Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যে কন্নড় সাহিত্য বলতে দক্ষিণ ভারত অঞ্চলে পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের শাসনকালে (৯৭৩-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) রচিত কন্নড় সাহিত্যকে বোঝায়। সেই যুগে পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণকারী এই রাজবংশটিকে রাজধানী কল্যাণীর (অধুনা বাসবকল্যাণ) নামানুসারে ‘কল্যাণী চালুক্য রাজবংশ’ এবং বাদামীর ঐতিহাসিক চালুক্য রাজবংশের (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী) সঙ্গে এটির তাত্ত্বিক সম্পর্কের নিরিখে ‘পরবর্তী চালুক্য রাজবংশ’ নামেও অভিহিত করা হয়।[1] মাঝে অবশ্য অল্প সময়ের জন্য (১১৬২-১১৮৩ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিম চালুক্যদের সামন্ত কলচুরি রাজবংশ (যারা অতীতে মধ্য ভারত থেকে কর্ণাটক অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল) চালুক্যদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কল্যাণী দখল করে রেখেছিল।[2][3] ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সর্বশেষ চালুক্য বংশধর চতুর্থ সোমেশ্বর কলচুরিদের পরাস্ত করে রাজধানী পুনরুদ্ধার করেন। যদিও এই প্রয়াগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ অল্পকাল পরেই দাক্ষিণাত্যের অপর তিন প্রধান চালুক্য সামন্ত শাসক হৈসল, কাকতীয় ও সেউণরা চালুক্যদের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে সক্ষম হয়।[4]
ভাষাগত দিক থেকে পশ্চিম চালুক্য যুগে রচিত কন্নড় সাহিত্যকে প্রাচীন কন্নড় সাহিত্যের বর্গভুক্ত করা হয়। চালুক্য রাজসভার কবি ও সাহিত্যিকদের রচনার একটি বৃহত্তর অংশ এই সাহিত্যের অন্তর্গত; এবং এই সভাসাহিত্য প্রধানত জৈন ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।[5][6] প্রাচীনতম সুপরিচিত শৈব সাহিত্যিকরাও ছিলেন এই যুগের ব্যক্তিত্ব।[7] কলচুরি রাজা দ্বিতীয় বিজ্জলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিশিষ্ট কন্নড় কবি ও সমাজ সংস্কারক বসব। দ্বিতীয় বিজ্জলের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বচন’ সাহিত্য নামে কাব্যসাহিত্যের স্থানীয় একটি রূপ দ্রুত বিকাশ লাভ করে।[8][9] কন্নড়-ভাষী অঞ্চলগুলিতে অবশ্য ‘বচন’ কাব্যধারার সূচনা ঘটেছিল খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই।[10] এছাড়া গদ্য-পদ্য মিশ্রিত ‘চম্পু’ ছন্দে রচিত কন্নড় সাহিত্য জনপ্রিয় করে তোলেন চালুক্য সভাকবিরা। তবে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীরশৈব ধর্ম আন্দোলনের উত্থানের পরে কবিরা ‘ত্রিপদী’ (এগারোটি ‘গণ’ বা মাত্রার তিন পংক্তির ছন্দ), ‘হডুগব্ব’ (গীতিকবিতা) ও মুক্তছন্দে কবিতা রচনার পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিলেন।[11][12]
সভাকবি, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, রাজা, সন্ন্যাসী ও সন্তেরা ‘মার্গ’ (মূলধারা) শৈলীতে সাহিত্য রচনা করতেন।[13] তবে কন্নড় ভাষায় যে শুধুমাত্র এই শ্রেণির সাহিত্যিকেরাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তা-ই নয়, বরং মুচি, তাঁতি, রাখাল ও মেষমালকদের মতো সাধারণ মানুষ ও শিল্পী-কারিগররাও ‘দেশি’ (লৌকিক) শৈলীতে সাহিত্য রচনা করতেন।[14] ‘বচনকার’ অর্থাৎ বচন সাহিত্যের কবিরা কন্নড় সাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করেন। রাজা ও অভিজাত পুরুষের মাহাত্ম্য কীর্তন করে সাহিত্য রচনার প্রচলিত প্রথাটিকে প্রত্যাখ্যান করে এই কবিরা কথ্য ভাষায় নীতিমূলক কবিতা ও গান রচনা করতেন। বচন সাহিত্যের শতাধিক পুরুষ কবির পাশাপাশি ত্রিশ জনেরও বেশি মহিলা কবির নাম নথিবদ্ধ হয়েছে। এই মহিলা কবিদের মধ্যে কয়েক জন আবার স্বামীর সঙ্গে সাহিত্যরচনা করতেন।[15][16]
ঘটনা | তারিখ |
---|---|
‘চম্পু’ শৈলীতে জৈন ভক্তিমূলক সাহিত্যের প্রাধান্য[5] |
৯৭৩–১১৫০ |
জৈন সাহিত্যিকদের আদি ধর্মনিরপেক্ষ রচনাবলি[17] | ১০০০–১১০০ |
বীরশৈব কবিদের রচিত আদি ‘বচন’ কবিতা, স্থানীয় ছন্দগুলিতে রচিত[18] |
১০৪০–১১২০ |
কন্নড় ব্যাকরণ সংহতকরণ[19] | ১০৪২ অথবা ১১৪৫ |
বীরশৈব আন্দোলন এবং ‘বচন’ সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ[20][21] |
১১৫০–১১৮৩ |
জৈন–বীরশৈব সাহিত্য প্রতিযোগিতা[22] |
১১৫০–১২০০ |
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর শেষভাগে দক্ষিণ ভারতের অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের অন্তর্গত ভূখণ্ডে পশ্চিম চালুক্য নামে এক নতুন রাজবংশ মান্যখেতের (অধুনা মালখেড, কলবুরগি জেলা, কর্ণাটক) রাষ্ট্রকূট সম্রাটকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। পশ্চিম চালুক্যদের প্রাচীনতম অভিলেখটি আনুমানিক ৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। অভিলেখটি ছিল তারাবাদী প্রদেশের (অধুনা বিজয়পুর জেলা, কর্ণাটক) রাষ্ট্রকূট সামন্ত শাসক দ্বিতীয় তৈলপের। [23][24] আনুমানিক ৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ অপর একটি অভিলেখ থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মন্দিরনগরী বনবাসীর কদম্ব গোষ্ঠীপতির সহায়তায় চত্তিদেব নামে চালুক্যবংশীয় এক স্থানীয় রাজা বিদ্রোহের চেষ্টা করেছিলেন। সেই বিদ্রোহ সফল না হলেও[25] তা দ্বিতীয় তৈলপের পথ সুগম করে দেয়। হানগলের কদম্ব গোষ্ঠীপতির সাহায্যে তিনি রাষ্ট্রকূট সম্রাট দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত করেন।[26]
এই রাজনৈতিক উত্থানপতনের এক শতাব্দীকাল পূর্বেই মহৎ সংস্কৃত ও প্রাকৃত মহাকাব্য ও ধ্রুপদি সাহিত্যের যুগ সমাপ্ত হয়েছিল। এই বহুপ্রজ যুগে সাহিত্যের এক বিশাল সম্ভার স্থানীয় কন্নড় ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে।[27] রাষ্ট্রকূট রাজসভাতেই কন্নড় রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিল। চালুক্য রাজারাও সোৎসাহে এই ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। ইতিহাসবিদ অনন্ত সদাশিব আলতেকরের মতে, খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীর কর্ণাটক অঞ্চলের জৈনদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এই প্রভাবশালী জৈনরা যে শুধুমাত্র সেই যুগের কর্ণাটকের সাংস্কৃতিক জগতে আধিপত্যই করত তা-ই নয়, বরং স্থানীয় ভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিতেও আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।[28] ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের রিসার্চ ফেলো অধ্যাপক শৈলেন্দ্রনাথ সেনের মতে, চালুক্য শাসনে কন্নড় সাহিত্য “নিখুঁত রূপ” পরিগ্রহ করে।[29][30] গবেষক শেলডন পোলক ও জ্যঁ হবেন দাবি করেন যে, চালুক্য রাজ-অভিলেখমালার ৯০ শতাংশই কন্নড় ভাষায় রচিত, রাজসভার কথোপকথনের ভাষা সংস্কৃত হওয়ায় অভিলেখে এই হারে কন্নড়ের ব্যবহার অবশ্যই একটি লক্ষণীয় বিষয়।[31][32]
প্রাচীন কন্নড় সাহিত্যের যে নিদর্শনগুলি পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থটি হল কবিরাজমার্গ (কবিগণের রাজপথ, আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ)। এই গ্রন্থের পরবর্তী কয়েকশো বছর জৈন কন্নড় সাহিত্য সংস্কৃত আদর্শকেই আঁকড়ে ছিল। সাহিত্যের এই আদর্শটি সম্রাট কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ায় কাব্যের স্থানীয় রূপগুলির (যেমন ‘চট্টন’ ও ‘বেডন্ডে’ প্রভৃতি রচনাশৈলী)[33] মর্যাদাহানি ঘটে।[34] সংস্কৃত আদর্শ দ্বারা কন্নড় সাহিত্যের কণ্ঠরোধের সর্বোত্তম উদাহরণটি হল রন্নের শব্দকোষ রন্নকাণ্ড (৯৯০ খ্রিস্টাব্দ)। এই গ্রন্থে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য স্থানীয় কন্নড় শব্দগুলিকে সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করে নেওয়া হয়, যা ইঙ্গিত করে যে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে স্থানীয় ভাষার শুদ্ধ রূপটিকে সংস্কৃতের সমতুল্য জ্ঞান করা হত না।[35] এই কারণেই পৃষ্ঠপোষক রাজার গুণকীর্তন করার সময় জৈন কন্নড় সাহিত্যিকেরা গদ্যের মধ্যে মধ্যে চিত্তাকর্ষক সংস্কৃত শ্লোক প্রকীর্ণ করে দিতেন। পৃষ্ঠপোষককে হিন্দু মহাকাব্যের নায়কদের সঙ্গে তুলনা করার রেওয়াজ ছিল। পম্প রচিত বিক্রমার্জুন বিজয় বা পম্প ভারত (হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের কন্নড় পুনর্কথন, ৯৪১ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রকূট সামন্ত বেমুলবাদের চালুক্য রাজা অরিকেশরীকে পাণ্ডব রাজপুত্র অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অন্যদিকে রন্নের সাহসভীমবিজয় বা গদাযুদ্ধ (এটিও মহাভারতেরই পুনর্কথন, ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যে পৃষ্ঠপোষক রাজা সত্যাশ্রয়কে তুলনা করা হয়েছে অপর পাণ্ডব রাজকুমার ভীমের সঙ্গে।[36]
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলচুরি শাসনকালে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক ধ্যানধারণার প্রচলন ঘটে, তার দলে মার্গ শৈলীর সাহিত্য জনপ্রিয়তা হারায়। প্রতিবাদী বীরশৈব মতাবলম্বী কবিরা শুদ্ধ কন্নড় ভাষায় কাব্য রচনা শুরু করেন। অধিকন্তু এই মতাবলম্বীরা একদা রাজা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রামাণ্য বলে স্বীকৃতি সাহিত্যশৈলীটির উচ্ছেদ কল্পে সমাজের নিম্নবর্ণীয় কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনার কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দিতে থাকেন।[37] এই কারণেই কথ্য কন্নড় ভাষায় স্থানীয় ছন্দে রচিত ‘বচন’ কবিতাগুলি জনসমাজে বিশেষ সাড়া ফেলে দেয়।[38] এইভাবে বীরশৈবরা যে নতুন ধর্মমত প্রচার করে তা বীরশৈব আন্দোলন নামে পরিচিত হয়।[39] বচন কাব্যসাহিত্যকে সাধারণভাবে সর্বভারতীয় ভক্তিবাদী সাহিত্যেরই অংশ মনে করা হয়। তবে বেশ কয়েকজন ‘বচনকার’ (বচন-রচয়িতা কবি) অতি গুহ্য ও ভক্তিবাদ-নিরপেক্ষ কবিতাও রচনা করেছিলেন।[40] বীরশৈব মতাদর্শ ও বচন কাব্যসাহিত্যের উৎসটি অস্পষ্ট। ঐতিহাসিক সাহিত্য বিশারদ ডি. আর. নাগরাজের মতে, এই প্রসঙ্গে আধুনিক গবেষকেরা দু’টি সাধারণ ধারণা পোষণ করেন। এল. বসবরাজ্য প্রমুখ গবেষকের মতে, বচন কাব্যসাহিত্যের উৎস সংস্কৃত উপনিষদ্ ও আগম শাস্ত্র; যদিও সেই ক্ষেত্রে এই মতের উদ্ভব আগে কেন ঘটেনি বা প্রতিবেশী তেলুগু-ভাষী অঞ্চলে প্রগতিবাদী শৈব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সেখানে বীরশৈব মতের প্রসার কেন ঘটেনি তা এই মত দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। অন্যদিকে চিদানন্দ মূর্তি, এম. এম. কলবুর্গি ও জি. এস. শিবরুদ্রাপ্পা প্রমুখের মতে, এই কাব্যধারার উৎস কর্ণাটক ভূখণ্ডেই ঘটেছিল; সেই ক্ষেত্রেও এই ধারার স্বতন্ত্র প্রকৃতিটির ব্যাখ্যা এই বক্তব্য দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।[40]
পশ্চিম চালুক্য রাজত্বকালে উত্তরের কন্নড়-ভাষী অঞ্চলগুলিতে বচন সাহিত্যের জনপ্রিয়তার চাপে[41] দক্ষিণের কন্নড়-ভাষী অঞ্চলের বিশিষ্ট হৈসল রাজা বিষ্ণুবর্ধন (১১০৮-১১৫২ খ্রিস্টাব্দ) জৈনধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে দীক্ষাগ্রহণ করেন। এর ফলে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী দর্শন হৈসল-শাসিত অঞ্চলগুলিতে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রামানুজপন্থী শ্রী বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই অঞ্চলে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।[42] ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বীরশৈব সাহিত্যিকেরা রূপকধর্মী সাহিত্য, অভিলেখ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বচনকার কবিদের জীবনী রচনায় মনোনিবেশ অরেন। এই যুগে জৈন লেখকদের সঙ্গে বীরশৈব লেখকদের এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। সন্ন্যাসের প্রথাগত পৌরাণিক (দার্শনিক) বিষয়বস্তু থেকে জৈনদের দিক পরিবর্তনের প্রথম প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় হৈসল সাহিত্যিক নেমিচন্দ্র ও অণ্ডয়্যের রচনায়। নেমিচন্দ্র রচিত উপন্যাস লীলাবতী প্রভন্দম-এর (১১৭০ খ্রিস্টাব্দ) বিষয়বস্তু ছিল প্রেম, যৌনকামনা ও কামদেব কর্তৃক নিজ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শিবকে জয় করার কাহিনি। এই উপন্যাসটিই এই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা প্রথম বই। এরপর অন্দয়্য রচনা করেন কব্বিগর কব (কবির রক্ষাকর্তা, ১২১৫-১২৩৭ খ্রিস্টাব্দ); এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু হল কামদেব ও শিবের মধ্যে একটি যুদ্ধ।[43] এই সকল প্রয়াস সত্ত্বেও পরবর্তী কয়েক দশকে ও কয়েক শতাব্দীতে জৈন সাহিত্যের প্রভাব হ্রাস পায় এবং প্রধানত কন্নড়-ভাষী উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতেই এই সাহিত্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।[44] রত্নাকর বর্ণি (১৫৫৭) প্রমুখ যাযাবর লেখক কর্তৃক এর পরেও উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হয়েছে, কিন্তু এই সাহিত্যের সংখ্যা অল্পই ছিল।[45][46]
এই সময়ই দ্বিতীয় নাগবর্মা কন্নড় ব্যাকরণ বিষয়ক গ্রন্থ কর্ণাটকভাষাভূষণ (কর্ণাটক ভাষার অলংকার, ১০৪২ বা ১১৪৫) রচনা করেন। কন্নড় সাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থটি একটি দিকনির্দেশক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের মাধ্যমেই কন্নড় ভাষা সুসংহত রূপ পরিগ্রহ করে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ও প্রাকৃতের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত ভাষাগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।[47] সংস্কৃত ভাষায় কন্নড় ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সমসাময়িক কালের সংস্কৃত পণ্ডিতরা সংস্কৃত ভাষাকে সাধারণ মানুষের ভাষা বলে এবং এই ভাষার ব্যাকরণকে অনুন্নত বলে যে অভিযোগ উত্থাপন করতেন, তা এই গ্রন্থে খণ্ডিত হয়।[48] চালুক্য পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি এই যুগের কন্নড় কবি ও সাহিত্যিকেরা পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের প্রতিবেশীর রাজ্যের রাজসভাতেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। হৈসল, দক্ষিণ কলচুরি, সেউণ, গঙ্গ ও শিলাহার রাজবংশ সাগ্রহে অভিলেখে কন্নড় ভাষা ব্যবহার করত এবং কন্নড় সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করত।[49][50][51]
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট কন্নড় কবি ও সাহিত্যিক (৯৭৩-১২০০ খ্রিস্টাব্দ) | |
রন্ন | ৯৮২ |
নেমিচন্দ্র | ৯৯০ |
মনসিজ | দশম শতাব্দী |
চন্দ্রভট্ট | দশম শতাব্দী |
মদীরাজ | দশম শতাব্দী |
কবিতাবিলাস | দশম শতাব্দী |
কন্নময়্য | দশম শতাব্দী |
জয়কীর্তি | ১০০০ |
চন্দ্ররাজ | ১০২৫ |
দুর্গসিংহ | ১০৩১ |
দ্বিতীয় চাবুণ্ডরায় | ১০২৫ |
শ্রীধরাচার্য | ১০৪৯ |
দ্বিতীয় নাগবর্মা | ১০৪২ |
শান্তিনাথ | ১০৬৮ |
গুণচন্দ্র | ১০৭০ |
নাগবর্মাচার্য | ১০৭০ |
হরিবর্মা | ১০৭০ |
নারায়ণ দেব | একাদশ শতাব্দী |
গুণবর্মা | ১০৭০-১১০০ |
নয়সেন | ১১১২ |
কোন্ডাগোলি কেশীরাজ | ১১২০ |
রাজকুমার কীর্তিবর্মা | ১১২৫ |
ব্রহ্মশিব | ১১২৫ |
কর্ণপার্য | ১১৪৫ |
জগদ্দল সোমনাথ | ১১৫০ |
কয়েকজন বিশিষ্ট কন্নড় ‘বচন’ কবি (তিন শতাধিক কবির মধ্যে থেকে) (খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী) | |
মদর চেন্নইয়া | একাদশ শতাব্দী |
দোহর কক্কইয়া | একাদশ শতাব্দী |
দেবর দেসিমাইয়া | ১০৪০ |
দুগ্গলে | ১০৪০ |
অল্লম প্রভু | ১১৬০ |
বসব | ১১৬০ |
অক্ক মহাদেবী | ১১৬০ |
গঙ্গাম্বিকে | ১১৬০ |
নীলাম্বিকে | ১১৬০ |
নাগলম্বিকে | ১১৬০ |
চেন্নবসব | ১১৬০ |
সিদ্ধরাম | ১১৬০ |
মদিবল মচয়্য | ১১৬০ |
অম্বিগেরে চৌদিয়া | ১১৬০ |
মদর ধুলিয়া | ১১৬০ |
হেন্দদ মারিয়া | ১১৬০ |
তুরুগাহি রমন্ন | ১১৬০ |
কন্নড়ি রেম্মিতন্ডে | ১১৬০ |
রেবন্ন সিদ্ধ | ১১৬০ |
উরিলিঙ্গ পেড্ডি | ১১৮০ |
বহুরূপী চৌদাইয়া | একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী |
সত্যক্ক | ১১৬০ |
অমুগে রয়ম্ম | ১১৬০ |
কেদিবে রেমব্ব | ১১৬০ |
মুকতয়ক্ক | ১১৬০ |
রাজকুমারী বোনতা দেবী | ১১৬০ |
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর শেষভাগে কর্ণাটক ভূখণ্ডে একটি নতুন সাম্রাজ্য সংগঠিত হচ্ছিল। সেই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দ্বিতীয় তৈলপ এবং উত্তরসূরি রাজা সত্যাশ্রয় প্রতিবেশী দক্ষিণ কোঙ্কণের শিলাহার, গুজরাতের চালুক্য, মধ্য ভারতের পরমার ও তঞ্জাবুরের চোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত হয়ে পড়েন।[24] কিন্তু এই জাতীয় রাজনৈতিক উত্থানপতনের দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই কন্নড় সাহিত্য রাজসভায় বিকাশ লাভ করতে থাকে। এই যুগের প্রধান সাহিত্যিক ছিলেন রন্ন। তিনি মুধোল শহরের এক চুড়িবিক্রেতার গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসবিদ কে. এ. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী ও শৈলেন্দ্রনাথ সেন রন্নকে ‘কন্নড় সাহিত্যের ত্রিরত্ন’-এর অন্যতম মনে করেন (অপর দুই রত্নের নাম পম্প ও পোন্ন)। রন্ন ছিলেন রাজা দ্বিতীয় তৈলপ ও রাজা সত্যাশ্রয়ের সভাকবি। প্রথম জীবনে রন্নের পৃষ্ঠপোষকতা করেন বিশিষ্ট গঙ্গ মন্ত্রী চাবুণ্ডরায়।[29][52][53][54] দ্বিতীয় জৈন তীর্থংকর অজিতনাথের জীবনী অবলম্বনে রন্ন অজিতপুরাণ (৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। যদিও রন্নের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল সাহসভীমবিজয় (অপর নাম গদাযুদ্ধ, ৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)। এই গ্রন্থটি হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের একটি জৈন পাঠান্তর। এতে পাণ্ডব রাজপুত্র ভীমের সঙ্গে কৌরব রাজপুত্র দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের বর্ণনায় কবি অসাধারণ কবিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।[55][56]
পম্প নিজের রচনায় অর্জুন ও কর্ণের মাহাত্ম্য কীর্তন করলেও রন্ন নিজের পৃষ্ঠপোষক রাজা সত্যাশ্রয়ের স্তুতি করেছেন এবং সত্যাশ্রয়কে ভীমের সঙ্গে তুলনা করে ভীমকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অবসানে সিংহাসনারূঢ় অবস্থায় চিত্রিত করেছেন। তিনি ভীমের প্রতিদ্বন্দ্বী দুর্যোধনকে ‘মহানুভব’ বলে উল্লেখ করেন। কন্নড় ভাষায় শোকগাথামূলক কবিতার (যাকে ‘শোক গীত’ বা ‘চরম গীত’ বলা হত) আদি নিদর্শন এই গ্রন্থেই পাওয়া যায়: যার মধ্যে কয়েকটি হল ভ্রাতা দুঃশাসন, সুখ-দুঃখের বন্ধু কর্ণ ও অর্জুনের বীর পুত্র অভিমন্যুর মৃতদেহ দেখে দুর্যোধনের বিলাপ।[57] বিবরণের রচনাভঙ্গি, ভাষা, শব্দচয়ন ও শৈলীর দিক থেকে রন্ন যে কৃতিত্ব দেখান তাতে তিনি কন্নড় সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে আসন অর্জন করেন।[56] কন্নড় ভাষায় রচিত প্রাচীনতম শব্দকোষ রন্নকাণ্ড-ও (৯৯০ খ্রিস্টাব্দ) রন্নের রচনা বলেই মনে করা হয়। এই গ্রন্থটির মাত্র একারোটি শ্লোক বর্তমানে পাওয়া যায়।[58] রন্নের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল চকেরেশ্বরচরিত ও পরশুরামচরিত। ইতিহাসবিদ সূর্যনাথ কামাথের মতে, অধুনালুপ্ত শেষোক্ত গ্রন্থটি সম্ভবত রন্নের প্রিয় সাহিত্যিক চবুন্দরায়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে রচিত একটি শোকগাথা।[59] সাহিত্যে অবদানের জন্য পৃষ্ঠপোষক রাজা রন্নকে ‘কবি চক্রবর্তী’ (‘কবিগণের সম্রাট’) উপাধি প্রদান করেছিলেন।[60]
দশম শতাব্দীর শেষভাগের অপর এক বিশিষ্ট লেখক ছিলেন নেমিচন্দ্র। তিনি কবিরাজ কুঞ্জর ও লীলাবতী (আনুমানিক ৯৯০) রচনা করেন। শেষোক্ত কাব্যটির নায়ক ও নায়িকা ছিলেন জয়ন্তীপুরার (অধুনা বনবাসী, কর্ণাটক) রাজপুত্র কবদর্প দেব ও রাজকন্যা লীলাবতী।[61] দশম শতাব্দীর শেষভাগের কয়েকজন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মগুলি আর পাওয়া যায় না। এই সাহিত্যিকদের মধ্যে কবিতাবিলাস (রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত), মদিরাজা, চন্দ্রভট্ট, কন্নময়্য ও মনসিজের নাম পাওয়া যায় চালুক্য মন্ত্রী দুর্গসিংহের রচনায়।[62][63][64] কুপ্পতুর ও হাবেরী অভিলেখে যথাক্রমে হরিবর্মা (১০৭০) ও নারায়ণ দেব নামে দুই জনপ্রিয় লেখকের শোকগাথা নথিবদ্ধ হয়েছে।[65]
কন্নড় ভাষাবিদ আর. নরসিংহাচার্যের মতে, পশ্চিম চালুক্য রাজত্বকালে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য রচিত হলেও একাদশ শতাব্দীতে তঞ্জাবুরের চোলেদের সঙ্গে চালুক্যদের বিবাদের প্রেক্ষিতে[66] কন্নড়-ভাষী অঞ্চলগুলির উপর বারংবার চোল আক্রমণের প্রভাব সম্ভবত সাহিত্যেও পড়েছিল।[62] উল্লেখযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যকর্মের অন্যতম ছিল চন্দ্ররাজা কর্তৃক ‘চম্পু’ ছন্দে রচিত মদনতিলক (১০২৫ খ্রিস্টাব্দ)। বাৎস্যায়নের সংস্কৃত কামসূত্র অবলম্বনে রচিত এই গ্রন্থটিই কন্নড় ভাষায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম রতিশাস্ত্র। যদিও আখ্যানটি রচিত হয়েছিল কবির পৃষ্ঠপোষক রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের (অপর নাম প্রথম জগদেকমল্ল) সামন্ত শাসক মচিরাজা[67] ও তদীয় পত্নীর কথোপকথনের আকারে এবং সেই যুগের কন্নড় ভাষার আধুনিকতম রূপ ‘পোসকন্নড়’-এ।[68][69] রাজা প্রথম সোমেশ্বরের (অপর নাম অহবমল্ল বা ত্রৈলোক্যমল্ল) পৃষ্ঠপোষকতায় জৈন ব্রাহ্মণ শ্রীধরাচার্য কন্নড় ভাষায় প্রাচীনতম জ্যোতিষ গ্রন্থ জাতকতিলক রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্টের সংস্কৃত রচনা থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছিলেন। শ্রীধরাচার্যের অপর গ্রন্থ চন্দ্রপ্রভা চরিতে ছিল একটি রম্যরচনা, কিন্তু এই গ্রন্থটি বর্তমানে অবলুপ্ত।[69][67]
রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের আশ্রিত শৈব ব্রাহ্মণ দ্বিতীয় চবুন্দরায় ‘চম্পু’ ছন্দে লোকোপকার রচনা করেন। এটিই কন্নড় ভাষায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম বিশ্বকোষ, যার মধ্যে স্থানে স্থানে কাব্যের স্পর্শও রয়েছে। বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বিশ্বকোষটির জনপ্রিয়তা তথ্যসূত্র হিসেবে পরেও অব্যাহত ছিল। দৈনন্দিন জীবন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, ‘পঞ্চাঙ্গ ফল’ (ভারতীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী), ভাস্কর্য, ভবন ও জলাধার নির্মাণ (‘বাস্তু বিচার’ ও ‘উদকরগল’), অশুভ সংকেত, জলের ভবিষ্যকথন, ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’ (লতাপাতা ও গুল্ম থেকে ঔষধ প্রস্তুত), ‘বৈদ্য’ (সাধারণ ঔষধ), সুগন্ধি, রন্ধনশৈলী ও ‘বিষবৈদ্য’ (বিষ-সংক্রান্ত বিজ্ঞান) ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।[64][69] জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্য ইডলির উল্লেখ এতে পাওয়া যায় এবং কীভাবে মাষকলাই ঘোলে ভিজিয়ে রেখে, তা ভালো করে বেটে মশলা ও দইয়ের স্বচ্ছ জল মিশিয়ে ইডলি প্রস্তুত করতে হয় তার প্রণালীও দেওয়া আছে।[70]
রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের ‘সন্ধি বিগ্রহী’ (যুদ্ধ ও শান্তি-বিষয়ক মন্ত্রী) দুর্গসিংহ পৈশাচী ভাষায় গুণাঢ্যের লেখা বৃহৎকথা অবলম্বনে ‘চম্পু’ শৈলীতে বিখ্যাত পঞ্চতন্ত্র (১০৩১ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি রচনা করেন। মূল ভাষা থেকে এটিই ভারতের কোনও আঞ্চলিক ভাষায় এই উপকথার প্রথম অনুবাদ। এই গ্রন্থে মোট ষাটটি উপকথা রয়েছে, যার মধ্যে তেরোটি মৌলিক এবং প্রতিটি গল্পেরই সারকথা জৈন মতবাদ অনুযায়ী একটি নীতিবাক্য দ্বারা উল্লিখিত হয়েছে।[71] এছাড়াও দুর্গাসিংহ কর্ণাটক বনচতন্ত্র গ্রন্থটি রচনা করেন। এটি কন্নড় ভাষায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম টীকাগ্রন্থ, যাতে পঞ্চতন্ত্র-এ উদ্ধৃত সকল সংস্কৃত শ্লোকের সংক্ষিপ্ত টীকা দেওয়া হয়েছে।[71] এই সময়েই কন্নড় তত্ত্ববিদ জয়কীর্তি (আনুমানিক ১০০০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দ) ছন্দানুশাসন গ্রন্থে সংস্কৃত ও কন্নড় ভাষার কাব্যের ছন্দের নিয়মগুলি একই বলে মতপ্রকাশ করেন।[72][73]
একাদশ শতাব্দীর শেষভাগেও কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিদ্যমান ছিলেন। রাজা দ্বিতীয় সোমেশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তিনাথ সুকুমারচরিত (আনুমানিক ১০৬৮ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যটি রচনা করেছিলেন।[62] দ্বিতীয় সোমেশ্বরের সামন্ত রাজা উদয়াদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় বল্লিগাবির অদ্বৈতবাদী ব্রাহ্মণ সন্ত নাগবর্মাচার্য ‘শতক’ ছন্দে রচনা করেছিলেন চন্দ্রচূড়মণি শতক (আনুমানিক ১০৭০ খ্রিস্টাব্দ) কাব্য। এটি একটি শত-চরণবিশিষ্ট কবিতা, যার প্রতিটি চরণ সমাপ্ত হয়েছে শিবের অপর নাম ‘চন্দ্রচূড়মণি’ দ্বারা। এই কাব্যে কবি ‘বৈরাগ্য’ অর্থাৎ সন্ন্যাসের আদর্শ নিয়ে কথা বলেছেন।[69][74][75] অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গুণচন্দ্র ও গুণবর্মা। উভয়েরই রচনা বর্তমানে অবলুপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে সমসাময়িক সাহিত্যে উভয়ের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা দ্বিতীয় সোমেশ্বর (অপর নাম ভুবনৈক মল্ল) ছিলেন গুণচন্দ্রের গুণমুগ্ধ। গুণচন্দ্র রচনা করেছিলেন পার্শ্বাভ্যুদয় ও মেঘনাদীশ্বর।[76] বৈয়াকরণ কেশিরাজ (আনুমানিক ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ) গুণবর্মাকে হরিবংশ গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, গুণবর্মা ‘ভুবনৈক বীর’ উপাধি অর্জন করেছিলেন, যে উপাধি এক যোদ্ধার সঙ্গেই মানানসই, কবির সঙ্গে নয়। এই উপাধি দৃষ্টে কবিকে দ্বিতীয় সোমেশ্বেরের মন্ত্রী তথা সেনাধ্যক্ষ উদয়াদিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যিনি ছিলেন এক গঙ্গ রাজকুমার। অন্যান্য যে রচনাগুলি গুণবর্মার রচনা বলে উল্লিখিত হয় সেগুলি হল পুষ্পদন্ত পুরাণ ও দেবচন্দ্র প্রভা স্তোত্র।[76]
পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যে দ্বাদশ শতাব্দী ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ। চারুকলার পৃষ্ঠপোষক রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক বিকাশ বিশেষ গতি লাভ করে। ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের পর যে পঞ্চাশ বছর ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন তা মধ্যযুগীয় কর্ণাটকের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে আখ্যাত হয়। তিনি চালুক্য অভিলেখমালায় শকাব্দের ব্যবহার বন্ধ করে ‘বিক্রম বর্ষ’-এর (বিক্রমাব্দ) ব্যবহার শুরু করেন।[77] অধিকাংশ বিশিষ্ট কন্নড় ও সংস্কৃত সাহিত্যিক ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের রাজসভা অলংকৃত করতেন।[78] এই যুগেই নয়সেন (গ্রন্থরচনার কাল গবেষক ডি. আর. নাগরাজ ও শেলডন পোলকের মতে দশম শতাব্দীর এবং ই. পি. রাইস ও আর. নরসিংহাচার্যের মতে আনুমানিক ১১১২ খ্রিস্টাব্দ[79][80] রচনা করেন ধর্মামৃত। এই গ্রন্থে নীতিকথামূলক ও রূপকধর্মী পনেরোটি কাহিনি রয়েছে। জৈন উপদেশধর্মী এই কাহিনিগুলির মধ্যে কয়েকটি সুপরিচিত কাহিনি হল “যজ্ঞদত্ত ও নেউল”, “কাপালিক ও হস্তীশাবক” এবং “সাপ, বাঘ, বাঁদর ও স্যাঁকরা, যারা কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল”।[81] এই গ্রন্থটি এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসামূলক গ্রন্থ, যেখানে লেখক প্রতিটি সমসাময়িক ধর্মকে সমালোচনা করেছেন এবং বাহ্য সাংস্কৃতিক প্রভাবে (যেমন হিংসাত্মক ও রক্তক্ষয়ী আচার-অনুষ্ঠান ও জাতিভেদ প্রথা) মূল জৈন ধর্মবিশ্বাসে যে দূষিতকরণের ঘটনা ঘটেছিল তার তীব্র নিন্দা করেন।[80]
ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সভাকবি ব্রহ্মশিব সময়পরিক্ষে (মতবাদ বিশ্লেষণ, আনুমানিক ১১২৫) গ্রন্থটি রচনা করে পৃষ্ঠপোষক রাজার কাছ থেকে ‘কবিচক্রবর্তী’ (‘কবিগণের সম্রাট’) উপাধি অর্জন করেছিলেন। এই দার্শনিক গ্রন্থে প্রচারণামূলক ব্যঙ্গ ও হাস্যরসের স্পর্শ রয়েছে। লেখকের উদ্দেশ্য ছিল জৈনধর্মের গুণাবলিকে সকল সমসাময়িক ধর্মমতের ঊর্ধ্বে স্থান প্রদান।[82][83] ব্রহ্মশিব কন্নড়-ভাষী অঞ্চলের জনসমাজের সমকালীন জীবন ও ধর্মমতকে চিত্রিত করেন। তিনি হিন্দুধর্মের এবং কোলাপুরে তীর্থংকর চন্দ্রপ্রভর একটি মন্দিরকে হিন্দু দেবী মহালক্ষ্মীর মন্দিরে রূপান্তরণের সমালোচনা করেন। কোনও পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলে সেই ক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় বহুত্ববাদের অস্তিত্বের বিষয়েও আপত্তি উত্থাপন করেন। দক্ষিণ ভারতে জৈনধর্মের জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং বীরশৈব আন্দোলনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি নিয়ে তিনি বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন।[84] ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজকুমার কীর্তিবর্মা রচনা করেন গোবৈদ্য (গবাদি পশুর ঔষধ)। এটিই হল কন্নড় ভাষায় প্রাপ্ত প্রথম পশুচিকিৎসা-সংক্রান্ত গ্রন্থ, যাতে ঔষধ ও জাদুবিদ্যা সহযোগে চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে।[82]
ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের উত্তরসূরি তৃতীয় সোমেশ্বর ও দ্বিতীয় জগদেকমল্লও কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।[85] কর্ণাপর্য দ্বাবিংশ তীর্থংকর নেমিনাথের জীবন অবলম্বনে ‘চম্পু’ ছন্দে রচনা করেন নেমিনাথপুরাণ (আনুমানিক ১১৪৫)। এই গ্রন্থে জৈন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত ও হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।[86] জগদ্দল সোমনাথের কর্ণাটক কল্যাণকারক (পূজ্যপাদের সংস্কৃত রচনা কল্যাণকারক-এর অনুবাদ, ১১৫০) হল কন্নড় ভাষায় রচিত প্রথম ঔষধ-সংক্রান্ত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে সম্পূর্ণ নিরামিষ ও সুরার সংশ্রবমুক্ত খাদ্যের নিদান দেওয়া হয়েছে।[86][87]
কন্নড় ব্যাকরণের প্রাপ্ত প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে কবিরাজমার্গ (৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থের একাংশে এই ভাষার ব্যাকরণের প্রাচীনতম কাঠামোটির সন্ধান মেলে।[88] এই গ্রন্থে স্থানে স্থানে যে ‘পূর্বাচার্যর’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে তা থেকে মনে করা হয় ইতিপূর্বেও এই ভাষায় বৈয়াকরণ বা ছন্দবিদদের আবির্ভাব ঘটেছিল।[48] যদিও দ্বিতীয় নাগবর্মাকেই প্রাচীনতম বিস্তারিত কন্নড় ব্যাকরণের রচয়িতার মর্যাদা দেওয়া হয়। পূর্বসূরি লেখকদের মধ্যে সঙ্কবর্মা ও প্রথম নাগবর্মার (প্রাপ্ত গ্রন্থ ছন্দোম্বুধি, আনুমানিক ৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ[89]) নাম তিনি উল্লেখ করেছেন কন্নড় ব্যাকরণের অগ্রপথিক হিসেবে।[48] দ্বিতীয় নাগবর্মার সঠিক সময়কাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কন্নড় ভাষায় একই নামের এক লেখকের লেখা বর্ধমান পুরাণম্ (বর্ধমানের জীবনী, আনুমানিক ১০৪২) আবিষ্কারের পূর্বাবধি ই. পি. রাইস, আর. নরসিংহাচার্য ও কে. এ. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী সহ অধিকাংশ গবেষকের ধারণা ছিল যে দ্বিতীয় নাগবর্মা দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের (১১৪৫ খ্রিস্টাব্দ) ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং চালুক্য রাজা দ্বিতীয় জগদেকমল্লের রাজসভার ‘কটকাচার্য’-এর (সভাকবি) পদ অলংকৃত করতেন।[90][91][92] যদিও পরবর্তীকালে সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার (১৯৮৮) গ্রন্থে এবং গবেষক ডি. আর. নাগরাজ ও শেলডন পোলকের রচনায় দ্বিতীয় নাগবর্মাকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ব্যক্তিত্ব তথা চালুক্য রাজা দ্বিতীয় জয়সিংহের (যিনি ‘জগদেকমল্ল’ উপাধি ধারণ করেছিলেন) সভাকবি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[48][93]
তবে তিনি কোন সময়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা ধর্তব্যের মধ্যে না এনেও বলা যায় যে কন্নড় সাহিত্যে খুব অল্প লেখকই দ্বিতীয় নাগবর্মার মতো এতগুলি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।[90][92] ব্যাকরণ, কাব্য, ছন্দ ও শব্দকোষ-সংক্রান্ত যে গ্রন্থগুলি তিনি রচনা করেছিলেন সেগুলি সবই প্রামাণ্য এবং কন্নড় ভাষার চর্চায় সেগুলির গুরুত্বও সুবিদিত। প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যালোকন (শিল্প ও কাব্য-বিষয়ক সন্দর্ভ) গ্রন্থটি ব্যাকরণ, কাব্যতত্ত্ব ও ছন্দ নিয়ে রচিত এবং নতুন পথ প্রদর্শনকারী এই গ্রন্থে কন্নড় ব্যাকরণের সকল গুরুত্বপূর্ণ দিকই আলোচিত হয়েছিল। এই বইটির প্রথম অংশটির নাম শব্দস্মৃতি। এই অংশে পাঁচটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যথাক্রমে ধ্বনিমাধুর্যগত শব্দমিশ্রণ, বিশেষ্য, যৌগিক বাক্য, বিশেষ্যসম্বন্ধী শব্দ-ব্যুৎপত্তি ও ক্রিয়াপদ। সংস্কৃত বৈয়াকরণ দণ্ডী ও ভমহের পূর্ববর্তী রচনা অবলম্বনে এটি লিখিত হয়। দ্বিতীয় নাগবর্মা সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন কর্ণাটক ভাষাভূষণ নামে একটি সুসংহত ও বিস্তারিত কন্নড় ব্যাকরণ গ্রন্থ। এই বইটি রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের কতন্ত্র শাখার মৌলিক কাঠামো অবলম্বনে।[48] কন্নড় ব্যাকরণে অবদানের জন্য দ্বিতীয় নাগবর্মাকে সাতবাহন যুগের বিশিষ্ট সংস্কৃত বৈয়াকরণের নামানুসারে ‘সর্ববর্মা’ উপাধি প্রদান করা হয়।[47] দ্বিতীয় নাগবর্মার লেখা অভিধান বাস্তুকোষ গ্রন্থটি একটি শব্দকোষ। এই গ্রন্থে প্রায় আট হাজার সংস্কৃত শব্দের কন্নড় প্রতিশব্দ দেওয়া হয়েছে। মনে করা হয় যে, এই গ্রন্থ রচনার ফলেই কন্নড় ভাষা সংস্কৃত-প্রধান সাহিত্য জগতে নিজ স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।[94][95] আধুনিক কন্নড় কবি গোবিন্দ পৈয়ের মতে অবশ্য কর্ণাটক ভাষাভূষণ গ্রন্থের রচয়িতা অপর এক নাগবর্মা, যিনি দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের ব্যক্তি ছিলেন।[48]
দ্বাদশ শতাব্দীতে জাতিভেদ প্রাথা-দীর্ণ কর্ণাটক ভূখণ্ডে একেশ্বরবাদী শিব-উপাসক বীরশৈব বা লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের উল্কাবৎ উত্থানের একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিদ্যমান। এই সম্প্রদায় যাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল, তারা ছিল মৌলিক শিক্ষার অধিকার-বঞ্চিত সমাজে নিম্নবর্গের মানুষজন।[96] এই আন্দোলনের মূল কথা ছিল মন্দির-কেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠান বর্জন এবং মূলধারার সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যের একচেটিয়া কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান। বীরশৈব কবিদের বচন কাব্যসাহিত্যে এই কথাই ব্যক্ত হয়েছে। কন্নড় গবেষক এইচ. এস. শিব প্রকাশের মতে, সম্ভবত তামিল-ভাষী অঞ্চলের ৬৩ জন নায়নমার (শিবভক্ত কবি, পঞ্চম-দশম শতাব্দী) সন্তকবির প্রভাব এই আন্দোলনের উপর পড়েছিল। বীরশৈবেরা শিবের প্রথাগত মূর্তির পূজা করত না, বরং একটি শিবলিঙ্গ গলায় ঝুলিয়ে রাখত।[18][97] বচন কাব্যসাহিত্যের (অপর নাম ‘অনুভব’ বা অতিন্দ্রীয়বাদী অথবা ‘শরণ’ বা ভক্তের সাহিত্য) সূত্রপাত কন্নড় ভাষায় একটি স্বতন্ত্র ধারার সূচনা ঘটায়। যদিও এই কবিতার উৎপত্তি ঘটেছিল খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতেই।[18][98]
একাদশ শতাব্দীর তিন ‘বচনকার’ কবির কয়েকটি কবিতা পাওয়া গিয়েছে। এইচ. এস. শিব প্রকাশের মতে, প্রথম বচনকার ছিলেন মদর চেন্নইয়া নামে এক সন্ত। প্রথম জীবনে মুচির কাজ করা চেন্নইয়াকে বসব সহ পরবর্তী দ্বাদশ শতাব্দীর কবিরা অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। চেন্নইয়ের মাত্র দশটি কবিতাই বর্তমানে পাওয়া যায়। এই কবিতাগুলিতে তিনি মুচির ব্যবসা থেকে রূপকালংকার গ্রহণ করে জাতিভেদ প্রথার নিন্দা করেছেন।[99] দ্বিতীয় কবি ছিলেন দোহর কক্কইয়া। জন্মসূত্রে দলিত কক্কইয়ার ছয়টি কবিতা পাওয়া যায়, যেগুলি স্বীকারোক্তিমূলক। এই বিষয়বস্তু পরবর্তীকালে বসবের কবিতার মধ্যেও দেখা গিয়েছে।[100] দেবর দাসিমাইয়ার (বা জেদর দাসিমাইয়া, ১০৪০) দেড়শোটি কবিতা পাওয়া গিয়েছে বলে তিনি তুলনামূলকভাবে বেশি পরিচিতি লাভ করেন। প্রবাদ-প্রবচন ও রূপকালংকারের চতুর ও সংক্ষিপ্ত প্রয়োগের মাধ্যমে এই কবিতাগুলিতে শিবের প্রতি একেশ্বরবাদী ভক্তিতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। দাসিমাইয়ার স্ত্রী দুগ্গলেকে প্রথম কন্নড় মহিলা কবি আখ্যা দেওয়া হয়, যদিও দুগ্গলের অল্প কয়েকটি কবিতাই পাওয়া গিয়েছে।[100]
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলচুরিরা তাদের অধিরাজ পশ্চিম চালুক্যদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে চালুক্য রাজধানী কল্যাণী দখল করে নেয়।[101] তিন দশকব্যাপী (১১৫৩-১১৮৩) এই অশান্ত যুগে বীরশৈবধর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[102][103] এইচ. এস. শিব প্রকাশের মতে, কলচুরি যুগটি ছিল মধ্যযুগীয় কন্নড় সাহিত্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।[104] কলচুরি রাজা দ্বিতীয় বিজ্জলের প্রধানমন্ত্রী ও সমাজ সংস্কারক বসবকে (বা বসবন্ন) সাধারণভাবে এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণা মনে করা হয়।[105] এই ধারার শতাধিক কবির মধ্যে অন্যান্য সুপরিচিত কবিরা ছিলেন অল্লম প্রভু, চন্নবসব, সিদ্ধরাম, অক্ক মহাদেবী ও কোন্ডুগোলি কেশিরাজ।[15][16]
কল্যাণীতে ‘অনুভব মন্তপ’ নামে ধর্মালোচনার এক কেন্দ্রে ভক্তেরা সমবেত হয়ে তাদের অতিন্দ্রীয়বাদী অভিজ্ঞতাগুলির কথা আলোচনা করত।[106] এখানে তারা তাদের শিবভক্তি প্রকাশ করত ‘বচন’ নামে পরিচিত এক শ্রেণির সরল কবিতার মাধ্যমে। এই কবিতাগুলি ছন্দোময়, শ্লেষাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক গদ্যের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ, যার মাধ্যমে ধনসম্পদ, অনুষ্ঠান ও পুথিগত বিদ্যার অসারতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হত।[20][21] এই ধরনের অনেক কবিতাই অজ্ঞাতনামা কবির রচনা, কিন্তু কবির নাম চিহ্নিত করা যায় কবিতাগুলিতে উল্লিখিত শিবের এক-একটি স্বতন্ত্র নামোল্লেখ দেখে।[107]
বসব (বা বসবন্ন, ১১০৬-১১৬৭) বসবন বাগেবাডি শহরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। উপনয়ন সংস্কার প্রত্যাখ্যান করে তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং কৃষ্ণা ও ঘটপ্রভা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত কূডল সঙ্গম তীর্থে (অধুনা কর্ণাটকের বাগলকোট জেলায় অবস্থিত) উপস্থিত হন। ইতিহাসবিদ পি. বি. দেসাইয়ের মতে, কূডল সঙ্গমেই গুরু ঈশান্যগুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বসব নিজের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন।[108] বসবের জীবন কর্ণাটকের ইতিহাসে একটি মাইলফলক সূচিত করেছিল। তিনি ছিলেন এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। শান্তিস্থাপনে বসবের উৎসাহ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড, এবং সেই সঙ্গে মানবসমাজে সাম্য স্থাপনে বসবের প্রভাব সমাজে এক দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সূচিত করে।[109]
বসবের জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় অনেক কন্নড় রচনা থেকেই। এগুলির মধ্যে সর্বপ্রাচীন রচনাগুলি বসবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রচিত হয়। হৈসল কবি হরিহরের লেখা বসবরাজদেবর রাগালে হল বসবের প্রথম জীবনী যার কথা জানা যায়। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কবি-লেখক ভীম কবির বসবপুরাণ (১৩৬৯), সিঙ্গিরাজার অমল বসবচরিতে (১৫০০) এবং বিজয়নগরের মন্ত্রী লক্কন দণ্ডেসের শিব তত্ত্বচিন্তামণি (১৪২৫-১৪৫০) হল অপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উৎস।[109] বসবের দর্শনের মূল কথাটি হল “কর্ম-পূজাই স্বর্গ”, তিনি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক পূজার ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মানবদেহকে ঈশ্বরের মন্দির হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি কর্মের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধ জীবনের কথা খুব জোর দিয়ে প্রচার করেন।[110][111] কবি হিসেবেও কন্নড় সাহিত্যে বসবের স্থান অতি উচ্চ। দক্ষতার সহিত লিখিত কবিতাগুলি তিনি শেষ করেছেন ‘কূডলসঙ্গমদেব’ (অর্থাৎ ‘দুই নদীর সঙ্গমস্থলের দেবতা’, শিবের যে রূপ বসব উপাসনা করতেন) শব্দটি দিয়ে। বসবের লেখা প্রায় ১,৩০০ কবিতা পাওয়া যায়, যেগুলিকে এইচ. এস. শিব প্রকাশ বর্ণনা করেছেন গীতিধর্মী, ব্যঙ্গাত্মক, গভীরভাবে চিন্তাশীল ও আত্মসমালোচনামূলক রূপে।[112]
একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতায় বসব এক সাপুড়ে ও তার বউয়ের ভণ্ডামির বর্ণনা দিয়েছেন; তারা তাদের ছেলের জন্য পাত্রীর সন্ধানে বেরিয়ে এক অশুভ সংকেত দেখে ফিরে আসে, সেই অশুভ সংকেতটি ছিল আরেক সাপুড়ে আর তার বউ।[113] বসব নিজে রাজার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত এক মন্ত্রী হলেও কোনও কোনও কবিতায় তিনি রাজপদের প্রতি ঘৃণা ও শিবের প্রতি গভীর ভক্তি প্রকাশ করেছেন।[114][115]
বসবের একটি কবিতা নিম্নরূপ:[113]
“ | আমি এক। পাঁচজনে আমাকে পোড়াচ্ছে। অসহ্য, উপরে আগুন আমি দাঁড়াতে পারি না। যখন এক বাঘ এক বুনো ষাঁড়কে টেনে নিয়ে যায় তুমি উদ্ধার করতে পারো না, [হে] কূডলসঙ্গমদেব। |
” |
অল্লম প্রভু ছিলেন এক ভিক্ষাজীবী সন্ত-কবি। পত্নী কমলাতের অকালমৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। অল্লমের জন্ম হয়েছিল অধুনা কর্ণাটকের শিবমোগ্গা জেলার প্রাচীন শহর বল্লিগাবির এক মন্দির-বাদক পরিবারে। তিনি নিজেও ‘মদ্দলে’ বাদ্যযন্ত্রটি দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন।[116][117] পত্নীর মৃত্যুর পর শোকাতুর অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি সন্ত অনিমিসয়্যের সংস্পর্শে আসেন। অনিমিসয়্যই অল্লমকে সন্ন্যাসদীক্ষা প্রদান করেন।
১,৩২১টি প্রাপ্ত কবিতা অল্লমের নামাঙ্কিত। প্রতিটি কবিতাই শেষ হয়েছে ‘গুহেশ্বর’ (অর্থাৎ, ‘গুহার ঈশ্বর’, শিবের একটি রূপ) শব্দটি দিয়ে, কারণ কথিত আছে যে অল্লম একটি গুহায় পরমজ্ঞান লাভ করেছিলেন।[116] অল্লমের দুর্বোধ্য কবিতাগুলি দয়ালু ভাবে পরিপূর্ণ হলেও সেগুলির ব্যঙ্গাত্মক ও বিদ্রুপাত্মক দিক, কটুকাটব্য ও ‘সিদ্ধি’ (সাধনলব্ধ অলৌকিক ক্ষমতা) প্রত্যাখ্যান-মূলক বক্তব্যের জন্য পরিচিত। এইচ. এস. শিব প্রকাশ অল্লমের কবিতাগুলিকে জাপানি জেন কাব্যের ‘কোয়ান’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন।[118] ডি. আর. নাগরাজের মতে, অল্লমের অতিন্দ্রীয়বাদী কবিতাগুলি একটি স্বতন্ত্র বর্গভুক্ত, সেগুলিকে ‘ভক্তিমূলক’ কবিতা বলা যায় না, কারণ ভক্তিমূলক কবিতা সাধারণত সহজবোধ্য ভক্তিমূলক ভাবের দ্বারাই চিহ্নিত করা যায়।[119]
একদিকে বসবের উৎসাহ ও প্রভাবে কল্যাণীতে বীরশৈব আন্দোলন সংগঠিত হয় ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে, অন্যদিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী অল্লম ভক্তসমাবেশে পৌরোহিত্য করতে থাকেন।[120][121] পঞ্চদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট কন্নড় লেখক তথা বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের সভাসদ চমরস অল্লমের উপদেশ ও কীর্তির বিবরণ প্রভুলিঙ্গ লীলে (১৪৩০) গ্রন্থে প্রদান করেন; বইটি চমরসের পৃষ্ঠপোষক রাজার আদেশে তেলুগু ও তামিল অনূদিত হয় এবং পরে সংস্কৃত ও মারাঠিতেও অনূদিত হয়। একটি কাহিনি অনুযায়ী, অল্লমকে মনে করা হত হিন্দু দেবতা গণেশের অবতার এবং কথিত হয়েছিল যে গণেশজননী পার্বতী বনবাসীর এক রাজকুমারীর রূপ ধারণ করেছেন।[122][123] শূন্যসম্পদনে (১৪০০) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন গ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল অল্লমের জীবদ্দশায়। এই গ্রন্থে অল্লমের সঙ্গে অন্যান্য সমসাময়িক সন্তদের কথোপকথনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।[124]
অল্লম প্রভুর একটি কবিতা নিম্নরূপ:[125]
“ | আমি দেখেছিলাম সুগন্ধ দূর হয়েছিল যখন মৌমাছি এসেছিল, কী আশ্চর্য! আমি দেখেছিলাম বুদ্ধি দূর হয়েছিল যখন হৃদয় এসেছিল। আমি দেখেছিলাম মন্দির দূর হয়েছিল যখন ঈশ্বর এসেছিলেন। |
” |
ত্রিশ জনেরও বেশি মহিলা কবির মধ্যে অক্ক মহাদেবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি শিবমোগ্গা জেলার উডাটাডি (বা উডুগানি) শহরে এক বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সম্ভবত কৌশিক নামে এক সামন্ত রাজার সঙ্গে বলপূর্বক বিবাহও সম্পন্ন হয়েছিল। পরে অক্ক মহাদেবী জাগতিক সুখ ত্যাগ করে ভক্তি ও সন্ন্যাসের পথ অবলম্বন করেন।[113] অক্ক মহাদেবীকে প্রায়শই আণ্ডাল, লল্লেশ্বরী ও মীরাবাইয়ের মতো বিশিষ্ট মহিলা হিন্দু সন্ত-কবির সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং কন্নড় ভাষার মহিলা কবিদের মধ্যে এক উচ্চ স্থান প্রদান করা হয়।[126][127]
অক্ক মহাদেবী ৪৩০টি ক্ষুদ্র কবিতা রচনা করেছিলেন। এই কবিতাগুলিতে তিনি দিব্য প্রেমিক ‘চন্ন মল্লিকার্জুন’-এর (অর্থাৎ, ‘সুন্দর মল্লিকার্জুন’, শিবের একটি নাম) প্রতি প্রেম ব্যক্ত করেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শূন্যসম্পদনে গ্রন্থটি অক্ক মহাদেবীর জীবন-সংক্রান্ত তথ্যের প্রধান উৎস।[128] এই কবিতাগুলিতে জাগতিক সম্পদের প্রতি ঘৃণা এবং জাগতিক বিষয় থেকে বৈরাগ্যের কথা বলা হয়েছে। অক্ক মহাদেবীর একটি জনপ্রিয় কবিতায় এক রেশমকীটের উল্লেখ পাওয়া যায়: রেশমকীট রেশমগুটির জাল বোনে, তারপর নিজের জালে নিজেই আবদ্ধ হয়ে সেখান থেকে বেরোতে না পেরে মারা যায় – রেশমকীটকে ব্যক্তির সঙ্গে এবং রেশমের সুতোকে জাগতিক কামনাবাসনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এই কবিতায়। কৌতুক রসের একটি কবিতায় তিনি ইষ্টদেবতাকে ‘সুগন্ধিত জুঁইফুলের প্রভু’ বলে উল্লেখ করে বলেছেন যে, দেবতা যেন কামনার রেশমগুটি ছেদন করে কবিকে এক প্রজাপতির মতো মুক্ত করেন।[129]
কবিতার পাশাপাশি অক্ক মহাদেবী মন্ত্রগোপ্য ও যোগনগতৃবিধি নামে ক্ষুদ্র গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। শেষোক্ত গ্রন্থটি স্থানীয় ‘ত্রিপদী’ ছন্দে রচিত এবং এতে আধ্যাত্মিক জাগরণের নানা স্তরের বর্ণনা পাওয়া যায়।[130] কথিত আছে যে, অক্ক মহাদেবী বস্ত্র পরিধান করতেন না। এটি ছিল সন্ন্যাসের একটি নিয়ম, যেটিকে তিনি “সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন আধ্যাত্মিক অবস্থা” বলতেন।[131] ত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই পবিত্র শহর শ্রীশৈলমের একটি কলাবনে তিনি মারা যান।[132]
অক্ক মহাদেবীর লেখা একটি কবিতা হল:[127]
“ | তুমি হলে সমগ্র বন এবং বনের সকল পাখি ও পশু। হে চন্নমল্লিকার্জুন, তুমি সকলকে দুর্বলচিত্ত করো কিন্তু তুমি আমাকে তোমার মুখ দেখাচ্ছ না কেন? |
” |
বসবের ভ্রাতুষ্পুত্র চন্নবাসব একজন রণকৌশলবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে অধিকতর জনপ্রিয় ছিলেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ও দীর্ঘ ‘বচন’ কবিতা ছাড়াও তিনি মন্ত্রগোপ্য নামে একটি যোগ অনুভূতি-সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাবেশ ও বসবের ‘মহামনে’-র (‘মহৎ বসতবাটী’) ব্যবস্থাপক।[133] অপর প্রভাবশালী ভক্ত এবং সোন্নলিগের (অধুনা সোলাপুর, মহারাষ্ট্র) অধিবাসী সিদ্ধরামের নামাঙ্কিত তথা ‘ত্রিপদী’ ছন্দে লিখিত ১,৩৭৯টি কবিতা পাওয়া যায় (যদিও কথিত আছে যে তিনি ৬৮,০০০ কবিতা রচনা করেছিলেন)। এই কবিতাগুলি বসবের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত এবং এগুলিতেও অন্ধবিশ্বাস, জাতিভেদ প্রথা ও লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।[134]
কারিগর কবিদের মধ্যে রয়েছেন কাঠুরিয়া মোলিগে মারাইয়া, ধোপা মদীবল মচয়্য, মাঝি অম্বিগেরে চৌদিয়া, মুচি মদর ধুলিয়া, তাড়ি প্রস্তুতকারক হেন্ডদ মারিয়া, গোচারণকারী তুরুগাহি রমন্ন, আয়না প্রস্তুতকারক কন্নডি রেম্মিতান্ডে এবং মেষপালক রেবন্ন সিদ্ধ। যদিও এই শ্রেণির কবিদের তালিকা দীর্ঘতর।[135] দক্কেয় বোম্মাইয়া, বহুরূপী চৌদাইয়া, কলাকেতাইয়া ও নাগেয় মারিতান্ডে প্রমুথ প্রথাগত পথগায়ক কবিদের কবিতায় এই শ্রেণির জীবনযাত্রার ছবি পাওয়া যায়।[136]
অক্ক মহাদেবী ছাড়াও বেশ কয়েকজন মহিলা কবি এই যুগে কন্নড় সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। বসবের ভগিনী নাগলম্বিকে ও বসবের দুই পত্নী গঙ্গাম্বিকে ও নীলাম্বিকে ছিলেন বিশিষ্ট কবি। নীলাম্বিকে রচিত কবিতার সংখ্যা অধিকতর। সত্যক্ক, কেলব্বে, মহাদেবী ও লিঙ্গাম্মা, অমুগে রায়াম্মা ও অক্কম্মা, কাদিরে রেমব্ব এবং মুক্তয়ক্ক প্রমুখেরা ছিলেন বীরশৈব সমাবেশের পুরুষ কবিদের পত্নী। সত্যক্কের কবিতার গুণগত মান অক্ক মহাদেবীর কবিতার সঙ্গে তুলনীয়।[137] দলিত কবি কেলব্বের কবিতায় উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্গাম্বার কবিতা গুহ্য ভাষায় রচিত। অক্কম্মা কবিতা রচনা করেছেন ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। সুতা প্রস্তুতকারক কাদিরে রেমব্ব ‘বেডাগু’ নামে এক দুর্বোধ্য ভাষা নিজ কবিতায় প্রয়োগ করতেন। মুক্তয়ক্ক পৃষ্ঠপোষক সন্ত অল্লমের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।[137] এছাড়াও উল্লেখযোগ্য মহিলা কবিরা হলেন লক্কম্মা, কেতলদেবী, গুদ্দব্বে ও রাজকুমারী বোন্তাদেবী।[137]
বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক সমাজের মূল অংশের বিরুদ্ধাচারণ করে বীরশৈবেরা এক উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে এক নিম্নবর্ণীয় শূদ্র পাত্রের বিবাহের আয়োজন করে। এর ফলে বিদ্রোহী বীরশৈবদের সঙ্গে রক্ষণশীল উচ্চবিত্তদের যে সংঘাত বাধে তার চূড়ান্ত ফলস্রুতিতে রাজা দ্বিতীয় বিজ্জল নিহত হন এবং বসব সহ অধিকাংশ ভক্তকে কল্যাণী থেকে উচ্ছেদ করা হয়।[138] দ্বিতীয় বিজ্জলের উত্তরসূরিদের দুর্বলতার সুযোগে অন্নিগেরী থেকে শাসনকারী চালুক্য চতুর্থ সোমেশ্বর ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণী আক্রমণ করে নিজ সাম্রাজ্য পুনর্নির্মাণে প্রয়াসী হন। এই যুদ্ধে তিনি জয়ী হলেও সামগ্রিক প্রয়াসটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ সোমেশ্বরকে বনবাসীতে নির্বাসনে প্রেরণ করে সেউণ শাসকেরা চালুক্য শাসনের অবলুপ্তি ঘটান।[4][139] যদিও এই অশান্ত ঘটনাবলি বীরশৈব সমাবেশ ও কাব্যরচনার পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল, তবু এই আন্দোলন কন্নড় জনসমাজে স্থান করে নিতে পেরেছিল। সেই কারণেই পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বীরশৈবরা তাদের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।[106][138]
চালুক্য-পরবর্তী যুগে শৈব ও বৈষ্ণব ভক্তিমূলক সাহিত্য জনপ্রিয়তা বজায় রাখে, যদিও স্থানীয় ছন্দে ধর্মনিরপেক্ষ ও রাজসভা-বিষয়ক সাহিত্যও বিকাশ লাভ করতে থাকে। সেযুগের প্রচলিত স্থানীয় ছন্দগুলি ছিল ‘ষটপদী’ (ছয় পংক্তির কবিতা), ‘ত্রিপদী’, ‘রাগালে’ (অন্ত্যমিলযুক্ত দোঁহা) ও ‘সাঙ্গত্য’ (বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গেয় রচনা)।[140] সামগ্রিকভাবে কন্নড় সাহিত্য ‘মার্গ’ (‘নিয়মানুগ’, সংস্কৃত প্রভাবের কারণে) শৈলী থেকে ‘দেশি’ (‘স্থানীয়’) শৈলীতে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে।[12]
এই পরিবর্তন হৈসল সভাকবিদের রচনাতেও স্পষ্ট। এই কবিদের কয়েকজন স্থানীয় ছন্দে সাহিত্য রচনায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[141] মধ্যযুগের প্রধান কবিদের অন্যতম ছিলেন বীরশৈব কবি হরিহর। তিনি বসবের জীবনী (বসবরাজ দেবর রাগালে, ১১৬০) রচনার সময় ‘রাগালে’ প্রথাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গ্রন্থটিই কন্নড় ভাষায় রচিত তথা সামগ্রিকভাবে বসবের প্রথম জীবনী গ্রন্থ যেটি এখনও পাওয়া যায়।[142] হরিহরের ভ্রাতুষ্পুত্র রাঘবাঙ্ক পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের জীবনী অবলম্বনে হরিশ্চন্দ্র কাব্য নামে এক স্বতন্ত্র ও মৌলিক আখ্যায়িকায় ‘ষটপদী’ ছন্দটিকে প্রতিষ্ঠা করেন।[143] মনে করা হয় যে, সিসুময়ন স্বরচিত রূপক কাব্য ত্রিপুরদহন ও অঞ্জনচরিত-এ ‘সাঙ্গত্য’ (১২৩২) নামে এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন।[144] কোনও কোনও জৈন সাহিত্যিক ‘চম্পু’ শৈলীতে সাহিত্য রচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। যেমন জন্ন এই শৈলীতে যশোধর চরিতে (১২০৭) রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এই কাব্যটি ৩১০টি শ্লোকে রচিত স্বতন্ত্র ধারার এক কাহিনিগুচ্ছ, যেগুলির বিষয়বস্তু মর্ষকামিতা ও আত্মার রূপান্তর।[145] প্রাচীনতম সুপরিচিত ব্রাহ্মণ সাহিত্যিকেরাও দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এই লেখকদের রচনার মধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিমূলক রচনা (রুদ্রভট্টের জগন্নাথ বিজয়, ১১৮৫) থেকে কাব্যতত্ত্বের উপর ধর্মনিরপেক্ষ সন্দর্ভ (কবি বর্মার শৃঙ্গার রত্নাকর, কাব্যিক অনুভূতি ও রসবিচার প্রসঙ্গে) সবই রচিত হয়েছিল।[146]
কলচুরি সাম্রাজ্যের পতনের পর বচন কাব্যধারা সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে বীরশৈবরা প্রভাবশালী অবস্থানে আসে। বিশেষত রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের (বা প্রৌঢ় দেব রায়) রাজত্বকালে তাদের প্রভাব বিস্তৃত হয়।[147] এই যুগটি যদিও দ্বাদশ শতাব্দীর মতো বচন কাব্যধারার দ্রুত বিকাশের জন্য খ্যাতি অর্জন করেনি, তবু সমসাময়িক সাহিত্যিকেরা পূর্বকালের সন্ত ও ভক্তদের উপদেশগুলিকে গ্রহণ করে তাদেরই সাহিত্যের প্রধান চরিত্রে পরিণত করেন। মতপ্রচারের এক অনুকূল সময় বুঝে এই সাহিত্যিকেরা ভাষ্য, সংকলন ও জীবনী সাহিত্য রচনা শুরু করেন।[147][148] এই জীবনীসাহিত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা গ্রন্থগুলি হল বসবের জীবনী অবলম্বনে ভীমকবির বসবপুরাণ (১৩৬৯), সিঙ্গিরাজের মালা-বসবপুরাণ (বা সিঙ্গিরাজপুরাণ, ১৫০০), অল্লম প্রভুর জীবন অবলম্বনে চামরসের প্রভুলিঙ্গলীলে (১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং চেন্নবসবের জীবন অবলম্বনে বিরুপাক্ষ পণ্ডিতের চেন্ন বসবপুরাণ (১৫৮৪)।[149] বহু সংখ্যক সংকলন গ্রন্থের মধ্যে শূন্যসম্পদনে গ্রন্থটির চারটি পাঠান্তর সর্বাপেক্ষা পরিচিত। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থের প্রথম পাঠটি শিবগণপ্রসাদী মহাদেবাইয়া কর্তৃক সমাপ্ত হয়। এটি প্রধান চরিত্র সন্ত অল্লম প্রভু ও অন্যান্য বিশিষ্ট বীরশৈব ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কথোপকথনের আকারে রচিত। পরবর্তী পাঠগুলি সংকলন করেন হলগে আর্য (১৫০০ খ্রিস্টাব্দ), গুম্মলপুরা সিদ্ধলিঙ্গায়েতি (১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ) ও গুলুর সিদ্ধবীরনোদয় (১৫৭০ খ্রিস্টাব্দ)।[150] খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আবার ‘বচন’ কবিতা রচনা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যদিও কন্নড় ভাষায় এই ধারায় শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবির আবির্ভাব ঘটেছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে। ভিক্ষুক কবি-নীতিজ্ঞ ও সমাজ সংস্কারক সর্বজ্ঞ (ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতাব্দী) প্রায় ২,১০০টি নীতিমূলক কবিতা রচনা করে কন্নড় সাহিত্যে এক চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে যান। গ্রাম্য জনসাধারণকে উপদেশ দেওয়ার জন্য সরল ‘ত্রিপদী’ ছন্দে রচিত এই কবিতাগুলির বিষয় বর্ণাশ্রম থেকে ধর্ম, অর্থনীতি থেকে প্রশাসন, শিল্পকলা থেকে পারিবারিক জীবন ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি নানাবিধ। সর্বজ্ঞের কবিতাগুলির মধ্যে কয়েকটি কন্নড় ভাষার জনপ্রিয়তম রচনাগুলির অন্যতম।[151][152][153]
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের চার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ সাহিত্যিক কুমার ব্যাস, তিম্মন্ন কবি, কুমার বাল্মীকি ও চতু বিট্ঠলনাত হিন্দু মহাকাব্যগুলির নিজস্ব পুনর্কথনের মাধ্যমে ‘ষটপদী’ ছন্দটির দ্রুত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন।[154] ‘বচন’ কবিরা যে রকম গীতি-গদ্য মাধ্যমে নিজেদের কাব্য রচনা করতেন, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হরিদাস সম্প্রদায়-ভুক্ত কবিরাও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদনে ‘কীর্তনে’ (দু’টি ধুয়া-বিশিষ্ট গান – রাগ ও তালে নিবদ্ধ), ‘সুলাদি’ (ছন্দ-নির্ভর) ও ‘উগভোগ’ (সুর-নির্ভর) শৈলীতে কাব্য রচনা করতেন।[155] দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে (কর্ণাটকী সংগীত) এই কবিদের অবদান সুবিদিত। এই ধারার সর্বাধিক জনপ্রিয় দুই কবি ছিলেন পুরন্দর দাস ও কনক দাস। পুরন্দরদাস ছিলেন হরিদাস কবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অতিপ্রজ লেখক। তিনি ‘রাগালে’ ছন্দে সাহিত্য রচনা করতেন এবং ‘কর্ণাটক সংগীত পিতামহ’ উপাধি অর্জন করেছিলেন।[156] কনকদাস ছিলেন বিভিন্ন স্থানীয় ছন্দে পারঙ্গম। তিনি ‘সঙ্গত্য’ ছন্দে মোহন তরঙ্গিনী এবং ‘ষটপদী’ ছন্দে নলচরিত এবং শিশুদের জন্য নীতিশিক্ষামূলক হরিভক্তি-সার গ্রন্থগুলি রচনা করেন।[157]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.