আলি

চতুর্থ খলিফা, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী পুরুষ সাহাবি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

আলি

আলি ইবনে আবু তালিব ছিলেন ( আরবি: علي ابن أبي طالب, প্রতিবর্ণীকৃত: ʿAlī ibn ʾAbī Ṭālib; জন্ম: আনু. ১৩ সেপ্টেম্বর ৬০১ – আনু. ২৯ জানুয়ারি, ৬৬১ খ্রি.) ইসলাম এর নবি মুহম্মাদ সা. এর চাচাতো ভাই, জামাতা ও সাহাবি, যিনি ৬৫৬ থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত খলিফা হিসেবে গোটা মুসলিম বিশ্ব শাসন করেন। সুন্নি ইসলাম অনুসারে তিনি চতুর্থ রাশিদুন খলিফাশিয়া ইসলাম অনুসারে তিনি মুহম্মদের ন্যায্য স্থলাভিষিক্ত ও প্রথম ইমাম[][][১০][১১][১২] তিনি ছিলেন আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিবফাতিমা বিনতে আসাদের পুত্র, ফাতিমার স্বামী এবং হাসানহুসাইনের পিতা।[১৩] তিনি আহল আল-কিসাআহল আল-বাইত এর একজন সদস্য।[১৪][১৫]

দ্রুত তথ্য ৪র্থ খলিফা সুন্নি ইসলাম, খিলাফত ...

ʿআলি ইবনে ʾআবি ত়ালিব
علي ابن أبي طالب

তালিকা
Thumb
আলির নাম সংবলিত আরবি চারুলিপি
৪র্থ খলিফা
সুন্নি ইসলাম
খিলাফত৬৫৬–৬৬১
পূর্বসূরিউসমান ইবনে আফফান
উত্তরসূরিহাসান ইবনে আলি
১ম ইমাম
শিয়া ইসলাম
ইমামত৬৩২–৬৬১
উত্তরসূরিহাসান ইবনে আলী
জন্মআনু. ১৫ সেপ্টেম্বর ৬০১ (১৩ রজব ২১ হিজরি)
মক্কা, হেজাজ, আরব উপদ্বীপ[]
মৃত্যুআনু. ২৯ জানুয়ারি ৬৬১ (২১ রমজান ৪০ হিজরি)
(বয়স ৫৯)[][][]
কুফা, ইরাক, রাশিদুন খিলাফত
সমাধি
দাম্পত্য সঙ্গিনী
সন্তান
পূর্ণ নাম
ʿআলি ইবনে ʾআবি ত়ালিব ইবনে ʾআব্দুল মুত্তালিব
আরবি: عَلِيّ ٱبْن أَبِي طَالِب ٱبْن عَبْد ٱلْمُطَّلِب
স্থানীয় নামعَلِيّ ٱبْن أَبِي طَالِب
বংশআহল আল-বাইত
বংশবনু হাশিম
রাজবংশকুরাইশ
পিতাআবি তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব
মাতাফাতিমা বিনতে আসাদ
ধর্মইসলাম
মৃত্যুর কারণআলি হত্যাকাণ্ড
সমাধিইমাম আলি মসজিদ, নাজাফ, ইরাক
৩১.৯৯৬১১১° উত্তর ৪৪.৩১৪১৬৭° পূর্ব / 31.996111; 44.314167
স্মৃতিস্তম্ভইমাম আলি মসজিদ, নাজাফ প্রদেশ, ইরাক
অন্যান্য নাম
  • আবুল হাসান
  • আবু তুরাব
পরিচিতির কারণজ্ঞান, প্রজ্ঞা, বীরত্ব, সাহসিকতা, নেতৃত্ব, আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা, বাগ্মিতা, ন্যায়বিচার
উল্লেখযোগ্য কর্ম
মুসহাফ আলি, আল-জাফর, নাহজুল বালাগা, গুরার আল-হিকাম ওয়া দুরার আল-কালিম, দীওয়ান আল-ইমাম আলি ইবনে আবি তালিব, সহিফা আল-আলবিয়া
প্রতিদ্বন্দ্বী
আত্মীয়মুহম্মদ ﷺ (চাচাতো ভাই ও শ্বশুর)
সামরিক কর্মজীবন
আনুগত্য
কার্যকাল৬২৩–৬৩২
৬৫৬–৬৬১
যুদ্ধ/সংগ্রাম
বন্ধ
দ্রুত তথ্য আরবি নাম, ব্যক্তিগত (ইসম) ...
আরবি নাম
ব্যক্তিগত (ইসম)আলি
পৈত্রিক (নাসাব)ʿআলি ইবন ʾআবি ত়ালিব ইবন আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিম ইবন আব্দ মনাফ ইবন কুসাই ইবন কিলাব
ডাকনাম (কুনিয়া)আবুল হাসান
উপাধি (লাক্বাব)আবু তুরাব
বন্ধ

হযরত আলি (রা.) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর খুবই ঘনিষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই নবী করীম (সা.) তাঁর যত্ন নিতেন। তাঁর পালন-পোষণ এবং শিক্ষার দায়িত্ব নিতেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন খুব কম বয়সেই (৯ থেকে ১১ বছর বয়সে( আলি (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম কয়েকজন মুসলিমের একজন ছিলেন। নবী করীম (সা.) আলি (রা.) কে নিজের ভাই, অভিভাবক এবং একদিনের উত্তরসূরি হিসেবে গণ্য করতেন[১৬] । তিনি আলি (রা.) এর উপর অত্যন্ত আস্থা রাখতেন। হিজরতের রাতে, যখন কুরাইশরা নবী করীম (সা.) কে হত্যা করার জন্য তাঁর ঘরে আসে, তখন আলি (রা.) নিজের জীবন ঝুঁকিয়ে নবী করীম (সা.) কে রক্ষা করেন এবং তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকেন। এই ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। মদিনায় আসার পর নবী করীম (সা.) এবং মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। সেখানেও আলি (রা.) নবী করীম (সা.) এর খুব কাছের সাহাবি হিসেবে ছিলেন এবং নবী করীম (সা.) তাকে তার ভাই হিসেবে বেছে নেন।। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অনেক যুদ্ধে পতাকাবাহকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরলোকগমনের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব কার কাছে থাকবে, এই প্রশ্নটি ইসলামী ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে, হযরত আলি (রা.) এর খিলাফতের অধিকার নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে একটি বড় ফাটল সৃষ্টি হয়, যার ফলে শিয়া ও সুন্নি এই দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে আসেন, তখন গাদীর খুম নামক স্থানে তিনি একটি বিখ্যাত বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তিনি বলেন, "আমি যার মাওলা, এই আলি তার মাওলা।" এই বাক্যটি ইসলামী ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাক্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু 'মাওলা' শব্দের অর্থ নিয়ে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। শিয়ারা মনে করেন, এই বাক্যের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলি (রা.) কে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে নির্দেশ করেছেন। অন্যদিকে, সুন্নিরা মনে করেন, 'মাওলা' শব্দের অর্থ শুধুমাত্র বন্ধু বা ভালবাসার বস্তু।[১৭] হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের পর যখন আলি (রা.) তাঁর দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন একদল মুসলমান সকীফাতে মিলিত হয় এবং আবু বকরকে খলিফা নির্বাচিত করে।[১৮] আলি (রা.) এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি, তবে তিনিও নিজে খলিফা হওয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ নেননি। পরবর্তীতে, আবু বকরের মৃত্যুর পর উমর (রা.) এবং উসমান (রা.) খলিফা হন। আলি (রা.) তাদের শাসনামলেও মুসলিম সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন তবে । তবে, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নেননি।[১৯] উসমান (রা.) এর খিলাফতকালে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলোর কারণে উসমান (রা.) শহীদ হন। এরপর মুসলমানদের এক বিরাট অংশ আলি (রা.) কে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করে। কিন্তু আলি (রা.) এর খিলাফতকালেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষের ফলে ইসলামি ইতিহাসে প্রথম ফিতনা শুরু হয়। এই বিভক্তি ইসলামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এর প্রভাব আজও বিদ্যমান। শিয়া ও সুন্নি এই দুটি মতবাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, তারা উভয়ই ইসলামের মূল নীতিগুলোতে বিশ্বাসী।

হযরত উসমান (রা.) এর মৃত্যুর পর ৬৫৬ সালে হযরত আলি (রা.) ইসলামের খলিফা নির্বাচিত হন। কিন্তু খিলাফতের শুরু থেকেই তিনি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। মক্কায় আয়েশা (রা.), তালহা এবং জুবাইরের নেতৃত্বে একটি দল খিলাফতের বিরোধিতা করেন এবং উটের যুদ্ধে হযরত আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে হযরত আলি (রা.) বিজয়ী হন। এরপর সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান উসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার দাবিতে হযরত আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সিফফিনের যুদ্ধে এই দুই শক্তির সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধের শেষে একটি সালিশি বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু এই সালিশি বোর্ডের সিদ্ধান্ত সবার মনোযোগ কাড়তে পারেনি। ফলে হযরত আলির কিছু অনুসারী তাঁর বিরোধিতা করে খারিজি নামে একটি গোষ্ঠী গঠন করে। হযরত আলি (রা.) খারিজীদের বিরুদ্ধে ৬৫৮ সালে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। ৬৬১ সালে একজন খারিজি ভিন্নমতাবলম্বী ইবনে মুলজাম হযরত আলিকে কুফার মসজিদে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে, যা মুয়াবিয়ার ক্ষমতা দখল এবং বংশগত উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। কুফা শহরের বাইরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। পরে তার মাজার নাজাফ শহর নির্মিত হয়।

হযরত আলি (রা.) কে সুন্নি মুসলমানরা চার খলিফার একজন এবং পাক পাঞ্চাতানের অংশ হিসেবে সম্মান করেন[১৫], হিসেবে সম্মান করেন এবং শিয়া মুসলমানরা তাঁকে প্রথম ইমাম হিসেবে পূজ্য মনে করেন। হযরত আলি (রা.) একজন সাহসী, সত্যবাদী এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রতি অবিচল ছিলেন এবং সকল মানুষের প্রতি সমান আচরণ করতেন। তাঁর জীবন এবং কর্মকাণ্ড ইসলামি ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আলির উত্তরাধিকার বহু গ্রন্থে সংরক্ষিত ও অধ্যয়ন করা হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো "নাহজুল আল-বালাগা"।

জন্ম ও বংশপরিচয়

সারাংশ
প্রসঙ্গ

হযরত আলি (রা.) মক্কা নগরীতে একটি সম্মানিত কুরাইশ বংশে আনুমানিক ৬০১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার কাবা শরিফের রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব পালন করত এবং মক্কার সমাজে অত্যন্ত মর্যাদাশীল অবস্থান ধারণ করত। তাঁর পিতা আবু তালিব কুরাইশ গোত্রের প্রভাবশালী শাখা বনু হাশিমের নেতৃত্ব দিতেন এবং কাবার রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আলি (রা.)-এর দাদা হাশিম বংশের অন্যান্য সদস্যদের মতোই হানিফ ছিলেন, অর্থাৎ ইসলামপূর্ব যুগেই একেশ্বরবাদী বিশ্বাসে দীক্ষিত ছিলেন। বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হিসেবে আলি (রা.) ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবার অভ্যন্তরেই জন্মলাভ করেন।[২০] তাঁর মাতা ছিলেন ফাতিমা বিনতে আসাদ[১৩] আবু তালিবের পত্নী ফাতিমা বিনতে আসাদ ১৩ রজব, শুক্রবার কাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রসববেদনা থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছিলেন। তখন অলৌকিকভাবে কাবার দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্মুক্ত হয় এবং তিনি অনুভব করেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করায়। সেখানে তিনি আলি (রা.)-কে জন্ম দেন। ইতিহাসবিদদের মতে, আলি (রা.) সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি কাবার পবিত্র অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[২১][২২][২৩] জন্মের পর তিনি ও তাঁর মাতা তিন দিন পর্যন্ত কাবার অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। বাহিরে আসার পর মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের অভ্যর্থনা জানান এবং নবজাতককে অন্নপ্রাশন করান। মহানবী (সা.) নিজেই শিশুটির নাম রাখেন 'আলি', যার অর্থ 'উন্নত ও মহান'। পরবর্তীতে মুহাম্মদ (সা.) আলি (রা.)-কে দত্তক নেন।

আবু তালিব তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদ (সা.)-কে পিতৃ-মাতৃহীন হওয়ার পর লালন-পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন আবু তালিব আর্থিক সংকটে পড়েন, তখন প্রায় পাঁচ বছর বয়সে আলি (রা.)-কে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) তাদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যান[২১]ইসলামের ইতিহাসের সূচনালগ্নে তিনি সর্বপ্রথম নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।[২৪] মুহাম্মদ (সা.) আলি (রা.)-কে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। আলি (রা.) প্রথম পুরুষ হিসেবে শিশুকালেই ইসলাম গ্রহণ করেন।[২৫] তিনিই প্রথম পুরুষ যিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে নামাজ আদায় করেছিলেন।

মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আলি (রা.) তাঁর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিলেন। তিনি প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অকুতোভয় বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের যুদ্ধে তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে জুলফিকার নামক ঐতিহাসিক তরবারি উপহার দেন।[২৬] খাইবারের যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার জন্য মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে 'আসাদুল্লাহ' (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন।[২৭] গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক ভাষণে মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে সমস্ত মুমিনের 'মওলা' (অভিভাবক) হিসেবে ঘোষণা দেন।[২৮][২৯]

শুরুর দিককার দিনগুলো

হযরত আলি (রা.) এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে এক গভীর আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল, যা আলি (রা.)-এর শৈশবকাল থেকেই বিকশিত হয়েছিল। এই বিশেষ সম্পর্কের পটভূমিতে রয়েছে পারিবারিক বন্ধনের ইতিহাস। আলি (রা.)-এর পিতা আবু তালিব ছিলেন রাসূল (সা.)-এর চাচা এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। রাসূল (সা.) যখন পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে পড়েন এবং তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন, তখন আবু তালিব তাঁকে নিজ সন্তানের মতো লালন-পালন করেন। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, রাসূল (সা.) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.)-কে বিয়ে করার প্রায় দুই-তিন বছর পর আলি (রা.)-এর জন্ম হয়। পরবর্তীতে আলি (রা.) শিশুকালে রাসূল (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে আসেন এবং তিনি তাঁকে পুত্রস্নেহে লালন করেন। শৈশব থেকেই আলি (রা.) রাসূল (সা.)-এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। রাসূল (সা.) যেখানেই যেতেন, আলি (রা.) তাঁর ছায়াসঙ্গী হতেন। তাঁর সকল কাজে তিনি সহযোগিতা করতেন। হেরা পর্বতের গুহায় মুহাম্মদ (সা.) যখন ধ্যানমগ্ন থাকতেন, আলি (রা.) প্রায়ই তাঁর সাথে থাকতেন। কখনো কখনো তারা একসাথে ৩-৪ দিন পর্যন্ত পাহাড়ে অবস্থান করতেন। আলি (রা.) মাঝে মাঝে মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন। স্বীয় বর্ণনা নাহজুল বালাগায় আলি (রা.) নিজেই এই সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: "আমি মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সেইভাবে থাকতাম, যেমন একটি বাচ্চা উট তার মায়ের অনুসরণ করে।"

ইসলাম গ্রহণ

যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম ঐশী বাণী প্রাপ্ত হন, তখন মাত্র ১১ বছর বয়সী আলি (রা.) অকুণ্ঠ বিশ্বাস সহকারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষখাদিজা (রা.)-এর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ইসলামে দীক্ষিত হন। ইসলামের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সৈয়দ আলি আসগর রাজউয়ী তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেছেন: "মুহাম্মদ (সা.) এবং খাদিজা (রা.)-এর গৃহে যমজ সন্তানের মতো কুরআন মজীদ ও আলি (রা.) একসাথে বেড়ে উঠেছেন।" অর্থাৎ, আলির জীবন ইসলামের জন্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। কাবায় নামাজ আদায়কারী প্রথম তিনজন ব্যক্তি ছিলেন মুহাম্মদ (সা.), খাদিজা (রা.) এবং আলি (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে রাসূল (সা.)-এর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হিসেবে সকল কাজে সহযোগিতা করতেন। শিয়া মাযহাব অনুযায়ী, তিনি কোনো প্রাক-ইসলামিক মক্কান ধর্মীয় রীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। অল্প বয়সেই আলি (রা.)-এর মধ্যে গভীর ধর্মীয় বোধের প্রকাশ ঘটে।তিনি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতেন।মূর্তি ভাঙ্গার মতো সাহসী কাজে অংশ নিতেন। লোকজনকে মূর্তিপূজার অসারতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। এটি প্রমাণ করে যে, খুব কম বয়সেই আলি ধর্মীয় বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে বুঝতেন এবং সাহসের সাথে নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়াতেন।

জুল আশিরার ভোজনোৎসব

ইসলামের ইতিহাসে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রথম প্রকাশ্য দাওয়াত 'দাওয়াত দুল-আশিরাহ' (দশজনের দাওয়াত) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। কুরআনের সূরা আশ-শুআরা ২১৪ নং আয়াতের নির্দেশনা অনুসারে, আল্লাহ তাআলা নবীকে প্রথমে নিজ আত্মীয়-স্বজনকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতে বলেছিলেন। এই নির্দেশনা পালনে নবী মুহাম্মাদ (সা.) প্রায় তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচারের পর বনু হাশিম গোত্রের সকল সদস্যকে একত্রিত করে একটি বিশেষ সমাবেশের আয়োজন করেন। এই ঐতিহাসিক সমাবেশে নবী (সা.) ইসলামের মৌলিক নীতিমালা উপস্থাপন করে একটি আবেগময় আহ্বান জানান:

"আমি আল্লাহর অশেষ রহমতের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমি তাঁর প্রশংসা করি এবং তাঁর হিদায়াত কামনা করি। আমি তাঁর উপর ঈমান রাখি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমি তাঁর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ আমাকে আদেশ দিয়েছেন: 'তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক কর' (সূরা আশ-শুআরা: ২১৪)। তাই আমি আপনাদের সতর্ক করছি এবং ঘোষণা করছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল।

হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানগণ! আমি এমন এক বস্তু নিয়ে এসেছি যা আগে কেউ আনেনি। এটি গ্রহণ করলে তোমাদের পার্থিব ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত হবে। এখন বলো, তোমাদের মধ্যে কে আমাকে এই মহান কাজে সাহায্য করবে? কে আমার পাশে দাঁড়াবে? কে এই দায়িত্বভার আমার সাথে বহন করবে? কে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমার উত্তরাধিকারী হবে? আল্লাহর পথে কে আমার সঙ্গী হবে?"[৩০]

সমাবেশে উপস্থিত সকলের মধ্যে থেকে কেবল তরুণ আলি (রা.)ই দৃঢ়চিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন: "হে আল্লাহর রাসূল! আমি সবচেয়ে কম বয়সী হলেও আপনার পাশে দাঁড়াব।" নবী (সা.) তিনবার একই প্রশ্ন করলেও কেবল আলিই সাড়া দেন। এইভাবে আলি (রা.) প্রথম যুবক হিসেবে ইসলামের পথে অগ্রসর হন এবং নবীর ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হন।

এই ঘটনার পর আবু লাহাব বিদ্রূপ করে আবু তালিবকে বলেন: "যাও, এখন তোমার ছেলের আনুগত্য কর।" বনু হাশিমের অধিকাংশ সদস্য নবীর বক্তব্য উপহাস করে সমাবেশ ত্যাগ করলেও আলি (রা.) তার প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ রাখেন। পরবর্তীতে তিনি সারা জীবন নবী (সা.)-কে সহযোগিতা করে ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য ভূমিকা রাখেন। এই ঘটনা ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসে বিশ্বাস ও সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

মুসলমানদের ওপর নীপিড়ন

মক্কায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার এবং বনু হাশিম গোত্রের প্রতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক বর্জন চলাকালীন আলি (রা.) অবিচলভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিরলসভাবে ইসলামের শত্রুদের হাত থেকে নবীজিকে রক্ষা করতেন। এক স্মরণীয় ঘটনায়, যখন নবী (সা.) তায়েফ শহরে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন তায়েফের কিশোররা তাঁকে পাথর নিক্ষেপ করে আঘাত করতে শুরু করে। সেই কঠিন মুহূর্তে আলি (রা.) নিজের জীবন বিপন্ন করে নবীজিকে রক্ষা করেন এবং আক্রমণকারীদের সরিয়ে দেন। তাঁর যৌবনকাল থেকেই আলি (রা.)-এর শারীরিক শক্তি, মানসিক দৃঢ়তা এবং অপরিমেয় সাহসিকতা তাঁকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিল। তাঁর প্রশস্ত বক্ষ, বলিষ্ঠ বাহু এবং আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব সবার মধ্যে তাঁকে অনন্য স্থান দিয়েছিল। এমনকি বয়সে বড়রাও তাঁর সামনে সতর্ক থাকত। নবীজিকে কেউ অপমান করার চেষ্টা করলেই তারা আলি (রা.)-এর উপস্থিতি টের পেয়ে পলায়ন করত, কারণ সবাই জানত আলিই নবীজির প্রধান রক্ষক।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আলি (রা.) ছিলেন নবীজির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য সহচর। যখন বহু লোক নবীর বিরোধিতা করছিল, আলি (রা.) কখনই তাঁর চাচাতো ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে তিনি নবীজির জন্য মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এক সময়ে নবীজি ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে শত্রুদের বর্জন এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে তাদের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই ক্রান্তিকালে নবী মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ঐতিহাসিক লাইলাতুল মবিত-এ নবীজি আলি (রা.)-কে নিজের বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন, যা আলি (রা.) অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নেন। এ সময় আলি (রা.) নবীজির আমানতগুলো প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়ার দায়িত্বও গ্রহণ করেন। সেই রাতে আলি (রা.) নিজ জীবনকে বিপন্ন করে নবীজির বিছানায় শুয়ে থাকেন, যেখানে কাফিররা নবীজিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। আলি (রা.)-এর এই অসাধারণ সাহসিকতার কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং নবীজি আবু বকর (রা.)-এর সাথে নিরাপদে মদিনায় হিজরত করতে সক্ষম হন।

আলি (রা.) নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করে নবীজির সেবায় সর্বদা নিবেদিত ছিলেন। তিনি সফলভাবে সকল আমানত ফেরত দিয়ে নবী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মদিনার পথে রওনা হন। এই কাফেলায় ছিলেন তাঁর মাতা ফাতিমা বিনতে আসাদ, খালা, হামজা (রা.)-এর স্ত্রী, নবীজির কন্যা ফাতিমা (রা.) সহ অন্যান্য মহিলারা। মক্কার কাফিররা আলি (রা.)-কে থামানোর চেষ্টা করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করে পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। অবশেষে তারা মদিনায় পৌঁছলে নবীজি শহরের বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নবীজি আলি (রা.) ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে মদিনায় প্রবেশ করেন। অনেক ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, আলি (রা.) ছিলেন মদিনায় পৌঁছানো প্রথম মক্কাবাসীদের মধ্যে অন্যতম, যা ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

মুহাম্মদের সাহচর্য

সারাংশ
প্রসঙ্গ

৬২২ খ্রিস্টাব্দে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের খবর পাওয়ার পর তিনি নিরাপত্তার জন্য ইয়াসরিবে (পরবর্তীতে মদিনা নামে পরিচিত) হিজরত করেন। কিন্তু আলি (রা.) নবীজির জীবন রক্ষার্থে মক্কায় থেকে যান এবং নবীজির ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রুদের বিভ্রান্ত করেন।[২১][৩১] আলি (রা.)-এর এই আত্মত্যাগের ঘটনা সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: "আর কিছু লোক এমন আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে।"[৩২][৩৩][২২] এই হিজরতের মাধ্যমেই ইসলামি হিজরি সন গণনা শুরু হয়। আলি (রা.) নবীজির আমানতসমূহ যথাযথভাবে মালিকদের ফেরত দিয়ে পরবর্তীতে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।[৩৪]

মদিনায় পৌঁছানোর পর নবীজি (সা.) মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপনকালে আলি (রা.)-কে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করেন।[৩৫] আনুমানিক ৬২৩ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুহাম্মদ (স.) তাঁর কন্যা ফাতিমাকে আলি (রা.)-এর সাথে বিবাহ দেন।[৩৬][৩৭] এ সময় আলি (রা.)-এর বয়স ছিল প্রায় বাইশ বছর। উল্লেখ্য, এর পূর্বে নবীজি আবু বকরউমর ইবনুল খাত্তাব সহ কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবির ফাতিমা (রা.)-কে বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।[৩৮][৩৯]

মুবাহালার ঘটনা

Thumb
মুহাম্মদ এবং আলি, পনেরো শতকের ইরানি মহাকাব্য খাওয়ারনামা থেকে একটি ফোলিও।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নজরান অঞ্চল থেকে একদল খ্রিস্টান প্রতিনিধি মদিনায় এসে মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে।[৪০][৪১] আলোচনাকালে তারা ঈসা (আ.)-এর স্বরূপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে - তিনি মানব না ঐশ্বরিক সত্তা?[৪২][৪৩]

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরআন মজীদে সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াত নাজিল হয়,[৪৪] যাতে মুহাম্মদ (সা.)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁর বিরোধীদের মুবাহালা (পারস্পরিক অভিশাপের মাধ্যমে সত্য নির্ণয়) করার আহ্বান জানাতে, বিশেষ করে যখন বিতর্ক অচলাবস্থায় পৌঁছায়।[৪৫] যদিও শেষপর্যন্ত খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, তবুও মুহাম্মদ (সা.) মুবাহালার জন্য নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আলি (রা.), তাঁর কন্যা ফাতিমা এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসানহুসাইন[৩৫]

মুহাম্মদ (সা.)-এর এই বিশেষ চারজনকে মুবাহালার সাক্ষী ও প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করা ইসলামের ইতিহাসে তাদের মর্যাদাকে বিশেষভাবে উন্নীত করে।[৪৬][৪৭][৪৮] শিয়া ইসলামের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কুরআনের এই আয়াতে 'আমাদের নিজেদের' শব্দগুচ্ছ দ্বারা যদি আলি (রা.) ও মুহাম্মদ (সা.)-কে নির্দেশ করা হয়ে থাকে, তবে তা প্রমাণ করে যে আলি (রা.) কুরআনের দৃষ্টিতে নবীজির সমতুল্য ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।[৪৯][৫০]

Thumb
আরবি ক্যালিগ্রাফিতে খোদাইকৃত শিলালিপি: "আলির চেয়ে বীর যুবক আর নেই, জুলফিকারের চেয়ে উৎকৃষ্ট তরবারিও নেই"

রাজনৈতিক জীবন

মদিনায় আলি (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যক্তিগত সচিব ও বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।[৫১][৩৪] তিনি কুরআনের আয়াতসমূহ লিপিবদ্ধকারী বিশেষ লেখকদের অন্যতম ছিলেন।[২১]

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে আলি (রা.) হুদায়বিয়ার ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির শর্তাবলি লিপিবদ্ধ করেন, যা মুসলিম ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে একটি গুরুত্বপূর্ণ কুরআনিক ঘোষণা প্রচারের জন্য মুহাম্মদ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে প্রত্যাহার করে আলি (রা.)-কে নিয়োগ দেন। সুন্নি হাদিস সংকলন সুনান আন-নাসাঈ অনুসারে এটি ছিল একটি ঐশ্বরিক নির্দেশ।[৫২][৫৩][২২] ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের মক্কা বিজয়ে আলি (রা.)-এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কৌশলী ভূমিকার ফলে এটি একটি রক্তপাতহীন বিজয় হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়। বিজয়ের পর তিনি কাবা শরিফের ভেতরে অবস্থিত সমস্ত মূর্তি অপসারণ করেন।

৬৩১ খ্রিস্টাব্দে আলি (রা.) ইয়েমেনে ইসলাম প্রচারের বিশেষ দূত হিসেবে প্রেরিত হন। তাঁর সফল প্রচারণার ফলে হামদান গোত্র শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম গ্রহণ করে।[৩১] এছাড়াও তিনি বানু জাধিমা গোত্রের সাথে মুসলমানদের সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঠেকিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করেন।

সামরিক জীবন

সারাংশ
প্রসঙ্গ

আলি (রা.) মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রায় সকল সামরিক অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে ৬৩০ সালে তাবুকের যুদ্ধ চলাকালে তিনি মদিনায় অবস্থান করে নগরীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।[৩১] এই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত একটি প্রসিদ্ধ হাদিসে মুহাম্মদ (সা.) আলি (রা.)-কে বলেন: "হে আলি, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, আমার সাথে তোমার সম্পর্ক হারুনমুসা-এর মতো, শুধু এই পার্থক্য যে, আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না?" এই হাদিসটি সুন্নি ইসলামের প্রামাণিক গ্রন্থ সহীহ বুখারীসহীহ মুসলিম-এ বর্ণিত হয়েছে।[৫৪]

শিয়া মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই হাদীসটি আলি (রা.)-এর নবীজির প্রকৃত উত্তরসূরি হওয়ার অধিকারের স্পষ্ট প্রমাণ, যা পরবর্তীতে অস্বীকার করা হয়।[৫৫] নবীজির অনুপস্থিতিতে ৬২৮ সালে আলি (রা.) ফাদাকের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।[৩৪][২১]

Thumb
খায়বারের যুদ্ধে আলি (রা.)-এর বীরত্ব

আলি (রা.)-এর অসামান্য বীরত্ব ও সাহসিকতা ইসলামের ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম।<[৩৫] পরাজিত শত্রুদের প্রতি তাঁর উদারতা ও মানবিক আচরণও সমানভাবে প্রসিদ্ধ ছিল।[৫৬] তিনি বদরের যুদ্ধ (৬২৪) এবং খায়বারের যুদ্ধ (৬২৮)-এ মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহন করেছিলেন।[৫১]

আলি (রা.) উহুদের যুদ্ধ (৬২৫) এবং হুনাইনের যুদ্ধ (৬৩০)-এ নবীজির জীবন রক্ষার্থে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। খায়বারের বিজয় মূলত আলি (রা.)-এর অসীম সাহসিকতার ফল ছিল। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি শত্রু দুর্গের বিশাল লোহার দরজা নিজ হাতে উপড়ে ফেলেছিলেন। ৬২৭ সালে খন্দকের যুদ্ধে আলি (রা.) আমর ইবনে আবদে ওদ নামক প্রসিদ্ধ আরব যোদ্ধাকে পরাজিত করেন।[২২] আত-তাবারির বর্ণনা অনুসারে, উহুদের প্রান্তরে মুহাম্মদ (সা.) একটি ঐশ্বরিক কণ্ঠস্বর শুনতে পান যা বলছিল: "জুলফিকার ছাড়া কোনো প্রকৃত তরবারি নেই এবং আলি ছাড়া কোনো প্রকৃত বীর নেই।"[৫৩] ৬২৬-৬২৭ সালের দিকে, আলি (রা.) এবং তাঁর সহযোদ্ধা যুবাইর ইবনে আল-আওয়াম বনু কুরাইজা গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ তাদের পুরুষ সদস্যদের শাস্তি প্রদানের তত্ত্বাবধান করেন। তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৫৭][৫৮][৫৯]

গাদীর খুম

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজ্জ থেকে ফিরার পথে ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) গাদীরে খুম নামক স্থানে বিশাল হজ্জযাত্রীদের কাফেলা থামান এবং জামাত নামাযের পর তাদের উদ্দেশ্যে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।[৬০] নামায সমাপ্তির পর,[৬১] মুহাম্মদ (সা.) বিপুল সংখ্যক মুসলিমের সমাবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেন, যেখানে তিনি পবিত্র কুরআনের মর্যাদা এবং তাঁর আহলে বাইতের (আক্ষ.'গৃহের লোকজন', অর্থাৎ তাঁর পবিত্র পরিবার) বিশেষ অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।[৬২][৬৩][৬৪][৬৫]

আলি (রা.)-এর হাত ধরে উঠিয়ে মুহাম্মদ (সা.) উপস্থিত মুসলমানদের জিজ্ঞাসা করেন: "আমি কি মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশি আউলা (আক্ষ.'অধিক কর্তৃত্বশীল ও নিকটতর') নই?"[৬৫][৬৬] এই প্রশ্নটি সরাসরি কুরআনের ৩৩:৬ নং আয়াতের ইঙ্গিতবাহী ছিল।[৬৭][৬৮] সমবেত মুসলিমগণ একবাক্যে এতে সম্মতি জানালে,[৬৫] মুহাম্মদ (সা.) মহান ঘোষণা দেন: "আমি যার মাওলা, আলিও তার মাওলা।"[৬৯][৬৫]

সুন্নি প্রামাণিক গ্রন্থ মুসনাদ ইবনে হাম্বল-এ বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মদ (সা.) এই ঘোষণাটি তিন থেকে চারবার পুনরাবৃত্তি করেন এবং খলিফা উমর (রা.) আলিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন: "হে আলি! আজ থেকে তুমি প্রতিটি মুমিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হয়েছ।"[৭০][৬৪] এই ঘটনার অব্যবহিত পূর্বেই মুহাম্মদ (সা.) মুসলিম উম্মাহকে তাঁর সন্নিকটে মৃত্যুর বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।[৭১][৬২][৭২] শিয়া সূত্রসমূহ এই ঘটনাকে কুরআনের ৫:৩ ও ৫:৬৭ নং আয়াতের সাথে স্পষ্টভাবে সম্পৃক্ত করে আরও বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করে।[৭১]

ইসলামী ইতিহাসে গাদীরে খুমের ঐতিহাসিক সত্যতা প্রায় সর্বজনস্বীকৃত,[৬৫][৭৩][৭৪][৬২] কারণ এটি প্রাথমিক ইসলামী সূত্রাবলীতে সর্বাধিক প্রমাণিত ও বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম।[৭৫] তবে মাওলা শব্দটি একটি বহুমাত্রিক অর্থবোধক আরবি পরিভাষা হওয়ায়, গাদীরে খুমের প্রেক্ষাপটে এর ব্যাখ্যা ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। শিয়া পণ্ডিতগণ মাওলা শব্দের অর্থ 'নেতা', 'প্রভু' ও 'পৃষ্ঠপোষক' হিসেবে ব্যাখ্যা করেন,[৭৬] অন্যদিকে সুন্নি আলিমগণ এটিকে আলির প্রতি মহব্বত ও আনুগত্য প্রকাশক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করেন।[২১][৭৭]

এজন্য শিয়া মুসলিমগণ গাদীরে খুমের ঘটনাকে মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আলি (রা.)-কে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিযুক্ত করার স্পষ্ট ঘোষণা হিসেবে গণ্য করেন,[৭৮][৭৯][২২] পক্ষান্তরে সুন্নি আলিমগণ এটিকে নবীজির প্রতি আলির গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রকাশ কিংবা নবীজির নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নে আলির ভূমিকা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।[২১][৬২][৮০] শিয়া পণ্ডিতগণ এই ঘোষণার অসাধারণ তাৎপর্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং কুরআন-হাদীসের দলীল উপস্থাপনপূর্বক মাওলা শব্দের একমাত্র সঠিক অর্থ 'নেতৃত্ব' ও 'কর্তৃত্ব' বলে দাবি করেন।[৭৭][৮১][৭১][৬২][৮২] অপরদিকে সুন্নি গবেষকগণ গাদীরে খুমের ঘটনাকে আলি (রা.) সম্পর্কিত পূর্ববর্তী কিছু প্রশ্নের জবাব হিসেবে বিবেচনা করেন।[৮৩]

আলি (রা.)-এর খিলাফতকালে তিনি মুসলিম উম্মাহকে গাদীরে খুমের সাক্ষ্য প্রদানে আহ্বান করেছিলেন,[৮৪][৮৫][৮৬] যা সম্ভবত তাঁর নেতৃত্বের বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ ছিল।[৮৭]

মুহাম্মাদ (সাঃ) এর যুগ

আলি যখন মদিনায় হিজরত করেছিলেন তখন তার বয়স ২২ বা ২৩ বছর ছিল। মুহাম্মদ(সা) যখন তার সাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করছিলেন, তখন তিনি আলিকে তার ভাই হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে, "আলি ও আমি একই গাছের যখন মানুষ বিভিন্ন গাছের অন্তর্গত হয়।" দশ বছর ধরে মুহাম্মদ(সা) মদীনাতে সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ছিলেন, আলি তার সম্পাদক এবং প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন,প্রতিটি যুদ্ধে ইসলামের পতাকার আদর্শ বাহক ছিলেন, আক্রমণে যোদ্ধাদের দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং বার্তা এবং আদেশ বহন করেছিলেন। মুহম্মদ(সা)র একজন প্রতিনিধি হিসাবে এবং পরে তার ছেলে আইন অনুসারে, আলি মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন৷

ফাতিমার সাথে বিবাহ

মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে মুহাম্মাদ(সা) তার কন্যা ফাতিমার জন্য বহু বৈবাহিক প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আদেশে তাকে আলির সাথে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন। বদরের যুদ্ধের বেশ কয়েকদিন আগে তার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। তবে তিন মাস পরে এই বিবাহ উদ্‌যাপিত হয়েছিল। আলির বয়স প্রায় ২৩ বছর এবং ফাতেমার বয়স ১৮ বছর। এটি সবচেয়ে আনন্দময় এবং উদযাপিত বিবাহ ছিল। তারা ছিলেন আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট দম্পতি। তাদের দুই পুত্র সন্তানের নাম যথাক্রমে হাসান (আল-হ়াসান ইবনে ʿআলি ইবনে ʾআবী ত়ালিব) এবং হুসাইন (হোসাইন ইবনে আলি )।

ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গ

মুহম্মদ(সা) আলিকে কুরআনের পাঠ্য রচনাকারীদের একজন হিসাবে মনোনীত করেছিলেন, যা পূর্ববর্তী দুই দশকে মুহাম্মদ(সা)র প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। ইসলাম যেভাবে আরব জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল, আলি নতুন ইসলামিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। ৬২৮ সালে তাকে হুদায়বিয়ার সন্ধি, মুহাম্মদ(সা) ও কুরাইশের মধ্যে সন্ধি রচনা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আলি এতটাই বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন যে মুহাম্মদ(সা) তাকে বার্তা বহন করতে ও আদেশগুলি ঘোষণা করতে বলেছিলেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে আলি মক্কায় তীর্থযাত্রীদের বিশাল সমাবেশে কুরআনের একটি অংশ আবৃত্তি করেছিলেন যা মুহাম্মদ(সা) এবং ইসলামী সম্প্রদায়কে আরব মুশরিকদের সাথে পূর্ববর্তী চুক্তি দ্বারা আবদ্ধ ঘোষণা করে না। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয়ের সময় মুহাম্মদ (সা)আলিকে নিশ্চয়তা দিতে বলেছিলেন যে এই বিজয় রক্তহীন হবে। তিনি আলিকে বনু আউস, বানু খাজরাজ, তায়ে এবং কাবা'র সমস্ত পূজা মূর্তি ভাঙার আদেশ দিয়েছিলেন যা পুরাতন কালের শিরক দ্বারা এটি অশুচি হওয়ার পরে এটিকে পবিত্র করা হয়েছিল। ইসলামের শিক্ষার প্রচারের জন্য এক বছর পর আলিকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন বিবাদ নিষ্পত্তি এবং বিভিন্ন উপজাতির বিদ্রোহ রোধের দায়িত্ব পালন করেন।

খুলাফায়ে রাশেদীনদের সময় জীবন

সারাংশ
প্রসঙ্গ

মুহাম্মদের (সা.) উত্তরাধিকার

Thumb
অ্যামবিগ্রাম -একক শব্দে লেখা মুহাম্মদ (ডানে) এবং আলি (বামে)। ১৮০ ডিগ্রি উল্টালে উভয় শব্দই প্রতিফলিত হয়।

সাকিফা

নবী মুহাম্মদ (সা.) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন, সেই সময় হযরত আলি (রা.)-এর বয়স ছিল তিরিশ বছরের কাছাকাছি।[৮৮] ইন্তেকালের পর হযরত আলি (রা.) এবং নবীর অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা তাঁর দাফন-কাফনের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত ছিলেন।[৮৯][৯০] এদিকে আনসারদের (মদিনার স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দা, আক্ষ.''সাহায্যকারী'') একটি দল সাকিফা বনু সায়িদা নামক স্থানে সমবেত হন। তাদের এই সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা অথবা মদিনার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা।[৯১] এই সভায় মুহাজিরদের (মক্কা থেকে হিজরতকারী মুসলমান, আক্ষ.''অভিবাসী'') পক্ষ থেকে আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.) কয়েকজন প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

যদিও সাকিফার সভায় হযরত আলি (রা.)-এর নাম নেতৃত্বের প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু তিনি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত না থাকায় এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।[৯২][৯৩] পরবর্তীতে সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের পর আবু বকর (রা.)-কে মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা নির্বাচিত করা হয়। ঐতিহাসিক সূত্রে এই বিতর্ককে অনেকাংশে উত্তপ্ত ও সহিংস বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[৯৪]

এই সিদ্ধান্তে গোত্রীয় রাজনীতি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।[৮৯][৯৫] ঐতিহাসিকদের মতে, যদি এই সিদ্ধান্ত একটি বৃহত্তর পরিষদে (শুরা) নেওয়া হতো এবং হযরত আলি (রা.)-কে প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, তাহলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত।[৯৬][৯৭] বিশেষ করে কুরাইশ গোত্রের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের প্রথা হযরত আলি (রা.)-এর পক্ষে ছিল,[৯৮][৯৯][১০০] কেননা তিনি নবী পরিবারের সদস্য এবং নবীর নিকটাত্মীয় ছিলেন। তবে তাঁর অপেক্ষাকৃত যুবক বয়স এই অবস্থানকে কিছুটা দুর্বল করে দিয়েছিল।[৩৪][৮৮] অন্যদিকে, আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতের সমর্থনে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর অসুস্থতার শেষ দিনগুলোতে কিছু নামাজের ইমামতি করার দায়িত্ব আবু বকরকে দিয়েছিলেন।[৮৯][১০১] তবে এই প্রতিবেদনের ঐতিহাসিক সত্যতা এবং এগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।[৮৯][১০২][১০৩]

ফাতিমার ঘরে আক্রমণ

যদিও আবু বকরের খিলাফত মদিনার সাধারণ জনগণের মধ্যে তেমন কোনো বড় ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়নি,[১০১] কিন্তু বনু হাশিম গোত্র এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবি দ্রুত আলি (রা.)-এর বাসভবনে একত্রিত হয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।[১০৪][১০৫] এই প্রতিবাদকারীদের মধ্যে হযরত জুবায়ের (রা.) এবং নবীর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.)-এর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।[১০৫] তারা গাদিরে খুমের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে হযরত আলি (রা.)-কেই নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত ও যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করতেন।[৩৭][১০৬][৬২] প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে জারির তাবারী তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, হযরত উমর (রা.) একটি সশস্ত্র দল নিয়ে হযরত আলি (রা.)-এর বাসভবনে উপস্থিত হন এবং স্পষ্ট ভাষায় হুমকি দেন যে, যদি আলি (রা.) ও তাঁর অনুসারীরা আবু বকর (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করেন, তবে তিনি বাড়িটি জ্বালিয়ে দেবেন।[১০৭][৩৭][১০৮][১০৯] এই পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠলে,[১১০][১১১] হযরত ফাতিমা (রা.)-এর হস্তক্ষেপ ও অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে উমর (রা.) ও তাঁর দল সেখান থেকে ফিরে যান।[১০৭]

পরবর্তীতে আবু বকর (রা.) বনু হাশিম গোত্রের উপর একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট আরোপ করতে সক্ষম হন,[১১২] যার ফলে তারা শেষ পর্যন্ত হযরত আলি (রা.)-কে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন।[১১২][১১৩] ঐতিহাসিকদের মতে, হযরত ফাতিমা (রা.)-এর মৃত্যু পর্যন্ত হযরত আলি (রা.) আবু বকর (রা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করেননি। উল্লেখ্য যে, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের মাত্র ছয় মাস পরেই হযরত ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেন।[১১৪] শিয়া সূত্রসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ফাতিমা (রা.)-এর মৃত্যু (এবং তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের গর্ভপাত) তাঁর বাসভবনে সংঘটিত হামলার ফলশ্রুতি ছিল, যা মূলত আবু বকর (রা.)-এর নির্দেশনায় হযরত আলি (রা.)-এর বিরোধিতা দমনের জন্য সংঘটিত হয়েছিল বলে তারা দাবি করে।[১১৫][৩৭][১০৬] অন্যদিকে সুন্নি পণ্ডিতরা এই দাবির সত্যতা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন,[১১৬] তবে তাদেরই কিছু প্রাচীন সূত্রে হযরত ফাতিমা (রা.)-এর গৃহে জোরপূর্বক প্রবেশ এবং হযরত আলি (রা.)-কে গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ রয়েছে।[১১৭][১১৮][১১৯] মজার ব্যাপার হলো, সুন্নি সূত্রেই বর্ণিত আছে যে, আবু বকর (রা.) তাঁর মৃত্যুশয্যায় এই ঘটনার জন্য গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন।[১২০][১২১]

ঐতিহাসিকদের মতে, সম্ভবত বানু হাশিম গোত্রকে দুর্বল করার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে,[১২২][১২৩][১২৪][১২৫] আবু বকর (রা.) ফাতিমার ফাদাকের উর্বর কৃষিজমি হযরত ফাতিমা (রা.)-এর কাছ থেকে জব্দ করে নেন। হযরত ফাতিমা (রা.) এই সম্পত্তিকে তাঁর পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত (অথবা বিশেষ উপহার হিসেবে প্রাপ্ত) সম্পত্তি বলে দাবি করেছিলেন।[১২৬][১২৭] ফাদাক বাজেয়াপ্তকরণের এই সিদ্ধান্তকে সুন্নি সূত্রসমূহে একটি হাদিসের মাধ্যমে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে এই হাদিসের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে, বিশেষত যখন এটি কুরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত স্পষ্ট বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।[১২৬][১২৮]

আবু বকরের খিলাফতকাল (৬৩২–৬৩৪)

জনসমর্থনের অভাবে এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য রক্ষার স্বার্থে হযরত আলি (রা.) শেষ পর্যন্ত আবু বকর (রা.)-এর খিলাফত মেনে নিতে বাধ্য হন।[১২৯][১৩০][১৩১] তবে তিনি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের যে কোনো প্রস্তাবকে স্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[১৩২][৩৪] হযরত আলি (রা.) নিজেকে নেতৃত্বের জন্য সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন, কারণ তিনি ব্যক্তিগত গুণাবলি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি নবী পরিবারের সদস্য হওয়ার অনন্য যোগ্যতা রাখতেন।[১৩৩][১৩৪][১৩৫] বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে, হযরত আলি (রা.) নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক মনোনীত প্রকৃত উত্তরসূরি হিসেবেও গণ্য করতেন।[১৩৬][৮৫][১৩৭]

যদিও নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হযরত আলি (রা.) ইসলামের প্রচার-প্রসার ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন,[১৩৮][১৩৯] আবু বকর (রা.) ও পরবর্তীতে হযরত উমর (রা.) এবং হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে তিনি স্বেচ্ছায় জনজীবন থেকে অনেকটা দূরে সরে যান।[২১][১৩৮][৩৫] তিনি রিদ্দার যুদ্ধ এবং প্রাথমিক মুসলিম বিজয় অভিযানসমূহে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন,[৩৫] যদিও তিনি আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)-কে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করতেন।[২১][৩৫]

ঐতিহাসিক সূত্রসমূহে হযরত আলি (রা.) ও প্রথম দুই খলিফার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত মতবিরোধের উল্লেখ পাওয়া যায়,[১৪০][১৪১][১৪২] যদিও সুন্নি ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতে এই বিরোধের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে।[১৪৩][১৪৪] এই মতপার্থক্য বিশেষভাবে প্রকট হয়ে উঠে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের সময়, যখন হযরত আলি (রা.) প্রথম দুই খলিফার প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টান্ত ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানান।[১৩৯][১৩৮] অন্যদিকে শিয়া ঐতিহাসিক সূত্রসমূহে দাবি করা হয় যে, হযরত আলি (রা.)-এর আবু বকর (রা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র (তাকিয়া), যা তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে ও অনুসারীদের রক্ষার জন্য প্রয়োগ করেছিলেন।[১৪৫] তবে কিছু গবেষক মনে করেন যে শিয়া সূত্রগুলোতে হযরত আলি (রা.)-এর বিরোধের বিষয়টি কিছুটা অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।[১৪৩]

উমরের খিলাফতকাল (৬৩৪–৬৪৪)

৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেন।[১৪৬] তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হযরত আলি (রা.)-এর সাথে কোনো ধরনের পরামর্শ করা হয়নি এবং প্রাথমিকভাবে এই সিদ্ধান্ত কয়েকজন প্রবীণ সাহাবি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।[১৪৭]

এই সময়কালে হযরত আলি (রা.) নিজে থেকে কোনো নেতৃত্বের দাবি উত্থাপন না করে উমর (রা.)-এর শাসনামলে সাধারণ জনজীবন থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে রাখেন।[১৪৮] তবে উমর (রা.) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলি (রা.)-এর পরামর্শ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়।[২১][১৪৯] ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে মদিনায় হিজরতকে নির্ধারণ করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি হযরত আলি (রা.)-এরই প্রস্তাব বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়।[৩১]

অনেক ক্ষেত্রে হযরত আলি (রা.)-এর রাজনৈতিক পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন।[৩৪] বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, যখন উমর (রা.) রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বণ্টনের জন্য ইসলামে অবদানের ভিত্তিতে একটি বিশেষ ব্যবস্থা (দেওয়ান) প্রবর্তন করেন,[১৫০] তখন আলি (রা.) স্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেন যে নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং আবু বকর (রা.)-এর নীতি অনুসরণ করে এই সম্পদ সমানভাবে বিতরণ করা উচিত ছিল।[১৫১][৩৪]

হযরত আলি (রা.) দামেস্কের নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সভাসমূহে সাধারণত অনুপস্থিত থাকতেন।[৩৪] তিনি উমর (রা.)-এর সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন সামরিক অভিযানেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি,[১৫২][২৩] যদিও তিনি কখনো প্রকাশ্যে এসব অভিযানের বিরোধিতা করেননি।[২৩]

ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, হযরত উমর (রা.) সম্ভবত মনে করতেন যে নবুয়তখিলাফত উভয়ই বনু হাশিম গোত্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত নয়।[১৫৩][১৫৪] এই বিশ্বাসই তাকে নবীজির মৃত্যুশয্যায় ওসিয়্যাহ (উইল) লিখতে বাধা দিতে প্ররোচিত করেছিল,[৬৩][১৫৫][১৫৬] বিশেষত এই আশঙ্কায় যে নবীজি স্পষ্টভাবে হযরত আলি (রা.)-কে তার উত্তরসূরি মনোনীত করবেন।[১৫৭]

তবে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য হযরত আলি (রা.) ও বনু হাশিম গোত্রের সহযোগিতা অপরিহার্য বিবেচনা করে উমর (রা.) তাদের প্রতি কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন।[১৫৮] উদাহরণস্বরূপ, তিনি মদিনায় অবস্থিত নবীজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হযরত আলি (রা.)-এর নিকট ফিরিয়ে দেন, যদিও ফাদাকখায়বার এর মত গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণেই রাখেন।[১৫৯]

কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় যে হযরত উমর (রা.) হযরত আলি (রা.)-এর কন্যা উম্মে কুলসুমের সাথে বিবাহের ব্যাপারে জোর প্রয়াস চালান। প্রথমে হযরত আলি (রা.) এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানালেও, পরবর্তীতে যখন উমর (রা.) জনসমর্থন নিয়ে তার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন, তখন তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্মতি দেন।[১৬০]

উসমানের নির্বাচন (৬৪৪)

Thumb
তারিখনামা গ্রন্থে বর্ণিত উসমানের খলিফা নির্বাচনের দৃশ্য

৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর (রা.)-এর মৃত্যুর পূর্বে,[১৬১] তিনি একটি ছয় সদস্যবিশিষ্ট শুরা কমিটি গঠন করেন যাদের দায়িত্ব ছিল নিজেদের মধ্য থেকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করা।[১৬২] এই কমিটিতে হযরত আলি (রা.) এবং হযরত উসমান (রা.) ছিলেন প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী।[১৬৩][১৬৪] কমিটির সকল সদস্যই কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তারা মহানবী (সা.)-এর প্রথম দিকের সাহাবাদের মধ্যে গণ্য হতেন।[১৬২]

শুরা কমিটির সদস্য আবদুর রহমান ইবনে আউফকে হয় কমিটি অথবা স্বয়ং উমর (রা.) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।[১৬৫][১৬৬][১৬৭] দীর্ঘ আলোচনার পর, ইবন আওফ (রা.) তার ভগ্নিপতি হযরত উসমান (রা.)-কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন।[১৬৮][১৬৯] উসমান (রা.) এই সময় প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর নীতিমালা অনুসরণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন।[১৬৮]

অন্যদিকে, হযরত আলি (রা.) এই শর্তে সম্মত হতে অস্বীকৃতি জানান,[১৬৮][১৬৭] অথবা কৌশলগতভাবে অস্পষ্ট উত্তর প্রদান করেন বলে কিছু সূত্রে উল্লেখ রয়েছে।[১৭০] এই শুরা কমিটিতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো আনসার সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল না,[১৭১][১৬৬] এবং ঐতিহাসিকদের মতে এটি স্পষ্টতই উসমান (রা.)-এর পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।[১৭২][১৭৩][১৬৭]

এই দুটি কারণই হযরত আলি (রা.)-এর বিরুদ্ধে কাজ করেছিল।[১৬৬][১৭৪][১৭৫] তবে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাকে সরাসরি নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়াও সম্ভব ছিল না।[১৭৬]

উসমানের খিলাফতকাল (৬৪৪–৬৫৬)

হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি,[১৭৭] প্রশাসনিক দুর্নীতি[১৭৮][১৭৯] এবং ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়।[১৮০] হযরত আলি (রা.)ও উসমান (রা.)-এর বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করেন,[৩৪][২৩][১৮১] বিশেষ করে তার আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অত্যধিক অর্থ বিতরণের নীতির বিরোধিতা করেন।[১৮২][১৮৩]

হযরত আলি (রা.) সত্যবাদী সাহাবিদের যেমন আবু যার (রা.)আম্মার (রা.)-কে রক্ষা করেছিলেন[১৮৪][১৮৫] এবং সামগ্রিকভাবে উসমান (রা.)-এর শাসনকে সংযত রাখার চেষ্টা করেছিলেন।[১৮৪] আলি (রা.)-এর কিছু অনুসারী এই বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন,[১৮৬][১৮৭] যাদের সাথে যোগ দেন তালহা (রা.), জুবাইর (রা.)—যারা উভয়েই নবীজির ঘনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন—এবং নবীজির স্ত্রী আয়িশা (রা.)[১৮৮][১৮৯][১৮৬]

আলি (রা.) এর এসব সমর্থকদের মধ্যে মালিক আল-আশতার (রা.) এবং অন্যান্য ধর্মীয়ভাবে শিক্ষিত কুররাআ (আক্ষ.'কুরআন পাঠক') ব্যক্তিত্বরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[১৯০][১৮৩] যদিও তারা আলি (রা.)-কে পরবর্তী খলিফা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সাথে আলি (রা.)-এর কোনো প্রকার সমন্বয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় না।[১৯১]

বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিতে আলি (রা.)-কে অনুরোধ করা হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন,[৩৪][১৯২] যদিও তাদের অভিযোগের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে মনে করা হয়।[১৯৩][১৯২] নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।[১৯৪][৩৪]

উসমানের হত্যাকাণ্ড (৬৫৬)

৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অসন্তুষ্ট জনগণ মদিনায় সমবেত হয়।[৩৫] মিশরীয় বিদ্রোহীরা আলি (রা.)-এর পরামর্শ চাইলে তিনি তাদেরকে উসমান (রা.)-এর সাথে আলোচনার পরামর্শ দেন।[১৯৫][১৯৬] একইভাবে, ইরাকের বিদ্রোহীদেরকে তিনি সহিংসতা পরিহার করার উপদেশ দেন, যা তারা মেনে নেয়।[১৯৭]

আলি (রা.) বারবার উসমান (রা.) ও বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন,[৩৫][১৯৮][১৯৯] যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অভিযোগের সমাধান করা যায়।[২০০][৩৫] বিশেষ করে, প্রথম অবরোধের অবসানে চুক্তি সম্পাদনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং এর বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেন।[২০১][৩৫]

পরবর্তীতে, আলি (রা.) উসমান (রা.)-কে প্রকাশ্যে অনুতপ্ত হওয়ার জন্য রাজি করান,[২০২] কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই উসমান (রা.) তার ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেন। এটি সম্ভবত তার সচিব মারওয়ান ইবন আল-হাকাম-এর চাপে ঘটেছিল।[২০৩] মিশরীয় বিদ্রোহীরা পুনরায় উসমান (রা.)-এর বাড়ি অবরোধ করে, যখন তারা একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি আটকায় যাতে তাদের শাস্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিদ্রোহীরা উসমান (রা.)-এর পদত্যাগ দাবি করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিঠির ব্যাপারে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।[২০৪]

প্রাথমিক সূত্রগুলোতে এই চিঠির জন্য সাধারণত মারওয়ানকেই দায়ী করা হয়।[২০৫][২০৬] আলি (রা.)ও উসমান (রা.)-এর পক্ষ নেন,[২০৪] কিন্তু উসমান (রা.) সম্ভবত চিঠির ব্যাপারে তাকে দায়ী করেন।[২০৭] সম্ভবত এই ঘটনার পরেই আলি (রা.) আর উসমান (রা.)-এর পক্ষে কোনো মধ্যস্থতা করতে অস্বীকার করেন।[২০৪][১৯৪]

এর অল্পদিন পরেই, মিশরীয় বিদ্রোহীরা উসমান (রা.)-কে হত্যা করে।[২০৫][২০৮][২০৯] আলি (রা.) এই হত্যাকাণ্ডে কোনো ভূমিকা রাখেননি,[৩৪][২১০] বরং তার পুত্র হাসান (রা.) বিদ্রোহীদের অবরোধকালে উসমান (রা.)-এর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এবং এতে আহত হন।[২১][২১১][১৮৬] অবরোধের সময় আলি (রা.) বিদ্রোহীদেরকে উসমান (রা.)-এর বাড়িতে পানি সরবরাহের অনুমতি দিতে রাজি করিয়েছিলেন।[২০৪][১৮৪]

খিলাফত

সারাংশ
প্রসঙ্গ

আলির খিলাফত নির্বাচন (৬৫৬)

Thumb
হযরত আলি (রা.) বাইআত গ্রহণ করছেন, ষোড়শ শতকের শেষভাগে অঙ্কিত চিত্র

৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত উসমান (রা.) মিশরীয় বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদাত বরণ করলে, খিলাফতের জন্য প্রধান দুই দাবিদার হিসেবে হযরত আলি (রা.) এবং হযরত তালহা (রা.)-এর নাম উঠে আসে। উমাইয়ারা মদিনা ত্যাগ করলে নগরীর নিয়ন্ত্রণ প্রাদেশিক বিদ্রোহী ও আনসারদের হাতে চলে যায়। মিশরীয়দের মধ্যে তালহার কিছু সমর্থন থাকলেও, ইরাকের অধিবাসী ও অধিকাংশ আনসার আলির পক্ষে ছিলেন।[১২৯] বেশিরভাগ মুহাজির সাহাবি,[৩৫][১৯২][২১২] এবং কিছু প্রভাবশালী গোত্রীয় নেতা তখন আলিকে সমর্থন করছিলেন।[২১৩] এই গোষ্ঠীগুলো আলিকে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য জোরালো আহ্বান জানায়। কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর,[১৯২][৩৫][২৩] আলি সর্বসমক্ষে এই দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন।[২১৪][২১৫][২১৬] ধারণা করা হয়, মালিক আল-আশতার (রা.) প্রথম ব্যক্তি যিনি আলির হাতে আনুষ্ঠানিক বাইয়াত দান করেন।[২১৬]

হযরত তালহা ও জুবাইর, যারা নিজেরাও খিলাফতের দাবিদার ছিলেন,[২১৭][২১৮] প্রথমে স্বেচ্ছায় বাইয়াত দান করেছিলেন,[২৩][২১৯][২১১] কিন্তু পরবর্তীতে তারা তাদের শপথ ভঙ্গ করেন।[২২০][২৩][২২১] আলি সম্ভবত কাউকে জোরপূর্বক বাইয়াত করতে বাধ্য করেননি,[২১৪] যদিও কিছু লোক পরবর্তীতে দাবি করেছিল যে তারা চাপে পড়ে বাইয়াত দান করেছিল।[২২২] তবে এটা সত্য যে, মদিনায় আলির সমর্থকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় অন্যদের উপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করেছিল।[২২৩]

খিলাফতের বৈধতা

Thumb
হযরত আলি (রা.)-এর বাইআত গ্রহণের আরেকটি চিত্রণ

হযরত উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের জন্য হযরত আলি (রা.) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[২২৪][১৯৮][২২৫] যদিও তার নির্বাচন আনুষ্ঠানিক শুরা পদ্ধতিতে হয়নি,[১২৯] তবুও মদিনায় এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি।[২১০][২২৬][২২৪] তবে বিদ্রোহীদের সমর্থন লাভের কারণে তাকে উসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়।[৩৪] যদিও সাধারণ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী সহজেই আলির পাশে দাঁড়ায়,[২২৭][২১৭] কিন্তু কুরাইশ গোত্রের প্রভাবশালী অংশের মধ্যে তার সমর্থন সীমিত ছিল, কারণ তাদের অনেকেই নিজেরা খিলাফতের দাবিদার ছিলেন।[২২৮][১২৯]

কুরাইশদের মধ্যে প্রধানত দুটি গোষ্ঠী আলির বিরোধিতা করেছিল: একদিকে উমাইয়া বংশ, যারা উসমান (রা.)-এর পর খিলাফতকে নিজেদের অধিকার মনে করত; অন্যদিকে, যারা আবু বকর (রা.)উমর (রা.)-এর সময়কার নীতির ভিত্তিতে কুরাইশদের নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীই কুরাইশদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।[২২০][২১০] হযরত আলি (রা.) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে নবী পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্বের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারী,[২২৯][২৩০] যা কুরাইশদের অন্যান্য গোত্রের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করছিল।[২৩১]

প্রশাসনিক নীতিমালা

Thumb
আরব-সাসানীয় মুদ্রা যা বিশাপুর-এ হযরত আলি (রা.)-এর শাসনকালে মুদ্রিত হয়েছিল। মুদ্রাটিতে আরবিসাসানীয় প্রতীক সংমিশ্রণ দেখা যায়, যেখানে মুকুটধারী দ্বিতীয় খসরু-এর চিত্র, পবিত্র অগ্নিকুণ্ড কেন্দ্রস্থলে, অর্ধচন্দ্র-তারার প্রতীক এবং বিসমিল্লাহ আরবি লিপিতে প্রান্তে খোদাই করা রয়েছে।[২৩২]

বিচার ব্যবস্থা

হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফতকাল কঠোর ন্যায়নীতি বাস্তবায়নের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে।[২৩৩][২৩৪][৩৫] তিনি নবুয়তী যুগের শাসনাদর্শ পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেন,[২৩৫][২৩৬][২৩৭] এবং হযরত উসমান (রা.)-এর নিয়োগকৃত প্রায় সকল প্রাদেশিক শাসককে অপসারণ করেন,[২২৮] যাদেরকে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত বিবেচনা করতেন।[২৩৮]

রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রাপ্ত সম্পদ হযরত আলি (রা.) মুসলিম জনগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করতেন, যা সরাসরি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসৃত নীতির প্রতিফলন ছিল।[২৩৯] তিনি প্রশাসনের সকল স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করেন।[২৪০][২৪১] এই সাম্যবাদী নীতি কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট করে, যারা উসমান (রা.)-এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার অজুহাতে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।[২৪২] এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুয়াবিয়া, যিনি তখন সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।[১৮৭]

কিছু ঐতিহাসিক হযরত আলি (রা.)-কে রাজনৈতিক কূটকৌশলের অভাব এবং অতিমাত্রায় অনমনীয়তার জন্য সমালোচনা করেন,[৩৪][২৪৩] অন্যদিকে অনেকে তাকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অটুট অবস্থানের জন্য প্রশংসা করেন।[২৪২][২৩৭] তার সমর্থকরা যুক্তি দেখান যে, নবী (সা.)-এর যুগেও অনুরূপ কঠোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল,[২৪৪][২৪৫] এবং ইসলামী ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। তারা কুরআনের ৬৮:৯ নং আয়াত উদ্ধৃত করেন, যেখানে বলা হয়েছে: "তারা তো এ কামনায় রয়েছে যে আপনি নমনীয় হোন, অতঃপর তারাও নমনীয় হয়ে যাবে।"[২৪৫][২৪৬]

সমসাময়িক গবেষকদের একটি অংশ মনে করেন, হযরত আলি (রা.)-এর গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ কেবল নীতিগত দিক থেকেই নয়, বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখেও সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ছিল।[২১৫][২৪৭][৩৫] বিশেষত জনগণের ন্যায়বিচারের দাবি পূরণের জন্য অজনপ্রিয় গভর্নরদের অপসারণ তার জন্য একমাত্র সম্ভাব্য পথ ছিল।[২১৫]

ধর্মীয় কর্তৃত্ব

হযরত আলি (রা.) তাঁর বিভিন্ন জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি কেবল মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক নেতাই নন, বরং একমাত্র বৈধ ধর্মীয় কর্তৃত্বও বটে।[২৪৮] তিনি কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার একচ্ছত্র অধিকার দাবি করতেন।[২৪৯][২৫০] তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীরা তাঁকে ঐশী-নির্দেশিত নেতা হিসেবে বিবেচনা করতেন, যিনি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ন্যায় পূর্ণ আনুগত্য পাওয়ার যোগ্য।[২৫১] তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আলির প্রতি তাঁদের আধ্যাত্মিক আনুগত্য (উয়ালায়া) সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী, যা কেবল রাজনৈতিক আনুগত্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।[২৫২]

প্রায় ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে আলির একদল অনুসারী প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ঘোষণা করেন।[২৫৩][২৫৪] তাঁরা আলির প্রতি তাঁদের পূর্ণ আনুগত্যকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো উপস্থাপন করতেন: আলির ব্যক্তিগত গুণাবলি ও ইসলামে তাঁর অগ্রগণ্যতা[২৫৫], নবী পরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর মর্যাদা[২৫৬], গাদির খুমের ঐতিহাসিক ঘোষণা[২৫২]

এই অনুসারীদের অনেকেই নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর থেকেই আলিকে তাঁর প্রকৃত উত্তরসূরি মনে করতেন,[২৫৭] যা সে সময়কার আরবি কবিতায়ও প্রতিফলিত হয়েছে।[২৫৮][২৫৯]

অর্থনৈতিক নীতি

হযরত আলি (রা.) প্রাদেশিক রাজস্বের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারির বিরোধিতা করেছিলেন।[২১৩] তিনি অতিরিক্ত কর আদায় বন্ধ করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও রাজস্ব মুসলিম জনগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করতেন,[২১৩][৩৪] যা সরাসরি নবী (সা.) ও হযরত আবু বকর (রা.)-এর নীতির অনুরূপ ছিল।[২৬০][২৩৯]

অন্যদিকে, হযরত উমর (রা.) ইসলামে অবদানের ভিত্তিতে রাজস্ব বণ্টন করতেন,[২৬১][২৬২] আর হযরত উসমান (রা.) স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন।[১৭৭][২৬৩][১৭৮]

আলির (রা.) এই সাম্যবাদী নীতি তাঁকে নিম্নবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির ব্যাপক সমর্থন এনে দেয়, বিশেষত আনসার, কুররাআ (কুরআন বিশেষজ্ঞ) এবং ইরাকের নতুন মুসলিমদের।[২২৭] কিন্তু হযরত তালহা (রা.) ও হযরত যুবাইর (রা.)-এর মতো কুরাইশ বংশীয় ধনী সাহাবিগণ, যারা উসমান (রা.)-এর শাসনামলে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন,[২৬৪] আলির কঠোর নীতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে বিদ্রোহ করেন।[২৬৫][২৩৯]

আলি (রা.) এমনকি নিজ আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও সরকারি তহবিল থেকে বিশেষ সুবিধা দিতে অস্বীকার করায়[২৬৬][২৬৭] আরও কিছু কুরাইশ নেতা তাঁর বিরোধিতা শুরু করেন।[২৬৮][২৬৯] অন্যদিকে, তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়া (রা.) সহজেই ঘুষ ও অর্থের বিনিময়ে সমর্থন কিনে নিতেন।[২৬৯][২৭০]

হযরত আলি (রা.) তাঁর প্রশাসকদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে কর আদায়ে জনগণের ওপর কোনো প্রকার জবরদস্তি না করা[২৭১], সরকারি তহবিল বণ্টনে দরিদ্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া[২৭১], কর আদায়ের চেয়ে কৃষি উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া[২৭২][২৭৩]

যুদ্ধের নীতি

মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় হযরত আলি (রা.) তাঁর সৈন্যদের জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে লুটপাট করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন[২৭৪], পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের নিয়মিত বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন[২৭৪]। যুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি পরাজিত শত্রুদের ক্ষমা প্রদর্শনে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন[২৭৫][২৭৬]। এই দুটি নীতিমালা পরবর্তীতে ইসলামি আইনশাস্ত্রে গৃহীত হয়[২৭৫]

হযরত আলি (রা.) তাঁর সেনাপতি মালিক আল-আশতারকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন: শান্তির প্রস্তাব অবহেলা না করতে, কোনো চুক্তি লঙ্ঘন না করতে[২৭৭], প্রথমে আক্রমণ না করার নীতি মেনে চলতে[২৭৮]

তিনি সৈন্যদের জন্য বিশেষ আচরণবিধি প্রণয়ন করেছিলেন: বেসামরিক জনগণকে হয়রানি না করতে[২৭৯], আহত ও পলায়নপর শত্রুসৈন্য হত্যা না করতে, মৃতদেহ বিকৃত না করতে, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত বাসস্থানে প্রবেশ না করতে, কোনো প্রকার লুটতরাজ না করতে, নারীদের প্রতি কোনো প্রকার অত্যাচার না করতে।[২৮০]

একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে তিনি বিজয়ের পর নারীদের দাসে পরিণত করার প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন, যদিও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল[৩৪]সিফফিনের যুদ্ধের সময় মুয়াবিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় তিনি প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে বিরত থাকেন এবং কৌশলগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শত্রুদের পানির উৎস ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন[২৮১][২৮২]

উটের যুদ্ধ

Thumb
Siyer-i nebi পাণ্ডুলিপি থেকে উটের যুদ্ধের চিত্র

হযরত আলি (রা.)-এর খিলাফত গ্রহণের অব্যবহিত পরেই হযরত আয়িশা (রা.) প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন।[২৮৩][২২৮] তিনি মক্কায় গিয়ে হযরত তালহা (রা.) ও হযরত যুবায়ের (রা.)-এর সাথে মিলিত হন,[২৮৪] যারা পূর্বে আলির হাতে বাইআত করলেও পরে তা ভঙ্গ করেন।[২২০][২৩][২২১]</ref> এই বিরোধী পক্ষ হযরত উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি তোলে[২৮৫][১৯৮] এবং আলিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে অভিযুক্ত করে।[৩৫] তারা আলিকে পদত্যাগের দাবি জানায় এবং কুরাইশ নেতাদের একটি পরিষদ গঠন করে নতুন খলিফা নির্বাচনের প্রস্তাব করে।[২৮৬]

ঐতিহাসিকদের মতে, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্ভবত উসমানের হত্যার প্রতিশোধ নয়, বরং আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করাই ছিল।[২৮৭][২৮৮] অথচ এই ব্যক্তিরাই পূর্বে উসমানের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।[২১১][১৮৮][২৮৯][২৯০][২৯১] হেজাজ অঞ্চলে তারা পর্যাপ্ত সমর্থন না পেয়ে[৩৪] বাসরা শহর দখল করে নেয় এবং সেখানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়।

হযরত আলি (রা.) কুফা থেকে এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন,[২৯২] যা পরবর্তীতে তাঁর প্রধান সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। উভয় পক্ষ বাসরার নিকটবর্তী এলাকায় শিবির স্থাপন করে,[২৯৩] এবং প্রতিটি বাহিনীতে প্রায় দশ হাজার সৈন্য ছিল বলে অনুমান করা হয়।[২৯৪] তিন দিনব্যাপী আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর,[২৯৫] উভয় পক্ষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

যুদ্ধের বিবরণ

এই ঐতিহাসিক যুদ্ধটি ৬৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত হয়েছিল।[২৯৬][২৯৭] বিদ্রোহী বাহিনী প্রথমে আক্রমণ শুরু করে,[২১১][২৯৮] যেখানে আয়িশা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি একটি বর্ম দ্বারা সুরক্ষিত বিশেষ হাওদায় (পালকী) অবস্থান করছিলেন, যা একটি লাল বর্ণের উটের পিঠে স্থাপন করা হয়েছিল।[২৯৯][৩০০] এই অনন্য দৃশ্যের কারণেই পরবর্তীতে এই যুদ্ধটি "উটের যুদ্ধ" নামে পরিচিতি লাভ করে।

যুদ্ধের সময় খলিফা উসমান (রা.)-এর সচিব মারওয়ান ইবনে হাকাম বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যেই অবস্থান করছিলেন এবং তিনিই তালহা (রা.)-কে হত্যা করেন।[৩০১][৩০২] অন্যদিকে, প্রখ্যাত সাহাবী ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা জুবাইর (রা.) যুদ্ধ শুরুর অল্প সময় পরেই রণক্ষেত্র ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন,[২৯৮][২১১] কিন্তু পরবর্তীতে তাকে ধাওয়া করে হত্যা করা হয়। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায় যে তিনি এই সংঘর্ষের নৈতিক ভিত্তি নিয়ে গভীরভাবে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।[২৯৮][২১১]

যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল ছিল আলি (রা.)-এর বিজয়।[৩০৩][২১১] বিজয়ের পর তিনি আয়িশাকে পূর্ণ সম্মান[২১১][৩০৪][২১৫] ও নিরাপত্তার সাথে হেজাজে প্রেরণ করেন।[৩০৫][২১১][২৯৬] আলি (রা.) একটি সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা প্রদান করেন[৩০৬], যার মাধ্যমে সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয় - এমনকি মারওয়ানকেও এই ক্ষমার আওতায় আনা হয়।[৩০৭][৩০৫] এছাড়াও তিনি নারীদের দাসত্বে নেওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে বাজেয়াপ্তকৃত সকল সম্পত্তি তাদের প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন।[৩০৮] পরবর্তীতে আলি কুফা শহরে স্থায়ীভাবে অবস্থান নেন,{{Sfn|Madelung|1997|p=182} যা ধীরে ধীরে তাঁর শাসনামলের কার্যকর রাজধানীতে পরিণত হয়।[২৯৬][২৮৮]

সিফফিনের যুদ্ধ

Thumb
প্রথম ফিতনার মানচিত্র; সবুজ রঙে আলির নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল; গোলাপি রঙে মুয়াবিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল
Thumb
তারিখনামা গ্রন্থে চিত্রিত সিফফিনের যুদ্ধে আলি ও মুয়াবিয়ার বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষ

সিরিয়ার তৎকালীন গভর্নর মুয়াবিয়াকে খলিফা আলি (রা.) প্রশাসনিক দুর্নীতিতে জড়িত ও পদে অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।[২৩৮] এ কারণে আলি (রা.) তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি মারফত গভর্নর পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দেন।[৩০৯][৩১০][৩১১] এর প্রতিক্রিয়ায় মুয়াবিয়া, যিনি খলিফা উসমান (রা.)-এর চাচাতো ভাইও ছিলেন, সিরিয়া জুড়ে একটি ব্যাপক প্রচারণা চালু করেন। এই প্রচারণায় তিনি আলি (রা.)-কে উসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেন এবং এজন্য প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বান জানান।[৩১২][৩১৩][৩১৪]

রাজনৈতিক সমর্থন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুয়াবিয়া প্রখ্যাত সেনানায়ক আমর ইবনুল আসের সাথে একটি জোট গড়ে তোলেন।[৩১৫] আমর ইবনুল আস ছিলেন একজন সুপরিচিত রণকৌশলবিদ।[৩১৬] তিনি মিশরের গভর্নর পদ আজীবনের জন্য লাভের শর্তে উমাইয়া বাহিনীতে যোগ দেন।[৩১৭] অবশ্য মুয়াবিয়া গোপনে আলি (রা.)-এর কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, আলি (রা.) যদি তাকে সিরিয়া ও মিশরের শাসনভার ছেড়ে দেন তবে তিনি আলি (রা.)-এর খিলাফত মেনে নেবেন।[৩১৮] কিন্তু আলি (রা.) এই শর্তসাপেক্ষ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।[৩১৯]

এ অবস্থায় মুয়াবিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি আলি (রা.)-কে খলিফা উসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ দাবি করেন। পাশাপাশি তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য সিরিয়ায় একটি শুরা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব দেন।[৩২০] আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, মুয়াবিয়ার এই প্রতিশোধের দাবি প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের একটি কৌশলমাত্র ছিল।[৩২১][৩২২][৩২৩][৩২৪][৩২৫][৩২৬]

যুদ্ধের বিবরণ

৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে আলি (রা.) ও মুয়াবিয়ার বাহিনী ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিফফিন নামক স্থানে তাদের সামরিক শিবির স্থাপন করে।[৩২৭] আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, আলি (রা.)-এর বাহিনীতে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য ছিল, অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার।[৩২৮] এই যুদ্ধে আলি (রা.)-এর পক্ষে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বহুসংখ্যক সাহাবী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিপরীতে মুয়াবিয়ার বাহিনীতে সাহাবীদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য।[২৩৪][৩২৮]

উভয় পক্ষ কয়েকদিন ধরে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চালিয়েও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি।[১৯৮][৩২৯][৩৫][৩৩০][৩৩১] অবশেষে ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই, বুধবার মূল যুদ্ধ শুরু হয়[৩২৬][৩২১] যা টানা তিন দিন ধরে চলতে থাকে এবং শুক্রবার অথবা শনিবার সকালে এর সমাপ্তি ঘটে।[৩৩২][৩২৯]

ঐতিহাসিকদের মতে, আলি (রা.) প্রথমে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে চাননি।[২১৫] কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সামনের কাতারে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া নিরাপদ দূরত্বে তার তাবু থেকে সেনা পরিচালনা করছিলেন।[৩৩৩][৩৩৪] মুয়াবিয়া আলি (রা.)-এর প্রস্তাবিত দ্বৈত যুদ্ধের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।[৩৩৫][৩২৬][৩৩৬]

এই যুদ্ধে আলি (রা.)-এর পক্ষে যুদ্ধরত অবস্থায় বর্ষীয়ান সাহাবী আম্মার ইবনে ইয়াসির শহিদ হন।[৩৩৪] সুন্নি হাদিস গ্রন্থসমূহে বর্ণিত একটি হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) আম্মারের মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তাকে al-fi'a al-baghiya (অর্থাৎ বিদ্রোহী ও সত্যবিমুখ গোষ্ঠী) হত্যা করবে, যারা মানুষকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে।[৩৩৭][৩২৮][৩২৯]

প্রথম ফিতনা

Thumb
রাশিদুন খিলাফতে চার রাশিদুন খলিফার অধীনস্থ এলাকাসমূহ। উক্ত বিভক্ত এলাকাগুলো খলিফা আলির খিলাফতকালীন সময়ের প্রথম ফিতনার সাথে সম্পর্কিত।
  প্রথম ফিতনার সময় রাশিদুন খলিফা আলি ইবনে আবি তালিবের অধীনস্থ এলাকা
  প্রথম ফিতনার সময় মুয়াবিয়ার অধীনস্থ এলাকা
  প্রথম ফিতনার সময় আমর ইবনুল আসের অধীনস্থ এলাকা

উসমান ঘাতক কর্তৃক নিহত হলে অনেক ব্যক্তিবর্গ আলিকে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট, একথা বলাবলি করতে থাকে। আলি সরাসরি এ কথা অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে জনগণ তাকে খলিফা নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তবুও জণগণ জোরপূর্বক তাকে খলিফা মনোনীত করে। এরপরেও হত্যার সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে আলির সম্পর্ক বিষয়ে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে। একপর্যায়ে তা চরম আকার ধারণ করতে থাকে এবং আয়িশা ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। হত্যার প্রতিশোধ নেওবার উদ্দেশ্যে তিনি জনগণের সাথে এক হন এবং বসরার ময়দানে আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজনে শরিক হন। আলির বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে তিনি পেছন থেকে নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দেন। ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধটি বসরার যুদ্ধ বা উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে আলির বিরুদ্ধবাহিনী পরাজিত হয় কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসে এ যুদ্ধের প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।[৩৩৮][যাচাই প্রয়োজন]

কুফায় গুপ্তহত্যা

Thumb
আলি ইবনে আবি তালিবের সমাধি

৪০ হিজরীর ১৯শে রমজান বা ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি মসজিদে কুফায় নামাজ পড়ার সময় তিনি, খারেজী আব্দুর রহমান ইবনে মুলজাম কর্তৃক হামলার শিকার হন। তিনি নামাজে সেজদা দেওয়ার সময় ইবনে মুলজামের বিষ-মাখানো তরবারী দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হন।Tabatabaei 1979, পৃ. 192 আলি তার পুত্রকে নির্দেশ দেন কেউ যেন খারেজীদের আক্রমণ না করে, তার বদলে তিনি নির্দেশ দেন যে, যদি তিনি বেঁচে যান, তবে যেন ইবনে মুলজামকে ক্ষমা করে দেয়া হয়; আর যদি তিনি মারা যান, তবে ইবনে মুলজামকে যেন নিজ আঘাতের সমতুল্য একটি আঘাত করা হয় (তাতে ইবনে মুলজামের মৃত্যু হোক বা না হোক।)।Kelsay 1993, পৃ. 92 আলি হামলার দুদিন পর ২৯শে জানুয়ারি ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে (২১শে রমজান ৪০ হিজরী) মৃত্যুবরণ করেন। আল-হাসান তার নির্দেশনা অনুযায়ী কিসাস পূর্ণ করেন এবং আলির মৃত্যুর পর ইবনে মুলজামকে সমপরিমাণ শাস্তি প্রদান করেন।

জ্ঞান সাধনা

হযরত আলি (রা.) অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞান তাপস ও জ্ঞান সাধক। তিনি সর্বদা জ্ঞানচর্চা করতেন। হাদিস, তাফসির,আরবি সাহিত্য ও আরবি ব্যাকরণে তিনি তাঁর যুগের সেরা ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। কথিত আছে যে, 'হযরত মুহাম্মদ (স.) হলেন জ্ঞানের শহর, আর আলি হলেন তার দরজা '। তার রচিত 'দিওয়ানে আলি' নামক কাব্য গ্রন্থটি আরবি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পারিবারিক জীবন

আলির নয়টি স্ত্রী এবং বেশ কিছু উপপত্নীর থেকে চৌদ্দোটি পুত্র ও উনিশটি কন্যা ছিল, তাদের মধ্যে হাসান, হুসাইন এবং মুহাম্মদ ইবনে আল হানাফিয়াহ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে এবং তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচজন বংশধর রেখে গেছেন।[৩৩৯] আলি, মুহাম্মদ(সা)র ছোট মেয়ে ফাতিমার কাছ থেকে চারটি সন্তান ছিলঃ হাসান, হুসাইন, জায়নব এবং উম্মে কুলসুম।

দৃষ্টিভঙ্গি

সারাংশ
প্রসঙ্গ

কোরআনে আলির উল্লেখ

হযরত আলির রাঃ শানে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে বলে উলামা কেরাম মনে করেন। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলি সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলির শানে অনেক ’ আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ। পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল :

১. সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াত

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ

"এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ (এরূপ) বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।"

সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলিকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলি (আ.) নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।

সূরা শূরার ২৩ নং আয়াত

قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى

"বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।"

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন : যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? রাসূল (সা.) বললেন : আলি,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।

সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াত

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

"(হে বিশ্বাসিগণ!) তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।"

শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলি (আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলি ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলি ইবনে আবি তালিব (আ.) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।

ঘটনাটি এরূপ : একদিন হযরত আলি (আ.) মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলি রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।

শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি

আলি রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে শিয়া সম্প্রদায়ের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। আলি সম্পর্কিত অসংখ্য আত্মজৈবনিক সূত্র প্রায়শই সাম্প্রদায়িক ধারায় পক্ষপাতদুষ্ট, তবে তারা একমত যে তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এবং কোরআনসুন্নাহর অনুসারী ন্যায়পরায়ণ শাসক। আলি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হলেও শিয়ারা তাঁকে নবীপরবর্তী প্রথম খলিফা ও ইমাম হিসেবে গণ্য করে। শিয়া মুসলমানেরা আরও বিশ্বাস করে যে, আলি ও অন্য ইমামগণ—যাদের সকলেই মুহাম্মদ(সা)এর পরিবার তথা আহল আল-বাইতের অন্তর্ভুক্ত—হলেন মুহম্মদ(সা)র ন্যায্য উত্তরাধিকারী।

সূফী দৃষ্টিভঙ্গি

مظهر العجائب مولى المؤمنين كرم الله وجهه

ইতিহাসলিখনধারা

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.