স্যার জগদীশচন্দ্র বসু[৩], সিএসআই, সিআইই, এফআরএস[৪][৫][৬] (৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ – ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭[৭]) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় পদার্থবিদ, [৮]জীববিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা ছিলেন৷[৯] ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা তার হাত ধরে হয় বলে মনে করা হয়৷[১০] ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাকে রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক হিসেবে অভিহিত করে৷[১১]
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু সিএসআই, সিআইই, এফআরএস | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ ৭৮) | (বয়স
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয়[১] |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় (জন্মসূত্রে)[১] |
মাতৃশিক্ষায়তন | ময়মনসিংহ জিলা স্কুল হেয়ার স্কুল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রাইস্ট কলেজ, কেমব্রিজ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়[২] |
পরিচিতির কারণ | মিলিমিটার তরঙ্গ বেতার ক্রেসকোগ্রাফ উদ্ভিদবিজ্ঞান |
দাম্পত্য সঙ্গী | অবলা বসু |
পুরস্কার | সিআইই (১৯০৩) সিএসএই (১৯১১) নাইট ব্যাচেলর (১৯১৭) |
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান, জৈবপদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কল্পবিজ্ঞান |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | ময়মনসিংহ জিলা স্কুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
উচ্চশিক্ষায়তনিক উপদেষ্টা | জন উইলিয়াম স্ট্রাট |
উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী | সত্যেন্দ্রনাথ বসু মেঘনাদ সাহা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ শিশির কুমার মিত্র দেবেন্দ্র মোহন বসু |
স্বাক্ষর | |
জীবনী
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমান বাংলাদেশ) অঞ্চলের মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন ৷ বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তার পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল ৷[১২] তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ৷[১৩] এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন ৷ ভগবান চন্দ্র এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ৷ পরবর্তীতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন ৷[১৪]
ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করান নি ৷ জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ৷ বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তার নিজস্ব যুক্তি ছিল ৷ তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলে-মেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত্ব করা উচিত ৷ বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে, তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে ৷ এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো৷ ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক ৷[১৫] জগদীশ চন্দ্রের পরবর্তী জীবনে তার প্রথম বাংলা স্কুলের অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল ৷[পাদটীকা ১]
জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন ৷[১৩] এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তার আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ৷[১২][১৪]:৩-১০ এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজি হন নি, কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার পুত্র একজন বিদ্বান হোক ৷[১৬]
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন নি ৷ তার ভগ্নিপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকূল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন ৷ এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন তিনি । ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন[২]৷ কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তার শিক্ষক ছিলেন ৷
প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান(কর্মজীবনের সূচনা)
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ভারতে ফিরে আসেন৷ তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন, প্রথম মার্কুইস অব রিপনের অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন৷ কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন৷ শুধু যে তাকে গবেষণার জন্য কোন রকম সুবিধা দেওয়া হত না তাই নয়, তিনি ইউরোপীয় অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনেরও কম অর্থ লাভ করতেন৷[১৪]:১১-১৩[১৭] এর প্রতিবাদে বসু বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান৷[১৪]:১১-১৩[১৮] দীর্ঘকাল ধরে এই প্রতিবাদের ফলে তার বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়৷[১৩] প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় ২৪-বর্গফুট (২.২ মি২) এর একটি ছোট ঘরে তাকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হত৷ পদে পদে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার বিজ্ঞান সাধনার প্রতি আগ্রহ ভগিনী নিবেদিতাকে বিস্মিত করেছিল৷[পাদটীকা ২] কলেজে যোগ দেওয়ার এক দশকের মধ্যে তিনি বেতার গবেষণার একজন দিকপাল হিসেবে উঠে আসেন৷
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়৷ এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে৷ এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে৷ প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন৷ তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট৷ সীমিত ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রিদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন৷ তার এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল৷ এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান৷ এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি৷ সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে এসেছিলেন৷
বিবাহ
১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলার বিয়ে হয়৷ অবলা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গামোহন দাশের কন্যা৷ বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল৷ ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে৷ সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন৷ তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন৷ এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না৷ এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়৷ এর মধ্য থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন৷ সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন৷
গবেষণা কর্ম
অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি ও প্রেরণ
জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা৷ ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান৷ ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী হের্ৎস প্রত্যক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন৷ এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান৷ জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন৷ এ ধরনের তরঙ্গকেই বলা হয় অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ৷ আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে৷
বক্তৃতাসমূহ
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে বক্তৃতা, লিভারপুল
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স”৷ মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে৷ অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান৷ জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন৷ এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী “টাইম্স”-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কেমব্রিজের এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ সাইন্স এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে৷ রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে৷” এই বক্তৃতা বিষয়ে পারসন্স ম্যাগাজিন লিখেছিল:
“ |
বিদেশী আক্রমণে ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বহুবছর ধরে ভারতে জ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে চলেছিল... প্রবল বাধা-বিপত্তির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে একজন ভারতীয় অধ্যাপক আধুনিক বিজ্ঞানের জগতেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাজের নজির রেখেছেন। বিদ্যুৎরশ্মি বিষয়ে তার গবেষণাপত্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে পঠিত হবার সময় তা ইউরোপীয় জ্ঞানী-গুণীমহলে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তার ধৈর্য ও অসাধারণ শক্তির প্রশংসা করতেই হয়- অন্ততঃ যখন ভাবি যে তিনি মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অত্যন্ত দুরূহ বিভাগের ছয়টি উল্লেখযোগ্য গবেষণা শেষ করেছেন। |
” |
রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা
লিভারপুলে বক্তৃতার পর তার আরও সাফল্য আসে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ৷ এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে “ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স” নামে সুপরিচিত ছিল৷ এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক৷ সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল৷ ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন৷ এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি৷ বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল৷ তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল”৷ এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়৷ ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত৷ এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব৷”
এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন৷ সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন৷ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যান এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique-এর সদস্য মনোনীত হন৷
স্বদেশপ্রেম
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, এই ভারতীয় বাঙালি বৈজ্ঞানিক ছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়া শত শত স্বদেশপ্রেমিকদের মধ্যে অন্যতম৷ তার বিভিন্ন বক্তৃতায় বারবার তার এই স্বদেশপ্রেমের দিকটি উন্মোচিত হয়েছে৷ আমাদের সৌভাগ্য যে পরাধীন ভারতবাসীর স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই তা সমভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিল৷
আচার্য বসু ১৯২৭ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে “ভারতে বিদ্যাচর্চার ধারা” সম্পর্কে বলেন -
“ | শিক্ষা প্রচারে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা ভারতে কখনও কোনো বিঘ্ন উৎপাদন করিতে সমর্থ হয় নাই৷ অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাই, অমর আচার্যগণ আজিও জীবিত থাকিয়া আমাদিগকে উৎসাহিত করিতেছেন৷ দেখিতেছি, আচার্য শঙ্কর পাণ্ডিত্য প্রভাবে দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর ভারতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত দেশ জয় করিয়া চলিয়াছেন৷ দেখিতেছি বঙ্গদেশের পণ্ডিতগণ কয়েকখানি তালপাতার পুঁথি মাত্র সম্বল লইয়া হিমালয় পর্বত অতিক্রম করিতেছেন- উদ্দেশ্য তিব্বত, চীন ও সুদূর প্রাচ্যে জ্ঞানালোক প্রচার৷ এই যে বিদ্যার অনুশীলন, তাহা কখনও কোনো বিশেষ প্রদেশে নিবদ্ধ ছিল না! বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জ্ঞান প্রজ্জ্বলিত ছিল৷ আচার্যের খ্যাতির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই সুদূর দেশ হইতে বিদ্যার্থীগণ আসিয়া আচার্যগৃহে সমবেত হইত৷ সেই প্রাচীন রীতি অদ্যাপি লুপ্ত হয় নাই৷ কারণ, বর্তমানকালেও চিন্তানায়কগণ দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিতেছেন এবং ঐক্য ও জাতিবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখিতেছেন৷ ঠিক ঠিক ভাবে যাঁহারা ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, যে সমস্ত বিভিন্ন জাতি ও প্রকৃতির লোক এদেশে আসিয়া এদেশকে নিজের মনে করিয়াছে, তাহাদিগকে এদেশ কি মহাশক্তি বলে নিজের করিয়া লইয়াছে৷ তাহাদেরই মিলিত চেষ্টায় ভবিষ্যতের বৃহত্তর ভারত গড়িয়া উঠিবে৷[১৯] | ” |
উক্ত সভাতেই “আধুনিক বিজ্ঞানে ভারতের দান” সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন -
“ | বিজ্ঞান প্রাচ্যেরও নহে, পাশ্চাত্যেরও নহে, ইহা বিশ্বজনীন৷ তথাপি ভারতরবর্ষ উত্তরাধিকারসূত্রে বংশ পরম্পরায় যে ধীশক্তি পাইয়াছে, তাহার দ্বারা সে জ্ঞানপ্রচারে বিশেষ করিয়া সক্ষম৷ যে জ্বলন্ত কল্পনা বলে ভারতবাসী পরস্পর বিরোধী ঘটনাবলীর মধ্য হইতে সত্য বাছিয়া লইতে পারে, সে কল্পনাই আবার ভারতবাসী সংযত করিতে পারে৷ এই মনঃসংযমই সত্যান্বেষণের শক্তি দিয়া থাকে৷[২০] | ” |
সুখ্যাতি
বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা কর্মজীবন অংশেই উল্লিখিত হয়েছে৷ এছাড়া তিনি বিজ্ঞান গবেষণায়ও প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছিলেন যার জন্য তার সুখ্যাতি তখনই ছড়িয়ে পড়েছিল৷ জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে৷ আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন:-
“ |
জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত। |
” |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন:
“ |
ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ। |
” |
ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড তাদের ৫০ পাউন্ডের নোটে নতুন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির মুখ যুক্ত করার জন্য নমিনেশন দিয়েছে৷ তাদের ওয়েবসাইটের হিসাবে গত ২৬ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত (প্রায়) ১,৭৫,০০০ নমিনেশন গ্রহণ করেছে৷ এর মধ্যে তারা ১,১৪,০০০ নমিনেশন প্রকাশ করে যেখানে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে সেরা তালিকায় রাখা হয়েছে৷ মূলত তারবিহীন প্রযুক্তিতে তিনি যে অবদান রেখেছেন সেটার কল্যাণেই আজকে আমরা ওয়াইফাই, ব্লুটুথ বা স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ খুব সহজে ব্যবহার করতে পারছি৷ যদিও আমরা আধুনিক রেডিও-র জনক হিসেবে জি.মার্কনিকে বিবেচনা করে থাকি ১৯০১ সালে তার আবিষ্কারের জন্য, কিন্তু তার কয়েক বছর আগেই স্যার জগদীশচন্দ্র বসু তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন৷ তাই, যদি নির্বাচিত হয় তাহলে ২০২০ সালে ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের ৫০ পাউন্ডের নোটে দেখা যাবে এ মহান বিজ্ঞানীর নাম৷ [২১]
সম্মাননা
- নাইটহুড, ১৯১৬
- রয়েল সোসাইটির ফেলো, ১৯২০
- ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য, ১৯২৮
- ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি, ১৯২৭
- লিগ অফ ন্যাশন্স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য
- ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো৷ এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি৷
- বিবিসি জরিপে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় সপ্তম স্থান লাভ করেন৷
মৃত্যু
১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে৷ মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তার আজীবন সঞ্চিত ১৭ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৩ লক্ষ টাকা বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে দান করেন৷ ১৯৫৮ সালে জগদীশ চন্দ্রের শততম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার "JBNSTS" নামে একটি বৃত্তি প্রদান আরম্ভ করেন।
রচনাবলি
বাংলা ভাষায়
ইংরেজি ভাষা
- Responses in the Living and Non-living (১৯০২)
- Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (১৯০৬)
- Comparative Electrophysiology (১৯০৭)
- Physiology of the Asent of Sap (১৯২৩)
- Physiology of Photosynthesis (১৯২৪)
- Nervous Mechanism of Plants (১৯২৫)
- Collected Physical Papers (১৯২৭)
- Motor Mechanism of Plants (১৯২৮)
- Growth and Tropic Movement in Plants (১৯২৯)
পাদটীকা
- At that time, sending children to English schools was an aristocratic status symbol. In the vernacular school, to which I was sent, the son of the Muslim attendant of my father sat on my right side, and the son of a fisherman sat on my left. They were my playmates. I listened spellbound to their stories of birds, animals and aquatic creatures. Perhaps these stories created in my mind a keen interest in investigating the workings of Nature. When I returned home from school accompanied by my school fellows, my mother welcomed and fed all of us without discrimination. Although she an orthodox old fashioned lady, she never considered herself guilty of impiety by treating these ‘untouchables’ as her own children. It was because of my childhood friendship with them that I could never feel that there were ‘creatures’ who might be labelled ‘low-caste’, I never realised that there existed a ‘problem’ common to the two communities, Hindus and Muslims.[১৪]:৩-১০
- "I was horrified to find the way in which a great worker could be subjected to continuous annoyance and petty difficulties ... The college routine was made as arduous as possible for him, so that he could not have the time he needed for investigation." After his daily grind, he carried out his research far into the night, in a small room in his college.[১৪]:১১-১৩
তথ্যসূত্র
আরও পড়ুন
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.