বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম [ ﷽ ] (আরবি: بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ, বি-স্মি ল্লাহি র্-রাহ্মানি র্-রাহিম); সংক্ষেপে বিসমিল্লাহ নামেও পরিচিত), বা তাসমিয়াহ (আরবি: تَسْمِيَّة) হলো একটি ইসলামি বাক্যাংশ যার অর্থ "পরম করুণাময়, অসীম দয়াবান আল্লাহর নামে"। এটি সাধারণত ৭৮৬ নামেও পরিচিত, যা আরবি আবজাদ গণনার মাধ্যমে নির্ধারিত। তবে অনেক ইসলামি পণ্ডিত মনে করেন, বিসমিল্লাহ সরাসরি উচ্চারণ বা লেখা উত্তম এবং সংখ্যার মাধ্যমে এটি প্রতিস্থাপন করা উচিত নয়।[১] এটি ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যাংশগুলোর একটি। এটি দিয়েই পবিত্র কুরআন শরিফের ১১৪টি সূরার মধ্যে নবম সূরা ব্যতিরেকে অন্য বাকি ১১৩টি সূরা শুরু করা হয়েছে। এছাড়া হাদিস থেকে জানা যায় ইসলামের নবি মুহাম্মাদ প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে এই বাক্যাংশটি বলতেন।[২] তাঁর অনুকরণে মুসলিমরা বেশিরভাগ সময় "উত্তম কাজ" শুরু করার পূর্বে (উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিনের নামাজের সময়) এবং এর পাশাপাশি বেশিরভাগ দৈনন্দিন কাজ শুরু করার পূর্বে এটি ব্যবহার করে থাকে। বিধানগত বিচারে এটা মাসনুন বা মুস্তাহাব হলেও এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর বলে বিবেচিত।[৩]
এই নিবন্ধে ব্যবহৃত কিছু তথ্যসূত্র নির্ভরযোগ্য নয়। (নভেম্বর ২০১৭)
বার্মিংহাম মুসাহাফ পাণ্ডুলিপিতে লেখা বিসমিল্লাহ, যা কুরআনে টিকে থাকা প্রাচীনতম কপি। রসম: "ٮسم الله الرحمں الرحٮم"
বিসমিল্লাহ চারুলিপিবিসমিল্লাহর একটি চারুলিপি সংস্করণমুঘল যুগের চারুলিপি
আফগানিস্তান,[৪] বাহরাইন,[৫] বাংলাদেশ,[৬] ব্রুনেই,[৭] মিশর,[৮] ইরান,[৯] ইরাক,[১০] কুয়েত,[১১] লিবিয়া,[১২] মালদ্বীপ,[১৩] পাকিস্তান,[১৪] সৌদি আরব,[১৫] তিউনিসিয়া[১৬] এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত[১৭] সহ অর্ধেকেরও বেশি রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুর বাক্যাংশ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয় যেখানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম বা জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ইসলাম অনুসরণ করে।
এটি কুরআনের প্রতিটি সূরার শুরুতে তিলাওয়াতকৃত করা বাক্যাংশ - কেবল নবম সূরা বাদে।[১৮] কুরআনের পাঠ্যের মধ্যে বিসমিল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে কিনা তা নিয়ে মুসলিমদের মতভেদ ১৯২৪ সালের কায়রো সংস্করণের পরে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল, যেখানে এটিকে কুরআনের ১ম সূরার প্রথম আয়াত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্র এটিকে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ১১২ টি সূরার আগে পাঠ্যের একটি অসংখ্যায়িত বাক্যাংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১৯]
বিসমিল্লাহ ৫ম এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আরবি শিলালিপিতে আবির্ভূত শব্দগুচ্ছের পূর্ববর্তী রূপগুলির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয়।[২০] আরবি চারুলিপিতে, বিসমিল্লাহ হলো সবচেয়ে প্রচলিত শৈলি, এমনকি শাহাদাহ্র চেয়েও বেশি।
নাম
এই ধ্রুপদী আরবি শব্দগুচ্ছটির ঐতিহ্যগত নাম ছিল তাসমিয়াহ। ইসলামের অন্যান্য সাধারণ বাক্যাংশগুলোকেওক্রিয়াপদের প্রথম ২টি ক্রিয়াবিশেষ্যের উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব নাম দেওয়া হয়েছিল, যেভাবে সুবহান আল্লাহ এর জন্য তাসবিহ (تَسْبِيح), আলহামদুলিল্লাহ এর জন্য তাহমিদ (تَحْمِيد), "আল্লাহু আকবার এর জন্য তাকবির (تَكْبِير), লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" এর জন্য তাহলিল (تَهْلِيل), এবং "আমি প্রবল শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই" (أَعُوذُ بِٱللَّٰهِ مِنَ ٱلشَّيْطَانِ ٱلرَّجِيمِ, ʾআʿউযু বি-ল্লাহি মিনা শ্-শাইতানি র্-রাজিম) এর জন্য তাউয (تَعَوُّذ) নামগুলো প্রচলিত।
এটিকে বাসমালা (بَسْمَلَة) নামেও ডাকা হয়। বাসমালা শব্দটি একটি সামান্য অস্বাভাবিক পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, যেখানে বিসমিল্লাহি... বাক্যাংশের প্রথম চারটি উচ্চারিত ব্যঞ্জনবর্ণ একটি নতুন চতুর্ধ্বনিত ক্রিয়ামূল তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল:[২১] ব্–স্–ম্–ল্ (ب-س-م-ل)। এই চতুর্ধ্বনিত ক্রিয়ামূলটি বিশেষ্য বাসমালা এবং এর সাথে সম্পর্কিত ক্রিয়ারূপগুলো পেতে করতে ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ "বাসমালা পাঠ করা" একটি বাক্যাংশে একাধিক শব্দের ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে একটি চতুর্ধ্বনিত নাম তৈরি করার পদ্ধতিটিও আলহামদুলিল্লাহর ঐতিহ্যবাহী নাম তাহমিদের পরিবর্তে "হামদালা" নামটি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।[২১]হাওকলা শব্দটি তৈরি করতেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম একটি নাশপাতি আকৃতির শৈল্পিক গঠন
তাফসির-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে, ‘উসমান বিন আফফান মুহাম্মাদকে ‘বিসমিল্লাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন,
"এতে আল্লাহ তায়ালার নাম। আল্লাহর বড় নাম এবং এই বিসমিল্লাহর মধ্যে এতদূর নৈকট্য রয়েছে যেমন রয়েছে চুর কালো অংশ ও সাদা অংশের মধ্যে।"
ইবনে মরদুওয়াইর তাফসিরে রয়েছে,মুহাম্মাদ বলেছেন,
"আমার ওপর এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার মতো আয়াত হজরত সুলায়মান(আঃ) ছাড়া অন্য কোনো নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়নি। আয়াতটি হলো, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’।"
জাবির বর্ণনা করেন,
যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন পূর্ব দিকে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, বায়ুমণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে যায়, তরঙ্গ বিুব্ধ সমুদ্র প্রশান্ত হয়ে ওঠে, জন্তুগুলো কান লাগিয়ে শয়তানকে বিতাড়ন করে এবং বিশ্বপ্রভু স্বীয় সম্মান ও মর্যাদার কসম করে বলেন, ‘যে জিনিসের ওপর আমার এ নাম নেয়া যাবে তাতে অবশ্যই বরকত হবে। (তাফসির ইবনে কাসির)[২২]
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, "যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি খাদ্য খাবে সে যেন বিসমিল্লাহ বলে। যদি বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায় তাহলে সে যেন বলে, বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু"। (আবু দাউদ হা-৩৭৬৭, ইবনু মাজাহ হা-৩২৬৪)।[২২]
ইসলামে বিসমিল্লাহর গুরুত্ব ও বরকত অপরিসীম। বিসমিল্লাহ না বলার কারণে একটি হালাল খাদ্য হারাম হয়ে যেতে পারে, আবার বিসমিল্লাহ না বলার কারণে নিয়ত শুভ থাকলেও অনেক কর্মে বরকত না হওয়ায় অনেকসময় ব্যাক্তির অসন্মানিত হতে হয়। কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা হলে সে কাজে আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতারিত হতে থাকে। শয়তান সেখানে অবস্থান নিতে পারে না। মুহাম্মদের (সা.) কাছে প্রথম ওহী অবতরণের সময়ও এই বাক্য পড়ানো হয়েছিল।[২২]
শয়তানের প্রভাব থেকে বাঁচার দোয়া
একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে বিসমিল্লাহ। ১০-১১ শতাব্দী
মুসলিমরা বিসমিল্লাহ দিয়েই সব কাজ শুরু করতে হয়। তারা মনে করে, কাজ ও কথার শুরুতেই বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। হাদিসে এসেছে,
যে কাজ বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা না হয় তা কল্যাণহীন ও বরকতশূন্য থাকে। এর মাধ্যমে কাজের শুরুতে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় এবং মানুষের অমতা ও বিনয় ভাব প্রকাশ পায়। এ বাক্যের মাধ্যমে কর্ম শুরু করলে শয়তানের অসওয়াসা থেকে মুক্ত থাকা যায়।[২২]
বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করলে আল্লাহ তাকে করুণা করেন, হেফাজতে রাখেন ও কাজে বরকত দান করেন। আনাস বলেন, {{রাসূলুল্লাহ বলেছেন, "যদি কোনো ব্যক্তি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে, ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহের নামে বের হলাম, আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম, আমার কোনো উপায় নেই, কোন ক্ষমতা নেই আল্লাহ ছাড়া’ তখন তাকে বলা হয় তুমি পথ পেলে, উপায় পেলে ও সহায়তা পেলে। তারপর শয়তান তার থেকে দূর হয়ে যায়। তখন আর এক শয়তান এ শয়তানকে বলে, তুমি লোকটিকে কেমন পেলে? তখন সে বলে, তাকে হেদায়েত দেয়া হয়েছে, পথ দেয়া হয়েছে ও রা করা হয়েছে’ (মিশকাত হা-২৪৪৩)[২২]"}}
সুসার বু-ফাতাতা মসজিদের ভিত্তি শিলালিপির শুরুতে বিসমিল্লাহ্। ৯ম শতাব্দী
হুজায়ফা বলেন,
নবী করীম (সা) বলেছেন, "শয়তান সেই খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয়, যে খাদ্যের ওপর বিসমিল্লাহ বলা হয় না।" (মুসলিম হা-২০১৭, আবু দাউদ হা-৩৭৬৬)
জাবির বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, "বিসমিল্লাহ বলে তুমি তোমার দরজা বন্ধ করো। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। বিসমিল্লাহ বলে বাতি নিভিয়ে দাও। একটু কাঠখড়ি হলেও আড়াআড়ি ভাবে বিসমিল্লাহ বলে পাত্রের মুখ ঢেকে রাখো। বিসমিল্লাহ বলে পানির পাত্র ঢেকে রাখো।" (বুখারি হা-৩২৮০, মুসলিম হা-২০১২, আবু দাউদ হা-৩৭৩১, তিরমিজি হা-২৮৫৭)[২২]
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করে, সে বলবে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবিনাশ শায়তানা অজান্নিবিশ শায়তানা মা রাজাকতানা’ অর্থাৎ আল্লাহর নামে মিলন শুরু করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শয়তান থেকে দূরে রাখো এবং শয়তানকে দূরে রাখো, আমাদের মাঝে কোনো সন্তান নির্ধারণ করলে শয়তান কখনো তার কোনো তি করতে পারবে না।’ (বুখারি হা-১৪৩৪, আবু দাউদ হা-২১৬১, তিরমিজি হা-১০৯২, ইবনু মাজাহ হা-১৯১৯)।[২২]
জিবরাইল (আ.) সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তা হচ্ছে জিবরাইল (আ.) বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনি আশ্রয় চান। মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই। অতঃপর জিবরাইল (আ.) বললেন, হে নবী! আপনি বলুন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। অতঃপর জিবরাঈল (আ.) বললেন, ইকরা' বিসমি… অর্থাৎ আপনি পড়–ন, আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।
—আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন,
এটাই প্রথম সূরা, যা আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে মুহাম্মাদের প্রতি অবতীর্ণ করেন।’ ( তাবারি, তাফসির ইবনু কাসির হা-২৬৩)[২২]
—আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)
সূচনাবাক্য
‘বিসমিল্লাহ’ হলো সব কাজের সূচনাবাক্য। পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতেও বিসমিল্লাহ বলা হয়। বিসমিল্লাহ দিয়েই অধিকাংশ সূরা শুরু করা হয়েছে। মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশিত ও ইসলামি বিধান মতে সমর্থিত কাজ শুরুর প্রাক্কালেই ‘বিসমিল্লাহ’ বলে থাকে। কিন্তু অন্যায় কাজ ও ইসলামবহির্ভূত কর্মের জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলা আল্লাহদ্রোহিতার অন্তর্ভুক্ত। [২২]
ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন
"প্রত্যেক ভালো কাজের শুরুতে যদি ‘বিসমিল্লাহ’ বলা না হয় তা হলে তা অসম্পূর্ণ ও নিম্নমানের থেকে যায়।’ (আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)।"[২২]