Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ফরিদ উদ্দিন খাঁ (১৮৯৩-১৯৫৭) ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও প্রকাশক। পেশাজীবনে ছিলেন শিক্ষক, ২৩ বছর স্কুলে (১৯১৬-৩৯) এবং ২ বছর কলেজে (১৯৪১-৪৩); অতঃপর পুস্তক প্রকাশক ও ব্যবসায়ী হিসেবে (১৯৪০-৫৭) সফলতা লাভ করেন। তিনি ছিলেন দশোধিক গ্রন্থের রচয়িতা, তাঁর রচিত কিছু পুস্তক তৎকালীন বাংলা ও আসাম অঞ্চলে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হত।[1][2]
১৮৯৩ সালে পিতার কর্মস্থল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার কোড়েরপাড় গ্রামের বিখ্যাত খাঁ বাড়ি। তাঁর পিতা ইউনুস আলি খাঁ (১৮৬৫-১৯২১) ছিলেন মুরাদনগর অঞ্চলের প্রথম মুসলিম এন্ট্রান্স পাশ (১৮৮৫ সাল) এবং ডাক বিভাগের হেড পোস্টমাস্টার (১৯১০ সালে অবসর নেন)। মাতা জওহরেন্নেসা ছিলেন ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত কোড়েরপাড় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষয়িত্রী। পিতামহ ইউসুফ আলী খাঁ। মাতামহ নাওয়ায মুনশি বর্তমান নরসিংদীর সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নের অন্তর্গত মুরাদনগর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর তিনজন চাচা যথাক্রমে ইদ্রিস আলী খাঁ, ইসরাইল খাঁ এবং ইসমাঈল খাঁ। ফরিদ উদ্দিন খানের ২ ভাই ও ৫ বোন। ভাই দুইজন হচ্ছেন, ফয়েজ উদ্দিন খান ও আলী হোসেন খান। এক বোনের নাম জাহেদা খানম।[1]
১৯১৩ সালে কুমিল্লার মুরাদনগরে অবস্থিত বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯১৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এফএ (আইএ) পাশ করেন। ১৯২০ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। পিতা ইউনুস আলী খাঁ চাইতেন ফরিদ উদ্দিন খাঁ আইন নিয়ে পড়াশোনা করে আইনজীবী হন, কিন্তু সত্যবাদীতা ও সততার প্রতি অনুরক্ত ফরিদ উদ্দিন খাঁ মিথ্যা বলতে হতে পারে এই ভয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে অস্বীকার করেন। বিএ পাশ করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন, কিন্তু ১৯২১ সালে টেলিগ্রামে পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে কলকাতা থেকে চলে আসেন এবং আর ফিরে যান নি।[1][3]
এফএ পাশ করার পর ১৯১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় অবস্থিত শ্যামগ্রাম মোহিনীকিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। তিন বছর শিক্ষকতার পর ১৯১৯ সালে বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ দুই দশক (১৯১৯-১৯৩৯) বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত থাকেন, পাশাপাশি কুমিল্লা আদালতের জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন প্রায় এক যুগ।
১৯৩৯ সালে শ্রী অবনীমোহন মজুমদারের সাথে যৌথভাবে রচিত পুস্তক ভারতের সহজ-শিক্ষা ইতিহাস ঢাকা থেকে ছাপিয়ে প্রকাশ করেন। প্রকাশনার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ১৯৪০ সালে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন এবং সিদ্দিক বাজারের নিজ বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করেন শাহজাহান প্রিন্টিং ওয়ার্কস (প্রেস) নামে একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এবং বাবুবাজারে শাহজাহান লাইব্রেরি নামে প্রকাশনা ও বই বিপণন প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, ফরিদ উদ্দিন খানের রচিত কিছু গ্রন্থ বিভিন্ন উচ্চতর শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪১ সালে ঢাকা ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) শিক্ষকতা শুরু করেন। ২ বছর পর ১৯৪৩ সালে শিক্ষকতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। আমৃত্যু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন।[1][2][4]
ফরিদ উদ্দিন খাঁ সিরাজদিখানের মালখানগর উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সপ্ত ভাইয়ের গৃহবিবাদ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ইসলাম রবি ও প্রলাপ তরঙ্গ (পরবর্তীতে জ্বলন্ত প্রেম) নামে গ্রন্থ দুটিও রচনা করেন ১৯১৩-১৫ সালের মধ্যে যখন তিনি এফএ (আইএ বা বর্তমান ইন্টারমিডিয়েট সমমানের) ক্লাসে অধ্যয়নরত, অর্থাৎ তাঁর বয়স তখন ছিল মাত্র ২০-২২ বছর। ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামে (কোড়েরপাড়ের পাশের গ্রাম) বেড়াতে এলে ফরিদ উদ্দিন খানের সাথে তাঁর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফরিদ উদ্দিন খাঁ তাদের কোড়েরপাড় খাঁ বাড়িতে নজরুলকে দাওয়াত করে নিয়ে আসেন।[2][1]
জীবিকা নির্বাহে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিলে দীর্ঘ সময় নিয়মিত সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে ছিটকে যান ফরিদ উদ্দিন খাঁ। ১৯৪৩ সালে শিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে সক্ষম হন। প্রকাশকালের দিকে তাকালে দেখা যায় ১৯৪৬-৫৩ সময়কালে (৮ বছর) তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, মৃত্যুর পরেও কিছু পুস্তক প্রকাশিত হয়।[2]
সাহিত্যিক ও প্রকাশক এই দুই পরিচয় তাঁর মাঝে একত্রিত হলে ঢাকার সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকদের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সিদ্দিকবাজারের বাসায় তাঁর নিয়মিত আড্ডায় যোগ দিতেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি গোলাম মোস্তফা, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, স্কুল পরিদর্শক ও লেখক মোজাম্মেল হকসহ আরও নানাজন।[1]
ইসলাম রবি (১৯১৯) - হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনীগ্রন্থ। রচনাকালঃ ১৯১৩-১৫ (এফএ ক্লাসে অধ্যয়নরত অবস্থায়)। ইসলাম রবি পুস্তকে 'পরিচয়' শিরোনামে ১৯৫০ সালের ৪ঠা মে তারিখে তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।[5][6]
জ্বলন্ত প্রেম (১৯১৯) - প্রথমে এই পুস্তকটি 'প্রলাপ তরঙ্গ' নামে ১৯১৩-১৫ সালে রচনা করেন, ১৯১৯ সালে জ্বলন্ত প্রেম নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় প্রকাশকালে এই পুস্তক সম্পর্কে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মন্তব্য লিখেনঃ "জ্বলন্ত প্রেম পুস্তকখানি একটি গদ্যকাব্য। আবেগময়ী জ্বলন্ত ভাষায় প্রেমিকের হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ইহার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে ব্যক্ত হইয়াছে। পড়িতে পড়িতে ভাবের আবেশে পাঠক পাঠিকার হৃদয় উত্তাল সাগরের মত দোল খাইতে থাকিবে। উদ্ভ্রান্ত প্রেমর পর বঙ্গভাষায় ইহা এক অপরুপ রসরচনা। ইহার ভাষা লালিত্যময়ী, ভাব অন্তরস্পর্শী। ভাবুক-সমাজে পুস্তকখানির আদর হইবে ইহা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।"[2] এই গ্রন্থটির এত সুখ্যাতি ছিল যে লেখকের জীবদ্দশাতেই সাতটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সপ্তম সংস্করণ ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে (যে বছর লেখক মৃত্যুবরণ করেন) প্রকাশিত হয় যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাজী আবুল কাসেম এবং প্রকাশক ছিলেন কামাল উদ্দীন খান। ১৯৫৭ সালে সপ্তম সংস্করণ প্রকাশের প্রায় ৬০ বছর পর ২০১৭ সালে 'জ্বলন্ত প্রেম' পুস্তকটি গবেষক ও লেখক জয়নাল হোসেনের ভূমিকা ও সম্পাদনায় দ্যু প্রকাশন থেকে পুনরায় প্রকাশিত হয়, ১৯১৯ সালে প্রথম প্রকাশের ৯৮ বছর পর গ্রন্থটি আবার প্রকাশ করে জনসমক্ষে আনা হয়।
পরিণয় সুখ (১৯৪৬)
বেহেস্তের আঙ্গুর (১৯৪৭)
Simple Grammar (১৯৪৭)
জাগ্রত নারী (১৯৪৯)
প্রীতি উপহার (১৯৪৯)
হীরকমালা (১৯৫০)
ইতিহাসের কথা (১৯৫০)
পতির প্রাণ (১৯৫১)
ইতিহাসের গল্প (১৯৫১)
কালো মেয়ে (১৯৫৩)
সবল স্বাস্থ্যকথা (১৯৫৩)
ভ্রান্ত প্রেমিক (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ) - লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। প্রকাশকঃ কামাল উদ্দীন খান।
যৌথরচনাঃ
ভারতের সহজ-শিক্ষা ইতিহাস (১৯৩৯) - শ্রী অবনীমোহন মজুমদারের সাথে যৌথভাবে
ভূগোল ও বিজ্ঞান (১৯৫৩) - ডা. আনসার আলীর সাথে যৌথভাবে[2]
ফরিদ উদ্দিন খাঁ ১৯১৯ সালে তাঁর মামা শামসুল হকের কন্যা শামসুন্নাহারকে বিবাহ করেন। তিনি ৪ পুত্র ও ২ কন্যার জনক। তারা হলেনঃ শামসউদ্দিন খান মোসলেম, কামাল উদ্দীন খান কানন, শফিক খান, মহীউদ্দিন খান রবি, ফয়জুন্নেসা খানম মায়া, ফরিদা রউফ আশা।[1]
প্রথম পুত্র শামস উদ্দিন খান মোসলেম (১৯৩৪-১৯৬৬) ছিলেন কবি ও আলোকচিত্রশিল্পী; ৩২ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় পুত্র প্রকাশক ও ব্যবসায়ী কামাল উদ্দীন খান কানন (১৯৩৭-২০১৬) ছিলেন শাহজাহান লাইব্রেরি এবং শাহজাহান প্রিন্টিং ওয়ার্কস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকাশক। তাঁর স্ত্রী নাজমা কামাল (১৯৫২-২০১৩) স্কুল পরিদর্শক ও সাহিত্যিক মোজাম্মেল হকের কন্যা। কামাল-নাজমা দম্পতির মেজো পুত্র মঈন উদ্দিন খান সাগর নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের টেরিটরি সেলস ম্যানেজার। তাদের কনিষ্ঠ কন্যা মাহমুদা খানমের স্বামী কুমিল্লা সরকারি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এবিএম শিহাব উদ্দিন আহমেদ।[1]
তৃতীয় পুত্র শফিক খান (১৯৪০-২০২০) ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক ও গণমুদ্রণ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার হাশমত আরা সাবেক সচিব মোহাম্মদ হারুন মল্লিকের কন্যা।[7]
চতুর্থ পুত্র ভূতত্ত্ববিদ মহীউদ্দিন খান রবি (১৯৪৩-২০১৪) ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান হাইড্রোজিওলজিস্ট ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা)। এছাড়া ছিলেন ঢাকা পরিবেশ অবকাঠামো প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। তিনি ছিলেন চিরকুমার।
জ্যেষ্ঠ কন্যা ফয়জুন্নেসা খানম মায়ার (১৯৩৮-১৯৫৮) স্বামী কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াহেদ (১৯২৪-১৯৫৯) ছিলেন কৃষি বিভাগের মাসিক কৃষিকথা পত্রিকার সম্পাদক। আব্দুল ওয়াহেদ ও ফয়জুন্নেসা দম্পতির একমাত্র সন্তান ফিরোজা সুলতানা জাপানির স্বামী ডাক্তার গোলাম সাত্তার রহমান হারুন (এমপিএইচ ও এমডি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়)।
কনিষ্ঠ কন্যা ফরিদা রউফ আশা (১৯৫২-২০০৭) এমপি, এবং জামাতা হুইপ আব্দুর রউফ।[8]
রাজনীতিবিদ এডভোকেট সিরাজুল হক তাঁর ভাগ্নে। এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর ভাগ্নে-পুত্র। তাঁর ভাগ্নি কামরুন্নাহার রেণুর বিয়ে হয় সাংবাদিক আতাউস সামাদের সাথে। এছাড়া সম্পর্কে রতন সিদ্দিকীর খালু হন তিনি। [1]
২১শে আগস্ট, ১৯৫৭ (৪ঠা ভাদ্র, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ) সালে ঢাকার সিদ্দিক বাজারের নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।[2]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.