Loading AI tools
বাংলাদেশে সড়ক পথে হতাহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দ্বারা সংগঠিত একটি আন্দোলন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
২০১৮-র নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ। ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।
২০১৮-র নিরাপদ সড়ক আন্দোলন | |||
---|---|---|---|
তারিখ | ২৯ জুলাই ২০১৮ - ৮ আগস্ট ২০১৮ | ||
অবস্থান | |||
কারণ | চালকের বেপরোয়া বাসচালনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু | ||
লক্ষ্য |
| ||
পদ্ধতি |
| ||
ফলাফল |
| ||
পক্ষ | |||
| |||
ক্ষয়ক্ষতি | |||
আহত | প্রায় ২০০ | ||
গ্রেপ্তার | ৯৭ |
শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও অবরোধ করতে চাইলেও দুর্ঘটনার পরদিন থেকেই পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে; পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও সরকার-সমর্থক বলে অভিযুক্ত যুবকেরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে। সরকার প্রচুর সংখ্যক আন্দোলনকারীকে এবং আন্দোলন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়ায় আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা দেশে ও বহির্বিশ্বে তীব্রভাবে নিন্দিত হয়।
পরবর্তীতে ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভা একটি খসড়া ট্রাফিক আইন অনুমোদন করে, যে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়; যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া চালনায় মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল। ৮ আগস্টের মধ্যে শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন সূত্রে বলা হয় যে নয় দিনের আন্দোলন থেমে গিয়েছে।
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ, রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসগুলোতে যা প্রকটভাবে দৃশ্যমান।[1][2][3] ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৫ হাজার মানুষ এবং আহত প্রায় ৬২ হাজার।[4] বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে; ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।[5]
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০১৮ সালে দেশে চলমান বৈধ গাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৪২ হাজার, কিন্তু বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ৯ লাখ গাড়ি লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা চালিত হয়। উপরন্তু দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার।[5] এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়তে থাকে। আন্দোলনের পূর্ববর্তী কয়েক মাসে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব,[6] বাসের হেলপার কর্তৃক নদীতে ফেলে দেয়া পায়েল,[7] বাসচাপায় আহত সৈয়দ মাসুদ রানা[8] ও সর্বশেষ বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী প্রমুখের মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে সমালোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সাম্প্রতিক এসব দুর্ঘটনার ফল বলে মনে করেন।[9]
২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং একটি বাস থামলে সেটাতে ওঠার চেষ্টা করে। সেসময় জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস বেশি-যাত্রী-পাওয়ার-জন্যে প্রতিযোগিতা করতে করতে অতিরিক্ত গতিতে এগিয়ে আসে, তার মধ্যে একটি বাস বেপরোয়াভাবে প্রথম বাসের পাশে ফুটপাথে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায়, তাতে ২ শিক্ষার্থী নিহত এবং আরো ১২ জন গুরুতর আহত হয়। পুলিশ পরে বাস তিনটির চালক, সহকারী এবং ঘাতক-বাসের মালিককে গ্রেপ্তার করে।[10][11][12]
কয়েক ঘণ্টা পরে সাংবাদিকরা এই ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সভাপতি শাজাহান খানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি হাসিমুখে বলেন যে "ভারতের মহারাষ্ট্রে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছেন। এখন সেখানে কী আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি, এগুলো কি ওখানে বলে?"[13] তার বক্তব্য দেশব্যাপী অত্যন্ত সমালোচিত হয় এবং আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তার ক্ষমাপ্রার্থনা ও পদত্যাগের দাবি তোলে।[14]
বিমানবন্দর সড়কের দুর্ঘটনার পর শহীদ রমিজউদ্দিন ও নিকটবর্তী অন্যান্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দোষী বাসচালকের বিচারের দাবিতে বিমানবন্দর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে এবং ঘাতক বাসসহ সড়কের অন্যান্য বাস ভাঙচুর করে।[15][16] ৩০ ও ৩১ জুলাই তারা নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে বিমানবন্দর সড়ক, উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি ও মতিঝিলে সড়ক অবস্থান নেয় এবং রেলস্টেশন অবরোধ করে; ফলে ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে নগর অনেকাংশে স্থবির হয়ে পড়ে।[17][18] পুলিশ সাঁজোয়া যান ও জলকামান নিয়ে ছাত্রদের ধাওয়া ও লাঠিপেটা করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাস ভাঙচুর করে। তবে তারা অ্যাম্বুলেন্স, স্কুলবাস, হজযাত্রী-বহনকারী গাড়ি ও প্রাইভেট কারকে ছেড়ে দেয়।
এরপর ১ থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে অসংখ্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে সড়কে অবস্থান, মানববন্ধন ও অবরোধের মাধ্যমে তাদের বিক্ষোভ জানান দিতে থাকে।[19] ২রা আগস্ট সরকার সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটসহ দেশের ৪২টি জেলায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। "উই ওয়ান্ট জাস্টিস", "আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাহিরে" প্রভৃতি স্লোগানে ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা সড়ক মুখরিত করে রাখে।
বিক্ষোভের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা শহরের ট্রাফিকও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গাড়ি আটকে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে; লাইসেন্সহীন চালক ও চলার অনুপযোগী গাড়িসমূহ ধরে ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ও তাদের মামলা নিতে বাধ্য করে। শিক্ষার্থীরা লাইসেন্স না থাকায় ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে বাণিজ্যমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারক, পুলিশের ডিআইজি প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে দেয়। পথচারীদের ট্রাফিক নিয়ম মানানো এবং স্থানবিশেষে রাস্তা পরিষ্কার ও সংস্কারও করতে দেখা যায় তাদের। সড়কে গাড়িগুলোকে তারা লেন অনুসারে চালনা করে এবং তৈরি করে অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপক গাড়ির জন্য ইমার্জেন্সি লেন যা ছিল বাংলাদেশে এই প্রথম। সাধারণ মানুষ তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা করে এবং ট্রাফিক নিয়েন্ত্রণে পুলিশ তাদের সহায়তা করে; অনেকস্থানে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফুল ও চকলেট বিনিময় হয়।[20] এর মাঝে ১লা আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সমর্থনে মানববন্ধন করে। ক্রমে ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থসাউথ, ইস্টওয়েস্ট, ইন্ডিপেন্ডেড বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়[note 1] ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও মানববন্ধন, ক্লাস বর্জন ও বিক্ষোভের মাধ্যমে আন্দোলনে অংশ নেয়। চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনসহ অন্যান্য নাগরিক সংগঠনগুলোও আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে মানববন্ধন করে; শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা সম্মতির পাশাপাশি রাস্তায়ও নেমেও সমর্থন জানান।[21][22]
সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়েছে জানিয়ে তাদের ফিরে যেতে বলে; কিন্তু তারা দাবিসমূহ বাস্তবায়ন শুরু না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে জানায়।[23] এদিকে ২, ৪, ৫ ও ৬ তারিখ ছাত্রলীগসহ সরকার-সমর্থক বলে অভিযুক্ত যুবকেরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সংবাদ-সংগ্রহে-যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে; সেসব সংঘর্ষে প্রায় দেড় শতাধিক জন আহত হন; পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের প্রতি নির্বিকার থাকলেও বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের দমাতে লাঠিচার্জ, কাঁদানেগ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। আন্দোলনকারীদের ওপর এরূপ হামলার প্রতিবাদে ও নৌমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে ৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মিছিল করে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর এলাকায় সড়কে অবস্থান নেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী সকালে বিক্ষোভ মিছিল করে এবং রাতে মশাল মিছিল করে সরকারের কাছে ৮ দফা দাবি[note 2] তুলে ধরে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক চেয়ে ইবি মানববন্ধন করে,[24] এবং ২২ অক্টোবর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট দল ক্যাম্পাসে র্যালি ও আলোচনা সভা আয়োজন করে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় জনসচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে।[25]
৬ আগস্ট ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ডিএসও সংগঠনের কর্মীরা আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল করে।[26] এছাড়া বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরাও বিক্ষোভসমাবেশ করেন। সর্বশেষ ৮ আগস্ট ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গ্রেপ্তারকৃত আন্দোলনকারীদের মুক্তি চেয়ে ক্লাস বর্জন করে। এরপর আর কোনো বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি।
শিক্ষার্থীরা নৌমন্ত্রীর পদত্যাগের[27] পাশাপাশি সড়কে নিরাপত্তার জন্যে সরকারের কাছে ৯টি দাবি তুলে ধরে:[28][29]
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক এবং এগুলো প্রকৃতপক্ষে নাগরিক অধিকার। তবে ৬ নং দফা অনুসারে যেকোনো স্থানে সিগন্যাল দিয়ে বাস থামালে আরো যানজট বাড়াতে পারে বলে তারা আশংকা প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থামানোর কথাই বুঝিয়েছে বলে জানায়।
আন্দোলন চলাকালীন সরকারের সমর্থকগণ, যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিকলীগের কর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে এবং প্রায় ১১৫ জন শিক্ষার্থী ও ১৫ জন সাংবাদিক আহত হন।[30][31][32] প্রথমদিকে ছাত্রলীগ আন্দোলনে সমর্থন জানায়।[33] কোনো কোনো জেলায় ছাত্রলীগকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় নেমে সংহতি প্রকাশ করে[34][35] ও আলোচনার চেষ্টা চালায়।[36] ১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বোঝানোর দায়িত্ব দেন।[37] পরে ২ আগস্ট থেকে ক্রমাগতভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হেলমেট পরে ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণের অভিযোগ ও প্রমাণ পাওয়া যায়; গণমাধ্যমে তাদেরকে 'হেলমেটবাহিনী' বলে আখ্যায়িত করা হতে থাকে। অন্যদিকে পুলিশের মুখপাত্রগণ শিক্ষার্থীদেরকে রাস্তা ছেড়ে যেতে আহ্বান করে। দুর্ঘটনার পরদিন থেকে জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে তারা সাঁজোয়া যান ও জলকামান নিয়ে ছাত্রদের ধাওয়া ও লাঠিপেটা করে এবং তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি চালায়; প্রায় একশত আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হয়। তবে সরকারি দলের কর্মীরা পুলিশের সাথে থেকে আক্রমণ চালালেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকে।[38]
২রা আগস্ট পুলিশের বৈঠকে আন্দোলন সামলাতে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[39] সেদিন মিরপুরের সংঘর্ষে[note 3] পুলিশের পাশাপাশি হেলমেটপরা ও লাঠিসোটাসজ্জিত যুবকেরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে এবং ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে বাধা দেয়। ৩ আগস্ট ধানমন্ডিতে আন্দোলনের ভিডিও ধারণ করায় কিছু দুর্বৃত্ত অনলাইন সংবাদমাধ্যম প্রিয় ডটকমের সাংবাদিক প্রদীপ দাসকে মারধোর করে এবং পরে প্রিয় ডটকমের অফিসে ভাঙচুর করে।[40][41]
৪ আগস্ট জিগাতলায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী এবং পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে প্রায় শখানেক ছাত্রছাত্রী আহত হয়।[note 4] এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, ফেনী ও ঢাকার মিরপুরেও তারা আন্দোলনরত কয়েকশো শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে।[42] জিগাতলায় ছাত্রলীগ কর্মীরা দ্য ডেইলি স্টার সংবাদপত্রের ৩ জন সাংবাদিককে পেটায় এবং একজন নারী সাংবাদিকের শ্লীলতাহানি করে।[43] স্থানীয় অন্যান্য সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন যে তাদের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়েছে,[44] মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছে[43] এবং চলমান সহিংসতার ভিডিও ফোন থেকে মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে।[42]
পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও ব্যাটন ব্যবহার করে এবং অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়।[45][46] তবে পুলিশ এবং সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণের সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।[45] আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষনেতা বলেন যে কিছু সন্ত্রাসী স্কুল ইউনিফর্ম পরে সহিংস কাজ করছে; তবে তিনি প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন।[46] সেদিন রাতে মোটরসাইকেল-আরোহী একদল সশস্ত্র লোক বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা করে; তবে কেউ হতাহত হননি।।[47] এরপর তারা নাগরিক সংগঠন 'সুজন'-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাড়িতেও আক্রমণ করে।[48]
৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে পুলিশ ও তাদের সাথে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করে।[49] ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে বৃদ্ধ ও নারী পথচারীসহ প্রায় 30 জন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আহত হন, যার মধ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, দৈনিক বণিক বার্তা ও যুগান্তরের ফটোজার্নালিস্টসহ একজন ফ্রিল্যান্স ফটোজার্নালিস্টও ছিলেন।[47][50][51] আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদের ঠেকানোর কোনো চেষ্টা না করে শিক্ষার্থীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।[51][52] হামলাকারীরা সাংবাদিকদের ক্যামেরা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং হুমকি দেয়।[53][54][55][56]
৫ আগস্ট রবিবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফেসবুকে গুজব রটনার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ।[57][58][59]
৫ আগস্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলম চলমান আন্দোলন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা আল জাজিরাতে সাক্ষাৎকার দেয়ার পর সেদিন রাতে সাদাপোশাকের পুলিশ তাকে আটক করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যায়;[60][61][62] পরদিন তাকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় "গণমাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচারের" অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং তাকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। শহিদুল আদালতে বলেন যে তাকে রিমান্ডে মারধোর করা হয়েছে।[63][64] আদালত তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন।[65][66] ৮ আগস্ট শহিদুলকে হাসপাতালে চেকআপ করিয়ে এনে[67] আবার পুলিশ হেফাজতে কারাগারে নেয়া হয়।[68] প্রায় সাড়ে তিনমাস কারাভোগের পর ২০ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।[69]
৬ আগস্ট নর্থ সাউথ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে; অন্যূন ৪০ ছাত্র আহত ও শতাধিক জনকে আটক করা হয়, তন্মধ্যে ২২ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।[note 5][70][71][72] আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ ১১ জনকে আটক করে।[73]
৬ আগস্ট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী দাবি করেন যে "ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ কাউকে নখের আঁচড়ও মারেনি।"[74] তিনি আরো বলেন, ৫ আগস্ট অস্ত্রসজ্জিত স্কুলড্রেস-পরিহিতরাই ছাত্রলীগের ওপর আক্রমণ করে; ছাত্রদের ব্যাগে পাথর ও রিভলবার ছিল; এবং সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী আহত হয়েছেন।[75][76]
১০ আগস্ট পুলিশপ্রধান জাবেদ পাটোয়ারী "ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ সহনশীল ছিল" এবং আন্দোলনে উসকানিদাতা ও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জানান।[77] পুলিশ আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনে সহায়তা, সহিংসতা, উসকানি, খাবার সরবরাহ, গাড়ি ভাঙচুর, অপপ্রচার প্রভৃতি অভিযোগে ৫১টি মামলায় শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীসহ ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করে।[78] মামলাগুলোতে প্রায় ৫০০০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।[79] এছাড়া শাহবাগ ও তেজগাঁওয়ে ৮৮ জন শিক্ষার্থীকে আটকের পর আন্দোলনকারীরা থানা ঘেরাও করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।[80] তবে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।[38][56] ২৩শে আগস্ট পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ জন জামিনে মুক্ত হন।[81]
২রা আগস্ট প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় আন্দোলন বন্ধ করে স্কুলে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।[82] ৫ আগস্ট গণভবনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ করেন এবং অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।[83][84] পরে ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় তিনি "শিক্ষার্থীরা কোনো আন্দোলনই করতে পারেনি" বলে মন্তব্য করেন। "আন্দোলন মানে রোদে পুড়বে, বৃষ্টিতে ভিজবে। (এই আন্দোলনে) এমন কিছু ঘটেনি" বলে মন্ত্রীদেরকে তিনি বিচলিত না হতে আহ্বান করেন।[85]
২ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।[19][86] শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।[87] ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ২৯ ব্যক্তি ও নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে আন্দোলন সম্পর্কিত খবর ও মিডিয়া প্রচারের অভিযোগে মামলা করে।[88] বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর টিভি ও নিউজ২৪ ছাত্র আন্দোলনের খবর ও ভিডিও সম্প্রচারের পর তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।[89]
৩ আগস্ট সরকারের পক্ষ থেকে বাসদুর্ঘটনায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা করে অনুদান এবং শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজকে ৫টি স্কুলবাস দেয়া হয়।[90]
৪ আগস্ট সরকার ২৪ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট অ্যাকসেস বন্ধ রাখে।[44] ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদেরকে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে ১.২৮ কিলোবাইট/সেকেন্ড করার আদেশ দেয়া হয় যাতে ইন্টারনেটে কোনো ছবি বা ভিডিও আপলোড না করা যায়।[91] তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন ফেসবুক রাষ্ট্রকে বিপন্ন করলে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে এরূপ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা "সীমা অতিক্রম করলে" পুলিশ "কঠোর ব্যবস্থা" নেবে।[92]
৫ আগস্ট কর্তৃপক্ষ আবার মোবাইলের ৩জি ও ৪জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখে, ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাময়িক ব্ল্যাকআউট সৃষ্টি হয়।[93] বিক্ষোভ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, ধৈর্যের সীমা ছাড়ালে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।[94]
৬ আগস্ট, মন্ত্রিসভায় নতুন ট্রাফিক আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়, যেটাতে মোটরযান দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ হত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে হত্যা করলে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।[95][96] ১৯ সেপ্টেম্বর আইনটি সংসদে পাশ হয়।[97]
৮ আগস্ট বাসমালিকেরা চালকদের মাসিক চুক্তিতে কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা দেন এবং ১ সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকর হবে বলে জানান।[98] তবে তারা প্রাথমিক উদ্যোগ নিলেও পরে আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি।[99]
১ আগস্ট বাস-ট্রাকচালক ও হেলপার তথা পরিবহন-শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের দ্বারা গাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদে ও নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে; টঙ্গীতে এক ছাত্র তাদের মারপিটের শিকার হয়।[100] শ্রমিকরা ২-৫ আগস্ট অঘোষিত ধর্মঘট করে দেশের সকল দূরপাল্লার বাস এবং অনেকাংশে অন্তঃনগর বাস পরিষেবাও বন্ধ রাখে। পরিবহনমালিক সমিতি শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সাথে সমর্থন জ্ঞাপন করলেও শ্রমিকদের নিরাপত্তা না পাওয়া পর্যন্ত বাস চলবে না বলে জানায়; পরে ৬ আগস্ট থেকে আবার বাস চলাচল শুরু হয়। সেদিন মন্ত্রিসভায় নতুন সড়ক পরিবহন আইন অনুমোদন হলে ক্ষুব্ধ পরিবহনশ্রমিকরা ৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর করে।
নাগরিক সমাজ এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ সাধারণভাবে আন্দোলন সমর্থন করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের সাথে রাস্তায় নামেন।[22] অনেক অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য শুকনো খাবার ও পানি নিয়ে আসেন। ৩ আগস্ট সড়কমন্ত্রী এবং পরদিন ডিএমপি কমিশনার জানান যারা খাবার সরবরাহ করেছে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতারা আন্দোলন সমর্থন ও সহানুভূতি জানিয়ে ছাত্রদের ঘরে ফেরার আহ্বান করেন।[101] বিরোধীদল জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ছাত্রলীগের হামলাকে "দুঃখজনক" বলে অভিহিত করেন এবং খুনি চালকের মৃত্যুদণ্ড চান। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে ব্যর্থ হওয়ায় নৌমন্ত্রীর এবং পরে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। ৪ আগস্ট বিএনপির নেতা আমীর খসরু এক বিএনপি কর্মীকে আন্দোলনে যোগ দিতে নির্দেশ দেয়ার অডিও ফোনালাপ প্রাকাশিত হয় যেটাকে সরকার "ষড়যন্ত্র" বলে অভিহিত করে এবং তিন বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা ও সেই কর্মী ও তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাম গণতান্ত্রিক জোট (সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ ও অন্যান্য দল) নৌমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করে এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে ৪ আগস্ট সংহতি সমাবেশ করে।[102][103] এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন,[104] কোটা সংস্কার আন্দোলন কমিটি, বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোসহ অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানায়, তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করে এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবি জানায়। মানবাধিকার কমিশন, গণফোরাম, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ অন্যান্য নাগরিক সংগঠনগুলোও অনুরূপ সংহতি প্রকাশ করে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক অভিনেতা, নাট্যকার ও সংগীতশিল্পীরা আন্দোলনে সমর্থন জানান এবং কোনো কোনো স্থানে তারাও ছাত্রদের সাথে সড়কে অবস্থান নেন।[105][106] কোনাল, সায়ানসহ আরো গায়কেরা পথে নেমে ছাত্রদের 'চল চল চল' গেয়ে শোনান।[107] আন্দোলনের সমর্থনে অনেক নতুন গানও লেখা হয়।
জাতিসংঘ বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে শিশু ও তরুণদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।[108] ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক বিবৃতিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার নিন্দা জানায়।.[109] তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জাতিসংঘের বিবৃতিকে "অনভিপ্রেত" এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে "নাক গলানোর চেষ্টা" করছে বলে মন্তব্য করেন।
লন্ডনভিত্তিক সেভ দ্য চিলড্রেন সংস্থা সরকারকে আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান করে।[110] বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শিক্ষার্থীদের সমাবেশ করার অধিকার ও বাকস্বাধীনতা খর্বকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়।[111] এছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে সমাজকর্মী ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মুক্তি, আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধ এবং তাদের ওপর হামলার তদন্ত দাবি করে।[112] লেখক ও সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল শহিদুলের তাৎক্ষণিক মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেয়।[113] ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়, কানাডীয় লেখক নাওমি ক্লেইন, মার্কিন লেখক-দার্শনিক নোম চম্স্কি এবং ভারতীয় বুদ্ধিজীবী বিজয় প্রসাদ প্রমুখ অবিলম্বে শহিদুল আলমকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দেন।[114] রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডার্স সরকারকে আহ্বান জানায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাথে সম্পৃক্ত সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।[115] সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গট ওয়ালসট্রোম ঢাকায় সহিংস পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানান এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকারকে সম্মান জানানোর আহ্বান করেন। ৭ আগস্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করে এবং সেসবের তদন্ত ও বিচার দাবি করে।[116] নিউইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর "বেআইনিভাবে আক্রমণ" এবং "শান্তিপূর্ণ সমালোচনার" কারণে লোকজনকে গ্রেপ্তার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিন্দা জানায়।[117]
অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, এস্তোনিয়া ও তাইওয়ানে প্রবাসী বাংলাদেশীরা আন্দোলনের সমর্থনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে।
আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় কর্তৃপক্ষ ৫-১৪ আগস্ট দশদিনব্যাপী সড়ক-নিরাপত্তামূলক "ট্রাফিক সপ্তাহ" ঘোষণা করে এবং এসময়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার অপরাধে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা এবং ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।[118] ডিএমপি সেপ্টেম্বর মাসকে ট্রাফিক সচেতনতা মাস ঘোষণা করে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তাতে সাফল্য আসেনি বলে জানায়। বাসমালিক ও চালকেরা এরজন্য পুলিশ ও পরিবহন নেতাদের ঘুষ ও চাঁদাবাজিকে দায়ী করেন।[119]
৯ আগস্ট নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির না দেয়া পর্যন্ত কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।[120] ছাত্রলীগের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের এক ছাত্রকে ফেসবুক পোস্টে অপপ্রচারের অভিযোগে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।[121]
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৫০০ প্রোফাইল পর্যবেক্ষণ করে আন্দোলনকালীন নৈরাজ্যসৃষ্টিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৫০টি প্রোফাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।[122] এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্দোলনে উসকানিদাতা ৬৬৪ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অন্যান্য ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।[123]
৭-৯ আগস্ট ও ২৮-৩০ আগস্ট পরিবহনশ্রমিকরা দেশের ১৭টি জেলায় নতুন আইনের শাস্তি কমানো ও অন্যান্য সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে ধর্মঘট করে।[124][125] তারা গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেলসহ সবধরনের যানবাহন আটকে দেয়, অনেক গাড়ির চালক ও যাত্রীদেরকে হেনস্থা ও মারধোর করে এবং মুখে ও পোশাকে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেয়।[126][127] তারা হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় মৌলভিবাজার ও সুনামগঞ্জে দুটি নবজাতক শিশু মারা যায়।[128][129] সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেসময় আইন সংশোধন করা সম্ভব না বলে জানান।[130]
বিমানবন্দর সড়কের দুর্ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত ৬ জনের মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা মুক্তি পান, বাসমালিককে জামিন দেওয়া হয় এবং বাকিদের বিরুদ্ধে ২৫ অক্টোবর চার্জ শুনানির আদেশ দেয়া হয়।[131][132]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.