয়াজিদের হাতে ধ্বংস হওয়া থেকে ইসলামকে রক্ষা করেছিলেন। হুসাইন আলীর পর শেষ ইমাম যাঁকে সকল শিয়া উপশাখা পরস্পর সমানভাবে স্বীকৃতি দেয়।[103] কারবালার যুদ্ধকে প্রায়শই ইসলামে সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যকার চূড়ান্ত ভাঙন হিসেবে উদ্ধৃত করা হয় এবং প্রতি বছর আশুরার দিনে শিয়ারা এই ঘটনাকে স্মরণ করে থাকে।
দ্বাদশী ও ইসমাইলিসহ অধিকাংশ শিয়ারা পরবর্তীকালে ইমামি হয়ে পড়ে। ইমামি শিয়ারা বিশ্বাস করে যে ইমামগণ হলেন মুহম্মদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উত্তরসূরী। ইমামেরা হলেন সেইসব ব্যক্তিত্ব যাঁরা ন্যায়বিচারের সহিত সমাজ পরিচালনার পাশাপাশি ঐশী আইন জারি রাখতে এবং এর গূঢ় অর্থ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। মুহম্মদ ও ইমামদের কথা ও কাজ জনসমাজের জন্য অনুসরণীয় পথপ্রদর্শক ও আদর্শ; ফলে তাদের অবশ্যই ত্রুটি ও পাপমুক্ত হতে হবে এবং অবশ্যই মুহম্মদের মাধ্যমে ঐশী ফরমান বা নাস দ্বারা মনোনীত হতে হবে।[105][106]
এই মতাদর্শ অনুসারে, প্রত্যেক যুগের একজন ইমাম রয়েছেন, যিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও আইন সংক্রান্ত সকল বিষয়ে ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত কর্তৃপক্ষ। আলী ছিলেন এই পরম্পরার প্রথম ইমাম, মুহাম্মদের ন্যায্য উত্তরসূরী, এরপর তার কন্যা ফাতিমা ও আলীর বংশোদ্ভূত পুরুষদের মধ্য দিয়ে যা বহাল থেকেছিল।
আহলুল বাইত (নবীর পরিবার ও বংশধর) কিংবা খলিফা আবু বকরকে অনুসরণ করার এই পার্থক্যটি কোরআনের কিছু আয়াত, হাদিস (মুহাম্মদের কথা, কাজ ও সম্মতি) এবং ইসলামের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে শিয়া ও অ-শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিকে রূপ প্রদান করেছে৷ শিয়া মুসলমানদের দ্বারা অনুসৃত হাদিস সংগ্রহটি আহলে বাইতের সদস্য ও তাঁদের সমর্থকদের থেকে বর্ণিত হাদিসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে, আহলে বাইতের সদস্য বা সমর্থক নন এমন ব্যক্তিদের থেকে বর্ণিত হাদিস এর অন্তর্ভুক্ত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ইবিনে আসাকির তার তারিখ কবীর মুত্তাকি ও কানজুল উম্মার বিবরণীতে বলেছেন যে খলিফা উমর আবু হুরায়রাকে আঘাত ও তিরস্কার করেছিলেন এবং হাদিস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন। উমর বলেছিলেন: “যেহেতু আপনি মহানবী (স.)-এর নিকট থেকে বহু সংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন, আপনি তার প্রতি কেবল মিথ্যা আরোপের জন্যই উপযুক্ত (অর্থাৎ, আপনার মতো একজন ধূর্ত লোকের কাছ থেকে একজন নবী সম্পর্কে কেবল মিথ্যাই প্রত্যাশা করতে পারে)। সুতরাং, আপনাকে অবশ্যই হাদিস বর্ণনা করা বন্ধ করতে হবে; নইলে আমি আপনাকে দুস ভূমিতে (ইয়েমেনের একটি গোত্র যেখানে আবু হুরায়রা জন্মেছিলেন) পাঠিয়ে দেব।” সুন্নিদের মধ্যে আলী ছিলেন চতুর্থ খলিফা, অন্যদিকে শিয়াদের মতে আলী ছিলেন দৈবিকভাবে মনোনীত প্রথম ইমাম বা মুহম্মদের স্থলাভিষিক্ত। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কারবালার যুদ্ধে আলীর পুত্র হোসেনের শাহাদাতবরণ ছিল শিয়া ইতিহাসের একটি প্রভাববিস্তারকারী ঘটনা। হোসেন তৎকালীন বেপরোয়া খলিফা ইয়াজিদের বশ্যতা অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন এবং ৭১ জন অনুসারী সমতে শহীদ হন। দ্বাদশী ও ইসমাইলি শিয়া মতবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, নবী ও ইমামদের আত্মার উৎস ছিল আকল বা ঐশী প্রজ্ঞা যা তাঁদের হিকমত তথা গূঢ় জ্ঞান প্রদান করেছিল এবং তাঁদের কষ্টভোগ ছিল তাঁদের ভক্তদের জন্য ঐশী অনুগ্রহ লাভের একটি উপায়।[107][108] যদিও ইমামদের নিকট ওহী নাজিল হত না, তথাপি আল্লাহর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁদের নির্দেশনা দিতেন এবং ইমামগণ সে অনুযায়ী লোকেদের পথপ্রদর্শন করতেন। ইমামত বা ঐশী নেতৃত্বে বিশ্বাস দ্বাদশী ও ইসমাইলি শিয়া শাখার একটি বুনিয়াদি বিশ্বাস। আল্লাহ কখনও মানবতাকে ঐশী পথপ্রদর্শন থেকে বঞ্চিত করবেন না — এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ইমামত তত্ত্বটি দাঁড়িয়ে আছে।[109]
মাহদী হলেন ইসলামি ঐতিহ্যে ভবিষ্যদ্বাণীকৃত একজন মুক্তিদাতা যিনি কিয়ামতের পূর্বে সাত, নয় বা উনিশ বছর (ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা অনুসারে) শাসন করবেন এবং দুনিয়াকে মন্দতা থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার কায়েম করবেন।[110][111] হাদিসশাস্ত্র অনুসারে, মাহদীর শাসনামলটি নবী ঈসার দ্বিতীয় আগমনের সমকালীন হবে এবং ঈসা মাহদীকে মসীহ আদ-দজ্জালের (আক্ষরিক অর্থে “ভণ্ড মসীহ”) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করবেন। ঈসা দামেস্কের পূর্বপ্রান্তে একটি সাদা তোরণের পাদদেশে অবতরণ করবেন। তার পরনে থাকবে হলদে পোশাক আর মাথা থাকবে উদ্বর্তিত। এরপর তিনি মাহদীর সঙ্গে দজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেবেন, যেখানে মাহদী দজ্জালকে হত্যা করবেন এবং মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।[112] বৃহত্তম শিয়া গোষ্ঠী দ্বাদশীরা বিশ্বাস করে যে তাদের একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারীর পুত্র মুহম্মদ আল-মাহদীই হলেন প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী যিনি বর্তমানে অন্তর্ধানে রয়েছেন। দাঊদি বোহরাসহ তৈয়িবি ইসমাইলি শিয়ারা বিশ্বাস করে যে ইমাম আত-তৈয়িব আবুল কাসিমের বংশোদ্ভূত একজন ইমামই বর্তমান লুক্কায়িত ইমাম ও মাহদী।[113][114]
কারবালার যুদ্ধের পরবর্তী শতাব্দীতে (৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) বিভিন্ন শিয়া-অধিভুক্ত গোষ্ঠী উদীয়মান ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে শিয়া নেতৃত্ব বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি জাতি গড়ে ওঠে।[115]
পারস্যে সাফাভীয় সাম্রাজ্যের শাসন (১৫০১–১৭৩৬) ছিল শিয়া ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে কয়েকটি বড় পরিবর্তন সাধিত হয়:
সাফাভি সাম্রাজ্যের পতনের পর পারস্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা—সরকারের নিযুক্ত বিচারকদের (কাজী) নিয়ে তৈরি আদালত ব্যবস্থাসহ—অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি মুজতাহিদদের নিয়ে গঠিত শরীয়া আদালতগুলোকে আইনি শূন্যতা পূরণের সুযোগ দেয় এবং উলামাদের তাঁদের বিচারিক কর্তৃত্ব আরোপ করতে সক্ষম করে। এই সময় উসুলি চিন্তাধারা শক্তিবৃদ্ধি করে।[126]
শিয়াবাদ ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা, যা সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ১০–১৫% কর্তৃক অনুসৃত হয়,[13] এটি বিস্তৃত এবং বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপগোষ্ঠী এর অন্তর্ভুক্ত।[16] মুসলিম বিশ্বে শিয়া ইসলাম ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রণালী ধারণ করে।[127][128] আদি শিয়া আত্মপরিচয়টি ইমাম আলীর অনুসারীদের উপর প্রযুক্ত হত[129] এবং শিয়া ধর্মতত্ত্ব হিজরতের পরে (অষ্টম শতাব্দীতে) সূত্রবদ্ধ হয়েছিল।[130] প্রারম্ভিক শিয়া সরকার ও সমাজগুলো খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামি অধ্যয়নের পণ্ডিত লুই মাসিনিওঁ দশম শতাব্দীকে “ইসলামের ইতিহাসে শিয়া ইসমাইলি শতাব্দী” বলে আখ্যায়িত করেছেন।[131]
ইসলামের শাহাদা তথা বিশ্বাসের ঘোষণার শিয়া সংস্করণটি সুন্নি সংস্করণ থেকে কিছুটা আলাদা। সুন্নি শাহাদাতে বলা হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ হলেন আল্লাহর রাসূল”। শিয়ারা এর সঙ্গে একটি অতিরিক্ত বাক্য “আলীউন ওয়ালীউল্লাহ” (علي ولي الله) সংযোজন করে যার অর্থ “আলী হলেন আল্লাহর ওয়ালি”। আলীকে আল্লাহর “ওয়ালি” গণ্য করার এই শিয়া বিশ্বাসটির ভিত্তি হিসেবে কোরআনের সূরা আল-মায়িদাহর ৫৫নং আয়াতটি (বেলায়েতের আয়াত) উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে।[132]
বিশ্বাসের ঘোষণায় এই অতিরিক্ত বাক্যটি মুহম্মদের পরিবার ও বংশধারার মধ্য দিয়ে কর্তৃত্বের উত্তরাধিকারের উপর শিয়া গুরুত্বারোপকে বহন করে। এভাবে শিয়া শাহাদার তিনটি বাক্য যথাক্রমে তাওহিদ (আল্লাহর একত্ব), নবুয়াত (মুহম্মদের নবীত্ব) ও ইমামতকে (আলীর অবিভাবকত্ব) সম্ভাষণ করে।
ইসমাহ হল ইসলামে অভ্রান্ততা বা ত্রুটি ও পাপমুক্ত থাকার স্রষ্টাপ্রদত্ত স্বাধীনতার ধারণা।[133] মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে মুহাম্মদ এবং ইসলামের অন্যান্য নবীগণ ইসমাহর অধিকারী। দ্বাদশী ও ইসমাইলি শিয়া মুসলমানেরা এই বৈশিষ্ট্যটিকে ইমামগণ ও নবীকন্যা ফাতিমার ওপরও আরোপ করে থাকে। অন্যদিকে জায়েদি শিয়ারা তাদের ইমামদের ওপর ইসমাহ আরোপ করে না।[134] প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হওয়া সত্ত্বেও ইমামদের অভ্রান্ততা ও পাপহীনতা পরবর্তীকালে শিয়া (অ-জায়েদি) মতবাদের একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাসরূপে বিকশিত হয়।[135]
শিয়া ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, অভ্রান্ততা আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় দিকনির্দেশনার জন্য একটি যৌক্তিক অপরিহার্য পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। তারা যুক্তি দেন যে, যেহেতু আল্লাহ এই ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে পরম আনুগত্যের হুকুম দিয়েছেন, অবশ্যই তাঁদের কেবল সঠিক আদেশ দিতে হবে। আহল আল-বাইতের অভ্রান্ততার মর্যাদাটি কোরআনের শুদ্ধির আয়াতের (সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াত) শিয়া ব্যাখার ওপর নির্ভরশীল।[136][137] সুতরাং, তারা সর্বাধিক বিশুদ্ধ এবং সর্বপ্রকার অশুচি থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ নিষ্কলঙ্ক ব্যক্তিগণ।[138] এর অর্থ এই নয় যে অতিপ্রাকৃত শক্তি তাঁদের পাপকাজ করতে বাধা দেয়, বরং আল্লাহর প্রতি তাদের নিখুঁত বিশ্বাস থাকার কারণে তারা যেকোনো প্রকার পাপকর্ম থেকে বিরত থাকেন।[139]
আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কেও তাঁদের পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে। তারা ফেরেশতাদের দ্বারা নবী ও রসুলদের নিকট আনিত সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী। তাঁদের জ্ঞান সর্বকালের সামগ্রিকতাকে ঘিরে থাকে। ফলে তারা ধর্মীয় বিষয়ে ত্রুটিহীনভাবে কাজ করেন।[140] শিয়ারা আলীকে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনার পাশাপাশি ইসলামি অনুশীলন ও এর গূঢ় অর্থ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম মুহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বিবেচনা করে। সুতরাং তাঁকে ত্রুটি ও পাপ থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ কর্তৃক ঐশী ফরমান (নাস) দ্বারা নিযুক্ত প্রথম ইমাম হিসেবে গণ্য করা হয়।[141] শিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে আলীকে মুহাম্মদের ন্যায় “পূর্ণাঙ্গ মানব” (আল-ইনসান আল-কামিল) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[142]
অন্তর্ধান বা সমাবরণ হল শিয়া ইসলামের কিছু উপদলের একটি বিশ্বাস যে একজন ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা ব্যক্তিত্ব, মাহদী নামে পরিচিত একজন গুপ্ত ইমাম, একদিন ফিরে আসবেন এবং বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। দ্বাদশী শিয়া ঐতিহ্য অনুসারে মাহদীর মূল লক্ষ্য হবে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং নবী মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ ইসলামি আইন প্রয়োগ করা। দ্বাদশীরা বিশ্বাস করে যে তাদের একাদশ ইমাম হাসান আল-আসকারীর পুত্র মুহম্মদ আল-মাহদীই হলেন প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী। পবিত্র কোরআনে ইমাম মাহদী সংক্রান্ত কোনো আয়াত নেই, তবে হাদিসে তার উল্লেখ রয়েছে। ইমাম মাহদীর অন্তর্ধান শিয়া ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস।[143]
কিছু শিয়া গোষ্ঠী, যেমন জায়েদি ও নিজারি ইসমাইলিরা, অন্তর্ধান ধারণাটিতে বিশ্বাস করে না। যে দলগুলো এটি বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে ইমামতের কোন কোন বংশধারাটি বৈধ এবং কোন ব্যক্তি অন্তর্ধানে গেছেন সে বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে যে বহু লক্ষণ রয়েছে যা তাঁর ফিরে আসার সময়কে ইঙ্গিত করবে।
দ্বাদশী শিয়া মুসলমানেরা বিশ্বাস করে যে দ্বাদশ ইমাম (মুহম্মদ আল-মাহদী) তথা প্রতিশ্রুত মাহদী ইতোমধ্যে পৃথিবীতে বিরাজ করছেন, বর্তমানে অন্তর্ধানে আছেন এবং শেষ জমানায় আবির্ভূত হবেন। ফাতিমীয়, বোহরা ও দাঊদি বোহরারা একই বিশ্বাস তাদের একবিংশ তৈয়িব আবুল কাসিম আত-তৈয়িবের প্রতি ধারণ করে এবং এও বিশ্বাস করে যে, একজন দা'ঈ আল-মুতলক (অবাধ ধর্মপ্রচারক) মাহদীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। অন্যদিকে সুন্নিরা বিশ্বাস করে যে মাহদী এখনও জন্মগ্রহণ করেননি এবং শেষ জমানায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন।[144]
শিয়ারা বিশ্বাস করে যে আলী ও আহলে বাইতের মর্যাদা এবং অন্যান্য সাহাবিদের উপর তাদের অগ্রাধিকার অসংখ্য হাদিস দ্বারা সমর্থিত, যেমন: গাদীর খুমের হাদিস, দুটি ভারী বস্তুর হাদিস, চাদরের হাদিস, কলম ও কাগজের হাদিস, নিকটাত্মীয়দের সতর্কীকরণের হাদিস, বারো খলিফার হাদিস ইত্যাদি। বিশেষত আহল আল-কিসার হাদিসটি প্রায়ই সুন্নি ও শিয়া উভয় সম্প্রদায়ের পণ্ডিতদের দ্বারা আলী ও তার পরিবারের প্রতি মুহম্মদের ভাবাবেগ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শিয়ারা আহল আল-বাইত এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহচরদের থেকে বর্ণিত হাদিসসমূহকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসনা আশারিয়ারা সুন্নিদের প্রসিদ্ধ হাদিস সংকলন কুতুব আল-সিত্তাহের বিপরীতে তাদের নিজস্ব সংকলন কুতুব আল-আরবাহ ব্যবহার করে।[145][146] এর অন্তর্ভুক্ত চারটি হাদিস গ্রন্থ রয়েছে:
নাম | সংগ্রাহক | হাদিস সংখ্যা |
---|---|---|
কিতাব আল-কাফী | মুহম্মদ ইবনে ইয়াকুব আল-কুলায়নী | ১৬,১৯৯ |
মান লা ইয়াহদুরুহু আল-ফকীহ | শেখ সদুক | ৯,০৪৪ |
তহজীব আল-আহকাম | শেখ তুসী | ১৩,৫৯০ |
আল-ইস্তিবসার | শেখ তুসী | ৫,৫১১ |
শিয়ারা বিশ্বাস করে যে মুহাম্মদসহ সকল নবীর হাতিয়ার ও পবিত্র জিনিসপত্র আহল আল-বাইতের ইমামদের নিকট ক্রমান্বয়ে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিতাব আল-কাফিতে ইমাম জাফর আল-সাদিক উল্লেখ করেছেন যে, “আমার কাছে আল্লাহর রাসূলের অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। এটি তর্কাতীত।”[147]
তিনি আরও দাবি করেন যে তার কাছে আল্লাহর রসুলের তলোয়ার, কুলচিহ্ন, লামাম (ধ্বজা) এবং ও শিরোস্ত্রাণ রয়েছে। এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন যে তার কাছে রয়েছে আল্লাহর রসুলের বিজয়ী পতাকা। তার কাছে আছে মুসার লাঠি, দাউদপুত্র সুলায়মানের আংটি এবং সেই বারকোশ যাতে মুসা তার নৈবেদ্য নিবেদন করতেন। তার কাছে রয়েছে সেই নাম যেটি আল্লাহর রসুল যখনই মুসলমান ও পৌত্তলিকদের মাঝে স্থাপন করতেন তখন পৌত্তলিকদের দিক থেকে কোনো তীর মুসলমানদের কাছে এসে পৌঁছত না। তার কাছে একই জিনিস রয়েছে যা ফেরেশতারা নিয়ে এসেছিলেন।[147]
আল-সাদিক আরও বর্ণনা করেন যে, হাতিয়ার হস্তান্তর করা ইমামত (নেতৃত্ব) প্রাপ্তির সমার্থক, ঠিক যেমন ইস্রায়েলীয়দের গৃহে পবিত্র সিন্দুকটি নবুওতকে ইঙ্গিত করেছিল।[147]
ইমাম আলি আল রিদা বর্ণনা করেন যে, “আমাদের মধ্যে যার কাছেই অস্ত্রশস্ত্র যাবে, জ্ঞানও তাকে অনুসরণ করবে এবং জ্ঞানসম্পন্ন (ইমাম) ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র কখনোই বিচ্যুত হবে না।”[147]
আল্লামা মুজফফরের মতে, আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির অনুষদ প্রদান করেছেন। এছাড়াও তিনি মানুষকে তার সৃষ্টির বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তিনি সমস্ত সৃষ্টিকে তার শক্তি ও মহিমার নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই নিদর্শনগুলি সমস্ত মহাবিশ্বকে ঘিরে আছে। অধিকন্তু, ছোট্ট বিশ্ব হিসেবে পৃথিবীতে মানবজাতি এবং বৃহৎ বিশ্ব হিসেবে মহাবিশ্বের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। যারা চিন্তাহীনভাবে কেবল অনুকরণের মাধ্যমে আল্লাহর উপাসনা করে, তিনি তাঁদের প্রার্থনা গ্রহণ করেন না, বরং তাদের এহেন কাজের জন্য দোষারোপ করেন। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষকে খোদাপ্রদত্ত যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির অনুষদ দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে বলা হয়েছে। শিয়া চিন্তাধারায় বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষদের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়।[148][149]
শিয়া চিন্তাধারায় দোয়ার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে, কেননা নবী মুহাম্মদ এটিকে বিশ্বাসীর অস্ত্র হিসাবে বর্ণনা করেছেন। বাস্তবিকই দোয়া শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। শিয়াদের মধ্যে দোয়া সম্পাদন করার বিশেষ আচরণবিধি রয়েছে। এ কারণে শিয়াদের মাঝে দোয়া পাঠের শর্তাবলি সংক্রান্ত অসংখ্য বই লেখা হয়েছে। বেশিরভাগ দোয়া মুহাম্মদের পরিবার থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে বহু গ্রন্থ সম্পাদিত হয়েছে। শিয়া নেতৃত্ব সর্বদা এর অনুসারীদের দোয়া পাঠে উদ্বুদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আলী ইবনে আবী তালিব দোয়া বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন।[150][151]
শিয়াদের ধর্মচর্চা, যেমন নামাজ, সুন্নিদের থেকে খানিকটা আলাদা। সুন্নি মুসলমানরা যেখানে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, শিয়াদের কাছে যোহরের নামাজের সাথে আসরের নামাজ এবং মাগরিবের নামাজের সাথে এশার নামাজ সমন্বিতভাবে পড়ে ফেলার বিকল্প রয়েছে, কারণ কোরআনে তিনটি পৃথক সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্নিরা কেবল কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নামাজের এরকম সমন্বয় করে থাকে।[152][153]
শিয়ারা নিম্নলিখিত বার্ষিক পবিত্র দিনসমূহ উদ্যাপন করে:
মুসলমানদের নিকট তিনটি পবিত্রতম স্থান হল মক্কা (মসজিদ আল-হারাম), মদিনা (মসজিদে নববী) ও কুদস (আল-আকসা মসজিদ)। এর পাশাপাশি শিয়া মুসলমানদের কাছে নাজাফ (ইমাম আলী মসজিদ), কারবালা (ইমাম হোসাইনের মাজার) ও কুফা (মসজিদ আল-কুফা) অত্যন্ত সম্মানিত স্থান।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানগুলির মধ্যে রয়েছে নাজাফের ওয়াদিউস সালাম কবরস্থান, মদিনার আল-বাকী কবরস্থান, মাশহাদের ইমাম রেজার মাজার, কাজিমিয়ার আল কাজিমিয়া মসজিদ, সামারার আল-আসকারী মসজিদ, কুফার মহামসজিদ ও সাহলা মসজিদ এবং কোম, সুসা ও দামেস্কের বেশ কয়েকটি স্থান।
সৌদি আরবের বেশিরভাগ শিয়া তীর্থস্থানগুলো ইখওয়ান যোদ্ধাদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এর মধ্যে ১৯২৫ সালে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে ইমামদের সমাধিসমূহ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।[158] ২০০৬ সালে একটি বোমা হামলায় আল-আসকারী মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যায়।[159]
শিয়া মুসলমানদের মতে, শিয়া জনসংখ্যার অনুমানের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হল শিয়া যদি কোনো মুসলিম দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু না হয়ে থাকে তাহলে সমগ্র জনসংখ্যাকে প্রায়শই সুন্নি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এর বিপরীতে নির্ভরযোগ্য কোনো জরিপ পরিচালনা করা হয়নি যা প্রতিটি সম্প্রদায়ের আকারের যথাযথ অনুমানের অবদান রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৬ সালে আরব উপদ্বীপে আল সৌদের উত্থান শিয়াদের বিরুদ্ধে সরকারি বৈষম্য নিয়ে আসে।[161] দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জনসংখ্যার ২১% শিয়া বলে ধারণা করা হয়, যদিও এই একই কারণে মোট সংখ্যাটি অনুমান করা মুশকিল।[162] ধারণা করা হয় যে মুসলিম বিশ্বের ১৫% হল শিয়া।[163][164][165][166] ২০০৯ সালের এক জরিপমতে বিশ্বে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা ২০০ মিলিয়নের অধিক।[165]
শিয়ারা আজারবাইজান, বাহরাইন, ইরান ও ইরাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী,[167][168] এছাড়া লেবাননে তারা সুন্নি মুসলমান ও মারোনীয় খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি অন্যতম সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। শিয়ারা মধ্যপ্রাচ্যের মোট জনসংখ্যার ৩৬.৩% এবং মুসলিম সংখ্যার ৩৮.৬%।[169]
শিয়া মুসলমানেরা লেবাননের জনসংখ্যার ২৭–৩৫%, ইয়েমেনের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% থেকে ৪০%,[167][170][171] কুয়েতের নাগরিক জনসংখ্যার ৩০–৩৫% (অনাগরিক জনসংখ্যার কোনো হিসেব নেই),[172][173] তুরস্কের জনসংখ্যার ২০% এর অধিক,[165][174] পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫–২০%[175][165] এবং আফগানিস্তানের জনসংখ্যার ১০–১৯%।[176][177]
সউদি আরবে একাধিক স্বতন্ত্র শিয়া সম্প্রদায়ের উপস্থিতি রয়েছে, যাদের মধ্যে পূর্ব প্রদেশের দ্বাদশী বাহরানা, মদিনার নাখাবিলা এবং নাজরানের ইসমাইলি সুলায়মানি ও জায়েদি সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। প্রাক্কলন অনুসারে সউদি আরবে শিয়া নাগরিকদের সংখ্যা ২–৪ মিলিয়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা স্থানীয় জনসংখ্যার প্রায় ১৫%।[178] [ভাল উৎস প্রয়োজন]
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রার উপকূলবর্তী অঞ্চলে এবং আচেহ প্রদেশে উল্লেখযোগ্য শিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে।[179] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যত্র শিয়াদের উপস্থিতি নগন্য, যেখানে মুসলমানেরা মূলত শাফিঈ সুন্নি।
নাইজেরিয়াতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়া সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিদ্যমান, যা আধুনিককালে কানো ও সোকোটো রাজ্যকেন্দ্রিক শিয়া আন্দোলনের ফলস্বরূপ।[165][166][180] আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে, যেমন: কেনিয়া,[181] দক্ষিণ আফ্রিকা,[182] সোমালিয়া[183] ইত্যাদিতে বিভিন্ন শিয়া উপদলের ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি রয়েছে। এরা মূলত ঔপনিবেশিক আমলে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের বংশধরগণ, যেমন: খোজা সম্প্রদায়।[184]
নিম্নোক্ত প্রথম তিনটি কলামে নির্দেশিত পরিসংখ্যানগুলো পিউ গবেষণা কেন্দ্রের ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের জনমিতিক গবেষণাপত্র ম্যাপিং দ্য গ্লোবাল মুসলিম পপুলেশনের ওপর ভিত্তি করে প্রদর্শন করা হয়েছে।[165][166]
দেশ | নিবন্ধ | ২০০৯ সালে শিয়া জনসংখ্যা[165][166] | ২০০৯ সালে শিয়া জনসংখ্যার শতকরা হার[165][166] | ২০০৯ সালে বৈশ্বিক শিয়া জনসংখ্যার শতকরা হার[165][166] | আদমশুমারি ও টীকা |
---|---|---|---|---|---|
ইরান | ইরানে শিয়া ইসলাম | ৬৬,০০০,০০০–৭০,০০০,০০০ | ৯০–৯৫ | ৩৭–৪০ | |
পাকিস্তান | ভারতীয় উপমহাদেশে শিয়া ইসলাম | ১৭,০০০,০০০–২৬,০০০,০০০ | ১০–১৫ | ১০–১৫ | ২০১০ সালের একটি জরিপমতে পাকিস্তানের জনসংখ্যার ১০–১৫% শিয়া মুসলমান।[185] |
ভারত | ভারতীয় উপমহাদেশে শিয়া ইসলাম | ১৬,০০০,০০০–২৪,০০০,০০০ | ১০–১৫ | ৯–১৪ | |
ইরাক | ইরাকে শিয়া ইসলাম | ১৯,০০০,০০০–২২,০০০,০০০ | ৬৫–৭০ | ১১–১২ | |
ইয়েমেন | ইয়েমেনে শিয়া ইসলাম | ৮,০০০,০০০–১০,০০০,০০০ | ৩৫–৪০ | ~৫ | |
তুরস্ক | তুরস্কে শিয়া ইসলাম | ৭,০০০,০০০–১১,০০০,০০০ | ১০–১৫ | ৪–৬ | |
আজারবাইজান | আজারবাইজানে শিয়া ইসলাম | ৫,০০০,০০০–৭,০০০,০০০ | ৬৫–৭৫ | ৩–৪ | আজারবাইজান অন্যতম শিয়াপ্রধান দেশ।[186][187] ২০০৪ সালের একটি জরিপমতে আজারবাইজানের জনসংখ্যার ৬৫% শিয়া, অন্যদিকে ২০১৩ সালের আরেকটি জরিপমতে ৫৫% শিয়া।[188] ২০১২ সালের একটি জরিপ মোতাবেক আজারবাইজানের ১০% লোক নিজেদের সুন্নি হিসেবে, ৩০% লোক শিয়া হিসেবে এবং বাকি মুসলমানেরা নিজেদের কেবল মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন।[188] |
আফগানিস্তান | আফগানিস্তানে শিয়া ইসলাম | ৩,০০০,০০০–৪,০০০,০০০ | ১০–১৫ | ~২ | কয়েক দশক ধরে আফগানিস্তানে কোনো জরিপ বা আদমশুমারি পরিচালিত হয়নি, তবে ধারণা করা হয় আফগান জনসংখ্যার ২০% শিয়া মুসলমান, এদের অধিকাংশই তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠীর লোক।[189] |
সিরিয়া | সিরিয়ায় শিয়া ইসলাম | ৩,০০০,০০০–৪,০০০,০০০ | ১৫–২০ | ~২ | |
সউদি আরব | সউদি আরবে শিয়া ইসলাম | ২,০০০,০০০–৪,০০০,০০০ | ১০–১৫ | ১–২ | |
নাইজেরিয়া | নাইজেরিয়ায় শিয়া ইসলাম | <৪,০০০,০০০ | <৫ | <২ | জরিপমতে নাইজেরিয়ার মুসলমানদের ২% থেকে ১৭% শিয়া।[lower-alpha 3] নাইজেরীয় শিয়াদের অনেকে ইব্রাহীম জাকজাকির নেতৃত্বাধীন ইরানপ্রভাবিত ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।[190] |
বাংলাদেশ | বাংলাদেশে শিয়া ইসলাম | ৪০,০০০–৫০,০০০ | <১ | <১ | |
লেবানন | লেবাননে শিয়া ইসলাম | ১,০০০,০০০–২,০০০,০০০ | ৪৫–৫৫ | <১ | সাম্প্রতিক কোনো সরকারি আদমশুমারি হয়নি।[192] তবে ধারণা করা হয় লেবাননের মুসলমানদের ৫০–৫৫% শিয়া।[193][194][195] |
তানজানিয়া | তানজানিয়ায় শিয়া ইসলাম | <২,০০০,০০০ | <১০ | <১ | |
কুয়েত | কুয়েতে শিয়া ইসলাম | ৫০০,০০০–৭০০,০০০ | ২০–২৫ | <১ | কুয়েতের ১.৪ মিলিয়ন নাগরিকদের ৩০% শিয়া (ইসমাইলিসহ)। কুয়েতে বসবাসরত ৩.৩ মিলিয়ন অনাগরিকদের ৫% শিয়া।[196] |
জার্মানি | জার্মানিতে শিয়া ইসলাম | ৪০০,০০০–৬০০,০০০ | ১০–১৫ | <১ | |
বাহরাইন | বাহরাইনে শিয়া ইসলাম | ৪০০,০০০–৫০০,০০০ | ৬৫–৭০ | <১ | |
তাজিকিস্তান | তাজিকিস্তানে শিয়া ইসলাম | ~৪০০,০০০ | ~৭ | ~১ | |
সংযুক্ত আরব আমিরাত | সংযুক্ত আরব আমিরাতে শিয়া ইসলাম | ৩০০,০০০–৪০০,০০০ | ১০ | <১ | |
যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্রে শিয়া ইসলাম | ২০০,০০০–৪০০,০০০ | ১০–১৫ | <১ | |
ওমান | ওমানে শিয়া ইসলাম | ১০০,০০০–৩০০,০০০ | ৫–১০ | <১ | ২০১৫ সাল নাগাদ ওমানের ৫% জনগণ শিয়া (৫০% ইবাদি ও ৪৫% সুন্নি)।[197] |
যুক্তরাজ্য | যুক্তরাজ্যে শিয়া ইসলাম | ১০০,০০০–৩০০,০০০ | ১০–১৫ | <১ | |
কাতার | কাতারে শিয়া ইসলাম | ~১০০,০০০ | ~১০ | <১ |
শিয়া সম্প্রদায় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইমামত ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শাখা বা উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৃহত্তম শাখাটি হল ইসনা আশারিয়া বা দ্বাদশী, এরপরই আছে জায়েদি ও ইসমাইলি। তিনটি দলই ইমামতের ভিন্ন ভিন্ন ধারা অনুসরণ করে।[198][199][200]
ইসনা আশারিয়া বা দ্বাদশী শিয়া হল শিয়া ইসলামের বৃহত্তম শাখা এবং শিয়া মুসলমান পরিভাষাটি প্রায়শই ইসনা আশারিয়াদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ইসনা আশারিয়া বা দ্বাদশী অভিধাটি ঐশ্বরিকভাবে মনোনীত দ্বাদশ নেতা তথা বারো ইমামে বিশ্বাস সংক্রান্ত তত্ত্ব থেকে গৃহীত হয়েছে। ইসনা আশারিয়া শিয়াদের ইমামি বা জাফরি নামেও অবিহিত করা হয়। জাফরি শব্দটি ইমাম জাফর আস-সাদিকের নাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে যিনি দ্বাদশী ফিকহশাস্ত্রকে সম্প্রসারণ করেছিলেন।[201]
ইসনা আশারিয়ারা ইরান (৯০%),[202] আজারবাইজান (৮৫%),[16][203] বাহরাইন (৭০%) ও ইরাকের (৬৫%) সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং লেবাননের (৩২%) অন্যতম সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী।[204][205][206]
ইসনা আশারিয়া ধর্মতত্ত্ব পাঁচটি নীতির উপর নির্ভরশীল।[207] এই পঞ্চনীতিকে উসুল আদ-দীন বলা হয় যেগুলো নিম্নরূপ:[208][209]
আরও নির্দিষ্টভাবে দ্বাদশীরা এই নীতিমালাকে উসুল আল-মাজহাব (শিয়া মাজহাবের নীতিমালা) নামে অবিহিত করে। এর মাধ্যমে তারা একে জরুরিয়ত আদ-দীন (ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা) থেকে পৃথকীকরণ করে যা মূলত একজন ব্যক্তির মুসলমান হওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। ইমামত বা ঐশী নেতৃত্ব জরুরিয়ত আদ-দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, কারণ এটি একজন ব্যক্তির মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতিলাভের ক্ষেত্রে আবশ্যক নয়। আয়াতুল্লাহ আবুল কাসিম আল-খোয়ীর মতো দ্বাদশী শিয়া পণ্ডিতদের মতে তওহীদ, ফেরেশতাকুল, আসমানী কিতাব, নবুয়ত, আখিরাত, তকদীর প্রভৃতিতে বিশ্বাস স্থাপন জরুরিয়ত আদ-দীনের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে দ্বাদশী শিয়ারা একদিকে ইসলামের মূল নীতিমালায় বিশ্বাস এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট শিয়া নীতিতে বিশ্বাসের মাধ্যমে একটি পার্থক্যের চিত্র তুলে ধরে।[210]
কোরআনের পাশাপাশি ইসনা আশারিয়া শিয়ারা হাদিস থেকেও দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে থাকে। তারা নবী মুহাম্মদ এবং বারো ইমামের কথা ও কাজকে হাদিস হিসেবে বিবেচনা করে। ইসনা আশারিয়ারা আহল আল-বাইত এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহচরদের কাছ থেকে বর্ণিত হাদিসসমূহকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কুতুব আল-আরবাহ নামক হাদিস সংকলনটি তাদের কাছে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।[211][212] এই সংকলনটি নিম্নোক্ত চারটি গ্রন্থের সমন্বয়ে গঠিত:
নাম | সংগ্রাহক | হাদিস সংখ্যা |
---|---|---|
কিতাব আল-কাফী[213] | মুহম্মদ ইবনে ইয়াকুব আল-কুলায়নী | ১৬,১৯৯ |
মান লা ইয়াহদুরুহু আল-ফকীহ | শেখ সদুক | ৯,০৪৪ |
তহজীব আল-আহকাম | শেখ তুসী | ১৩,৫৯০ |
আল-ইস্তিবসার | শেখ তুসী | ৫,৫১১ |
ইসনা আশারিয়াদের মতে বারো ইমাম হলেন মুহম্মদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক উত্তরসূরি। ইসনা আশারিয়া ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী মুহম্মদের উত্তরাধিকারী ইমামগণ হলেন নিষ্পাপ ও অভ্রান্ত যাঁরা ন্যায়বিচারের সাথে সমাজ পরিচালনার পাশাপাশি শরীয়ত এবং কুরআনের গূঢ় অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। মুহম্মদ ও ইমামদের কথা ও কাজ হল উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় দিকনির্দেশনা এবং আদর্শ; কাজেই তাদের অবশ্যই ত্রুটি ও পাপ থেকে মুক্ত থাকা জরুরি এবং ইমামগণ অবশ্যই মুহম্মদ কর্তৃক ঐশী ফরমান তথা নাস দ্বারা মনোনীত হতে হবেন।[105][106]
ক্রম | ইসলামি চারুলিপি | নাম কুনিয়া | আরবি উপাধি তুর্কি উপাধি[214] !! জীবনকাল (খ্রিস্টাব্দ) জীবনকাল (হিজরি)[215] জন্মস্থান |
ইমামত গ্রহণকালে বয়স | মৃত্যুকালে বয়স | ইমামতকাল | গুরুত্ব | মৃত্যুর কারণ ও মৃত্যুস্থল সমাধি[216] | |
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১ | ʿআলী ʾইবনে ʾআবী ত়ালিব ٱلْإِمَام عَلِيّ ٱبْن أَبِي طَالِب عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবুল হ়াসান أَبُو ٱلْحَسَن |
|
৬০০–৬৬১[217]
২৩ হিজরতপূর্ব–৪০[224] মক্কা, হেজাজ[217] |
৩৩ বছর | ৬১ বছর | ২৮ বছর | মুহম্মদের ﷺ চাচাতো ভাই ও জামাতা। শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবার অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণকারী একমাত্র ব্যক্তি এবং প্রথম ইসলামগ্রহণকারী পুরুষ। শিয়া মুসলমানেরা তাঁকে মুহম্মদের ﷺ একমাত্র ন্যায্য স্থলাভিষিক্ত এবং প্রথম ইমাম হিসেবে বিবেচনা করে। সুন্নি মুসলমানেরা তাঁকে চতুর্থ রাশিদুন খলিফা হিসেবে গণ্য করে। সুফিবাদের প্রায় সকল তরিকায় তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়; তরিকাসমূহের সদস্যগণ মুহম্মদ ﷺ পর্যন্ত তাদের সিলসিলা আলীর মাধ্যমে জারি রাখেন।[217] | রমজান মাসে মসজিদ আল-কুফায় নামাজে সেজদারত অবস্থায় আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম নামক এক খারিজি গুপ্তঘাতকের বিষাক্ত তরবারির আঘাতে আহত হয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।[217][225] শিয়া বিশ্বাসমতে তাঁকে ইরাকের নাজাফ শহরের ইমাম আলী মসজিদে দাফন করা হয়। | |
২ | হ়াসান ʾইবনে ʿআলী ٱلْإِمَام ٱلْحَسَن ٱبْن عَلِيّ عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু মুহ়ম্মদ أَبُو مُحَمَّد |
|
৬২৫–৬৭০[228]
৩–৫০[229] মদীনা, হেজাজ[228] |
৩৯ বছর | ৪৭ বছর | ৮ বছর | তিনি ছিলেন মুহম্মদের ﷺ কন্যা ফাতিমার গর্ভজাত দৌহিত্রদের মধ্যে সবার বড়। হাসান কুফায় তাঁর পিতা আলীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত হন। সাত মাস খলিফা হিসেবে দায়িত্বপালনের পর মুয়াবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে তিনি পদত্যাগ করেন।[228] | মুয়াবিয়ার প্ররোচনায় স্বীয় স্ত্রীর মাধ্যমে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়।[230] তাঁকে মদীনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। | |
৩ | হ়োসাইন ʾইবনে ʿআলী ٱلْإِمَام ٱلْحُسَيْن ٱبْن عَلِيّ عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু ʿআব্দুল্লাহ أَبُو عَبْد ٱللَّٰه |
|
৬২৬–৬৮০[235]
৪–৬১[236] মদীনা, হেজাজ[235] |
৪৬ বছর | ৫৭ বছর | ১১ বছর | তিনি ছিলেন মুহম্মদের ﷺ দৌহিত্র, আলীর পুত্র এবং হাসানের ভাই। হোসাইন উমাইয়া শাসক ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার দুঃশাসনের বিরোধিতা করেন। ফলস্রুতিতে তিনি, তাঁর পরিবার ও সহচারীরা কারবালার যুদ্ধে ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনার পর থেকে হোসাইনের শাহাদতের স্মৃতিচারণ শিয়া আত্মপরিচয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে।[235] | কারবালার যুদ্ধে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। তাঁকে ইরাকের কারবালার ইমাম হোসেনের মাজারে দাফন করা হয়।[235] | |
৪ | ʿআলী ʾইবনে হ়োসাইন ٱلْإِمَام عَلِيّ ٱبْن ٱلْحُسَيْن ٱلسَّجَّاد عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু মুহ়ম্মদ أَبُو مُحَمَّد |
|
৬৫৮/৬৫৯[237] – ৭১২[238]
৩৮[237]–৯৫[238] মদীনা, হেজাজ[237] |
২৩ বছর | ৫৭ বছর | ৩৪ বছর | সহিফা আস-সাজ্জাদিয়ার রচয়িতা, যা আহল আল-বাইতের স্তোত্র হিসেবে পরিচিত।[238] দুর্বলতাজনিত অসুস্থতার কারণে কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। | উমাইয়া খলিফা প্রথম আল-ওয়াহিদের নির্দেশে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।[238] মদীনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়। | |
৫ | মুহ়ম্মদ ʾইবনে ʿআলী ٱلْإِمَام مُحَمَّد ٱبْن عَلِيّ ٱلْبَاقِر عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু জাʿফর أَبُو جَعْفَر |
|
৬৭৭–৭৩২[239]
৫৭–১১৪[239] মদীনা, হেজাজ[239] |
৩৮ বছর | ৫৭ বছর | ১৯ বছর | সুন্নি ও শিয়া উভয় সূত্রমতে তিনি অন্যতম প্রাচীন ও বিশিষ্ট ফিকহশাস্ত্রবিদ ছিলেন যিনি তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন।[239][240] | উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের নির্দেশে ইব্রাহীম ইবনে ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল্লাহ কর্তৃক বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়।[238] মদীনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে দাফন করা হয়। | |
৬ | জাʿফর ʾইবনে মুহ়ম্মদ ٱلْإِمَام جَعْفَر ٱبْن مُحَمَّد ٱلصَّادِق عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু ʿআব্দুল্লাহ[241] أَبُو عَبْد ٱللَّٰه |
|
৭০২–৭৬৫[242]
৮৩–১৪৮[242] মদীনা, হেজাজ[242] |
৩১ বছর | ৬৫ বছর | ৩৪ বছর | শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি জাফরি মাজহাব এবং দ্বাদশী ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য পণ্ডিতদের শিক্ষাদান করেছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ফিকহশাস্ত্রে আবু হানিফা ও মালিক ইবনে আনাস, কালামশাস্ত্রে ওয়াসিল ইবনে আতা ও হিশাম ইবনে হাকাম, এবং বিজ্ঞান ও আলকেমিতে জাবির ইবনে হাইয়ান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[242] | আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নির্দেশে মদীনায় বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়।[242] তাঁকে মদীনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। | |
৭ | মুসা ʾইবনে জাʿফর ٱلْإِمَام مُوسَىٰ ٱبْن جَعْفَر ٱلْكَاظِم عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবুল হ়াসান أَبُو ٱلْحَسَن ٱلْأَوَّل[243] |
|
৭৪৪–৭৯৯[244]
১২৮–১৮৩[244] আল-আবওয়াʿ, হেজাজ[244] |
২০ বছর | ৫৫ বছর | ৩৫ বছর | তিনি জাফর আস-সাদিকের মৃত্যুর পর ইসমাইলি ও ওয়াকিফি বিচ্ছেদকালীন শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন।[245] তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও বৃহত্তর খোরাসানের শিয়া মতাবলম্বীদের কাছ থেকে খুমুস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিদের একটি অন্তর্জাল গড়ে তোলেন। তিনি মাহদবী তরিকায় উচ্চ সম্মানে ভূষিত যারা তাঁর মাধ্যমে মুহম্মদ ﷺ অবধি সিলসিলা চিহ্নিত করে থাকে।[246] | আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের নির্দেশে বাগদাদে তাঁকে কারাবন্দী করা হয় এবং বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। ইরাকের বাগদাদ শহরের কাজিমিয়া শহরতলীর আল-কাজিমিয়া মসজিদের তাঁকে দাফন করা হয়।[244] | |
৮ | ʿআলী ʾইবনে মুসা ٱلْإِمَام عَلِيّ ٱبْن مُوسَىٰ ٱلرِّضَا عَلَيْهِ ٱلسَّلَام দ্বিতীয় আবুল হ়াসান أَبُو ٱلْحَسَن ٱلثَّانِي[243] |
|
৭৬৫–৮১৭[247]
১৪৮–২০৩[247] মদীনা, হেজাজ[247] |
৩৫ বছর | ৫৫ বছর | ২০ বছর | আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন তাঁকে যুবরাজ ঘোষণা করেন। তিনি মুসলিম ও অমুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতদের সাথে তাঁর আলোচনার জন্য বিখ্যাত।[247] | শিয়া সূত্রমতে আল-মামুনের নির্দেশে পারস্যের মাশহাদে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়৷ তাঁকে ইরানের মাশহাদের ইমাম রেজার মাজারে দাফন করা হয়।[247] | |
৯ | মুহ়ম্মদ ʾইবনে ʿআলী ٱلْإِمَام مُحَمَّد ٱبْن عَلِيّ ٱلْجَوَّاد عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবু জাʿফর أَبُو جَعْفَر |
|
৮১০–৮৩৫[248]
১৯৫–২২০[248] মদীনা, হেজাজ[248] |
৮ বছর | ২৫ বছর | ১৭ বছর | আব্বাসীয় খলিফাদের নিপীড়নের মুখেও তাঁর উদারতা ও ধার্মিকতার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। | খলিফা আল-মুতাসিমের নির্দেশে আল-মামুনের কন্যা ও স্বীয় স্ত্রীর মাধ্যমে বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে ইরাকের বাগদাদ শহরের কাজিমিয়া শহরতলীর আল কাজিমিয়া মসজিদে দাফন করা হয়।[248] | |
১০ | ʿআলী ʾইবনে মুহ়ম্মদ ٱلْإِمَام عَلِيّ ٱبْن مُحَمَّد ٱلْهَادِي عَلَيْهِ ٱلسَّلَام তৃতীয় আবুল হ়াসান أَبُو ٱلْحَسَن ٱلثَّالِث[249] |
|
৮২৭–৮৬৮[249]
২১২–২৫৪[249] মদীনার নিকটস্থ সুরাইয়া গ্রাম, হেজাজ[249] |
৮ বছর | ৪২ বছর | ৩৪ বছর | তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিনিধিদের অন্তর্জালকে জোরদার করেন। তিনি তাঁদের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং বিনিময়ে বিশ্বাসীদের কাছ থেকে খুমুস জাতীয় আর্থিক অনুদান ও ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি লাভ করেন।[249] | খলিফা আল-মুতাজের নির্দেশে ইরাকের সামাররায় তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।[250] তাঁকে ইরাকের সামাররা শহরের আল-আসকারী মসজিদে দাফন করা হয়। | |
১১ | হ়াসান ʾইবনে ʿআলী ٱلْإِمَام ٱلْحَسَن ٱبْن عَلِيّ ٱلْعَسْكَرِيّ عَلَيْهِ ٱلسَّلَام আবুল মাহদী أَبُو ٱلْمَهْدِيّ |
|
৮৪৬–৮৭৪[251]
২৩২–২৬০[251] মদীনা, হেজাজ[251] |
২২ বছর | ২৮ বছর | ৬ বছর | তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই খলিফা আল-মুতামিদের নজরদারিতে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটে। এই সময় শিয়া মুসলমানেরা সংখ্যায় ও শক্তিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ওপর নিপীড়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।[252] | ইরাকের সামাররায় খলিফা আল-মুতামিদের নির্দেশে বিষপ্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়।[253] তাঁকে ইরাকের সামাররা শহরের আল-আসকারী মসজিদে দাফন করা হয়। | |
১২ | মুহ়ম্মদ ʾইবনে হ়াসান مُحَمَّد ٱبْن ٱلْحَسَن আবুল ক়াসিম أَبُو ٱلْقَاسِم |
|
৮৬৯–বর্তমান[257]
২৫৫–বর্তমান[257] সামাররা, ইরাক[257] |
৫ বছর | অজানা | বর্তমান | দ্বাদশী শিয়া বিশ্বাসমতে তিনি হলেন বর্তমান ইমাম এবং প্রতীক্ষিত মাহদী, একজন মসীহীয় ব্যক্তিত্ব যিনি নবী ঈসা ইবনে মরিয়মের সঙ্গে শেষ জমানায় আবির্ভূত হবেন। তিনি ইসলামের ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে ন্যায়বিচার ও বিশ্বশান্তি কায়েম করবেন।[258] | দ্বাদশী শিয়া তত্ত্বমতে তিনি ৮৭৪ সাল থেকে গয়বত বা সমাবরণে চলে গিয়েছেন এবং আল্লাহর নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এ অবস্থাতেই থাকবেন।[257] |
প্রত্যেক ইমামই পূর্ববর্তী ইমামের ছেলে ছিলেন। এর ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল হোসেন ইবনে আলী, যিনি ছিলেন পূর্ববর্তী ইমাম হাসান ইবনে আলীর ভাই। দ্বাদশ এবং চূড়ান্ত ইমাম হলেন মুহম্মদ আল-মাহদী, ইসনা আশারিয়াদের বিশ্বাসমতে যিনি বর্তমান জীবিত ও অন্তর্হিত ইমাম এবং প্রতীক্ষিত মাহদী।[109]
দ্বাদশী আইনশাস্ত্র সাধারণ জাʿফরি ফিকহ নামে পরিচিত। এই ফিকহ অনুযায়ী নবী মুহাম্মদের মৌখিক ঐতিহ্যসমূহ এবং ইমামগণ কর্তৃক সেগুলোর প্রয়োগ ও ব্যাখ্যাকে সুন্নত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাʿফরি ফিকহের অন্তর্গত তিনটি ঘরানা রয়েছে: উসুলি, আখবারি ও শাইখি। উসুলি ঘরানা বর্তমানে বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী। দ্বাদশীদের মধ্যে আলেভি, বেকতাশি এবং কিজিলবাশ উপদলগুলো জাʿফরি ফিকহ অনুসরণ করে না।
জাʿফরি ফিকহ অনুযায়ী ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে যেগুলো উসূল আদ-দীন (আরবি: أصول الدين, প্রতিবর্ণীকৃত: Uṣūl ad-Dīn) হিসেবে পরিচিত। এগুলো মূলধারার সুন্নি ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ থেকে কিছুটা আলাদা। জাʿফরি পঞ্চস্তম্ভ হল:
জাʿফরি ফিকহশাস্ত্রে দশটি আনুষঙ্গিক স্তম্ভ তথা ফুরূʿ আদ-দীন (আরবি: فروع الدين, প্রতিবর্ণীকৃত: furūʿ ad-dīn) রয়েছে যেগুলো নিম্নরূপ:[259]
ইসনা আশারিয়াদের মতে, ইসলামি আইনশাস্ত্রের সংজ্ঞায়ন ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব মুহম্মদ ও বারো ইমামের। যেহেতু ১২শ ইমাম বর্তমানে অন্তর্হিত, কাজেই ওলামায়ে কেরামের কর্তব্য হল কোরআন ও হাদিস মোতাবেক ইসলামি আইনের সীমার মধ্যে থেকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যমান সমস্যাবলি সমাধানের উপায় সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে আইনি সিদ্ধান্তগুলো চিহ্নিত করা।
অন্য কথায়, ইসনা আশারিয়া ওলামা ইসলামি আইনশাস্ত্রের অবিভাবকত্ব করেন যা মুহাম্মদ ও তার বারোজন উত্তরসূরি কর্তৃক সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াটিকে ইজতিহাদ বলা হয়ে থাকে এবং আলেমদের মারজা অর্থাৎ সূত্র নামে অবিহিত করা হয়। আল্লামা, হুজ্জাত আল-ইসলাম, আয়াতুল্লাহ প্রভৃতি আখ্যাগুলি ইসনা আশারিয়া আলেমদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
জায়েদি হল ইমাম জায়েদ ইবনে আলীর অনুসারী শিয়া সম্প্রদায়। এদের প্রায়শই পঞ্চমী বা পাঁচ ইমামি নামে অবিহিত করা হয়। ইয়েমেনের জনসংখ্যার শতকরা ৪২ থেকে ৪৭ ভাগ জায়েদি মতাবলম্বী।[260][261]
জায়েদি, দ্বাদশী ও ইসমাইলিরা অভিন্নভাবে প্রথম চার ইমামকে স্বীকৃতি দেয়; তবে জায়েদিরা জ়ায়েদ ʾইবনে ʿআলীকে পঞ্চম ইমাম হিসেবে গণ্য করে। তাদের বিশ্বাসমতে জায়েদের পর হাসান বা হোসেনের বংশোদ্ভূত যে কেউ নির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে ইমাম হতে পারেন।[262] ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত অন্যান্য জায়েদি ইমামদের মধ্যে ইয়াহিয়া ইবনে জায়েদ, মুহম্মদ আন-নফস আজ-জাকিয়া এবং ইব্রাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জায়েদি ইমামত তত্ত্বমতে ইমামগণ নিষ্পাপ বা অভ্রান্ত নন, এমনকি তারা ঐশী দিকনির্দেশনাও পান না। জায়েদিরা এও বিশ্বাস করে না যে ইমামত পিতা থেকে পুত্রতে স্থানান্তরিত হয়। বরং তাদের মতে হাসান ইবনে আলী বা হোসেন ইবনে আলীর বংশধর যেকোনো সৈয়দ ইমাম হতে পারেন (কারণ হাসানের মৃত্যুর পর ইমামত তার পুত্রের কাছে না গিয়ে তার ভাই হোসেনের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছিল)। ঐতিহাসিকভাবে, জায়েদিরা মনে করে যে জ়ায়েদ ছিলেন ৪র্থ ইমামের ন্যায্য স্থলাভিষিক্ত কেননা তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। মুহম্মদ আল-বাকির কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াননি, এবং জায়েদিরা বিশ্বাস করে যে একজন প্রকৃত ইমামকে অবশ্যই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
ফিকহশাস্ত্রীয় বিষয়ে জায়েদিরা ইমাম জ়ায়েদ ʾইবনে ʿআলীর শিক্ষাকে অনুসরণ করে যা তার রচিত মজমুʿ আল-ফ়িক়হ (مجموع الفِقه) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইয়েমেনে জ়ায়েদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা আল-হাদী ইলা আল-হক ইয়াহিয়াকে জ়ায়েদ ফিকহের বিধিবদ্ধকারী হিসেবে দেখা হয় এবং বর্তমানে অধিকাংশই জায়েদিই হাওয়াদি হিসেবে পরিচিত।
ইদ্রিসীয় রাজবংশ ছিল একটি আরব জায়েদি শিয়া রাজবংশ যারা উত্তর আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চলে ৭৮৮ থেকে ৯৮৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিল।[263][264][265][266][267][268][269] এই বংশের নামকরণ করা হয়েছিল এর সর্বপ্রথম সুলতান প্রথম ইদ্রিসের নামানুসারে।
আলাভিরা ৮৬৪ সালে গিলান, দেয়লামান ও তাবারিস্তানে (উত্তর ইরান) একটি জায়েদি রাষ্ট্র কায়েম করেছিল;[270] ৯২৮ সালে এর নেতা সামানীয়দের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রটি স্থায়ী হয়েছিল। মোটামুটিভাবে এর চল্লিশ বছর পর ১১২৬ সালে হাসানীয়দের নেতৃত্বে এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১২শ ও ১৩শ শতাব্দীতে দেয়লামান, গিলান ও তাবারিস্তানের জায়েদিরা ইয়েমেনের জায়েদি ইমামদের এবং ইরানের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী ইমামদের স্বীকৃতি প্রদান করে।[271]
বুয়ী রাজবংশ ছিল প্রাথমিকভাবে একটি জায়েদি শিয়া রাজবংশ।[272] ৯ম ও ১০ম শতাব্দীর আল-ইয়ামামার বনু উখাইজির শাসকেরাও ছিল জায়েদি।[273] জায়েদি সম্প্রদায়ের নেতা খলিফা উপাধি ধারণ করেছিলেন। এভাবে ইয়েমেনের শাসক খলিফা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রাসসীয় নেতা আল-হাদী ইয়াহিয়া ইবনে আল-হোসেন ইবনে আল-কাসিম আর-রাসসী (আলীর পুত্র হাসানের বংশধর) ৮৯৩–৮৯৭ সালের দিকে সাʿদায় জায়েদি ইমামত কায়েম করেন। এই শাসনব্যবস্থাটি ২০শ শতাব্দীর মধ্যভাগ অবধি ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৬২ সালের বিপ্লবের ফলে জায়েদি ইমামতটির পতন ঘটে। ইয়েমেনের আদি জায়েদি মতাবলম্বীরা ছিল জারুদিয়া দলভুক্ত। তা সত্ত্বেও সুন্নি ইসলামের হানাফি ও শাফিঈ মতাবলম্বীদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান মিথষ্ক্রিয়ার ফলে তারা সুলেমানিয়া, তাবিরিয়া, বুতরিয়া বা সালিহিয়া প্রভৃতি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।[274] জায়েদিরা ইয়েমেনের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ধর্মীয় গোষ্ঠী। বর্তমানে তারা ইয়েমেনের মোট জনসংখ্যার ৪০–৪৫%। জাফরি আর ইসমাইলিরা ২–৫%।[275] সৌদি আরবে পশ্চিমা প্রদেশগুলোতে ১০ লক্ষাধিক জায়েদিদের বসবাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমানে সবচেয়ে প্রভাবশালী জায়েদি আন্দোলন হল হুসি আন্দোলন, যা শবাব আল-মুমিনীন (বিশ্বাসী যুবকদল) বা আনসারুল্লাহ (আল্লাহর বাহিনী) নামেও পরিচিত। ২০১৪–২০১৫ সালে হুসিরা সানায় ইয়েমেনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফেলে, যার ফলে আব্দ রাব্বুহ মনসুর হাদীর নেতৃত্বাধীন সৌদিপন্থী সরকারের পতন ঘটে।[276] হুসি ও তাদের মিত্রশক্তি ইয়েমেনের একটি বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং ইয়েমেনে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হুসি এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট উভয়ই ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্টের আক্রমণের শিকার হয়।[277][278]
ইসমাʿইলিরা তাদের নাম ইসমাʿইল ইবনে জাʿফর থেকে লাভ করেছে যাঁকে তারা জাফর আস-সাদিকের পরবর্তী ঐশ্বরিকভাবে নিযুক্ত আধ্যাত্মিক স্থলাভিষিক্ত বা ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে। যেখানে ইসনা আশারিয়ারা ইসমাʿইলের ছোট ভাই মুসা আল-কাজিমকে প্রকৃত ইমাম হিসেবে গণ্য করে।[279]
৮ম শতাব্দীতে মুহম্মদ ইবনে ইসমাইলের মৃত্যু বা অন্তর্ধানের পর ইসমাইলি মতবাদের শিক্ষাগুলি আজকের পরিচিত বিশ্বাসব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয় যেখানে বিশ্বাসের গভীরতর ও গূঢ়ার্থের (বাতিন) ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। পরবর্তীকালে আখবারি ও উসুলি চিন্তাধারাকে কেন্দ্র করে দ্বাদশী মতবাদের অধিকতর আক্ষরিক (জাহির) বিকাশের সাথে সাথে শিয়া মতবাদ ভিন্ন দুটি অভিমুখে অগ্রসর হয়। একদিকে রূপকাশ্রিত ইসমাইলি গোষ্ঠী যারা ঈশ্বরের মরমিবাদী পথ ও প্রকৃতি এবং যুগের ইমামের ব্যক্তিত্বের মাঝে ঈশ্বরের চেহারাস্বরূপ ঐশ্বরিক প্রকাশে মনোযোগী, অন্যদিকে অধিকতর আক্ষরিকতাবাদী দ্বাদশী গোষ্ঠী যারা ঐশী আইন (শরীয়ত) এবং নবী মুহাম্মদ ও তার উত্তরসূরিদের (আহল আল-বাইত)—যাঁরা ইমাম হিসেবে ছিলেন অনুসরণীয় এবং ঈশ্বরের নূরস্বরূপ—কথা ও কাজের (সুন্নত) প্রতি মনোযোগী।[280]
যদিও ইসমাইলিদের মধ্যে একাধিক উপদল রয়েছে, তবুও আজকের প্রচলিত ভাষায় এই শব্দটি সাধারণত নিজারি ইসমাইলি মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যারা মূলত আগা খানের অনুসারী এবং ইসমাইলিদের মধ্যে বৃহত্তম গোষ্ঠী।[281] ইসমাইলিদের অন্তর্ভুক্ত আরেকটি উপদল হল দাঊদি বোহরা যারা একজন দাঈ আল-মুতলাককে লুক্কায়িত ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে অনুসরণ করে। যদিও ইসমাইলিদের মধ্যে আরও অসংখ্য উপদল রয়েছে যাদের বাহ্যিক চর্চা একে অন্যের থেকে ভীষণ আলাদা, তথাপি আধ্যাত্মিক ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে বেশিরভাগ বিশ্বাসই প্রারম্ভিক ইমামদের যুগের মতোই অভিন্ন রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে ইসমাইলিরা মূলত একটি ইন্দো-ইরানীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে,[282] তবে ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, সউদি আরব,[283] ইয়েমেন, চীন,[284] জর্ডান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং সাম্প্রতিক অভিবাসনের ফলে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকায় ইসমাইলি শিয়াদের বসবাস রয়েছে।[285]
ইসমাইল ইবনে জাফরের মৃত্যুর পরে অনেক ইসমাইলি বিশ্বাস করেছিল যে, ইসমাইলের পুত্র মুহম্মদ ইবনে ইসমাইল একদিন মসীহ বা মুক্তিদাতা ইমাম মাহদী হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হবেন এবং ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। এদের মধ্যে কারমাতীয় বলে একটি সহিংস গোষ্ঠী ছিল যাদের বাহরাইনে দুর্গ ছিল। এর বিপরীতে কিছু ইসমাইলি বিশ্বাস করেছিল যে ইমামতের ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং ইমামগণ অন্তর্ধানে চলে গেলেও ধর্মপ্রচারক দাঈদের একটি অন্তর্জালের মাধ্যমে অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও শিক্ষাদান করে চলেছেন।[286][287]
৯০৯ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ আল-মাহদী বিল্লাহ নামক ইসমাইলি ইমামতের এক দাবিদার ফাতিমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়কালে ইমামতের তিনটি বংশধারা তৈরি হয়। প্রথম শাখাটি হাকিম বি আমরুল্লাহর মাধ্যমে শুরু হয়। আমরুল্লাহ ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে (৩৮৬ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র এগারো বছর বয়সে শাসক হিসেবে ক্ষমতারোহণ করেন। সাধারণত ধর্মীয়ভাবে সহিষ্ণু ফাতিমীয় সাম্রাজ্য তার শাসনামলে ব্যাপক দমনপীড়ন প্রত্যক্ষ করে। ১০২১ খ্রিস্টাব্দের (৪১১ হিজরি) কোনো একদিন তার খচ্চর রক্তে রঞ্জিত হয়ে তাঁকে ছাড়াই প্রাসাদে ফিরে আসে, তখন তার অনুসারী দল—যা তার জীবদ্দশায় একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে উঠছিল—মূলধারার ইসমাইলি শিয়া মতবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তার উত্তরসূরি নির্বাচন থেকে বিরত থাকে। তারা আল-হাকিমকে আল্লাহর অবতার এবং প্রতীক্ষিত মাহদী হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু করে যিনি একদিন পৃথিবীতে পুনরাবির্ভূত হয়ে ন্যায়বিচার কায়েম করবেন। তারা পরবর্তীকালে দ্রুজ হিসেবে পরিচিত লাভ করে।[288] দ্রুজরা ইসমাইলি মতবাদ এবং মূলধারার ইসলাম থেকে আলাদা এবং খুবই অস্বাভাবিক ধর্মতত্ত্ব গড়ে তোলার ফলে ইসমাইলি শিয়া মুসলমানদের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।[289][290]
দ্বিতীয় বিভাজনটি ১০৯৪ খ্রিস্টাব্দে (৪৮৭ হিজরি) মাʿদ আল-মুস্তানসির বিল্লাহর মৃত্যুর পর তৈরি হয়। তার শাসনকাল ছিল যেকোনও ইসলামি সাম্রাজ্যের যেকোনও খলিফার চেয়ে দীর্ঘতম। তার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠপুত্র নিজার এবং কনিষ্ঠপুত্র আল-মুস্তালি রাজবংশের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করেন। নিজারকে পরাজিত ও কারাবন্দী করা হয়। তবে নিজারি ঐতিহ্য অনুসারে, তার ছেলে আলামুতের দিকে পালিয়ে যান এবং সেখানকার ইরানি ইসমাইলিরা তাঁকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে।[291] এরপর থেকে নিজারি ইসমাইলি ইমামতের সিলসিলা আজ অবধি অব্যাহত আছে।[292]
মুস্তালি ধারা আবার তৈয়িবি (দাঊদি বোহরা এর প্রধান শাখা) ও হাফিজি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তৈয়িবিরা দাবি করে যে আত-তৈয়িব আবুল কাসিম (আল-আমীর বি-আহকামুল্লাহর পুত্র) ও তার পরবর্তী ইমামগণ একটি নামপরিচয়হীন যুগে (দওর-এ-সতর) প্রবেশ করেছেন এবং সম্প্রদায়কে দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য একজন দাঈ আল-মুতলাক নিয়োগ করেছেন, ঠিক যেরকম প্রারম্ভিক ইসমাইলিরা ইসমাইল ইবনে জাফরের মৃত্যুর পর বিশ্বাস করেছিল। অন্যদিকে হাফিজিরা দাবি করে যে ক্ষমতাসীন নেতা হাফিজ ছিলেন ইমাম এবং ফাতিমীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ইমামতের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে।[293][294][295][296]
ইসমাইলিরা তাদের ধর্মীয় চর্চাগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করেছে যা ইসমাইলি সপ্তস্তম্ভ হিসাবে পরিচিত:[297]
|
|
ইসমাইলি মতবাদে শাহাদাকে (বিশ্বাসের ঘোষণা) একটি স্তম্ভ হিসেবে না দেখে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় যার ওপর এই সপ্তস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।[298]
নিজারিরা হাজির ইমামের অস্তিত্বের কারণে একটি বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান থাকার উপর গুরুত্বারোপ করে। যুগের ইমাম ফিকহশাস্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেন এবং ভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির কারণে তার দিকনির্দেশনা তার পূর্ববর্তী ইমামদের আলাদা হতে পারে। নিজারি ইসমাইলিদের ৪৯তম ও বর্তমান ইমাম হলেন করিম আল-হোসেনী চতুর্থ আগা খান। নিজারি ইমামতের সিলসিলা আজ অবধি জারি রয়েছে।[299]
দাঊদি বোহরা শাখায় ঐশী নেতৃত্ব অবারিত ধর্মপ্রচারণা প্রতিষ্ঠান দাঈদের মাধ্যমে জারি রয়েছে। বোহরা ঐতিহ্য অনুসারে, সর্বশেষ ইমাম আত-তৈয়িব আবুল কাসিম নির্জনতায় যাওয়ার পূর্বে তার পিতা বিংশ ইমাম আল-আমীর বি-আহকামুল্লাহ ইয়েমেনে তার স্ত্রী আল-হুররা আল-মালিকাকে তার নির্জনতার পর একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করার নির্দেশনা প্রদান করেন। এই দাঈ হলেন একজন অবারিত ধর্মপ্রচারণা প্রতিষ্ঠান যিনি মুস্তালি-তৈয়িবি ইমামদের বংশধারার নির্জনবাসকালীন (দওর-এ-সতর) ইমামের সহকর্মী হিসেবে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উভয় ক্ষেত্রেই সম্প্রদায়কে পরিচালনা করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। মুস্তালিদের তিনটি শাখা আলাভি বোহরা, সুলেমানি বোহরা ও দাউদি বোহরারা, বর্তমান দাঈ কে সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে।[300][301][302][303]
শিয়া ও সুন্নি চিন্তাধারার প্রারম্ভিক বিকাশের সময় থেকে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ইতিহাস প্রায়শই ছিল সহিংসতাপূর্ণ। বিভিন্ন কালপর্বে শিয়া গোষ্ঠীসমূহ নিপীড়নের শিকার হয়েছে।[304][305][306][307][308][309]
সামরিকভাবে প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বহু সুন্নি শাসকেরা শিয়া সম্প্রদায়কে তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব উভয়ের জন্যই হুমকিস্বরূপ বলে মনে করতেন।[310] উমাইয়া শাসনামলে সুন্নি শাসকেরা সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়কে প্রান্তিকীকরণের চেষ্টা চালায় এবং পরবর্তীকালে আব্বাসীয়রা তাদের এককালীন মিত্রশক্তি শিয়াদের প্রতি আচরণ পাল্টে ফেলে এবং প্রচুর শিয়াদের কারাবন্দী, নির্যাতন ও হত্যা করে। শিয়াদের অধিকাংশ ইমামদের উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। ইতিহাসজুড়ে সুন্নি সহধর্মবাদীদের দ্বারা শিয়া নিপীড়নকে প্রায়শই পাশবিক ও গণহত্যাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০–১৫% অংশ হওয়ায় শিয়ারা আজও বহু সুন্নি অধ্যুষিত দেশে তাদের ধর্ম পালন ও সংগঠনের অধিকার ছাড়াই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করছে।[311]
১৫১৪ সালে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম ৪০,০০০ আনাতোলীয় শিয়াদের গণহত্যার নির্দেশ দেন।[312] জালাল আল-এ-আহমদের মতে, “সুলতান প্রথম সেলিম ব্যাপারটাকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি ঘোষণা করেন একজন শিয়া হত্যা করলে ৭০ জন খ্রিস্টান হত্যার সমান সওয়াব অর্জিত হয়।”[313]
১৮০১ সালে সউদি ওয়াহাবি সেনাবাহিনী পূর্ব ইরাকের কারবালায় আক্রমণ ও ধ্বংসসাধন করে যেখানে তৃতীয় ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর মাজার অবস্থিত।[314]
১৯৬৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেনের বাসবাদী শাসনামলে (১৯৬৮–২০০৩) ইরাকে শিয়া মুসলমানদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।[315]
২০১১ সালের মার্চ মাসে মালয়েশীয় সরকার শিয়া সম্প্রদায়কে একটি “বিচ্যুত” উপদল হিসাবে ঘোষণা করে এবং শিয়াদের অন্যান্য মুসলমানদের কাছে তাদের বিশ্বাস প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে তাদের ব্যক্তিগতভাবে এটি চর্চা করতে অনুমোদন দেয়।[316][317]
সহিংস উপায়ে শিয়া সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য সুন্নি মুসলমানদের সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং গুরুতর প্রচেষ্টা ছিল ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মধ্যে সিরিয়া ও ইরাকে আইএসআইএল/আইএসআইএস/আইএস/দায়েশ কর্তৃক সংগঠিত ও সম্পাদিত শিয়া মুসলমানদের বড় আকারের গণহত্যা[318][319][320][321] যা মধ্যপ্রাচ্যের একই অঞ্চলে অন্যান্য অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণহত্যার পাশাপাশি ঘটেছে যা পূর্বোক্ত সুন্নি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী এবং সালাফি-জিহাদবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল।[318][320][322][323]
কুরআন : প্রখ্যাত শিয়া মারজা আয়াতুল্লা আবু আল-কাসিম আল-খুয়েইএর মতে আল-কোরান কখনো পরিবর্তিত কিংবা পরিবর্ধিত হয় নি। তিনি তার সংকলিত কিতাব " আল বায়ান ফি তাফসীর আল-কোরআন " এ সাম্প্রতিক সময়কার বাইবেল এবং তাওরাতের সাথে তুলনা করে, সেখানকার বিভিন্ন ত্রুটি চিহ্নিত করে কোরানের মর্যাদা হাদিস অনুসারে সমুন্নত করেছেন। এছাড়াও শিয়া মনীষী সাঈদ আলী খামেনি, আয়াতুল্লাহ মাকারিম সিরাজীর মতেও কুরানের তাহরিফ কখনো ঘটে নি। কিছু শিয়া মনীষী ভিন্ন মত পোষণ করলেও তা খুবই নগন্য।
আল-কুরাআনের তাফসির প্রসঙ্গে শিয়া ইসলাম যে সকল কিতাবের ওপর নির্ভর করে, সেগুলো হলো -
( ১ ) তাফসীরে নূর আল-সাকালাঈন।
( ২ ) তাফসীরে আকা মাহদি পুয়া।
( ৩ ) তাফসীর আল-মিজান।
( ৪ ) তাফসীর আন-নামুনাহ্।
( ৫ ) আল তিবীয়ান ফি তাফসীর আল-কোরান।
( ৬ ) মাজমা আল-বাইয়ান।
( ৭ ) পার্তুভি আয-কোরান।
( ৮ ) বাহার আল-আনোয়ার।
ইত্যাদি
আল-হাদিস: শিয়া ইসলাম রাসুলুল্লাহ ( সা. ) এর হাদীদের সাথে তার আহলুল বাঈতের হাদিসের প্রতিও গুরত্বারোপ করেন। শিয়াদের মতে আহলুল বাঈতের কাছে রাসুলুল্লাহ ( সা. ) এবং তার পূর্ববর্তী নবি ও রাসুলদের সুন্নাহ্ সংরক্ষিত আছে। তারাই সুন্নার যোগ্য উত্তরসূরী।
শিয়ারা " সিহাহ সিত্তাহ " বা " কুতুব আল-সিত্তাহ " এ বিদ্যমান ছয়টি হাদিস কিতাবকে গুরত্বারোপ করেন না, তাঁদের মতে এ হাদিস কিতাবে উল্লেখিত রাবীগণ ( যেমন আবু হুরাইরা, আনাস বিন মালিক, উমর ইবনে খাত্তাব, আইশা বিনতে আবু বকর, খালিদ বিন ওয়ালিদ, হাফসা ইত্যাদি ) অগ্রহনযোগ্য।
শিয়ারা ইসলাম সুন্নিদের " কুতুব আল-সিত্তাহ " এর বদলে " কুতুব আল-আর্বাহ্ " কে অধিক গ্রহনযোগ্যতা দেয়। " কুতুব আল-আর্বাহ্ " এর চারটি হাদিস কিতাবের নামসমুহ নিম্নরূপ-
( ১ ) কিতাব আল-কাফি - ইমাম আল-কুলিয়ানি।
( ২ ) মান লা ইয়াযুরুহু আল-ফাকিহ্ - আল-সাঈখ আস-সাদুক।
( ৩ ) তাহযিব আল-আহকাম - সাঈখ তুসী।
( ৪ ) কিতাব আল-ইস্তিবসার - সাঈখ তুসী।
" কিতাব আল-আর্বাহ্ " এর কিতাবগুলো ছাড়াও যে কিতাবগুলো শিয়া মুসলিমগণ চর্চা করেন, সেগুলো নিম্নরূপ:
( ১ ) নাহজুল বালাঘা - ইমাম আলী ইবনে আবু তালীব।
( ২ ) সাহিফা এ আলাবিয়া - ইমাম আলী ইবনে আবু তালীব।
( ৩ ) সাহিফা আল-কামিলাহ্ ওয়া সাজ্জাদিয়া - ইমাম জয়নুল আবেদীন আল-সাজ্জাদ।
( ৪ ) সহিহ আল-নবি - আল্লেমাহ্ আত-তাবাতাবাই।
( ৫ ) বাসাঈর আদ-দারাজাত- বাকির আল-মাজিসী।
( ৬ ) বাহার আল-আনোয়ার - বাকির আল-মাজিসী।
( ৭ ) ওয়াসাঈল আল-শিয়া - আল-হূর আল-আমিনী।
( ৮ ) কিতাব আল-ইরশাদ - সাঈখ আল-মুফিদ।
( ৮ ) কিতাব আল-মুমিন - আল-হুসাইন ইবনে সাঈদ আল-কুফী আহওয়াযী।
সহ অন্যান্য।
সুন্নি হাদিসগুলোর মতো এ কিতাবগুলোতেও হাদীসের গ্রহনযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য " সহিহ ", " দূর্বল ", " দাঈফ " ট্যাগগুলো ব্যবহৃত হয়।
১. ইমামাহ্: ইমামাহ্ শব্দের অর্থ নেতৃত্ব। শিয়া মুসলিমদের মতে নেতৃত্ব বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এগুলো হলো : হুজ্জাহ্ (আল্লাহ্-এর প্রমাণ), একজন উম্মার নেতা এবং একজন ধর্মীয় নেতা।
বার জন ইমামেরা একই সাথে হুজ্জা, (সমগ্র) উম্মার নেতা এবং ধর্মীয় নেতা ছিলেন। এজন্য বারজন ইমামেরা তিনটা অর্থেই ইমাম। কিন্তু তাঁদের পরে এমন কোন ইমামের আবির্ভাব ঘটে নি যারা তিনটা অর্থেই ইমাম হতে পেরেছেন।
যেমন সাঈদ আলী খামেনি একজন ধর্মীয় নেতা এবং উম্মার নেতৃত্বদানকারী অর্থে ইমাম কিন্তু তিনি কোন হুজ্জা নন। সে ইমামই হুজ্জা হবার যোগ্য যাঁর দ্বারা আল্লাহ শরিয়ত এবং ইসলাম পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং যাঁর দ্বারা আল্লাহ্ নিজের অস্তিত্বকে তুলে ধরেছেন।
শেষ নবি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ এর মতে ধর্ম কখনোই শেষ হবে না যতক্ষন না বার জন ইমামের আবির্ভাব না ঘটে। (ইয়ানাবি আল-মাওয়াদ্দাহ্)
যখনই "হুজ্জা" নামটি তোলা হবে তখনই বার জন ইমামের নাম সামনে এসে যাবে। তারা কেবল মাত্র আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারি। কিন্তু যখন শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবে ইমাম অথবা ওয়ালী শব্দটি ব্যবহৃত হবে তখন বার জন ইমামের সাথে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য,তারা হলেন,
১. আয়াতুল্লাহ্ হাসান বুরেজেদি।
২. আয়াতুল্লাহ সাঈদ আলী হুসাঈনি আল-খামেনি।
৩. সাঈদ হাসান নাসরাল্লাহ। (হিজবুল্লাহ্ নামক সশস্ত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত)
৪. সাঈদ জাফর মুরতাজা আল-আমিলী। ("আল-সহিহ্ মিন সিরাত আল-নবি আল-আযম" লেখার জন্য বিখ্যাত)
৫. আল্লেমাহ্ আত-তাবাতাবাই। (শিয়া তাফসির কিতাব "আল-মিজান" লেখার জন্য বিখ্যাত)
৬. সাঈখ আযহার নাসির।
৭. আল্লেমাহ্ বাকির মাজিসি৷ ("বাহার আল আনোয়ার" নামক হাদিস কিতাব সংকলনের জন্য বিখ্যাত)
৮. আয়াতুল্লাহ ইব্রাহিম রাইসি।
৯. আয়াতুল্লাহ উযয়া রুহুল্লাহ্ খুমেনি। ( " ওয়ালাইতে ফাকিহ্ এর ধারণা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত )
১০. আয়াতুল্লাহ্ সাঈদ সিস্তানি।
১১. আয়াতুল্লাহ্ মাকারিম সিরাজি। (তাফসির কিতাব " তাফসিরে নামুনাহ্ " সংকলনের জন্য বিখ্যাত)
এবং আরও অগণিত ধর্মীয় নেতা আছেন যাঁদের নাম লিখে সমাপ্ত করা যাবে না।
যখন "ধর্মীয় নেতা" এর সাথে উম্মার নেতা হিসেবে "ওয়ালী" অথবা "ইমাম" শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন যাঁদের নাম সামনে আসে,
১. বার জন ইমামেরা।
২. আয়াতুল্লাহ উযয়া রুহুল্লাহ্ আল-খুমেনি।
৩. সাঈদ আলী খামেনি।
এখানে "ধর্মীয় নেতা" বলতে বোঝানো হয় " মারজা " যার প্রতি একজন শিয়া আনুগত্য পোষণ করেন। তিনি শরিয়তের আইন কানুন, বিধি বিধান, আল-কুরানের তাফসির, হাদিস শাস্ত্র এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে একান্তই পণ্ডিত। [ 1 ]
২. নিকাহ্ মুতাহ (মুতাহ্ বিবাহ) : মুতাহ্ বিবাহ্ বলতে বোঝায় সাময়িক বিবাহ অর্থাৎ কতক্ষন ধরে বিয়েটি বর্তমান থাকবে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ঠিক করে রাখা। [ 2
৩. তাকিয়া: " তাকিয়া " শব্দের মূল অর্থ লুকিয়ে রাখা। ছলনা, মিথ্যে সহ নানা উপায়ে নিজের বিশ্বাসকে রক্ষা করাই তাকিয়ার মূল নীতি।
৪. আল-ঘাইবা: শিয়াদের মতে ইমাম মাহদি নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করবেন না বরং তিনি বহু আগেই ইমাম হাসান আল আসকারি (আ.) এর জীবদ্দশায় ইমাম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তিনি এখনো বেঁচে আছেন। আল্লাহ তাঁকে লোকসমাজ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। যাতে অন্যান্য ইমামের মতো তাঁকে উমাঈয়াদ এবং আব্বাসিদদের হাতে হত্যার শিকার না হতে হয়।
ঘাইবাত দুই প্রকার : (১) ঘাইবাতে সুঘরা এবং (২) ঘাইবাতে কুবরা
ঘাইবাতে সুঘরার সময়কালীন সাক্ষীর সংখ্যা চার জন:
(১) জনাব আবু আমর উসমান ইবনে সাঈদ আম্রি ( রা. )।
(২) জনাব আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে উসমান ইবনে সাঈদ আম্রি ( রা. )।
(৩) জনাব আবুল কাসিম হুসাইন ইবনে রাউহ্ নাওবাখতি ( রা. )।
(৪) জনাব আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মাদ শেইমুরি ( রা. )।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.