গণপত্যথর্বশীর্ষ (সংস্কৃত: गणपत्यर्थवशीर्ष) বা গণপত্যুপনিষদ্ হল হিন্দুধর্মের একটি গৌণ উপনিষদ্। অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত[1] এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে রচিত এই উপনিষদে হিন্দু দেবতা গণেশকে পরমেশ্বর বা ব্রহ্ম রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[1][2]
গণপত্যথর্বশীর্ষের একাধিক পুথি পাওয়া গিয়েছে। পুথিগুলির পাঠে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও বিষয়বস্তু একই। এই গ্রন্থে গণেশকে অন্যান্য দেবদেবীর সমতুল্য, পরম সত্য (ব্রহ্ম), সচ্চিদানন্দ, ব্যক্তি ও সর্ব প্রাণীর আত্মা ও ওঙ্কার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[3][4][5]
গণপত্যথর্বশীর্ষ পাঁচটি অথর্বশীর্ষোপনিষদের অন্যতম। এই পাঁচটি উপনিষদ্ হিন্দুধর্মের স্মার্ত সম্প্রদায়ের প্রধান পাঁচ দেবতার (গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও জয়দুর্গা) নামে নামাঙ্কিত।[6][7][8]
ইতিহাস
ঘুর্যের মতে, গণেশকে পরব্রহ্ম রূপে বর্ণনাকারী গণপত্যথর্বশীর্ষ নিতান্তই আধুনিক কালের রচনা।[9] কোর্টরাইট ও থাপানের মতে, এই গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিস্টীয় ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দী।[10][11] তবে "গণপতি" শব্দটির প্রথম উল্লেখ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে রচিত ঋগ্বেদেই (দ্বিতীয় মণ্ডল, সূক্ত ২৩, ঋক ১) পাওয়া যায়।[12] শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "জনসমষ্টির নেতা"। অবশ্য ঋগ্বেদে শব্দটির মাধ্যমে গণেশকেই বোঝানো হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।[13][14]
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংকলিত মুক্তিকোপনিষদে উল্লিখিত ১০৮টি উপনিষদের তালিকায় এই গ্রন্থের ক্রমসংখ্যা ৮৯।[15] ১৮০০ সালে উপনিষদ্ ব্রহ্মযোগী তাঁর মুক্তিকোপনিষদ্ ভাষ্যেও এই গণপত্যথর্বশীর্ষের নাম উল্লেখ করেছেন।[16]
সংস্করণ
গণপত্যথর্বশীর্ষের একাধিক পাঠান্তর পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভ্যানস কেনেডি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ-সহ এই গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ সংস্করণ প্রকাশ করেন।[17] জে. আর. সার্থা ১৯৬৯ সালে এই গ্রন্থের আর একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন।[18] সেই সংস্করণটির ভিত্তিতে কোর্টরাইট ১৯৮৫ সালে এই গ্রন্থের একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।[19] এর আগে ১৯৮৪ সালে গাডরান বুনেমান এই গ্রন্থের অনুবাদ-সহ একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন।[20]
১৯৮৭ সালে স্বামী চিন্ময়ানন্দ ইংরেজি অনুবাদ-সহ গণপত্যথর্বশীর্ষের একটি সংস্কৃত পাঠান্তর প্রকাশ করেন। এই সংস্করণের শ্লোকগুলির উৎসসূত্রটিকে তিনি অভিহিত করেন "উপমন্ত্র" নামে। তিনি লিখেছিলেন, এইভাবে শ্লোকবিন্যাসের ফলে অন্যান্য সংস্করণের তুলনায় তাঁর প্রকাশিত সংস্করণে শ্লোকসংখ্যা ও বিন্যাসে হেরফের ঘটতে পারে।[4]
১৯৯৫ সালে গণপতি সংক্রান্ত একটি বইতে জন গ্রিমস মূল উপনিষদ্টির সংস্কৃত পাঠ ও ইংরেজি অনুবাদ-সহ গ্রন্থের একটি গঠনগত ব্যাখ্যাও প্রদান করেন। তবে এই সংস্করণে শ্লোকসংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।[1]
বিষয়বস্তু
অন্যান্য অনেক সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থের মতো গণপত্যথর্বশীর্ষও একটি শান্তিবচনের মাধ্যমে শুরু হয়েছে।[21][22]
পরম সত্য রূপে গণেশ
গণপত্যথর্বশীর্ষের মূল অংশের প্রথম শ্লোকে গণেশকে পরম সত্ত্বা ও পরব্রহ্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[23] যেমনভাবে শৈব উপনিষদ্গুলিতে শিবকে, বৈষ্ণব উপনিষদ্গুলিতে বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে, শাক্ত উপনিষদ্গুলিতে মহাশক্তিকে ওঙ্কার, ব্রহ্ম, পরমাত্মা বলে এবং ছান্দোগ্যোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে উল্লিখিত বৈদিক "তত্ত্বমসি" ("তুমিই সেই") ধারণার মূর্ত প্রতীক রূপে বর্ণনা করা হয়েছে,[24][25][8] গণপত্যথর্বশীর্ষে গণেশকেও অনুরূপ বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে।[26]
শ্রীগণেশ স্তোত্র। ওঁ। গণপতিকে প্রণাম করি। তুমিই পরিদৃশ্যমান "তত্ত্বমসি "। তুমিই ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। তুমিই ব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা। তুমিই ব্রহ্মাণ্ডের সংহারকর্তা। তুমিই সর্বব্যাপী সত্য। তুমি ব্রহ্মের স্বরূপ।[27]
চিন্ময়ানন্দের অনুবাদ অনুসারে এই শ্লোকের অর্থটি নিম্নরূপ:
(হে শ্রীগণপতি!) একমাত্র তুমিই "তত্ত্বমসি" শব্দের সারতত্ত্বের প্রত্যক্ষ রূপ। একমাত্র তুমিই (ব্রহ্মাণ্ডের) সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। একমাত্র তুমিই ধ্বংসকর্তা। জগতে একমাত্র তুমিই এই সর্বস্ব – ‘ইদং সর্বম্’। কারণ, তুমি ব্রহ্ম। তুমি সাকারে চিরন্তন আত্মা।[28]
অন্যান্য দেবতা ও ওঙ্কারের সঙ্গে সমন্বয়
গণেশ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, সকল দেবদেবী, ব্রহ্মাণ্ড ও ওঙ্কারের সমতুল্য।[29] এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য হল, গণেশ পরমেশ্বর এবং সকল জীবাত্মার সমতুল্য।[29]
তুমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র (শিব)। তুমি অগ্নি, বায়ু ও সূর্য। তুমি চন্দ্র। তুমি ভূলোক, অন্তরীক্ষ ও স্বর্গলোক। তুমি ওঙ্কার মন্ত্রের স্বরূপ।[27]
চিন্ময়ানন্দের অনুবাদ অনুসারে এই শ্লোকটির অপর অর্থটি নিম্নরূপ:
(হে শ্রীগণপতি!) তুমি (ত্রিদেব) ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ। তুমি ইন্দ্র। তুমি অগ্নি ও বায়ু। তুমি সূর্য ও চন্দ্র। তুমি ব্রহ্ম। তুমি (ত্রিলোক) ভূলোক, অন্তরীক্ষলোক ও স্বর্গলোক। তুমি ওঙ্কার। (অর্থাৎ, তুমিই এই সর্বস্ব)।[30]
এই শ্লোক অনুসারে, গণেশ হলেন সকল আধ্যাত্মিক বস্তু, সচ্চিদানন্দ, সকল শব্দ, বাক্যের চারটি স্তর, সকল জ্ঞান, সকল চৈতন্য, সকল ব্রহ্মাণ্ডের উৎস, সকল ব্রহ্মাণ্ডের বর্তমান স্বরূপ, ভবিষ্যতে যাতে ব্রহ্মাণ্ড বিলীন হবে, সাংখ্য দর্শনের তিন গুণ ও গুণাতীত, জীবের সকল সত্ত্বা, সত্য, একত্ব, তুষ্টি ও আনন্দ।[31]
তন্ত্রের সমন্বয়
গণপত্যথর্বশীর্ষ যে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা, তার অন্যতম প্রমাণ হল এই গ্রন্থে নিহিত তান্ত্রিক ধারণাগুলির সমন্বয়। এই গ্রন্থে গণপতিকে মূলাধার চক্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে:
এই গ্রন্থে গণেশের বীজমন্ত্র "গং "-এর (সংস্কৃত: गं; gaṃ) বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই বীজমন্ত্রটি পূর্বরচিত গণেশপুরাণেও পাওয়া যায়। কোর্টরাইটের অনুবাদ অনুসারে এই শ্লোকটি এইরূপ:
"গণ " শব্দের প্রথম অক্ষর "গ " উচ্চারণপূর্বক যখন আনুনাসিক "ণ " অক্ষরটি উচ্চারণ করি, তখন তা অর্ধ্বচন্দ্রের ন্যায় সুন্দর রূপে প্রতিভাত হয়। এইটিই তোমার রূপ। "গ " এখানে প্রথম বর্ণ, "অ " মধ্যবর্ণ এবং "ণ " শেষবর্ণ। এই শব্দটি (অর্থাৎ "গং ") উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সকল শব্দ একযোগে উচ্চারিত হয়।[27][33]
গায়ত্রী মন্ত্র
গণেশ গায়ত্রী
একদন্তায় বিদ্মহে
বক্রতুণ্ডায় ধীমহি
তন্নো দন্তিঃ প্রচোদয়াৎ
(एकदन्ताय विद्महे
वक्रतुण्डाय धीमहि
तन्नो दन्तिः प्रचोदयात्)
আমরা যেন দকদন্তকে জানতে পারি,
আমরা যেন বক্রতুণ্ডের ধ্যান করতে পারি,
দন্তি আমাদের জ্ঞান ও ধ্যানকে অনুপ্রাণিত করুন।
—গণপত্যথর্বশীর্ষ, শ্লোক ৮,
জন গ্রিমসের অনুবাদ অবলম্বনে[34][35]
গণপত্যথর্বশীর্ষের অষ্টম শ্লোকে গণেশগায়ত্রী বর্ণিত হয়েছে। "নৃচদ গায়ত্রী" ছন্দে রচিত এই মন্ত্রটিকে গণেশের ধ্যান ও জ্ঞানের প্রেরণাদাত্রী বলে মনে করা হয়।[35] জন গ্রিমস বলেছেন, মন্ত্রটিকে মানুষের পরম আধ্যাত্মিক প্রেরণাদাত্রীও মনে করা হয়।[35] তাঁর মতে, গণেশগায়ত্রীর দন্ত ও তুণ্ড (শুঁড়) শব্দ দু’টি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক সত্যের প্রতীক। এই প্রতীকতত্ত্বের মাধ্যমে পার্থিব, বৌদ্ধিক ও অতিন্দ্রিয় আত্ম-উপলব্ধির সংযোগ সাধিত হয়।[36]
পরিশিষ্ট: উপনিষদের মর্যাদা
গণপত্যথর্বশীর্ষের পরিশিষ্টে গ্রন্থটিকে উপনিষদের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছে: "এই হল শ্রীগণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ্"।[37] গ্রন্থকার গ্রন্থটিকে অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। চিন্ময়ানন্দ এই শ্লোকটির অনুবাদ করেছেন: "এইরূপ অথর্বণ বলে থাকেন" (সংস্কৃত: ইত্যথর্বণবাক্যম্, इत्यथर्वणवाक्यम्; ityatharvaṇavākyam)।[38]
গণপত্যথর্বশীর্ষের সমাপ্তি অংশেও একটি শান্তিবচন রয়েছে। এই শান্তিবচনে বলা হয়েছে, "[ব্রহ্ম] আমাদের তুল্যরূপে রক্ষা করুন, তুল্যরূপে পালন করুন। আমরা যেন মহৎ কার্য সম্পাদন করি। ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি!"[39]
গুরুত্ব
গণপত্যথর্বশীর্ষ গ্রন্থটি হিন্দুধর্মের গণেশ-উপাসক গাণপত্য সম্প্রদায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ।[40]
আরও দেখুন
- অথর্বশীর্ষোপনিষদ্
- দেব্যুপনিষদ্
- মহানারায়ণোপনিষদ্
- নির্বাণোপনিষদ্
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.