মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ

উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ী (৬ ডিসেম্বর ১৮৪৬[] – ২ নভেম্বর ১৯২৬[] ), যিনি ভাদুড়ী মহাশয় (Bhaduri Mahasaya) নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন ভারতীয় সিদ্ধ যোগী। আধ্যাত্মিক উপাধি - 'মহাশয়' মহান যোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ীর মতো নগেন্দ্রনাথের নামের সঙ্গেও সংযুক্ত। পরমহংস যোগানন্দ তাঁকে "ভাদুড়ী মহাশয়"[] হিসেবেই অভিহিত করেছেন। নগেন্দ্রনাথ 'মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ' (Maharṣi Nagēndranātha) নামেও অভিহিত হন। কাশীর সুমেরু মঠাধীশ শংকরাচার্য প্রমুখ ধর্মপ্রচারকরা তাঁকে 'মহর্ষি' উপাধিতে ভূষিত করেন। []

দ্রুত তথ্য মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ, জন্ম ...
মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ
জন্ম৬ ডিসেম্বর ১৮৪৬
পায়রাটুঙ্গী, হাওড়া
মৃত্যু২ নভেম্বর ১৯২৬
কলকাতা
অন্যান্য নামভাদুড়ী মহাশয়
পরিচিতির কারণসিদ্ধ যোগী,ধর্মীয় গুরু
পিতা-মাতাপিতা: পার্বতীচরণ ভাদুড়ী
মাতা: ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী
বন্ধ

জীবন কথা

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন হাওড়া জেলার পায়রাটুঙ্গী গ্রামে[] এক সম্পন্ন জমিদার পরিবারে। বর্তমানে এই গ্রামের নাম ধারসা। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পিতার নাম ছিল পার্বতীচরণ ভাদুড়ী। মাতা ছিলেন ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী। এঁরা ছিলেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। এই ভাদুড়ী বংশেরই সন্তান রাজা গণেশ, উদয়নাচার্য ভাদুড়ী

পার্বতীচরণ ভাদুড়ীর ভ্রাতা কালীচরণ ভাদুড়ী ছিলেন প্রখ্যাত সেতার ও এস্রাজ বাদক সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পিতা। সুরেন্দ্রনাথ - ভট্টাচার্য উপাধিতে ভূষিত হন। তাই ভাদুড়ী হলেও সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যই ব্যবহার করতেন। এই সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যেরই তিন পুত্র বাংলা সংগীত জগতের তিন কিংবদন্তি - সুরকার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সাধক শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য[]

শিক্ষা ও কর্ম জীবন

মেধাবী নগেন্দ্রনাথ কলকাতার ডাফ কলেজে সিনিয়র স্কলারশিপ লাভ করেন।[] ইনি স্বগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করে পাঠদানের ব্যবস্থা করেন।[] মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ছিলেন বহু ভাষাবিদ। তিনি ইংরেজী, বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দী, ফারসী, আরবী, ল্যাতিন, গ্ৰীক প্রভৃতি আটটি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন।[] মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাই ইংরেজী বিদ্যালয়ে ও পরে বালি হাইস্কুলে।[]

বিদ্যালয় ও গ্রন্থাগার স্থাপন

১৮৯৪ খ্রী. নগেন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘পেট্রিয়টিক ইনস্টিটিউশন’ নামে একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপন করেন।[] ‘পেট্রিয়টিক লাইব্রেরী’ স্থাপনও[] তাঁর আর একটি অনন্য কীর্তি।

গ্রন্থ রচনা

নগেন্দ্রনাথ বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘প্রতিজ্ঞা শতক’, ‘সামুদ্রিক বিদ্যা (১ম ভাগ)’, ‘পরমাৰ্থ সঙ্গীতাবলী’ প্রভৃতি তাঁর রচিত গ্রন্থ।[] তাঁর রচিত 'প্রতিজ্ঞা শতক' নীতি গ্রন্থটিকে মহাকালী পাঠশালার প্রতিষ্ঠাত্রী মাতাজী গঙ্গাবাঈ পাঠ্য পুস্তক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।[]

সনাতন ধর্ম প্রচার

সারাংশ
প্রসঙ্গ

ধর্মপ্রচারের জন্য নগেন্দ্রনাথ ‘সত্যপ্ৰদীপ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।[] এই 'সত্য প্রদীপ' পত্রিকার গুরুত্ব নির্দেশ করতে গিয়ে কলিকাতা, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন খ্যাতনামা অধ্যাপক পরেশনাথ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন :

"মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ সনাতন ধর্ম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করলেন সনাতন ধর্ম প্রচারিণী সভা এবং সত্য প্রদীপ, এই দুই রক্ষাকবচের সাহায্যে।"

[]

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ ১৮৯১ খ্রী. এই সনাতন ধর্ম প্রচারিণী সভা প্ৰতিষ্ঠা করেন।[] এই ‘সনাতন ধর্ম প্রচারিণী সভা’-র কার্যাবলীর বিবরণ দিয়েছেন স্বামী নির্বাণানন্দ :

"কলিকাতার রামমোহন রায় রোডে সনাতন ধর্ম প্রচারিণী সভা প্রতিষ্ঠিত হবার পর কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, অলিকুল মধুপান লোভে দলে দলে যেমন ফুলের কাছে উড়ে যায়, সাগর-সঙ্গম আশায় নদীসকল যেমন অধীর আগ্রহে উন্মাদ তরঙ্গ-ভঙ্গে ছুটে যায়, তেমনভাবে সম্ভাবসম্পন্ন ভক্তগণ বিষয়-মধু তুচ্ছ জ্ঞান ক'রে নামসুধা পানের উদ্দেশ্যে মহর্ষির শ্রীচরণপ্রান্তে দলে দলে উপনীত হ’তে লাগলেন। প্রতি রবিবারে শ্রীহরিনামসংকীর্তন, নগরফেরি, দরিদ্রনারায়ণসেবা, ধর্মাধিবেশন, পল্লীর মধ্যে ও চতুষ্পার্শ্বে বেশ একটা সাড়া ও নাড়া-চাড়া সৃষ্টি ক’রল । স্থানীয় অধিবাসিগণের মধ্যে একটা বিশেষ ধর্মভাব ও আকর্ষণ জাগিয়ে তুলল।"

[]

সত্যপ্রদীপ পত্রিকা-য় শ্রীমৎ ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী মহারাজের সম্পাদনায় ১৩৪৫ সালের গুরু পূর্ণিমা থেকে ১৩৫১ সালের আশ্বিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে 'শ্রীশ্রীনগেন্দ্র- উপদেশামৃত' প্রকাশিত হয়।[] সেই সময়ের বহু বিধগ্ধ পণ্ডিতের লেখায় সত্যপ্রদীপ পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়।[১০] এই আধ্যাত্মিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের রচিত পরমার্থসঙ্গীতও।[১১] এই পরমার্থ সঙ্গীতগুলির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী লক্ষ্য করেছিলেন মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে বৈদিক ঋষিদের ভাবনার সাযুজ্য :

"উপনিষদের যুগে এসে একটি তত্ত্ব খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ব্ৰহ্মই পরম সত্য। তিনি সর্বব্যাপী। চন্দ্রে, সূর্যে, ওষধিতে, বনম্পতিতে, জীবের জীবনে—এমন কি পৃথিবীর ধূলিকণাতেও তিনিই বিরাজমান ৷ তিনি অণুর অণু-‘অণোর ণীয়ান্’, তিনিই মহতের মহৎ—‘মহতো মহীয়ান্’। তিনি বিশ্বের নিয়ন্তা ও অন্তর্যামী, তিনি সর্বভূতান্তরাত্মা । এক কথায় ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ ।

পরম তত্ত্বকে পরাৎপর, সারাৎসার রূপে জানা ভক্তিবাদেরও মূল কথা। জ্ঞানী ঋষিরা বলেন, সবই ব্রহ্ম—ভক্ত বলেন ‘বাসুদেবঃ সর্বম্’। হরিই সব—এই সত্যটি মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পরমার্থসঙ্গীতে ও অগণিত ভাষণে এমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যা বৈদিক ঋষিদের ভাবনা থেকে পৃথক্ নয় । নগেন্দ্রনাথ যেমন বলেন—

সুনীল অম্বরে হরি তারকা নিকরে হরি,

শোভন পল্লবে হরি, বল হরি হরি।

প্রাবৃট্‌ হেমন্তে হরি মধুর বসন্তে হরি

শরত নিদাঘে হরি, বল হরি হরি ॥

বৈদিক ঋষিরাও তেমনই বলেন,

যো দেবো অগ্নৌ যো অপ্ সু যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ ।

য ওষধীষু যো বনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ ॥"

[১২]

সাধন জীবন

সারাংশ
প্রসঙ্গ

১৮৮১ খ্ৰী. দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে নগেন্দ্রনাথের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে।[] এই মহামিলনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শ্রীমৎ ভক্তিপ্রকাশ ব্রহ্মচারী লিখেছেন :

"ঠাকুর নগেন্দ্রনাথ গেলেন তাঁকে দেখতে দেখলেন—মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশের দক্ষিণ দিকে ৺গঙ্গার নিকটে একটা ছোট্ট ঘরে ঠাকুর রামকৃষ্ণ—একটি খাটিয়ার উপরে পাতা মাদুরের উপরে—৺গঙ্গার দিকে মুখ করে ব’সে আছেন, পরণে লাল পেড়ে ন-হাতি ধুতি, কাঁধে একটা চাদর, মুখ প্রসন্ন, জ্যোতির্ময়, চোখ দুটি টল-টল-ছল-ছল । যেন এখনি মায়ের কাছে কোনও আবদার পূরণের জন্য চেয়ে না পেয়ে কান্নাকাটি ক’রেছেন, তার জের তখনও রয়েছে। ঠাকুর নগেন্দ্রনাথ মাষ্টারি করেন ৷ অত্যন্ত প্রাচীন পন্থী । আচারে ব্যবহারে পূর্ব পুরুষের ভাবধারা তাঁর সর্ব ́ অবস্থায় পরিস্ফুট। ধুতি চাদর-পাঞ্জাবী পরা হ'লেও ফিট্‌ফাট বাবুটি। কিন্তু জহুরী জহর চেনে। ঠাকুর নগেন্দ্রনাথ যেতেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেন বহু দিনের বহু যুগের পরিচিত এক জনকে কাছে পেয়েছেন,—এমন মনে হ'ল। সাধনার কথা, অনুভবের কথা হ’ল। অনুভবের কথা-প্রসঙ্গ উঠতেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের ভাবান্তর উপস্থিতি হ'তে থাকল’, যেন আর স্থির থাকতে পারছেন না, আর বাইরে মন রাখতে পারছেন না। ঠাকুর নগেন্দ্রনাথকে একটা গান গাইতে ব’ললেন— ঠাকুর রামকৃষ্ণ গান বড় ভালবাসেন কিনা ! ঠাকুর নগেন্দ্রনাথ গাইলেন তাঁর স্বরচিত গান— !

“অগাধ জলের মীন তুমি হরে-

তোমায় ধ’রতে কেবা পারে নাথ ! বিনা নিপুণধীবরে ॥"

[১৩]

এরপর -

"তিনি তাঁর সুমধুর কণ্ঠে নিজের রচিত তিনখানি গান ঠাকুরকে শোনান। গান শুনে ঠাকুরের সমাধি হয়েছিল এবং মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ দিব্যভাবে বিভোর এক জ্যোতির্ময় পুরুষে উত্তীর্ণ হন। দু'জন মহান ঈশ্বর সন্ধানী আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে যে দিব্য ভাব বিনিময় করেছিলেন তার নজির বিরল। সমাধি ছিল মহর্ষি নগেন্দ্রনাথও সহজাত।"

[১৪]

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ কুম্ভ মেলায় যোগদানের জন্য এলাহাবাদে গেলে তাঁর ভাইপো ননীলাল ভাদুড়ী তাঁর সঙ্গী হন। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের কাছে তাঁর ব্রহ্মচর্য দীক্ষা হলেও তাঁর মনে সন্ন্যাস গ্রহণের বাসনা জাগে। এই সময় মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ নিজেও সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমত পরিস্থিতিতে এক মকর সংক্রান্তির পূণ্য প্রভাতে গঙ্গাস্নানের পর তাঁরা দুজনেই সন্ন্যাস নেওয়ার জন্য দীক্ষাগুরুর সন্ধান করতে থাকেন। ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ কোনও এক দণ্ডী সন্ন্যাসী যোগী পুরুষকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সন্ন্যাস দীক্ষার পর হিমালয়ে গিয়ে কঠোর তপস্যা করার ইচ্ছা গুরুর কাছে ব্যক্ত করেন। কিন্তু গুরুদেব তাঁকে গেরুয়াবস্ত্র ধারণ না করে সনাতন ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দিয়ে কলকাতায় আসতে বলেন। এর সম্ভাব্য কারণ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য :

" তাঁর ভারতীয় দর্শন এবং হিন্দু শাস্ত্র সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যই গুরুকে এই নির্দেশ দিতে বাধ্য করেছিল।"

[১৫]

ননীলাল ভাদুড়ী- যিনি মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের কাছে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হয়ে ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী নামে অভিহিত হন - সেই ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী-ও এই কাজে ঐ সন্ন্যাসীর নির্দেশে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের সঙ্গী হন।

একসময় মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি খুব একটা বাইরে বের হবেন না। প্রায় কুড়ি বছর তিনি গৃহেই সাধনা করতে থাকেন। এই পর্যায়ে যাতে তাঁর সাধনা বিঘ্নিত না হয় সেজন্য সদা সতর্ক থাকতেন তাঁর এক শিষ্য। পরমহংস যোগানন্দের লেখায় এর - বিবরণ আছে :

"সেদিন বৈকালে স্কুল থেকে বাড়ী ফেরবার সময় ভাদুড়ী মশায়ের আশ্রমের পাশ দিয়ে আসতে আসতে একবার তাঁকে দর্শন করে আসব বলে মনস্হ করলুম । সাধারণ লোকেদের সেখানে প্রবেশলাভ দূরূহ। একটি যাত্র শিষ্য কেবল নিচের তলায় থেকে গুরুর নির্জনতা যাতে ভঙ্গ না হয়, সে দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখেন। শিষ্যটি দারুণ কড়া, সহজে কাউকে তাঁর কাছে ঘেঁসতে দেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, দেখা করবার কোন কথা আগে থেকে ঠিক করা আছে কিনা। তাঁর গুরুদেব কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ঠিক সময়েই এসে পড়ে, আমায় পত্রপাঠ বিদায়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন। ভাদুড়ী মশাই চোখদুটি মিট মিট করে

বললেন, “মুকুন্দর যখনই ইচ্ছে হবে ও তখনই আসবে। আমার নির্জনে থাকবার ব্যবস্হা আমার নিজের আরামের জন্যে নয়, বাইরের লোকেদের জন্যে, বুঝলে? সংসারের লোক সরলতা চায় না, যাতে করে তাদের মোহ

টুটে যায় ! সাধুরা যে কেবল বিরল তা নয়, দুর্বোধ্যও। শাস্ত্রেও তাঁদের চালচলন একটু খাপছাড়া ধরণেরই বলে।” আমি ভাদুড়ী মশায়ের সঙ্গে উপরতলায় তাঁর অত্যন্ত সাদাসিধে আস্তানায় গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে কদাচিৎ তিনি কোথাও নড়তেন। পার্থিব সুখদুখের মিছিল সাধুসন্তরা উপেক্ষা করেই চলেন।"

[১৬]

- এই বর্ণনায় যে শিষ্যের কথা বলা হয়েছে তিনি মহর্ষিদেবের ছায়াসঙ্গী ধ্যানপ্ৰকাশ ব্রহ্মচারীই।

শেষ জীবন

১৩ই কার্তিক ১৩৩৩ সালে মহর্ষি নগেন্দ্ৰনাথ অসুস্থতা অনুভব করেন। ১৫ কার্তিক ১৩৩৩ (ইংরেজী ২ নভেম্বর, ১৯২৬) তিনি সকালবেলা শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়েন এবং ধ্যানপ্ৰকাশ ব্রহ্মচারীকে ভগবানের নাম করতে বলেন। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে পদ্মাসনে বসে 'রাম নাম' শুনতে শুনতে তিনি মহাসমাধি লাভ করেন। এর পরের দিন ধ্যানপ্রকাশ ব্রহ্মচারী মহর্ষির দেহ নিমতলা ঘাটে সৎকার করেন। [১৭]

শিষ্যবর্গ

সারাংশ
প্রসঙ্গ

দার্শনিক অধ্যাপক ডাঃ মহেন্দ্রনাথ সরকার, ভারতী বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভবতারণ সরকার, টাউন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা কালীচরণ চক্রবর্তী, প্রসিদ্ধ হোমিওপ্যাথি ডাঃ চন্দ্ৰশেখর কালী প্রমুখ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন।[] যোগেশ ব্রহ্মচারী-ও বেশ কয়েকবার মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের কাছে যান। তাঁদের মধ্যে শাস্ত্রীয় বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের জ্ঞানের গভীরতায় যোগেশ ব্রহ্মচারী মুগ্ধ হয়ে যান। যোগেশ ব্রহ্মচারী এই মহর্ষি নগেন্দ্রনাথকে নিজের "গুরু" হিসেবে এবং নিজেকে মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের "মন্ত্রণাগ্রহণকারী শিষ্য" হিসেবে অভিহিত করেছেন। যোগেশ ব্রহ্মচারী নিজেই লিখে গিয়েছেন সে কথা :

"আমি মহাত্মা নগেন্দ্রনাথের মুখে বেদে জ্ঞান-কর্ম-ভক্তির সমন্বয়ের কথা শুনিয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। তাঁহার অর্জিত জ্ঞানের তথা আত্মোপলব্ধির গভীরতা দেখিয়া জাগ্রত আগ্রহে আমার গর্বিত মস্তকটি তাঁহার চরণে লুটাইয়া দিতে বাধ্য হইলাম । সেই প্রথম দর্শনের দিনের কথা আজও আমাকে তাঁহার চরণে প্রণত করিয়া রাখিয়াছে। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়া যিনি দেন তাঁহাকে যদি গুরু বলা হয় মহাত্মা নগেন্দ্রনাথও আমার গুরু। অর্জুন যখন কৃষ্ণকে “শিষ্যস্তেঽহম্” ইত্যাদি বাক্য বলিয়া ছিলেন তখন তিনি অন্যায় বলেন নাই। কারণ অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের নিকট হইতে মন্ত্র গ্রহণ না করিলেও মন্ত্রণা গ্রহণ করার প্রার্থী হইয়াই নিজেকে শিষ্য বলিয়াছেন। আমিও মহাত্মা নগেন্দ্রনাথের মন্ত্রণাগ্রহণকারী শিষ্য বলিয়া নিজেকে এখনও মনে করি।"

[১৮]

যোগ - ভক্তিবাদ

ভক্তদের অনুভবে সিদ্ধযোগী ভাদুড়ি মহাশয় - মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ হলেন হরিহর (দেবতা)-এর অবতার। তাঁদের চোখে নগেন্দ্রনাথ ছিলেন - বহিরঙ্গে শিব, অন্তরঙ্গে বিষ্ণু। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথকে যোগশিক্ষা প্রদান করেছিলেন স্বয়ং নারায়ণ :

"লঘিমা সিদ্ধ যোগী মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ বলছেন নারায়ণ তাঁকে যোগের গুরু হিসেবে দর্শন দেন। তিনি নিয়ত শঙ্খ, চক্র, গদাপদ্মাধারী শ্রীহরির দর্শন পেতেন, কথোপকথনও হতো।"

[১৯]

অবশ্য তাঁর মানব গুরুও ছিলেন। তিনি লাহিড়ী মহাশয় অর্থাৎ শ্যামাচরণ লাহিড়ী।[২০]

কিন্তু নিজে সিদ্ধ যোগী হলেও মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ নির্দেশ করে গিয়েছেন ভক্তি মার্গ :

"In Maharshi Nagendranath's life and teachings we find a synthesis of Karma-yoga, Jnana-Yoga, Dhyana-yoga and Bhakti-yoga. But, as we have said, he always affirmed that Bhakti-yoga or the path of devotion is the easiest and safest way to attain God. In his later years he used to say that nothing can be achieved without the Grace of God."

[২১]

পশ্চিমে যাত্রার আগে পরমহংস যোগানন্দ মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের কাছ বিদায় আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। নগেন্দ্রনাথ তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেন :

“Son, go to America. Take the dignity of hoary India for your shield. Victory is written on your brow; the noble distant people will well receive you.”

[২২]

শ্রীশ্রী নগেন্দ্র মঠ এবং নগেন্দ্র মিশন

মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ যে সনাতন ধর্মপ্রচারিণী সভা তৈরি করেন - মহর্ষি যেখানে থাকতেন সেখানেই এর সভা চলত। পরে তাঁর শিষ্য-ভক্তরা তাঁকে স্থায়ী আবাসের কথা বলেন। মহর্ষি প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত শিষ্য- ভক্তদের ক্রমাগত অনুরোধে রাজি হন এবং কলকাতার গড়পার অঞ্চলে রামমোহন রায় রোডে একটি স্থায়ী আবাস গৃহ নির্মিত হয়। ১৯১৬ সালের দোল পূর্ণিমার দিনে এখানে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মহর্ষির দেহাবসানের একদিন পর মহর্ষির ভক্ত- শিষ্যরা মিলে মহর্ষিদেবের নামে একটি মঠ তৈরীর পরিকল্পনা করেন।[২৩] এই মঠ তৈরির উদ্দেশ্য ছিল মহর্ষিদেবের বাণী, সাধনা ও আদর্শের প্রচার এবং প্রসার। তাঁর অস্থিকলস মাটিতে পুঁতে দিয়ে তার ওপর সমাধি মন্দির নির্মিত হয়। তাঁর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এবং পাদুকাও তাঁর বসবাসের ঘরে সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়।[১৭] এই গৃহে এই সূত্রেই ১৯২৬-এ শ্রীশ্রী নগেন্দ্র মঠ গড়ে ওঠে। ২০০৫-এ গড়ে ওঠে নগেন্দ্র মিশন। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথের শেষ জীবনের এই সাধন ভূমি দর্শনে প্রতিদিনই আসেন দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তরা।

তথ্যসূত্র

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.