Loading AI tools
ছিটমহল বিনিময় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশ-ভারত-ছিটমহল,[1][2][3][4] শুধু ছিটমহল নামেও পরিচিত এবং কখনও কখনও পাশা ছিটমহল নামেও পরিচিত,[5] ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর ছিটমহল, যা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যসমূহে অবস্থিত ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ভারতীয় ভূখণ্ডের ১০৩টি ছিটমহল, যার মধ্যে ২১টি বাংলাদেশী কাউন্টার ছিটমহল ছিল, যার মধ্যে একটিতে ছিল ভারতীয় কাউন্টার ছিটমহল- বিশ্বের একমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর ছিটমহল। ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে ৭১টি বাংলাদেশী ছিটমহল ছিল, যার মধ্যে ৩টি ভারতীয় কাউন্টার ছিটমহল ছিল। ২০১০ সালের একটি যৌথ আদমশুমারিতে দেখা গেছে, এই ছিটমহলগুলোতে ৫১,৫৪৯ জন লোক বাস করে: বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলেে ৩৭,৩৩৪ জন এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশী ছিটমহলেে ১৪,২১৫ জন।[6][3]
এই নিবন্ধটি মেয়াদোত্তীর্ণ। |
২০১৫ সালের ০১ আগস্টের পূর্বে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সর্বমোট ১৬২ টি ছিটমহল ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা ১৯৭৪ সালে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন ছিটমহল বিনিময় এবং তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সরলীকরণের জন্য। ৭ মে, ২০১৫ তারিখে ভারতের সংসদ ভারতের সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী পাস করার সময় দুই দেশ এই চুক্তির একটি সংশোধিত সংস্করণ গ্রহণ করে।[7][8] এই চুক্তির অধীনে ২০১৫ সালের ৬ জুন অনুমোদিত এই চুক্তির আওতায় ভারত ভারতের মূল ভূখণ্ডে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল (৭,১১০ একর (২,৮৮০ হেক্টর) লাভ করে, অন্যদিকে বাংলাদেশ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল (১৭,১৬০ একর (৬,৯৪০ হেক্টর) লাভ করে।[9] ছিটমহলের বাসিন্দাদের হয় তাদের বর্তমান অবস্থানে বসবাস চালিয়ে যেতে অথবা তাদের পছন্দের দেশে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।[10] ছিটমহল বিনিময় ৩১ জুলাই ২০১৫ থেকে ৩০ জুন ২০১৬ মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল।[11] ০১ আগস্ট রাত ১২:০১ মিনিটে দুই দেশ ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা নিজেদের ছিটমহলগুলো পরস্পরের সাথে বিনিময় করে এবং ছিটমহল বাসিন্দাদের স্থানান্তর ৩০ নভেম্বর ২০১৫ সম্পন্ন হয়। স্থল সীমান্ত চুক্তির পর ভারত বাংলাদেশের কাছে প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটার (১৫ বর্গ মাইল) হারায়।[12][13]
বিনিময়ের সময় উল্লেখযোগ্য ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল যেটি বাংলাদেশেই থেকে যায়। এছাড়া, ভারতের একটি 'থার্ড-অর্ডার' ছিটমহল 'দাহালা খাগড়াবাড়ি' বাংলাদেশ এর পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এই ছিটমহলটি বাংলাদেশী গ্রাম 'উপানচৌকি ভজনী #১১০' দ্বারা পরিবেষ্টিত; যা আবার ভারতীয় ছিটমহল'বালাপাড়া খাগড়াবাড়ি' গ্রাম দ্বারা বেষ্টিত। এ বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ এবং নাগরিকত্বহীনতা থেকে মুক্তি পান এ ১৬২ টি ছিটমহলের অধিবাসীরা। মূলত, এই সঙ্কট তৈরি হয় অখণ্ড ভারত খণ্ড করার সময়েই। গোড়ায় গলদটা রেখে যান ব্রিটিশ সিরিল রেডক্লিফ। তিনিই পাকিস্তান-ভারত সীমানা নির্ধারণ করেন। সেই সঙ্গে সৃষ্টি করেন এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার।[14]
অঞ্চল বিনিময়এর পর থেকে, একমাত্র অবশিষ্ট ছিটমহল হচ্ছে বাংলাদেশের দহগ্রাম ইউনিয়ন বা দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতা।[15][16]
অখণ্ড ভারত বিভক্ত করে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লগ্নে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে র্যাডক্লিফ মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। এতে এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয় । ১৬২ টি ছিটমহল ছিল দুই প্রতিবেশী দেশে। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতের অভ্যন্তরে। এসব ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫১ হাজার। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার।২৪ হাজার ২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দুই দেশের ছিটমহল ছিল। তার মধ্যে ভারতের জমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৫৮ একর। বাংলাদেশের ছিটমহলের জমির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ১১০ একর।[17] ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯ টি, পঞ্চগড়ে ৩৬ টি, কুড়িগ্রামে ১২ টি ও নীলফামারিতে ৪ টি ভারতীয় ছিটমহল ছিল। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার ও ৪ টি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত ছিল।
একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, ছিটমহলগুলি শতাব্দী আগে দুই আঞ্চলিক রাজা, কোচ বিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজার মধ্যে তাস বা দাবা খেলায় অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হত।[3] ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, ছোট অঞ্চল দৃশ্যত কোচবিহার রাজ্য এবং মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে ১৭১৩ সালের চুক্তির একটি বিভ্রান্তিকর ফলাফল ছিল। সম্ভবত, রাজ্য এবং মুঘলরা কোন অঞ্চল লাভ বা হারিয়ে যাওয়া কোন সীমানা নির্ধারণ না করে যুদ্ধ শেষ করে।[18] ফলে কোচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কোচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই ছিল ছিটমহল।[19]
১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কোনো রকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তরাধিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির পর এই সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছে দুই দেশ।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর রংপুর পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেয়। কোচবিহার রাজ্য, তার ছিটমহল নিয়ে, একটি দেশীয় রাজ্য ছিল, যার রাজার হয় ভারত বা পাকিস্তানে যোগদানের সুযোগ ছিল। কোচবিহার জেলা ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে একত্রিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে জওহরলাল নেহেরু এবং ফিরোজ খান নুনের মধ্যে একটি চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের ইচ্ছা প্রকাশ পায়। কিন্তু এরপর বিষয়টি ভারতে সর্বোচ্চ আদালতের একটি মামলায় কাজ করে, এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় দেয় যে জমি হস্তান্তরের জন্য একটি সাংবিধানিক সংশোধনী প্রয়োজন। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে সুবিধার্থে নবম সংশোধনী প্রবর্তন করা হয়। দক্ষিণ বেরুবাড়ি ছিটমহল স্থানান্তরের আপত্তির কারণে এই সংশোধনী পাস করা যায়নি।[3][20] চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[21] এই চুক্তির অধীনে ভারত বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ ছিটমহল টিকিয়ে রাখে এবং বাংলাদেশ দহগ্রাম- আঙ্গোরপোতা ভারতের সাথে ১৭৮ বাই-৮৫ মিটার (৫৮৪ ফুট × ২৭৯ ফুট) করিডোর প্রদান করে, যাকে বলা হয় তিন বিঘা করিডোর। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে দ্রুত এই চুক্তি অনুমোদন করে কিন্তু ভারত তা করতে ব্যর্থ হয়। পশ্চিমবঙ্গের দাইখাতা-৫৬, ত্রিপুরার মুহুরি নদী-বেলোনিয়া এবং আসামের লতিলা-দুমাবাড়ি তিনটি সেক্টরে প্রায় ৬.১ কিলোমিটার (৩.৮ মাইল) ভূমি সীমানার বিষয়টিও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। স্থানীয়দের বিরোধী সত্ত্বেও ১৯৯২ সালে তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে লিজ দেওয়া হয়।[3]
ছিটমহলের তালিকা ১৯৯৭ সালে দুই দেশ দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। ২০০১ সালে ছিটমহলের তথ্য বিস্তারিত জানার জন্য দুটি যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। মে ২০০৭ সালে একটি যৌথ আদমশুমারি সম্পন্ন করা হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত বাংলাদেশের সাথে ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য অতিরিক্ত প্রোটোকল স্বাক্ষর করে।[22] উভয় দেশ ১৬২টি ছিটমহল অদলবদল করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছে, যাতে বাসিন্দাদের জাতীয়তা পছন্দ সুযোগ রয়েছে।[23][24][25]
১৯৫৮ সালে সই হওয়া নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩ সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়।
ভারতীয়-বাংলাদেশ ছিটমহল গুলির মধ্যে এটি অন্যতম।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.