অদ্বৈত বেদান্ত

বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী মতবাদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

অদ্বৈত বেদান্ত

অদ্বৈত বেদান্ত (সংস্কৃত: अद्वैत वेदान्त) হল বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী [][][][] ধর্মীয় অনুশীলন বা সাধনার পদ্ধতিগত ধারা।[web ১] সর্বেশ্বরবাদী অনুসারে, মানুষের সত্যিকারের সত্ত্বা আত্মাব্রহ্ম হলো শুদ্ধ চৈতন্য,[note ১][] এবং এ বিষয়ে উপনিষদগুলিতে সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।[] অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান ব্যাখ্যাকর্তা হলেন আদি শঙ্কর[] তবে তিনি এই মতের প্রবর্তক নন। পূর্বপ্রচলচিত অদ্বৈতবাদী মতগুলিকে তিনি সুসংবদ্ধ করেছিলেন।[]

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রথম ঐতিহাসিক প্রবক্তা গৌড়পাদের ধ্যানস্থ ভঙ্গীর মূর্তি। ইনি আদি শঙ্করের গুরু গোবিন্দ ভাগবতের গুরু। কথিত আছে, গৌড়পাদই শ্রীগৌড়পাদাচার্য মঠের প্রতিষ্ঠাতা।

পাশ্চাত্য প্রাচ্যবাদ ও দীর্ঘস্থায়ী দর্শন মতের প্রভাব, এবং ভারতের নব্য-বেদান্ত মত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর অদ্বৈত বেদান্তের প্রভাবের জন্য[১০] অদ্বৈত মতকে হিন্দু দর্শনের বেদান্ত[note ২] শাখা ও সেগুলির সাধনপদ্ধতিগুলির[১১] মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী[১২] ও শক্তিশালী[১৩][১৪] মত মনে করা হয়। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে অদ্বৈতবাদী শিক্ষার প্রভাব দেখা যায়।[১৫] ভারতীয় সংস্কৃতির বাইরেও অদ্বৈত বেদান্ত হিন্দু অধ্যাত্মবিদ্যার একটি সাধারণ উদাহরণ বলে বিবেচিত হয়।[১০]

বেদান্তের প্রতিটি শাখারই প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল প্রস্থানত্রয়ী (উপনিষদ, ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্র)। অদ্বৈত মতে, এই বইগুলির দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।[][note ৩] [note ৪]

অদ্বৈত অনুগামীরা আত্মা ও ব্রহ্ম জ্ঞান সংক্রান্ত বিদ্যা[১৭] বা জ্ঞানের সাহায্যে মোক্ষ লাভ করতে চান। এই মোক্ষ লাভ দীর্ঘকালীন প্রয়াস। গুরুর অধীনে থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি লাভ করা সম্ভব।

ইতিহাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ
আদি শঙ্কর ও তাঁর শিষ্যেরা। রাজা রবি বর্মার আঁকা ছবি (১৯০৪)

আদি শঙ্করের আগেও অদ্বৈত বেদান্ত মতবাদ প্রচলিত ছিল। কিন্তু আদি শঙ্করের ব্যাখ্যাই এই মতবাদটিকে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী করে তোলে।[১৮]

আদি শঙ্করের পূর্বে অদ্বৈতবাদ

ব্রহ্মসূত্র (৪০০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ[১৯]) রচনার আগে বেদান্তের কোনো শাখা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না।[১৯] ব্রহ্মসূত্র ও শঙ্করের মধ্যবর্তী সময়ের (বিশেষত খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়[১৯]) কথাও বিশেষ জানা যায় না। এই সময়ে লেখা দুটি বই পাওয়া যায়: ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় (পঞ্চম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ[২০]) ও গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকা (সপ্তম শতাব্দী)।[১৯]

প্রাচীন ইতিহাস

বালসুব্রহ্মণ্যমের মতে, বেদবেদান্ত দর্শন সমসাময়িক। কারণ, বেদান্ত দর্শন শাখার ধারণাগুলির মূল উৎস হল বেদ।[২১] বৈদিক যুগে (১৫০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ[২১]) ঋষিরা যে ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্র এবং কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলিই পরে বিস্তার লাভ করে বেদের জ্ঞানকাণ্ড[২২] উপনিষদ্‌ গ্রন্থাবলির মধ্যে।[২৩] উপনিষদের মধ্যে "মতবাদ ও মতবাদ প্রবর্তনের উপযোগী সঠিক দর্শন জ্ঞানের" অভাব ছিল।[২৪] এই দার্শনিক ভিত্তিটি গড়ে তোলার জন্য পরে ষড়দর্শন নামে পরিচিত ছয়টি মতের জন্ম হয়।[২৫]

বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র

বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র[২২] গ্রন্থের যে সংস্করণটি এখন প্রচলিত, সেটি খ্রিস্টীয় ৪০০-৪৫০ অব্দের রচনা।[২৬] তবে "সূত্রের অনেক অংশ তার আগেও প্রচলিত ছিল।"[২৬] বাদরায়ণ ঠিক কোন সময়ের লোক ছিলেন তা জানা যায় না। তবে সম্ভবত তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ের লোক ছিলেন।[২৭]

ব্রহ্মসূত্র হল উপনিষদের শিক্ষাগুলির একটি সমালোচনামূলক আলোচনা। এটি এখনও বেদান্ত গুরুদের একটি অন্যতম প্রধান সহায়ক বই।[২২] বাদরায়ণ অবশ্য প্রথম বেদান্তের শিক্ষাগুলির সুসংহত রূপ দেননি।[২৮] তিনি তার পূর্ববর্তী ৭ জন বেদান্তগুরুর কথা উল্লেখ করেছেন:[২৮]

বাদরায়ণ যেভাবে অন্যদের মতের উল্লেখ করেছেন, তাতে স্পষ্ট যে উপনিষদের শিক্ষা তাঁর আগেই আলোচিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছিল। তাই চার অধ্যায়ে বিভক্ত ২৫৫ সূত্রে তাঁর ব্যাখ্যাটিকে এই প্রচেষ্টার সর্বশেষ ও সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা চলে।[২৮]

ব্রহ্মসূত্র থেকে শঙ্কর

নাকামুরার মতে, "সম্ভবত এই সময় অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার কিছু খণ্ডাংশই আমরা পাই। আবার বহু গ্রন্থ হারিয়ে গিয়েছে। আজ আর সেগুলি পাওয়া যায় না।"[১৯] শঙ্কর তার রচিত ভাষ্যগুলিতে তার সম্প্রদায়ের ৯৯ জন পূর্বসূরির নাম উল্লেখ করেছেন।[] বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌-এর ভাষ্যে শঙ্কর ব্রহ্মবিদ্যা সম্প্রদায়ের গুরুদের প্রণাম করেছেন।[web ৩] প্রাক-শঙ্কর যুগের মতবাদ ও উক্তিগুলি পরবর্তীকালের শাখাগুলিকেও ব্যবহার করতে দেখা যায়। এই সব মতবাদ ও উক্তির মাধ্যমে প্রাচীন বেদান্ত দর্শনের বিকাশের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানা যায়।[১৯]

যমুনাচার্যের সিদ্ধিত্রয় (১০৫০ খ্রি.), রামানুজের বেদার্থসংগ্রহ (১০৫০-১১৫৭ খ্রি.) ও শ্রীনিবাসদাসের যতীন্দ্রমতদীপিকা গ্রন্থে আদি বেদান্ত দার্শনিকদের নাম পাওয়া যায়।[১৯] ব্রহ্মসূত্র ও শঙ্করের জীবদ্দশার মধ্যবর্তী সময়ে সর্বমোট[১৯] চোদ্দোজন দার্শনিকের নাম পাওয়া যায়।[১৯][note ৫]

শঙ্করকে কেউ কেউ অদ্বৈত বেদান্ত শাখার প্রবর্তক বললেও, নাকামুরার মতে, আদি বেদান্তবাদী ও শঙ্করের মতবাদগুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে, শঙ্করের প্রতিটি কথাই তার আগে কেউ না কেউ বলে গিয়েছেন।[২৯] শঙ্কর শুধু তার পূর্ববর্তীকালে প্রচলিত "অদ্বৈতবাদ" মতটিকে সুসংহত রূপ দিয়েছেন।[২৯] এই সুসংহত করার কাজে তিনি প্রাচীন বিদ্যার পুনর্নবীকরণের পক্ষে জোরালো মত প্রচার করেন।[৩০] তার ভাষ্যগুলি দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান গ্রহণ করে।[৩০] তার প্রচেষ্টার ফলেই অদ্বৈত বেদান্ত ভারতীয় দর্শনে একটি প্রধান স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়।[৩০]

গৌড়পাদ

গৌড়পাদ, ইনি অদ্বৈত বেদান্তের প্রথম ঐতিহাসিক প্রবক্তা আদি শঙ্করের পরমগুরু তথা শ্রীগৌড়পাদাচার্য মঠের প্রতিষ্ঠাতা
অদ্বৈত বেদান্ত মতে, রাজহংসের প্রতীকতত্ত্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গৌড়পাদ (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী)[৩১] ছিলেন গোবিন্দ ভাগবতপাদের গুরু। গোবিন্দ ভাগবতপাদ আবার ছিলেন শঙ্করের গুরু।

মাণ্ডুক্য কারিকা

গৌড়পাদ মাণ্ডুক্য কারিকা রচনা অথবা সম্পাদনা করেছিলেন।[৩২] এই গ্রন্থটি গৌড়পাদ কারিকা বা আগম শাস্ত্র নামেও পরিচিত।[note ৬] মাণ্ডুক্য কারিকা হল মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌-এর ভাষ্য। মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌ হল সবচেয়ে ক্ষুদ্রায়তন অথচ অন্যতম প্রধান একটি উপনিষদ্‌। এই উপনিষদে মাত্র তেরোটি গদ্য পঙ্‌ক্তি আছে। শঙ্করের সময়ে এটিকে শ্রুতির মর্যাদা দেওয়া হলেও, খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হত না।[৩৩] পরবর্তীকালে এটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং শেষ পর্যন্ত এটিকে উপনিষদ্‌ দর্শনের সারমর্ম ঘোষণা করা হয়।[৩৩]

মাণ্ডুক্য কারিকা-ই অদ্বৈত বেদান্তের প্রাচীনতম প্রাপ্ত সুসংহত গ্রন্থ।[৩৪] তবে এটি অদ্বৈত দর্শনের প্রাচীনতম গ্রন্থ নয়।[] এমনকি এটি প্রাক্‌-শঙ্কর যুগের একমাত্র সমজাতীয় শিক্ষার বই নয়।[]

বৌদ্ধ প্রভাব

বৌদ্ধদের দুটি মতবাদ গৌড়পাদ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলি হল: সর্বোচ্চ সত্য হলেন শুদ্ধ চৈতন্য ("বিজ্ঞপ্তি-মাত্রা", যোগাচার মত)[৩১][note ৭] এবং "বিশ্বের প্রকৃতি চারমুখী মিথ্যা"।[৩১][note ৮] গৌড়পাদ উভয় মতবাদকেই মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌-এর দর্শনের সঙ্গে একীভূতক করেন। পরে শঙ্কর এই মতকে আরও প্রসারিত করেছিলেন।[৩৮][note ৯] একই সঙ্গে গৌড়পাদ বৌদ্ধদের জ্ঞানতত্ত্বমূলক আদর্শবাদের জোরালো বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন স্বপ্নে দেখা বস্তু এবং বাস্তব জগতের বস্তুর মধ্যে পার্থক্য আছে, যদিও শেষ পর্যন্ত দুইই মিথ্যা। বিজ্ঞানবাদ শাখার মূল মতবাদ চৈতন্যের বহুত্ব ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং সেই সঙ্গে উক্ত মতের মুক্তিলাভের প্রক্রিয়াটিকে তিনি অস্বীকার করেন।[৪০]

নাগার্জুনের মধ্যমক দর্শন থেকে "অজাত" (যেখানে "অণুৎপাদ" পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়েছে[৪১] ) ধারণাটিও গৌড়পাদ গ্রহণ করেন।[৪২][৪৩][note ১০] "অজাতিবাদ" বা "অ-সৃষ্টিতত্ত্বের মতবাদ"[৪৮][note ১১] বা সৃষ্টিতত্ত্বহীন মতবাদ হল গৌড়পাদের মূল দর্শনতত্ত্ব।[৪৮]

রিচার্ড কিং-এর মতে বেদান্ত ও বৌদ্ধধর্ম উভয়ের প্রেক্ষিতেই অজাতিবাদ একটি বিপ্লবী-সুলভ ভিন্ন অর্থ বহন করে। বৌদ্ধ লেখকরা অজাতিবাদ সম্পর্কে লিখেছেন, কারণের সারবত্তা কিছুই নেই আর তাই পরিবর্তন সম্ভব। গৌড়পাদ বিপরীত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি সৃষ্টি ও ধ্বংসকে মিথ্যা বলে চরম অবস্থানে গিয়েছেন এবং একমাত্র সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্মকে অনাদি ও অপরিবর্তনীয় বলেছেন।[৪৯]

গৌড়পাদের মতে, সর্বোচ্চ সত্য জন্ম, পরিবর্তন ও মৃত্যুর অধীন নন। তিনি "অজ" অর্থাৎ জন্মহীন সত্য।[৪৮] জগতের আপাত-বাস্তবতাকে মিথ্যা বলা হয় এবং তাকে চিরস্থায়ী মনে করা হয় না।[৪৮]

শ্রীগৌড়পাদাচার্য মঠ

৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়পাদ শ্রীগৌড়পাদাচার্য মঠ স্থাপন করেন।[note ১২] এর অপর নাম কাভালে মঠ। এটি গোয়ার পোন্ডা তালুকের কাভালেতে অবস্থিত।[৫০] এটি দক্ষিণ ভারতের সারস্বত ব্রাহ্মণদের প্রাচীনতম মঠ।[৫১][৫২]

আদি শঙ্কর

আদি শঙ্কর (৭৮৮–৮২০) অদ্বৈত তত্ত্বকে সুসংহত ও পুনরুজ্জীবিত করেন।[৩০] তিনি শঙ্কর ভাগবদপাদাচার্য বা আদি শঙ্করাচার্য নামেও পরিচিত। অদ্বৈত বেদান্তকে তিনি বৈদিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাজে তিনি অন্যান্য বৈদান্তিক গুরু, যেমন শঙ্করের গুরু গোবিন্দ ভাগবতপাদ, গোবিন্দের গুরু গৌড়পাদ, গৌড়পাদের গুরু অজাতিবাদকে গ্রহণ করেন। তার ব্যাখ্যা ও তার নামে প্রচলিত রচনাগুলি অদ্বৈত বেদান্তের প্রামাণিক ব্যাখ্যা।[৫৩]

উত্তর-ধ্রুপদি হিন্দুধর্ম

৬৫০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দকে হিন্দুধর্মের ইতিহাসে উত্তর ধ্রুপদি হিন্দুযুগ বলা হয়।[৫৪] শঙ্কর এই যুগের মানুষ ছিলেন।[৫৪]

এর পূর্ববর্তী যুগটিকে "হিন্দুধর্মের সুবর্ণযুগ"[৫৫] (৩২০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ[৫৫]) বলা হয়। গুপ্ত শাসনকাল[৫৬] (৩২০-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে হর্ষ সাম্রাজ্যের পতন[৫৬] (৬০৬-৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) এই যুগের অন্তর্গত। এই যুগে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, বৈদেশিক ও আন্তঃবাণিজ্য প্রসারিত হয়েছিল, আইনব্যবস্থা সুসংহত হয়েছিল এবং সাক্ষরতার সার্বিক প্রসার ঘটেছিল।[৫৬] এই যুগেই মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রসারিত হয়। কিন্তু গুপ্ত রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়।[৫৭] সমাজে ব্রাহ্মণদের উচ্চস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।[৫৬] প্রথম হিন্দু মন্দিরও গুপ্ত যুগেই স্থাপিত হয়েছিল।[৫৬]

গুপ্ত ও হর্ষ সাম্রাজ্যের পতনের পর, ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়। বেশ কয়েকটি বড়ো রাজ্য ও অনেকগুলি আশ্রিত রাজ্যের জন্ম হয়।[৫৮][note ১৩] এই রাজ্যগুলি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশশাসন করত। ছোটো রাজ্যগুলি বড়ো রাজ্যগুলির উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্রাটরা ছিলেন সাধারণ্যের অনধিগম্য। তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। তাদের দেবতা মনে করা হত।[৫৯] তান্ত্রিক মণ্ডলগুলিতে রাজাদের এমনভাবেই দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজাকে মণ্ডলের কেন্দ্রে কল্পনা করা হত।[৬০]

কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ধর্মের মধ্যেও আঞ্চলিকতা দেখা যায়। এর ফলে ধর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার পরিবেশের সৃষ্টি হয়।[৬১][note ১৪] স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও ভাষাগুলি পরিপুষ্ট হয়। "ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রথাবহুল হিন্দুধর্মের"[৬১] ক্ষমতা হ্রাস পায়।[৬১] শৈবধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, ভক্তিবাদতন্ত্র[৬১] গ্রামীণ ও ভক্তিবাদী শাখাগুলির উদ্ভব ঘটে। যদিও এই সম্প্রদায়গুলি তখন তাদের বিকাশের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল।[৬১] ধর্মীয় শাখাগুলিকে স্থানীয় শাসকদের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে হত।[৬১] বৌদ্ধধর্ম তার স্থানটি হারায় এবং ভারত থেকে অবলুপ্ত হতে শুরু করে।[৬১]

বৌদ্ধধর্মকে সমর্থন করত প্রাচীন ভারতের নগর সভ্যতা। সারা দেশে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথাগত ধর্মমতের প্রভাবে এই ধর্ম নিজের স্থান হারাতে থাকে।[৬৩] বাংলায় বৌদ্ধধর্ম রাজরোষের সম্মুখীন হয়। আবার গৌড়পাদ উপনিষদ্‌ ব্যাখ্যায় বৌদ্ধ দর্শনকে গ্রহণ করলে বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।[৬৪] আত্মা ও ব্রহ্ম "সজীব সত্ত্বা"য় পর্যবসিত হয়ে[৬৫] "মায়াবাদ"-এর উদ্ভব ঘটে।[note ১৫] এখানে আত্মা ও ব্রহ্মকে দেখা হতে থাকে "শুদ্ধ জ্ঞানচৈতন্য" হিসেবে।[৬৬] শিপারসের মতে, "মায়াবাদ" মতটিই পরবর্তীকালের ভারতীয় দর্শনের প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে।[৬৩]

দর্শন

শঙ্কর তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের মতবাদকে সুসংহত করেন।[] উপনিষদের প্রামাণিক দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি তার নিজস্ব বেদান্তচর্চার ধারাটি গড়ে তোলেন।

শঙ্করের অন্যতম প্রকরণ গ্রন্থ বিবেকচূড়ামণি-র নিম্নোক্ত পঙ্‌ক্তিটি থেকে শঙ্করের অদ্বৈত দর্শনের সারসংক্ষেপ করা যায়:[note ১৬]

যা কোটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, তা আমি এক পঙ্‌ক্তিতে বলি;

ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা (অর্থাৎ, জগতের পৃথক অস্তিত্ব নেই),

এবং আত্মা ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়।[৬৭][note ১৭]

শ্রীঙ্গেরি মঠের মতে, শঙ্করের বাণীকে আরও সংক্ষেপে বলা যায়:

চিরন্তন, নির্গুণ, চৈতন্যরূপ সর্বোচ্চ সত্ত্বা ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়।[web ১০]

রচনাবলি

আদি শঙ্করের প্রধান কাজ হল প্রস্থানত্রয়ীর ভাষ্যরচনা। তিনি ব্রহ্মসূত্র, ভগবদ্গীতাউপনিষদ্‌ গ্রন্থাবলির ভাষ্য রচনা করেছিলেন। নাকামুরার মতে, শঙ্করের বেদান্তসূত্রভাষ্য হল "বেদান্ত দর্শনের সবচেয়ে প্রামাণ্য ও সর্বাধিক পরিচিত রচনা"।[৬৮] নিজের দার্শনিক মতকে প্রসারিত করার জন্য ভাষ্য ছাড়াও তিনি উপদেশলহরী নামে একটি পৃথক গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থের রচনাকারের নাম সঠিক জানা যায় না। তবে এটি শঙ্করের রচনা হিসেবে প্রচলিত।[৬৯][৭০][৭১] এটি "শঙ্করের দার্শনিক মতের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত যে, তাঁর কোনো ব্যাখ্যা এই গ্রন্থের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলে, তাকে অসম্পূর্ণ ধরা হয়।"[৬৯][note ১৮]

শঙ্কর মাণ্ডুক্য উপনিষদ্‌ ভাষ্য ও গৌড়পাদের মাণ্ডুক্য কারিকা-র ভাষ্য লিখেছিলেন কিনা তা নিয়েও দ্বিমত আছে।[৭২][note ১৯]

অদ্বৈত মঠ

বিদ্যাশঙ্কর মন্দির, শ্রীঙ্গেরি সারদা পীঠ, শ্রীঙ্গেরি

পাশ্চাত্য জগতে অদ্বৈত বেদান্ত মূলত একটি দার্শনিক মত হিসেবে প্রচলিত। তবে এতে একটি সন্ন্যাস প্রথাও আছে। দর্শন ও সন্ন্যাস এই মতে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত:[web ১]

অদ্বৈত মতের অধিকাংশ প্রধান লেখকই সন্ন্যাসী সংঘের সদস্য। এই ধারার দুই দিকই মূল্যবোধ, আচরণ ও দর্শনের দিক থেকে একই ঐতিহ্য বহন করছে।[web ১]

শঙ্করকে শিবের অবতার মনে করা হয়।[web ১] একদণ্ডী সন্ন্যাসীদের একাংশকে দশটি নামের অধীনে এনে তিনি দশনামী সম্প্রদায় স্থাপন করেন।[web ১] অবশ্য একদণ্ডী সন্ন্যাসীদের অনেকগুলি ধারা দশনামী সম্প্রদায়ের বাইরেই থেকে যায়।[৭৭][৭৮][৭৯]

আদি শঙ্কর চারটি মঠের অধীনে দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের সংগঠিত করেন। এই চার মঠের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিমে দ্বারকা, পূর্বে জগন্নাথ পুরী, দক্ষিণে শ্রীঙ্গেরি ও উত্তরে বদরিকাশ্রম[web ১] প্রতিটি মঠের প্রধান হয়েছিলেন শঙ্করের চার প্রধান শিষ্যের এক একজন। এঁরাই বেদান্ত সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

পাণ্ডের মতে, শঙ্কর নিজে এই মঠগুলি স্থাপন করেননি। ঋষি বিভান্দক ও তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ এগুলিকে আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৮০] উত্তরাধিকার সূত্রে শঙ্কর দ্বারকা ও শ্রীঙ্গেরির আশ্রম দুটি পান। অন্য দুটি আশ্রমের ক্ষেত্রে তিনি শৃঙ্গবেরপুরা থেকে বদরিকাশ্রমে এবং অঙ্গদেশ থেকে জগন্নাথ পুরীতে আশ্রম স্থানান্তরিত করেন।[৮১]

এই দশ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের মধ্যে মতবিশ্বাস ও ধর্মানুশীলন-সংক্রান্ত পার্থক্য আছে। এগুলির একাংশ শঙ্করের চালু করা নির্দিষ্ট বিধির অধীনে পড়ে না। দশনামী সম্প্রদায় আদি শঙ্করের নির্দেশ মেনে চললেও, এদের কেউ কেউ মতবিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন। তারা শঙ্কর মঠের অধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন না।

অদ্বৈত সম্প্রদায় শৈব নয়।[web ১][৮২] যদিও শৈবধর্মের সঙ্গে এই মতের যোগ ঐতিহাসিক:

অদ্বৈতবাদীরা অসাম্প্রদায়িক। তাঁরা শিব ও বিষ্ণু, এমনকি শক্তি, গণপতি ও অন্যান্য দেবতার পূজার স্বপক্ষে।[web ১]

অবশ্য সমসাময়িক শঙ্করাচার্যেরা বৈষ্ণব সম্প্রদায় অপেক্ষা শৈব সম্প্রদায়ের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত।[web ১] অদ্বৈত ধারার গুরুদের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায় স্মার্তদের মধ্যে। এঁরা হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদী ধারার সঙ্গে বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের মিলন ঘটিয়েছেন।[web ১]

নাকামুরার মতে, এই মঠগুলি শঙ্করের দ্বারা প্রভাবিত। এই প্রবানের কারণটিকে তিনি বলেছেন "প্রতিষ্ঠানগত"।[] তার প্রতিষ্ঠিত মঠগুলি আজও বিদ্যমান আছে এবং সেগুলি শঙ্করের শিক্ষা ও প্রভাবকে সংরক্ষণ করে। যদিও তার পূর্ববর্তী অন্যান্য পণ্ডিতদের রচনাবলি হারিয়ে গিয়েছে।[৮৩]

নিচের সারণিতে আদি শঙ্করের প্রতিষ্ঠিত চারটি "আম্নায় মঠ"-এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল:[web ১১]

আরও তথ্য শিষ্য (পরম্পরা), স্থান ...
শিষ্য
(পরম্পরা)
স্থান মঠ মহাবাক্য বেদ সম্প্রদায়
পদ্মপাদ পূর্ব গোবর্ধন পীঠম্‌ প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম (চৈতন্যই ব্রহ্ম) ঋগ্বেদ ভোগবল
সুরেশ্বর দক্ষিণ শ্রীঙ্গেরি সারদা পীঠম্‌‌ অহং ব্রহ্মাস্মি (আমি ব্রহ্ম) যজুর্বেদ ভুরিবল
হস্তমালক পশ্চিম দ্বারকা পীঠম্‌ তত্ত্বমসি (তুমিই সেই) সামবেদ কিতাবল
তোটক উত্তর জ্যোতির্মঠ পীঠম্‌ অয়মাত্মা ব্রহ্ম (এই আত্মা হলেন ব্রহ্ম) অথর্ববেদ নন্দবল
বন্ধ

শাখা

শঙ্করের মৃত্যুর পর অদ্বৈত বেদান্তের একাধিক শাখার উদ্ভব হয়। এর মধ্যে দুটি শাখা এখনও আছে। এগুলি হল - ভামতী বিবরণ[web ১২][] পঞ্চপাদিকা ও ইষ্টসিদ্ধি শাখাদুটি এখন অবলুপ্ত।[৮৪]

এই শাখাদুটি অদ্বৈতবাদের নানা মতবাদের যুক্তিগত প্রয়োগ ঘটায়। এই প্রয়োগের সময় এগুলিকে দুটি প্রধান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এগুলি হল মায়াঅবিদ্যা ধারণার অতিরিক্ত ব্যাখ্যা।[web ১২]

ভামতী

ভামতী শাখার নামটি এসেছে আদি শঙ্করের ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের উপর বাচস্পতি মিশ্রের লেখা একটি টীকা থেকে।[web ১২][web ১৩] কিংবদন্তি অনুসারে, বাচস্পতি মিশ্র টীকাটি রচনাকালে নিজ স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করেছিলেন বলে টীকাটিকে তিনি নিজ স্ত্রীর নামে চিহ্নিত করেছিলেন।[web ১৩]

বাচস্পতি মিশ্র শঙ্করের চিন্তাধারার সঙ্গে মণ্ডন মিশ্রের মতের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। ভামতী শাখাটি তাত্ত্বিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই মতে জীব হল অবিদ্যার উৎস।[web ১২]

বিবরণ

বিবরণ শাখাটির নামটি এসেছে পঞ্চপাদিকা গ্রন্থের পদ্মপাদ রচিত টীকা পঞ্চপাদিকা-বিবরণ গ্রন্থের নাম থেকে।[৮৪] প্রকাশাত্মা প্রথম "মূলাবিদ্যা" বা "মায়া"র ধারণাটিকে "ইতিবাচক অনাদি প্রকৃতির" বলে বর্ণনা করেন।[৮৫] বিবরণ শাখাটি জ্ঞানতত্ত্বমূলক মতবাদে বিশ্বাস করে। এই শাখার মতে ব্রহ্মই অবিদ্যার উৎস। এই শাখার সমালোচকেরা বলেন, শুদ্ধচৈতন্যের উৎস ব্রহ্ম অবিদ্যার উৎস হতে পারেন না। এই শাখায় জ্ঞান ও অজ্ঞান - এই দুই বিপরীতধর্মী গুণকেও ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যা এই মতের অন্যতম প্রধান সমস্যা।[web ১২]

পরবর্তীকালের বিকাশ

শঙ্কর-পরবর্তীকালে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তারা হলেন: প্রকাশাত্মা (দশম শতাব্দী), বিমুক্তাত্মা (দশম শতাব্দী), সর্বজ্ঞাত্মা (দশম শতাব্দী), শ্রীহর্ষ (দ্বাদশ শতাব্দী), চিৎসুখ (দ্বাদশ শতাব্দী), আনন্দগিরি (ত্রয়োদশ শতাব্দী), অমলানন্দ (ত্রয়োদশ শতাব্দী), বিদ্যারণ্য (চতুর্দশ শতাব্দী), শঙ্করানন্দ (চতুর্দশ শতাব্দী), সদানন্দ (পঞ্চদশ শতাব্দী), প্রকাশানন্দ (ষোড়শ শতাব্দী), নৃসিংহাশ্রম (ষোড়শ শতাব্দী), মধুসূদন সরস্বতী (সপ্তদশ শতাব্দী), ধর্মরাজ অদ্বরীন্দ্র (সপ্তদশ শতাব্দী), আয়াপ্পা দীক্ষিত (সপ্তদশ শতাব্দী), সদাশিব ব্রহ্মেন্দ্র (অষ্টাদশ শতাব্দী), চন্দ্রশেখর ভারতী (বিংশ শতাব্দী) ও সচ্চিদানন্দেন্দ্র সরস্বতী (বিংশ শতাব্দী)।[web ১৪]

প্রভাব

সারাংশ
প্রসঙ্গ

জনপ্রিয়করণ

শঙ্করের আগেও অদ্বৈতবাদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সে সময় এই মতবাদ বেদান্ত দর্শনে প্রধান স্থানটি অধিকার করতে পারেনি।[৮৬] বেদান্তের প্রথম যুগের দার্শনিকেরা ছিলেন সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ। তারা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন। তারা সমাজে এক উচ্চশ্রেণির জন্ম দেন। এই শ্রেণি হিন্দুধর্মের সাধারণ মতাবলম্বী ও তাত্ত্বিকদের থেকে স্পষ্ট পার্থক্য বজায় রাখত।[৮৭] তাদের শিক্ষা অল্পসংখ্যক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই প্রচারিত হয়েছিল।[৮৭] বেদান্ত শাখার প্রাচীন শাখাগুলিতে বিষ্ণু বা শিবের উপাসনার কথা নেই।[৮৮] শঙ্করের পরেই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মতাত্ত্বিকরা বেদান্ত দর্শনকে কমবেশি তাদের মতবাদের ভিত্তি হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন।[১৫] এর ফলেই ভারতীয় সমাজে বেদান্তের ধর্মীয় প্রভাবটি বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ নেয়।[৮৭]

বেদান্তীকরণ

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু বিশ্বজনীনতাবাদ

ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও বিদেশি উপনিবেশ স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু নবজাগরণ শুরু হয়। এই নবজাগরণের ফলে ভারত ও পাশ্চাত্য সমাজে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ধারণাই বদলে যায়।[১০] পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদেরা বেদের মধ্যে ভারতীয় ধর্মগুলির "সারবত্তা" খুঁজতে শুরু করেন।[৮৯] এদিকে একাধিক ধর্মীয় মতকে[৯০] এবং "আধ্যাত্মিক ভারত" নামে একটি জনপ্রিয় ধারণাকে "হিন্দুধর্ম" শব্দটির অধীনে আনা হয়।[৯০][১০] হিন্দুধর্মের সারমর্ম বেদে নিহিত আছে বলে পাশ্চাত্য গবেষকরা যা মনে করেছিলেন, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন হিন্দু সংস্কারপন্থীরাও। সেই সঙ্গে বিশ্বজনীনতাবাদ ও দীর্ঘস্থায়ী দর্শন মতের প্রভাবে সব ধর্মকে একটি সাধারণ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সত্য বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।[৯১] ইউনিটারিয়ান চার্চ[৯২] হিন্দুধর্মের এই নতুন পরিচয়ের প্রচারে ব্রাহ্মসমাজকে কিছুকাল সাহায্য করে।[৯৩]

বেদান্তকে হিন্দুধর্মের সারমর্ম ধরে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে অদ্বৈত বেদান্তকে হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক সত্ত্বার শাস্ত্রীয় উদাহরণ বলে ধরে নেওয়া হয়।[৯৪] হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাও এই মত পোষণ করতেন। তারা অদ্বৈত বেদান্তকে ভারতীয় ধর্মগুলির সর্বোচ্চ রূপ বলে প্রচার করতেন। ফলে এই মত প্রভূত জনপ্রিয়তা পায়।[৯৫] এর ফলে হিন্দুরা বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানোর জন্য একটি জাতীয় আদর্শ গঠন করার সুযোগ পান।[৯৬]

বিবেকানন্দের নব্য-বেদান্ত

অদ্বৈত বেদান্তের বিশ্বজনীন ও স্থায়িত্ববাদী ব্যাখ্যা জনপ্রিয় করার ব্যাপারে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ[৯৭] তিনি সামগ্রিকভাবে হিন্দু নবজাগরণ[৯৮]রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে অদ্বৈত বেদান্ত প্রচারে প্রধান ভূমিকাও নিয়েছিলেন। তার অদ্বৈত বেদান্ত ব্যাখ্যাটি "নব্য-বেদান্ত" নামে পরিচিত।[৯৯] ১৮৯৬ সালে লন্ডনে দেওয়া একটি বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেন,

আমি সাহসের সঙ্গে বলতে পারি যে, আধুনিক গবেষকদের থেকে বাহ্যিক ও নৈতিক ব্যাপারে একটি ধর্মই একটু এগিয়ে আছে আর সেটি হল অদ্বৈত। এই কারণেই এই ধর্ম আধুনিক বিজ্ঞানীদের এত আকর্ষণ করে। পুরনো দ্বৈতবাদী তত্ত্বগুলি তাদের পক্ষে যথেষ্ট নয় বলেই তাঁরা মনে করেন। শুধু বিশ্বাসে একজন মানুষের চলে না। তার চাই বৌদ্ধিক বিশ্বাস।".[web ১৫]

বিবেকানন্দ মুক্তি অর্জনের জন্য সমাধির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।[১০০] উপনিষদ্‌ বা শঙ্করের মতবাদের কোথাও সমাধির উপর একটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।[১০১] শঙ্কর ধ্যান ও নির্বিকল্প সমাধিকে আত্মা ও ব্রহ্মের একত্ব অনুভব করার জন্য জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি বলেছেন।[১০০] তবে এটিকে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলেননি:

রাজযোগ হল বিশ্ব ও বিশ্বস্বরূপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ধ্যানপদ্ধতি। এর ফলে ব্যক্তি বিশ্বের চূড়ান্ত সত্ত্বা বা চৈতন্যের অনুভূতি প্রাপ্ত হয়। ধ্রুপদি রাজযোগের চিত্তবৃত্তি নিরোধ আর এই পদ্ধতির মধ্যে ফারাক আছে।[১০০]

বিবেকানন্দের আধুনিকীকরণের সমালোচনায় বলা হয়:

কোনো দার্শনিক অদ্বৈতকে নিজের বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারেন কিনা সেই প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, [...] এই পদ্ধতিতে পাশ্চাত্যকরণ অদ্বৈত শাখার মূল ধারণাটিকেই অস্পষ্ট করে দিয়েছে। শঙ্করাচার্য যে স্বপ্নাবস্থা ও জাগ্রতাবস্থাকে মায়ার রাজত্বের বিষয় বলেছেন, তাকে অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে ত্যাগ ও চৈতন্যের বিষয়টি একটু খাটো হয়ে গিয়েছে।[৯৯]

নব্য-অদ্বৈত

"নব্য-অদ্বৈত" হল অদ্বৈত বেদান্তের জনপ্রিয় পাশ্চাত্য ব্যাখ্যা এবং রমণ মহর্ষির শিক্ষা-ভিত্তিক একটি নব্য ধর্মীয় আন্দোলন।[১০২] নব্য-অদ্বৈত মতটি সমালোচিত হয়।[১০৩][note ২০][১০৫][note ২১][note ২২] কারণ, প্রথাগত বিশ্বাস অনুযায়ী শাস্ত্রজ্ঞান[১০৬]জ্ঞানযোগ পথের গুরুত্ব এই মত অস্বীকার করে।[১০৬][১০৭] এই মতের প্রধান প্রবক্তারা হলেন এইচ. ডব্লিউ. এল. পুঞ্জা,[১০৮] তার শিষ্য গঙ্গাজি,[১০৯] অ্যান্ড্রু কোহেন,[note ২৩]একহার্ট টোল[১০২]

অদ্বৈতবাদ

পাশ্চাত্য আধ্যাত্মিকতা ও নিউ এজ মতবাদে বিভিন্ন মতবাদকে একই অদ্বৈতবাদী অভিজ্ঞতাপ্রসূত মনে করা হয়। এই জন্য অদ্বৈত বেদান্ত এই দুই মতাবলম্বীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।[১১১] অদ্বৈতবাদকে "উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের চেতনা ব্যতীত একটি অনাদি প্রাকৃতিক সচেতনতা" মনে করা হয়।[web ২১] এটিকে আবার "আন্তঃযোগাযোগতা" বা "ইন্টারকানেক্টেডনেস" হিসেবেও অভিহিত করা হত। অর্থাৎ, "এই মতে সব কিছুই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, কিছুই পৃথক নয়; কিন্তু একই সময় প্রতিটি বস্তুই তাদের স্বাতন্ত্র্য্য বজায় রাখছে।"[web ২২]

জর্জ ফুরস্টেইনের অদ্বৈতবাদ-সংক্রান্ত উদ্ধৃতি অনুসারে [note ২৪] অদ্বৈত বেদান্তের সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ:

সত্য বললে, এই জটিল ব্রহ্মাণ্ডে একটিই সত্য আছে। এখানে একটিই মহান সত্ত্বা আছেন, যাঁকে ঋষিরা বলেন ব্রহ্ম। ব্রহ্মের মধ্যেই অসংখ্য রূপ বিদ্যমান। সেই মহান সত্ত্বাই চৈতন্য। ইনিই সব কিছুর কেন্দ্র বা সকল জীবের আত্মা।[web ২৪][note ২৫]

ধর্মগ্রন্থ

সারাংশ
প্রসঙ্গ

উপনিষদ্, ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্র – এই তিন শ্রুতিশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে অদ্বৈত বেদান্ত মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত। আদি শঙ্কর তার ভাষ্যগুলিতে এই গ্রন্থগুলির দার্শনিক দিকগুলি আলোচনার মাধ্যমে এগুলিকে সুসংহত রূপ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই তিনটি ধর্মগ্রন্থ ও ভাষ্যগুলির উপর ভিত্তি করে অদ্বৈত মতবাদ আরও প্রসারিত হয়।

প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ

প্রামাণিকতার ভিত্তিতে বৈদিক ধর্মশাস্ত্রকে নিম্নলিখিত ক্রমে ভাগ করা যায়,

  • শ্রুতি: এই শাস্ত্রই হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় ধর্মশাস্ত্র। হিন্দুধর্মের প্রধান উৎস এবং সেই কারণে হিন্দু বিধিব্যবস্থায় সর্বাধিক প্রভাবশালী।[১১২]
  • স্মৃতি: হিন্দুধর্মের রীতিনীতিগুলিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এই শাস্ত্রে। উত্তর-বৈদিক যুগে রচিত রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ইত্যাদি এই শাস্ত্রের অন্তর্গত। এই ধর্মশাস্ত্রে মানুষের ধর্মাচরণের নিয়ম ব্যাখ্যাত হয়েছে।
  • পুরাণ: উত্তর-বৈদিক এই ধর্মশাস্ত্রে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও উৎপত্তি বিষয়ে পৌরাণিক কাহিনি এবং রাজা, যোদ্ধা, ঋষি ও দেবতাদের বংশতালিকা এবং সেই সঙ্গে হিন্দু দর্শনের আলোচনা পাওয়া যায়।[web ২৬]
  • শিষ্টাচার: সৎ আচরণবিধি-সংক্রান্ত ধর্মশাস্ত্র।
  • আত্মতুষ্টি: কোনটি সঠিক মত, তা নির্ণয়ের পদ্ধতি। প্রথম দিকে এটি প্রামাণ্য শাস্ত্র ছিল না। তবে মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে এটিকে শেষ প্রামাণিক ধর্মশাস্ত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

যদি এগুলির কোনোটির মত, ঊর্ধ্বতন ধর্মশাস্ত্রের মতের বিপক্ষে যায় তবে নিম্ন স্থানাধিকারী শাস্ত্রের মত বাতিল হয়ে যায়। ভারতীয়দের মধ্যে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে “স্মৃতির আগে শ্রুতি”। তাই কোনো আস্তিক দার্শনিক মতই শ্রুতি অর্থাৎ বেদের অনুমোদন ছাড়া গ্রহণযোগ্য হয় না।

প্রস্থানত্রয়ী

আদি শঙ্কর তিনটি ধর্মগ্রন্থকে “প্রস্থানত্রয়ী” বা তিন প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত করেন। এগুলি পরবর্তীকালে অন্যান্য বেদান্ত শাখাতেও প্রধান হিন্দু দর্শন গ্রন্থের মর্যাদা পায়।

এগুলি হল:

  1. উপনিষদ্‌ বা “উপদেশ প্রস্থান”,
  2. ভগবদ্গীতা বা “সাধন প্রস্থান”
  3. ব্রহ্মসূত্র বা “ন্যায় প্রস্থান” বা “যুক্তি প্রস্থান” (উত্তর মীমাংসা দর্শনের অংশ)

বারো বা তেরোটি উপনিষদ্ প্রধান, অন্যগুলি অপ্রধান। ভগবদ্গীতা মহাভারতের একটি অংশ। ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র গ্রন্থে উপনিষদ্ ও ভগবদ্গীতার সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছে।

আদি শঙ্কর প্রস্থানত্রয়ীর উপর ভাষ্য লিখেছিলেন। সেই জন্য অদ্বৈত পরম্পরায় মৌলিক ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায়।

সিদ্ধিগ্রন্থ

প্রস্থানত্রয়ীর পর অদ্বৈত পরম্পরায় চারটি সিদ্ধিগ্রন্থের স্থান:

  1. মণ্ডন মিশ্রের (৭৫০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ব্রহ্মসিদ্ধি,
  2. সুরেশ্বরের (খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী) নৈষ্কর্মসিদ্ধি,
  3. বিমুক্তানন্দের (১২০০ খ্রিষ্টাব্দ) ইষ্টসিদ্ধি,
  4. মধুসূদন সরস্বতীর (১৫৬৫-১৬৬৫) অদ্বৈতসিদ্ধি[web ২৭]

ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ

অদ্বৈত বেদান্তের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থগুলি হল:

  • অষ্টাবক্র সংহিতা (প্রাক-শঙ্কর), এই গ্রন্থে অদ্বৈত মতে উল্লেখ পাওয়া যায়।[note ২৬]
  • তত্ত্ববোধ (আদি শঙ্কর), এই গ্রন্থে অদ্বৈত বেদান্তের পরিভাষা ব্যাখ্যাত হয়েছে।[note ২৭]
  • আত্মবোধ, (আদি শঙ্কর)।[note ২৮]
  • বেদান্তসার (রামানুজ, ১০১৭-১১৩৭ খ্রিষ্টাব্দ[web ৩৪])[note ২৯]
  • বাক্যবৃত্তি
  • লঘুবাক্যবৃত্তি
  • দৃগ্‌দৃশ্যবিবেক
  • পঞ্চীকরণম্‌
  • বেদান্ত-পরিভাষা (ধর্মরাজ অর্ধ্বরীন্দ্র)
  • অদ্বৈত-মকরন্দ (লক্ষ্মীধর কবি)
  • অপরোক্ষানুভূতি
  • দক্ষিণামূর্তি স্তোত্রম্‌
  • পঞ্চদশী (বিদ্যারণ্য)
  • কৌপিন-পঞ্চকম্‌
  • সাধন-পঞ্চকম্‌
  • মণীষা-পঞ্চকম্‌
  • দশশ্লোকী

আধুনিক ধর্মগ্রন্থ

অদ্বৈত বেদান্ত সম্পর্কে ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ আধুনিক কালেও লেখা হয়েছে। জ্ঞানযোগ স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলি পাশ্চাত্যে অদ্বৈত বেদান্তের প্রসারে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।

দর্শন

সারাংশ
প্রসঙ্গ

অদ্বৈত বেদান্তের দর্শনের ভিত্তি উপনিষদ্‌, ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্র। আদি শঙ্কর তার ভাষ্যগুলির মধ্যে এগুলির অন্তর্নিহিত দার্শনিক অর্থ আলোচনা করেছেন। এই জন্য এই গ্রন্থগুলি অদ্বৈত বেদান্ত পরম্পরায় কেন্দ্রীয় ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায়।

পুরুষার্থ

ভারতীয় দর্শনে পুরুষার্থ বা মানুষের জীবনের প্রধান চারটি লক্ষ্যের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়:[১১৩]

  • ধর্ম: জীবনের সঠিক পথ, "নিজের ও সমাজের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্য ও দায়িত্ব এবং ব্যক্তির প্রতি সমাজের কর্তব্য ও দায়িত্ব"কে ধর্ম বলা হয়েছে;[১১৪]
  • অর্থ: ব্যক্তির জীবন নির্বাহের জন্য উপযুক্ত জীবিকা;
  • কাম: আনন্দ ও বিনোদন;
  • মোক্ষ: মুক্তি।

পুলিগ্যান্ডলার মতে:

যথাযথ নামবিশিষ্ট কোনো দর্শনেরই শুধুমাত্র বৌদ্ধিক অনুশীলনমাত্র না হয়ে এমন কিছু ব্যবহারিক দিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত, যাতে মানুষ আলোকিত জীবন যাপন করতে পারবে। যে দর্শনে গুণমান ও আমাদের জীবনযাত্রার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না, সেই দর্শন দর্শনই নয়, শুকনো বৌদ্ধিক ইমারত মাত্র।[১১৫]

মোক্ষ অর্জনের জন্য অদ্বৈত বেদান্ত বিস্তারিত পথের বর্ণনা দেয়। এই দর্শন আত্ম-অনুসন্ধান ও ব্যক্তির সত্যকারের সত্ত্বার অনুসন্ধানের প্রতি যৌক্তিক গুরুত্ব আরোপ করে। এই অনুসন্ধানের জন্য যে সব অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলিতে এবং বিশেষ করে জ্ঞানযোগের অনুশীলনের ক্ষেত্রে কামনাবাসনার নিবৃত্তির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।[web ১৭]

মোক্ষ

অদ্বৈত বেদান্তের লক্ষ্য হল আত্মাব্রহ্মের একত্ব অনুভূতির মাধ্যমে মোক্ষ অর্জন। আদি শঙ্করের মতে, উপনিষদ্‌, ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্রের দার্শনিক উপলব্ধির মাধ্যমে ব্রহ্ম সম্পর্কে জানা সম্ভব। এজন্য সমন্যাস (আত্মসমীক্ষা), শ্রবণ (ঋষিদের বাক্য শোনা), মনন (উপদেশ মনে রাখা) ও ধ্যান (তত্ত্বমসি সত্যের চিন্তা) – এই চারটি স্তর পেরোতে হয়।

আত্মা ও ব্রহ্মের স্বরূপ

অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে, আত্মা ও ব্রহ্মের স্বরূপ জানলে মোক্ষলাভ সম্ভব। পটারের মতে,

৮. সর্বোচ্চ সত্য হলেন শুদ্ধ চৈতন্য, তার বাইরে তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব নয়।

৯. আর এই সর্বোচ্চ সত্য, যিনি শুদ্ধ চৈতন্য, তিনি জগতের সর্বোচ্চ সত্ত্বা ব্রহ্মের থেকে পৃথক নন [...]

১১. [...] ব্রহ্ম (=সর্বোচ্চ সত্য, শুদ্ধ চৈতন্য) একমাত্র সত্য (সৎ), কারণ তিনি দ্বৈত, অজ্ঞানের চিহ্নের স্পর্শ পাননি এবং তিনিই একমাত্র সত্ত্বা যাঁকে সূক্ষ্ম করা যায় না।[]

"জ্ঞান"-কেই "শুদ্ধ চৈতন্য" বলা হয়।[] যদিও "জ্ঞানম্"[] শব্দটি সাধারণ অনুবাদে "চৈতন্য"। শব্দটির বৃহত্তর অর্থ "জানা", "কোনো কিছুর সঙ্গে পরিচিত হওয়া",[web ২] "কোনো কিছু জানা",[web ২] "সচেতনতা",[web ২] বা "উচ্চতর জ্ঞান"।[web ২]

"ব্রহ্ম" শব্দের অর্থও অনেক বিস্তারিত। পল ডুসেনের মতে,[১৬] ব্রহ্ম হলেন:

  • সত্যম্, "সর্বোচ্চ সত্য তবে তাঁকে দেখা বা শোনা যায় না।
  • জ্ঞানম্, "সেই জ্ঞান যা উদ্দেশ্য ও বিধেয়তে বিভক্ত হয়নি। "
  • অনন্তম্, "যাঁর সীমা বা পরিসীমা নেই।"

ডেভিড লের মতে,

ব্রহ্মজ্ঞান [...] বলতে অন্য কিছু ব্রহ্ম তা বোঝায় না, বোঝায় আমি নিজেই ব্রহ্ম।[১১৬]

সচ্চিদানন্দ ধারণাতেই একই কথা পাওয়া যায়। এই ধারণায় ব্রহ্মের গুণাবলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শব্দটির অর্থ সাধারণত "চিরন্তন আনন্দময় চৈতন্য",[১১৭] "সর্বোচ্চ আনন্দময় চৈতন্য",[web ৩৯] বা "অস্তিত্ব, চিন্তা ও আনন্দের মিলিত রূপ"।[web ৪০] সচ্চিদানন্দ শব্দটি তিনটি সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণে গঠিত:

এই জ্ঞান হল স্বতঃস্ফুর্ত জ্ঞান। [১২০][note ৩১]

মহাবাক্য

যে বাক্যে “মানুষের অন্তরের অমর সত্ত্বা ও বৃহৎ জাগতিক শক্তিকে এক ও অভিন্ন” বলে উল্লেখ করা হয়, তাকেই “মহাবাক্য” বলা হয়।[১২১] এই ধরনের বাক্য বেদ-এ অনেক আছে। তবে প্রত্যেক বেদ থেকে একটি করে বাক্যকে মহাবাক্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।

আরও তথ্য সংখ্যা, বাক্য ...
সংখ্যা বাক্য অর্থ উপনিষদ্ বেদ
प्रज्ञानं ब्रह्म (প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম) প্রজ্ঞান[note ৩২] হলেন ব্রহ্ম[note ৩৩] ঐতরেয় ৫।৩ ঋগ্বেদ
अहं ब्रह्मास्मि (অহং ব্রহ্মাস্মি) আমি ব্রহ্ম, বা আমি দিব্যসত্ত্বা[১২৬] বৃহদারণ্যক ১।৪।১০ শুক্ল যজুর্বেদ
तत्त्वमसि (তত্ত্বমসি) তুমিই সেই ছান্দগ্যো ৬।৮।৭ সামবেদ
अयमात्मा ब्रह्म (অয়মাত্মা ব্রহ্ম) এই আত্মা হলেন ব্রহ্ম মাণ্ডুক্য ২ অথর্ববেদ
বন্ধ

জীবন্মুক্ত

অদ্বৈতবাদীরা বিশ্বাস করেন, জাগতিক দুঃখকষ্টের কারণ হল মায়া। এই মায়াই মিথ্যা বা বৈতথ্য নামে পরিচিত। একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানই মায়াকে ধ্বংস করতে সক্ষম। সাধারণ ভূমিতে জীব ও ঈশ্বর “পরস্পর থেকে ভিন্ন এবং শুদ্ধ চৈতন্য ও সর্বোচ্চ সত্য (পারমার্থিকা) ব্রহ্মের তুলনায় সত্যের এক ধাপ নিচে অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়”।[web ৪৭] মায়া অপসারিত হলে "ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব ন অপরঃ" (ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা, জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন নয়) এই সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয়:[web ৪৮]

ব্রহ্ম (সর্বোচ্চ সত্ত্বা) হলেন একমাত্র সত্য; এই জগৎ পরিবর্তনশীল; জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন নয়।[web ৪৮]

ব্রহ্মজ্ঞান লাভের এই অবস্থাকেই বলা হয় “জীবন্মুক্ত”।[১২৭]

গুরুর প্রয়োজনীয়তা

গুরুর সহায়তা গ্রহণ

আদি শঙ্কর ও অন্যান্য ধর্মগুরুর মতে, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন অনুসরণ করতে গেলে একজন গুরুর (শিক্ষক) সহায়তা গ্রহণ আবশ্যক।[১২৮] গুরু বেদ ব্যাখ্যা ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলির সমাধানের পথ বলে দিয়ে শিষ্যের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানের স্ফুরণ ঘটাতে পারেন বলে বিশ্বাস করা হয়। গুরুর ভূমিকা শুধুমাত্র অণুপ্রেরণাদাতা বা পরামর্শদাতার ভূমিকা নয়, শিষ্যকে যথার্থরূপে ব্রহ্মজ্ঞানী করে তোলার দায়িত্ব গুরুকে পালন করতে হয়।[১২৯]

গুরুর গুণাবলি

মাণ্ডুক্য উপনিষদ্ (১।২।১২) অনুসারে গুরুর মধ্যে নিম্নোক্ত গুণগুলি থাকা আবশ্যক:

  1. শ্রোত্রিয় — গুরুকে বেদজ্ঞসম্প্রদায় সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে হয়।
  2. ব্রহ্মনিষ্ঠ— আক্ষরিক অর্থে ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত; ব্রহ্ম সর্বব্যাপী এই তত্ত্ব গুরুকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করতে হয়। সবকিছুর মধ্যে এবং নিজের মধ্যে তাকে ব্রহ্মকেই দেখতে হয়।

শিষ্যকে গুরুর সেবা করতে হয়। ভগবদ্গীতা (৪।৩৪) অনুসারে, শিষ্যকে সংশয় নাশের জন্য গুরুর কাছে সশ্রদ্ধভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। অদ্বৈত মতে, তা করলে শিষ্য মোক্ষ (জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি) অর্জন করতে পারেন।

অদ্বৈত অনুশীলন

অদ্বৈত অনুশীলন, বিশেষত জ্ঞানযোগের অনুশীলনের জন্য “বাসনার নিবৃত্তির একান্ত প্রয়োজন” বলে মনে করা হয়। অদ্বৈতবাদীরা বলেন, কামনা ও বাসনা থাকলে সত্যকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।[web ১৭]

জ্ঞানযোগ – ধর্মানুশীলনের চারটি স্তর

ধ্রুপদী অদ্বৈত বেদান্ত জ্ঞানযোগের পথটির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। জ্ঞানযোগ হল অধ্যয়ন ও তপস্যার দ্বারা মোক্ষ অর্জনের পথ। এই পথে চারটি স্তর রয়েছে:[১৩০][web ৪৯]

  • সমন্যাস বা সম্পত্তি:[১৩১] এগুলিকে সাধন-চতুষ্টয় (চার প্রকার সাধনা) বলা হয়:[১৩০][web ৫০]
    • নিত্যানিত্য বস্তু বিবেক (नित्यानित्य वस्तु विवेकम्) — যা কিছু চিরন্তন ("নিত্য") বস্ত (অর্থাৎ ব্রহ্ম) এবং যা কিছু চিরন্তন নয় ("অনিত্য") তার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণের ক্ষমতা ("বিবেক")।
    • ইহাঽমুত্রার্থ ফল ভোগবিরাগম্‌ (इहाऽमुत्रार्थ फल भोगविरागम्) — এই জগতের ("ইহ") ও পরকালে ("অমুত্র") প্রাপ্তব্য ভোগ্যবস্তু সকল ("অর্থ ফল ভোগ) সম্পর্কে বিতৃষ্ণা ("বিরাগ")।
    • শমাদি ষট সম্পত্তি (शमादि षट्क सम्पत्ति) — ছয়টি গুণ,
      • শম (অন্তঃকরণের সংযম)।[web ৫১]
      • দম (বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলির সংযম)।
      • উপরতি (বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোগ্য বস্তু থেকে দূরে রাখা অথবা শাস্ত্রীয় কর্ম ত্যাগ করা)।[note ৩৪]
      • তিতিক্ষা (ত্রিতাপ সহ্য করা)
      • শ্রদ্ধা (গুরুবেদের শিক্ষাগুলিতে বিশ্বাস স্থাপন)।
      • সমাধান (ব্রহ্ম ও গুরুতে মনোযোগ স্থাপন)।
    • মুমুক্ষুত্ব (मुमुक्षुत्वम्) — এই জগৎ যে প্রকৃতিগতভাবে দুঃখময় সে সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন এবং মোক্ষ (জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি) লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
  • শ্রবণ, উপনিষদ্‌ ও অদ্বৈত বেদান্ত সম্পর্কে ঋষিগণের উপদেশ শোনা এবং ব্রহ্মসূত্র ইত্যাদি বৈদান্তিক গ্রন্থ পাঠ। এই স্তরে শিক্ষার্থী ব্রহ্মের সত্য স্বরূপ ও আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে শিক্ষা করেন।
  • মনন, এই স্তরে উক্ত শিক্ষাগুলি সম্পর্কে শিক্ষার্থী চিন্তা করেন।
  • ধ্যান, এই স্তরে "তত্ত্বমসি" সত্যটিকে ধ্যান করা হয়।
ভক্তিযোগ

অদ্বৈত বেদান্তে ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের পথদুটিকে সহকারী পথ মনে করা হয়।

ভক্তিযোগে ঈশ্বরকে কোনো একটি বিশেষ রূপে (যেমন কৃষ্ণ বা কালী) পূজা করা হয়। আদি শঙ্কর নিজেও ছিলেন ভক্তিযোগের অন্যতম প্রবক্তা। তবে আদি শঙ্করের মতে, বৈদিক যাগযজ্ঞ, পূজা ও ভক্তির সাধনা ব্যক্তিকে জ্ঞানের পথে নিয়ে যায় মাত্র, ভক্তির দ্বারা মোক্ষলাভ করা সম্ভব হয় না। ভক্তিযোগের পথে শুক্লগতিতে মোক্ষে পৌঁছানো যায়।

কর্মযোগ

কর্মযোগ হল ব্যক্তিগত লাভ বা ক্ষতির হিসেব না করে কর্তব্য কর্ম করে যাওয়া। স্বামী বিবেকানন্দের মতে,

কর্মযোগ হল সকল কর্ম মনোযোগ-সহকারে করে তার ফল ঈশ্বরে সমর্পণ। কর্মযোগ হল ঈশ্বর-সহবাসে থেকে সকল কর্মের সাধন, যার মাধ্যমে সব বন্ধন ক্ষয় হয় এবং যা থাকে তা সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেই থাকে।

কর্মযোগ হল মানবসমাজের প্রতি নিঃস্বার্থ কর্তব্য সাধন। কর্মযোগ হল সেই যোগ যা হৃদয়কে শুদ্ধ করে এবং আত্মজ্ঞান লাভের পথে অন্তঃকরণকে তৈরি করে। মূল কথাটা হল কোনো রকম স্বার্থ বা অহংকার ছাড়া তোমাকে মানবজাতির সেবা করতে হবে।

[web ৫২]

ঈশ্বর মিথ্যা ও সত্য

সর্বোচ্চ ধারণায় ঈশ্বরকে “মিথ্যা” বলা হয়েছে, কারণ ব্রহ্ম মায়ার আবরণের জন্য ঈশ্বর রূপে প্রতিভাত হন। তবে পার্থিব ক্ষেত্রে যেহেতু জগৎ সত্য, সেই হেতু ঈশ্বরও পার্থিব ক্ষেত্রে সত্য। জগৎ যেহেতে সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, ঈশ্বরও সেহেতু সম্পূর্ণ মিথ্যা নন।

সগুণ ব্রহ্ম

ঈশ্বরকে সগুণ ব্রহ্ম বা সাকার ব্রহ্ম বলা হয়। ব্রহ্মের এই সত্ত্বাটি মানবীয় ও ঐশ্বরিক গুণাবলির সংমিশ্রণ। এই ধারণায় ঈশ্বর শিব, বিষ্ণু বা কালীর রূপে পূজিত হন।

কর্ম

ঈশ্বর কর্মফলদাতা। ব্রহ্মই ঈশ্বর। ঈশ্বর জ্ঞানের সাকার মূর্তি। ভক্তির মাধ্যমে অসৎ কর্মের ফল নষ্ট হয়। এর ফলে সত্য জ্ঞান অর্জন হয় ও মন শুদ্ধ হয়। ধীরে ধীরে পূজ্য ও পূজকের মধ্যে ভেদ ঘুচে যায় এবং জ্ঞানের ফলে জীব মোক্ষ লাভ করে।

বেদে ঈশ্বর

আদি শঙ্কর বেদ থেকে ঈশ্বরের একমাত্র প্রমাণ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বর যুক্তি ও চিন্তার অগম্য। কান্টও একইভাবে দেখিয়েছেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাসই আস্তিক্যবাদের মূল কথা। যদিও আদি শঙ্কর ঈশ্বরের আরও কিছু যুক্তিগত প্রমাণ দেখিয়েছেন। তবে বলেছেন, এগুলির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায় না। এগুলি হল:

  • জগৎ একটি কার্য। সেক্ষেত্রে এর একটি কারণও থাকবে। এই কারণটি হল ঈশ্বর।
  • জগৎ আশ্চর্যজনকভাবে ঐক্যবদ্ধ। অর্থাৎ, এর স্রষ্টা নিশ্চয় বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন।
  • মানুষ ভাল ও মন্দ কাজ করে ইহকালে বা পরকালে ফল ভোগ করে। মানুষ নিজের কর্মের ফল নিজেকে দিতে পারে না। কেউই পাপের ফল নিজেকে দিতে পারে না। একইভাবে ফলদাতা চৈতন্যবিহীন হতে পারেন না। অর্থাৎ কর্মের ফলদাতা হলেন ঈশ্বর।

নীতিবোধের স্থান

কোনো কোনো মতে, অদ্বৈত বেদান্তে নীতিবোধের কোনো স্থান নেই। “কারণ, এটি পুরোপুরিই নশ্বরতা সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক তত্ত্ব। অনৈতিক না হলেও, এটিকে “নীতিনিরপেক্ষ” বলা চলে।” [১৩২]

তবে অন্য মতে অদ্বৈত দর্শনে নীতির স্থান আছে। অদ্বৈত মতানুসারে, সৎ কর্ম সত্য জ্ঞান অর্জনে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে।[১৩৩] প্রমাণের মাধ্যমে কর্মের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়।[note ৩৫] যদিও অদ্বৈত শিক্ষার্থীদের বিদ্যা অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন ও অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কর্মের আদর্শ অনুসরণ করা হয়।

সত্য, অহিংসা, জীবে সেবা ও দয়া হল ধর্ম এবং মিথ্যা, হিংসা, প্রতারণা, স্বার্থপরতা ও লোভ হল অধর্ম। যদিও কোনো প্রধান অদ্বৈত ধর্মগ্রন্থে ধর্মের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

অদ্বৈত ও ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখা

সারাংশ
প্রসঙ্গ

অদ্বৈত মতের বিকাশ ঘটেছিল এক বহুমুখী ধর্মীয় ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে। বৌদ্ধধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম ও বেদান্তের অন্যান্য শাখাগুলির সঙ্গে অদ্বৈতবাদের মতের আদানপ্রদান ঘটেছে।

মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রভাব

বেদান্তের অন্যান্য শাখাগুলির মতো শঙ্করের অদ্বৈত মতও নিজেকে প্রধানত উপনিষদ্ [note ৩৬], ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্র-ভিত্তিক বলে দাবি করে। কিন্তু অনেক গবেষকের মতে, এর মধ্যে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়। মহাযানের দুটি উপশাখার সঙ্গে শঙ্করের মতের মিল আছে বলে ধারণা করা হয়। এদুটি হল নাগার্জুন প্রবর্তিত মধ্যমক [১৩৫] এবং বসুবন্ধু [১৩৬]অসঙ্গ [১৩৭] প্রবর্তিত (প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে) যোগাচার মত।[১৩৮]

জন গ্রিমস লিখেছেন, অতীতে অদ্বৈত বেদান্তের উপর মহাযান মতের প্রভাবের বিষয়টি উপেক্ষিত হলেও, এখনকার গবেষকরা এই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন না।

এলিয়ট ডচ ও রোহিত ডালভি লিখেছেন:

যে কোনো ক্ষেত্রেই মহাযান শাখা ও বেদান্তের মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল। মহাযানের নির্দিষ্ট মতটি বেদান্তে গৃহীত না হলেও যুক্তিবাদের পদ্ধতিটি গৃহীত হয়েছিল পরবর্তীকালে।[১৩৯]

এস. মুদগল বলেছেন, কয়েকজন রক্ষণশীল ভারতীয় গবেষক ধরে নিয়েছেন যে শঙ্কর

কার্যত (বৌদ্ধদের) সব যুক্তিবিদ্যা, পদ্ধতি, যুক্তি ও ব্যাখ্যা, ধ্যানধারণা, পরিভাষা এমনকি পরমতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁদের দর্শনটিও গ্রহণ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বৌদ্ধধর্মের বেদান্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মটিকেও লুপ্ত করে দেন... শঙ্কর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই গ্রহণ করা বৌদ্ধধর্মের পক্ষে কাল হল।[১৪০]

গৌড়পাদ পর্যন্ত এই প্রভাব দেখা যায়:

গৌড়পাদ অনেক সময় যুক্তি দিতে গিয়ে বা পার্থক্য করতে গিয়ে বৌদ্ধ দার্শনিক সূত্র থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এমনকি এই যুক্তির প্রেক্ষিতে যে রূপ ও কল্পনাগুলির ব্যবহার হয়েছে, সেগুলিও ব্যবহার করেছেন।[১৩৯]

মাইকেল কম্যানসও বলেছেন, কীভাবে আদি-বৈদান্তিক গৌড়পাদ মধ্যমক মৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তির অবতারণা করেছেন। যদিও কম্যানস মনে করেন, বৌদ্ধমত ও গৌড়পাদের মতের মৌলিক তত্ত্বগুলির মধ্যে ফারাক আছে। বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি তার পরাধীন উৎসের তত্ত্ব। তবে গৌড়পাদ তা নেননি। তার অজাতিবাদ হল অপরিবর্তনশীল অদ্বৈত সত্যের উপর প্রয়োগ করা যুক্তিবাদের ফলস্রুতি। এটিই উপনিষদের মূল কথা।[১৪১]

উপনিষদের প্রভাব

অনেক লেখকের মতে, বৌদ্ধধর্ম ও অদ্বৈতবাদের মধ্যেকার সাদৃশ্যের কারণটি হল উভয় মতের উপর উপনিষদের প্রভাব। দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তার ইন্ডিয়ান ফিলোজফি বইতে বলেছেন:

"সন্দেহ নেই বৌদ্ধধর্ম ও অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। তবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, দুই ধারার প্রেক্ষাপটই হল উপনিষদ্।"[১৪২]

সি. ডি. শর্মা তার আ ক্রিটিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ান ফিলোজফি বইতে বলেছেন:

বৌদ্ধধর্ম ও বেদান্তকে দুটি পরস্পরবিরোধী মত বলে মনে করা উচিত না। শুধু যে মতটি উপনিষদ্ থেকে উৎসারিত, সেটি বুদ্ধের পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে পরে বিস্তারিত হয়ে হয়েছে মহাযান বৌদ্ধধর্ম। গৌড়পাদ এর বিরোধিতা করেন। পরে সেই মত শঙ্করের মতবাদে পূর্ণতা পায়।[১৪৩]

মুদগল বলেছেন, শঙ্করের অদ্বৈত হল দুটি স্বাধীন ও পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারার মিশ্রণ। এই দুটি মত হল রক্ষণশীল ঔপনিষদ্ ও উদার বৌদ্ধ মত।[১৪৪]

অদ্বৈত সমালোচনা

অদ্বৈত মতের সঙ্গে বৌদ্ধ মতের সাদৃশ্য থাকার জন্য পরবর্তীকালে প্রবর্তিত বেদান্ত শাখাগুলি যেমন অদ্বৈত মতের নিন্দা করেছে, তেমনি ভাব্যবিবেক প্রভৃতি মহাযান মতগুলিকে থেরবাদী বৌদ্ধেরা বেদান্তানুসারী বলে নিন্দা করেন।[১৪৫][note ৩৭][১৪৬]

শঙ্কর এই সব অভিযোগের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন:

শঙ্করের বৌদ্ধধর্ম-বিরোধিতা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় শঙ্কর কীভাবে বৌদ্ধ মত ও তাঁর বেদান্ত দর্শনের পার্থক্য করেছিলেন।[১৩৯]

পারস্পরিক প্রভাব

কলুপাহন ‘চরমপন্থী’ ও ‘ভাবপন্থী’দের মিলনের কথা বলেছেন। তিনি দেখেছেন, এই মিলনের বিরোধী মধ্যমক ও যোগাচার শাখাগুলি কীভাবে মিলনের বিরোধিতা করতে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের আদি মতবাদের দিকে ফিরতে চেয়েছে।[১৪৭][১৪৮] উভয় শাখাই তিব্বত, চীন ও জাপানে টিকে আছে। এগুলির মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু ভারতে এই শাখাগুলি এবং ‘ভাবপন্থী’ শাখাটি অবলুপ্ত।

আধুনিক কালে বুদ্ধের প্রশংসা

আধুনিক ভারতে অদ্বৈত বেদান্ত শাখার গুরুরা বুদ্ধের প্রশংসা করেছেন। উনিশ শতকের ভারতের ধর্মীয় ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বিবেকানন্দ বুদ্ধের অনেক প্রশংসা করেছেন। [১৪৯] তিনি অদ্বৈত ও বৌদ্ধ মতের মিলগুলির কথাও বলেছেন।[১৫০]

সাধারণ মৌলিক তত্ত্ব

এন. ভি. ইসায়েভা প্রমুখ পশ্চিমী গবেষকেদের মতে, ঐতিহাসিক বা আকস্মিক বিস্তারের মাধ্যমে সংস্কৃত হওয়ার পর অদ্বৈত ও বৌদ্ধ দর্শনকে অবশ্যই একই সর্বোচ্চ সত্যের দুটি পৃথক অভিপ্রকাশ বলা চলে।[১৫১]

ধর্ম-ইতিহাসবিদ নিনিয়ান স্মার্টের মতে, শঙ্কর ও মহাযান মতের মধ্যেকার পার্থক্যটির মূল কারণ, নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ ও প্রেক্ষাপট। এর সার বক্তব্যের মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই।[১৫২][note ৩৮]

বেদান্তের অন্যান্য শাখাগুলির সঙ্গে সম্পর্ক

শঙ্করের অদ্বৈত ব্যাখ্যা ও প্রসারের ফলে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত

বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের প্রবর্তম যমুনাচার্য (দশম শতাব্দী) শঙ্করের অদ্বৈতবাদের বিরোধিতা করেছেন। তিনি তার সিদ্ধিরায় বইতে অদ্বৈতকে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, বৌদ্ধদের মতো অদ্বৈতবাদীরাও জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়য়ের মধ্যেকার পার্থক্যকে মিথ্যা মনে করেন। তিনি বলেছেন, অদ্বৈত মায়ার দিকে নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধ মতবাদ বুদ্ধির দিকে নিয়ে যায়।[১৫৩] অপর বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী দার্শনিক রামানুজাচার্য শঙ্করকে "প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ" বলেছেন।[১৫৪]

দ্বৈত বেদান্ত

মধ্ব (১২৩৮-১৩১৭) ছিলেন দ্বৈত বেদান্তের প্রবর্তক। এটি একটি বৈষ্ণব মত। এতে অদ্বৈতবিরোধী একটি উপনিষদ্-ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মধ্বের জীবনীকার নারায়ণ তার লেখা মধ্ব-জীবনী গ্রন্থ মধ্ববিজয়ে শঙ্কর ও মধ্বকে আজন্ম শত্রু এবং শঙ্করকে “পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া এক দৈত্য” বলেছেন।[১৫৫] সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন, মধ্ব-সংক্রান্ত লোককথাগুলিতে এও লেখা হয়েছে যে, শঙ্করের অনুগামীরা “চক্রান্তকারী এবং তাঁরা মঠ পুড়িয়েছেন, গবাদি পশু হত্যা করেছেন এবং নারী ও শিশুদেরও হত্যা করেছেন।” [১৫৬]

অদ্বৈত ও কাশ্মীরি শৈবধর্ম

কালক্রমে, অদ্বৈত মতাবলম্বীরা শঙ্করকে শিবের অবতার বলে মানতে শুরু করেন।[web ৫৫][১৫৭] অভিনবগুপ্ত প্রবর্তিত কাশ্মীরি শৈবধর্মও আপাত অদ্বৈত-অনুসারী একটি মত। এটি অনেক ব্যাপারে অদ্বৈত মতের অনুসরণ করলেও, কয়েকটি প্রধান ক্ষেত্রে দুই মতের পার্থক্য আছে। যেমন, অদ্বৈত বেদান্তের মূল ভিত্তি উপনিষদ্, ভগবদ্গীতাব্রহ্মসূত্র হলেও,[১৫৮] কাশ্মীরি শৈবধর্ম ভৈরব তন্ত্র ও কৌল তন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত।[১৫৯] কোনো কোনো গবেষকের মতে, অভিনবগুপ্ত গৌড়পাদ প্রমুখ অদ্বৈতবাদী দার্শনিকেদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।[১৬০][note ৩৯]

অদ্বৈত ও সুফিবাদ

ইসলাম ধর্মের একটি মরমিয়া সম্প্রদায় হল সুফিবাদ। সুফি ধর্মবিদ মার্টিন লিংস বলেছেন,

রাজকুমার দারা শিকো (মৃত্যু ১৬১৯) ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সুফি মতাবলম্বী পুত্র। তিনি বলেছিলেন, সুফিবাদ ও হিন্দুদের অদ্বৈত বেদান্তের মধ্যে শুধু পারিভাষিক পার্থক্য ছাড়া বাকি সবই এক।[web ৫৬]

ওয়াহদাত আল-উজুদের সূফী ধারণা অদ্বৈত বেদান্তে দাবি করা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি।[১৬১] জিয়াউর রহমান আজমি দাবি করেন, ওয়াহাদাতুল উজুদের উৎপত্তি হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শন থেকে, যা ইবনে আরাবি ভারত সফরের পর তার মক্কা বিজয় গ্রন্থে লিখেছেন, যা খলীফা আল মামুনের শাসনামলে আরবিতে অনূদিত হয় এবং মনসুর হাল্লাজ অসংখ্যবার ভারত সফরের সময় বিভিন্ন গ্রন্থে এই ধারণার কথা লিখেছেন। ভারত সফরের পর বাগদাদে ফিরে হাল্লাজ ধ্যানরত অবস্থায় বলতেন, أنا الحق("আনাল্ হাক্ক") "আমিই পরম সত্য", যা তিনি নিয়েছিলেন ভারত ভ্রমণের সময় মহাবাক্য দর্শনের একটি বাক্য "অহম ব্রহ্মাস্মি" থেকে।[১৬২]

শিক্ষকদের তালিকা

ভারত ও অন্যান্য দেশে বিভিন্ন সময়ে অদ্বৈত বেদান্তের অনেক শিক্ষক ছিলেন এবং আছেন।

আরও দেখুন

  • শ্রীগৌড়পাদাচার্য মঠ
  • কাশ্মীরি শৈবধর্ম
  • শ্রীঙ্গেরি মঠ
  • অধ্যাত্মপ্রকাশ কার্যালয়
  • সুফি অধিবিদ্যা

টীকা

  1. Although the common translation of jnanam[] is "consciousness", the term has a broader meaning of "knowing"; "becoming acquainted with",[web ২] "knowledge about anything",[web ২] "awareness",[web ২] "higher knowledge".[web ২] See also jnana, prajna and Prajñānam Brahma.
  2. Literally: end or the goal of the Vedas.
  3. "Brahman" too has a broader meaning than "pure consciousness". According to Paul Deussen,[১৬] Brahman is:
    • Satyam, "the true reality, which, however, is not the empirical one
    • Jñãnam, "Knowledge which, however, is not split into the subject and the object"
    • anantam, "boundless or infinite"
    See also satcitananda.
  4. "Brahman" is not to be confused with Brahma, the Creator and one third of the Trimurti along with Shiva, the Destroyer and Vishnu, the Preserver.
  5. Bhartŗhari (c.450–500), Upavarsa (c.450–500), Bodhāyana (c.500), Tanka (Brahmānandin) (c.500–550), Dravida (c.550), Bhartŗprapañca (c.550), Śabarasvāmin (c.550), Bhartŗmitra (c.550–600), Śrivatsānka (c.600), Sundarapāndya (c.600), Brahmadatta (c.600–700), Gaudapada (c.640–690), Govinda (c.670–720), Mandanamiśra (c.670–750).[১৯]
  6. Nakamura notes that there are contradictions in doctrine between the four chapters.[৩২]
  7. It is often used interchangeably with the term citta-mātra, but they have different meanings. The standard translation of both terms is "consciousness-only" or "mind-only." Several modern researchers object this translation, and the accompanying label of "absolute idealism" or "idealistic monism".[৩৫] A better translation for vijñapti-mātra is representation-only.[৩৬]
  8. 1. Something is. 2. It is not. 3. It both is and is not. 4. It neither is nor is not.[web ৪][৩৭]
  9. The influence of Mahayana Buddhism on other religions and philosophies was not limited to Vedanta. Kalupahana notes that the Visuddhimagga contains "some metaphysical speculations, such as those of the Sarvastivadins, the Sautrantikas, and even the Yogacarins".[৩৯]
  10. "An" means "not", or "non"; "utpāda" means "genesis", "coming forth", "birth"[web ৫] Taken together "anutpāda" means "having no origin", "not coming into existence", "not taking effect", "non-production".[web ৬] The Buddhist tradition usually uses the term "anutpāda" for the absence of an origin[৪২][৪১]or sunyata.[৪৪] The term is also used in the Lankavatara Sutra.[৪৫] According to D.T Suzuki, "anutpada" is not the opposite of "utpada", but transcends opposites. It is the seeing into the true nature of existence,[৪৬] the seeing that "all objects are without self-substance".[৪৭]
  11. "A" means "not", or "non" as in Ahimsa, non-harm; "jāti" means "creation" or "origination;[৪৮] "vāda" means "doctrine"[৪৮]
  12. সংস্কৃত: श्री संस्थान गौडपदाचार्य मठ, Śrī Sansthāna Gauḍapadācārya Maṭha
  13. In the east the Pala Empire[৫৮] (770–1125 CE[৫৮]), in the west and north the Gurjara-Pratihara[৫৮] (7th–10th century[৫৮]), in the southwest the Rashtrakuta Dynasty[৫৮] (752–973[৫৮]), in the Dekkhan the Chalukya dynasty[৫৮] (7th–8th century[৫৮]), and in the south the Pallava dynasty[৫৮] (7th–9th century[৫৮]) and the Chola dynasty[৫৮] (9th century[৫৮]).
  14. This resembles the development of Chinese Chán during the An Lu-shan rebellion and the Five Dynasties and Ten Kingdoms Period (907–960/979), during which power became decentralised end new Chán-schools emerged.[৬২]
  15. The term "maya-vada" is primarily being used by non-Advaitins. See [web ৭][web ৮][web ৯]
  16. The authorship of this work is disputed. Most 20th-century academic scholars feel it was not authored by Sankara, and Swami Sacchidanandendra Saraswathi of Holenarsipur concurs.[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
  17. slokārdhena pravaksāmi yaduktaṃ granthakotibhih, brahma satyaṃ jagat mithyā, jīvo brahmaiva nāparah
  18. Pande comes to the same conclusion: "Vivekachudamani, whether actually authored by Shankara or not, is traditionally held to voice his views authentically".[৭১]
  19. Nakamura concludes that Shankara was not the author, for several reasons.[৭৩] Shankara understood Buddhist thought, while the author of the commentary shows misunderstandings of Buddhist thought.[৭৩] The commentary uses the terms vijnapti and vjnaptimatra, which is "a uniquely Buddhist usage",[৭৪] and does not appear in Shankara's commentary on the Brahma-sutras.[৭৫] The two commentaries also quote different Upanishads.[৭৬] Nevertheless, Nakamura also concludes: "Although the commentary to the Madukya is not actually by sankara, it may be assumed that there is nothing drastically wrong in using it as a source when discussing early Vedanta philosophy".[৭৩]
  20. Marek: "Wobei der Begriff Neo-Advaita darauf hinweist, dass sich die traditionelle Advaita von dieser Strömung zunehmend distanziert, da sie die Bedeutung der übenden Vorbereitung nach wie vor als unumgänglich ansieht. (The term Neo-Advaita indicating that the traditional Advaita increasingly distances itself from this movement, as they regard preparational practicing still as inevitable)[১০৪]
  21. Alan Jacobs: Many firm devotees of Sri Ramana Maharshi now rightly term this western phenomenon as 'Neo-Advaita'. The term is carefully selected because 'neo' means 'a new or revived form'. And this new form is not the Classical Advaita which we understand to have been taught by both of the Great Self Realised Sages, Adi Shankara and Ramana Maharshi. It can even be termed 'pseudo' because, by presenting the teaching in a highly attenuated form, it might be described as purporting to be Advaita, but not in effect actually being so, in the fullest sense of the word. In this watering down of the essential truths in a palatable style made acceptable and attractive to the contemporary western mind, their teaching is misleading.[১০৫]
  22. See for other examples Conway [web ১৬] and Swartz [web ১৭]
  23. Presently cohen has distnced himself from Poonja, and calls his teachings "Evolutionary Enlightenment".[১১০] What Is Enlightenment, the magazine published by Choen's organisation, has been critical of neo-Advaita several times, as early as 2001. See.[web ১৮][web ১৯][web ২০]
  24. Feuerstein's summary, as given here, is not necessarily representative for Feuerstein's thought on Advaita. It is quoted on nonduality-websites,[web ২৩] which is informed by the Perennial philosophy and New Age thinking. It is also discerneable in Neo-Advaita. The quote seems to give a subtle reinterpretation, in which the distinction between Real and maya is replaced by a notion of interconnectedness or pantheism. The original quote is from Feuerstein's book "The Deeper Dimension of Yoga: Theory and Practice", p.257-258. It is preceeded by the sentence "The esoteric teaching of nonduality – Vedantic Yoga or Jnana Yoga – can be summarized as follows".
  25. Compare Shankara's own words, from his commentary on the Brahman Sutras: " It is obvious that the subject and the object — that is, the Self (Atman) and the Not-Self, which are as different as darkness and light are — cannot be identified with each other. It is a mistake to superimpose upon the subject or Self (that is, the "I," whose nature is consciousness) the characteristics of the object or Not-"I" (which is non-intelligent), and to superimpose the subject and its attributes on the object. Nonetheless, man has a natural tendency, rooted in ignorance (avidya), not to distinguish clearly between subject and object, although they are in fact absolutely distinct, but rather to superimpose upon each the characteristic nature and attributes of the other. This leads to a confusion of the Real (the Self) and the Unreal (the Not-Self) and causes us to say such [silly] things as "I am that," "That is mine," and so on...[web ২৫]
  26. "Sat is absolute non changing truth." –Maharishi Mahesh Yogi[web ৩৯]
  27. Compare Radhakrishnan's notion of "intuition". See [web ৪২][web ৪৩][web ৪৪]
  28. "Consciousness"[১২২][web ৪৫] "বুদ্ধি",[১২৩][১২৪] "জ্ঞান"[web ৪৬]
  29. "the Absolute"[১২২][১২৫] "অনন্ত",[১২৫] "সর্বোচ্চ সত্য"[১২৫]
  30. nivartitānāmeteṣāṁ tadvyatiriktaviṣayebhya uparamaṇamuparatirathavā vihitānāṁ karmaṇāṁ vidhinā parityāgaḥ[Vedāntasāra, 21]
  31. With the exception of Āgama, though this is contradicted, subtrated, by the Pramāṇas such as Anumāna, Upamāna, or Arthāpatti
  32. a collection of philosophical works that include Pre-Buddhist, Buddhist era and Post-Buddhist texts,[১৩৪]
  33. King: "In chapter four of his Madhyamakahrdyakarika (on the sravaka-yana), Bhavaviveka puts forward a Sravaka objection to the Mahayana on the grounds that it is a form of crypto-Vedantism"
  34. Ninian Smart is a proponent of the so-called "common core thesis", which states that all forms of mysticism share a common core. See also [web ৫৩] and [web ৫৪]
  35. Isaeva: "The link between Gaudapada and Bhartrhari on the one hand, and the Kasmir Saivites on the other, is certainly much more evident and natural than any links that might exist between these early Vedantins and Sankara's Advaita Vedanta." And: "The closest parallels to Gaudapada's and Bhartrhari's ideas are to be found mainly within the fold of so-called nondualist Saivism". Page 182, "the most close similarities with Gaudapada's notion of vibration (spandita).... are to be found in Abhinavagupta's version of Saivism (the Pratyabhijna school, or the school of recogntion)". Page 183: "The development of the early Vedanta ideas within the fold of Kasmir Saivism shows that the very element of language was always regarded as a highly erotic medium..".

পাদটীকা

সূত্র

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.