Loading AI tools
সাতবাঽন সাম্রাজ্যে মুদ্রা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে বিদ্যমান।[1] আধুনিক কালে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন ক্ষেত্রে, যথা, গাড়ি প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, মহাকাশ, মেরু ও আণবিক প্রযুক্তিতে ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পরিচয় দিয়েছে।
খৃঃ পূঃ ৫৫০০ সালের সময় মেহেরগড়ের মত আরও বসতি গড়ে উঠছিল, যা পরে ক্যালকোলিথিক সংস্কৃতির পূর্বসুরি ছিল।[2] এই অঞ্চলের অধিবাসীদের পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।[2]
৪৫০০ খৃ: পূ: সালে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা সেচের উদ্ভাবন করে।[3] এই উদ্ভাবনার ফলে অনেক পরিকল্পিত বসতি গড়ে ওঠে যেখানে পয়ঃপ্রণালী ছিল। ফলে সিন্ধু সভ্যতার ব্যপ্তি ও সমৃদ্ধি বেড়ে গিয়েছিল, যা পরবর্তী পর্যায়ে নিকাশি ও পয়ঃপ্রণালীর ব্যবহার করে আরও পরিকল্পিত বসতি স্থাপন করতে সাহায্য করে।[3] ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরী করা গিরনারের কৃত্রিম জলাধার গুলি এবং ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সেচখাল ব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার পরিশীলিত সেচ ও জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার উজ্জ্বল নিদর্শন।[4] খৃষ্টপূর্বাব্দ ৫ম-৪র্থ শহস্রাব্দেই এই অঞ্চলে তুলা চাষ প্রচলিত ছিল।[5] আখ মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফসল।[6] তবে আখের বিভিন্ন প্রজাতি সম্ভবত বিভিন্ন স্থানে উদ্ভূত হয়েছে; যেমন এস. বারবেরি (S. barberi) ভারতে, এবং এস. এডুল (S. edule) ও এস. অফিসিনারুম(S. officinarum) এসেছে নিউ গিনি থেকে।[6]
সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরা ওজন ও পরিমাপের ব্যবহারে প্রমিতিকরণের একটি পদ্ধতি গড়ে তোলেন, যা সিন্ধু উপত্যকায় বিভিন্ন খনন থেকে সুস্পষ্ট।[7] এই প্রযুক্তিগত মানক থাকায় পরিমাপের যন্ত্রগুলি কৌনিক পরিমাপ ও নির্মাণের পরিমাপে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছিল।[7] কিছু যন্ত্রের ক্ষেত্রে একাধিক উপবিভাগের পাশাপাশি পরিমাপের যন্ত্রে ক্রমাঙ্কনও পাওয়া যায়।[7] এই অঞ্চলের প্রাচীনতম বন্দরগুলির মধ্যে একটি লোথালে (খৃঃপূঃ ২৪০০) এমনভাবে মূল স্রোতের থেকে দূরে তৈরী করা হয়েছিল যাতে বন্দরে পলি জমা এড়ানো যায়।[8] আধুনিক সমুদ্রবিজ্ঞানীদের মতে হরপ্পা অধিবাসীদের নিশ্চয়ই জোয়ার-ভাঁটা, জললেখচিত্রবিদ্যা ও সামুদ্রিক প্রকৌশল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ছিল। না হলে, নিয়ত-পরিবর্তনশীল সবরমতি নদীখাতে এরকম বন্দর নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না।[8]
অধুনা পাকিস্তানের বালাকোটের উৎখনন থেকে সেখানে চুল্লীর (খৃঃপূঃ ২৫০০-১৯০০) উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।[9] সম্ভবতঃ চীনামাটির সামগ্রী প্রস্তুত করতে এই চুল্লীর ব্যবহার হত।[9] সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্য্যায়ের (খৃঃ পূঃ ২৫০০-১৯০০) রান্নার উনুনও এই বালাকোটেই পাওয়া গেছে।[9] এছাড়াও কালিবঙ্গা প্রত্নতাত্তিক স্থলে অনেক পাত্র আকৃতির রান্নার চুলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা মাটির উপরে ও নিচে উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।[10] কালিবঙ্গাতে ভাটিখানারও সন্ধান পাওয়া গেছে।[10]
প্রত্নতাত্তিক ও পাঠ্য প্রমাণের ভিত্তিতে, আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক জোসেফ ই. স্বোয়ার্টজবার্গের (২০০৮) মতে, ভারতে মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যার জন্ম হয় খৃঃ পূঃ ২৫০০-১৯০০ সময়কালে সিন্ধুসভ্যতার হাত ধরে।[12] বৈদিক যুগের (খৃঃ পূঃ ২য় - ১ম সহস্রাব্দ) ভারতে বৃহদাকার নির্মাণ পরিকল্পনা, মহাকাশবিদ্যা সংক্রান্ত অঙ্কণ, এবং মানচিত্রনির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার প্রচলিত ছিল।[12] অধিকাংশ প্রমাণ জলবায়ুর কারণে ধ্বংশ হয়ে গেছে, তবুও, উৎখননের থেকে পাওয়া অনেক জরীপের যন্ত্র ও পরিমাপ দন্ড প্রাচীনকালে মানচিত্র নির্মান সংক্রান্ত কার্যকলাপ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে প্রমাণ করেছে।[13] স্বোয়ার্টজবার্গ (২০০৮)—টিকে থাকা মানচিত্রের বিষয়ে—আরও বলেছেন: 'যদিও অসংখ্য নয়, প্রস্তর যুগের হাজার হাজার ভারতীয় গুহা চিত্রগুলির মধ্যে মানচিত্রের মতো নক্সা উপস্থিত রয়েছে; এবং অন্তত একটি জটিল মেসোলিথিক চিত্রকে মহাবিশ্বের প্রতিকৃতি বলে মনে করা হয়।'[14]
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় সিন্ধু সভ্যতার সময়ে (খৃঃ পূঃ ২৫০০) পশু-কর্ষিত হালের ব্যবহার ছিল।[15] হরপ্পা অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত তামার সবচেয়ে প্রাচীন তরোয়ালটি খৃঃ পূঃ ২৩০০ সময়কালের।[16] ভারতের গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে ব্রোঞ্জের তরোয়াল পাওয়া গেলেও তামার তরোয়ালই বেশি পাওয়া গেছে।[16]
বৈদিক যুগের বিভিন্ন লেখা থেকে বৃহৎ সংখ্যা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া।[20] যজুর্বেদসংহিতার (খৃঃ পূঃ ১২০০-৯০০) সময় থেকেই ১০১২ মত বড় সংখ্যার উল্লেখ বিভিন্ন লেখায় পাওয়া যেতে শুরু করে।[20] যেমন, অশ্বমেধ যজ্ঞে অন্নহোমের শেষে সূর্য্যোদয়ের সময়ে যে মন্ত্রোচ্চারণ করা হত তাতে দশের শত গুণ থেকে দশ সহস্রের ত্রিঘাত গুণ পর্য্যন্ত শক্তির উন্মেষ হত।[20] খৃঃ পূঃ ৯ম শতাব্দীর শতপথ ব্রাহ্মণে সুলবা সূত্রের মত কিছু ধর্মীয় জ্যামিতিক গঠনের নিয়মাবলী পাওয়া যায়।[21]
খৃঃ পূঃ ৮ম শতাব্দীতে বৌধায়ন বৌধায়ন সুলবা সূত্রের সৃষ্টি করেন। এই সূত্রে সাধারণ পিথাগোরীয় সংখ্যাত্রয়ের উদাহরণ পাওয়া যায়, যেমন, (৩, ৪, ৫), (৫, ১২, ১৩), (৮, ১৫, ১৭), (৭, ২৪, ২৫), এবং (১২, ৩৫, ৩৭)।[22] শুধু তাই নয় বর্গক্ষেত্রের বাহু বিষয়ক পিথাগোরাসের উপপাদ্যের একটি বক্তব্যও পাওয়া যায়: "বর্গক্ষেত্রের কর্ণ বরাবর কোনো দড়ি টানলে সেই দড়িকে বাহু ধরে যে বর্গক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে সেটির ক্ষেত্রফল পূর্বের বর্গক্ষেত্রের দ্বিগুণ হবে।"[22] সুলবা সূত্রে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের আয়তক্ষেত্রের বাহু বিষয়ক বক্তব্যও পাওয়া যায়: "আয়তক্ষেত্রের কর্ণ বরাবর কোনো দড়ি টানলে সেই দড়িকে বাহু ধরে যে বর্গক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে সেটির ক্ষেত্রফল আয়তক্ষেত্রের উল্লম্ব ও অনুভূমিক বাহু থেকে উদ্ভূত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান।"[22] বৌধায়ন দুই-এর বর্গমূলের সূত্রও দিয়েছেন সুলবা সূত্রে।[23] এই সময় মেসোপটেমিয়ার প্রভাব ছিল বলে মনে করা হয়।[24]
প্রাচীনতম ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত পুঁথি খৃঃ পূঃ ১৪০০-১২০০ সময়কালে লাগাধ বিরচিত বেদাঙ্গ জ্যোতিষকে মনে করা হয় বিশ্বের প্রাচীনতম জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ।[25] এতে বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় কাজের সময় নির্ধারণের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা ব্যবহারের বর্ণনা আছে। এতে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত গণনা, পঞ্জিকা প্রণয়ন এবং গবেযণামূলক পর্যবেক্ষণের নিয়মগুলিও বিশদে বলা আছে।[26] যদিও বেদাঙ্গ জ্যোতিষ একটি ধর্মীয় গ্রন্থ, এতে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত অনেক বিষয় আছে, যেমন, সময় ও কাল বিষয়ক চর্চা, চান্দ্রমাস, সৌরমাস, এমনকি অধিবর্ষের নিষ্পত্তির জন্য চান্দ্র-অধিমাস বা অধিকামাসের বর্ণনাও আছে।[27] ঋতু ও যুগের উল্লেখও পাওয়া যায় এই গ্রন্থে।[27] ত্রিপাঠীর মতে, "সাতাশটি নক্ষত্রপুঞ্জ, গ্রহণ, সাতটি গ্রহ এবং রাশিচক্রের বারোটি রাশিও সেই যুগে ভারতীয়দের জানা ছিল।"[27]
মিশরীয় কাহুনের প্যাপিরাস (খৃঃ পূঃ ১৯০০) এবং ভারতে বৈদিক যুগের বিভিন্ন গ্রন্থের থেকে জানা যায় সেই প্রাচীন যুগেই পশু চিকিৎসার প্রচলন ছিল।[28] কেয়ার্নস ও ন্যাশ (২০০৮) বলেছেন খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সুশ্রুত সংহিতায় কুষ্ঠ রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুশ্রুত সংহিতা একটি আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ১৮৪টি অধ্যায়ে ১১২০টি রোগের বর্ণনা আছে; এছাড়া ৭০০টি আয়ুর্বেদিক উদ্ভিদ, পুঙ্খানুপুঙ্খ শারীরস্থানের বর্ণনা, ৬৪টি খনিজ পদার্থ থেকে ও ৫৭টি প্রাণীজ পদার্থ থেকে ঔষধ বানানোর পদ্ধতি বিবরণ পাওয়া যায়।[29][30] তবে, The Oxford Illustrated Companion to Medicine বই বলছে, খৃঃ পূঃ ১৫০০-১২০০ সময়কালে রচিত হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অথর্ববেদে কুষ্ঠ রোগের ও সেই রোগের ধর্মীয় পদ্ধতিতে উপশমের উল্লেখ পাওয়া যায়।[31]
খৃঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে সুশ্রুত ছানির অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি জানতেন।[32] জবামুখী শলাকা নামের একটি বিশেষ অস্ত্রের সাহায্যে ছানির অস্ত্রোপচার করা হত। এটি একটি বাঁকা সূঁচ, যা দিয়ে ছানিগ্রস্ত মণিকে আলগা করে দৃষ্টিসীমার বাইরে সরিয়ে দেওয়া হত।[32] অস্ত্রোপচারের পর চোখকে উষ্ণ মাখনে ভিজিয়ে পটি বেঁধে দেওয়া হত।[32] যদিও এই পদ্ধতি যথেষ্ট সফল ছিল, তবুও সুশ্রুত শুধুমাত্র একান্ত প্রয়োজনেই এই শল্যচিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন।[32] ভারত থেকেই চীনে ছানির অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি পরিচিতি পায়।[33]
খৃঃ পূঃ ৫ম শতাব্দীতে, ব্যাকরণবিদ পাণিনি ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, এবং রূপমূলতত্ত্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন।[34] পাণিনির রূপমূলতত্ত্বের ব্যাখ্যা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সমবিষয়ক পশ্চিমি তত্ত্বের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল।[35]
খৃঃ পূঃ ৫ম শতাব্দীর আগেই ভারতে ধাতুজাত মুদ্রার প্রচলন ছিল।[36][37] খৃঃ পূঃ ৪০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালের মূলতঃ রূপা বা তামার মুদ্রা তৈরী হত, যাতে নানা রকম পশু ও উদ্ভিদের চিহ্ণ থাকত।[38]
রাজস্থানে উদয়পুরের কাছে জাওয়ার দস্তা খনি খৃঃ পূঃ ৪০০ সালেও ব্যবহার হত।[39][40] বিভিন্ন ধরনের হাতলযুক্ত বিভিন্ন রকমের তরবারি পাওয়া গেছে বর্তমান উত্তর প্রদেশের ফতেগড়ে।[41] এই তরবারিগুলি খৃঃ পূঃ ১৭০০ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যে তৈরী করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, তবে সম্ভবতঃ তরোয়ালের বহুল ব্যবহার শুরু হয় খৃঃ পূঃ প্রথম সহস্রাব্দে।[42] বর্তমান উত্তর প্রদেশের মলহার, ডাদোপুর, রাজা নালা কা টিলা ও লাহুরাদেওয়া প্রত্নস্থলগুলিতে লোহার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে খৃঃ পূঃ ১৮০০ ও খৃঃ পূঃ ১২০০ সময়কালের।[43] রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে ভারতে পাওয়া লৌহ সামগ্রীর বয়স নির্ধারণ করা যায় খৃঃ পূঃ ১৪০০ সময়কালের।[44] কিছু বিশেষজ্ঞের মতে খৃঃ পূঃ ১৩শ শতাব্দীতেই ভারতে লৌহ বিগলনের পদ্ধতি বহুল পরিচিত ছিল, সুতরাং এটা মনে করা যেতেই পারে লৌহ বিগলন পদ্ধতির উন্মেষ আরও অনেক আগেই হয়েছে।[43] দাক্ষিণাত্যে (আজকের মহীশূর) খৃঃ পূঃ ১১শ থেকে ১২শ শতাব্দীতেই লোহার ব্যবহার শুরু হয়।[45] এত প্রাচীন লোহার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়ায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে দাক্ষিণাত্যে লোহার ব্যবহার দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের থেকে স্বাধীন ভাবেই হয়েছে। কারণ ঐ সময় দাক্ষিণাত্যের সাথে সিন্ধু সভ্যতার সম্ভবতঃ কোনো যোগাযোগ ছিল না।[45]
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বাঁধ ও সেতু বানানোর কথা বলা আছে।[46] ৪র্থ শতাব্দীর সময়কাল থেকে বাখারি ও লোহার শিকল দিয়ে প্রস্তুত ঝুলন্ত সেতুর ব্যবহার দেখা যায়।[47] প্যাগোডা ও তোরীর পূর্বসূরী, বৌদ্ধ স্তুপের নির্মাণ খৃঃ পূঃ ৩য় শতক থেকেই শুরু হয়ে গেছিল।[48][49] ভারতের শুষ্ক অঞ্চলে পাথর কেটে ধাপ-কূপ তৈরী করা শুরু হয় ২০০-৪০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।[50] পরবর্তী পর্যায়ে, ধাপ-কুয়ো বা ধাপ-পুকুর আরও বিভিন্ন স্থানে তৈরী করা হয়, যেমন, ধাঁক (৫০০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও ভিনমাল (৮৫০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)[50]
খৃঃ পূঃ ১ম সহস্রাব্দে বৈশেষিক পরমাণুবাদের সূচনা হয়। এই তত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা ছিলেন ভারতীয় দার্শনিক কণাদ (খৃঃ পূঃ ৬০০)।[51] এই তত্ত্ব অনুসারে পরমাণু অবিনশ্বর ও অবিভাজ্য,[52] এবং প্রতিটি পরমাণুর বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বর্তমান।[53] বৈশেষিক পরমাণুবাদের আরও প্রসার হয় বৌদ্ধ পরমাণুবাদে। ৭ম শতাব্দীর ধর্মকীর্তি ও দিগনাগ ছিলেন এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা। এঁরাই প্রথম বলেন পরমাণু বিন্দু আকৃতির, কালহীন, এবং শক্তি দিয়ে সৃষ্ট।[54]
খৃষ্টীয় ১ম শতাব্দীর শুরুর দিকেই গহনা ও পাত্র হিসাবে কাঁচের ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল।[55] ইউরোপীয় গ্রেকো-রোমান সভ্যতার সংস্পর্শে আসার দরুন নতুন নতুন পদ্ধতি আত্মিকরণ হতে শুরু করে। ফলে স্থানীয় কারিগরেরা কাঁচের ঢালাই করা, নক্সা করা ও নানা রকম রং মেশানোর পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলে খৃষ্টীয় প্রথম কয়েকটি শতাব্দীতেই।[55] The সাতবাহন সাম্রাজ্যের সময় দেখা যায় মিশ্র কাঁচের ছোট ছোট চোঙ, যার কোনো কোনোটিতে হলুদ ও সবুজ রঙের সুন্দর ব্যবহার দেখা যায়।[56] খৃষ্টীয় প্রথম কিছু শতাব্দীতে ভারতেই উটজ-এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয়।[57] ইউরোপ, চীন ও আরব অঞ্চলে উটজ রপ্তানী করা হত। আরবে এটি দামাস্কাস ইস্পাত নামে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় দক্ষিণ ভারতে উটজ বানানোর পদ্ধতি জানা ছিল খৃষ্টের জন্মেরও আগে।[58][59]
খৃষ্টীয় ২য় শতাব্দীতেই ভারতে ধুনুরি জাতীয় যন্ত্রের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।[60] হীরার খনি ও রত্ন হিসাবে হীরার ব্যবহার ভারত থেকেই শুরু হয়।[61] প্রাচীন ভারতে গোলকুন্ডায় একটি গুরুত্বপূর্ণ হীরার খনি ছিল।[61] এখানের হীরা সারা বিশ্বে রপ্তানি করা হত।[61] বিভিন্ন সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন গ্রন্থে হীরার উল্লেখ পাওয়া গেছে।[62] ভারতে হীরক ব্যবসার উল্লেখ পাওয়া যায় অর্থশাস্ত্রে।[63] গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের সময়কালে (৩৭৫-৪১৩), স্থাপিত দিল্লির লৌহস্তম্ভে আজ প্রায় ২০০০ বছর পরেও কোনো মরচে ধরেনি।[64] খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর রসরত্নসমুচ্চয় গ্রন্থে দস্তার দুটি আকরিকের কথা বলা আছে। একটি থেকে দস্তা ধাতু নিষ্কাশন সম্ভব, অন্যটি শুধুমাত্র ঔষধি প্রস্তুতে ব্যবহার করা যায়।[65] র সময়কালের (২০০-৮৪৮) জাহাজের ধংসাবশেষের ভিত্তিতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বানানো কাঠামো। এটি থিরুনেভেলির সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত আছে।]]
চরকার উৎপত্তি নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা আছে, তবে ভারতকে একটি সম্ভাব্য উৎস হিসাবে মনে করা হয়।[66][67] খৃষ্টীয় ১৪শ শতাব্দীতে এটি ভারত থেকেই ইউরোপে গিয়েছিল।[68] যান্ত্রিক উপায়ে তুলা বীজ থেকে তুলা ছাড়ানোর উপায় ভারতেই উদ্ভাবিত হয়, - কাঠের তৈরি এই যন্ত্রের নাম ছিল চরখি।[60] বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই যন্ত্র হস্তচালিত হলেও কোনো কোনো এলাকায় জলশক্তিতেও এই যন্ত্র চালানো হত।[60] অজন্তা গুহাচিত্র থেকে প্রমাণিত হয় খৃষ্টীয় ৫ম শতাব্দীতেও ভারতে এই যন্ত্র ব্যবহৃত হত।[69] পরবর্তী পর্যায়ে পদচালিত তুলা ছাড়ানোর যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।[69] বিভিন্ন প্রাচীন চীনা নথি থেকে জানা যায়, ৬৪৭ সাল থেকে শুরু করে, ভারতে কমপক্ষে দুটি অভিযান হয়েছিল চিনি পরিশোধনের প্রযুক্তি আহরণের জন্য।[70] কিন্তু, প্রতিটি অভিযানই চিনি পরিশোধনের বিষয়ে আলাদা আলাদা তথ্য নিয়ে ফেরে।[70] সঙ্গীত বিশারদ পিঙ্গল (খৃঃ পূঃ ৩০০-২০০) সংস্কৃত ভাষায় ছন্দশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায়, বিভিন্ন মাত্রার সমন্বয়ের গণনা করতে গিয়ে, পিঙ্গল প্যাস্কেলের ত্রিভূজ ও দ্বিপদ গুণাঙ্ক (Binomial coefficient) আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও তিনি দ্বিপদ তত্ত্ব (Binomial theorem) জানতেন না।[71][72] পিঙ্গলের লেখায় বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতির ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।[73] গুণের চিহ্নের ব্যবহার পদ্ধতি ভারতীয়দের সৃষ্টি। ঋণাত্বক সংখ্যা ও বিয়োজ্য সংখ্যা খৃঃ পূঃ ২য় শতাব্দী থেকেই পূর্ব এশিয়ায় ব্যবহৃত হত, আর খৃষ্টীয় ৭ম শতাব্দী থেকে ভারতীয় গাণিতিকেরা ঋণাত্বক সংখ্যা জানতেন,[74] এবং ঋণের গণনার ক্ষেত্রে এই সংখ্যার ব্যবহারও বুঝতেন।[75] যদিও ভারতীয়রা বিয়োজ্য সংখ্যার ব্যবহার প্রথম শুরু করেননি, তবে তারা ধণাত্বক ও ঋণাত্বক সংখ্যার গুণের ক্ষেত্রে "চিহ্নের ব্যবহারে"র নিয়মাবলী প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যাপারটা পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন লেখায় ১২৯৯ সালের আগে দেখা যায় না।[76] ঋণাত্মক সংখ্যা সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঠিক যে নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা আরবীয়দের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।[75]
অন্ততঃ খৃঃ পূঃ ৩০০০ অব্দ থেকেই মিশরীয় চিত্রলিপিতে দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার ছিল,[77] পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিক সংখ্যা ব্যবস্থা তৈরীর সময় প্রাচীন ভারতে দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়।[78] খৃষ্টীয় ৯ম শতাব্দীর মধ্যে, হিন্দু-আরবী সংখ্যা পদ্ধতি ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।[79] শুধুমাত্র পৃথক করার চিহ্ন হিসাবে নয়, বরং সংখ্যা হিসাবে ০-এর ধারণার উদ্ভব ভারতে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।[80] খৃষ্টীয় ৯ম শতাব্দী থেকেই ভারতে অন্যান্য সংখ্যার মতই ব্যবহারিক গণিতে, এমনকি বিভাজনেও, শূন্যের প্রচলন ছিল।[80][81] ব্রহ্মগুপ্ত (৫৯৮–৬৬৮) পেল সমীকরণের সমাধান করেছিলেন।[82] দ্বিতীয় ভাস্কর ১১৫০ সালে চিরস্থায়ী গতিশীল যন্ত্রের খসড়া বানিয়েছিলেন। তিনি একটি চিরস্থায়ী ঘুর্ণনশীল চাকার বর্ণনা করেছিলেন।[83]
খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে আর্যভট্ট ত্রিকোণমিতির সাইন ও ভেরসাইনের ব্যবহার জানতেন। এর সাহায্যে সহজেই যে কোসাইন নির্ণয় করা যায় সেটাও তিনি জানতেন।[84][85] আজকের "রোলের উপপাদ্য" নামের কলনবিদ্যার উপপাদ্যটি খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতেই ভারতীয় গণিতজ্ঞ দ্বিতীয় ভাস্কর বর্ণনা করেছিলেন।[86]
রঞ্জক হিসাবে নীলের (ইন্ডিগোফেরা টিঙ্কটোরিয়া বা ইংরাজি: Indigofera tinctoria) বহুল ব্যবহার ভারতে প্রচলিত ছিল।[87] রেশম পথ ধরে রঞ্জক হিসাবে নীল গ্রীক ও রোমানদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এক মহার্ঘ্য ভোগ্য বস্তু হিসাবে।[87] কাশ্মীরে পশমিনা শাল হাতে তৈরী করা হত।[88] কাশ্মীর অঞ্চলের পশমের শালের উল্লেখ বিভিন্ন লেখায় খৃঃ পূঃ ৩য় শতাব্দী থেকে খৃষ্টীয় ১১শ শতকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।[89] গুপ্ত যুগে চিনির ব্যবহার শুরু হয়,[90] এবং প্রাচীনতম মিছরির ব্যবহারের উল্লেখ ভারতেই পাওয়া যায়।[91] পাট চাষ ভারতেই হত।[92] ইরাকের মসুল শহরে প্রথমবার এই কাপড় ইউরোপীয়রা দেখতে পেয়েছিল বলে নাম হয়েছিল মসলিন, কিন্তু এই কাপড় তৈরী হত বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায়।[93][94] খৃষ্টীয় ৯ম শতাব্দীতে, সুলেমান নামক আরব ব্যবসায়ী লিখেছেন এই কাপড়ের উৎস হল বঙ্গ (আরবি ভাষায় রুহমল)।[94]
ইউরোপীয় পণ্ডিত ফ্রান্সেস্কো লোরেঞ্জো পুলি একাধিক ভারতীয় মানচিত্র নকল করেছিলেন তার লা কার্টোগ্রাফিয়া অ্যাণ্টিকা ডেল ইন্ডিয়া নামে মহাগ্রন্থে।[95] এই মানচিত্রগুলির মধ্যে, দুটি নকল করা হয়েছিলএকাদশ শতাব্দীর কাশ্মীরী পণ্ডিত ক্ষেমেন্দ্র রচিত গ্রন্থ লোকপ্রকাশ থেকে নেওয়া হয়েছিল।[95] এছাড়া, সমগ্র গ্রন্থ থেকেও অনেক মানচিত্র নকল করা হয়েছিল পুলির গ্রন্থে।[95]
১১শ শতাব্দীর রাজা ভোজের লেখা সমরাঙ্গণ সূত্রধারা নামক সংস্কৃত ভাষার গ্রন্থে একটি অধ্যায়ে যান্ত্রিক মৌমাছি ও পাখি, মানবাকৃতির ও পশু আকৃতির ঝরণা এবং যান্ত্রিক নারী-পুরুষ পুতুল (যে গুলি তৈলপ্রদীপে তেল ভরা থেকে শুরু করে নৃত্য পরিবেশন, বাদ্যযন্ত্র বাদন, এমনকি বিভিন্ন হিন্দু পৌরাণিক দৃশ্যের অভিনয় করতে সক্ষম ছিল) প্রভৃতি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানাবার কথা বলা আছে।[96][97][98]
সঙ্গমাগ্রামের মাধব (খৃষ্টীয় ১৩৪০ - ১৪২৫) ও তার কেরালার জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিদ্যালয় গাণিতিক বিশ্লেষণের প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি সাধন করে।[99] মাধব প্রথম π-এর অসীম ক্রমের কথা বলে. তিনি ক্রমের সম্প্রসারণ ব্যবহার করে -এর যে অসীম ক্রমের উপস্থাপনা করেন, তা আজ মাধব-গ্রেগরি ক্রম নামে পরিচিত। এই ক্রমের সীমিত সমষ্টির চ্যুতির যুক্তিসঙ্গত আসন্নমানের যে গনণা তারা করেছিলেন তা বিশেষ আগ্রহের বিষয়। তারা এই চ্যুতিকে এমন কৌশলে ব্যবহার করেছিলেন যাতে -এর একটি দ্রুততর অভিসারী ক্রম পাওয়া যায়। তারা এই উন্নত ক্রম ব্যবহার করে ১০৪৩৪৮/৩৩২১৫ অঙ্কটি নির্ণয় করেন যা -এর নবম দশমিক স্থান পর্যন্ত সঠিক মান নির্ণয় করতে সক্ষম ছিল, যথা, ৩.১৪১৫৯২৬৫৩ (-এর আরও নিখুঁত মান হল ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭...)।[100] ১৫শ শতাব্দীতে কেরালার গণিত বিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞেরা ত্রিকোণমিতিক অপেক্ষকের (সাইন, কোসাইন ও আর্ক ট্যানজেন্ট) জন্য বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক ক্রমের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।[101] ইউরোপে কলনবিদ্যা উদ্ভাবনের দুই শতাব্দী আগেই তারা যা কাজ করেছিলেন তা আজ ঘাত শ্রেণীর (গুণোত্তর শ্রেণী ব্যতিরেকে) প্রাচীনতম উদাহরণ হিসাবে পরিচিত।[101]
শের শাহ ইসলামি চিহ্ন সংবলিত রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন, যা পরে মুঘল সাম্রাজ্য অনুকরণ করে।[38] চৈনিক ব্যবসায়ী মা হুয়ান (১৪১৩-৫১) কোচিতে দেখেছিলেন ফানম নামের স্বর্ণমুদ্রা। চৈনিক ওজনের হিসাবে এই মুদ্রার ওজন ছিল মোট এক ফেন ও এক ইল-এর সমতুল্য।[102] উচ্চমানের এই স্বর্ণমুদ্রাগুলির বিনিময়ে চীনে চার ইল ওজনের ১৫টি রৌপ্যমুদ্রা সহজেই পাওয়া যেত।[102]
কেরালার জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিদ্যালয়ের নীলকন্ঠ সোময়াজি খৃষ্টীয় ১৫০০ শতাব্দীতে তার তন্ত্রসংগ্রহ গ্রন্থে আর্যভট্টের বুধ ও শুক্রগ্রহের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ সংক্রান্ত ধারণার পরিমার্জন করেছিলেন। এই গ্রহগুলির কেন্দ্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার সমীকরণ ১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের আগমনের আগে পর্যন্ত সবথেকে সঠিক গণনা পদ্ধতি ছিল।[103]
৯৯৮ হিজরি সালে (খৃঃ ১৫৮৯-৯০) কাশ্মীরে আলি কাশ্মীরী ইবন লাকমান জোড়হীন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গোলকের উদ্ভাবন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে, মুঘল শাসনকালে লাহোর ও কাশ্মীরে আরও কুড়িটি অনুরূপ গোলক তৈরী হয়।[104] ১৯৮০-এর দশকে এই গোলকগুলির পুনরাবিষ্কারের আগে, আধুনিক ধাতুবিদেরা, যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্বেও, জোড়হীন ধাতব গোলক বানানো অসম্ভব বলে মনে করতেন।[104] এই মুঘল ধাতুবিদেরা ভারেওয়া পদ্ধতি[105] বা হৃতমোম ঢালাই (ইংরাজি:lost-wax casting) পদ্ধতিতে পথিকৃৎ ছিলেন।[104]
ভারতে মঙ্গোল আক্রমণের মাধ্যমে বারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্রের আমদানি হয়েছিল।[106][107] দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মঙ্গোলদের পরাজিত করায়, কিছু মঙ্গোল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে উত্তর ভারতে পাকাপাকিভাবে থেকে যায়।[107] 'তারিখ-ই ফিরিস্তায় (১৬০৬–১৬০৭) লেখা আছে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে মঙ্গোল শাসক হালাকু খানের দূতকে স্বাগত জানাতে দিল্লিতে আতসবাজির প্রদর্শনী করা হয়।[108] তৈমুরীয় শাসক শাহ রূখের (১৪০৫-১৪৪৭) ভারতীয় দূতাবাসের আব্দ অল-রাজ্জাক বলেছেন হাতির পিঠে বসে ন্যাপথা ছুঁড়ে নানা ধরনের আতসবাজির প্রদর্শনী দেখানো হত।[109] ১৩৬৬ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে তোপ-ও-তুফাক নামে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হত।[108] এই সময় থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। ১৪৭৩ সালে বেলগাঁও-এ বাহমানি সুলতান মুহম্মদ শাহ বাহমনির অবরোধের মত সমরকৌশল, যা মধ্যযুগে আগ্নেয়াস্ত্র নির্ভর যুদ্ধের অন্যতম অভিজ্ঞান, প্রায়শঃই দেখা যেতে শুরু করে।[110]
জেমস রিডিক পার্টিংটন তাঁর গ্রীক আগুন ও বারুদের ইতিহাস (A History of Greek Fire and Gunpowder, বাংলা ভাষায় আ হিস্টোরি অফ গ্রিক ফায়ার অ্যান্ড গানপাউডার) গ্রন্থে ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীর মুঘল ভারতে আগ্নেয়াস্ত্র নির্ভর যুদ্ধের বর্ণনা করেছেন, এবং লিখেছেন যে, "ইউরোপে ব্যবহার করার আগে ভারতীয় যুদ্ধ রকেটগুলি ভয়ঙ্কর অস্ত্র ছিল। বাঁশের লাঠিতে লোহার ছুঁচালো মাথাযুক্ত রকেটগুলি বাঁধা থাকত। সলতেয় অগ্নিসংযোগ করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাক করে চালনা করা হত, তবে গতিপথ অনিশ্চিত ছিল … আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে বিস্ফোরক মাইন ও পাল্টা-মাইন ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।"[111] ভারতে এই রকেটগুলি তীর-এ-হাওয়াই বা অগ্নি বাণ নামেও পরিচিত ছিল।[112]
১৬শ শতাব্দী থেকেই, ভারতে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বানানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাঞ্জোর, ঢাকা, বিজাপুর ও মুর্শিদাবাদে, বিশেষ করে, বড় বড় কামান দেখা যেতে শুরু করে।[113] কালিকট (১৫০৪) ও দিউ (১৫৩৩) থেকে ব্রোঞ্জের কামান পাওয়া গেছে।[111] ১৭শ শতাব্দীতে গুজরাত থেকে ইউরোপে শোরা রপ্তানি করা হত আগ্নেয়াস্ত্র নির্ভর যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য।[114] বাংলা ও মালওয়াতে শোরা প্রস্তুত করা হত।[114] ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজেরা ছাপরাকে কেন্দ্র করে শোরা পরিশোধন করত।[115]
জল সরবরাহ নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির বর্ণনা পাওয়া যায় বিভিন্ন আরবি ও ফার্সি ভাষার গ্রন্থে।[116] মধ্যযুগে, ভারতীয় ও পারসিক সেচ প্রযুক্তির আদান-প্রদানের কারণে এক উন্নত সেচ ব্যবস্থার প্রচলন হয়, ফলে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে জনজীবনে সামগ্রিক উন্নতিও দেখা যায়।[116] কাশ্মীরের ১৫শ শতাব্দীর শাসক, জায়ন-উল-আবিদিনকে পশমিনা শিল্পের জনক বলে মনে করা হয়। তিনি মধ্য এশিয়া থেকে বয়নশিল্পীদের এনে এই শিল্পের পত্তন করেন।[89]
উত্তর প্রদেশের জৌনপুরের পণ্ডিত সাদিক ইস্ফাহানি বিশ্বের কিছু অংশের মানচিত্রের এক সঙ্কলন করেছিলেন, যা তার মতে 'মানব জীবনের জন্য উপযুক্ত'।[117] ৩২পাতার এই সঙ্কলন—সেই যুগের ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সাযুয্য রেখে দক্ষিণমুখী—ইস্ফাহানি করেছিলেন ১৬৪৭ সালে এক বৃহৎ শিক্ষামূলক গ্রন্থের অংশ হিসাবে।[117] জোসেফ ই. স্বোয়ার্টজবার্গের মতে (২০০৮): 'বৃহত্তম ভারতীয় মানচিত্রটি প্রাক্তন রাজপুত রাজধানী অম্বরের প্রতিটি বাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সংবলিত ছিল আর তার আয়তন ছিল ৬৬১ × ৬৪৫ সে.মি. (২৬০ × ২৫৪ ইঞ্চি, বা প্রায় ২২ × ২১ ফুট)।'[118]
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে দ্রাবিড় জাতি স্বাভাবিক কারণে সমুদ্রগামী হওয়ায় মানচিত্র নির্মাণ করত।[121] এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে (২০০৮), স্টিফেন অলিভার ফট ও জন এফ. গিলমার্টিন, জুনিয়ার ১৮শ শতাব্দীতে মহীশূরের বারুদ প্রযুক্তির বিশদ বর্ণনা করে বলেছেন:[122]
মহীশূরের সুলতান হায়দার আলী, যুদ্ধ রকেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করেন: বিস্ফোরক বহনকারী পাত্র হিসাবে ধাতুর চোঙ ব্যবহার করেন। যদিও পেটানো নরম লোহার এই নলগুলির গুণগত মান অত্যন্ত সাধারণ ছিল, তবে আগের কাগজের চোঙের তুলনায় বিস্ফোরক শক্তি অনেক বেশি ছিল। ফলে এই অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ চাপ রকেটগুলিকে দ্রুততর গতিতে অধিক দূরত্বে নিক্ষেপ করতে সাহায্য করত। রকেটের চোঙটি চামড়ার ফিতা দিয়ে লম্বা বাঁশের লাঠিতে বাঁধা থাকত। সম্ভবত এক মাইলের তিন চতুর্থাংশ (এক কিলোমিটারেরও বেশি) পর্যন্ত রকেটের পাল্লা ছিল। যদিও পৃথকভাবে দেখলে এই রকেটগুলির লক্ষ্য খুব একটা স্থির ছিলনা, তবে অনেক সংখ্যক রকেটের যুগপত আক্রমণের সময় নিখুঁত লক্ষ্যের প্রয়োজন পড়ত না। এই রকেটগুলি বিশেষ করে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর ছিল। ব্যবহার করার দুটি পদ্ধতি ছিল, - হাতে ধরে সলতেয় অগ্নিসংযোগ করে হাওয়ায় নিক্ষেপ করে, অথবা, শক্ত, শুকনো মাটিতে শুইয়ে সলতেয় অগ্নিসংযোগের ফলে মাটিতে ঘষটে রকেটগুলি ধাবিত হত। হায়দার আলীর ছেলে, টিপু সুলতান, রকেট অস্ত্র ব্যবহারের বিকাশ ও সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছিলেন ও রকেট পরিচালনকারী সেনার সংখ্যা ১,২০০ থেকে বাড়িয়ে ৫,০০০ করেন। ১৭৯২ এবং ১৭৯৯ সালের শ্রীরঙ্গপত্তনের যুদ্ধে এই রকেটগুলি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
১৮শ শতাব্দীর শেষে ভারতীয় ডাক ব্যবস্থা অতীব দক্ষ হয়ে ওঠে।[123] যেমন, টমাস ব্রোটনের বক্তব্য অনুযায়ী, যোধপুর মহারাজা তার রাজধানী থেকে ৩২০ কি.মি. দূরে নাথাদেওরার মন্দিরে প্রত্যেক দিন তাজা ফুলের অর্ঘ্য পাঠাতেন, যা পরের দিন সূর্য্যোদয়ের সাথে সাথে ঠিক প্রথম দর্শনের সময় পৌঁছে যেত।[123] পরবর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশ রাজ আসার সঙ্গে ডাক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হয়।[124] ১৮৩৭ সালের ১৭তম পোস্ট অফিস আইন (The Post Office Act XVII of 1837) বলে ভারতের গভর্নর-জেনারেল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এলাকার যে কোনো স্থানে ডাক মাধ্যমে সংবাদ পাঠাতে পারতেন।[124] কিছু আধিকারিকের এই বিনামূল্যে ডাক ব্যবস্থা ব্যবহার করার সুবিধা, পরের দিকে বিতর্কের সৃষ্টি করে।[124] ১লা অক্টোবর ১৮৩৭ সালে ভারতীয় পোস্ট অফিস পরিষেবার সূচনা হয়।[124] কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্রিটিশেরা ভারতে এক সুবিশাল রেল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলে।[125]
ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা মূলতঃ স্থানীয় জন সমাজ থেকে পুর ও প্রশাসনিক চাকরির যোগ্য প্রার্থী তৈরী করার উদ্দেশ্যে চালু হলেও, এর ফলে ভারতীয় ছাত্রদের কাছে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে যায়।[126] স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮–১৯৩৭), আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪–১৯৭৪), মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩–১৯৫৬), প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ (১৮৯৩–১৯৭২), স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন (১৮৮৮–১৯৭০), সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (১৯১০–১৯৯৫), হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা (১৯০৯–১৯৬৬), শ্রীনিবাস রামানুজন (১৮৮৭–১৯২০), উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (১৮৭৩–১৯৪৬), বিক্রম সারাভাই (১৯১৯–১৯৭১), হর গোবিন্দ খোরানা (১৯২২–২০১১), হরিশ চন্দ্র (১৯২৩–১৯৮৩), এবং আবদুস সালাম (১৯২৬-১৯৯৬) হলেন এই সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য কৃতি বিজ্ঞানী।[126]
ঔপনিবেশিক যুগে স্থানীয় ও ঔপনিবেশিক বিজ্ঞান গবেষণার গভীর আদান-প্রদান ছিল।[127] পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রভাবকে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক সত্তা হিসাবে দেখা হত না বরং ভারতীয় জাতি গঠনে এর উপযোগিতা,[128] বিশেষ করে কৃষি ও বাণিজ্যে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য ছিল।[127] ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েন।[128] ভারতের স্বাধীনতার সময় ঔপনিবেশিক যুগে গড়ে ওঠা ভারতীয় বিজ্ঞান সারা বিশ্বে সমাদৃত হতে শুরু করে।
ফরাসি জ্যোতির্বিদ, পিয়ের জ্যানসেন ১৮ই আগস্ট ১৮৬৮ সালের সূর্যগ্রহণ নিরীক্ষা করে হিলিয়াম গ্যাস আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ রাজ্যের গুন্টুর থেকে।[128] ১৮৯৭ সালে স্যার রোনাল্ড রস প্রথমে সেকেন্দ্রাবাদে ও পরে কলকাতায় গবেষণা করে আবিষ্কার করেন ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ মশক-বাহিত।[129][130] এই কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।[131]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.