Loading AI tools
৬২৯ খ্রিস্টাব্দে আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধসমূহের একটি যুদ্ধ। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মুতার যুদ্ধ (আরবি: معركة مؤتة , غزوة مؤتة; মারিকাতু মু'তা ) হলো জর্ডানের মুতা নামক স্থানে মুসলিম এবং রোমানদের মাঝে সংঘটিত একটি অন্যতম যুদ্ধ। যুদ্ধে মুসলিমরা কৌশলগত জয়লাভ করে। এ যুদ্ধে ১২ জন মুসলিম শহিদ হন এবং রোমকদের মধ্যে কতোসংখ্যক হতাহত হয়েছিল, তার বিবরণ জানা যায়নি। এটি ৬২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত হয়েছিল। [১৩]
এই নিবন্ধটি ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সংশ্লিষ্ট নিবন্ধ অনুবাদ করে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। (আগস্ট ২০২৩) অনুবাদ করার আগে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী পড়ার জন্য [দেখান] ক্লিক করুন।
|
মুতার যুদ্ধ (غزوة مؤتة) | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ | |||||||
মুতার যুদ্ধ সংঘটিত স্থানের নিকটবর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশের নিদর্শন। | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
আরব মুসলিম |
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য গাচ্ছানিদ | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
যায়েদ ইবনে হারেসা † জাফর ইবনে আবি তালিব † আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা † খালিদ বিন ওয়ালিদ |
থিওডর হিরাক্লিয়াস শুহরাবিল ইবনে আমর | ||||||
শক্তি | |||||||
৩০০০[৫] |
১০০,০০০ (আল ওয়াকিদি)[৬] | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
১২[১১] (বিতর্কিত)[১২][৩] |
৩০০০(চ্যাটজিপিটি এবং অন্যান্য সোর্সেস) |
মুতা হল জর্ডানের বালকা এলাকার নিকটবর্তী একটি জনপদ। এই জায়গা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দূরত্ব মাত্র দুই মানযিল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় মুসলিমরা যে সকল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এ যুদ্ধ তাদের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ছিল। এই যুদ্ধের ফলেই মুসলমানদের জন্যে খৃষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ জয়ের পথ খুলে যায়। এটি অষ্টম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত হয়।[১৪]
নবি মুহাম্মাদ সা. হারেস ইবনে উমায়ের আল আযদী নামক একজন সাহাবিকে একটি চিঠিসহ তৎকালীন বসরার গভর্নরের নিকট প্রেরণ করেন। তখন রোমের কায়সারের গভর্নর শুরাহবিল ইবনে আমর গাস্সানি বসরায় গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিল। তিনি মুহাম্মদ সা. এর প্রেরিত দূতকে গ্রেফতার করেন এবং শক্ত রশিতে বেঁধে হত্যা করে। দূতহত্যা সর্বযুগ জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হত এবং এটা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ছিল।
এ কারণে মুহাম্মদ সা. তার প্রেরিত দূতের হত্যার খবর শোনার পরই সেই এলাকায় মোতায়েন করার জন্যে সৈন্যদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী তিন হাজার সৈন্যের বিশাল বহর তৈরী হয়। [১৫] খন্দকের যুদ্ধ ছাড়া ইতিপূর্বে অন্য কোন যুদ্ধেই মুসলমানরা তিন হাজার সৈন্য সমাবেশ করেননি।
তিনি যায়েদ ইবনে হারেসাকে এ সৈন্যদলের সেনাপতি মনোনীত করেন। এরপর বলেন যে, যায়েদ যদি নিহত হন, তাহলে জাফর এবং জাফর যদি নিহত হন, তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা সেনাপ্রধান নিযুক্ত হবেন।[১৬]
তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর জন্যে সাদা পতাকা তৈরী করে তা যায়েদ ইবনে হারেসার কাছে দেন [১৭] এবং সৈন্যদলকে এ বলে ওসিয়ত করেন যে, হারেস ইবনে ওমায়েরে হত্যাকান্ডের জায়গায় তারা যেন অবশ্যই আগে স্থানীয় লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে কোনো যুদ্ধ হবে না এবং যদি ইসলাম গ্রহণ না করে, তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; খেয়ানত করবে না; কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও গীর্জায় অবস্থানকারী দুনিয়া পরিত্যাগকারীকে হত্যা করবে না। খেজুর ও অন্য কোন গাছ কাটবে না; কোন অট্টালিকা ধ্বংস করবে না। [১৮]
মুসলিম বাহিনী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে সাধারণ মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোনীত সেনানায়কদের সালাম এবং বিদায় জানান। সেই সময় অন্যতম সেনানায়ক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহ কাঁদছিলেন। তাকে এ সময়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ বা তোমাদের সাথে সম্পর্কের কারণে আমি কাঁদছি না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনে জাহান্নামের ভয়ে আমি কাঁদছি। সেই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে, এটা তোমাদের প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।’
— সূরা মারইয়াম, আয়াত ৭১
আমি জানি না যে, জাহান্নামে পেশ করার পর ফিরে আসব কীভাবে? মুসলমানরা বললেন, আল্লাহ তায়ালা সালামতির সাথে আপনাদের সঙ্গী হোন। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের হেফাযত করুন এবং গনীমতের মালসহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনুন। হযরত আবদুল্লাহ তখন এই কবিতা আবৃত্তি করেন,
“ রহমানের কাছে মাগফেরাতের জন্যে মগজ বের করা তলোয়ারের আঘাতের জন্যে
বর্শা নিক্ষেপকারীর হাত, অন্ত্র কলিজা
চিরে ফেলা আঘাত করার শক্তি দানের জন্যে
সাহায্য চাই। আমার কবরে পাশ দিয়ে
যাবে যারা তারা বলবে এই সেই গাজী
যাকে আল্লাহ হেদায়াত দিয়েছেন এবং
যিনি হেদায়অত প্রাপ্ত।
”
মুসলিম সৈন্যরা এরপর রওয়ানা হয়ে যান। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছানিয়াতুল অদা পর্যন্ত সেনাদলের সঙ্গে গিয়ে সৈন্যদের বিদায় জানান। [১৯]
উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে মুসলিম সৈন্যরা মাআন নামক এলাকায় পৌঁছুলেন। এ স্থান ছিলো হেজাজের সাথে সংশ্লিষ্ট জর্ডানি এলাকায়। মুসলিম বাহিনী এখানে এসে অবস্থান নেন। মুসলিম গুপ্হচররা এসে খবর দিলেন যে, রোমের কায়সার বালকা অঞ্চলের মাআব এলাকায় এক লাখ রোমক সৈন্য সমাবেশ করে রেখেছে। এছাড়া তাদের পতাকাতলে লাখাম, জাজাম, বলকিন, বাহরা এবং বালা গোত্রের আরো এক লাখ সৈন্য সমবেত হয়েছিলো। উল্লিখিত শেষোক্ত এক লাখ ছিলো আরব গোত্রসমূহের সমন্বিত সেনাদল।
মুসলমানরা ধারণাই করতে পারেননি যে, তারা কোন দুর্ধর্ষ সেনাদলের সম্মখীন হবেন। দূরবর্তী এলাকায় তারা সত্যিই সঙ্কটজনক অবস্থার সম্মুখীন হলেন। তাদের সামনে এ প্রশ্ন মূর্ত হয়ে দেখা দিল যে, তারা কি তিন হাজার সৈন্যসহ দুই লাখ সৈন্যের সাথে মোকাবেলা করবেন? বিস্মিত চিন্তিত মুসলমানরা দুইরাত পর্যন্ত পরামর্শ করলেন। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিঠি লিখে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হোক। এরপর তিনি হয়তো বাড়তি সৈন্য পাঠাবেন অথবা অন্য কোন নির্দেশ দেবেন। সেই নির্দেশ তখন পালন করা যাবে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) দৃঢ়তার সাথে এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন। তিনি বললেন,
“ হে লোক সকল, আপনারা যা এড়াতে চাইছেন এটাতো সেই শাহাদাত, যার জন্য আপনারা বেরিয়েছেন। স্মরণ রাখবেন যে, শত্রুদের সাথে আমাদের মোকাবেলার মাপকাঠি সৈন্যদল, শক্তি এবং সংখ্যাধিক্যের নিরিখে বিচার্য নয়। আমরা সেই দ্বীনের জন্যই লড়াই করি, যে দ্বীন দ্বারা আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। কাজেই সামনের দিকে চলুন। আমরা দুইটি কল্যাণের মধ্যে একটি অবশ্যই লাভ করবো। হয়তো আমরা জয়লাভ করবো অথবা শাহাদাত বরণ করে জীবন ধন্য হবে। ”
অবশেষে আবদুল্লাহ ইববে রাওয়াহার মতামতের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
মাআন নামক এলাকায় দুই রাত অতিবাহিত করার পর মুসলিম বাহিনী শত্রুদের প্রতি অগ্রসর হলেন। বালকার মাশারেফ নামক জায়গায় তারা হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদের মুখোমুখি হলেন। শত্রুরা আরো এগিয়ে এলে মুসলমানরা মুতা নামক জায়গায় গিয়ে সমবেত হন। এরপর যুদ্ধের জন্য সৈন্যদের বিন্যস্ত করা হয়। ডানদিকে কোতাবা ইবনে কাতাদা আজরিকে এবং বামদিকে ওবাদা ইবনে মালেক আনসারী (রা.)-কে নিযুক্ত করা হয়।
মুতা নামক জায়গায় উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে অত্যন্ত তিক্ত লড়াই হয়। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিসম্ময়কর ছিলো এ যুদ্ধ। দুনিয়ার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। ঈমানের বাহাদুরি চলতে থাকলে এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে।
সর্বপ্রথম রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় পাত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছ (রা.)পতাকা গ্রহণ করেন। অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ ধরনের বীরত্বের পরিচয় মুসলমান ব্যতীত অন্য কারো ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়নি।
হযরত যায়েদ-এর শাহাদাতের পর পতাকা তুলে নেন হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও তুলনাহীন বীরত্বের পরিচয় দিয়ে লড়াই করতে থাকেন। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজের সাদাকালো ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে শত্রুদের ওপর আঘাত করতে থাকেন। শত্রুদের আঘাতে তার ডানহাত কেটে গেলে তিনি বাঁ হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত এভাবে পতাকা ধরে রাখেন।
ইমাম বোখারী (রা.) নাফে-এর মাধ্যমে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
“ মুতার যুদ্ধের দিনে হযরত জাফর শহীদ হওয়ার পর আমি তার দেহে আঘাতের চিহ্নগুলো গুণে দেখেছি। তার দেহে তীর ও তলোয়ারের পঞ্চাশটি আঘাত ছিলো। এ সব আঘাতের একটিরও পেছনের দিকে ছিলো না।[২০] ”
উভয় বর্ণনায় সংখ্যার পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য নিরসন এভাবে করা হয় যে, তীরের আঘাতের সংখ্যাসহ ৯০টি।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে,আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন,
“ আমি মুতার যুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গে ছিলাম। জাফর ইবনে আবু তালেবকে সন্ধান করে নিহতদের মধ্যে তাকে পেয়ে যাই। তার দেহে বর্শা ও তীরের ৯০টির বেশি আঘাত দেখেছি।[২১] ”
নাফে থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ইবনে ওমরের বর্ণনায় এও আছে যে,
“ আমি এসকল জখম লক্ষ্যে করেছি তার দেহের সম্মুখভাগে।[২২] ”
বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে হযরত জাফর (রা.)-এর শাহাদাত বরণের পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.) পতাকে গ্রহণ করে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে সামনে অগ্রসর হন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তিনি এ কবিতা আবৃতি করেন,
“ ওরে মন খুশী অখুশি যেভাবে হোক মোকাবেলা কর। যুদ্ধের আগুন জ্বেলেছে ওরা
বর্শা রেখেছে খাড়া। জান্নাত থেকে
কেন'রে তুই থাকতে চাস দূরে?
”
এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.)বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার চাচাতো ভাই গোশত লেগে থাকা একটা হাড় তার হাতে দেন। তিনি এক কামড় খেয়ে ছুঁড়ে ফেলেন। এরপর লড়াই করতে করতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা শাহদাতের পর বনু আযলান গোত্রের ছাবেত ইবনে আরকাম একজন সাহাবী গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, হে মুসলমানরা, তোমারা উপযুক্ত একজনকে সেনাপতির দায়িত্ব দাও। সাহাবারা ছাবেতকেই সেনাপতির দায়িত্ব নিতে বললে তিনি বলেন, আমি একাজের উপযুক্ত নই। এরপর সাহাবারা হযরত খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি পতাকা গ্রহণের পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহীহ বোখারীতে স্বয়ং খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো। [২৩]
অপর এক বর্ণনায় তার যবানীতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, মুতার যুদ্ধের দিনে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার হাতে একটি ইয়েমেনী ছোট তলোয়ার অবশিষ্ট ছিলো।[২৪]
এদিকে রসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম রণক্ষেত্রের খবর লোক মারফত পৌঁছার আগেই ওহীর মাধ্যমে পান। তিনি বলেন, যায়েদ পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনি শহীদ হন। এরপর জাফর পতাকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি শহীন হন। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেছিলেন, তিনিও শহীন হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের চোখ এ সময় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এরপর পতাকা গ্রহণ করেন আল্লাহর তলোয়ার সমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।
বীরত্ব, বাহাদুরি ও নিবেদিত চিত্ততা সত্তেও মুসলমানদের মাত্র তিন হাজার সৈন্য দুই লাখ অমুসলিম সৈন্যের সামানে টিকে থাকা ছিলো এক বিস্ময়কর ঘটনা। হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা.)এ সময়ে যে বীরত্বের পরিচয় দেন, ইতিহাসে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহে যথেষ্ট মতভেত রয়েছে। সকল বর্ণনা পাঠ করার পর জানা যায় যে, যুদ্ধের প্রথম দিন শেষ পর্যায়ে হযরত খালেদ (রা.)রোমক সৈন্যদের মোকাবেলায় অবিচল ছিলেন। তিনি সেই সময় এক নতুন যুদ্ধকৌশলের কথা ভাবছিলেন, যাতে রোমকদের প্রভাবিত করা যায়। সেই কৌশলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মুসলমানদের পিছিয়ে নেয়ায় ছিলো উদ্দেশ্য। তবে, কোন অবস্থায়ই রোমকরা যেন ধাওয়া করতে না পারে, সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা রোমকরা ধাওয়া করলে তাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া হবে খুবই কঠিন।
পরদিন সকালে হযরত খালেদ (রা.)সেনাদল রদবদল করে বিন্যাস্ত করলেন। ডানদিকের সৈন্যদেরকে বাঁদিকে এবং বাঁদিকের সৈন্যদের পেছনে নিয়ে গেলেন। এরূপ আদল বদলে দৃশ্য থেকে শত্রুরা বলাবলি করতে লাগলো যে, মুসলমানর সহায়ক সৈন্য পেয়েছে, তাদরে শক্তি পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সেনা বিন্যাস অদল বদল করে হযরত খালেদ (রা.) মুসলমানদের ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিলেন। রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো না কারণ তারা তখন ভাবছিলো যে, মুসলমানরা ধোঁকা দিচ্ছে। তার মরুপ্রান্তরে নিয়ে পাল্টা হামলা করে পর্যদুস্ত করবে। এরূপ চিন্তা করে রোমক সৈন্যরা মুসলমানদের ধাওয়া না করে নিজেদের এলাকায় ফিরে গেলো। এদিকে মুসলমানরা পিছাতে পিছাতে মদীনায় গিয়ে পৌছালেন।[২৫]
মুতার যুদ্ধে ১২ জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। রোমকদের মধ্যে কতোসংখ্যক হতাহত হয়েছে তার বিবরণ জানা যায়নি। তবে যুদ্ধের বিবরণ পাঠে বোঝা যায় যে, তাদের বহু হতাহত হয়েছে। কেননা, একমাত্র হযরত খালেদের হাতেই ৯টি তলোয়ার ভেঙ্গেছিলো। এতেই শত্রু সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুতা অভিযান পরিচালিত হয়েছিলো, সেটা সম্ভব না হলেও এ যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের সুনাম সুখ্যাতি বহু দূর বিস্তার লাভ করে। সমগ্র আরব জগত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কেননা, রোমকরা ছিলো সে সময়ের শ্রেষ্ঠ শক্তি। আরবরা মনে করতো যে, রোমকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। কাজেই, উল্লোখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া তিনহাজার সৈন্য দুই লাখ সৈন্যের মোকাবেলায় আরবের জনগণ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো যে, ইতিপূর্বে পরিচিতি সকল শক্তির চেয়ে মুসলমানরা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের নেতা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃসন্দহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ কারণেই দেখা যায় যে, মুসলমানদের চিরশত্রু জেদী ও অহংকারী হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু সংখ্যক গোত্র মুতার যুদ্ধের পর ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গোত্র হচ্ছে বনু ছালিম, আশজা, গাতফান, জিবান ও ফাজারাহ।
মুতার যুদ্ধের প্রাক্কালে রোমকদের সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়েছিলো এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের বিজয় গৌরব দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করে।
মুতার যুদ্ধে রোমক সৈন্যদের সাথে আরবদের বিভিন্ন গোত্রের সহযোগিতামূলক ভূমিকার কথা জেনে রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী মনে করেন যাতে, রোমক ও আরবদের গোত্রগুলো মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের হাত প্রসারিত করে এবং ভবিষ্যতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সৈন্য সমাবেশের চিন্তা না করে।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ উদ্দেশ্যে হযরত আমর ইবনু আস (রা.)-কে মনোনীত করেন। তার দাদী ছিলেন বালা গোত্রের মহিলা। মুতার যুদ্বের পর অষ্টম হিজরীর জমাদিউস সানিতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আমর ইবনু আস (রা.)-কে প্রেরণ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, গুপ্তচরদের মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে যে, বনু কাজাআ গোত্র হামলা করতে মদীনার উপকন্ঠে বহু সৈন্য প্রস্তুত করেছে। এসব কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর ইবনুল আস (রা.)-কে প্রেরণ করেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, মুসলিম সেনাদল বলি, আজরা এবং বলকিন এলাকার লোকদের কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের কাছে যেন সাহয্য চান। মুসলিম সেনাদল রাত্রিকালে সফর করতেন এবং দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতেন। শত্রুদের কাছাকাছি পৌঁছার পর জানা যায় যে, শত্রুরা দল ভারি। হযরত আমর তখন রাফে ইবনে মাকিছ জাহনিকে সাহায্যের চিঠিসহ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইশত সৈন্য হযরত আবু ওবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। এদের মধ্যে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর সহ আনসার ও মোহাজেরদরে বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দও ছিলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা.)-কে নির্দেশ দেন, তিনি যেন আমর ইবনুল আস এর সাথে মিলিত হয়ে উভয়ে মিলেমিশে কাজ করেন। কোন প্রকার মতানৈক্য যেন না করেন। আবু ওবায়দা অকূস্থলে যাওয়ার পর পুরো বাহিনীর অধিনায়কত্ব চান। কিন্তু হযরত আমর ইবনুল আস বললেন, অধিনায়ক তো আমি, আপনি তো সহায়ক সৈন্য নিয়ে এসেছেন। আবু ওবায়দা একথা মেনে নেন। এরপর নামাযের ইমামতিও সেনাদল প্রধান হযরত আমর ইবনুল আসই করতে থাকেন।
সহায়ক সেনাদল পৌঁছার পর কাজাআ এলাকায় পৌঁছেন এবং সেখান থেকে দূরবর্তী স্থানে যান। একপর্যায়ে শত্রুদের সাথে মোকাবেলা হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু মুসলমানদের হামলার উদ্যেগের মুখে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।
এরপর আওফ ইবনে মালেক আশজায়ীকে দূত হিসেবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করা হয়। তিনি মুসলমানদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন এবং অভিযানের বিবরণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শোনান।
যাতে-ছালছেল ওয়দিউল কোরা প্রন্তরের সামনের একটি জায়গা। এটি মদীনা থেকে ১০ দিনের দূরত্বে অবস্থিত। ইবনে ইসহাক বলেন, মুসলমানরা জাজাম গোত্রের ছালাছেল নামের একটি জলাশয়ের পাশে অবতরণ করেন। তাই এ অভিযানের নাম করা হয় যাতে-ছালাছেল।[২৬]
অষ্টম হিজরীর শাবান মাস
এ অভিযানের কারণ ছিলো এই যে, নজদের অভ্যন্তরে মুহরিব গোত্রের এলাকার খাজরাহ নামের জায়গায় বনু গাতফান গোত্র সৈন্য সমাবেশ করছিলো। এদের দমন করতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পনেরজন সাহাবীকে হযরত আবু ওবায়দার নেতৃত্বে প্রেরণ করেন। এই সেনাদল শত্রুদের কয়েকজনকে হত্যা, কয়েকজনকে বন্দী এবং গনীমতের মাল লাভ করেন। এই অভিযানে প্রেরিত সেনাদল হযরত আবু ওবায়দার নেতৃত্বে পনের দিন মদীনার বাইরে অবস্থান করেন। [২৭]
সে বললো, (বিজয় লাভ করা (সত্বেও) আজ তোমাদের বিরুদ্ধে (আমার) কোন প্রতিশোধ নেই,আল্লাহ তায়ালা (অতীত আচরণের জন্য) তোমাদের ক্ষমা করে দিন, (কেননা তিনি সব দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। [২৮]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.