Loading AI tools
হিন্দু দেবতা, বিঘ্নহরতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
গণেশ (সংস্কৃত: गणेश, গণেশ্অ) হলেন হিন্দুধর্মের সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বাধিক পূজিত দেবতাদের অন্যতম।[4] তিনি গণপতি, বিঘ্নেশ্বর, বিনায়ক, গজপতি, একদন্ত ইত্যাদি নামেও পরিচিত। নেপাল , শ্রীলঙ্কা , থাইল্যান্ড , ইন্দোনেশিয়া ( জাভা এবং বালি ), সিঙ্গাপুর , মালয়েশিয়া , ফিলিপাইন , বাংলাদেশ , ফিজি, গায়ানা , মরিশাস এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সহ বৃহৎ জাতিগত ভারতীয় জনসংখ্যার দেশগুলিতে গণেশের প্রতি ভক্তি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ।[5][6] জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও গণেশ-ভক্তিবাদ মিশে গিয়ে গণেশ পূজার প্রথা বিস্তার লাভ করেছে।[7]
গণেশ | |
---|---|
দেবনাগরী | गणेश |
সংস্কৃত লিপ্যন্তর | গণেশ |
অন্তর্ভুক্তি | দেব, গাণপত্য, সগুণ ব্রহ্ম, পঞ্চদেবতা পূজা |
আবাস |
|
মন্ত্র | ওঁ শ্রীগণেশায় নমঃ ওঁ গম্ গণপতয়ে নমঃ |
অস্ত্র | পরশু (কুড়াল), পাশ (ফাঁস) ও অঙ্কুশ |
প্রতীকসমূহ | স্বস্তিকা, ওঁ, মোদক |
দিবস | মঙ্গলবার ও বুধবার |
বাহন | মুষিক (ইঁদুর) |
গ্রন্থসমূহ | গণেশ পুরাণ, মুদ্গল পুরাণ, গণপতি অথর্বশীর্ষ |
লিঙ্গ | পুরুষ |
উৎসব | গণেশ চতুর্থী, গণেশ জয়ন্তী |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | |
সহোদর | কার্তিক |
সঙ্গী | কিছু ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধি, ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি বা ব্রহ্মচারী |
যদিও গণেশের অনেক গুণাবলী রয়েছে, তবে তিনি সহজেই তার হাতির মাথা দ্বারা চিহ্নিত হন।[8] গণেশকে বিঘ্ননাশকারী,[9] শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা রূপে পূজা করা হয়।[10] বিভিন্ন শুভকার্য, উৎসব ও অনুষ্ঠানের শুরুতেও তার পূজা প্রচলিত আছে। অক্ষর ও জ্ঞানের দেবতা রূপে লেখার শুরুতেও গণেশকে আবাহন করা হয়।[11][2] বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে গণেশ-সংক্রান্ত একাধিক পৌরাণিক উপাখ্যান পাওয়া যায়। এই উপাখ্যানগুলি থেকে গণেশের জন্মবৃত্তান্ত, লীলাকথা ও তার স্বতন্ত্র মূর্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
যদিও পণ্ডিতেরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে তার জন্ম সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন, গণেশ গুপ্ত যুগে খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন[12] এবং বৈদিক ও প্রাক-বৈদিক পূর্বসূরিদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বৈশিষ্ট পেয়েছিলেন। হিন্দু গ্রন্থে তাকে পার্বতী ও শিবের পুত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হিন্দুধর্মের গাণপত্য ঐতিহ্যে গণেশ হলেন পরম সত্তা । গণেশ-সংক্রান্ত প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল গণেশপুরাণ, মুদ্গলপুরাণ ও গণপতি অথর্বশীর্ষ।
গণেশকে গণপতি, বিঘ্নেশ্ব এবং পিল্লায়ার সহ আরও বিভিন্ন উপাধি ও বিশেষণে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুধর্মের সম্মানসূচক শ্রী উপাধি প্রায়শই গণেশের নামের আগে যুক্ত করা হয়।
"গণেশ" নামটি একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ। গণ ও ঈশ শব্দদুটির সন্ধির মাধ্যমে এই শব্দটির উৎপত্তি। গণ শব্দের অর্থ একটি গোষ্ঠী, সমষ্টি বা বিষয়শ্রেণি এবং ঈশ শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু।[13] গণেশের নামের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণ’ শব্দটির মাধ্যমে বিশেষভাবে একই নামের একপ্রকার উপদেবতার গোষ্ঠীকে বোঝায়। এঁরা গণেশের পিতা শিবের অনুচরবর্গ।[14] সাধারণভাবে গণ বলতে বোঝায় একটি বিষয়শ্রেণী, শ্রেণি, গোষ্ঠী, সংঘ বা জনসমষ্টি।[15] কোনো কোনো টীকাকারের মতে, "গণেশ" নামের অর্থ "গোষ্ঠীর ঈশ্বর" বা পঞ্চভূত ইত্যাদি "সৃষ্ট বিষয়সমূহের ঈশ্বর"।[16] "গণপতি" (गणपति) নামটি গণেশ নামের সমার্থক। এটিও একটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ। ‘গণ’ ও ‘পতি’ শব্দদুটির মিলনের মাধ্যমে এই শব্দটির উৎপত্তি। এখানে গণ শব্দের অর্থ গোষ্ঠী এবং ‘পতি’ শব্দের অর্থ শাসক বা প্রভু।[15] গণপতি শব্দটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দে রচিত ঋগ্বেদ গ্রন্থের ২য় মণ্ডলের ২৩ সূক্তের ১ম শ্লোকে। তবে বৈদিক ‘গণপতি’ শব্দটির মাধ্যমে বিশেষভাবে গণেশকে নির্দেশ করা হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।[17][18] প্রাচীন সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ গ্রন্থে[19] ‘গণেশ’ নামের আটটি সমার্থক শব্দ পাওয়া যায়। এগুলি হল: ‘বিনায়ক’, ‘বিঘ্নরাজ’ (যা ‘বিঘ্নেশ’ নামেরও সমার্থক), ‘দ্বৈমাতুর’ (যাঁর দুইজন মাতা),[20] ‘গণাধিপ’ (যা ‘গণপতি’ ও ‘গণেশ’ নামেরও সমার্থক), ‘একদন্ত’ (যাঁর একটি দাঁত, এখানে গণেশের হস্তীমুণ্ডের বাইরের দাঁতের কথা বলা হয়েছে), ‘হেরম্ব’, ‘লম্বোদর’ (যাঁর স্ফীত উদর) ও ‘গজানন’ (যাঁর হাতির মতো মাথা)।[21]
‘বিনায়ক’ (विनायक, ৱিনায়ক্অ) নামটি গণেশের একটি বহুল-পরিচিত নাম। এই নামটি পুরাণ ও বৌদ্ধ তন্ত্রগুলিতে বহু বার উল্লিখিত হয়েছে।[22] মহারাষ্ট্রের আটটি বিখ্যাত গণেশ মন্দিরের নামকরণের ক্ষেত্রেও এই নামটির প্রতিফলন লক্ষিত হয়। এই আটটি মন্দিরকে ‘অষ্টবিনায়ক’ (अष्टविनायक অষ্টৱিনায়ক্অ) মন্দির বলা হয়।[23] ‘বিঘ্নেশ’ (विघ्नेश; ৱিঘ্নেশ্অ) ও ‘বিঘ্নেশ্বর’ (विघ्नेश्वर, ৱিঘ্নেশ্ৱর্অ, "বিঘ্নের ঈশ্বর")[24] নাম দুটি থেকে বোঝা যায় যে, হিন্দুধর্মে তার প্রধান কাজ বিঘ্নের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন ও বিঘ্ন অপসারণ।[25]
তামিল ভাষায় গণেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল "পিল্লই" (তামিল: பிள்ளை) বা ‘পিল্লইয়ার’ (பிள்ளையார்)।[26] এ. কে. নারায়ণের মতে, ‘পিল্লই’ শব্দের অর্থ ‘শিশু’ এবং ‘পিল্লইয়ার’ শব্দের অর্থ ‘মহান শিশু’। তিনি আরও বলেছেন যে, দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠীতে ‘পাল্লু’, ‘পেল্লা’ ও ‘পেল্ল’ শব্দগুলির মাধ্যমে ‘দাঁত বা হাতির দাঁত’ বোঝায়।[27] অনিতা রাইনা থাপান বলেছেন যে, ‘পিল্লাইয়ার’ নামটির মূল ‘পিল্লে’ শব্দটির আদি অর্থ সম্ভবত ‘হস্তীশাবক’। কারণ, পালি ভাষায় ‘পিল্লকা’ শব্দের অর্থ তাই।[28]
বর্মি ভাষায় গণেশ ‘মহা পেইন্নে’ (မဟာပိန္နဲ, উচ্চারিত: [məhà pèiɴné]) নামে পরিচিত। এই নামটির উৎস পালি ‘মহা বিনায়ক’ (မဟာဝိနာယက) নামটি।[29] থাইল্যান্ডে গণেশের জনপ্রিয় নামটি হল ‘ফ্রা ফিকানেত’।[30] অধুনা ইন্দোনেশিয়া,[31] থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম ভূখণ্ডে প্রাচীনতম যে সব মূর্তি ও উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে, তা খ্রিস্টীয় ৭ম ও ৮ম শতাব্দীর সমসাময়িক।[32] এগুলিতে ভারতের ৫ম শতাব্দী বা তার পূর্ববর্তী গণেশ মূর্তি ও তার বিবরণের প্রতিফলন দেখা যায়।[33]
শ্রীলঙ্কার সিংহল বৌদ্ধ অঞ্চলগুলিতে গণেশ ‘গণ দেবিয়ো’ নামে পরিচিত। সেখানে বুদ্ধ, বিষ্ণু, স্কন্দ ও অন্যান্য দেবতার সঙ্গে গণেশের পূজাও প্রচলিত আছে।[34]
ভারতীয় শিল্পকলায় গণেশ একটি জনপ্রিয় চরিত্র।[35] অন্যান্য দেবদেবীদের তুলনায় গণেশের মূর্তির মধ্যে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল বৈচিত্র্য ও স্বতন্ত্র নিদর্শন বেশি দেখা যায়।[36] দণ্ডায়মান, নৃত্যরত, দৈত্যনাশে উদ্যত, শিশুরূপে পরিবারের সঙ্গে ক্রীড়ারত, মাটিতে বা সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় অথবা বিভিন্ন ধরনের আধুনিক অবস্থানে তাকে চিত্রিত করা হয়।
খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গণেশের মূর্তি নির্মাণ প্রাধান্য লাভ করেছিল।[37] গাণপত্য সম্প্রদায়ে একজন স্বাধীন দেবতা রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খ্রিস্টীয় ৯০০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে যে সব গণেশ মূর্তি নির্মিত হয়েছিল, সেগুলি ছিল ১৩শ শতাব্দীতে নির্মিত গণেশ ভাস্কর্যের আদর্শস্থানীয়। গণেশের কয়েকটি সাধারণ ভাস্কর্য বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পল মার্টিন-ডাবোস্ট খ্রিস্টীয় ৯৭৩ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ের একটি প্রায় অনুরূপ মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন।[38] প্রতাপাদিত্য পালও খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর আর একটি অনুরূপ মূর্তির কথা উল্লেখ করেছেন।[39] গণেশের মাথাটি হাতির এবং তার উদরটি স্ফীত। এই মূর্তিতে গণেশের চারটি হাত দেখা যায়। গণেশের চতুর্ভূজ মূর্তিই সর্বাধিক পরিচিত। নিচের ডান হাতে তিনি নিজের একটি ভাঙা দাঁত (তার হস্তীমুণ্ডের বাইরের দাঁত) ধরে থাকেন। নিচের বাঁ হাতে থাকে একটি মিষ্টান্ন। এটি তিনি নিজের শুঁড় দিয়ে স্পর্শ করে থাকেন। গণেশের প্রাচীন মূর্তিগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, শুঁড়টি বাঁ দিকে বাঁকানো থাকে, যাতে গণেশ তার নিচের বাঁ হাতের মিষ্টান্নটি আস্বাদন করছেন, সেটি বোঝা যায়।[40] ইলোরা গুহাসমূহে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর একটি প্রাচীনতর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এই মূর্তিতে গণেশের উপরিউক্ত রূপটি চিত্রিত হয়েছে।[41] তবে এই মূর্তিতে তার অন্য দুটি হাতের চিত্রণ অস্পষ্ট। সাধারণ মূর্তিগুলিতে দেখা যায়, গণেশ উপরের একটি হাতে একটি কুঠার বা অঙ্কুশ ধরে আছেন এবং অপর হাতে ধরে আছেন একটি পাশ (ফাঁস)। অল্প কয়েকটি মূর্তিতে দেখা যায়, তার হাতে রয়েছে একটি নরমুণ্ড।[42]
এই প্রাচীন মূর্তিতত্ত্বগত উপাদানগুলির প্রভাব গণেশের আধুনিক মূর্তিগুলির মধ্যেও দেখা যায়। একটি আধুনিক মূর্তিতে শুধু দেখা যায়, গণেশের নিচের ডান হাতটিতে ভাঙা দাঁত নেই। বরং সেটি দর্শক বা ভক্তের উদ্দেশ্যে অভয়দানকারী ভঙ্গিতে (অভয় মুদ্রা) প্রদর্শিত হচ্ছে।[43] গণেশের নৃত্যরত মূর্তিটিও বেশ জনপ্রিয়। এই মূর্তিতেও তার হাতগুলির অবস্থান ও অন্যান্য গুণাবলি অনুরূপ। [44]
‘গণপতি’র প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে। দুটি ঋক মন্ত্রে ‘গণানাম গণপতিম হবামহে...’ [45] ও ‘বিষু সীদা গণপতে...’[46] বাক্যবন্ধগুলি বৈদিক গণপতির একটি ধারণা দেয়। যদিও এই গণপতি ও বর্তমান কালে পূজ্য পৌরাণিক গণপতি এক নয়। তবে একথা অনেকেই স্বীকার করেন বেদোত্তর যুগে ঋগ্বেদের ‘গণপতি-ব্রহ্মণস্পতি’ থেকেই পৌরাণিক ‘গজবদন-গণেশ-বিঘ্নেশ্বর’-এর ধারণাটি বিবর্তিত হয়েছে।[47]
ঋগ্বৈদিক গণপতির অপর নাম ছিল 'বৃহস্পতি' বা 'বাচস্পতি'। তিনি জ্যোতির্ময় দেবতা। তার গাত্রবর্ণ রক্তিমাভ-স্বর্ণালি। অঙ্কুশ বা কুঠার তার অস্ত্র। তার আশিষ ভিন্ন কোনও ধর্মীয় সিদ্ধি সম্ভব নয় বলে মনে করা হত। তিনি সর্বদা ‘গণ’ নামে একটি নৃত্যগীতকারী দলের সঙ্গে বিরাজমান ও দেবতাদের রক্ষকরূপে কল্পিত হতেন। [48]
অন্যমতে, ভারতের আদিম অধিবাসীদের পূজিত হস্তিদেবতা ও লম্বোদর যক্ষের মিশ্রণে গণেশ কল্পনার উদ্ভব। অথবা এমনও হতে পারে গণেশ সম্পূর্ণ অনার্য দেবতা, পরে যাঁর আর্যীকরণ ঘটে। গণেশের বাহন ইঁদুর এই আদিম কোনও সংস্কারের প্রতীক। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময়ের লেখা বৌধায়ণ ধর্মসূত্রে গণেশের উল্লেখ নেই। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে কালিদাস, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারবি, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে পঞ্চতন্ত্র বা ভরত নাট্যশাস্ত্রও গণেশের সাক্ষ্য দেয় না। গুপ্ত যুগের শেষভাগে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক থেকেই এঁর একক পূজা প্রচলিত হয়।
'মানবগৃহ্যসূত্র' ও 'যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি'-তে শাল, কটঙ্কট, উষ্মিত, কুষ্মাণ্ড রাজপুত্র ও দেবযজন ইত্যাদিকেও বিনায়ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাভারতে এঁরাই বিনায়ক। এঁদের কাজ বিঘ্ন উৎপাদন করা। এই সব বিনায়ক মিলে পরে বিঘ্নরাজ গণপতির রূপ নেয়। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি অনুসারে একজন বিনায়ক অম্বিকার পুত্র। এখানেই গণেশকে প্রথমবার দুর্গার সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়। বহু পুরাণে তাকে স্বয়ম্ভূ বলা হয়েছে। আবার স্কন্দের গণ বা পার্ষদদের অনেকে পশুপাখির মুখবিশিষ্ট। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের 'ভূমারা'তে এই ধরনের বহু গণের উল্লেখ পাওয়া যায়। গণেশ অর্থাৎ গণ-ঈশের হস্তিমুখের এও এক কারণ হতে পারে। আবার কোনও কোনও মতে যক্ষ ও নাগদেবতা মিলে গণেশ। হাতির মাথাযুক্ত যক্ষ পুরাণে বর্ণিত। এছাড়া যক্ষরাও লম্বোদর।
'যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা'-য় বিনায়ক ও গণপতির পূজার বিবরণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে রচিত ললিত মাধব-এও গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। [49]
গণেশ পৌরাণিক হিন্দুধর্মে সর্বাগ্রে পূজ্য ও সেই কারণে অন্যতম প্রধান দেবতা। স্বাভাবিক কারণেই তার সম্পর্কে প্রচলিত নানা আখ্যান-উপাখ্যান বিভিন্ন পুরাণ ও মহাকাব্যে স্থান পেয়েছে। গণেশ সম্পর্কিত যে কাহিনিটি পুরাণ ও উপকথায় সর্বাধিক চর্চিত সেটি হল গণেশের ‘গজানন’ হবার কারণ। বলাই বাহুল্য, পুরাণের স্বাভাবিক চরিত্র অনুসারে এক একটি পুরাণে এই প্রসঙ্গে এক এক রকমের ভাষ্য পাওয়া যায়। এমনকি একই পুরাণে পরস্পর-বিরোধী দুটি মতও কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থান পেয়েছে। এছাড়াও গণেশের পিতৃমাতৃভক্তি ও বিবাহ সম্পর্কিত নানা কাহিনিও বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়।
ভাদ্র ও মাঘমাসের শুক্লাচতুর্থীকে গণেশ চতুর্থী বলা হয়। হিন্দু বিশ্বাসে এই দিনটি গণেশের জন্মদিন। গণেশ চতুর্থী সংক্রান্ত একটি কিংবদন্তি হিন্দুসমাজে প্রচলিত, একবার গণেশ চতুর্থীতে প্রতি বাড়িতে মোদক ভক্ষণ করে ভরা পেটে ইঁদুরে চেপে ফিরছিলেন গণেশ। পথে ইঁদুরের সামনে একটি সাপ এসে পড়লে সে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। এতে গণেশ পড়ে যান ও তার পেট ফেটে সব মোদক রাস্তায় পড়ে যায়। গণেশ উঠে সেগুলি কুড়িয়ে পেটের মধ্যে পুরে পেটের ফাটা জায়গাটি ওই সাপ দিয়ে বেঁধে দেন। আকাশ থেকে চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন। তাই গণেশ শাপ দেন যে চতুর্থীর দিন চাঁদ কেউ দেখবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গণেশ অত্যন্ত মোদকপ্রিয় দেবতা। অন্যমতে, এই দিনে শিব গণেশকে লুকিয়ে কার্তিকেয়কে একটি ফল দিয়েছিলেন। চন্দ্র তা দেখে হেসে ফেলেন বলে শিব চন্দ্রকে অভিশাপ দেন।
গাণপত্য সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগ্রন্থ তথা গণেশ বিষয়ক দুই উপপুরাণ গণেশ পুরাণ ও মুদ্গল পুরাণ-এ পৃথক পৃথকভাবে গণেশের যথাক্রমে চার ও আটটি অবতারের কথা বলা হয়েছে।
ভারতীয় শিল্প ও চিত্রকলায় গণেশ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় মূর্তিকল্প। গণেশের নানা রূপের বর্ণনা যেমন পুরাণ ও ইতিহাসে পাওয়া গেছে, তেমনি তার বিচিত্র ও বহুমুখী মূর্তিও ভারতীয় উপমহাদেশে, এমনকি উপমহাদেশের বাইরেও নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মূর্তিগুলি বিচিত্র ভাবে রঞ্জিত। কোথাও তিনি দণ্ডায়মান, কোথাও নৃত্যরত, কোথাও তিনি অসুরবধকারী বীর যুবা, কোথাও বা শিশুপুত্র বেশে মাতাপিতার ক্রোড়ে ক্রীড়ারত, আবার কোথাও নিছক পূজাভিলাষী হয়ে উপবিষ্ট। জানা যায়, গণেশের মূর্তি প্রথম নির্মিত হয়েছিল শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের গণেশের মূর্তি নির্মিত হতে শুরু করে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকেই গণেশ এক লোকপূজ্য দেবতার আসন লাভ করেন ও তার বহু মূর্তি নির্মিত হতে শুরু করে।
ভারতীয় শিল্পকলায় প্রথম থেকেই গণেশ গজানন, একদন্ত ও লম্বোদর। গণেশের ধ্যান, প্রার্থনা ও প্রণাম মন্ত্রেও তার এই রূপেরই কদর বেশি। যেমন –
“খর্বং স্থূলতনুং গজেন্দ্রবদনং লম্বোদরং সুন্দরং প্রস্যন্দন্মদ্গন্ধলুব্ধমধুপব্যালোলগণ্ডস্থলম্।
দন্তাঘাতবিদারিতারিরুধিরৈঃ সিন্দূরশোভাকরং বন্দে শৈলসুতাসুতং গণপতিং সিদ্ধিপ্রদং কামদম্।।” (গণেশধ্যানম্)
অর্থাৎ, “যিনি খর্বাকৃতি, স্থূলশরীর, লম্বোদর, গজেন্দ্রবদন অথচ সুন্দর; বদন হইতে নিঃসৃত মদগন্ধে প্রলুব্ধ ভ্রমরসমূহের দ্বারা যাঁহার গণ্ডস্থল ব্যাকুলিত; যিনি দন্তাঘাতে শত্রুর দেহ বিদারিত করিয়া তাহার দন্ত দ্বারা নিজ দেহে সিন্দূরের শোভা ধারণ করিয়াছেন; সেই পার্বতীপুত্র সিদ্ধিদাতা ও কামদাতা গণপতিকে বন্দনা করি।” [58]
গণেশের প্রণামমন্ত্রেও দেখা যায় –
একদন্তং মহাকায়ং লম্বোদরং গজাননং।
বিঘ্ননাশকরং দেবং হেরম্বং প্রণমাম্যহম্।। (গণেশপ্রণামঃ)
অর্থাৎ, “যিনি একদন্ত, মহাকায়, লম্বোদর, গজানন এবং বিঘ্ননাশকারী সেই হেরম্বদেবকে আমি প্রণাম করি।” [58]
গণেশের প্রার্থনা মন্ত্রটি ততোধিক সুলিখিত –
দেবেন্দ্রমৌলিমন্দারমকরন্দকণারুণাঃ।
বিঘ্নং হরন্তু হেরম্বচরণাম্বুজরেণবঃ।। (গণেশপ্রার্থনা)
অর্থাৎ, “দেবরাজ ইন্দ্রের মস্তকে বিরাজিত মন্দারপুষ্পের পরাগসমূহের দ্বারা রক্তিম হেরম্বের পাদপদ্মের রেণুসমূহ আমার বিঘ্নহরণ করুক।” [58]
গণেশের প্রথম দিকের মূর্তিগুলিতে দেখা যায়, গণেশ তার ভগ্ন দাঁতটি স্বহস্তে ধরে আছেন। গণেশ লম্বোদর গুপ্তযুগ থেকেই। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে, তার উদরে সমগ্র জগৎসংসারের অবস্থান বলেই তিনি লম্বোদর। [59] গণেশের হস্তসংখ্যা ও অস্ত্র নিয়ে নানা মতদ্বৈধ দেখা যায়। সচরাচর গণেশের চতুর্ভূজ মূর্তি অধিক পূজিত হলেও স্থানবিশেষে দ্বিভূজ থেকে ষড়ভূজ গণেশও দেখা যায়। গণেশের হাতে সাধারণভাবে পাশ-অঙ্কুশ, বরাভয় ও মোদকই দেখা যায়। তবে বাঙালি বিশ্বাসে গণেশ বিষ্ণুর মতো শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী। এই প্রসঙ্গে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কথিত পার্বতীর কৃষ্ণরূপী পুত্রলাভের উপাখ্যানটি স্মর্তব্য। গণেশের বাহন মুষিক বা ইঁদুর। ইঁদুর ধর্মের অবতার; মহাবল ও পূজাসিদ্ধির অনুকূল। অন্যমতে, সংস্কৃত মুষিক শব্দটি ‘মুশ’ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ চুরি করা। মনে করা হয়, গণেশের পদতলে ইঁদুর, গণেশ কর্তৃক বিঘ্নবিজয়ের প্রতীকমাত্র। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে পৃথিবী গণেশকে মুষিক বাহন দিয়েছিলেন।
ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বিভিন্ন শাস্ত্রে গণেশের এই সাধারণ রূপের বহু রূপভেদও দৃষ্ট হয়। এই সকল রূপভেদের মূর্তি অনুসারে ধ্যান ও পূজাবিধি ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, গুপ্তযুগে প্রাপ্ত কয়েকটি গণেশমূর্তি অষ্টভূজ থেকে দশভূজ। আবার তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসার, কাশ্মীরে, নেপালে ও আফগানিস্তানে কোনও কোনও ক্ষেত্রে গণেশের বাহন সিংহ। এদিকে প্রসন্ন গণেশ সাধারণ রূপেই বিরাজমান। কিন্তু প্রাণতোষিনী তন্ত্র-এ উল্লিখিত চৌরগণেশ সাধনার ফল চুরি করেন। বিঘ্নগণেশ বিঘ্ন ঘটান। লক্ষ্মীগণেশ লক্ষ্মীকে আলিঙ্গন করে থাকেন।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে মির্মিত শ্রীলঙ্কার মিহিনটালে প্রাপ্ত শিলাফলকে গুড়ি মারা গজমুণ্ড ও রদবিশিষ্ট মূর্তিটিকে গণেশের প্রাচীনতম শিল্পরূপ বলে মনে করা হয়। উত্তর প্রদেশের ফররুখবাদ জেলায় প্রাপ্ত আনুমানিক চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত দ্বিভূজ একটি গণেশ শিলামূর্তিতে দেখা যায় দেবতার বাম হস্তে মোদকভাণ্ড ও তিনি শুঁড় দিয়ে মোদক ভক্ষণ করছেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে নির্মিত মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি গুহাগাত্রে, ভূমারা ও উত্তরপ্রদেশের ভিতরগাঁও মন্দিরে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে মোদকভক্ষণরত গণেশ মূর্তি দেখা যায়। এর মধ্যে উদয়গিরির মূর্তিটি উর্ধ্বলিঙ্গ বলে মনে করা হয়। এই মূর্তিগুলি তিনপ্রকার – উপবিষ্ট, নৃত্যরত ও দণ্ডায়মান। এর মধ্যে উপবিষ্ট মূর্তির সংখ্যাই সর্বাধিক। নৃত্যরত মূর্তিতে দেখা যায় গণেশ বাহনের উপর নাচছেন। এখানে তিনি গজমুণ্ড, ত্রিনয়ন, খর্বাকার, লম্বোদর, চতুর্ভূজ বা ষড়ভূজ বা অষ্টভূজ বা দশভূজ। দ্বিভূজ মূর্তি সংখ্যায় কম। বৌদ্ধ ও জৈনরাও গণেশের এই মূর্তি পূজা করতেন বলে জানা যায়।
প্রথম দিকের গণেশ মূর্তিগুলি দ্বিভূজ ও উপবিষ্ট। হাতে কুঠার ও মোদক। দেবতা গজানন, একদন্ত ও লম্বোদর। কয়েকটি মূর্তিতে চতুর্ভূজ গণেশও দেখা যায়। বৃহৎসংহিতা গ্রন্থ অনুসারে, গণেশ দ্বিভূজ এবং এখানেও তার হাতে মূলক। এই মূলক হাতির খাদ্য বলে উল্লিখিত হয়েছে। অমরকোষ গ্রন্থে গণেশ একদন্ত। অংশুমৎভেদাগম, কালিকাগম ও বিষ্ণুধর্মোত্তর প্রভৃতি গ্রন্থে গণেশ চতুর্ভূজ এবং তার হাতে নিজ দন্ত, কপিত্থ মোদক, পাশ-অঙ্কুশ, নাগ, অক্ষসূত্র, পদ্ম ইত্যাদি দেখা যায়। এই সকল গ্রন্থের উত্তরকালের সংস্করণগুলিতে দেখা যায় গণেশের বাহন মুষিক ও স্ত্রী ভারতী (সরস্বতী), শ্রী (লক্ষ্মী), বিঘ্নেশ্বরী, বুদ্ধি ও কুবুদ্ধি। এছাড়াও এই গ্রন্থগুলিতে গণেশের অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্যও দৃষ্ট হয়। যেমন – তিনি ত্রিনয়ন, ব্যাঘ্রচর্মপরিহিত ও নাগযজ্ঞোপবীতধারী। তার মূর্তি আভঙ্গ বা সমভঙ্গ।
বিগ্রহ রূপেও গণেশের নানা মূর্তি প্রচলিত ছিল। এই সব মূর্তি সবই গুপ্তোত্তর যুগে নির্মিত হয়নি। গুপ্তযুগের প্রথম দিকে মথুরাতে প্রাপ্ত বেলেমাটির গণপতি ও ভিতরগাঁও-এর ইষ্টকনির্মিত মন্দিরে প্রাপ্ত পোড়ামাটির গণপতির মূর্তিটি গণেশ মূর্তির বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যবহন করছে। উল্লেখ্য মথুরায় গণেশমূর্তিতে ইঁদুরের উপস্থিতি দেখা যায় না এবং ভিতরগাঁওতেও ঠিক দেবতার আকারে গণেশ চিত্রিত হননি, সেখানে তিনি উড্ডীয়মান। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভূমারা শিবমন্দিরে প্রাপ্ত গণেশ মূর্তি গণেশ-বিবর্তনের শেষ নিদর্শন। প্রথম যুগের মূর্তিগুলি নগ্ন ও দণ্ডায়মান। এগুলিকে দেখে দেবতা বলে বোধ হয় না। এছাড়া গুপ্তযুগের প্রথম ভাগে ভিলসা উদয়গিরির চন্দ্রগুপ্ত গুহায় গণেশের যে উৎকীর্ণ চিত্রটি পাওয়া যায়, সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই মূর্তি অনুসারে গণেশ পর্যঙ্ক আসনে উপবিষ্ট, বাম হাতে তার মোদকভাণ্ড ও ইঁদুর অনুপস্থিত। উপবিষ্ট গণেশ মূর্তি প্রথম ও শেষ গুপ্তযুগে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আরেক ধরনের গণেশ মূর্তির সন্ধান মেলে ওড়িশায়। তিনি নৃত্যগণেশ, অষ্টভূজ, সামনের ডানহাত গজহস্ত, নৃত্যের আবর্ত দেহে সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
পরবর্তীকালে তান্ত্রিকতা ও শক্তিপূজার সঙ্গে গণেশ ধারণা বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন তান্ত্রিক গণেশ মূর্তিতে শক্তির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেতে থাকে। যেমন – শক্তিগণেশ, লক্ষ্মীগণেশ (লক্ষ্মীগণেশের লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী নন), উচ্ছিষ্টগণেশ ইত্যাদি। দাক্ষিণাত্যে উচ্ছিষ্টগণেশের কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলি বামাচারে পূজিত। জব্বলপুরের কাছে গজমুণ্ডবিশিষ্ট একটি দেবীমূর্তিও পাওয়া গেছে। সম্ভবত ইনি তন্ত্রোল্লিখিত গণেশ-পত্নী গণেশানী।
ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে গণেশের মূর্তি পাওয়া যায়। আনামে প্রাপ্ত মূর্তি দ্বিভূজ ও মোদকভক্ষণরত। হাতে মোদকভাণ্ড ছাড়াও কুঠার, অক্ষমালা, মূলদন্তক, অঙ্কুশ, পাশ, দণ্ড, শূল, সর্প, ধনু ও শরও দেখা যায়। জাভা দ্বীপের বাড়া নামক স্থানে আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত একটি মূর্তি নরকপালযুক্ত আসনে উপবিষ্ট ও মাথার জটায় নরকপালধারী। জাভাতে গণেশ চতুর্ভীজ। এই মূর্তিতে তন্ত্রের প্রভাব সুস্পষ্ট। ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলের অন্যত্রও গণেশের উপবিষ্ট মূর্তি পাওয়া গেছে। তবে খিচিঙে আবিষ্কৃত মূর্তিটি সবচেয়ে সুন্দর। মধ্যযুগের প্রথমদিকে নির্মিত এই মূর্তিটি চতুর্ভূজ, আভঙ্গ দেহ, কটাক্ষে চতুর ইশারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারী, বাহন ইঁদুর। চারহাতের তিনটিতে অক্ষসূত্র, বিষাণ, মোদকভাণ্ড; চতুর্থ হাতটি অস্পষ্ট।
হিন্দুদের সমস্ত ধর্মীয় ও বিভিন্ন সারস্বত অনুষ্ঠানে গণেশ পূজিত হন। এছাড়াও ব্যবসারম্ভের সময় গণেশপূজা আবশ্যকর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সকল কার্যের পূর্বে গণেশ স্মরণ বা পূজন শুভকর ও মঙ্গলজনক এবং তা করলে কার্যে সিদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গণেশের একক পূজা প্রচলিত হবার দু-এক শতক পরে গাণপত্য নামে এক গণেশপূজক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। ক্রমশ এই সম্প্রদায় ছটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে – মহাগাণপত্য, হরিদ্রাগাণপত্য, উচ্ছিষ্টগাণপত্য, নবনীতগাণপত্য, স্বর্ণগাণপত্য ও সন্তানগাণপত্য। বর্তমানে গাণপত্য সম্প্রদায় অবলুপ্ত এবং গণেশ এক সম্প্রদায়বিহীন বা নন-সেক্টেরিয়ান হিন্দু দেবতা।
মার্গসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিশেষত ভরতনাট্যমের সূচনায় গণেশ বন্দনার প্রথা প্রচলিত আছে। ‘ওঁ শ্রী গণেশায় নমঃ’ বা ‘ওঁ গাং গণেশায় নমঃ’ গণেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ দুটি মন্ত্র। গণেশ পূজার সময় ভক্তগণ মোদক অর্থাৎ লাড্ডু, রক্তবর্ণের পুষ্প, রক্তচন্দন ও দূর্বা ঘাস নিবেদন করে থাকেন।
বাংলায় গণেশ এক অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। ইনি ঘরে ঘরে পূজিত হন। তবে শুধুমাত্র গণেশের নামে উৎসর্গিত কোনও উৎসব বাংলায় পালিত হয় না। এই অঞ্চলে গণেশের সবচেয়ে বড় উৎসব পয়লা বৈশাখ তারিখে বাংলা নববর্ষের দিন পালিত হয়। প্রত্যেক বাঙালি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে এইদিন গণেশ পূজিত হন। কলকাতার কালীঘাট ও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে গণেশ ও লক্ষ্মীর প্রতিমা এবং হালখাতা নিয়ে অনেকে এই দিন সকালে পূজা প্রদান করতে যান। পূজা হয় গঙ্গাতীরে ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মন্দিরেও। দুর্গাপূজার সময় গণেশ বিশেষভাবে পূজিত হন। দুর্গামূর্তির ডানদিকে অথবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাঁদিকে গণেশের মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করা হয়। এছাড়া ভাদ্র ও মাঘ মাসের শুক্লাচতুর্থী তিথিতেও ঘরোয়া গণেশ পূজা বাংলায় প্রচলিত। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান এই সময় সর্বজনীন গণেশ পূজারও আয়োজন করে থাকেন। এছাড়াও কেউ কেউ কালীপূজার দিন লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা করে থাকেন।
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে অনুষ্ঠিত গণেশ চতুর্থী গণেশের নামে উৎসর্গিত বৃহত্তম উৎসব। প্রতিবছর অগস্ট মাসের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে ভাদ্রমাসের শুক্লাচতুর্থী তিথিতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশদিন ধরে মহারাষ্ট্রে এই উৎসব চলে। অতঃপর অনন্ত চতুর্দশীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের মাধ্যমে উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। মহারাষ্ট্রে এই উৎসব পূর্বে ছিল পারিবারিক গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ এক ক্ষুদ্র পর্বমাত্র। ১৮৯৩ সালে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক এই উৎসবকে মহারাষ্ট্রের এক জাতীয় উৎসবে পরিণত করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের জাতিভেদের সংকীর্ণতা দূর করে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ ও সংগঠিত করা। তিলকই প্রথম বারোয়ারি মণ্ডপে গণেশ প্রতিমা স্থাপন করেন ও দশদিন বাদে গণেশ বিসর্জনের প্রথার সূচনা করেন। আজও মহারাষ্ট্র ও সন্নিহিত অঞ্চলের লোকজন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে এই উৎসব পালন করে থাকেন। মুম্বাই মহানগরীতে এই উৎসব সর্বাধিক জাঁকজমকের সহিত পালিত হয়।
ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের প্রধান পাঁচজন দেবতার একজন রূপে স্বীকৃতি পাওয়ার পর কিছু ব্রাহ্মণ গণেশকেই তাদের প্রধান দেবতা রূপে পূজা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এইভাবে গঠিত হল গাণপত্য সম্প্রদায় এবং তার সঙ্গে সঙ্গেও গণপতিকে কেন্দ্র করে রচিত হল দুটি উপপুরাণ – গণেশ পুরাণ ও মুদ্গল পুরাণ।
গণেশ পুরাণ ও মুদ্গল পুরাণ গ্রন্থদুটির রচনাকাল প্রসঙ্গে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে এই দুই পুরাণের রচনাকাল ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও সময় বলে মনে করা হয়। সাধারণভাবে গণেশ পুরাণ-কে পূর্ববর্তী ধরা হলেও কোনও কোনও গবেষক এটিকে মুদ্গল পুরাণ-এর পরবর্তী বলে মনে করেন। অপর একটি লোকমান্য শাস্ত্রগ্রন্থ গণপতি অথর্বশীর্ষ খ্রিস্টীয় ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময়ে রচিত হয়েছিল।
হিন্দু মন্দিরে গণেশের উপস্থিতি দুইভাবে হয়ে থাকে – প্রথমত ‘পরিবার-দেবতা’র ‘পার্শ্বদেবতা’ রূপে; অথবা মন্দিরের প্রধান দেবতা রূপে। পুরাণে কথিত পার্বতীর দ্বাররক্ষক গণেশের স্মরণে, পূজাসিদ্ধির দেবতারূপে মন্দিরদ্বারের উপরে তার মূর্তিও খোদিত হয়ে থাকে। এছাড়াও শুধুমাত্র গণেশের জন্যও অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্রের অষ্টবিনায়ক মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। পুণে শহরের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এই আটটি মন্দিরের একটি ‘মণ্ডল’ গণপতির পবিত্র জগতের প্রতীক। এছাড়া উত্তর ভারতের যে কয়েকটি অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য গণেশ মন্দির আছে সেগুলি হলঃ মহারাষ্ট্র রাজ্যের ওয়াই; মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের উজ্জয়িনী; রাজস্থান রাজ্যের যোধপুর, নাগপুর ও রায়পুর; বিহার রাজ্যের বৈদ্যনাথ; গুজরাত রাজ্যের বরোদা, ধোলাকা ও ভালসাদ; উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারাণসী শহরের ধূণ্ডিরাজ মন্দির। দক্ষিণ ভারতের গণেশ মন্দিরগুলি হলঃ তামিল নাড়ু রাজ্যের তিরুচিরাপল্লীতে জম্বুকেশ্বর মন্দির, ঐ রাজ্যের রামেশ্বরম ও সুচিন্দ্রমের মন্দির; কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পি, কাসারগোড় ও ইডাগুঞ্জি এবং অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের ভদ্রাচলমের মন্দির। পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে কোনও উল্লেখযোগ্য গণেশ মন্দির নেই। তবে ভারতের বাইরে নেপাল ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নানান দেশে গণেশ মন্দিরের দেখা মেলে।
মধ্যযুগীয় ও আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যে গণেশের উপস্থিতি অনেকাংশেই উজ্জ্বল। মধ্যযুগীয় সাহিত্যে গণেশ বিঘ্ননাশক দেবতা এবং সেই সূত্রে কাব্যের প্রারম্ভে তার বন্দনা আবশ্যকর্তব্য। এছাড়া কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণ পদ্যানুবাদে গণেশের জন্মকাহিনিটি অন্তর্গত করেছিলেন। অন্যদিকে আধুনিক সাহিত্যে গণেশের সেই দেবভূমিকা অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে। আজও বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীতে ব্যঙ্গকৌতুকমূলক রচনায় গণেশের উপস্থিতি উজ্জ্বল।
বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে গণেশের জন্মোপাখ্যানের বদলে স্থান পেয়েছিল কার্তিকেয়ের জন্মকথা। কৃত্তিবাস সেই কাহিনি পরিহার করে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণে-এ উল্লিখিত কাহিনির মিশেলে গণেশের জন্মবিষয়ক একটি উপাখ্যান তার রামায়ণে অন্তর্ভুক্ত করেন। কাহিনিটি এইরূপ – রাজা দশরথ শনির ভবনে গমন করলে শনি প্রীত হলেন। কিন্তু তিনি রাজার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বাক্যালাপ করতে লাগলেন। দশরথ এর কারণ জানতে চাইলে শনি বললেনঃ
কোপদৃষ্টে সুদৃষ্টে যাহা পানে চাই।
দেব দৈত্য নাগ নর হৈয়া যায় ছাই।।
পূর্ব্ব কথা কহি রাজা তাহে দেহ মন।
যেমতে শিবের পুত্র হৈল গজানন।।
গৌরীর সন্তান হলে সকল দেবগণ তাকে দেখতে গেলেন। কিন্তু গেলেন না শনি। এতে গৌরী দূত পাঠিয়ে তাকে ডেকে পাঠালেন। গৌরীর ইচ্ছায় শনি শুভদৃষ্টেই নবজাতকের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। কিন্তু সেই শিশুর মুণ্ড তাতেই ছাই হয়ে গেল। গৌরী ব্যাথিত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কে আমার পুত্রের মাথা নিয়েছে? তখন দেবগণ তাকে শনির কুদৃষ্টির কথা বুঝিয়ে বললেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে দেবী শূল হস্তে শনিকে বধ করতে উদ্যত হলেন। দেবগণ অনেক স্তবস্তুতি করে শান্ত করলেন তাকে। গৌরীর বরেই শনি যার দিকে তাকান তার মুণ্ডহানি হয়। তাই বিনা কারণে শনিকে বধ করার যৌক্তিকতা কোথায়! দেবগণ গৌরীকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তার পুত্রকে তারা জীবিত করবেন। ব্রহ্মা তখন পবনদেবকে আদেশ করলেন উত্তর দিকে মাথা করে শুয়ে থাকা কাউকে দেখতে পেলে তার মাথাটি কেটে আনতে। গঙ্গাজল পান করে ইন্দ্রের ঐরাবত উত্তরদিকে মাথা করে ঘুমাচ্ছিল। তার মাথাটিই কেটে আনলেন পবন। গৌরীপুত্র গজানন হলেন। এতে গৌরী কিছু দুঃখিত হলেন। বললেন, সকল দেবতার পুত্র সুদর্শন। তাদের মধ্যে গজাননের কোথায় স্থান হবে! ব্রহ্মা তখন গণেশকে বর দিলেন যে তিনি সকল দেবতার অগ্রে পূজাধিকার পাবেন। তাকে বাদ দিয়ে অন্য দেবতার পূজা করলে পূজা বা কাজ কোনওটিই সিদ্ধ হবে না। অন্যদিকে ঐরাবতের বিহনে ইন্দ্র কাঁদতে শুরু করলে ব্রহ্মা পবনকে পুনরায় আদেশ করলেন পশ্চিম শিয়রে শায়িত কারও মাথা কেটে এনে ঐরাবতের মস্তকে জুড়ে দিতে। পশ্চিম শিয়রে শুয়েছিল একটি সাদা হাতি। তারই মাথা কেটে এনে জুড়ে দেওয়া হল ঐরাবতের দেহে। [61]
মঙ্গলকাব্যের শুরুতেই গণেশ বন্দনার রেওয়াজ দেখা যায়। শাস্ত্রীয় কারণে কোথাও এই নিয়মের ব্যতয় ঘটেনি। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদিতে দেখা যায়ঃ
গণপতি দেবের প্রধান
ব্যাস আদি জত কবি তোমার চরণ সেবি
প্রকাশিলা আগম পুরাণ।
অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর মার্জিত রুচির ভাষায় রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যও গণেশ বন্দনা দ্বারা শুরু করেছেনঃ
গণেশায় নমো নমঃ আদি ব্রহ্ম নিরুপম
পরমপুরুষ পরাৎপর।
খর্ব্বস্থূল কলেবর গজমুখ লম্বোদর
মহাযোগী পরম সুন্দর।।...
আমি চাহি এই বর শুন প্রভু গণেশ্বর
অন্নপূর্ণামঙ্গল রচিব।
কৃপাবলোকন কর বিঘ্নরাজ বিঘ্ন হর
ইথে পার তবে যে পাইব।।...
আবার ওই কাব্যের ‘হরগৌরীর কোন্দল’ অংশে গণেশকে নিয়ে রঙ্গতামাশা করতেও ছাড়েননি কবি,
বড় পুত্র গজমুখে চারি হাতে খান।
সব গুণ সিদ্ধি খেতে বাপের সমান।।
ভিক্ষা মাগি খুদ কণা যা পান ঠাকুর।
তাহার ইন্দুরে করে কাটুর-কুটুর।।
শাক্ত পদাবলির আগমনী অংশে গণেশের চিত্রটি বাড়ির আদুরে সন্তানের ছবি। গণেশ-জননীরূপী দুর্গা বাঙালির বিশেষ প্রিয়। দাশরথি রায়ের গানে পাওয়া যায়ঃ
বসিলেন মা হেমবরণী, হেরম্বে ল’য়ে কোলে।
হেরি গণেশ-জননী-রূপ, রাণী ভাসেন নয়ন-জলে।
ব্রহ্মাদি বালক যার, গিরি-বালিকা সেই তারা।
পদতলে বালক ভানু, বালক চন্দ্রধরা।
বালক ভানু জিনি তনু, বালক কোলে দোলে।।
রাণী মনে ভাবেন- উমারে দেখি, কি উমার কুমারে দেখি,
কোন্ রূপে সঁপিয়ে রাখি নয়নযুগলে।
দাশরথি কহিছে, রাণী, দুই তুল্য দরশন
হের, ব্রহ্মময়ী আর ঐ ব্রহ্ম-রূপ গজানন,
ব্রহ্ম-কোলে ব্রহ্ম-ছেলে বসেছে মা বলে।। [62]
বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বিস্তার করে। গণেশকে বিশেষভাবে ব্যবসায়ী ও বণিকরা পূজা করতেন, যারা বাণিজ্যিক উদ্যোগের জন্য ভারতের বাইরে গিয়েছিলেন।[63] আনুমানিক ১০ শতকের পর থেকে, বাণিজ্য গিল্ড গঠন এবং অর্থ সঞ্চালনের পুনরুত্থান সহ বিনিময়ের নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। এই সময়ে, গণেশ ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন।[64] প্রাচীনতম শিলালিপিটি বণিক সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত অন্য কোনো দেবতার আগে গণেশকে আহ্বান করে।[65]
হিন্দুরা সামুদ্রিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয় এবং গণেশ সহ তাদের সংস্কৃতিকে তাদের সাথে নিয়ে যায়।[66] প্রায়ই শিব অভয়ারণ্যের পাশে গণেশের মূর্তিগুলি সমগ্র অঞ্চলে পাওয়া যায়। ফিলিপাইন , জাভা , বালি এবং বোর্নিওর হিন্দু শিল্পে গণেশের রূপগুলি নির্দিষ্ট আঞ্চলিক প্রভাব দেখায়।[67] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে হিন্দু সংস্কৃতির বিস্তার বার্মা, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডে পরিবর্তিত আকারে গণেশ পূজা প্রতিষ্ঠা করে। ইন্দোচীনে , হিন্দুধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম পাশাপাশি চর্চা করা হত এবং এই অঞ্চলে গণেশের মূর্তিচিত্রে পারস্পরিক প্রভাব দেখা যায়।[68] থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামের চ্যামসের হিন্দু শ্রেণীর মধ্যে গণেশকে প্রধানত বাধা অপসারণকারী হিসেবে ভাবা হতো।[69]
আজ বৌদ্ধ থাইল্যান্ডে, গণেশকে বাধা দূরকারী, সাফল্যের দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[70] থাইল্যান্ড গণেশকে প্রধানত শিল্প ও শিক্ষার দেবতা বলে মনে করে। এই বিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন চক্রী রাজবংশের রাজা ভজিরাভুধ যিনি ব্যক্তিগতভাবে গণেশের ভক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি নাখোন পথম প্রদেশে তার ব্যক্তিগত প্রাসাদ, সানাম চন্দ্র প্রাসাদে একটি গণেশ মন্দির তৈরি করেছিলেন যেখানে তিনি তার একাডেমিক এবং সাহিত্যকর্মগুলিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠার পর গণেশকে শিল্পের দেবতা হিসাবে তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস আনুষ্ঠানিকভাবে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।যেখানে তিনি গণেশকে সীল হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আজ, গণেশকে চারুকলা বিভাগের সীলমোহরে এবং থাইল্যান্ডের প্রথম বিশিষ্ট চারুকলা একাডেমির সিলপাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয় চিত্রিত করা হয়েছে ।
ইসলামের আগমনের আগে , ভারতের সাথে আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় দেবতার পূজা করা হতো। ৫ম থেকে ৭ম শতাব্দীর ভাস্কর্যগুলির উদাহরণগুলি টিকে আছে, যা থেকে বোঝা যায় যে গণেশের পূজা তখন এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল।[71]
জৈন ধর্মাবলম্বীরাও গণেশের পূজা করে , যাদের জন্য তিনি সম্পদের দেবতা কুবেরের কিছু কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয় ।[72] ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সাথে জৈন সম্পর্ক এই ধারণাটিকে সমর্থন করে যে জৈন ধর্ম বাণিজ্যিক সংযোগ এবং হিন্দু ধর্মের প্রভাবের ফলে গণেশ পূজা গ্রহণ করেছিল।[73] প্রাচীনতম জৈন গণেশ মূর্তিটি প্রায় ৯ম শতাব্দীর।[74] ১৫ শতকের একটি জৈন পাঠ্য তার ছবি স্থাপনের পদ্ধতির তালিকা করে।[75] রাজস্থান ও গুজরাটের কিছু জৈন মন্দিরে গণেশের ছবি দেখা যায়।[76]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.