ত্রিপুরা
ভারতের একটি রাজ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতের একটি রাজ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ত্রিপুরা (/ˈtrɪpʊrə,
ত্রিপুরা | |
---|---|
রাজ্য | |
ডাকনাম: "পার্বত্য টিপ্পেরা" | |
নীতিবাক্য: সত্যমেব জয়তে | |
ভারতে ত্রিপুরার অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ২৩.৮৪° উত্তর ৯১.২৮° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
অঞ্চল | উত্তরপূর্ব ভারত |
পূর্বে ছিল | দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরা |
ভারতে ভুক্তি | ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯[১] |
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল | ১ নভেম্বর ১৯৫৬ |
গঠিত হয়েছে | ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ |
রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর | আগরতলা |
জেলা | ৮ টি |
সরকার | |
• শাসক | ত্রিপুরা সরকার |
• রাজ্যপাল | ইন্দ্রসেন রেড্ডি[২] |
• মুখ্যমন্ত্রী | মানিক সাহা (বিজেপি) |
• প্রধান সচিব | জে.কে সিংহ[৩] |
রাজ্য আইনসভা | এককক্ষ বিশিষ্ট |
• বিধানসভা | ত্রিপুরা বিধানসভা (৬০টি আসন) |
জাতীয় সংসদ | ভারতীয় সংসদ |
• রাজ্যসভা | ১টি আসন |
• লোকসভা | ২টি আসন |
উচ্চ আদালত | ত্রিপুরা উচ্চ আদালত |
আয়তন[৪] | |
• মোট | ১০,৪৯১ বর্গকিমি (৪,০৫১ বর্গমাইল) |
এলাকার ক্রম | ২৮তম |
মাত্রা | |
• দৈর্ঘ্য | ১৭৮ কিলোমিটার (১১১ মাইল) |
• প্রস্থ | ১৩১ কিলোমিটার (৮১ মাইল) |
উচ্চতা | ৭৮০ মিটার (২,৫৬০ ফুট) |
সর্বোচ্চ উচ্চতা (বেটলিংছিপ[৫]) | ৯৩০ মিটার (৩,০৫০ ফুট) |
সর্বনিন্ম উচ্চতা (পশ্চিম প্রান্ত) | ১৫ মিটার (৪৯ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০২৩)[৬] | |
• মোট | ৪১,৪৭,০০০ |
• ক্রম | ২৩তম |
• জনঘনত্ব | ৪০০/বর্গকিমি (১,০০০/বর্গমাইল) |
• পৌর | ৩৯.১৯% |
• গ্রামীণ | ৬০.৪১% |
বিশেষণ | ত্রিপুরবাসী, ত্রিপুরী |
ভাষা | |
• সরকারি | [৭] |
• সরকারি লিপি | |
জিডিপি | |
• মোট (২০২৩–২০২৪) | ₹ ০.৮৯ কোটি (ইউএস$ ১,০৮,৭৮৭.৩৭) |
• ক্রম | ২৪তম |
• মাথাপিছু | ₹ ১৫৮৩৮২ (ইউএস$ ১,৯৩৫.৯৫) (২১তম) |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় প্রমাণ সময় (ইউটিসি+০৫:৩০) |
আইএসও ৩১৬৬ কোড | IN-TR |
যানবাহন নিবন্ধন | টিআর (TR) |
মানব উন্নয়ন সূচক (২০২২) | ০.৬৬৭ মধ্যম[৮] (২৫তম) |
সাক্ষরতা (২০১৩) | ৯৪.৬৫%[৯] (প্রথম) |
লিঙ্গ অনুপাত (২০২৩) | ৯৬৭♀/১০০০ ♂ (দ্বিতীয়) |
ওয়েবসাইট | tripura |
ত্রিপুরার প্রতীকী সমূহ | |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ত্রিপুরা দিবস |
প্রাণী | চশমাপরা হনুমান |
পাখি | কবুতর |
মাছ | বোয়ালী পাবদা |
ফুল | নাগেশ্বর |
উদ্ভিদ | আগর উদ্ভিদ |
ফল | আনারস |
রাজ্য সড়ক প্রতীক | |
ত্রিপুরার রাজ্য সড়ক | |
ভারতীয় রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতীকের তালিকা | |
†এটি উত্তর-পূর্ব এলাকা (পুনর্গঠন) আইন ১৯৭১ দ্বারা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা থেকে রাজ্যে উন্নীত হয়েছিল। |
আধুনিক ত্রিপুরার এলাকা মাণিক্য রাজবংশের দ্বারা কয়েক শতাব্দী ধরে শাসিত হয়েছিল যা ত্রিপুরী রাজ্যের অংশ ছিল (পার্বত্য টিপ্পেরা নামেও পরিচিত)। এটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে একটি রাজকীয় রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠে। এটি ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে একীভূত হয় এবং একটি 'পার্ট সি রাজ্য' (কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল) হিসাবে মনোনীত হয়।[১৪] ত্রিপুরা ১৯৭২ সালে ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়।
ত্রিপুরা ভারতের একটি ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থানে অবস্থিত, কারণ শুধুমাত্র একটি প্রধান মহাসড়ক, জাতীয় মহাসড়ক ৮, রাজ্যটিকে দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করে। রাজ্যের পাঁচটি প্রধান পর্বতশ্রেণী — বারামুরা, আথারমুরা, লংথারাই, শাখান এবং জাম্পুই পাহাড়। মধ্যবর্তী উপত্যকা সহ উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। রাজধানী আগরতলা পশ্চিমে সমভূমিতে অবস্থিত। রাজ্যের একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাভানা জলবায়ু রয়েছে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু থেকে মৌসুমী ভারী বৃষ্টিপাত হয়।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ত্রিপুরা হল ভারতের অন্যতম সাক্ষর রাজ্য, যেখানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৮৭.৭৫%। মূলধারার ভারতীয় সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী অনুশীলনের সাথে সহাবস্থান করে। যেমন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহ এবং উত্সব উদযাপনের জন্য বিভিন্ন নৃত্য; স্থানীয়ভাবে তৈরি বাদ্যযন্ত্র, কাপড় ব্যবহার এবং আঞ্চলিক দেবতাদের পূজা। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান উনাকোটি, পিলাক এবং দেবতামুরার ভাস্কর্যগুলি আদিবাসী ধর্মের মধ্যে শৈল্পিক সংমিশ্রণের ঐতিহাসিক প্রমাণ প্রদান করে।
ত্রিপুরা নামটি ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি উদয়পুরের ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের প্রধান দেবী, ত্রিপুরা সুন্দরীর সাথে সম্পর্কযুক্ত[১৫][১৬]। তাছাড়া কিংবদন্তি অত্যাচারী রাজা ত্রিপুরের সাথেও হয়তো নামের মিল রয়েছে, যিনি এই অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন। ত্রিপুর ছিলেন দ্রুহ্যুর ৩৯তম বংশধর, যিনি চন্দ্র রাজবংশের রাজা ইয়াতীর বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[১৭]
ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন বিকল্প তত্ত্ব রয়েছে, যেমন তিব্বত-বর্মান (কোকবোরোক) নামের সংস্কৃতে সম্ভাব্য ব্যুৎপত্তিগত পুনর্ব্যাখ্যা। এটির নামের বিভিন্ন রূপের মধ্যে রয়েছে তিপ্রা, তুইপ্রা এবং তেপ্রা, যেগুলি সবই এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের বোঝাতে পারে।[১৫] কোকবোরোক ভাষায় এর অর্থ, তৈ (জল) এবং প্রা (কাছের) শব্দ দুটো থেকেও নামের ব্যুৎপত্তির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে; এটি মনে করা হয় যে ত্রিপুরার সীমানা বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল যখন টিপ্পেরা রাজ্যের রাজারা মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে বর্তমান বার্মার রাজ্য আরাকান পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিল; তাই নামটির অর্থ সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চল প্রতিফলিত করতে পারে।[১৫][১৬][১৮]
যদিও ত্রিপুরায় প্রাক বা মাঝারি প্রস্তর যুগীয় জনবসতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু হাওরা এবং খোয়াই উপত্যকায় জীবাশ্ম কাঠের তৈরি উচ্চ প্রস্তর যুগীয় সময়কালের অস্ত্র ও যন্ত্রদি পাওয়া গেছে।[১৯] ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত; প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ পুরাণ; এবং খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মৌর্য সম্রাট অশোকের পাথর স্তম্ভের শিলালিপি অশোকের আদেশ, ইত্যাদি সব কিছুতেই ত্রিপুরার কথা উল্লেখিত রয়েছে।[১৭] ত্রিপুরার একটি প্রাচীন নাম (মহাভারতে উল্লিখিত) হল কিরাত দেশ (বা "কিরাতের ভূমি"), সম্ভবত কিরাতা রাজ্য বা আরও সাধারণ শব্দ কিরাতাকে বোঝায়।[২০] :১৫৫ যাইহোক, আধুনিক ত্রিপুরার ব্যাপ্তি কিরাত দেশের সাথে মিলিত কিনা তা স্পষ্ট নয়।[২১] এই অঞ্চলটি কয়েক শতাব্দী ধরে তুইপ্রা রাজ্যের অধীনে ছিল, কিন্তু কখন এই রাজবংশ শুরু হয়েছিল তা নথিভুক্ত করা হয়নি। রাজমালা, ত্রিপুরী রাজাদের একটি ইতিহাস যা প্রথম ১৫ শতকে লেখা হয়েছিল।[২২] এটি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্য (১৮৩০-১৮৫০) পর্যন্ত ১৭৯ জন রাজার তালিকা প্রদান করে,[২৩] :৩[২৪][২৫] তবে এটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নয়।[২৬]
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজ্যের সীমানা পরিবর্তিত হতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে এর সীমানা বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনের জঙ্গলে দক্ষিণ পর্যন্ত, পূর্ব দিকে বার্মা পর্যন্ত; এবং আসামের কামরূপ রাজ্যের সীমানার উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল।[২২] ১৩ শতকের পর থেকে এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মুসলিম আক্রমণ হয়েছিল।[২২] ১৭৩৩ সালে সাম্রাজ্যের সমতল ভূমিতে মুঘল আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল, যদিও তাদের শাসন কখনও পার্বত্য অঞ্চলে প্রসারিত হয়নি। পরবর্তীতে ত্রিপুরী রাজাদের নিয়োগে মুঘলদের প্রভাব ছিল।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে ত্রিপুরা একটি রাজকীয় রাজ্যে পরিণত হয়। ব্রিটিশ ভারতে ত্রিপুরার রাজাদের শাসনাধীন কিছু অঞ্চল ছিল, যা টিপ্পেরা জেলা বা চাকলা রোশনবাদ (বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা) নামে পরিচিত,[২২] তাছাড়াও পার্বত্য টিপ্পেরা নামে পরিচিত স্বাধীন এলাকাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই এলাকাটি মোটামুটিভাবে বর্তমান ত্রিপুরার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[২২] ত্রিপুরার দক্ষিণে অবস্থিত উদয়পুর ছিল রাজ্যের পুরাতন রাজধানী, পরবর্তীতে রাজা কৃষ্ণ মাণিক্য ১৮ শতকের দিকে পুরাতন আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৯ শতকে রাজধানীটি আগরতলায় নতুন শহরে পুন স্থানান্তরিত হয়। বীর চন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-১৮৯৬) তার প্রশাসনকে ব্রিটিশ ভারতের আদলে তৈরি করেন এবং আগরতলা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন গঠন সহ একাধিক সংস্কার প্রণয়ন করেন।[২৭]
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত টিপ্পেরা জেলা, পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলায় পরিণত হয় এবং পার্বত্য টিপ্পেরা ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত একটি রিজেন্সি কাউন্সিলের অধীনে ছিল। ত্রিপুরার মহারানি, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯-এ ত্রিপুরা একীভূতকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ত্রিপুরা তৃতীয় শ্রেণীর রাজ্য হিসেবে ভারতের একটি অংশে পরিণত করে।[২৮] এই অঞ্চলটি ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে আইনসভা ছাড়াই একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় এবং জুলাই ১৯৬৩ সালে একটি নির্বাচিত মন্ত্রক প্রতিষ্ঠিত হয়।[২৮] ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব এলাকা (পুনর্গঠন) আইন, ১৯৭১ দ্বারা ত্রিপুরাকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতার সাথে, ভৌগলিক বিভাজনের ফলে রাজ্যের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিপর্যয় দেখা দেয়, কারণ রাজ্য এবং সদ্য-স্বাধীন ভারতের প্রধান শহরগুলির মধ্যে সড়ক পরিবহনকে পূর্ব পাকিস্তানের আশেপাশে আরও বৃত্তাকার পথ অনুসরণ করতে হয়েছিল। দেশভাগের আগে কলকাতা ও আগরতলার মধ্যে সড়ক দূরত্ব ছিল ৩৫০ কিমি (২২০ মা) এর কম এবং ভারত বিভাজনের পর যা ১,৭০০ কিমি (১,১০০ মা) বেড়েছে, যেহেতু সড়কটিকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান এড়িয়ে যেতে হয়েছিল।[২৯]
ভারত বিভাজনের পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে অনেক বাঙালি হিন্দু ত্রিপুরায় চলে আসেন, বিশেষ করে ১৯৪৯ সালের পর থেকে[২৮]। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দু বাঙালিদের বসতি আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা রাজ্যের কিছু অংশ গোলাবর্ষণ করেছিল। যুদ্ধের সমাপ্তির পর, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক সীমান্তের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে পুনর্গঠিত করে, যার ফলে ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনটি নতুন রাজ্যের অস্তিত্ব আসে:[৩০] মেঘালয়, মণিপুর এবং ত্রিপুরা।[৩০] ভারতের ইউনিয়নের সাথে ত্রিপুরার একীভূত হওয়ার আগে, জনসংখ্যার অধিকাংশই আদিবাসী ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত ছিল।[২৮] ত্রিপুরী উপজাতি এবং প্রধানত অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব বিক্ষিপ্ত সহিংসতার দিকে পরিচালিত হতে থাকে,[৩১] এবং কয়েক দশক ধরে বিদ্রোহের জন্ম দেয়, যার মধ্যে ১৯৮০ সালের মান্দাই গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।[৩২] পরবর্তীতে একটি উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা এবং কৌশলগত বিদ্রোহ-বিরোধী অভিযানের ব্যবহারের পরে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ হ্রাস পায়।[৩৩]
ত্রিপুরা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত পার্বত্য রাজ্য। ভারতে সাতটি সংলগ্ন রাজ্য রয়েছে, যথা: অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা; এগুলো সম্মিলিতভাবে সপ্ত ভগিনী রাজ্য নামে পরিচিত। ১০,৪৯১.৬৯ কিমি২ (৪,০৫০.৮৬ মা২) এর বেশি আয়তন বিশিষ্ট ত্রিপুরা, গোয়া এবং সিকিমের পরে দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য। রাজ্যটি, অক্ষাংশ ২২°৫৬'উঃ থেকে ২৪°৩২'উঃ এবং দ্রাঘিমাংশ ৯১°০৯'পূঃ থেকে ৯২°২০'পূঃ পর্যন্ত বিস্তৃত।[২৮] :৩এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭৮ কিমি (১১১ মা), এবং সর্বোচ্চ প্রস্থ ১৩১ কিমি (৮১ মা)। ত্রিপুরার পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে বাংলাদেশ এবং উত্তর পূর্ব দিক জুড়ে আছে ভারতের আসাম এবং পূর্বে মিজোরাম রাজ্য।[২৮] :৩আসামের করিমগঞ্জ জেলা এবং মিজোরামের মামিত জেলার মধ্য দিয়ে যাওয়া জাতীয় মহাসড়ক দ্বারা ত্রিপুরা অন্য রাজ্যের সাথে যুক্ত।[৩৪]
ত্রিপুরার স্থলভূমি বিভিন্ন পর্বতশ্রেণী, উপত্যকা এবং সমভূমি দ্বারা গঠিত। রাজ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত ভিন্ন পাহাড়-পর্বত পরিলক্ষিত হয়, যেমন: পশ্চিমে বড়মুড়া থেকে আঠারমুড়া, লংতরাই এবং শাখান হয়ে পূর্বে জম্পুই পাহাড় পর্যন্ত পাঁচটি পশ্চাদমুখী পর্বতমালা রয়েছে। মধ্যবর্তী সিনকলাইনগুলি হল আগরতলা-উদয়পুর, খোয়াই-তেলিয়ামুড়া, কমলপুর-আম্বাসা, কৈলাসহর-মনু এবং ধর্মনগর-কাঞ্চনপুর উপত্যকা।[৩৫]:৪ ৯৩৯ মি (৩,০৮১ ফু) উচ্চতা বিশিষ্ট জাম্পুই পর্বতশ্রেণীর বেটলিং ছিপ রাজ্যের সর্বোচ্চ বিন্দু।[২৮] :৪ রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন টিলা রয়েছে। পশ্চিমে উপস্থিত সরু উর্বর পলিমাটি উপত্যকাগুলি ডোং/লুঙ্গা নামে পরিচিত।[২৮] :৪ বেশ কিছু নদী ত্রিপুরার পাহাড়ে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে।[২৮] :৪খোয়াই, ধলাই, মনু, জুরি এবং লঙ্গাই উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে; পশ্চিমে গোমতী; এবং দক্ষিণ পশ্চিমে মুহুরী ও ফেনী নদী প্রবাহিত হয়েছে।[৩৫]:৭৩
ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপ দ্বারা প্রকাশিত লিথোস্ট্রেটিগ্রাফি উপাত্তে রাজ্যের শিলাগুলির তারিখ বর্ণিত করা হয়। এই শিলাগুলো ভূতাত্ত্বিক সময় স্কেলে, অলিগোসিন যুগ এবং হোলোসিন যুগের মধ্যবর্তী সময়কালের। পাহাড়ে ছিদ্রযুক্ত লাল ল্যাটেরাইট মাটি রয়েছে। বন্যার সমভূমি এবং সরু উপত্যকাগুলি পলিমাটি দ্বারা আবৃত এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে অধিকাংশ কৃষি জমি রয়েছে।[২৮] :৪ ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস অনুসারে ভূমিকম্পের প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য, এক থেকে পাঁচ এর স্কেলের মধ্যে রাজ্যটি সিসমিক জোন V- এ অবস্থিত।
রাজ্যের একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাভানা জলবায়ু রয়েছে।[৩৬] ত্রিপুরার চারটি প্রধান ঋতু, যথা: শীতকাল, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত; প্রাক-বর্ষা বা গ্রীষ্ম, মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত; বর্ষাকাল, মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত; এবং বর্ষা-পরবর্তী, অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।[৩৭] বর্ষা ঋতুতে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারী বৃষ্টি নিয়ে আসে, যা ঘন ঘন বন্যার কারণ হয়ে দাড়ায়।[২৮] ১৯৯৫ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ছিল ১,৯৭৯.৬ থেকে ২,৭৪৫.৯ মিমি (৭৭.৯৪ থেকে ১০৮.১১ ইঞ্চি)।[৩৮] শীতকালে, তাপমাত্রা ১৩ থেকে ২৭ °সে (৫৫ থেকে ৮১ °ফা) এর মধ্যে থাকে, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায় ২৪ এবং ৩৬ °সে (৭৫ এবং ৯৭ °ফা) এর মধ্যে পড়ে।[৩৭] জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুসারে, রাজ্যটি বায়ু এবং ঘূর্ণিঝড় থেকে "খুব উচ্চ ক্ষতির ঝুঁকি" অঞ্চলে রয়েছে।[৩৯]
মাস | জানু | ফেব্রু | মার্চ | এপ্রিল | মে | জুন | জুলাই | আগস্ট | সেপ্টে | অক্টো | নভে | ডিসে | বছর |
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
সর্বোচ্চ গড় °সে (°ফা) | ২৫.৬ (৭৮.১) |
২৮.৩ (৮২.৯) |
৩২.৫ (৯০.৫) |
৩৩.৭ (৯২.৭) |
৩২.৮ (৯১.০) |
৩১.৮ (৮৯.২) |
৩১.৪ (৮৮.৫) |
৩১.৭ (৮৯.১) |
৩১.৭ (৮৯.১) |
৩১.১ (৮৮.০) |
২৯.২ (৮৪.৬) |
২৬.৪ (৭৯.৫) |
৩০.৫ (৮৬.৯) |
সর্বনিম্ন গড় °সে (°ফা) | ১০ (৫০) |
১৩.২ (৫৫.৮) |
১৮.৭ (৬৫.৭) |
২২.২ (৭২.০) |
২৩.৫ (৭৪.৩) |
২৪.৬ (৭৬.৩) |
২৪.৮ (৭৬.৬) |
২৪.৭ (৭৬.৫) |
২৪.৩ (৭৫.৭) |
২২ (৭২) |
১৬.৬ (৬১.৯) |
১১.৩ (৫২.৩) |
১৯.৭ (৬৭.৪) |
অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি) | ২৭.৫ (১.০৮) |
২১.৫ (০.৮৫) |
৬০.৭ (২.৩৯) |
১৯৯.৭ (৭.৮৬) |
৩২৯.৯ (১২.৯৯) |
৩৯৩.৪ (১৫.৪৯) |
৩৬৩.১ (১৪.৩০) |
২৯৮.৭ (১১.৭৬) |
২৩২.৪ (৯.১৫) |
১৬২.৫ (৬.৪০) |
৪৬ (১.৮) |
১০.৬ (০.৪২) |
২,১৪৬ (৮৪.৪৯) |
উৎস: [৪০] |
বেশিরভাগ ভারতীয় উপমহাদেশের মতো, ত্রিপুরাও ইন্দো-মালয় জীবভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। ভারতের জৈব-ভৌগলিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে, রাজ্যটি "উত্তর-পূর্ব" জৈব-ভৌগলিক অঞ্চলে রয়েছে। ২০১১ সালে রাজ্যের মোট স্থলের ৫৭.৭৩% ছিল বনাঞ্চল।[৪১] ত্রিপুরায় তিনটি ভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে: পর্বত, বন এবং মিষ্টি জল।[৪২] পাহাড়ের ঢালে এবং বালুকাময় নদীর তীরে চিরহরিৎ বনাঞ্চলে ডিপ্টেরোকার্পাস, আর্টোকার্পাস, আমুরা, ইলাওকার্পাস, সিজিজিয়াম এবং ইউজেনিয়া প্রজাতির গাছের প্রাধান্য রয়েছে।[৪৩] আর্দ্র পর্ণমোচী মিশ্র বন এবং সাল গাছের বন রাজ্যের বেশিরভাগ গাছপালা ধারণ করে।[৪৩] পর্ণমোচী এবং চিরসবুজ উদ্ভিদের সাথে বাঁশ এবং বেতের বনের ছেদ ত্রিপুরার গাছপালাগুলির একটি বিশেষত্ব।[৪৩] তৃণভূমি এবং জলাভূমিও রয়েছে, বিশেষ করে সমভূমিতে। ত্রিপুরার জলাভূমিতে ভেষজ উদ্ভিদ এবং গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ যেমন আলবিজিয়া, ব্যারিংটোনিয়া, লেজারস্ট্রোমিয়া এবং ম্যাকারাঙ্গা বৃদ্ধি পায়।[৪৩]
১৯৮৯-৯০ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে ত্রিপুরায় ৬৫টি গোত্রের এবং ১০টি শ্রেণীর, প্রায় ৯০টি স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে।[৪৪] সেগুলির মধ্যে রয়েছে হাতি, ভালুক, বিন্টুরং, সজারু, মায়া হরিণ, সাম্বার, বুনো শুয়োর, গৌর,চিতা, মেঘলা চিতা, এবং অনেক প্রজাতির ছোট বিড়াল এবং প্রাইমেট।[৪৪] ভারতের ১৫টি ফ্রি রেঞ্জিং প্রাইমেটের মধ্যে সাতটি ত্রিপুরায় পাওয়া যায়; এটি ভারতের যেকোনো রাজ্যে পাওয়া প্রাইমেট প্রজাতির সর্বোচ্চ সংখ্যা।[৪৪] ত্রিপুরায় বন্য মহিষ এখন বিলুপ্ত।[৪৫] রাজ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।[৪৫]
রাজ্যের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যগুলি হল সিপাহিজোলা, গোমতী, রোয়া এবং তৃষ্ণা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।[৪৬] রাজ্যের জাতীয় উদ্যানগুলি হল ক্লাউডেড লেপার্ড ন্যাশনাল পার্ক এবং রাজবাড়ি জাতীয় উদ্যান।[৪৬] এই সুরক্ষিত এলাকাগুলি মোট ৫৬৬.৯৩ কিমি২ (২১৮.৮৯ মা২) অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত।[৪৬] গোমতীও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি উদ্যান।[৪৭] শীতকালে, গোমতী ও রুদ্রসাগর হ্রদে হাজার হাজার পরিযায়ী জলপাখি ভিড় করে।[৪৮]
২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে, ত্রিপুরার প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে বড় রাজনৈতিক কাঠামোগত পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়েছিল। ২০১২ সালের পূর্বে রাজ্যে মোট চারটি জেলা ছিল – ধলাই (সদর দপ্তর আমবাসা), উত্তর ত্রিপুরা (সদর দপ্তর কৈলাশহর), দক্ষিণ ত্রিপুরা (সদর দপ্তর উদয়পুর, ত্রিপুরা), এবং পশ্চিম ত্রিপুরা (সদর দপ্তর আগরতলা)। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যমান চারটি জেলার মধ্যে থেকে চারটি আরও নতুন জেলা তৈরি করা হয়েছিল, সেই নতুন চারটি জেলা হল: খোয়াই, উনাকোটি, সিপাহিজলা ও গোমতী।[৪৯] তারই সাথে ছয়টি নতুন মহকুমা এবং পাঁচটি নতুন ব্লকও যুক্ত হয়েছে।[৫০] প্রতিটি জেলা একজন জেলা কালেক্টর বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা সাধারণত ভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবা দ্বারা নিযুক্ত হয়ে থাকেন। প্রতিটি জেলার মহকুমাগুলি একজন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা শাসিত হয় এবং প্রতিটি মহকুমাকে আরও ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে। ব্লকগুলি পঞ্চায়েত (গ্রাম পরিষদ) এবং শহরের পৌরসভা নিয়ে গঠিত। বর্তমানে রাজ্যের আটটি জেলা, ২৩টি মহকুমা এবং ৫৮টি উন্নয়ন ব্লক রয়েছে।[৫১]
জেলা | সদর দপ্তর | জনসংখ্যা | আয়তন (বর্গ কিমি) |
---|---|---|---|
ধলাই জেলা | আমবাসা | ৩৭৭৯৮৮ | ২৩১২.২৯ |
উত্তর ত্রিপুরা জেলা | ধর্মনগর | ৪১৫৯৪৬ | ১৪২২.১৯ |
দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা | বেলোনিয়া | ৪৩৩৭৩৭ | ২১৫২ |
পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা | আগরতলা | ৯১৭৫৩৪ | ৯৮৩.৬৩ |
ঊনকোটি জেলা | কৈলাসহর | ২৭৭৩৩৫ | ৬৮৬.৯৭ |
খোয়াই জেলা | খোয়াই | ৩২৭৫৬৪ | ১৩৭৭.২৮ |
গোমতী জেলা | উদয়পুর | ৪৪১৫৩৮ | ১৫২২.৮ |
সিপাহীজলা জেলা | বিশ্রামগঞ্জ | ৪৮৪২৩৩ | ১০৪৩.০৪ |
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সবচেয়ে জনবহুল শহর। দশ হাজার বা এর বেশি জনসংখ্যা সহ অন্যান্য প্রধান শহরগুলি (২০১৫ সালের আদমশুমারি অনুসারে) হল সাব্রুম, ধর্মনগর, যোগেন্দ্রনগর, কৈলাশহর , প্রতাপগড়, উদয়পুর, অমরপুর, বেলোনিয়া, গান্ধীগ্রাম, কুমারঘাট , খোয়াই, রানীরবাজার, তেশপুরাগড়, সোমপুরানগর, আমবাসা, কামালপুর, বিশ্রামগঞ্জ, কাঁঠালিয়া, শান্তিরবাজার ও বক্সানগর।
মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, বর্তমান মূল্যে (১৯৯৯-২০০০ ভিত্তি)[৫২] ভারতীয় টাকায় মিলিয়নের অঙ্কে | |
বছর | মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন |
---|---|
১৯৮০ | ২,৮৬০ |
১৯৮৫ | ৫,২৪০ |
১৯৯০ | ১০,৩১০ |
১৯৯৫ | ২২,৯৬০ |
২০০০ | ৫২,৭০০ |
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ত্রিপুরার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হয়েছে ৪৬,১৩৩ কোটি টাকা বা ৬.৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা তাজিকিস্তান এর সমতুল্য।[৫৩]
ত্রিপুরার অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী এবং ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশই কৃষির সাথে যুক্ত। পণ্যফসলের তুলনায় ত্রিপুরায় খাদ্যফসল উৎপাদনের পরিমাণই অধিক। ত্রিপুরায় উৎপন্ন প্রধান খাদ্যফসলগুলি হল ধান, তৈলবীজ, ডাল, আলু এবং আখ। চা ও রাবার হল রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পণ্যফসল। ত্রিপুরা হল "ভারতীয় রাবার বোর্ড" দ্বারা ঘোষিত দেশের দ্বিতীয় রাবার রাজধানী এবং এর স্থান কেরলের পরেই। ত্রিপুরার হস্তশিল্পও অত্যন্ত বিখ্যাত। ২০০০-২০০১ আর্থিক বছরে এ রাজ্যের মাথাপিছু আয় বর্তমান মূল্যে হল ১০,৯৩১ টাকা এবং স্থায়ী মূল্যে হল ৬,৮১৩ টাকা।
শাল, গর্জন এবং টিক সহ কিছু উৎকৃষ্ট মানের কাঠ ত্রিপুরার বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। এছাড়া ত্রিপুরা খনিজ সম্পদে বিশেষ সমৃদ্ধ না হলেও এখানে ভাল প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হয়। তবে শিল্পক্ষেত্রে ত্রিপুরা এখনও অনগ্রসর।
ত্রিপুরা ভারতের অন্যতম জনশক্তি সরবরাহকারী রাজ্য। এখানে সুলভ শ্রমিক ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কাজের খোঁজে পাড়ি জমায়।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতই ত্রিপুরাতেও সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিচালিত হয়। সরকার ব্যবস্থা তিনটি শাখায় বিভক্ত যথা, আইনসভা, বিচারবিভাগ এবং প্রশাসন। ত্রিপুরার আইনসভা হল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপুরা বিধানসভা। বিধানসভার অধ্যক্ষ এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে উপাধ্যক্ষ সভার কার্যাবলিতে পৌরোহিত্য করে থাকেন। ত্রিপুরার বিচারবিভাগের প্রধান হল ত্রিপুরা উচ্চন্যায়ালয়। এছাড়াও বিভিন্ন নিম্ন আদালতের দ্বারা বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ত্রিপুরা রাজ্যে প্রশাসনের সাংবিধানিক প্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত রাজ্যপাল। কিন্তু মূল প্রশাসনিক ভার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার উপরে ন্যস্ত। বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল অথবা রাজনৈতিক জোটের নেতা অথবা নেত্রীকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য আহ্বান জানান। এরপর রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যারা তাঁদের কার্যাবলির বিবরণ বিধানসভায় পেশ করে থাকেন। ত্রিপুরা বিধানসভা হল ৬০ সদস্য বিশিষ্ট একটি এককক্ষীয় আইনসভা।[৫৪] একটি নির্বাচিত বিধানসভার পূর্ণ মেয়াদ হল পাঁচ বছর কিন্তু সরকার নির্ধারিত মেয়াদের আগেই বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারেন। ত্রিপুরা থেকে লোকসভায় দু'জন সদস্য এবং রাজ্যসভায় একজন সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়াও গ্রামীণ পরিচালন সংস্থা পঞ্চায়েতে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপুরার প্রধান রাজনৈতিক জোট ও দলগুলি হল ভারতীয় জনতা পার্টি, বামফ্রন্ট এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। বর্তমানে ত্রিপুরা সরকারে ক্ষমতাসীন রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ড: মানিক সাহা নেতৃত্বাধীন বিজেপি। ১৯৭৭ সালের পূর্বাবধি ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ ত্রিপুরা সরকার পরিচালিত হয় বামফ্রন্টের নেতৃত্বাধীনে এবং ১৯৯৩ সাল থেকে আবার তারা ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতির জোট সরকার পরিচালনা করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনে ৬০টি আসনের ৪৪টি তে জয়লাভ করে ভারতীয় জনতা পার্টি অধীন এন.ডি.এ. জোট ক্ষমতাসীন হয় অপরদিকে সিপিআই(এম) পায় মাত্র ১৬টি আসন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর ৫৫টি আসনে জামানত জব্দ হয়।
ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে ত্রিপুরা সংযুক্ত হয়েছে অসমের মধ্যে দিয়ে লামডিং এবং শিলচর পর্যন্ত বিস্তৃত ব্রডগেজ রেলওয়ে লাইন দ্বারা। ত্রিপুরার প্রধান রেল স্টেশনগুলি হল আগরতলা, ধর্মনগর এবং কুমারঘাট। এছাড়া ৮নং জাতীয় সড়কও ত্রিপুরাকে অসম সহ সমগ্র ভারতের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করেছে।
আগরতলা বিমানবন্দর হল এ রাজ্যের প্রধান বিমানবন্দর এবং এখান থেকে কলকাতা, গুয়াহাটি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি এবং শিলচরের উদ্দেশে নিয়মিত উড়ান রওনা দেয়।
ভারতের প্রধান টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলির অধিকাংশই ত্রিপুরা রাজ্যে উপস্থিত এবং এগুলি রাজধানী সহ রাজ্যের অন্যান্য অংশে দূরভাষ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদান করে।
ত্রিপুরা হল অসমের পরেই উত্তর-পূর্ব ভারতের দ্বিতীয় জনবহুল রাজ্য। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে রাজ্যের মোট জনসংখ্যা হল ৩,১৯৯,২০৩ এবং জনঘনত্ব হল প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩০৫ জন। সারা দেশে জনসংখ্যার বিচারে ত্রিপুরার স্থান ২২ তম। সমগ্র ভারতের জনসংখ্যার ০.৩১% এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যার ৮.১৮% ত্রিপুরায় বসবাস করে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৭০% বাঙালি এবং বাকি ৩০% বিভিন্ন উপজাতি ও জনজাতীয় সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত। জনজাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী উপজাতি রয়েছে এবং এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হল ককবরকভাষী ত্রিপুরি সম্প্রদায়। এছাড়াও রয়েছে জামাতিয়া, রিয়াং, নোয়াতিয়া অন্যান্য সম্প্রদায়। আদিবাসী অঞ্চল গুলিতে বাঙালি ও আদিবাসীদের মধ্যে কিছু উত্তেজনা বিরাজমান।
১৯৯১ সালের সূত্র অনুযায়ী মানব উন্নয়ন সূচকে সারা দেশে ত্রিপুরার স্থান ২২তম এবং দারিদ্র সূচকে ২৪তম। ত্রিপুরায় স্বাক্ষরতার হার ৮৭.৭৫%, যা স্বাক্ষরতার জাতীয় হার ৬৫.২০%-এর অধিক।
ত্রিপুরার ধর্মবিশ্বাস[৫৬] | ||||
---|---|---|---|---|
ধর্ম | শতকরা হার | |||
হিন্দুধর্ম | ৮৩.৪% | |||
ইসলাম | ৮.৬% | |||
খ্রিস্ট ধর্ম | ৪.৩৫% | |||
বৌদ্ধ ধর্ম | ৩.৪১% |
ত্রিপুরার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায় হল হিন্দু (মোট জনসংখ্যার ৮৩.৪০%)।[৫৬] সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মুসলিম (৮.৬০%), খ্রিস্টান (৪.৩৫%) এবং বৌদ্ধ (৩.৪১%)।[৫৬]
সম্প্রদায় | ভাষা | ভাষাগোষ্ঠী |
---|---|---|
বাঙালি | বাংলা | ইন্দো-ইউরোপীয় |
ত্রিপুরি | কোক বোরোক ভাষা | চীনা-তিব্বতি ভাষাগোষ্ঠী|চীনা-তিব্বতি |
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি | বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি | ইন্দো-ইউরোপীয় |
মণিপুরী | মৈতৈ | চীনা-তিব্বতি |
চাকমা | চাকমা | ইন্দো-ইউরোপীয় |
কুকি | কুকি | চীনা-তিব্বতি |
মিজো | মিজো | চীনা-তিব্বতি |
আরাকানিজ় | আরাকানিজ় | তিব্বতি-বর্মী |
এই পরিসংখ্যান সময়ের সাথে সাথে ত্রিপুরার বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপাতের একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে। ১৯৪১ সালে ত্রিপুরার জনসংখ্যায় হিন্দু ছিল ৭০%, মুসলিম ছিল ২৩% এবং ৬% ছিল বিভিন্ন উপজাতি ধর্মাবলম্বী।[৫৭] এটিও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ১৯৫১ সালে ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ৬৪৯৯৩০, যা ১৯৪১ সালে ছিল আরও স্বল্প কারণ তখনও পূর্ববঙ্গ থেকে শতাধিক শরণার্থীর আগমন ঘটেনি। যদিও এই শরণার্থীর আগমনও ত্রিপুরার জনপরিসংখ্যানে ১৯৭০-এর দশকের আগে বিশেষ প্রভাব ফেলেনি।
বাঙালি এবং উপজাতি মিলিয়ে ত্রিপুরার অধিকাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বীই শাক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। রাজতান্ত্রিক আমলে হিন্দুধর্মই ছিল ত্রিপুরার রাজধর্ম। সমাজে পূজারী ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল অত্যন্ত উঁচুতে। ত্রিপুরার হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উপাস্য প্রধান দেবদেবীগণ হলেন শিব এবং দেবী শক্তির অপর রূপ দেবী ত্রিপুরেশ্বরী।
ত্রিপুরায় হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলি হল দুর্গাপূজা, নবরাত্রি, কালীপূজা, ইত্যাদি। এছাড়াও ত্রিপুরায় পালিত হয় গঙ্গা উৎসব, যাতে ত্রিপুরার উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ দেবী গঙ্গার উপাসনা করে থাকে।[৫৮]
ভারতের অন্যান্য অংশের মতই ত্রিপুরাতেও দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় হল মুসলিম সম্প্রদায়।[৫৬] ত্রিপুরার অধিকাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষই ইসলামের সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত।
২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে ত্রিপুরায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১০২৪৮৯। রাজ্যের অধিকাংশ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীই ত্রিপুরি এবং অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত।
ত্রিপুরার খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রধান উল্লেখযোগ্য শাখা হল ত্রিপুরা ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান ইউনিয়ন নামক সংগঠনের অধীনস্থ ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়। সারা রাজ্যে এই সংগঠনের ৮০০০০ সদস্য এবং প্রায় ৫০০ গির্জা রয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় হল রোমান ক্যাথলিক গির্জা এবং এই সম্প্রদায়ের ২৫০০০ সদস্য রয়েছেন।
রাজ্যের আগরতলা-এ একটি ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ত্রিপুরার উত্তরাংশে অরণ্যাবৃত পাহাড় ও উপত্যকা, আর দক্ষিণে গহন জঙ্গল। প্রতি বছর এখানে ৪,০০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এখানে প্রায় ৩৬ লক্ষ লোকের বাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩৫০ জন বসবাস করেন। এখানকার প্রায় ৮৫.৬% লোক হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে স্বল্প সংখ্যক মুসলমান ও খ্রিস্টানও বাস করেন। বাংলা ভাষা, ইংরেজি ও ককবরক ভাষা এখানকার সরকারি ভাষা। মণিপুরী মৈতৈ ভাষাও প্রচলিত।
আগরতলাতে ১৯৮৭ সালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষিকাজ এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। এদের মধ্যে চা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল। এছাড়াও এখানে পাট, তুলা, ফলমূল, গম, আলু এবং আখের চাষ হয়। কৃষিকাজের কারণে বনাঞ্চলের কিয়দংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ত্রিপুরা থেকে ভারতের জাতীয় আইনসভাতে তিনজন সদস্য প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এবং বাকী দুইজন নিম্নকক্ষ লোকসভায় যান। ত্রিপুরাতে আটটি জেলা আছে। ১৯৯৩ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র কার্যকলাপ এর প্রেক্ষিতে এখানে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রযুক্ত হয়। পরে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচিত রাজ্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রাত্যহার করা হল। বর্তমানে ত্রিপুরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। জাতি উপজাতির মধ্যে ভ্রাতৃভাব ও বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বেড়ে উঠার আগেই পরাস্ত আর খতম হয়ে গেছে।
১৪শ শতকে রচিত রাজমালাতে ত্রিপুরার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ছিল ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের কাহিনী। মাণিক্য রাজবংশ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, ত্রিপুরা ভারতের অংশ হবার আগ পর্যন্ত অঞ্চলটি ধারাবাহিকভাবে শাসন করে। কথিত আছে প্রায় ২৫০০ বছর ধরে ১৮৬জন রাজা এই অঞ্চলটি শাসন করেছেন।[৫৯] ১৯৫৬ সালে ত্রিপুরা একটি ইউনিয়ন টেরিটরি এবং ১৯৭২ সালে একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
ত্রিপুরার প্রায় ৭০% লোক বাংলা ভাষী। বাকী ৩০% বিভিন্ন আদিবাসী জাতির লোক। এদের মধ্যে ককবরক ভাষায় কথা বলা ত্রিপুরি জাতি, জামাতিয়া জাতি, রেয়াং জাতি এবং নোয়াতিয়া জাতির লোক বৃহত্তম সম্প্রদায়। আদিবাসী এলাকাগুলিতে ত্রিপুরী ও আদিবাসীদের মধ্যে অনুকরণীয় সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বিরাজমান।
ত্রিপুরায় সাক্ষরতার হার প্রায় ৮৭.৭৫%, যা ভারতের গড় সাক্ষরতার হারের চেয়ে বেশি।
নীরমহল ত্রিপুরার একটি দর্শনীয় স্থান। নীর অর্থাৎ জলের মাঝে মহলটি স্থাপিত বলে এর নামকরণ করা হয় নীরমহল। মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক বাহাদুরের আমলে নীরমহল তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতেরই আরেক প্রদেশ রাজস্থানের উদয়পুরে ঠিক একই রকম একটি প্রাসাদ রয়েছে। ইংল্যান্ডের মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানি ১৯৩০ সালে এর কাজ শুরু করে এবং ১৯৩৮ সালে ভবনটির উদ্বোধন করা হয়।ত্রিপুরার একটি ছোট এলাকা মেলাঘরে নীরমহল অবস্থিত। রাজধানী আগরতলা থেকে এর দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার।নীরমহল বাজারের পাশে রুদ্রসাগর নামে বিশাল একটি জলাশয় আছে। এর আয়তন প্রায় পাঁচ দশমিক তিন বর্গকিলোমিটার। রুদ্রসাগরের ঠিক মাঝখানে ত্রিপুরার রাজার গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এই মহলটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটি একাধারে যেমন রাজার সৌন্দর্যপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়, তেমনি হিন্দু ও মোঘল সংস্কৃতি মিশিয়ে তিনি একটি দর্শনীয় কিছু করতে চেয়েছিলেন, সেই ধারণারও প্রমাণ পাওয়া যায়।প্রাসাদের দুটি অংশ। মূল অংশ রয়েছে পশ্চিম পাশে এবং পূর্ব পাশে রয়েছে নিরাপত্তাবাহিনীর জন্য দুর্গ। মূল অংশকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- বাইরের কক্ষ এবং অন্দরমহল। বাইরের কক্ষগুলোর মধ্যে বিশ্রামঘর, খাজাঞ্চিখানা ও নাচঘর উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের পাঁচটি কক্ষ সেখানে রয়েছে। এছাড়া দাবা খেলার জন্যও একটি আলাদা কক্ষ রয়েছে। রাণী ও অন্যদের জন্য অন্দরমহলে রয়েছে বিশাল ছয়টি কক্ষ। এছাড়া রান্না ঘর, রাজার সভাঘর, আড্ডাঘর ইত্যাদি তো রয়েছেই। বর্তমানে মহলের ভিতর একটি জাদুঘরও রয়েছে।অন্দরমহলটি এমনভাবে সাজানো ছিলো যাতে রাজা-রাণী নৌকাভ্রমণ সেরে অন্দরমহলের সিঁড়িতে সরাসরি প্রবেশ করতে পারেন। এছাড়া প্রাসাদের ভেতরের অংশে একটি বিরাট বাগানও রয়েছে। রাজা-রাণীর বেড়ানোর জন্য ঘাটে সবসময় মোটরচালিত নৌকা থাকত।বাইরের দিকে দুটি ঘাট রয়েছে। সেখানে কর্মচারীরা গোসল করতো এবং ঘাটগুলো তাদের যাতায়াতের জন্যও ব্যবহার করা হতো।তবে মহারাজা অনেক অর্থ খরচ করে এই প্রাসাদ নির্মাণ করলেও খুব বেশি দিন তিনি ভোগ করতে পারেননি। মাত্র সাত বছর তিনি এই প্রাসাদ ব্যবহার করেছে। কারণ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান।মহারাজা মারা যাওয়ার পর বহুদিন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো। এ সময় আস্তে আস্তে এটি ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। অবশেষে ১৯৭৮ সালে ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রক এর দায়িত্ব নেয় এবং ভবনটি রক্ষায় সচেষ্ট হয়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ভবনটিতে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এটিকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতি শীতের সময়ে লাইট অ্যান্ড লেজার শোর মাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি এই প্রাসাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এছাড়া প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে রুদ্রসাগর লেকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে বাসে সরাসরি মেলাঘর যাওয়া যায়। এছাড়া জিপ ও অন্যান্য গাড়ি ভাড়া করে সেখানে যাওয়া যাবে। বাস ভাড়া ৪০ টাকা। সময় লাগে দুই ঘণ্টা। মেলাঘর বাসস্ট্যান্ডে সাগরমহল ট্যুরিস্ট লজে রিকশা দিয়ে যেতে হবে। ভাড়া ১০ টাকা।সাগরমহল ট্যুরিস্ট লজটি ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রকের অধীনে। এতে আধুনিক সুযোগসুবিধাসহ মোট ৪৪টি সিট রয়েছে। এসি ও নন-এসি দু'ধরনের সুবিধাই রয়েছে রুমগুলোতে।
ত্রিপুরার বিখ্যাত লেখক বা কবি শ্রীমান অনিল সরকার (১৯৩৯-২০১৫) ছদ্মনাম চন্দ্রগুপ্ত
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.