Loading AI tools
হিন্দুধর্মের একটি সম্প্রদায় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বৈষ্ণববাদ (সংস্কৃত: वैष्णवसम्प्रदायः) হিন্দুধর্মের শাখা সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ে বিষ্ণু বা তার অবতারগণ (মুখ্যত রাম ও কৃষ্ণ) আদি তথা সর্বোচ্চ ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। বৈষ্ণব দর্শনে বিষ্ণুকে সমগ্র জগতের পালনকর্তা রূপে গণ্য করা হয়। বিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে, বিশেষত ভক্তি ও ভক্তিযোগ প্রসঙ্গে, বৈষ্ণব দর্শনের প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি উপনিষদ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য পৌরাণিক শাস্ত্র। যথা – শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, গরুড় পুরাণ ও পদ্মপুরাণ।[1][2][3]
বৈষ্ণব সম্প্রদায় অনুসারীদের বৈষ্ণব নামে অভিহিত করা হয়। বৈষ্ণব দর্শনের মূল কথা হল আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন এবং এই একাত্মতার জন্য যে পথ অবলম্বন করা হয় তা হলো, কেবলমাত্র প্রেম ও ভক্তি এবং সম্পূর্ণরূপে অহিংসা। বৈষ্ণব দর্শনে পরমাত্মার উপাসনার জন্য সকল প্রকার জাগতিক গুন বর্জন করে নির্গুণ হয়ে পরমাত্মার সাথে একাত্ম হওয়ার উপদেশ রয়েছে। প্রাচীন ভারতে গুপ্তযুগেও এই বৈষ্ণব দর্শনের প্রচলন ছিল। এই গুপ্তযুগেই বিখ্যাত বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থ "বিষ্ণুস্মৃতি" রচিত হয়। বৈষ্ণবরা মূলত নিরামিষ ভোজী। বৈষ্ণবরা হিন্দু সমাজের অন্যতম বৃহৎ অংশ।[4] এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস ভারতে। দক্ষিণ ভারতে "অঙ্করভাট মন্দির", "তিরুপতি বালাজির মন্দির" ও "পদ্মনাভস্বামী মন্দির" বৈষ্ণব দর্শনের চর্চার জন্য বিখ্যাত। তবে ভারতবর্ষের বাইরে ইন্দোনেশিয়াতেও বিষ্ণু পূজার নিদর্শন রয়েছে। সাম্প্রতিককালে ধর্মসচেতনতা, স্বীকৃতি ও ধর্মপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বাইরে বৈষ্ণবদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বৈষ্ণব দর্শনের প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে আসছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটি।[5] মুখ্যত, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপ গ্রামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরেই এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখাটির প্রচলন। চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবধারাকে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন "হরে কৃষ্ণ" আন্দোলন জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভৌগোলিক প্রসার ঘটিয়ে সম্পাদন করছে। বহু বিদেশিও এই নবদ্বীপে এসে সমগ্র বিশ্বে বৈষ্ণব দর্শনের প্রচারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছেন। এছাড়াও অতি সম্প্রতি অন্যান্য বৈষ্ণব সংগঠনও পাশ্চাত্যে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেছে।[6]
ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মের মিলন ঘটেছে ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মে।[7] ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্ম আবার ঐতিহাসিক বৈদিকধর্মের একটি অঙ্গ। বিষ্ণু পূজার প্রাধান্য অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি থেকে পৃথক করেছিল ঐতিহাসিক বিষ্ণুধর্মকে।[8] বিষ্ণুধর্মের আকারেই ভারতে সর্বপ্রথম বৈষ্ণব ধর্মমতের চর্চা শুরু হয়। এককথায় বিষ্ণুধর্ম ছিল ভারতের প্রথম দেশজ সম্প্রদায়গত ধর্মমত।[9] এই ধর্মমতে বিষ্ণুকে সকল অবতারের উৎসস্বরূপ বলে স্বীকার করে নেওয়া হলেও, বিষ্ণু নামটি কেবলমাত্র সর্বোচ্চ দেবতা অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হয়। তার অন্যান্য নামগুলি হল নারায়ণ, বাসুদেব ও কৃষ্ণ। প্রত্যেকটি নামের সঙ্গে স্বকীয় দিব্য বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব আরোপিত হয়; যেগুলিকে বৈষ্ণব ধর্মের সংশ্লিষ্ট উপসম্প্রদায়সমূহ পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মনে করে।[10] উদাহরণস্বরূপ, কৃষ্ণধর্ম বৈষ্ণবধর্মেরই একটি শাখা।[11] গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নিম্বার্ক ও বল্লভাচার্য সম্প্রদায় কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর বা স্বয়ং ভগবান মনে করে। কিন্তু বিষ্ণু মতের অনুগামীরা তা স্বীকার করেন না।[12]
বৈষ্ণবধর্মের বিষ্ণুকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি বিষ্ণু বা নারায়ণকে সর্বোচ্চ দেবতা মনে করে। আবার বল্লভ সম্প্রদায় বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতো কৃষ্ণকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলি কৃষ্ণকেই সর্বোচ্চ দেবতা তথা সকল অবতারের উৎস মনে করে।[13] বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসটির মূল ভিত্তি পুরাণে বর্ণিত বিষ্ণুর নানা অবতারের উপাখ্যান। এই সকল উপাখ্যানে তার সঙ্গে গণেশ, সূর্য, দুর্গা প্রমুখ দেবতার পার্থক্য প্রতিপাদন করে তাদের উপদেবতার পর্যায়ে পর্যবসিত করা হয়েছে। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুসারে, হিন্দু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা শিব হলেন বিষ্ণুর অনুগত ভক্ত[13] এবং স্বয়ং এক বৈষ্ণব।[14] স্বামীনারায়ণ হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠাতা স্বামীনারায়ণ এই মতের বিরোধী। তার মতে, শিব ও বিষ্ণু একই ঈশ্বরের দুই পৃথক সত্ত্বা।[15] তবে উল্লেখ্য, স্বামীনারায়ণের মতবাদ বৈষ্ণবদের একটি সংখ্যালঘু অংশের মত।
বৈষ্ণবদের অপর একটি সংখ্যালঘু অংশ আব্রাহামিক ধর্মের সর্বোচ্চ ঈশ্বরের সঙ্গে বিষ্ণুকে একীভূত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই মতটির বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কারণ, আব্রাহামিক ধর্মের জিহোবা বা আল্লাহকে একেশ্বরবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়; তিনি একক চিরন্তন সত্ত্বা এবং তার সৃষ্ট জগতের বাইরে পৃথকভাবে অবস্থান করেন। অন্যদিকে বিষ্ণুকে হিন্দুধর্মের বহুদেববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। এখানে সকল সত্ত্বাই ঈশ্বরে সমাহিত, এবং ঈশ্বর সকল সত্ত্বার মধ্যেই অস্তিত্বমান।[16] বৈষ্ণব ধর্মমতে একটি বিশিষ্ট বক্তব্য হল, ঈশ্বর (বিষ্ণু এবং/অথবা কৃষ্ণ) "সত্য ব্যক্তিত্ব এবং তার বহুবর্ণময় সৃষ্টিও সত্য"।[17]
বৈষ্ণব দর্শনের মূলভিত্তি হিন্দুধর্মের কয়েকটি কেন্দ্রীয় ধর্মমত; যথা: বহুদেববাদ, পুনর্জন্ম, সংসার, কর্ম এবং বিভিন্ন যোগশাস্ত্র। তবে ভক্তি যোগের পথে বিষ্ণুর প্রতি ভক্তির প্রতিই এই ধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই ভক্তির অঙ্গ হল বিষ্ণুর নামগান (ভজন ও কীর্তন), তার রূপচিন্তন (ধারণা) এবং দেবপূজা। দেবপূজার তত্ত্ব ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে পঞ্চরাত্র ও বিভিন্ন সংহিতায়।[18]
পূজার মাধ্যমে বৈষ্ণবগণ বিষ্ণুকে তাদের অন্তরে অধিষ্ঠিতরূপে কল্পনা করেন। এই রূপে তারা তাদের সত্ত্বার উৎস ঈশ্বরকে অন্তর্যামী নামে অভিহিত করেন। এই নামটি নারায়ণ নামের সংজ্ঞার একটি অংশ। হিন্দুধর্মের অন্যান্য শাখাসম্প্রদায়ের জীবনের উদ্দেশ্য যেখানে মোক্ষ লাভ বা পরমব্রহ্মের সঙ্গে মিলন, সেখানে বৈষ্ণবদের জীবনের উদ্দেশ্য বিষ্ণু বা তার কোনো অবতারের সেবায় মায়াময় জগতের বাইরে 'বৈকুণ্ঠধামে' অনন্ত আনন্দময় এক জীবনযাপন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে বৈষ্ণবদের সর্বোচ্চ সত্ত্বার তিন বৈশিষ্ট্য – ব্রহ্মণ, পরমাত্মা ও ভগবান – অর্থাৎ, যথাক্রমে, বিশ্বময় বিষ্ণু, হৃদয়যামী বিষ্ণু ও ব্যক্তিরূপী বিষ্ণু।[19]
বৈষ্ণবগণ সাধারণত দীক্ষানুষ্ঠান প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করেন। গুরু কর্তৃক দীক্ষিত হয়ে তারা গুরুর অধীনেই বৈষ্ণব ধর্মানুষ্ঠান শিক্ষা করেন। দীক্ষার সময় শিষ্যকে কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্র দান করা হয়। এই মন্ত্রটিকে পূজার অঙ্গ রূপে সোচ্চারে বা অনুচ্চারে বারংবার আবৃত্তি করতে হয়। এই বারংবার মন্ত্র আবৃত্তিকে জপ বলা হয়। বিভিন্ন বৈষ্ণব শাস্ত্রে দীক্ষা ও গুরুর অধীনে ধর্মানুশীলনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্রগুলিতেও বলা হয়েছে যে যিনি বিষ্ণু বা কৃষ্ণের নামজপমাত্র পূজা করেন, তিনিই ধর্মানুশীলনের প্রশ্নে বৈষ্ণব বলে পরিগণিত হন:
বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলি নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে তাদের পূর্বতন আচার্যদের রচনাকেই প্রামাণ্য শাস্ত্র রূপে গ্রহণ করেন।[13] স্মার্তবাদ ও অদ্বৈতবাদী দর্শনে কথিত মুখ্যবৃত্তি-র আক্ষরিক অর্থ এই ধর্মে প্রধান আলোচ্য। এর পরই গৌণবৃত্তি-র পরোক্ষ অর্থটির স্থান: সাক্ষাৎ উপদেশস্তু শ্রুতিঃ (শ্রুতিশাস্ত্রকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করো, এর অন্তর্নিহিত অর্থটিকে গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই)।[13][23]
বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীগণ চারটি প্রধান উপশাখায় বিভক্ত। এই উপশাখাগুলিকে বলা হয় সম্প্রদায়।[24] প্রত্যেক সম্প্রদায়ের আদর্শ কোনো নির্দিষ্ট বৈদিক চরিত্র। জীবাত্মা ও পরমাত্মা (বিষ্ণু বা কৃষ্ণ) সম্পর্কে এই চার সম্পর্কের মতের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যদিও অধিকাংশ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মূল মতবাদ একই প্রকারের।[6][13][25]
বৈষ্ণবদের মধ্যে কপালে তিলক অঙ্কণ করার রীতি রয়েছে। কেউ কেউ দৈনিক উপাসনার অঙ্গ হিসেবে তিলক আঁকেন, কেউ কেউ তিলক কাটেন বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসব উপলক্ষে। বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলির নিজস্ব তিলক অঙ্কণশৈলী রয়েছে। এগুলি সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের প্রতীক। সাধারণত তিলকের আকার ইংরেজি Y অক্ষরটির মতো। দুই বা ততোধিক লম্বরেখা এবং নাকের উপর অপর একটি রেখা বিশিষ্ট এই তিলক বিষ্ণুর পদ ও পদ্মের প্রতীক।[27]
ভারতে মহাকাব্য বা "ইতিহাস"-এর যুগ থেকেই বিষ্ণুর পূজা প্রচলিত।[28] হপকিনসের মতে, "এককথায় বিষ্ণুধর্ম ছিল ভারতে প্রচলিত একমাত্র স্থানীয় ধর্মসম্প্রদায়।" ("Vishnuism, in a word, is the only cultivated native sectarian native religion of India.")[9] ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত মহাভারতের একটি অংশে বৈষ্ণবধর্মের ধারণাটি পাওয়া যায়। উক্ত অংশটি কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কথোপকথনের আকারে বিধৃত রয়েছে। কৃষ্ণ বিষ্ণু অন্যতম অবতার এবং উক্ত অংশে অর্জুনের রথের সারথি।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও তার পরবর্তীকালের বহু রাজাই পরমভাগবত বা ভাগবত বৈষ্ণব নামে পরিচিত ছিলেন।[29]
শৈবধর্ম প্রভাবিত দক্ষিণ ভারতে খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে বৈষ্ণবধর্মের প্রসার ঘটে। এই অঞ্চলে বৈষ্ণবধর্ম আজও প্রচলিত। তামিলনাড়ুতে বারোজন অলভর সন্ত ভক্তিমূলক স্তোত্ররচনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মকে ছড়িয়ে দেন। অলভরেরা যেসকল মন্দিরে গমন করেছিলেন বা যে মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেন সেগুলি দিব্য দেশম নামে পরিচিত। তামিল ভাষায় রচিত তাদের বিষ্ণু বা কৃষ্ণের স্তোত্রকবিতাগুলি নালয়িরা বা দিব্য প্রবন্ধ নামে পরিচিত। তামিলনাড়ুতে বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তার মূলেও তারাই রয়েছেন।[30][31]
পরবর্তীকালে রামানুজাচার্য, মাধবাচার্য, মানবল মামুনিগল, বেদান্ত দেসিকা, সুরদাস, তুলসীদাস, ত্যাগরাজ প্রমুখ আচার্যগণের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[32][33][34][35]
এডওয়ার্ড ওয়াসবার্ন হপকিনস তার দ্য রিলিজিয়ন অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলেছেন, বিষ্ণুধর্ম বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এই ধর্ম ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই একটি অংশ। কৃষ্ণধর্মের উদ্ভব হয় অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে। এর কারণ এই যে আধ্যাত্মিক বা নৈতিক চরিত্রের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ব্রাহ্মণদের কাছে কৃষ্ণের তুলনায় শিব অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। পরে বিষ্ণুধর্মই কৃষ্ণধর্মের সঙ্গে মিশে যায়। হপকিনসের মতটি বর্তমানে সর্বজনগ্রাহ্য।[36]
সমগ্র ভারতেই আজ এক বিরাট সংখ্যক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের দেখা পাওয়া যায়। পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাটের মত পশ্চিম ভারতীয় রাজ্যগুলিতে এঁদের সংখ্যা অধিক। বৈষ্ণবদের প্রধান প্রধান তীর্থগুলি হল: গুরুভায়ুর মন্দির, শ্রীরঙ্গম, বৃন্দাবন, মথুরা, অযোধ্যা, তিরুপতি, পুরী, মায়াপুর, দ্বারকা ও খেতুরী ধাম।[37]
বিংশ শতাব্দীতে ভারতের বাইরে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও রাশিয়ায় বৈষ্ণবধর্ম প্রসারিত হয়।[38] এই প্রসার সম্ভব হয়েছিল ১৯৬৬ সালে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকন আন্দোলনের ফলে।[39][40][41]
দুটি প্রসিদ্ধ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বৈষ্ণব দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
রামায়ণ বিষ্ণুর অবতার রামের উপাখ্যান। ধর্মনীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিচারে ইতিহাসে তাকে ‘আদর্শ রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রামের স্ত্রী সীতা, ভাই লক্ষ্মণ ও ভক্ত হনুমানের আচরণও বৈষ্ণবদের নিকট আদর্শ। মহাকাব্যের খলনায়ক রাবণ এক দুষ্ট রাজা। বৈষ্ণবদের কী করা উচিত নয় তার উদাহরণ রাবণ।
মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষ্ণুর অপর অবতার কৃষ্ণ। এই মহাকাব্যের মূল উপজীব্য একটি পারিবারিক গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে কৃষ্ণ ধার্মিক পাণ্ডব ভাতৃগণের পক্ষাবলম্বন করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাগমুহুর্তে কৃষ্ণ ও অর্জুনের যে কথোপকথন হয় তা ভারতীয় দর্শনের একটি মূল্যবান উপাদান। এই অধ্যায়টি ভগবদ্গীতা নামে হিন্দুদের একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থের মর্যাদাপ্রাপ্ত। হিন্দু দর্শনের উপর এই গ্রন্থটির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তবে বৈষ্ণবদের কাছে এটি আরও বেশি মূল্যবান। কারণ তারা মনে করেন, এই গ্রন্থের প্রতিটি বক্তব্যই কৃষ্ণের নিজের মুখ থেকে উৎসারিত হয়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলিতে কৃষ্ণের মর্যাদা অত্যন্ত সম্মানজনক। কোনো কোনো সম্প্রদায় তাকে বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার মনে করেন। আবার গৌড়ীয় ও নিম্বার্ক সম্প্রদায় তাকেই বিষ্ণুসহ সকল অবতারের উৎস মনে করেন।[43]
বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীগণ এই দুই মহাকাব্যের নানা অংশ অবলম্বনে নাট্য রচনা করে থাকেন। এই নাটকগুলি সংশ্লিষ্ট অবতারের উৎসবে অভিনীত হয়। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ভগবদ্গীতা বহুপঠিত। ইংরেজি সহ বিশ্বের একাধিক ভাষায় এই গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে।
ভারতে কয়েক শতাব্দীকাল বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব ছিল ভক্ত, দার্শনিক ও পণ্ডিতদের গবেষণা ও তর্কবিতর্কের বিষয়। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে ইউরোপে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর হিন্দু স্টাডিজ ও ভক্তিবেদান্ত কলেজের মতো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। যেসকল বিশেষজ্ঞ এই বিষয়টিকে পাশ্চাত্য বিদ্বজ্জন সমাজে তুলে ধরতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন তারা হলেন তমালকৃষ্ণ গোস্বামী, হৃদয়ানন্দ দাস গোস্বামী, গ্রাহাম শেউইগ, কেনেথ আর. ভ্যালপেই, গাই বেক ও স্টিভেন আর. রোসেন প্রমুখ।
১৯৯২ সালে স্টিভেন রোসেন দ্য জার্নাল অফ বৈষ্ণব স্টাডিজ নামক হিন্দু গবেষণা পত্রিকাটি চালু করেন।[44] এই পত্রিকায় বৈষ্ণবধর্ম, বিশেষত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.