Loading AI tools
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্তরেখা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
র্যাডক্লিফ লাইন বা র্যাডক্লিফ রেখা হল ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা৷ এটি এই রেখার পরিকল্পনাকারী স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ এর নামে নামাঙ্কিত৷ তিনি প্রায় ৮.৮ কোটি মানুষের বসতি ও সর্বমোট ১,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত বাংলা ও পাঞ্জাব উভয় প্রদেশের জনবিন্যাসগত সুষ্ঠু বিভাজন পরিকল্পনার যুগ্মসভাপতি হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন৷[১]
১৭ই আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজন সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারণ রেখার অন্তিম পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়৷ বর্তমানে এই রেখাটির পশ্চিমভাগ ভারত–পাকিস্তান সীমান্ত ও পূর্বভাগ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নামে পরিচিত৷
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাইতে যুক্তরাজ্যের আইনসভাতে (ব্রিটিশ পার্লামেন্ট) পাশ হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনকে নির্দেশ করে, যা একমাস পরে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ফললাভ করে৷ শুধু তাই নয় আইনটির মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি অধিরাজ্যের মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশসমূহ বিভাজনের ইঙ্গিতও নিহিত ছিলো৷
ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় ও আইনানুসারে ভারতের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে দেশীয় রাজ্য এবং ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলগুলো একীভূত করে তাদের নেতৃবৃন্দের ওপর কে কোন অধিরাজ্য চয়ন করবে সেই অধিকার দেওয়া হয়৷[২]
পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিলো একটি মুসলিমপ্রধান ক্ষেত্র তৈরী করা, অপরদিকে ভারতীয় অধিরাজ্য চেয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে৷ ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলোই পরে পাকিস্তানের স্রষ্টা হয়ে ওঠে৷ প্রাথমিকভাবে উত্তরপশ্চিমের বেলুচিস্তান প্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৯১.৮% মুসলিম জনসংখ্যা) ও সিন্ধুপ্রদেশ (বিভাজনের পূর্বে ৭২.৭% মুসলিম জনসংখ্যা) পুরোপুরিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ উক্ত প্রদেশগুলোতে অন্যান্য ধর্মের সংখ্যা নগণ্য হলেও (যদিও সিন্ধুপ্রদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল ছিলো হিন্দুপ্রধান) উত্তর পশ্চিমের পাঞ্জাব ও পূর্বভারতের বঙ্গপ্রদেশ ছিলো যথাক্রমে ৫৫.৭% ও ৫৪.৪% মুসলিমপ্রধান৷[৩] পাঞ্জাবের পশ্চিমভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় আবার পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়৷ পরে পূর্ব পাঞ্জাব পাঞ্জাব, হরিয়াণা ও হিমাচল প্রদেশ নামে তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়৷ বঙ্গপ্রদেশও পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) ও পশ্চিমবঙ্গতে (ভারত) বিভক্ত হয়ে যায়৷ স্বাধীনতার পূর্বে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (যা পূর্বে ডুরান্ড সীমার মাধ্যমে আফগানিস্তানের সাথে সীমানা নির্দেশিত ছিলো) গণভোটের মাধ্যমে ঠিক হয় যে তা পাকিস্তানের যাথে যুক্ত হবে৷[৪] এই বিতর্কিত গণভোটটি যদিও পরবর্তীকালে উক্ত প্রদেশে খুদাই খিদমতগার আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয় পাঠানরা বয়কট করে৷ এটি বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ৷
পাঞ্জাবের ধর্মীয় জনবিন্যাস এমনই ছিলো যেন কোনো রেখার দ্বারাই হিন্দু, মুসলিম ও শিখপ্রধান অঞ্চল আলাদা করা সম্ভব ছিলো না৷ একই কারণে কোনোভাবেই ব্রিটিশ প্রস্তাবিত কোনো সীমা নির্ধারণকারী রেখা মহম্মদ আলি জিন্নাহ পরিচালিত মুসলিম লীগ এবং জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পরিচালিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস উভয়কে খুশি করতে পারেনি৷ উপরন্তু ধর্মের ভিত্তিতে করা যেকোনো প্রকার বিভাজনের ফলস্বরূপ রেল ও সড়ক বিছিন্ন, সেচ পরিকল্পনা, বৈদ্যুতিন সংযোগ এমনকী ভূসম্পত্তির টানাপোড়ন হওয়া সম্ভাবনা নাকচ করা যেতো না৷[৫] যাইহোক, একটি সুপরিকল্পিত রেখা দ্বারা চাষী ও চাষের জমিকে বা সাধারণ মানুষকে সর্বনিম্ন হয়রানির সম্মুখীন করা যেতো৷
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে উপমহাদেশে প্রায় ১.৪ কোটি জনসাধারণ বাস্তুহারা হয়৷ তারা যে যেমনভাবে পারুক বাসে, ট্রেনে, আকাশপথে, এক্কাগাড়ি, লরিতে করে এবং অধিকাংশই পায়ে হেঁটে আপন জমিহারা হয়ে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হন৷[৬] তাদের অনেকেই প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়, অনেকে দুর্ভিক্ষগ্রস্থ হয়ে বা অবসন্ন হয়ে মারা যান৷ এছাড়া ঊনপুষ্টি জনিত শরণার্থীদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কলেরা ও আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন৷[৭] উক্ত সময়ে ব্রিটিশ বাহিনীর অনুমোদিত গণনা অনুসারে প্রায় ২,০০,০০০ জন শরণার্থী বিভিন্ন কারণে মারা যায়, যদিও জণগণনার মাধ্যমে জানা যায় যে এর পরিমাণ প্রায় দশলক্ষের কাছাকাছি ছিলো৷[৭]
খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই ব্রিটিশ ভারতে বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশের বিভাজনের পরিকল্পনা বিভিন্ন স্তরে চলতে থাকে৷ শুধু পরিকল্পনাই নয় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাংলা ও তৎলগ্ন আসাম, বিহার ও ওড়িশা বঙ্গভঙ্গের কবলিত হয়েছিলো৷ প্রথমবার এই বঙ্গভঙ্গে প্রস্তাব দেন লর্ড কার্জন। ফলস্বরূপ নবগঠিত 'পূর্ব বাংলা ও আসাম' প্রদেশটি একটি মুসলিমপ্রধান প্রদেশে পরিণত হয় ও ঢাকা শহরটিকে তার রাজধানী হিসাবে স্থাপিত করা হয়৷ অপরপক্ষে 'পশ্চিম বাংলা' প্রদেশটি ছিলো একটি হিন্দু প্রধান প্রদেশ, যার রাজধানী ছিলো শহর কলকাতা। নবগঠিত উভয় প্রদেশ থেকে প্রবল বিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রশমিত করার লক্ষে এই বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়৷ কিন্তু পুরাতন বৃহত্তর বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে বিহার, আসাম ও উৎকল প্রদেশকে পৃথক করে দেওয়া হয়৷[৮]
বঙ্গভঙ্গের অনুরূপ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঞ্জাব প্রদেশটি বিভাজনের প্রস্তাব আসা শুরু হয়৷ পাঞ্জাব ভাগের প্রবক্তারা হলেন হিন্দু নেতা পরমানন্দ মোহিয়াল, জাতীয় কংগ্রেসের নেতা লালা লাজপত রায়, শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাসহ অন্যান্য আরো অনেক শিখ নেতা৷ ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের লাহোর প্রস্তাবের সময় মুসলিম লীগ আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে৷ ডাঃ বি. আর. আম্বেদকর "থটস অন পাকিস্তান" (পাকিস্তানের পরিকল্পনা) নামক ৪০০ পাতার একটি গবেষণামূলক পুস্তিকা লেখেন৷[৯] পুস্তিকাটি মূলত বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলিম ও অমুসলিম জনসীমানা ও তার বিশ্লেষণের ওপর নির্দেশিত৷ তার গণনা অনুযায়ী তিনি দেখান পাঞ্জাবের পশ্চিমাঞ্চলের ১৬টি জেলা মুসলিম প্রধান ও পূর্বের বাকী ১৩টি জেলা শিখ বা হিন্দু, তথা অমুসলিমদের দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ আবার বাংলার ক্ষেত্রে ১৫টি জেলা অমুসলিম তথা হিন্দুপ্রধান হিসাবে তিনি প্রকাশ করেন৷ তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম জনগণ প্রাদেশিক সীমানা পুণর্নির্ধারণ নিয়ে কোনো প্রকার মতবিরোধ করবে না৷ তার মতে, যদি এরপরেও তাদের বিরোধ হয় তবে এটাই বুঝে নিতে হবে যে তারা তাদের নিজের মূল দাবীচ্যুত ও অন্যপ্রকার পরিকল্পনায় রত৷[১০][১১]
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের সিমলা সম্মেলন বিফল হওয়ার পর পাকিস্তান তৈরীর পরিকল্পনা গভীরভাবে শুরু হয়৷ ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত মুনশি স্যার ইভান জেনকিন্স, যিনি পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হিসাবে নিয়োজিত হন, "পাকিস্তান এন্ড দ্য পাঞ্জাব" (পাকিস্তান এবং পাঞ্জাব) নামক একটি স্মারকলিপি লেখেন৷ সেখানে তিনি পাকিস্তান বিভাজনকে ঘিরে তৎকাল ও পরবর্তী সময়ে কী কী সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেই বিষয়ে আলোচনা করেছেন৷ এরপরেই বিকানেরের অমাত্য-প্রধান কে. এম. পণিক্কর ভাইসরয়কে একটি ফিরতি স্মারকলিপি পাঠান৷ তার পাঠানো "নেক্সট স্টেপ ইন ইন্ডিয়া"তে (ভারতে পরবর্তী পদক্ষেপ) তিনি ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দেন যে, তারা যেন মুসলিমপ্রধান অঞ্চল আলাদা করার মূলনীতি মাথায় রেখেই পাঞ্জাব এবং বাংলাতে বসবাসকারী সার্বিক সংখ্যালঘু হিন্দু এবং শিখদের দাবীগুলোও পুরণ করার চেষ্টা করে এবং সেই মতো স্থানিক সমন্বয় ঘটায়৷ এই আলোচনার ওপর ভিত্তি করে ভাইসরয় ভারতীয় রাজ্য মহাসচিবকে "পাকিস্তান থিওরি" (পাকিস্তান প্রকল্প) নামে একটি চিঠি লেখেন৷[১২] ভাইসরয় রাজ্য মহাসচিবকে জানান যে, সম্পূর্ণ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে কোনোরকম ন্যূনতম আপোস না করে তার পরিকল্পনা মতো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চান৷ যেখানে একটি বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি থাকার জন্য জাতীয় কংগ্রেস উভয় প্রদেশেরই প্রায় অর্ধেকাংশ ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন৷ এই পরিস্থিতিই সেসময়ে বিভাজনের একমাত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷[১৩]
রাজ্যসচিব তার প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লর্ড ওয়াভেলকে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলোর সঠিক নির্বাচন করে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার কথা বলেন৷ পুণর্গঠন কমিশনার ভি.পি.মেনোন এবং তার সহকর্মী স্যার বি.এন.রাও-এর ওপর এই কাজ অর্পিত হয়৷ তারা "ডিমার্কেশন অফ পাকিস্তান এরিয়া" (পাকিস্তান অঞ্চলের সীমানানির্দেশ) নামে একটি চিঠি প্রস্তুত করে৷ তাদের চিঠি অনুসারে সিন্ধুপ্রদেশ, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ পাঞ্জাবর পশ্চিমভাগের তিনটি বিভাগ যথা, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান ও লাহোর বিভাগকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়৷ তাদের অনুমান করেছিলো এর ফলে প্রায় ২২ লক্ষ শিখ ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানে ও ১৫ লক্ষ শিখ ভারতে অবস্থান করবে৷ পাকিস্তানের লাহোর বিভাগের অমৃৎসর জেলা ও গুরুদাসপুর জেলাকে শিখপ্রধান অঞ্চল হিসাবে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (অমৃৎসর ছিলো একটি অমুসলিম প্রধান জেলা ও গুরুদাসপুর ছিলো প্রান্তীয় মুসলিম প্রধান জেলা)৷ সম্পূর্ণ গুরুদাসপুর জেলার ভারতভুক্তির ক্ষতিপূরণ হিসাবে সীমানা নির্ধারণ কমিশন বাংলার সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পূর্ণ দিনাজপুর জেলাকে পাকিস্তানের পূর্বপ্রান্তে যুক্ত করা হয়৷ ভারপ্রাপ্ত গৃহপরিকল্পনা কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য জন থর্নের কাছ থেকে তার মন্তব্য শোনার পর ভাইসরয় ওয়াভেল তা রাজ্যসচিবকে জানানোর ব্যবস্থা করেন৷ শিখদের ধর্মীয় পবিত্র শহর অমৃৎসরকে পাকিস্তান থেকে বহির্ভুত করার এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গুরুদাসপুর জেলাকেও ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়৷[১৪][১৫][ক] রাজ্য মহাসচিব এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে তা ভারত-ব্রহ্মদেশ সমিতিকে স্থানান্তর করেন ও জানান, "আই ডু নট থিঙ্ক দ্যাট এনি বেটার ডিভিশান দ্যান দ্য ওয়ান দ্য ভাইসরয় প্রোপোসেস ইস লাইকলি টু বি ফাউন্ড" (আমার মনে হয় না ভাইসরয়ের দ্বারা প্রস্তাবিত বিভাজন রেখার থেকে উত্তম কোনো প্রস্তাব হতে পারে)৷[১৬]
প্রাক্তন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর প্রস্তাব ও মুসলিম লীগের প্রস্তাবিত দাবীর মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের যেকোনো প্রকার পরিকল্পনাই শিখদের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মাস্টার তারা সিং ব্যাখ্যা করেন৷ তার মতে এই বিভাজনের ফলে শিখরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যাবে৷ তিনি পাঞ্জাবের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের বিপক্ষে ছিলেন, বরং তিনি চেয়েছিলন পাঞ্জাব যেন একটি সায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হয়৷ তার মতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের কখনোই পাঞ্জাবে শাসন করতে দেওয়া ঠিক নয়৷ অন্যান্য শিখরাও স্বীকার করেছিলেন যে মুসলিমরা হিন্দু আধিপত্য ও শিখরা মুসলিম আধিপত্যযুক্ত স্থান এড়িয়ে চলতে চান৷ শিখরা ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করে দেন যে, পাঞ্জাবের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত বিভাজন বা সম্পূর্ণ পাঞ্জাবকে পাকিস্তানে যুক্ত করলে ব্রাটিশবাহিনীতে কর্মরত শিখ সেনাদলের মনোবল ক্ষুণ্ণ করবে৷ যেহেতু বাকী হিন্দুরা পাঞ্জাবকে বাদ দিয়ে বাকী ভারত নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলো তাই শিখ নেতা মাস্টার তারা সিং হিন্দুদের সাথে সমন্বয় না ঘটিয়ে বরং ইংরেজদের সরাসরি আলোচনার কথা বলতে আগ্রহী হন৷ ভারত ভাগের উপরিফলস্বরূপ গিয়ানী কর্তার সিং একটি আলাদা শিখরাজ্য গঠন করার প্রস্তাব পরিকল্পনা করেন৷[১৭]
বিভাজন পরিকল্পনা ও সীমা নির্ধারণ চলাকালীন পাকিস্তানের পরিকল্পক মহম্মদ আলি জিন্নাহ শিখদের পূর্ণ অধিকারের সাথে সমস্ত সাংবিধানিক স্বাধীনতা-অধিকার দেওয়ার শর্তে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন৷ শিখরা এই প্রস্তাবকে খারিজ করে দেয় ও পাকিস্তানের বিরোধীতা করতে থাকে৷ তারা একটি বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রে একটি প্রদেশের ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়ে থাকতে চাননি৷ শিখ সম্প্রদায়ের লোক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি বা পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দিতে চাওয়ার একাধিক কারণ থাকলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, পাঞ্জাবের বিভাজনের ফলে শিখদের একাধিক পবিত্র ধর্মীয়স্থল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়ে, যা ঐসমস্ত ধর্মস্থলগুলোকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে৷[১৮]
যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একটি অখণ্ড ভারত গড়ার পরিকল্পনা করেন ও মুসলিম লীগ একটি পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে ঐ ঐকই সময়ে শিখনেতা ডাঃ বীর সিং ভাট্টি ‘খালিস্তান’ নামে একটি পৃথক শিখরাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন৷[১৯] পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধে অনড় শিখনেতাদের মধ্যে সকলেই পৃথক শিখরাজ্যের দাবীকে সমর্থন করেন৷ মাস্টার তারা সিং স্বাধীন খালিস্তানের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারত বা পাকিস্তান অধিরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে যুক্ত হওয়ার কথা বলেন৷ তবে এটা মানতে হয় যে, শিখরা যেই অঞ্চলটিকে নিয়ে খালিস্তান তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেখানে কোনো ধর্মেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না৷[২০] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত থেকে পৃথক খালিস্তান রাজ্যের দাবী উঠতে থাকে৷ প্রাথমিকভাবে আলাপালোচনার মাধ্যমে ব্রিটিশ বাহিনী এই দাবীকে মেনে নিলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের চাপের বশে শিখরা পরে তাদের এই দাবী প্রত্যাহার করে নেয়৷[২১] ক্যাবিনেট মিশনের সিদ্ধান্ত শিখদের মূলগতভাবে নাড়া দিয়েছিলো, কারণ যখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই ব্রিটিশ প্রস্তাবে সন্তুষ্ঠ হলে দেখা যায় তাতে শিখদের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত রয়ে যায়৷ হয় তাদের একাধিক ধর্মস্থল বিসর্জন দিয়ে হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রে যোগ দিতে হতো, নতুবা নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে যোগ দিতে হত যেখানে তাদের প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা ছিলো৷ মাস্টার তারা সিং ৫ই মে এই প্রস্তাবের বিরোধ করেন৷ সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকের মধ্যে তাদের পূর্ববর্তী দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব সত্ত্বেও শিখনেতারা ব্রিটিশদের অন্তর্বর্তী প্রস্তাবে মান্যতা দেয়৷[২০] শিখরা ধর্মীয় ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিতে ভারতীয় অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷[২১]
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যকার মতবিরোধ দূর করে একটি সঠিক সমাধানের লক্ষ্যে ভারতে একটি ক্যাবিনেট মিশন পাঠান৷ কংগ্রেস খাঁটি মুসলিম অঞ্চলগুলো নিয়ে পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাবে মান্যতা দেয়৷ শিখনেতারা শিখদের স্বার্থে আম্বালা, জলন্ধর, লাহোর বিভাগ এবং মুলতান বিভাগের কিছু জেলা একত্রিত করে একটি শিখ স্বশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দেন, যদিও তা ক্যাবিনেট সদস্যদের গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি৷ জিন্নাহের সাথে আলোচনার পর ক্যাবিনেট মিশন সিদ্ধান্ত নেয়, হয় গুরুদাসপুর বাদে অন্যান্য মুসলিম প্রধান জেলাগুলো নিয়ে একটি ক্ষুদ্র পাকিস্তান তৈরী হবে নতুবা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বৃহত্তর পাকিস্তান তৈরী হবে৷[২২] প্রাথমিক ভাবে ক্যাবিনেট মিশন সমস্ত প্রস্তাব সম্বলিত হয়ে একটি বৃহত্তর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব দিলেও শেষে অকেন্দ্রীভূত ভারতের শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে নেহেরু এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন৷[২৩][২৪]
পাঞ্জাব এবং বাংলা উভয় প্রদেশেরই হিন্দু এবং শিখরা প্রদেশদুটির বিভাজনকে ক্ষতিকর বলে মনে করেছিলো কারণ যদি ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগও হয় তবুও এই দুটি প্রদেশে মুসলিমরা সামান্য প্রান্তীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো কিন্তু ভারতভাগের সীমানা এই প্রদেশদুটির ওপর দিয়েই নির্ধারিত হয়৷[২৫] ব্রিটিশ সরকারও এই যুক্তির সাথে সহমত পোষণ করে৷[২৬][২৭] বিদ্বান আকবর আহমেদ মনে করেন যে, ভারতের শাসনতন্ত্রের মৌলিক একক হলো প্রদেশ, এবং তাই প্রদেশভাগের জায়গায় জেলাভিত্তিক বিভাজন হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং বিভাজনের মূল উদ্দেশ্যকে খণ্ডিত করে৷ তিনি আরো বলেন যে, এই ধরনের সিদ্ধান্তে বিচ্ছিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবী তুলতে পারে৷[২৮]
শিয়ালকোটের পণ্ডিত ও লেখক মনে করেন, ভি.পি.মেনোন ও সর্দার প্যাটেল যুগ্ম প্রচেষ্টায় মুসলিমদের একটি "মথ ইটেন পাকিস্তান" (অপূর্ণ পাকিস্তান) দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন৷ এরপর নেহেরু ভাইসরয় ওয়াভেলের সাথে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাজন বিষয়ক আলোচনা শুরু করেন৷ নেহেরু মেনোনকে জানান যে, এই বিভাজনের ফলে পাঞ্জাব ও বাংলার যথাক্রমে কৃষি ও শিল্পে উন্নত অংশগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে আর পাকিস্তান কন্ধ-কাটা হয়ে তার গুরুত্ব হারাবে৷[২৫] নেহেরু গান্ধীজিকে বলেছিলেন যে, "ইট ইস আনলাইকলি দ্যাট জিন্নাহ এন্ড মুসলিম লীগ উইল এগ্রি টু দিস ট্রানকেটেড পাকিস্তান হুইচ ক্যান নেভার সাক্সিড ইকোনমিকালি অর আদারওয়াইস" (এটা প্রায় অসম্ভব যে জিন্নাহ এবং মুসলীম লিগ এরকম একটি কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরীতে সম্মত হবে যা পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য দিক দিয়ে অগ্রসর হতে অপারগ) স্যার ক্রিপ্স বলেন, পাকিস্তান যা চেয়েছিলো তার থেকে তারা যা পাচ্ছে তা কিছু অংশে পরিবর্তন যোগ্য এবং এটা হতেও পারে যে তারা এই পরিকল্পনাকে অস্বীকার করবে৷[২৯] ৮ই মার্চ তারিখে কংগ্রেস পাঞ্জাব বিভাজনের সম্ভাব্য সমাধান পেশ করে৷[২৯][৩০]
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্পষ্ট আদেশ নিয়ে পরবর্তী ভাইসরয় হিসাবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন৷ শিয়ালকোটের প্রখ্যাত লেখকের মতে, মাউন্টব্যাটেন এবং তার সদস্যরা সেখানে আসার আগে থেকেই পাঞ্জাব বিভাজনের সমস্ত সুপারিশের মূল্যায়ন করে রেখেছিলেন৷ দশদিনের মধ্যে মাউন্টব্যাটেন এর কর্মীরা সুনিশ্চিতভাবে বলেন যে, কংগ্রেস পাঞ্জাবের পূর্বদিকের ১৩টি জেলা (অমৃৎসর ও গুরুদাসপুর জেলা সহ) বাদে বাকী অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে বিনাবাধায় প্রস্তুত৷[৩১]
জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ এই প্রস্তাব সহ্য করে নেয়৷ যদিও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে পরপর হওয়া ছয়টি আলোচনাসভাতে তিনি প্রদেশগুলোর পাকিস্তানে সম্পূর্ণ ভুক্তির কথা তুলতে থাকেন৷ তিনি তীব্রভাবে অভিযোগ করেন যে তার পরিকল্পিত সম্পূর্ণ পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং বাংলাকে ভেঙে ভাইসরয় একটি অসম্পূর্ণ ও কন্ধ-কাটা পাকিস্তান তৈরী করতে চান৷[৩২][৩৩][৩৪]
অমুসলিমদের জন্য গুরুদাসপুর জেলা একটি মুখ্য কলহপরায়ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷ পাঞ্জাব লোকসভায় তাদের সদস্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মুখ্যসদস্য লর্ড ইসমায়কে এবং জেলাশাসককে জানান যে, গুরুদাসপুর আসলে একটি অমুসলিম জেলা৷ তারা বিস্তারিতভাবে বোঝান যে গুরুদাসপুর জেলায় জনসংখ্যার দিক থেকে ৫১% মুসলিম হলেও সমগ্র জেলাটির জমির মাত্র ৩৫% মুসলিমদের মালিকানাধীন এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা এসেছে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির হারের কারণে৷[৩৫]
এপ্রিল মাসে গভর্নর ইভান জেনকিন্স লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে একটি মুক্তপত্র লেখেন যে, পাঞ্জাব মুসলিম এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভাত্তিতে বিভাজন হবে কিন্তু সংলগ্ন তহশিল সংক্রান্ত বিষয়ে একমাত্র চুক্তির মাধ্যমেই সমন্বয় স্থাপন করা সম্ভব৷ তিনি পাঞ্জাব লোকসভাতে দুজন মুসলিম এবং দুজন অমুসলিম সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বাধিক নিখুঁত সীমানা কমিশন তৈরী করে বিচার বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ তিনি আরো প্রস্তাব দেন যে, উচ্চ আদালতের একজন ব্রিটিশ বিচারক যেন এই কমিশনের সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন৷[৩৬] জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ আলোচনা ও সভার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দুটি প্রদেশের বিভাজনকে আটকানোর চেষ্টা করে যান আবার অপরদিকে উপেক্ষিত শিখরা পূর্বের মাত্র ১২টি জেলা ভারতে সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তথা তারা মনে করেছিলো যে শিখদের পবিত্র গুরুদাসপুর হয়তো এই বিভাজনের ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে৷ এই আশঙ্কা পূর্ণতা পায় যখন ৩রা জুন বিভাজনের পরিকল্পনার প্রকল্পে ১২টি জেলা ভারতে ও ১৭টি জেলা পাকিস্তানের যুক্ত করার কথা লেখা হয় এবং চূড়ান্ত সীমান্ত নির্ধারন স্থির হয়৷ পরে তা পুণর্মূল্যায়নের মাধ্যমে গুরুদাসপুরকে ভারতে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ শিয়ালকোটের লেখকের দৃষ্টিতে এটা ছিলো শিখদের শান্ত করার প্রয়াস৷[৩৭]
মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে ভয় দেখান যে যদি তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগকে সমর্থন না করেন তবে পরিকল্পনা করে তিনি শিখদের পক্ষ নেবেন ও মুসলিমদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে এরকম একটি সীমানারেখা তৈরী করবেন৷[৩৮] পরবর্তীকালে সদস্য লর্ড ইসমায় বোঝান যে জিন্নাহকে ভয় না দেখিয়ে তার মানসিকতাকে আঘাত করলেও একইরকম ফল পাওয়া যেতে পারে৷ শেষমেশ তারা জিন্নাহর দাবী নাকচ করতে সক্ষম হন৷[৩৯] ২রা জুন জিন্নাহ আবার মাউন্টব্যাটেনের কাছে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ না করার প্রস্তাব দেন৷ কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন, "ইউ উড লুজ পাকিস্তান প্রব্যাবলি ফর গুড" (আপনি হয়তো এভাবে পাকিস্তানকে হারাতে চলেছেন)৷[২৮]
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারন করেছিলেন৷ কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে একটি অন্তর্বঙ্গ এবং আরেকটি অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে স্যার শেরিল র্যাডক্লিফকে নিয়োগ করেন৷[৪০]
প্রত্যাসন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নির্ণয় করে সেই ভিত্তিতে পাঞ্জাবের ভারতীয় খণ্ড ও পাকিস্তানি খণ্ড ন্যূনতম প্রতিরোধের সাথে নির্ধারন করার জন্য ভারতে কমিশন গঠন করা হয়েছিলো৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও এই কমিশন অন্যান্য বিষয়গুলোকেও বিবেচনার মধ্যে আনে৷[৪১] সামান্য কিছু বিচ্যুতি বাদ দিয়ে অন্যান্য ভিত্তিক বিষয়গুলো সুস্পষ্ট না হলেও র্যাডক্লিফ লাইনটি প্রাকৃতিক সীমানা, যোগাযোগ, জলসম্পদ ও সেচকার্যের ওপরেও নির্ভর ছিলো৷ এছাড়া কিছুক্ষেত্রে আর্থসামাজিক বিবেচনার মাধ্যমেও সীমানা ঠিক হয়৷[৫] প্রতি কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন৷ উভয়পক্ষের আগ্রহীদের অচলাবস্থায় বা তাদের হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় মাননীয় র্যাডক্লিফই অন্তিম সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই জুলাই মাসে একটি পক্ষপাতশূণ্য সীমানা নির্ধারণের জন্য র্যাডক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন৷[৪০] শীঘ্রই তিনি তার মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠী মাউন্টব্যাটেনের সাথে কমিশনের সদস্যদের সাথে দেখা করার জন্য লাহোর এবং কলকাতাতে এসে উপস্থিত হন৷ কমিশন সদস্যের মধ্যে মুখ্য দুজন ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের মুখ্য জওহরলাল নেহেরু মহাশয় ও মুসলিম লীগের সভাপতি জনাব মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ৷[৪২] তিনি এতো ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে এরকম বৃহত্তর সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে না চাইলেও সমস্ত দলীয় সদস্যরা তার কাছে ১৫ই আগস্টের পূর্বে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন৷ মাউন্টব্যাটেন এইসময়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ভাইসরয় পদে আসীন থাকতে রাজি ছিলেন[৪৩] পদ প্রত্যাহারের ঠিক দুদিন আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিলো কিন্তু রাজনৈতিক চাপানউতোর ও কুটনৈতিক কারণে স্বাধীনতার ঘোষণার দুদিন পর অর্থাৎ ১৭ই আগস্ট তারিখে চূড়ান্ত সীমানা ঘোষণা হয়৷[৪০]
প্রতি সীমানা নির্ধারণ কমিশনে চারজন করে প্রতিনিধি ছিলেন তাদের মধ্যে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও অপর দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন৷ এছাড়াও পঞ্চম ব্যক্তি হিসাবে উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্বয়ং র্যাডক্লিফ।[৪৪]
বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক সি.সি.বিশ্বাস এবং বিজন কুমার মুখার্জী এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক আবু সালেহ মুহাম্মদ আক্রম এবং শেখ আব্দুর রহমান।[৪৫]
পাঞ্জাবের সীমানা নির্ধারণ কমিশনে জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক তেজ সিং এবং মেহের চাঁদ মহাজন এবং মুসলিম লীগের তরফ থেকে ছিলেন বিচারক দীন মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ মুনীর।[৪৫]
বাইরে থেকে আনীত আইনজ্ঞ, র্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য মজুত থাকা ও অভিজ্ঞতা থাকার দরুন অতিরিক্ত কোনো সময় নষ্ট বা প্রতিনিধিদলের প্রয়োজন পড়েনি৷ সীমানা তৈরীর মতো তাদের কাছে কোনো দক্ষ প্রযোজক ও তথ্যপ্রযৌক্তিক ছিলো না৷ তাদের কোনো বিবেচক ও ছিলো না আবার কাজটি একদম নিঁখুতভাবে করার জন্য আঞ্চলিক তথ্য বা জরিপ করার সময়ও ছিলো না৷ দক্ষ অভিজ্ঞ মানুষ ও বিবেচকদের অভাব থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃত এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত সম্ভব নেওয়ার চেষ্টা করে৷[৪৬] ব্রিটেনের নতুন নির্বাচিত শ্রমজীবী সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি, ঋণের বোঝা ও তার টালবাহান সাম্রাজ্যের চাপ নিতে প্রস্তুত ছিলো না৷[৪৭] বাইরের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে ব্রিটিশরা তাদের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের ইতি ঘটাতে চান যেমন, তারা অন্যান্য অধিকৃত দেশের সাথে করেছিলো৷ একই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থেকে মুক্তি পায়, সেই পরিস্থিতির পুণরাবৃত্তি হয় ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও৷[৪৮]
নিশ্চুপ অবস্থা ত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগ উভয়ই সমান প্রতিনিধিত্ব করে গৃহীত সিদ্ধান্তের পক্ষপাতিত্ব প্রশমিত করতে থাকে৷ তাদের সম্পর্ক এতটাই উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে যে, বিচারকমন্ডলীও তাদের সাথে পৃথকভাবে আলোচনা করতে নাকচ করে দেয় এবং বিষয়সুচি এতটাই বিষম হয়ে ওঠে যে কোনো ছোট বিষয়ও বাদ যায়নি৷ বিষম পরিস্থিতি এতটাই বাজে হয়ে ওঠে যে স্বাধীনতার কিছু সপ্তাহ পূর্বে লাহোরে অবস্থানরত এক শিখ বিচারকের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হয়৷[৪৯]
কার্যত, বিপক্ষ দলের হিন্দু এবং মুসলিম সদস্য সংখ্যালোপ করার জন্য পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে৷ প্রসঙ্গত পরিস্থিতি এমন হয় যে, পাঞ্জাবে সীমানা কমিশনকে একটি শিখপ্রধান অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে ভাগ করতে হয়৷[৫০] লর্ড ইসলায় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন "প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের সহায়ক চমৎকার ভারতীয় সৈন্যদল"কে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কিন্তু তা ছিলো ব্রিটিশদের অন্যতম ঐতিহাসিক ভুল৷[৫১] যাইহোক, শিখ সৈন্যদল কোনোভাবেই তাদের সম্প্রদায় একটি মুসলিমপ্রধান দেশের জন্য যুদ্ধ করুক তা চায়নি, ফলে তারা ভারতে থাকতে চায়৷ উপরন্তু ভারতে যুক্ত না হলেও তাদের অনেকে আলাদা রাষ্ট্রের দাবী করেছিলো যা ব্রিটিশরা ও কমিশন কোনোভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি৷[৫২]
পরিশেষে, অন্যান্য সম্প্রদায়গুলোর ভাগ্য প্রতিনিধির অভাবে বাকী দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে৷ বাংলা সীমানা কমিশন প্রতিনিধিরা কলকাতা শহর কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে সেই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে৷ আবার উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের তরফ থেকে কমিশনে কোনো সদস্য ছিলো না৷ তারা ভারতভাগের দুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সমস্ত তথ্য থেকে রহিত ছিলো ফলে তারা কোনো সদস্যপদের আবেদনও করার সুযোগ পায়নি৷[৫৩]
এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেও সীমানা নির্ধারণ আশু প্রয়োজনীয় দেখে র্যাডক্লিফ নিজেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন৷ শুরুতে সবকিছু পর্যালোচনা করা অসম্ভব ছিলো কিন্তু র্যাডক্লিফ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং আবার নতুন করে বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে ভেবে এরপর কোনোপ্রকার পরিবর্তন করার কথা খারিজ করে দেন৷[১]
কার্যনিযুক্তির পূর্বে র্যাডক্লিফ কখনো ভারতে কার্যসুত্রে বা ভারত পরিদর্শনে আসেননি ফলে তিনি স্থানীয়দের কাছে যেমন অপরিচিত মুখ ছিলেন তেমনি তারও ভারত সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিলো না৷ ব্রিটিশদের এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কের পরেও পক্ষপাতহীনত্বই এই প্রকল্পের মূল সম্পদ ছিলো৷ ব্রিটেন ছাড়া অন্য যেকোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না এই শর্তেই তিনি নিযুক্ত হন৷[১] তার ব্যক্তিগত মুনশী ক্রিস্টোফার ব্যুমন্ট পাঞ্জাবের প্রশাসন ও জীবনশৈলীর সাথে পরিচিত ছিলেন৷ নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য র্যাডক্লিফ; ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথেও দূরত্ববজায় রাখতে থাকেন৷[৫]
দ্বন্দ্ব এড়িয়ে থাকা যাবে এরকম সীমানা নির্ধারণ করার মতো বিচক্ষণতা বা পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা কারোর পক্ষেই সম্ভব ছিলো না৷ পাঞ্জাব এবং বাংলায় আগেই হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশদের ভারত বিদায়কে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছিলো৷[৫৪] উপনিবেশ পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া কী ধরনের অসাম্প্রদায়িকতা ও হানাহানি হতে পারে তার আভাষ অর্ধশতাব্দী পূর্বেই উপ্ত হয়েছিলো৷ উপমাহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও করদ অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন ছিলো ফলে সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের হাতের শতাব্দীর দুঃখজনক এই বিভাজনের ঘটনা অনিবার্য হয়ে পড়ে৷[৫৫]
র্যাডক্লিফ স্বতঃসিদ্ধ সত্যতার সাথে নৈমিত্তিক বিভাজন করাকে ন্যায্য বলে ভেবেছিলেন যদিও তাতে বহুলোককে সাম্প্রদায়িকভাবে ভুক্তভোগী হতে হতো৷ র্যাডক্লিফ ভারত ছাড়ার আগে তার সমস্ত নথিপত্র বিনষ্ট করে দেন তাই এই যুক্তির পেছনে র্যাডক্লিফের চিন্তাভাবনা জানা যায় না৷[৫৬] সীমান্ত তৈরীর পরিকল্পনা সম্পন্ন করে তা লাগু হওয়ার আগেই তিনি নিজে থেকে ভারতের স্বাধীনতার দিন ভারত থেকে বিদায় নেন৷ র্যাডক্লিফের স্ব-উক্তিতে বলেন যে ভারতীয় জলবায়ু তার শরীর পক্ষে উপযুক্ত না৷ তার তাড়াতাড়ি ভারতত্যাগের এই কারণটিই তিনি জনসমক্ষে পেশ করেন৷[৫৭]
সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া যতটা দ্রুততার সাথে নেওয়া হয়েছিলো তার বাস্তবায়ন ও করা হয় সেরকমই দ্রুততার সাথে কোনো বিবেচনা ছাড়া৷ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট র্যাডক্লিফের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিন ১৬ই আগস্ট তারিখে বিকাল ৫টার সময় ঐ পরিকল্পনাটি ভারতীয় ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পড়ার জন্য দুঘণ্টা সময় দেওয়া হয়৷[৫৮]
মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৯ই এবং ১২ই আগস্ট-এর মধ্য পরিকল্পনা মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গেলেও তা স্বাধীনতার দুদিন পর আনা হয়, তার আগে নয়৷
রিড এবং ফিশারের মতে, কিছু পরিস্থিতিগত প্রমাণ এও পাওয়া যায় যে মাউন্টব্যাটেন বা রেডক্লিফের ভারতীয় সহকারী পারিষদের সদস্যরা ৯ বা ১০ই আগস্টে পাঞ্জাবের প্রদেশ বিভাজন ও তার রূপায়ণ সম্বন্ধ্যে সমস্ত গোপন তথ্য নেহেরু ও প্যাটেলকে ফাঁস করে দেয়৷[৫৯] এই গোপন সংবাদ কীভাবে প্রকাশ হলো সেই বিষয়ে চিন্তা না করে পরিবর্তনস্বরূপ শতদ্রু খালকে পাকিস্তানে না দিয়ে ভারতের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয় যা শতদ্রু নদীর পূর্বদিকের প্রাচীরের কাজ করবে বলে মনে করা হয়৷ এই অঞ্চলে পাঁচলক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার সাথে দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিল রয়ে যায়। এই পরিকল্পনা পরিবর্তনের দুটি কারণকে তুলে ধরা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলে একটি সেনাবলের অস্ত্রদপ্তর ছিলো এবং এটি ছিলো শতদ্রু খালের মুখ, যা সমগ্র বিকানের রাজ্যের জলপ্রাপ্তির অন্যতম উৎস৷ ভারতের মরু অঞ্চলগুলোতে এই সেচখালের মাধ্যমেই চাষাবাদ হতো৷
দেশ ভাগের পরে, ব্রিটিশ সরকার দেশত্যাগ করলে সীমানা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের ওপর পড়ে৷ আগস্ট মাসে লাহোর পরিদর্শনের পরে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আসন্ন দাঙ্গা আটকানোর জন্য শীঘ্রভাবে পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স (পাঞ্জাব সীমানারক্ষা বল) মোতায়েন করেন৷ কিন্তু ৫০,০০০ লোকবল যুক্ত এই সেনাদল ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড আটকানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিলো না৷ ৭৭% হত্যাকাণ্ডই হয়েছিলো পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলগুলোতে৷ প্রদেশটির আয়তনানুসারে লোকবল এতই কম ছিলো যে প্রতিবর্গমাইলেও একজন করে সেনা গোনা যেত না৷ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা ও দুর্ঘটনার শিকার হয় প্রচুর মানুষ বাস্তুহারা হয়ে দেশান্তরী হন, এই বিপুর পরিমাণ বিশৃঙ্খলা আটকানোর ক্ষমতা ঐ সামান্য সেনাবাহিনীর ছিলো না৷[৬০]
ভারত এবং পাকিস্তান কেউই চুক্তি ভাঙতে রাজি ছিলো৷ তারা নির্ধারিত সীমানার উভয়দিকের গ্রামগুলোতে আসন্ন বিদ্রোহর কথা মাথায় রেখে তা প্রশমনে তৎপর হয়, নয়তো এই বিষয়টির ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে উভয় দেশকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে ফলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পড়তে পারে৷ সীমানা বিতর্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছিলো এবং পরবর্তী কালে ১৯৯৯ তে কার্গিল যুদ্ধও ছিলো বিতর্কিত সীমানা কলহেরই ফল৷
র্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে দুইটি মুখ্য বিবাদ ছিল, বাংলার পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা। এ ছাড়া বাংলার মালদা, খুলনা এবং মুর্শিদাবাদ জেলার অংশে ও আসামের করিমগঞ্জে সামান্য বিবাদ হয়েছিল।
পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার মুসলিম প্রধান তহশিলগুলোর সাথে সাথে র্যাডক্লিফ অমৃৎসর জেলার মুসলিমপ্রধান অজনালা তহশিল, ফিরোজপুর জেলার মুসলিমপ্রধান জিরা ও ফিরোজপুর তহশিল, জলন্ধর জেলার মুসলিমপ্রধান জলন্ধর ও নাকোদার তহশিলকে পাকিস্তানের বদলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷[৬১]
লাহোর জেলা সামগ্রিকভাবে ৬৪.৫% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও লাহোর শহরটি মোটামুটিভাবে ৮০% হিন্দু এবং শিখদের বাসভূমি ছিলো৷[৬২] র্যাডক্লিফ তার মূল পরিকল্পনাতে লাহোর শহরটিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলেন৷[৬৩][৬৪][৬৫] সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বক্তব্য অনুসারে, "আমি লাহোর শহরকে প্রায় ভারতের মধ্যে যুক্ত করতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু দেখলাম যে পাকিস্তানে কোনো বড় শহর থাকছে না৷ আমি আগে থেকেই কলকাতাকে ভারতের জন্য স্থির করে রেখেছিলাম৷"[৬৩][৬৪] যখন র্যাডক্লিফ মহাশয়কে বলা করা হয়েছিলো যে, পাকিস্তানের মুসলিম সমাজ তার ভারতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য রুষ্ট হয়েছেন তখন তিনি বলেছিলেন যে, “তাদের উচিৎ আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা, কারণ নিয়ম মত লাহোর শহর ভারতে যুক্ত হওয়ার কথা, পাকিস্তানে নয়৷"[৬৪] কিন্তু এটা শুধুই এই যুক্তি ছিলো, কারণ ভারতে স্বাধীনতা অধিনিয়ম এবং ভারতভাগের ভিত্তি ছিলো ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, যেখানে লাহোরের ৮০% জমির মালিক অমুসলিমরা হলেও মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো৷[৬৬] ভূসম্পত্তির পরিমাপ দেশভাগের মাপকাঠি ছিলো না৷
বর্তমানে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এটা স্বীকার করেন যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ফিরোজপুর জেলাকে উপহার হিসাবে ভারতকে দিয়েছিলো, এই জেলার একাধিক তহশিল ছিলো মুসলিমপ্রধান৷[৬৭]
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পাঞ্জাব প্রদেশের সর্বোত্তরের জেলাটি ছিলো গুরুদাসপুর জেলা৷ জেলাটি তখন চারটি তহশিলে বিভক্ত ছিলো, সেগুলো হলো যথাক্রমে- উত্তরে শঙ্করগড় তহশিল, পাঠানকোট তহশিল এবং দক্ষিণে গুরুদাসপুর তহশিল ও বাতালা তহশিল৷ এই চারটি তহশিলের মধ্যে ইরাবতী নদী দিকে অন্য তহশিলের থেকে বিচ্ছিন্ন শঙ্করগড় তহশিলটি পাকিস্তানকে দেওয়া হয়৷ তহশিলটি পশ্চিম পাঞ্জাব প্রদেশের নারোওয়াল জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷[৬৯] গুরুদাসপুর, বাতালা ও পাঠানকোট তহশিল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যের অংশীভুত হয়৷ মুসলিম দের পাকিস্তানে গমন এবং হিন্দু ও শিখদের ভারতে আনয়নের মাধ্যমে এই জেলাটির জনবিন্যাস তহশিলগতভাবে পরিবর্তন করে জেলাটিকে দুটি অধিরাজ্যে ভাগ করা হয়েছিলো৷
ঐসময়ে গুরুদাসপুর জেলা সামগ্রিকভাবে ৫০.২% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো৷[৭০] ভারতীয় স্বাধীনতা আইনৈর রিপোর্ট অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাকে ৫১.১৪% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে দেখানোাহয়৷[৭১] ১৯০১ সালের জনগণনা অনুসারে গুরুদাসপুর জেলাতে ৪৯% মুসলিম, ৪০% হিন্দু এবং ১০% শিখ জনসংখ্যা ছিলো বলে জানা যায়৷[৭২] পাঠানকোট তহশিলটি হিন্দু প্রধান হলেও বাকী তিনটি তহশিল মুসলিম প্রধান ছিলো, যদিও একমাত্র শঙ্করগড় তহশিলটিই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়৷
র্যাডক্লিফ ব্যাখ্যা দেন যে, গুরুদাসপুর ছিলো শতদ্রু খালের মুখ যা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলের উৎস, তাই এই অঞ্চলটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ৷ তাছাড়া এই খালটি শিখদের পবিত্র অমৃৎসর নগরের নিকাশি ব্যবস্থার মূল ছিলো৷[৭১] লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সিদ্ধান্ত নেন যে গুরুদাসপুর জেলাটিও অমৃৎসর জেলার সাথে যেকোনো একটি অধিরাজ্যে যুক্ত হওয়া উচিৎ৷ পরে শিখদের ধর্মীয় স্থানের কথা চিন্তা করে তাকে ভারতে যুক্ত করার কথা ভাবেন৷[৭১] তিন আরো বলেন যে, অমৃৎসর থেকে পাঠানকোট অবধি রেল সংযোগটি বাতালা ও গুরুদাসপুর তহশিলের ওপর দিয়েই বিস্তৃত৷[৭৩]
পাকিস্তানিরা মনে করেন যে, গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিলকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে দিয়েছিলেন সহজপথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে জম্মুতে পৌঁছানোর জন্য৷[৭০] আবার শিরীণ ইলাহি দেখান যে ভারতে অন্যান্য জায়গা থেকে সহজে কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য পাঠানকোট তহশিলই ব্যবহার করা হতো, যা শুরু থেকেই একটি হিন্দু প্রধান তহশিল ছিলো৷ গুরুদাসপুর এবং বাতালা তহশিলকে ভারতে যুক্ত করার সাথে কাশ্মীরের কোনো যোগাযোগ নেই৷[৭৪]
পাকিস্তান শুরু থেকেই ভেবে আসছিল যে গুরুদাসপুর জেলাকে ভারতে দেওয়াই হয়েছিলো কাশ্মীরের সাথে যোগাযোগ সহজ করার জন্য৷[৭৫] জাতীয় তথ্যানুসারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য গুরুদাসপুর জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার জন্য সাক্ষর করে৷[৭৬] ১৪ থেকে ১৭ই আগস্টের মধ্যে মুস্তাক আহমেদ চীমা পাকিস্তানের হয়ে গুরুদাসপুরে ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হন কিন্তু পরে এর অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি সেই পদ ত্যাগ করে পাকিস্তানে ফেরত চলে যান৷[৭৭] ভারত বিভাজন ও ভারতের স্বাধীনতা অধিনিয়ম অনুসারে যেহেতু গুরুদাসপুর জেলা ছিলো একটি মুসলিম প্রধান জেলা তাই তারা ভেবেছিলো নির্দ্বিধায় এই জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হবে৷ কিন্তু কাশ্মীরে ভারতের হস্তক্ষেপ বাড়াতে গুরুদাসপুরকে ভারতের সাথে যুক্ত করা হয়৷[৭৮] এটা ধীরে ধীরে পাকিস্তানের একটি চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷ জিন্নাহ এবং পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এই বিভাজনকে সরাসরি অনৈতিক এবং ভুল সিদ্ধান্ত বলে দাবী করেন৷[৭৯]
মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান সীমানা নির্ধারণ কমিশন পেশ হওয়ার পূর্বেই মুসলিম লীগকে সতর্ক করেছিলেন যে এই আনীত কমিশনটি প্রহসন ছাড়া কিছুই না৷ তার মতে মাউন্টব্যাটেন ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি আগে থেকেই হয়ে গিয়েছিলো৷[৮০] সীমানা কমিশনের এক অমুসলিম সদস্য মেহের চাঁদ মহাজন তার নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে ভারত ভাগের সমস্ত সূক্ষ্ম পরিকল্পনা লর্ড মাউন্টব্যাটেন আগে থেকেই করেছিলেন এবং তিনি সহ অন্যান্য অমুসলিম সদস্যরা ছিলেন লোক দেখানোর জন্য একটি পুত্তলিকাস্বরূপ মাত্র৷[৮১] শুধুই ব্রিটিশদের চাপে পড়ে শেষ মুহূর্তে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে র্যাডক্লিফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গে সরকারীভাবে র্যাডক্লিফ জাতিপুঞ্জের কাছে পাকিস্তানের দাবীকে কখনো তুলে ধরতে দেননি৷[৮২]
জাফরুল্লাহ খান মহাশয় আরো বলেন যে, শুধু গুরুদাসপুর নয় ফিরোজপুর জেলার ফিরোজপুর ও জিরো তহশিল, জলন্ধর জেলার জলন্ধর ও রহোন তহশিল হুশিয়ারপুর জেলার দাসুয়া তহশিলগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও সেগুলো পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি৷ এই তহশিলগুলো পাকিস্তানকে দেওয়া হলে পাঞ্জাবের কাপুরথালা জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তহশিলগুলোও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যেত৷ আবার অমৃৎসরের অজনালা তহশিলও ছিলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ পাকিস্তানকে গুরুদাসপুর জেলার গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিলটি দেওয়াও যুক্তিযুক্ত ছিলো৷ যদি সত্যিই সঠিক নিয়মে বিভাজন করা হতো তবে নির্ধারিত ১৬টি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলা ও গুরুদাসপুর জেলা ছাড়াও উপর্যুক্ত তহশিলগুলো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো, যার ফলে কাংড়া জেলাটি হতো ভারতের দিকে ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত৷ এই সমস্ত অঞ্চলের একটি বৃহত্তর অঞ্চল পাকিস্তানে দিলে পাকিস্তান লাভবান হতে পারতো এবং এক্ষত্রে তহশিলগুলো দেশভাগের গুরুত্বপূর্ণ একক হিসাবে কাজ করতো৷[৭৬] কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত শঙ্করগড় তহশিল বাদে কোনো মুসলিমপ্রধান তহশিলই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে ভারতে দিয়ে দেওয়া হয় উপরন্তু পাকিস্তান এর বদলে পাঞ্জাবের কোনো অমুসলিম প্রধান তহশিল পায় না৷[৬১] তার মতে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাবকে জেলা, তহশিল, থানা এমনকি গ্রাম হিসাবে ভাগ করেও ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন, যা ছিলো পাকিস্তানের পক্ষে খুবই অনিষ্টকর৷[৭৬]
জাফরুল্লাহ খানের মতে, গুরুদাসপুর জেলার সদর ও বাতালা তহশিল যে কাশ্মীরকে সুগম্য করার ফন্দি নয় তা মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য৷ যদি গুরুদাসপুর ও বাতালা তহশিল পাকিস্তানকে দিয়ে দেওয়া হতো তবে পাঠানকোট তহশিলটি পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো এবং পাকিস্তান বেষ্টিত হয়ে যেতো৷ যদিও হুশিয়ারপুরের মাধ্যমে পাঠানকোটে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হতো কিন্তু রেল, সতু ও সড়ক নির্মানে সময় লাগতো অনেক কারণ সৈন্যবলের জন্য এই স্থানটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো৷[৭৮]
স্ট্যানলি ওয়লপার্ট তার একটি বইতে লিখেছিলেন যে প্রাথমিক ভাবে রেডক্লিফ গুরুদাসপুর জেলার তিনটি তহশিল ভারতকে উপহার হিসাবে তুলে দেন কিন্তু নেহেরু এবং তার শ্রদ্ধাভাজন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিশ্চিত করেন যেন এই জেলাটিকে কোনোভাবেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না করে দেওয়া হয় কারণ এটা ছিলো পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীরের যাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ৷[৮৩] ইসলামিক বিভিন্ন মতবাদের ওপর ভিত্তি করে ইউনেস্কোর একটি সদস্যদল অতিসম্প্রতিকালে ব্রিটিশ শাসনকালের জটিলতা, ভারত বিভাজনের আইন এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিতে ভারত এবং ভারতের উচ্চদলগুলোর অবদান সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ উন্মোচন করেন৷ তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন জাতীয় কংগ্রেসের নেহেরুর সাথে হাত মিলিয়ে র্যাডক্লিফকে বাধ্য করেন যেন তিনি ভারতকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গুরুদাসপুর জেলা ও অন্যান্য তহশিলগুলো উপহার দেন৷ এর ফলে কাশ্মীরের দখল নিতেও ভারতকে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না৷[৮৪] ঐতিহাসিক অ্যান্ড্রিউ রবার্টস বিশ্বাস করেন যে, মাউন্টব্যাটেন ভারত পাকিস্তান সীমানাচুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন[৮৫] এবং ফিরোজপুর জেলার বহু নথিপত্র জাল করা হয়েছিলো এবং গুরুদাসপুরের ক্ষেত্রে তিনিই যে কাশ্মীরকে ভারতে রাখার জন্য র্যাডক্লিফ বাধ্য করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷[৮৬][৮৭][৮৮]
পেরি অ্যান্ডারসনের মতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন সরকারীভাবে কোনোরকম পরীক্ষা বা সমীক্ষা এবং কোনো ভবিষ্যৎ বিবেচনা করেননি এবং তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে নেহেরুর পরিকল্পিত পথে চলেছিলেন এবং তার শ্রমলাঘব করার জন্য তিনি তাকে উপহারস্বরূপ উক্ত তহশিলগুলো দেন৷ তিনিই র্যাডক্লিফের ওপর গুরুদাসপুর জেলা বিষয়ে অনধিকার চর্চা করেন ফলে ভারত দিল্লি থেকে কাশ্মীর অবধি বিনা বাধায় সড়ক যোগাযোগের পথ পেয়ে যায়৷[৮৯]
আবার কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে কাশ্মীর ছিলো একটি করদ রাজতান্ত্রিক রাজ্য, কারো সম্পত্তি নয়,[৯০] ফলে কাশ্মীরের সাথে দিল্লির যোগসাধনের জন্য গুরুদাসপুরের ভারতভুক্তির কথা মেনে নেওয়া যায় না৷ পাকিস্তানের নেতা তথা মুসলিম লীগই এই গুরুদাসপুর জেলার গুরুত্ব না বুঝতে পেরে শুরু শঙ্করগড় তহশিল নিয়েই খুশি ছিলো৷ যতক্ষন না ভারতীয় সৈন্য কাশ্মীরে প্রবেশ করে ততক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান এই জেলার গুরুত্ব বুঝতে অপারক ছিলো৷[৯১] র্যাডক্লিফ এবং মাউন্টব্যাটেন উভয়ই এইধরনের দোষারোপকে অস্বীকার করন৷ মাউন্টব্যাটেনের খসড়াসম্বন্ধীয় বিষয়ে ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার ও সংগ্রহালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাশ্মীরের ভারতে যুক্ত হওয়াকে ঐ অঞ্চলের মুসলিমদের জন্য একটি দুঃখজনক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়৷[৯২]
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিলো একটি অতি অমুসলিমপ্রবণ অঞ্চল যার ৯৭% ই ছিলো অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে একটি সিংহভাগ মানুষই ছিলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী৷ তা’সত্ত্বেও এটিকে পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়৷ চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্ট পিপলস' এসোসিয়েশন বাংলায় সীমানা নির্ধারণকারী কমিশনের কাছে আবেদন করেন যে, যেহেতু এই অঞ্চলটি অতি অমুসলিমপ্রবণ তাই তারা ভারতেই থাকতে চায়৷ যেহেতু তাদের কোনো সরকারী প্রতিনিধিত্ব ছিলো না তাই সরকারীভাবে এই বিষয় নিয়ে সেরকম কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি৷ এবং ভারতের অনেকে ভেবেছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ত ভারতকেই দেওয়া হবে৷
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট তারিখ অবধি তারা জানতো না যে তারা কোন দেশের অংশ হবে৷ ১৭ই আগস্টের র্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফল হিসাবে দেখা যায় এটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ পাকিস্তানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দেওয়ার যুক্তি হিসাবে দেখানো হয় যে, তারা ভারতে অনধিগম্য এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরাঞ্চলকে গ্রামাঞ্চলিক সাহায্য ও কর্ণফুলী নদীর নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জরুরি৷ ফলে প্রায় জোর করেই এই অঞ্চলকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়৷
দুদিন পরে, তারা পাকিস্তানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও ভারতের পতাকা উত্তোলন করে৷ পাকিস্তানি সৈন্যদল বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসে এবং অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তারা পাকিস্তানের অপসারণ দাবী করে৷[৯৪]
র্যাডক্লিফের দ্বারা নেওয়া আরেকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিলো বাংলার মালদহ জেলাকে ঘিরে৷ জেলাটি সার্বিকভাবে সামান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো কিন্তু জেলাটি বিভাজন কালে অধিকাংশ অঞ্চলই ভারতকে দেওয়া হয়৷ তার মধ্যে ছিলো মুসলিমপ্রধান চাঁচল মহকুমা এবং সদরশহর মালদা৷ ১৫ই আগস্টের পর প্রায় তিন-চার দিন অবধি এখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিলো কিন্তু পরে পরিকল্পনা জনসমক্ষে এলে স্থানীয়রাই মালদায় পাকিস্তানের বদলে ভারতীয় পতাকার স্থান দেন৷
পূর্বতন অবিভক্ত খুলনা জেলা ছিলো সামান্য হিন্দু প্রধান জেলা (৫২%), যার খুলনা মহকুমা বাদে বাকী মহকুমা দুটি মুসলিমপ্রধান ছিলো৷ তা’সত্ত্বেও জেলাটিকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ এবং এর ফলস্বরূপ ৭০% মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ ১৭ই আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা ভারতের পতাকা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার আগে অবধি মুর্শিদাবাদে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরুন পাকিস্তানের পতাকাই উত্তোলিত হয়েছিলো৷[৯৫] মুর্শিদাবাদকে ভারতে যুক্ত করে হিন্দুপ্রধান খুলনাকে পাকিস্তানে দেওয়া ছিলো একটি শর্তমাত্র৷ কারণ কলকাতা বন্দর যে হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত তা এই মুর্শিদাবাদেই গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে, ফলে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে থাকলে রাজধানী শহর কলকাতা ও কলকাতা বন্দর সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তো৷
সিলেট গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা আসাম থেকে পাকিস্তানে যোগ দেয়৷[৯৬] কিন্তু সিলেটেরই করিমগঞ্জ মহকুমাটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি জেলার মর্যাদা পায়৷ মনে করা হয় ত্রিপুরার সাথে ভারতের মূল ভুখণ্ডের যোগাযোগ বৃদ্ধি ও সহজ পথে আসাম থেকে ত্রিপুরাতে আসা-যাওয়ার সিলেট থেকে করিমগঞ্জ মহকুমাটি সাড়ে তিনটি থানসহ পৃথক করা হয়েছিলো৷ ২০০১ সালে জনগণনা অনুসারে করিমগঞ্জ জেলার ৫২.৩% জনগণ ধর্মে মুসলিম৷[৯৭]
ভারতের বিভাজন হলো ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মূল কেন্দ্রীয় ঘটনাগুলোর একটি এবং একটি যুক্ত ইতিহাসের স্মৃতি৷ এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হাওয়ার্ড ব্রেন্টন ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটি রচনা করেছিলেন৷ তিনি র্যাডক্লিফের ভারত ভ্রমণকালে সীমা নির্ধারণ রেখা তৈরী এবং বাঁচার তাগিদে দেশান্তরী হওয়া ও শতকষ্টে থাকা এই মানুষদের জীবনকাহিনী নিয়ে কিঞ্চিত উৎসাহিত হয়েছিলেন, যা তার নাটকে ফুটে উঠেছে৷[৯৮]
দেশভাগের চূড়ান্ত নিয়ন্তা হিসাবে র্যাডক্লিফ লাইনের প্রস্তাব, তার বাস্তবায়ন এবং তার দীর্ঘমেয়াদী ফলস্রুতি বিভিন্ন লেখকদের অনুপ্রাণিত করে৷ অনেকে এবিষয়ে কখনো বই বা কখনো নাটক উপস্থাপন করেন, অনেকে এই ঘটনার শৈল্পিক চিত্রায়ন করে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছিলেন৷ এই বিষয়ে স্মৃতি রক্ষা করে গল্প বা নাটকের পুণর্মূল্যায়ন করে উপস্থাপন করা ব্যক্তিত্বে সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা৷
ড্রয়িং দ্য লাইন নাটকটিতে লেখক র্যাডক্লিফকে একটি গূরুত্বপূর্ণ আসনে বসিয়েছিলেন৷ একটি জনসভাতে তিনি বলেছিলেন যে, র্যাডক্লিফকে ঐসময়ে খুব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, "তিনি আয়হীনভাবে মানচিত্র এবং সমস্ত নথিপত্র তার ইংল্যান্ডের বাড়িতে নষ্ট করে দিয়েছিলেন৷ তিনি তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই পরিবারের সদস্যদের জানাতে চান নি৷ আমি এই তথ্যগুলো ঘাটার সময়ে এগুলোই আমাকে এই নাটক লেখার জন্য ধাবিয়ে তোলে"[৯৮]
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রাম মাধবানী একটি নয় মিনিটের ছোট চলচ্চিত্র তৈরী করেন যেখানে তিনি রেডক্লিফের সীমা নির্ণয়কিলীন একটি বিশ্বাসযোগ্য চিত্রপট তুলে ধরেন৷ চলচ্চিত্রটি দেশবিভাগ সম্বন্ধীয় ডব্লিউ. এইচ. অড্যান এর একটি কবিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরী৷[৯৯][১০০]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.