হিন্দুধর্মে, ব্রহ্ম (সংস্কৃতब्रह्म) বা ব্রহ্মন্ (সংস্কৃত: ब्रह्मन्) হলো মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণা।[১][২][৩] হিন্দু দর্শনে এর অর্থ সৃষ্টির বস্তুগত, গুণগত, প্রামাণ্য ও অন্তিম কারণ।[২][৪][৫] ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, অনাদি ও অনন্ত, চিরসত্য ও পরমানন্দ যা নিজে অপরিবর্তনীয় হয়েও সকল পরিবর্তনের কারণ।[১][৩][৬] ব্রহ্ম আধিভৌতিক ধারণা হিসেবে  বৈচিত্র্যের পিছনে একক আবদ্ধ ঐক্যকে বোঝায় যা মহাবিশ্বে বিদ্যমান।

ওঁ, ব্রহ্মের সারমর্মকে বোঝায়, চূড়ান্ত বাস্তবতা
সমুদ্রের একটি ফোঁটা: আত্মার ব্রহ্মে মিশে যাওয়ার উপমা।

ব্রহ্ম হল বৈদিক সংস্কৃত শব্দ, এবং এটি হিন্দুধর্মে ধারণা করা হয়, পল ডিউসেন বলেন, "সৃজনশীল নীতি যা সমগ্র বিশ্বে উপলব্ধি করা হয়েছে"।[৭] ব্রহ্ম হল মূল ধারণা যা বেদের মধ্যে পাওয়া যায় এবং এটি প্রাথমিক উপনিষদে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে।[৮] বেদ ব্রহ্মকে মহাজাগতিক নীতি হিসেবে ধারণা করে।[৯] উপনিষদে, একে বিভিন্নভাবে সত-চিৎ-আনন্দ (সত্য-চেতনা-আনন্দ)[১০][১১] এবং অপরিবর্তনীয়, স্থায়ী, সর্বোচ্চ বাস্তবতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[১২][১৩][টীকা ১][টীকা ২]

হিন্দুশাস্ত্রে ব্রহ্ম আত্মা,[৮][১৬] ব্যক্তিগত,[টীকা ৩] নৈর্ব্যক্তিক[টীকা ৪] বা পরম ব্রহ্ম,[টীকা ৫]  অথবা দার্শনিক দর্শনের উপর নির্ভর করে এই গুণগুলির বিভিন্ন সংমিশ্রণে আলোচনা করা হয়েছে।[১৭] আস্তিক দ্বৈত বেদান্তের মতো হিন্দুধর্মের দ্বৈতবাদী দর্শনে, ব্রহ্ম প্রতিটি সত্তায় আত্মার থেকে আলাদা।[৫][১৮][১৯] অদ্বৈত দর্শনে যেমন অদ্বৈত বেদান্ত, ব্রহ্ম আত্মার অনুরূপ, সর্বত্র ও প্রতিটি জীবের ভিতরে রয়েছে, এবং সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে সংযুক্ত আধ্যাত্মিক একতা বিদ্যমান।[৬][২০][২১]

ব্যুৎপত্তি ও সম্পর্কিত শব্দ

সংস্কৃত ব্রহ্মন্‌ শব্দের মূল "বৃঃ", যার অর্থ স্ফীত হওয়া বা বিস্তারলাভ করা। এটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ শব্দ, তাই পুংলিঙ্গবাচক "ব্রহ্মণ" ও হিন্দু ত্রিমূর্তির অন্তর্গত দেবতা ব্রহ্মার থেকে একে আলাদা করে বোঝা কাম্য। ফলে ভগবানের পুরুষ অথবা স্ত্রীমূর্তি কল্পনার চেয়ে ব্রহ্মের ধারণা অধিকতর ব্যক্তি-নিরপেক্ষ। ব্রহ্মকে চূড়ান্ত সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জনৈক দার্শনিকের মতে ব্রহ্মের অর্থ "জগতের মাঝে ও জগৎ ছাড়িয়ে বিস্তৃত সত্যের অব্যয় রূপ"।[২২] দার্শনিক সাইনারের মতে ব্রহ্মের "যথাযথ সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।"[২৩]

বৈদিক সংস্কৃতে:

  • ব্রহ্ম (ब्रह्म) (নামপদ, একবচন), ব্রহ্মন্‌ (ब्रह्मन्) (মূল) (ক্লীবলিঙ্গ[২৪])-এর মূল ধাতু বৃঃ, যার অর্থ হতে পারে দৃঢ় করা বা হওয়া, কঠিন, পরিবর্ধন।[২৫]
  • ব্রহ্মন (ब्रह्मन) (নামপদ, একবচন ও বহুবচন নেই)-এর মূল ধাতু "বৃহ" (দৃঢ়, পরিবর্ধন) + "মন্‌" (প্রকাশ) অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট শক্তি, অন্তর্নিহিত দৃঢ়তা অথবা মৌলিক নীতির প্রকাশকে বোঝায়।[২৫]

পরবর্তী সংস্কৃতে ব্যবহার:

  • ব্রহ্ম (ब्रह्म) (নামপদ একবচন), ব্রহ্মন্‌ (ब्रह्मन्) (মূল) (ক্লীবলিঙ্গ[২৪]) বলতে হিন্দুধর্মে বোঝায় অতিলৌকিক ও সর্বব্যাপী চূড়ান্ত সত্য তথা চেতনা। বিভিন্ন হিন্দু দর্শন বিশেষত বেদান্তে এই ধারণাটি কেন্দ্রীয়, যা নিয়ে পরে আলোচনা করা হয়েছে।
  • ব্রহ্মা (ब्रह्मा) (নামপদ একবচন), ব্রহ্মন্‌ (ब्रह्मन्) (মূল) (পুংলিঙ্গ) অর্থাৎ দেবতা প্রজাপতি ব্রহ্মা। ইনি হিন্দু ত্রিমূর্তির প্রথম জন এবং জগতের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু বর্তমান ভারতে এঁর অর্চনা সীমিত। এর সম্ভাব্য কারণ ব্রহ্মা দীর্ঘায়ু হলেও অনন্ত নন; কল্পান্তে তিনি পুরুষে লীন হয়ে যান এবং পরবর্তী কল্পে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন/প্রকট হন।

এগুলি থেকে আলাদা:

  • ব্রাহ্মণ (ब्राह्मण, পুংলিঙ্গ, যার আক্ষরিক অর্থ "প্রার্থনা সংক্রান্ত") হল বৈদিক মন্ত্রগুলির গদ্য ভাষ্য - বৈদিক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ৷
  • ব্রাহ্মণ (ब्राह्मण, পুংলিঙ্গ), মানে পুরোহিত; এই ব্যবহারে শব্দটিকে সাধারণত ইংরেজিতে "ব্রাহ্মণ" হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়। এই ব্যবহারটি অথর্ববেদেও পাওয়া যায়। নিরপেক্ষ বহুবচনে, ব্রাহ্মণী।
  • ঈশ্বর, অদ্বৈতে ঈশ্বর, (সাহিত্যিক, পরমেশ্বর ভগবান), চূড়ান্ত বাস্তবতা, গুণহীন ব্রহ্মের আংশিক জাগতিক প্রকাশ (সীমিত বৈশিষ্ট্য সহ) হিসাবে চিহ্নিত। বিশিষ্টাদ্বৈত ও দ্বৈতে, তবে, ঈশ্বরের (সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক) অসীম গুণাবলী রয়েছে এবং নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্মের উৎস।
  • দেবগণ, ব্রহ্ম/ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপে বিস্তৃতি, প্রতিটি একটি নির্দিষ্ট গুণের সাথে। বৈদিক ধর্মে, ৩৩ দেবতা ছিল, যা পরবর্তীতে ৩৩ কোটি দেবতায় অতিরঞ্জিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, দেবগণকে এক এবং পরম ব্রহ্মের আরও জাগতিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় (পরম ব্রহ্ম)। কোটি এর সংস্কৃত শব্দের অর্থও গোষ্ঠী, এবং ৩৩ কোটি দেবের অর্থ মূলত ৩৩ প্রকারের ঐশ্বরিক প্রকাশ।

ইতিহাস ও সাহিত্য

বেদে

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে রচিত বেদের সংহিতা অংশে ব্রহ্মের ধারণার উল্লেখ আছে, যথা:[২৬]

ঋক্‌ পরিমিত,
সমন্‌ পরিমিত,
এবং যজুর্গণও পরিমিত,
কিন্তু "ব্রহ্মন্‌ শব্দের শেষ নেই।

তৈত্তিরীয় সংহিতা ৭.৩.১.৪, অনুবাদ: বার্বারা হোল্ড্রেজ[২৬]

বেদের শত শত স্তোত্রে ব্রহ্মনের ধারণার উল্লেখ আছে।[২৭] যেমন, ঋগ্বেদের ২.২.১০ নং স্তোত্র[২৮], ৬.২১.৮ নং স্তোত্র[২৯] ও ১০.৭২.২ নং স্তোত্রে[৩০] এবং অথর্ববেদের ৬.১২২.৫, ১০.১.১২ ও ১৪.১.১৩১ নং স্তোত্রে[২৭] এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যের নানা পর্যায়ে ব্রহ্মের সম্পর্কে বলা আছে, যেমন ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১.১৮.৩, কৌশিতকী ব্রাহ্মণ ৬.১২, শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩.৫.২.৫, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২.৮.৮.১০, জৈমিনীয় ব্রাহ্মণ ১.১২৯, তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৪.৪.১ থেকে ৫.৪.১, বাজসনেয়ী সংহিতা ২২.৪ থেকে ২৩.২৫ এবং মৈত্রয়নী সংহিতা ৩.১২.১: ১৬.২ থেকে ৪.৯.২: ১২২.১৫। এছাড়া বেদাঙ্গের শ্রৌত সূত্র ১.১২.১২ এবং পরস্কার গৃহসূত্রের ৩.২.১০ থেকে ৩.৪.৫ অবধি ব্রহ্মের বর্ণনার চেষ্টা আছে।[২৭]

জাঁ হোন্দার মতে, ঋগ্বেদ সংহিতা থেকে শুরু করে বৈদিক সাহিত্যের নানা শাখায় ব্রহ্মের ধারণার বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে শব্দটির বহুমাত্রিক তাৎপর্যের আন্দাজ পাওয়া যায়।[৩১] তিনি আরও বলেন, আধুনিক পাশ্চাত্যের কোনও ভাষাতেই একটি শব্দের দ্বারা ব্রহ্ম শব্দের অর্থের ব্যাপকতা ধরা যায় না।[৩১] বেদের প্রাচীনতম শ্লোকগুলিতে ব্রহ্মের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে "বেদের ধ্বনি, শব্দ, শ্লোক ও সূত্রসমূহের অন্তর্নিহিত শক্তি" হিসেবে। অবশ্য জাঁ হোন্দা এও বলেন যে এই অর্থটি কখনওই একমাত্র অর্থ ছিল না, এবং প্রাচীন ভারতে কালে কালে এই অর্থের প্রসার ও সমৃদ্ধকরণ ঘটেছে।[৩২]

বার্বারা হোল্ড্রেজ বলেন, বেদে মূলত চারটি অভিমুখে ব্রহ্মের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে: শব্দ তথা শ্লোক হিসেবে (শব্দব্রহ্ম)[৩৩], সৃষ্টিতত্ত্বে বিধৃত জ্ঞান হিসেবে, সৃষ্টির নিজেরই প্রকাশ বা সৃষ্টির অভেদ হিসেবে এবং বহু ঐতিহ্যের সমন্বয় হিসেবে[৩৪]। হ্যানা গুডম্যান বলেন, বেদে বর্ণিত ব্রহ্ম চরাচরে নিহিত পরম নীতিবিশেষ[৯]। গেভিন ফ্লাড বলেন, বৈদিক যুগে ক্রমশ ব্রহ্ম শব্দের বিমূর্ত থেকে বিমূর্ততর ব্যাখ্যা হতে থাকে এবং এভাবেই প্রাথমিক শব্দ ও শ্লোকগত অর্থ বিস্তৃত হয়ে পরবর্তী "সর্বব্যাপী", "অখণ্ড", "অব্যয়" ও "সত্তার আধার (আত্মন্‌)" অর্থগুলির প্রচলন হয়েছে।[৩৫]

উপনিষদে

Thumb
হিন্দু সংকেতব্যবস্থায় হাঁস বা হংস হল ব্রহ্ম ও আত্মনের প্রতীক।[৩৬][৩৭]

উপনিষদের মূল আলোচ্য হল ব্রহ্মবিদ্যা ও আত্মবিদ্যা (আত্মন্‌ বা স্ব-সত্তাকে জানার বিদ্যা); এই দুই ধারণার সংজ্ঞা ও তৎসম্পর্কিত চর্চার প্রকৃতি।[৩৮] উপনিষদগুলি এই বিষয়ে কোনও একক ও সুসংহত তত্ত্বের অবতারণা করে না, বরং বহুভাবে অনুধাবন করার যোগ্য অনেকগুলি সম্ভাব্য দিকনির্দেশ দেয়, যেগুলি থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় শাখার উদ্ভব হয়েছে।[৮]

পল ডয়সনের মতে পরাবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা ও মুক্তিতত্ত্বের বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে উপনিষদে প্রাপ্ত ব্রহ্মের ধারণার ব্যাখ্যা করা যায়। এর সমর্থনে তিনি একাধিক উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন, যেমন "সৃষ্টিকে জন্মদান, রক্ষা ও লয়কারী আদিম সত্য"[৩৯], "সৃষ্টির নীতিস্বরূপ"[৩৯], "পরম সত্য"[৪০], "সীমিত অথচ অসীম"[৪১], "মহাজাগতিক নীতিস্বরূপ"[৪২], "সমস্ত দেবতাসহ সমগ্র বিশ্বের পরম কারণ"[৪৩], "দৈব সত্তা, ঈশ্বর, পরমেশ্বর, বা আত্মস্থিত ঈশ্বর"[৪৪], "পরম জ্ঞানস্বরূপ"[৪৫], "সর্বমানবের অভ্যন্তরস্থ নির্ভীক, জ্যোতিস্বরূপ, শুদ্ধ ও মুক্ত আত্মজ্ঞান"[৪৬], "আধ্যাত্মিক মুক্তি ও স্বনির্ভরতার সার"[৪৭], "সর্বজীবের অন্তর্বিশ্ব ও বহির্বিশ্ব"[৪৬] "চরাচরের অন্তরে, বাইরে ও সর্বত্র বিরাজমান সবকিছুর সারবত্তা"[৪৮]

গেভিন ফ্লাড উপনিষদে বিবৃত ব্রহ্মের ধারণার সারসংক্ষেপ করে বলেছেন - "অনন্ত বিশ্ব ও মহাজগতের ক্ষুদ্রতম কণা তথা অন্তঃসার", "বোধগম্য কিন্তু অদৃশ্য সব কিছুর সার", "সর্বমানব ও সর্বজীবের আত্মা", "সত্য", "বাস্তব", "পরম" ও "আনন্দ"।[৩৫]

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের মতে, উপনিষদের ঋষিরা ব্রহ্মকে ব্যাখ্যা করেছেন চক্ষুকর্ণের অগোচর সেই সমস্ত ঘটনাবলীর পরম সার হিসেবে যাদের শুধুমাত্র আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমেই অনুধাবন করা সম্ভব।[৪৯]

ব্রহ্মের ধারণার ব্যাখ্যার্থে বিভিন্ন উপনিষদে একাধিক "মহাবাক্য" রয়েছে[৫০], যথা:

আরও তথ্য বাক্য, উৎস উপনিষদ ...
বাক্য উৎস উপনিষদ অনুবাদ সূত্র
अहं ब्रह्म अस्मि
অহং ব্রহ্ম অস্মি
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০ "আমি ব্রহ্ম" [৫১]
अयम् आत्मा ब्रह्म
অয়ং আত্মা ব্রহ্ম
মুণ্ডক উপনিষদ, দ্বিতীয় মুণ্ডক "এই আত্মা ব্রহ্ম" [৫২][৫৩]
सर्वं खल्विदं ब्रह्म
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১ "এই সবকিছুই তো ব্রহ্ম" [৫৪]
एकमेवाद्वितीयम्
একমেবাদ্বিতীয়ম্‌
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.২.১ "এক[ব্রহ্ম]-ই অদ্বিতীয়" [৫৫]
तत्त्वमसि
তত্ত্বমসি
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৪.৭ "তুমিই সেই" ("তুমিই ব্রহ্ম") [৫৬][৫৭]
प्रज्ञानं ब्रह्म
প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম
ঐতরেয় উপনিষদ ৩.৩ "জ্ঞান ব্রহ্ম" [৫৮]
বন্ধ

উপনিষদে ব্রহ্মের পরাবিদ্যাভিত্তিক বিস্তৃত আলোচনা আছে। অন্যতম প্রাচীনতম উপনিষদ ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের শাণ্ডিল্য সূত্র এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য।[৫৯] শতপথ ব্রাহ্মণে বলা আছে আত্মনের অস্তিত্ব আছে, ব্রহ্ম ও আত্মন্‌ পরস্পর অভিন্ন, সুতরাং মানবের অন্তরেও ব্রহ্মের অধিষ্ঠান। এই উদ্ধৃতিগুলি হিন্দুধর্মের বহু অর্বাচীন শাস্ত্র ও আধুনিক দর্শনের আলোচনায় বহুল ব্যবহৃত।[৫৯][৬০][৬১]

এই চরাচর ব্রহ্ম। একে নিভৃতে তজ্জলন হসেবে অর্চনা করতে হয়। (যা থেকে উৎপত্তি, যা তার প্রাণ এবং যাতে তার লয়)

ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১[৫৯][৬২]

মানব তার ক্রতুময়ের (क्रतुमयः ইচ্ছাশক্তি) জীব। অতঃপর এই ইচ্ছাশক্তিকে তার গোচরে আসতে দাও। যিনি জ্ঞানী, যাঁর শরীর জীবন-সূত্রের দ্বারা সম্পৃক্ত, যাঁর অবয়ব জ্যোতির্ময়, যাঁর চিন্তা সত্যচালিত, যাঁর আত্মা ব্যোম-সদৃশ (অদৃশ্য অথচ বর্তমান), যাঁর থেকে সর্বকর্ম, সর্ববাসনা, সর্ব ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়ে চরাচরকে বেষ্টন করে রাখে, যিনি মৌন ও নির্বিকার, তিনিই আমি, আমার আত্মা, আমার অন্তরের সত্তা।

ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১ থেকে ৩.১৪.৩[৫৯][৬৩]

এই আমার অন্তরতম আত্মা, এই পৃথিবীর চেয়ে বড়, এই আকাশের চেয়ে বড়, এই ব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বড়। এই আত্মা, এই আত্মসত্তাই হল সেই ব্রহ্ম।

ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.৩ থেকে ৩.১৪.৪[৬২][৬৩]

পল ডয়সন দেখিয়েছেন যে উপরে উদ্ধৃত আত্মা সম্পর্কিত মতবাদ বহু শতাব্দী পরে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক প্লটিনাসের এনিয়াডেস গ্রন্থে পুনরাবৃত্ত হয়েছিল (এনিয়াডেস ৫.১.২)।[৬২]

মহাবাক্যে ধারণাটির সমালোচনা

আদি ৭.১২৮[৬৪]-এর উদ্দেশ্যের নির্বাচিত অংশ থেকে এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের বাণী নিম্নে দেওয়া হল:

মায়াবাদী দার্শনিকরা অনেক বৈদিক মন্ত্রকে মহাবাক্য বা প্রধান বৈদিক মন্ত্র বলে মনে করেন, যেমন তৎ ত্বাম অসি (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭),  ইদম সর্বম ইয়াদ অয়ম আত্মা এবং  ব্রহ্মেদম সার। আত্মাইবেদম সর্বম।(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭.২৫.৩) এবং নেহা নানাস্তি কিন্কানা ( কঠ উপনিষদ ৩.১.১১)। এটি মহান ভুল। শুধুমাত্র ওঙ্কার হল মহাবাক্য। এই সমস্ত অন্যান্য মন্ত্র যা মায়াবাদীরা মহাবাক্য হিসাবে গ্রহণ করে শুধুমাত্র ঘটনাগত। এগুলিকে মহাবাক্য বা মহামন্ত্র হিসাবে নেওয়া যায় না। মন্ত্র তৎ ত্বাম অসি শুধুমাত্র বেদের আংশিক বোঝার ইঙ্গিত দেয়, ওঙ্কারের বিপরীতে, যা বেদের সম্পূর্ণ বোঝার প্রতিনিধিত্ব করে। তাই অতীন্দ্রিয় ধ্বনি যা সমস্ত বৈদিক জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে ওঙ্কার (প্রণব)। ওঙ্কার বাদে, শঙ্করাচার্যের অনুসারীদের দ্বারা উচ্চারিত কোনো শব্দই মহাবাক্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। তারা নিছক মন্তব্য করছে।

আলোচনা

ব্রহ্ম ধারণাটির অর্থের অনেক প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে ও বোঝা কঠিন। এটি অধিবিদ্যা, সত্তাতত্ত্ব, তত্ত্ববিজ্ঞান (নৈতিকতা ও নন্দনতত্ত্ব), উদ্দেশ্যবাদপরিত্রাণ তত্ত্বে প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

আধিভৌতিক ধারণা হিসাবে ব্রহ্ম

হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন দর্শনে ব্রহ্ম হল মূল আধিভৌতিক ধারণা। অধিবিদ্যার দুটি কেন্দ্রীয় প্রশ্নে এটি বিভিন্ন আলোচনার বিষয়: শেষ পর্যন্ত বাস্তব কি, এবং বাস্তব যা কিছুতে প্রযোজ্য নীতি আছে?[৬৫] ব্রহ্ম হল চূড়ান্ত "চিরন্তন, ধ্রুবক" বাস্তবতা, যেখানে পর্যবেক্ষিত মহাবিশ্ব ভিন্ন ধরনের বাস্তবতা কিন্তু যা বিভিন্ন গোঁড়া হিন্দু দর্শনে "অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল"  মায়া। মায়া প্রাক-অস্তিত্ব আছে এবং ব্রহ্মের সাথে সহ-অস্তিত্ব আছে—অন্তিম বাস্তবতা, সর্বোচ্চ সার্বজনীন, মহাজাগতিক নীতি।[৬৬]

আত্মা: চূড়ান্ত বাস্তবতা

ব্রহ্মের ধারণা ছাড়াও, হিন্দু অধিবিদ্যায় আত্মা-বা আত্ম-এর ধারণা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা চূড়ান্তভাবে বাস্তব বলেও বিবেচিত হয়।[৬৬] হিন্দুধর্মের বিভিন্ন দর্শন, বিশেষ করে দ্বৈতঅদ্বৈত দর্শন, আত্মার প্রকৃতির উপর ভিন্ন, তা ব্রহ্ম থেকে আলাদা, বা ব্রহ্মের মতই। যারা ব্রহ্ম ও আত্মকে স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে তারা হল ঈশ্বরবাদী, এবং দ্বৈত বেদান্ত এবং পরবর্তী ন্যায় দর্শন এই ভিত্তিকে ব্যাখ্যা করে।[৬৭] যারা ব্রহ্ম ও আত্মকে একই বলে মনে করে তারা অদ্বৈত বা ধর্মবাদী, এবং অদ্বৈত বেদান্ত, পরবর্তীতে সাংখ্য[৬৮] ও যোগ দর্শন এই আধিভৌতিক ভিত্তিকে ব্যাখ্যা করে।[৬৯][৭০][৭১] যে সমস্ত দর্শনে ব্রহ্মকে আত্মানের সাথে সমান করে, ব্রহ্মই একমাত্র, চূড়ান্ত বাস্তবতা।[৭২] উপনিষদের প্রধান শিক্ষা হল প্রতিটি মানুষের মধ্যে নিজের আত্মিক পরিচয়, অন্য প্রতিটি মানুষ ও জীবিত সত্তার সাথে, সেইসাথে পরম, চূড়ান্ত বাস্তব ব্রহ্মের সাথে।[৭৩][৭৪]

মায়া: অনুভূত বাস্তবতা

হিন্দুধর্মের প্রধান দর্শনগুলির অধিবিদ্যায়, মায়াকে বাস্তবতা হিসেবে ধরা হয়, যা লুকানো নীতিগুলিকে প্রকাশ করে না, প্রকৃত বাস্তবতা—ব্রহ্ম। মায়া অচেতন, ব্রহ্ম-আত্ম চেতন। মায়া হল আক্ষরিক ও প্রভাব, ব্রহ্ম হল রূপক উপদান-নীতি ও কারণ। প্রকৃতির অদৃশ্য নীতির কারণে মায়ার জন্ম হয়, পরিবর্তিত হয়, বিবর্তিত হয়, সময়ের সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে। আত্ম-ব্রহ্ম হল শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, অদৃশ্য নীতি, অপ্রভাবিত পরম ও উজ্জ্বল চেতনা।[৬৬] মায়া ধারণা, আর্কিবল্ড গফ বলেছেন, "ব্রহ্মের সাথে প্রাক-বিদ্যমান, উদ্ভূত বা উদ্ভূত অস্তিত্বের সমস্ত সম্ভাবনার উদাসীন সমষ্টি", ঠিক যেমন ভবিষ্যত গাছের সম্ভাবনা গাছের বীজের মধ্যেই বিদ্যমান।[৬৬]

নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্ম

ব্রহ্ম, চূড়ান্ত বাস্তবতা, উভয় বৈশিষ্ট্য সহ এবং ছাড়াই। এই প্রসঙ্গে, পরম ব্রহ্ম নিরাকার ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর - দেবতা বা  পরমাত্মা এবং ওম (ওঁ), যেখানে সগুণ ব্রহ্ম হল মূর্তিরূপে ঈশ্বরের প্রকাশ বা অবতার

যদিও হিন্দুধর্মের উপ-দর্শন যেমন অদ্বৈত বেদান্ত ব্রহ্ম ও আত্মার সম্পূর্ণ সমতাকে জোর দেয়, এছাড়াও তারা ব্রহ্মকে সগুণ ব্রহ্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করে—গুণ সহ ব্রহ্ম, এবং নির্গুণ ব্রহ্ম—বৈশিষ্ট্যবিহীন ব্রহ্ম।[৭৫] নির্গুণ ব্রহ্ম হল ব্রহ্ম যেমন এটি আসলেই, তবে, সগুণ ব্রহ্মকে নির্গুণ ব্রহ্ম উপলব্ধি করার উপায় হিসাবে স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু হিন্দুধর্মের দর্শনগুলি সগুণ ব্রহ্মকে চূড়ান্ত নির্গুণ ব্রহ্মের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।[৭৬] সগুণ ব্রহ্মের ধারণা, যেমন অবতারের আকারে, হিন্দুধর্মের এই দর্শনগুলিতে তাদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় যারা এখনও তাদের জন্য দরকারি প্রতীক, পথ ও হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হয়, কিন্তু ধারণাটি পরিশেষে সম্পূর্ণরূপে আলোকিতদের দ্বারা বাদ দেওয়া হয়।[৭৬]

সত্তাতত্ত্বীয় ধারণা হিসাবে ব্রহ্ম

স্বয়ং (আত্ম) সহ ব্রহ্ম ভারতীয় দর্শনের সত্তাতত্ত্বীয়[৭৭] প্রাঙ্গণের অংশ।[৭৮][৭৯] ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দর্শনে ব্যাপকভাবে ভিন্নতা রয়েছে। হিন্দুধর্মের বৌদ্ধধর্মচার্বাক দর্শন অস্বীকার করে যে "স্ব" (মহাজাগতিক অর্থে ব্যক্তি আত্মা বা ব্রহ্ম) বলে কিছু আছে। যদিও হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম ও আজীবিকের গোঁড়া দর্শনগুলি মনে করে যে "স্বয়ং" আছে।[৮০][৮১]

অদ্বৈত বেদান্ত ও যোগের মত হিন্দুধর্মের দর্শনগুলিতে ব্রহ্ম পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের (এবং জীবন্ত প্রাণীর) মধ্যে আত্মাকে সমতুল্য এবং একমাত্র বাস্তবতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, চিরন্তন, স্ব-জন্ম, সীমাহীন, জন্মগতভাবে মুক্ত, আনন্দময় পরম॥[৮২][৮৩][৮৪] নিজের নিজেকে জানা মানে নিজের ভিতরের ভগবানকে জানা, এবং এটিকে ব্রহ্ম (সর্বজনীন স্ব) এর সত্তাতত্ত্বীয় প্রকৃতি জানার পথ হিসাবে ধরা হয় কারণ এটি আত্মার (ব্যক্তিগত স্ব) অনুরূপ। আত্মা-ব্রহ্মের প্রকৃতি এই দর্শনগুলিতে অনুষ্ঠিত হয়, বারবারা হোল্ড্রেজ বলেন, বিশুদ্ধ সত্তা (সত), চেতনা (চিত্ত) ও আনন্দে পূর্ণ (আনন্দ) হিসাবে এবং এটি নিরাকার, স্বতন্ত্র, অপরিবর্তনীয় ও সীমাহীন।[৮২]

দ্বৈত বেদান্তের মত আস্তিক বিদ্যালয়ে এর বিপরীতে, ব্রাহ্মণের প্রকৃতিকে শাশ্বত, সীমাহীন, সহজাতভাবে মুক্ত, আনন্দময় পরম হিসাবে ধরা হয়, যখন প্রতিটি ব্যক্তির আত্মকে স্বতন্ত্র এবং সীমিত হিসাবে ধরা হয় যা সর্বোত্তমভাবে অনন্তকালের কাছাকাছি আসতে পরম ব্রহ্মের আনন্দময় প্রেম। [৮৫]

ব্রহ্ম, বাস্তবতা ও অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কিত হিন্দু ধর্মের অন্যান্য দর্শনগুলির নিজস্ব সত্তাতত্ত্বীয় প্রাঙ্গণ রয়েছে। হিন্দুধর্মের বৈশেষিক দর্শন, উদাহরণস্বরূপ, উল্লেখযোগ্য, বাস্তববাদী তত্ত্ববিদ্যা ধারণ করে।[৮৬] চার্বাক দর্শন ব্রহ্ম ও  আত্মকে  অস্বীকার করেছে এবং বস্তুবাদী তত্ত্ববিদ্যা ধারণ করেছে।[৮৭]

তত্ত্বীয় ধারণা হিসাবে ব্রহ্ম

ব্রহ্ম ও আত্মন হল হিন্দু তত্ত্বের তত্ত্ববিজ্ঞানের মূল ধারণা: নীতিশাস্ত্র ও নন্দনতত্ত্ব।[৮৮][৮৯] মাইকেল মায়ার্স ও অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে, আনন্দ সার্বজনীন অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি হিসাবে ব্রহ্মের ধারণার অক্ষীয় গুরুত্ব রয়েছে।[৯০][৯১] কিছু পণ্ডিত ব্রহ্মকে তত্ত্বীয় অর্থে সর্বোচ্চ মূল্যের সাথে সমতুল্য করেন।[৯২]

ব্রহ্ম ও আত্মনের তত্ত্বীয় ধারণা হিন্দু মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু।[৯৩] বিবৃতি যেমন শ বলেন, 'আমি ব্রহ্ম', মানে 'আমি সবকিছুর সাথে সম্পর্কিত', এবং এটি হিন্দুধর্মে অন্যদের প্রতি করুণার অন্তর্নিহিত ভিত্তি, প্রতিটি ব্যক্তির কল্যাণ, শান্তি বা সুখ অন্যের উপর নির্ভর করে, বৃহৎ আকারে অন্যান্য প্রাণী এবং প্রকৃতি সহ, এবং তদ্বিপরীত।[৯৪] তিএতগে বলেছেন যে এমনকি হিন্দুধর্মের অ-দ্বৈত দর্শনে, যেখানে ব্রহ্ম ও  আত্মন কে সত্ত্বাতত্বীয়ভাবে সমতুল্য বিবেচনা করা হয়, মূল্যবোধের তত্ত্বটি পৃথক প্রতিনিধি ও নৈতিকতার উপর জোর দেয়। হিন্দুধর্মের এই দর্শনগুলিতে, তিএতগে বলেছে, কর্মের তত্ত্বটি অন্যের প্রতি সমবেদনা থেকে উদ্ভূত ও কেন্দ্রীভূত হয়, এবং নিজের জন্য অহংকারী উদ্বেগ নয়।[৯৫]

বাউয়ার বলেন, মূল্যের তত্ত্বীয় তত্ত্বটি ব্রহ্ম ও 'আত্মনের ধারণা থেকে নিহিতভাবে উদ্ভূত হয়েছে।[৯৬] মানুষের অভিজ্ঞতা ও নীতিশাস্ত্রের নন্দনতত্ত্ব হল হিন্দুধর্মে আত্ম-জ্ঞানের ফলাফল, যা ব্রহ্ম, প্রত্যেকের স্বয়ং, সমস্ত কিছু এবং সমস্ত অনন্তকালের সাথে নিজের আত্মের নিখুঁত, নিরবধি একীকরণের ফলেমানুষের অভিজ্ঞতার শিখর পরকালের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং বর্তমান জীবনেই বিশুদ্ধ চেতনা।[৯৬] এটি অনুমান করে না যে ব্যক্তি দুর্বল এবং এটি অনুমান করে না যে সে সহজাতভাবে মন্দ, কিন্তু বিপরীত: মানুষের স্ব এবং তার প্রকৃতিকে মৌলিকভাবে অযোগ্য, ত্রুটিহীন, সুন্দর, সুখী, নৈতিক, সহানুভূতিশীল ও ভাল হিসাবে ধরা হয়।[৯৬][৯৭] অজ্ঞতা হল এটাকে মন্দ মনে করা, মুক্তি হল তার চিরন্তন, বিস্তৃত, আদিম, সুখী ও ভাল প্রকৃতিকে জানা।[৯৬] নিকম বলেন, হিন্দু চিন্তাধারা ও সাধারণভাবে ভারতীয় দর্শনের অক্ষীয় প্রাঙ্গণ হল ব্যক্তিকে উন্নীত করা, মানুষের সহজাত সম্ভাবনাকে উন্নত করা, যেখানে তার সত্তার বাস্তবতা হল মহাবিশ্বের বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা।[৯৮] হিন্দুধর্মের উপনিষদ, নিকমকে সংক্ষিপ্ত করে, মনে করে যে ব্যক্তির বস্তুনিষ্ঠ মহাবিশ্বের মতো একই সারমর্ম এবং বাস্তবতা রয়েছে এবং এই সারমর্মটি সর্বোত্তম সারাংশ; স্বতন্ত্র স্ব হল সর্বজনীন স্ব, এবং আত্মা একই বাস্তবতা এবং ব্রহ্মের মতোই নান্দনিকতা।[৯৮]

উদ্দেশ্যবাদী ধারণা হিসাবে ব্রহ্ম

ব্রহ্ম ও আত্মন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যবাদী ধারণা। উদ্দেশ্যবাদ কোনো কিছুর আপাত উদ্দেশ্য, নীতি বা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে, এই প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটা বলে :

যারা ব্রহ্ম সম্পর্কে অনুসন্ধান করে তারা বলে:

ব্রহ্মের কারণ কি? কেন আমাদের জন্ম হয়েছিল? আমরা কিসের দ্বারা বাঁচি? আমরা কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত? কার দ্বারা শাসিত, হে ব্রহ্ম জানো, আমরা কি সুখে-দুঃখে বাস করি, প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থায় থাকি?

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, স্তোত্র ১.১

ব্রহ্মের মূল উদ্দেশ্য এবং কেন এটি বিদ্যমান তা উপনিষদের মতে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন। কেউ তার আসল উদ্দেশ্য তখনই খুঁজে পেতে পারে যখন কেউ ব্রহ্ম হয়ে ওঠে কারণ ব্রহ্ম হল সমস্ত জ্ঞান যা নিজেই জানতে পারে। তাই, জীবনের যেকোনো কিছুর সম্পূর্ণ উত্তর তখনই নির্ধারণ করা যায় বা পাওয়া যায় যখন ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা হয় কারণ ব্রহ্ম হল সম্পূর্ণ জ্ঞান। এটি ঐতরেয় উপনিষদ ৩.৩ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪.৫.১৭ এবং অন্যান্য অনেক উপনিষদে বলা হয়েছে।

জ্ঞান হল সব কিছুর চোখ, এবং জ্ঞানের উপর এটি প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞান হল বিশ্বের চোখ, এবং জ্ঞান হল ভিত্তি। ব্রহ্ম জানেন।

ঐতরেয় উপনিষদ, স্তোত্র ৩.৩[৯৯][১০০]

উপনিষদ অনুসারে কেন ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা উচিত তার কারণ হল এটি ব্যক্তির জীবন থেকে দুঃখ দূর করে। কারণ ব্যক্তিটির অপরিবর্তনীয় (পুরুষ; আত্মা-ব্রহ্ম) এবং চির-পরিবর্তনশীল (প্রকৃতি; মায়া) মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা ও জ্ঞান রয়েছে এবং তাই ব্যক্তি ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তির সাথে সংযুক্ত থাকে না। অত:পর, ব্যক্তি শুধুমাত্র স্ব নিয়েই সন্তুষ্ট এবং তার শরীর বা স্ব ছাড়া অন্য কিছুতে নয়।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ৩.৯.২৬-এ এটি উল্লেখ করে যে আত্মা 'ভয়ে কাঁপতে পারে না বা আঘাত পায় না' এবং ঈশ উপনিষদে ৬-৭-এ এটিও যন্ত্রণাকে অস্তিত্বহীন বলে কথা বলে যখন কেউ ব্রহ্ম হয়ে ওঠে কারণ তারা সমস্ত প্রাণীর মধ্যে আত্মকে দেখতে পায়। এবং সমস্ত প্রাণীর মধ্যে রয়েছে।তাই, ব্রহ্মের আপাত উদ্দেশ্যটি উপনিষদে আলোচনায় আছে কিন্তু উপনিষদ অনুসারে ব্রহ্ম নিজেই একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্দেশ্য এবং সত্য লক্ষ্য, তাই প্রশ্নটি করা অপ্রয়োজনীয়। উপনিষদগুলি ব্রহ্মকেই জীবনের একমাত্র প্রকৃত সার্থক লক্ষ্য বলে মনে করে এবং শেষ পর্যন্ত এটি হয়ে ওঠার লক্ষ্য রাখা উচিত কারণ এটি চূড়ান্ত জ্ঞান, অমরত্ব ইত্যাদির উপায় এবং শেষ। সুতরাং ব্রহ্ম সহ সমস্ত কিছুর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী এই প্রশ্নের উত্তর ব্রহ্মকে উপলব্ধি করা বা অর্জন করার মাধ্যমে পাওয়া যায় কারণ ব্রহ্ম নিজেই চূড়ান্ত জ্ঞান। তাই, ব্রহ্ম হল উদ্দেশ্যবাদী ধারণা কারণ এটি সম্ভাব্য সবকিছুর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য এবং সবকিছুর মধ্যে রয়েছে।

পরিত্রাণ তত্ত্বীয় ধারণা হিসাবে ব্রহ্ম: মোক্ষ

হিন্দুধর্মের গোঁড়া দর্শন, বিশেষ করে বেদান্ত, সাংখ্যযোগ দর্শনগুলি তাদের মোক্ষের আলোচনায় ব্রহ্ম এবং আত্মার ধারণার উপর ফোকাস করে। অদ্বৈত বেদান্ত মনে করে যে আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে কোন সত্তা/অ-সত্তার পার্থক্য নেই। আত্মজ্ঞান (আত্ম-জ্ঞান) ব্যক্তির ভিতরে ও ব্যক্তির বাইরে ব্রহ্মের জ্ঞানের সমার্থক। অধিকন্তু, ব্রহ্মের জ্ঞান সমস্ত অস্তিত্ব, আত্ম-উপলব্ধি, অবর্ণনীয় আনন্দমোক্ষ (স্বাধীনতা, পরমানন্দ) সহ একত্বের বোধের দিকে পরিচালিত করে,[১০১] কারণ ব্রহ্ম-আত্মা হল সমস্ত কিছুর উৎপত্তি এবং শেষ, সর্বজনীন নীতি যা আছে সব কিছুর পিছনে এবং উৎসে, চেতনা যা সবকিছু এবং সকলকে পরিব্যাপ্ত করে।[১০২]

হিন্দুধর্মের দ্বৈত বেদান্তের মতো আস্তিক উপ-দর্শন একই প্রাঙ্গণ দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু স্বতন্ত্র স্ব এবং ব্রহ্ম আলাদা, এমন ভিত্তি যোগ করে, এবং এর ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যেখানে বিশ্বের অন্যান্য প্রধান ধর্মে ব্রহ্মকে ঈশ্বরের অনুরূপভাবে ধারণা করা হয়।[১৮] আস্তিক দর্শনগুলি দাবি করে যে মোক্ষ হল স্বতন্ত্র ও পৃথক ব্রহ্মের (বিষ্ণুশিব বা সমতুল্য বৈষম্যবাদ) এর সাথে প্রেমময়, চিরন্তন মিলন বা নৈকট্য। ব্রহ্ম, হিন্দুধর্মের এই উপ-দর্শনগুলিতে অস্তিত্বের সর্বোচ্চ পরিপূর্ণতা হিসাবে বিবেচিত হয়, যা প্রতিটি স্বয়ং তার নিজস্ব উপায়ে মোক্ষের জন্য যাত্রা করে।[১০৩]

দার্শনিক চিন্তাধারা

বেদান্ত

ব্রহ্মের ধারণা, এর প্রকৃতিআত্মা এবং পর্যবেক্ষণ করা মহাবিশ্বের সাথে এর সম্পর্ক, হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন উপ-দর্শনের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান বিষয়।

অদ্বৈত বেদান্ত

অদ্বৈত বেদান্ত অনন্দ্যবাদকে সমর্থন করে। ব্রহ্ম হল একমাত্র অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা,[৭২] সেখানে কোনো দ্বৈততা নেই, কোনো সীমিত স্বতন্ত্র স্ব বা পৃথক সীমাহীন মহাজাগতিক আত্ম নেই, বরং সমস্ত স্ব, সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত স্থান ও সময় জুড়ে, এক এবং অভিন্ন।[৬][৮২][১০৪] অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে প্রতিটি সত্তার ভিতরের ব্রহ্মাণ্ডআত্মা হল ব্রহ্ম, এবং প্রতিটি সত্তার বাইরের ব্রহ্মাণ্ড ও আত্মা হল ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হল বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সব কিছুর আদি ও শেষ। ব্রহ্ম হল সমস্ত কিছুর মূল উৎস। ব্রহ্মকে শেখানো বা উপলব্ধি করা যায় না (বৌদ্ধিক জ্ঞানের বস্তু হিসাবে), কিন্তু এটা সব মানুষের দ্বারা শেখা ও উপলব্ধি করা যায়।[২০] অদ্বৈত বেদান্তের লক্ষ্য হল উপলব্ধি করা যে একজনের আত্ম (আত্মা) অজ্ঞতা এবং মিথ্যা-পরিচয় (অবিদ্যা) দ্বারা অস্পষ্ট হয়ে যায়। যখন অবিদ্যা অপসারিত হয়, তখন আত্মা (ব্যক্তির অভ্যন্তরে) ব্রহ্মের সাথে অভিন্নরূপে উপলব্ধি করা হয়।[৭৫] ব্রহ্ম বাইরের, পৃথক, দ্বৈত সত্তা নয়, ব্রহ্ম প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে, হিন্দুধর্মের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন বলে। ব্রহ্ম হল সবই যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং যা সত্যই বিদ্যমান।[৭২] এই দৃষ্টিভঙ্গি এই দর্শনে বিভিন্ন রূপে বিবৃত হয়েছে, যেমন "একম সত" ("সত্য এক"), এবং সবই ব্রহ্ম।

মহাবিশ্ব কেবল ব্রহ্ম থেকে আসে না, এটি ব্রহ্ম। অদ্বৈত বেদান্তের একজন প্রবক্তা আদি শঙ্করের মতে, শ্রুতি যে ব্রহ্মের জ্ঞান প্রদান করে তা আত্ম অনুসন্ধান ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া যায় না।[১০৫]

অদ্বৈত বেদান্তে, নির্গুণ ব্রহ্ম, যা গুণবিহীন ব্রহ্ম, তাকে চূড়ান্ত এবং একমাত্র বাস্তবতা বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।[৭২][৭৬] চেতনা ব্রহ্মের সম্পত্তি নয় বরং এর স্বভাব। এই ক্ষেত্রে, অদ্বৈত বেদান্ত অন্যান্য বেদান্ত দর্শন থেকে পৃথক।[১০৬]

ভগবদ্গীতার উদাহরণ শ্লোকগুলি অন্তর্ভুক্ত করে:

নৈবেদ্য (যজ্ঞ) হল ব্রহ্ম; উৎসর্গ হল ব্রহ্ম;
ব্রহ্মের অগ্নিতে ব্রহ্ম নিবেদিত।
তার দ্বারা ব্রহ্ম লাভ হবে,
যিনি সর্বদা ব্রহ্মকে কর্মে দেখেন।

ভগবদ্গীতা, স্তোত্র ৪.২৪[১০৭][১০৮]

যে তার মধ্যে তার সুখ খুঁজে পায়,
ভিতরে তার আনন্দ,
এবং ভিতরে তার আলো,
এই যোগিন ব্রহ্মের পরমানন্দ লাভ করে, ব্রহ্ম হয়।

ভগবদ্গীতা, স্তোত্র ৫.২৪[১০৯]

দ্বৈত বেদান্ত

দ্বৈত দর্শন মতে ব্রহ্ম হল বিশ্বের প্রধান ধর্মে ঈশ্বরের অনুরূপ ধারণা।[১৮] দ্বৈত মনে করেন যে স্বতন্ত্র আত্ম ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু স্বতন্ত্র।[১৮]

দ্বৈত তত্ত্ববাদকে ব্যাখ্যা করে যার অর্থ সর্বজনীন স্তরের মধ্যে সত্তার তত্ত্বগুলির (উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য) মধ্যে পার্থক্য বোঝা এইভাবে:[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

  1. জীব-ঈশ্বর-ভেদ — আত্মাবিষ্ণুর মধ্যে পার্থক্য
  2. যদ-ঈশ্বর-ভেদ — অবোধ ও বিষ্ণুর মধ্যে পার্থক্য
  3. মিঠ-জীব-ভেদ — যে কোনো দুটি আত্মার মধ্যে পার্থক্য
  4. জড়-জীব-ভেদ — অবোধ ও আত্মার মধ্যে পার্থক্য
  5. মিঠ-জাদ-ভেদ — যে কোনো দুটি অন্তর্নিহিতের মধ্যে পার্থক্য

অচিন্ত্য ভেদ অবেদ

অচিন্ত্য ভেদ অভেদ দর্শন দ্বৈতদ্বৈত এর অনুরূপ। এই দর্শনে, ব্রহ্ম শুধু নৈর্ব্যক্তিক নয়, ব্যক্তিগতও।[১১০] যে ব্রহ্ম হলেন পরম সত্যের উপলব্ধির প্রথম পর্যায়ে (প্রক্রিয়া দ্বারা যাকে বলা হয় জ্ঞান) যদিও ভগবানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব, তিনি নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্ম হিসাবে উপলব্ধি করা হয়, তারপরে শাশ্বত বৈকুণ্ঠ আবাস (ব্রহ্মলোক সনাতন নামেও পরিচিত) থাকা ব্যক্তিগত ব্রাহ্ম হিসাবে উপলব্ধি করা হয়, তারপরে  পরমাত্মা (যোগ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতিনিয়ত-ধ্যানের মাধ্যমে, হৃদয়ে বিষ্ণু-ভগবান)—বিষ্ণু (নারায়ণ, প্রত্যেকের হৃদয়েও) যার বহু আবাস রয়েছে বিষ্ণুলোক (বৈকুণ্ঠলোক) নামে পরিচিত, এবং পরিশেষে (ভক্তি দ্বারা পরম সত্য উপলব্ধি করা হয়) ভগবান হিসাবে, ভগবানের পরম ব্যক্তিত্ব, যিনি পরমাত্মা ও ব্রহ্ম উভয়ের উৎস (ব্যক্তিগত, নৈর্ব্যক্তিক, বা উভয়)।[১১০]

বৈষ্ণবধর্ম

সমস্ত বৈষ্ণব দর্শনগুলি সর্বস্তুতবাদী ও আত্ম-উপলব্ধির মধ্যবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্মের সাথে আত্মার সনাক্তকরণের অদ্বৈত ধারণাকে উপলব্ধি করে, কিন্তু মুক্তি নয় বা বা ভক্তি যোগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ঈশ্বর-উপলব্ধির চূড়ান্ত মুক্তি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]  গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম, অচিন্ত্য ভেদ অভেদ দর্শনের রূপ, এছাড়াও উপসংহারে পৌঁছেছে যে ব্রহ্ম হলেন ঈশ্বরের সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব। তাদের মতে, ব্রহ্ম হলেন ভগবান বিষ্ণু; মহাবিশ্ব ও পরমের অন্যান্য সমস্ত প্রকাশ তাঁরই সম্প্রসারণ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ভক্তি আন্দোলন

হিন্দুধর্মের ভক্তি আন্দোলন ব্রহ্ম-নির্গুণ ও সগুণের দুটি ধারণাকে ঘিরে এর ধর্মতত্ব তৈরি করেছিল।[১১১] নির্গুণ ব্রহ্ম ছিল নিরাকার, গুণ বা গুণ ছাড়াই চূড়ান্ত বাস্তবতার ধারণা।[১১২] সগুণ ব্রহ্ম, বিপরীতে, রূপ, গুণাবলী ও গুণের মতোই কল্পনা ও বিকশিত হয়েছিল।[১১২] দুটির সমান্তরাল ছিল যথাক্রমে প্রাচীন ধর্মবাদী অব্যক্ত এবং আস্তিকবাদী প্রকাশ ঐতিহ্যে, এবং ভগবদ্গীতায় অর্জুন-কৃষ্ণ কথোপকথনের সাথে পাওয়া যায়।[১১১][১১৩] এটি একই ব্রহ্ম, কিন্তু দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, নির্গুণ জ্ঞান-কেন্দ্র থেকে এবং অন্যটি সগুনী প্রেম-কেন্দ্রবিন্দু থেকে, গীতায় কৃষ্ণ (ভগবান বিষ্ণুর একটি ৮ম অবতার) হিসাবে একত্রিত।[১১৩] নির্গুণ ভক্তের কবিতা ছিল জ্ঞানশ্রয়ী, বা জ্ঞানের শিকড় ছিল।[১১১] সগুণ ভক্তের কবিতা ছিল প্রেমা-শ্রয়ী, বা প্রেমের শিকড়।[১১১] ভক্তিতে, জোর দেওয়া হয় পারস্পরিক প্রেম এবং ভক্তি, যেখানে ভক্ত ঈশ্বরকে ভালবাসেন, এবং ঈশ্বর ভক্তকে ভালবাসেন।[১১৩]

জিনেনে ফাউলার বলেছেন যে নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্মের ধারণা, ভক্তি আন্দোলনের ধর্মতত্ত্বের মূলে, হিন্দুধর্মের বেদান্ত দর্শন ধারণাগুলির সাথে আরও গভীর বিকাশ ঘটেছে, বিশেষ করে আদি শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত, এবং মধ্বাচার্যের দ্বৈত বেদান্ত।[১১২] ভক্তির উপর দ্বাদশ শতাব্দীর দুটি প্রভাবশালী গ্রন্থ হল শান্দিল্য ভক্তি সূত্র—নির্গুণ-ভক্তির সাথে অনুরণিত গ্রন্থ, এবং নারদ ভক্তিসূত্র—একটি গ্রন্থ যা সগুণ-ভক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।[১১৪]

ভক্তি আন্দোলনের নির্গুণ ও সগুণ ব্রহ্ম ধারণা পণ্ডিতদের কাছে বিস্ময়কর ছিল, বিশেষ করে নির্গুণী ঐতিহ্য কারণ এটি প্রস্তাব করে, ডেভিড লরেঞ্জেন বলেন, "গুণবিহীন ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক ভক্তি, এমনকি কোনো সংজ্ঞায়িত ব্যক্তিত্ব ছাড়াই"।[১১৫] তবুও "নির্গুণ ভক্তি সাহিত্যের পাহাড়" দেওয়া, লরেঞ্জেন যোগ করেন, সগুণ ব্রহ্মের ভক্তির সাথে সাথে নির্গুণ ব্রহ্মের জন্য ভক্তি হিন্দু ঐতিহ্যের বাস্তবতার অংশ।[১১৫] এগুলি ভক্তি আন্দোলনের সময় ঈশ্বরকে কল্পনা করার দুটি বিকল্প উপায় ছিল।[১১১]

ব্রহ্ম সম্পর্কে বৌদ্ধ ধারণা

বৌদ্ধধর্ম ব্রহ্ম ও আত্মার উপনিষদিক মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করে (স্থায়ী স্ব, সারাংশ)।[টীকা ৬] ড্যামিয়েন কিউনের মতে, "বুদ্ধ বলেছিলেন যে তিনি ব্যক্তিগত আত্ম (আত্মান) বা এর মহাজাগতিক প্রতিরূপ (ব্রহ্ম) এর অস্তিত্বের জন্য কোন প্রমাণ খুঁজে বুদ্ধ পাননি"।[১১৬] বৌদ্ধধর্মের অধিবিদ্যা তার অনাত্তা মতবাদের মাধ্যমে ব্রহ্ম (চূড়ান্ত সত্তা), ব্রহ্ম-সদৃশ সারমর্ম, স্বয়ং ও আধ্যাত্মিকভাবে সমতুল্য যেকোনো কিছুকে প্রত্যাখ্যান করে।[১১৭][১১৮][১১৯]

মার্ভ ফাউলারের মতে, বৌদ্ধধর্মের কিছু রূপ ব্রহ্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ধারণাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।[টীকা ৭] উদাহরণ হিসেবে, ফাউলার বৌদ্ধধর্মের প্রথম দিকের সর্বস্তিবাদ দর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন, যেটি "খুবই সর্বেশ্বরবাদী ধর্মীয় দর্শন গ্রহণ করতে এসেছিল, এবং মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিকাশে তারা যে প্রেরণা দিয়েছিল তার কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ"।[১২০] উইলিয়াম থিওডোর ডি বারির মতে, মহাযান বৌদ্ধধর্মের যোগাকার দর্শন মতবাদে, "মর্যাদার দেহ, চূড়ান্ত বুদ্ধ, যিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে পরিব্যাপ্ত ও অধীনস্থ করেছেন [...] প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব স্বয়ং, উপনিষদের ব্রহ্ম, নতুন রূপে"।[১২১] ফাউলারের মতে, কিছু পণ্ডিত হিন্দু ব্রহ্ম/আত্মনের সাথে বৌদ্ধ নির্বাণকে, চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসাবে কল্পনা করেছেন; ফাউলার দাবি করেন যে এই দৃষ্টিভঙ্গি "বৌদ্ধ চেনাশোনাগুলিতে সামান্য সমর্থন পেয়েছে।"[১২২] ফাউলার দাবি করেছেন যে মহাযান গ্রন্থের একটি সংখ্যার লেখকরা তাদের ধারণাগুলি ব্রহ্মের উপনিষদিক মতবাদ থেকে আলাদা করার জন্য কষ্ট করেছেন।[টীকা ৮]

বৌদ্ধ গ্রন্থে ব্রহ্মের সহকর্মী হিসাবে ব্রহ্মা

বৈদিক সাহিত্যে ব্রহ্মের আধ্যাত্মিক ধারণা অনেক বেশি প্রাচীন, এবং কিছু পণ্ডিত পরামর্শ দেন যে দেবতা ব্রহ্মা নৈর্ব্যক্তিক, নির্গুণের (ব্যতীত) রূপ এবং গুণাবলী (সগুণ সংস্করণ) সহ একটি ব্যক্তিগত ধারণা এবং মূর্তি হিসাবে আবির্ভূত হতে পারেগুণাবলী, নিরাকার সার্বজনীন নীতিকে ব্রহ্ম বলা হয়।[১২৩] হিন্দু গ্রন্থে, বিষ্ণুশিবের সাথে দেবতা ব্রহ্মার প্রাচীনতম উল্লেখগুলির মধ্যে মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের পঞ্চম প্রপথক (পাঠ) এ রয়েছে, সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের উত্থানের পর খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের শেষের দিকে রচিত হয়।[১২৪][১২৫][১২৬]

প্রাথমিক বৌদ্ধরা ব্রহ্মার ধারণাকে আক্রমণ করেছিল, গণনাথ ওবেয়েসেকেরে বলেন, এবং এর ফলে লিঙ্গ নিরপেক্ষ, বিমূর্ত আধিভৌতিক ব্রহ্মের বৈদিক ও উপনিষদিক ধারণাকে বিতর্কিতভাবে আক্রমণ করেছিলেন।[১২৭] প্রাথমিক বৌদ্ধ গ্রন্থে ব্রহ্মার এই সমালোচনার লক্ষ্য হল বেদকে উপহাস করা, কিন্তু একই পাঠ্য একই সাথে মেত্তা (প্রেমময়-দয়া, করুণা) কে ব্রহ্মার সাথে মিলনের অবস্থা বলে। বৈদিক ব্রহ্মবিহারের ধারণায়, বৌদ্ধ মূল্য ব্যবস্থায় মূল্য ব্যবস্থা বজায় রেখে ব্রহ্মার প্রতি প্রাথমিক বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কোনো সৃষ্টিকর্তার দিককে প্রত্যাখ্যান করা।[১২৭] মার্টিন উইল্টশায়ারের মতে, "স্বর্গ লোক" এর পরিবর্তে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে "ব্রহ্ম লোক" শব্দটি সম্ভবত উপনিষদে ব্রহ্ম ধারণার "সত্য শক্তি" এবং জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুকে বেছে নেওয়ার ও জোর দেওয়ার বৌদ্ধ প্রচেষ্টা।[১২৮] একই সাথে, ব্রহ্মকে ব্রহ্মা হিসাবে সংস্কার করে এবং এটিকে তার দেব ও সংসার তত্ত্বের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে, প্রারম্ভিক বৌদ্ধধর্ম বেদের আত্ম-ব্রহ্ম ভিত্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তার নিজস্ব ধম্ম মতবাদ (অ্যানিকা, দুক্খ ও অনাত্তা)।[১২৯]

শিখধর্মে ব্রহ্ম

Thumb
Thumb
আইকে ওঙ্কার (বাম) শিখধর্মের মুল মন্তরের অংশ, যেখানে এর অর্থ হল "ওঙ্কার [ঈশ্বর, বাস্তবতা] এক"।[১৩০] শিখধর্মের ওঙ্কার ওঁ-এর সাথে সম্পর্কিত যাকে ওঙ্কারও[১৩১] বলা হয়—হিন্দুধর্মে।[১৩০][১৩২] হিন্দুধর্মের প্রাচীন গ্রন্থে ওঁকে সর্বোচ্চ বাস্তবতা, ব্রহ্মের প্রতীক হিসেবে বলা হয়েছে।[১৩৩][১৩৪]

ব্রহ্মের আধিভৌতিক ধারণা, বিশেষ করে নির্গুণ ব্রহ্ম হিসেবে—গুণহীন, নিরাকার, চিরন্তন সর্বোচ্চ বাস্তবতা—শিখধর্মের ভিত্তি।[১৩৫] এই বিশ্বাস শিখদের দ্বারা নির্গুণ ভক্তির মাধ্যমে পালন করা হয়।[১৩৬][১৩৭]

গৌরীতে, যা গুরু গ্রন্থ সাহিবের অংশ, ব্রহ্মকে "এক সেকেন্ড ছাড়া একজন" হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, শ্রী রাগে "সবকিছুই তাঁর থেকে জন্মগ্রহণ করে এবং অবশেষে তাঁর মধ্যে লীন হয়", ভার আসাতে "আমরা যা দেখি বা শুনি ব্রহ্মের প্রকাশ"।[১৩৮] নেসবিট বলেছেন যে শিখ ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবের শুরুতে বারোটি শব্দের মুল মন্তরে প্রথম দুটি শব্দ, ইক ওঙ্কার, পণ্ডিতরা তিনটি ভিন্ন উপায়ে অনুবাদ করেছেন: "একই ঈশ্বর আছে", "এই সত্তা এক", এবং "একই বাস্তবতা"।[১৩০]

ব্রহ্মের আধিভৌতিক ধারণার জন্য "এক সেকেন্ড ছাড়াই" এর উপর অনুরূপ জোর হিন্দুধর্মের প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদের অধ্যায় ৬.২।[১৩৯][১৪০] শিখধর্মের ঈশ্বর ও সর্বোচ্চ বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণাগুলি হিন্দুধর্মে ব্রহ্মের সগুণ ও নির্গুণ ধারণাগুলিতে পাওয়া ধারণাগুলি ভাগ করে।[১৩৫][১৪১]

চূড়ান্ত বাস্তবতা (ব্রহ্ম) এর ধারণাকে শিখধর্মে নাম, সত-নাম বা নাম হিসাবেও উল্লেখ করা হয়েছে এবং হিন্দু ওঁ-এর মত ঋক ওঁকার এই বাস্তবতার প্রতীক।[১৪২][১৪৩]

জৈনধর্মে ব্রহ্ম

জৈনধর্মে ব্রহ্মের ধারণা প্রত্যাখ্যান বা গৃহীত কিনা তা নিয়ে পণ্ডিতরা বিতর্ক করেন।আস্তিক ঈশ্বরের ধারণা জৈনধর্ম দ্বারা প্রত্যাখ্যান করা হয়, কিন্তু জীব বা "আত্ম (আত্মা) বিদ্যমান" আধিভৌতিক সত্য এবং এর পুনর্জন্ম এবং কেবল জ্ঞানের তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হয়।[১৪৪]

বিসেট বলেছেন যে জৈনধর্ম "বস্তুজগৎ" ও "আত্মান" গ্রহণ করে, কিন্তু ব্রহ্মকে প্রত্যাখ্যান করে- হিন্দুধর্মের প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া চূড়ান্ত বাস্তবতা এবং মহাজাগতিক নীতির আধিভৌতিক ধারণা।[১৪৫] গোস্বামী, এর বিপরীতে, বলেছেন যে জৈনধর্মের সাহিত্যে অদ্বৈত ধারণার আন্ডারকারেন্ট রয়েছে, যেখানে স্বয়ং যিনি ব্রহ্ম (সর্বোচ্চ বাস্তবতা, সর্বোচ্চ জ্ঞান) জ্ঞান অর্জন করেন তিনি নিজেই ব্রহ্মের অনুরূপ।[১৪৬] জৈনি বলেছেন যে জৈন ধর্ম চূড়ান্ত বাস্তবতার (ব্রহ্ম) ভিত্তিকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করে না, পরিবর্তে জৈন তত্ত্ববিদ্যা অনেকান্তবাদ নামক বহুমুখী মতবাদ গ্রহণ করে। এই মতবাদ ধারণ করে যে "বাস্তবতা অপরিবর্তনীয়ভাবে জটিল" এবং কোনো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা বর্ণনা পরম সত্যকে উপস্থাপন করতে পারে না।[১৪৭][১৪৮] যারা পরম সত্যকে উপলব্ধি করেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন তারাই মুক্তিপ্রাপ্ত ও পরমাত্মা, কেবল জ্ঞানের সাথে।[১৪৭]

টীকা

  1. "not sublatable",[১৩] the final element in a dialectical process which cannot be eliminated or annihilated (German: "aufheben").
  2. It is also defined as:
    • The unchanging, infinite, immanent, and transcendent reality which is the Divine Ground of all matter, energy, time, space, being, and everything beyond in this Universe; that is the one supreme, universal spirit.[১৪]
    • The one supreme, all pervading Spirit that is the origin and support of the phenomenal universe.[১৫]
  3. Saguna Brahman, with qualities
  4. Nirguna Brahman, without qualities
  5. Supreme
  6. Merv Fowler, Zen Buddhism: Beliefs and Practices (Brighton: Sussex Academic, 2005), p. 30: "Upanisadic thought is anything but consistent; nevertheless, there is a common focus on the acceptance of a totally transcendent Absolute, a trend which arose in the Vedic period. This indescribable Absolute is called Brahman [...] The true Self and Brahman are one and the same. Known as the Brahman-Atman synthesis, this theory, which is central to Upanisadic thought, is the cornerstone of Indian philosophy. The Brahman-Atman synthesis, which posits the theory of a permanent, unchanging self, was anathema to Buddhists, and it was as a reaction to the synthesis that Buddhism first drew breath. Merv Fowler p. 47: "For the Upanisadic sages, the real is the Self, is Atman, is Brahman. [...] To the Buddhist, however, any talk of an Atman or permanent, unchanging Self, the very kernel of Upanisadic thought, is anathema, a false notion of manifest proportion."
  7. Merv Fowler, Buddhism: Beliefs and Practices (Brighton: Sussex Academic, 1999), p. 34: "It was inevitable that the non-theistic philosophy of orthodox Buddhism should court the older Hindu practices and, in particular, infuse into its philosophy the belief in a totally transcendent Absolute of the nature of Brahman."
  8. Merv Fowler, Buddhism: Beliefs and Practices (Brighton: Sussex Academic, 1999), p. 82: "The original writers of these Mahayana texts were not at all pleased that their writings were seen to contain the Brahman of the Upanisads in a new form. The authors of the Lankavatara strenuously denied that the womb of Tathagatahood, [...] was in any way equatable with the 'eternal self', the Brahmanical atman of Upanisadic thought. Similarly, the claim in the Nirvana Sutra that the Buddha regarded Buddhahood as a 'great atman' caused the Yogacarins considerable distress."

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.