Remove ads
ভারতের সর্ববৃহৎ ইসলামি সংগঠন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ (অনু. ভারতীয় আলেমদের পরিষদ)[১] ভারতের দেওবন্দি আলেমদের অন্যতম প্রধান সংগঠন। একইসাথে এটি ভারতীয় মুসলমানদের সর্ববৃহৎ পুরনো সংগঠন।[২] আব্দুল বারি ফিরিঙ্গি মহল্লী, কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, আহমদ সাইদ দেহলভিসহ প্রমুখ আলেম ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
جمعیت علمائے ہند | |
গঠিত | নভেম্বর ১৯১৯ |
---|---|
প্রতিষ্ঠাতা | |
আইনি অবস্থা | ধর্মীয় সংগঠন |
উদ্দেশ্য | প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস পদ্ধতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা, বর্তমান উদ্দেশ্য হল ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়ন |
সদরদপ্তর | ১, বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ, নতুন দিল্লি |
যে অঞ্চলে কাজ করে | ভারত |
সদস্যপদ | ১ কোটি ২০ লক্ষাধিক এবং লক্ষ লক্ষ অনুগামী |
দাপ্তরিক ভাষা | উর্দু, ইংরেজি |
মহাসচিব |
|
সভাপতি |
|
প্রকাশনা | আল কিফাহ (আরবি মুখপত্র; ১৯৭৩ – ১৯৮৭) |
ওয়েবসাইট | মাহমুদ গ্রুপ আরশাদ গ্রুপ |
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ২০০৮ সালের মার্চ মাসে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়, একটি আরশাদ গ্রুপ এবং অন্যটি মাহমুদ গ্রুপ, উভয়ই "আ" এবং "ম" দ্বারা চিহ্নিত। |
এটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সংগঠনটি ভারত বিভাজনের বিরোধিতাসহ মুসলিম এবং অমুসলিমদের একই জাতি স্বীকৃত দিয়ে সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলস্বরূপ ১৯৪৫ সালে এই সংগঠন থেকে জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম নামে একটি ছোট উপদল বের হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই সংগঠনের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি। ২০২১ সাল পর্যন্ত এই সংগঠন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংগঠন বিস্তারসহ ইদারা মাবাহিছে ফিকহিয়্যাহ, জমিয়ত জাতীয় উন্মুক্ত বিদ্যালয়, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ হালাল ট্রাস্ট, লিগ্যাল সেল ইনস্টিটিউট এবং জমিয়ত যুব ক্লাবের মত প্রতিষ্ঠান ও শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসআদ মাদানির মৃত্যুর পর তার ভাই আরশাদ মাদানি সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে ২০০৮ সালের মার্চে সংগঠনটি আরশাদ গ্রুপ এবং মাহমুদ গ্রুপ নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উসমান মনসুরপুরী মাহমুদ গ্রুপের সভাপতি হন এবং ২০২১ সালের মে মাসে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। অন্তর্বর্তী সভাপতি হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন মাহমুদ মাদানি, যিনি ১৮ সেপ্টেম্বর স্থায়ী হন। আরশাদ মাদানি আরশাদ গ্রুপের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে আগত মুসলিম পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে ১৯১৯ সালের ২৩ নভেম্বর খেলাফত কমিটি দিল্লিতে তাদের প্রথম সম্মেলন করে।[৩][৪] পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে পঁচিশ জনের একটি দল দিল্লির কৃষ্ণ থিয়েটার হলে একটি পৃথক সম্মেলন করে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ গঠন করেন।[৩] তাদের মধ্যে ছিলেন—আব্দুল বারি ফিরিঙ্গি মহল্লী, আহমদ সাইদ দেহলভি, কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মোহাম্মদ আকরম খাঁ।[৫] অন্যান্য পণ্ডিতের মধ্যে ছিলেন—মুহাম্মদ ইব্রাহিম মীর শিয়ালকোটি, আবদুল হালিম গায়াভি, আজাদ সুবহানি, বখশ অমৃতসারী, ইব্রাহিম দারবাঙ্গাভি, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ ইমাম সিন্ধি, মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ সিন্ধি, মুহাম্মদ ফখির, মুহাম্মদ আনিস, মুহাম্মদ সাদিক, খুদা বখশ মুজাফফরপুরী, খাজা গোলাম নিজামুদ্দিন, কাদের বখশ, সালামাতুল্লাহ, সৈয়দ ইসমাইল, সৈয়দ কামাল উদ্দিন, সৈয়দ মুহাম্মদ দাউদ এবং তাজ মুহাম্মদ।[৬]
জমিয়ত, ইসলামি প্রেক্ষাপটের একটি শব্দ, যা একটি সমাবেশ, লীগ বা অন্যান্য সংগঠনকে নির্দেশ করে।[৭] আরবি জমায়েত (جمع) থেকে এই শব্দের উৎপত্তি এবং উর্দুতে এটি বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[৮][৯]
সানাউল্লাহ অমৃতসারির অনুরোধে ১৯১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর অমৃতসরে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি এই সংগঠনের গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া উপস্থাপন করেন।[৪][৩] আবুল মুহাসিন মুহাম্মদ সাজ্জাদ ও মাজহার উদ্দিনকেও মূল প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়।[১০] একটি সাধারণ ভুল ধারণা বিদ্যমান যে, জমিয়ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাহমুদ হাসান দেওবন্দি এবং হুসাইন আহমদ মাদানিসহ তার অন্যান্য সহকর্মীরা, তবে এটি সত্য নয়, কারণ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার সময় তারা মাল্টার কারাগারে ছিলেন।[১১]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠার পর কেফায়াতুল্লাহ দেহলভিকে অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি এবং আহমদ সাইদ দেহলভিকে অন্তর্বর্তীকালীন সাধারণ সম্পাদক করা হয়।[১২] অমৃতসরে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ সভায় সংগঠনটির প্রথম পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়।[৩][১৩] ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে জমিয়তের দ্বিতীয় সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে মাহমুদ হাসান দেওবন্দিকে সভাপতি এবং কেফায়াতুল্লাহ দেহলভিকে সহ-সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এর কয়েকদিন পর দেওবন্দি মৃত্যুবরণ করলে ১৯২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি স্থায়ী সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সহ-সভাপতি এবং একই সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[১২] মাহমুদ হাসান দেওবন্দির মুক্তির পর দারুল উলুম দেওবন্দের আলেমগণ জমিয়তের সাথে যুক্ত হন এবং এটি প্রতিষ্ঠায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা ছিল না।[১৪] বর্তমানে এটি দেওবন্দি আলেমদের একটি প্রধান সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হয়।[১৫]
জমিয়তের প্রাথমিক নীতি ও গঠনতন্ত্র রচনা করেন কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি। অমৃতসরে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, এগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর উপস্থিত একদল আলেমের মতামত নেওয়া হবে এবং পরবর্তী সভায় এগুলো আবার আলোচনা করা হবে।[১৬] দিল্লিতে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় দেহলভির প্রণীত নীতি ও গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়।[১৬] সেখানে সংগঠনটির নাম, “জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ”, সদর দফতর “দিল্লি” এবং সীলমোহর “আল জমিয়তুল মারকাজিয়াহ লিল উলামায়িল হিন্দ” ঠিক হয়।[১৬] এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে বাইরের বা বিদেশি হুমকি থেকে রক্ষা করা; সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে ইসলামি অনুশাসনের মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া এবং ‘দারুলকাধা’ নামে একটি ইসলামি আদালত প্রতিষ্ঠা করা।[১৬]
অমৃতসরে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ সভায় জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রথম পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এর সদস্যরা ছিলেন—আবদুল মজিদ বাদায়ুনি, আবুল মুহাসিন মুহাম্মদ সাজ্জাদ, আহমদ সাইদ দেহলভি, হাকিম আজমল খান, হযরত মোহানি, খোদা বখশ, মাজহার উদ্দিন, মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সিন্ধি, মুহাম্মদ ফখির এলাহাবাদী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মুহাম্মদ ইব্রাহিম মীর শিয়ালকোটি, মুহাম্মদ সাদিক কারাচিভি, রুকনুদ্দিন দানা, সালামাতুল্লাহ ফিরিঙ্গি মহল্লী, সানাউল্লাহ অমৃতসারী, সৈয়দ মুহাম্মদ দাউদ গজনভি এবং তুরাব আলী সিন্ধি।[৩]
১৯২২ সালের ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে জমিয়তের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়।[৩] ৯ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির মধ্যে ছিলেন: আবদুল হালিম সিদ্দিকী, আবদুল মজিদ কাদরি বাদায়ুনি, আবদুল কাদির কুসুরি, আহমাদুল্লাহ পানিপতি, হাকিম আজমল খান, হযরত মোহানি, কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি, মাজহার উদ্দিন এবং শাব্বির আহমদ উসমানি।[১৩] ১৯২২ সালের মার্চে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা বারোতে উন্নীত করা হয়, নতুন তিন সদস্য ছিলেন: আবদুল কাদির বাদায়ুনি, আজাদ সুবহানী এবং ইব্রাহিম শিয়ালকোটি।[১৩] ১৯২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জমিয়ত মুর্তাজা হাসান চাঁদপুরী এবং নিসার আহমদ কানপুরীকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত করে।[১৩]
জমিয়তের সাংগঠনিক কার্যক্রম সারা ভারত জুড়ে বিস্তৃত। ‘আল জমিয়ত’ নামে উর্দু ভাষায় সংগঠনটির একটি দৈনিক পত্রিকা আছে।[১৭] ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয়, ভারতের স্বাধীনতার পর মুহাম্মদ মিয়া দেওবন্দিকে সম্পাদক নিযুক্ত করে ১৯৪৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর পত্রিকাটি পুনরায় চালু হয়।[১৮] জমিয়ত তার জাতীয়তাবাদী দর্শনের একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে, তা হল—স্বাধীনতার পর থেকে মুসলিম এবং অমুসলিমরা ভারতে একটি পারস্পরিক চুক্তিতে প্রবেশ করেছে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ভারতের সংবিধান এই চুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এটি উর্দুতে মুয়াহাদাহ নামে পরিচিত। তদনুসারে, মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যেমন এই মুয়াহাদাকে সমর্থন ও শপথ করে, তেমনি ভারতীয় সংবিধানকে সমর্থন করাও ভারতীয় মুসলমানদের দায়িত্ব। এই মুয়াহাদাটি মদিনায় স্বাক্ষরিত মদিনা সনদের অনুরূপ।[১৭]
১৯২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জমিয়ত ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের জন্য ‘ফতোয়া তারকে মাওয়ালাত’ নামে ৫০০ জন আলেম স্বাক্ষরিত একটি ফতোয়া জারি করে। এটি রচনা করেন আবুল মুহাসিন মুহাম্মদ সাজ্জাদ।[১৯] জমিয়ত ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।[২০] ১৯১৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর লক্ষ্য ছিল একটি “ব্রিটিশ মুক্ত ভারত”।[৩] আইন অমান্য আন্দোলনের সময় এটি ‘ইদারাহ হারবিয়্যাহ’ (অনু. যুদ্ধ পরিষদ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে।[২১][২২]
এই সংগঠনের আলেমদের ঘন ঘন গ্রেফতার করা হত এবং এর সাধারণ সম্পাদক আহমদ সাইদ দেহলভি তার জীবনের ১৫ বছর জেলে কাটান।[২৩] জমিয়ত ব্রিটিশ কাপড় ব্যবহার এড়িয়ে চলতে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রতিজ্ঞা করায় এবং লবণ সত্যাগ্রহে অংশ নেওয়ার জন্য প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তালিকাভুক্ত করে।[২২] জমিয়তের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ছয় মাস গুজরাতের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৩২ সালের ৩১ মার্চ তিনি এক লক্ষেরও বেশি মানুষের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতার হন এবং মুলতান কারাগারে ১৮ মাস কারাভোগ করেন।[২৪] জমিয়তের আরেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মিয়া দেওবন্দিকে পাঁচবার গ্রেফতার করা হয় এবং ব্রিটিশ শাসন ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুসলিম আলেমদের লড়াই নিয়ে আলোচনা করার জন্য তার বই উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী জব্দ করা হয়।[২৫] জমিয়তের আরেক আলেম হিফজুর রহমান সিওহারভি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য একাধিকবার গ্রেফতার হন। তিনি ৮ বছর কারাগারে কাটান।[২৬][২৭] জমিয়তের দ্বিতীয় সভাপতি হুসাইন আহমদ মাদানি ৭ বছর ৯ মাস ব্রিটিশদের কারাগারে কাটান।[২৮]
দারুল উলুম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিস ও তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় দেওবন্দি আলেম হুসাইন আহমদ মাদানি বলেন, মুসলমানরা নিঃসন্দেহে অবিভক্ত ভারতের অংশ এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রয়োজন। ভারত বিভাজন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন।[২৯][৩০] ১৯৪৫ সালে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের মধ্যে একটি উপদল আবির্ভূত হয় যারা নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টিকে সমর্থন করে। এই দলটির নেতৃত্বে ছিলেন জমিয়তের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাব্বির আহমদ উসমানি।[৩১] জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ নিখিল ভারত আজাদ মুসলিম সম্মেলনের সদস্য ছিল, যার মধ্যে অবিভক্ত ভারতের পক্ষে বেশ কয়েকটি মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন ছিল।[৩২]
ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, তাদের সমর্থনের বিনিময়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ভারতীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পায় যে, রাষ্ট্র মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করবে না। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, জওহরলাল নেহেরু এই প্রতিশ্রুতির সাথে একমত হন, তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলমানদের প্রথমে এই আইনগুলো সংস্কার করা উচিত।[৩৩] এসব ছাড় সত্ত্বেও, ভারত ভাগের সময় সারা দেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে পাইকারি হারে হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং অসংখ্য মুসলমান নিহত হয়; জমিয়তে হিন্দ তখন মুসলমানদের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৩৪] সৈয়দ মেহবুব রিজভী বলেন, জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক হিফজুর রহমান সিওহারভি তার অসামান্য চেতনা, সাহস, অটল সংকল্প এবং নেতা ও কর্মকর্তাদের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে এই গুরুতর পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মহান দুঃসাহসিক কাজ সম্পন্ন করেছেন, সন্ত্রাসে আক্রান্ত মুসলমানদের হৃদয় থেকে ভয় ও শঙ্কা দূর করেছেন।[৩৪]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন দেয় এবং তার পক্ষে কাজ করে। এটিকে তারা শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের প্রতিবাদ আখ্যা দেয়।[৩৫] জমিয়তের তৎকালীন সভাপতি আসআদ মাদানি মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ করে এটিকে ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ নয় বলে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে তুলে ধরেন।[৩৬] তিনি ভারতে প্রায় ৩০০ সমাবেশ করে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনে কাজ করেন।[৩৬] ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল ও ১৮ আগস্ট কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে আয়োজিত জমিয়তের কনভেনশন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে দুই দফায় ২টি রেজুলেশন পাস করা হয়।[৩৬] জমিয়তের পক্ষ থেকে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মুসলমান নিয়ে দিল্লিতে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ঘেরাও করা হয়।[৩৭] জমিয়তের পক্ষ থেকে শরনার্থী শিবির ও ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়।[৩৮] বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশে আসেন আসআদ মাদানি। তিনি কাজী মুতাসিম বিল্লাহ সহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সাথে রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ফলে ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ উঠে যায়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেন।[৩৬]
প্রাক্তন সভাপতি আসআদ মাদানির মৃত্যুর পর ২০০৮ সালের মার্চ মাসে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।[৩৯][৪০] আরশাদ মাদানির বিরুদ্ধে জমিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনার পর আরশাদ মাদানি এবং তার ভাতিজা মাহমুদ মাদানির মধ্যে মতবিরোধের কারণে এই বিভাজন ঘটে।[৩৯] হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, আরশাদ তার ব্যক্তিগত শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত শাখাসমূহ এবং এর গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছেন।[৪০] ফলস্বরূপ, ২০০৬ সালের ৫ মার্চ আরশাদকে অবিভক্ত জমিয়তের সভাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়, পরে তিনি তার নেতৃত্বে একটি নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করেন, যাকে তিনি আসল জমিয়ত বলে দাবি করেন।[৪০] বিদ্যমান জমিয়তের নেতৃত্বে ছিলেন মাহমুদ মাদানি এবং ২০০৮ সালের ৫ এপ্রিল এই দলটি উসমান মনসুরপুরীকে তাদের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত করে।[৪০] আরশাদ গ্রুপের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল আলিম ফারুকী, যিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০১ পর্যন্ত অবিভক্ত জমিয়তের ১০ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৩][৪১]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ২০১৯ সালের নভেম্বরে তার শতবর্ষ উদযাপন করে।[৪২] জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম (ফ) ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল থেকে শুরু করে ২ দিন পাকিস্তানের আজাখেল বালায় শতবর্ষ উদযাপন করে।[৪২] এতে সৌদি আরবের সাবেক মন্ত্রী সালেহ বিন আবদুল আজিজ আশ শেখ উপস্থিত ছিলেন।[৪৩]
২০০৮ সালের নভেম্বরে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের ২৯তম সাধারণ সভায় ৬০০০ জন আলেম একটি সন্ত্রাসবিরোধী ফতোয়ার অনুমোদন দেন। এই ফতোয়াটি দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃক জারি করা হয় এবং এর প্রধান মুফতি হাবিবুর রহমান খায়রাবাদী কর্তৃক ২০০৮ সালের মে মাসে স্বাক্ষরিত হয়।[৪৪] এই সভায় রবি শঙ্কর এবং স্বামী অগ্নিবেশ উপস্থিত ছিলেন।[৪৪] ফতোয়ায় বলা হয় যে,
“ | ইসলাম সকল প্রকারের অন্যায্য সহিংসতা, শান্তির লঙ্ঘন, রক্তপাত, হত্যা ও লুণ্ঠনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর কোনরূপ অনুমতি প্রদান করে না। এটিই ইসলামের মূলনীতি যে, আপনি সৎকর্মে পরস্পরকে সহায়তা করেন এবং পাপ বা নিপীড়নের জন্য কাউকে সহযোগিতা করবেন না। পবিত্র কুরআনে প্রদত্ত সুস্পষ্ট নির্দেশিকাতে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্ব শান্তির নির্দেশ দেওয়া ইসলামের মতো ধর্মের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদ মুছে ফেলার জন্য এবং বিশ্ব শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল। | ” |
— [৪৫] |
২০০৯ সালে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ বলেছিল যে, হিন্দুদের কাফের বলা যাবে না। কারণ এই শব্দটির অর্থ “অমুসলিম” হলেও এর ব্যবহারে সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।[৪৬] ২০০৯ সালের নভেম্বরে জমিয়ত একটি প্রস্তাব পাস করে যাতে বন্দে মাতরম্কে একটি ইসলাম-বিরোধী গান বলে উল্লেখ করা হয়। এর বিরোধিতা করে মুসলিম জাতীয় মঞ্চের আহ্বায়ক মোহাম্মদ আফজাল বলেন, “আমাদের মুসলিম ভাইদের ফতোয়াটি অনুসরণ করা উচিত নয়। কারণ বন্দে মাতরম্ দেশের জাতীয় সংগীত এবং প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের উচিত এটি সম্মান করা ও আবৃত্তি করা।[৪৭]
১৯৩৪ সালে বাবরি মসজিদের কয়েকটি অংশ ভাঙচুর করা হয় এবং রামসহ হিন্দু দেবদেবীর ছবি খোদাই করে স্থাপন করা হয়। জমিয়তের তৎকালীন সভাপতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি অযোধ্যা পরিদর্শন করেন এবং পরে জমিয়তের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।[৪৯] কার্যনির্বাহী কমিটি বাবরি মসজিদ মামলা অনুসরণ করে এবং ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হুসাইন আহমদ মাদানির সভাপতিত্বে এবং আবুল কালাম আজাদ ও হিফজুর রহমান সিওহারভির উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে।[৫০] পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফৈজাবাদের জেলা দায়রা জজ কৃষ্ণ মোহন পান্ডে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতি দিতে বাবরি মসজিদের গেটের তালা খুলে দেওয়ার আদেশ দেন।[৫১][৫২] জমিয়তের সভাপতি আসআদ মাদানি ও আসরারুল হক কাসেমি ভারত সরকারের কাছে এই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আবেদন করেন এবং একই সঙ্গে এই আদেশের বিরুদ্ধে একটি আবেদনও উত্থাপন করেন।[৫১] ১৯৮৬ সালের ৩ মার্চ রাজীব গান্ধীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়; তাকে এই মামলায় ব্যক্তিগত আগ্রহ নিতে এবং বিষয়টির সমাধানে সহায়তা করতে বলা হয়।[৫৩] ১৯৮৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাবরি মসজিদ মামলার পর্যালোচনার জন্য জমিয়ত একটি কমিটি গঠন করে। এতে জলিল আহমদ সিওহারভি, মুহাম্মদ মতিন এবং আইনজীবী জাফরিয়াব জিলানি ও মুহাম্মদ রাইক ছিলেন।[৫৩] ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদকে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ছেড়ে দিতে এবং মুসলমানদের ৫ একর জমি নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য আদেশ দিলে জমিয়ত এটিকে “স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়” বলে মন্তব্য করে।[৫৪][৫৫] আরশাদ মাদানি বলেন, যদিও মুসলিম সংগঠনগুলো বাবরি মসজিদ হারিয়েছে, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ অন্যান্য উপাসনালয়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে।[৫৬]
দি ইকোনমিক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আরশাদ মাদানি বলেন, “আমরা এই দেশের নাগরিক এবং আমাদের জায়গার উপর আমাদের অধিকার আছে। আমরা আমাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেগুলো রক্ষা করতে থাকব। একটি মামলার ভাগ্য সব ক্ষেত্রে ভাগ্য নয়। এখনও আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা আছে।”[৫৬] জমিয়তের অবস্থান ছিল, বাবরি মসজিদের জন্য কোন বিকল্প স্থান গ্রহণযোগ্য নয় এবং মুসলিম সংগঠনগুলোর কোন প্রস্তাবিত জমি বা অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়।[৫৭]
২০১৭ সালের মে মাসে জমিয়তের মাহমুদ গ্রুপ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে উসমান মনসুরপুরীর নেতৃত্বে আসাম চুক্তির পক্ষালম্বন করে।[৫৮] তারা জাতীয় নাগরিক পঞ্জির সমর্থনে একটি প্রস্তাবও পাস করে।[৫৯] অবশ্য আরশাদ গ্রুপের সভাপতি আরশাদ মাদানি বলেন, "এনপিআর–এনআরসি প্রকল্প ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার অংশ।”[৬০] তিনি এটাও মনে করেন যে, এটি মুসলিম ও দলিতসহ আরও কিছু সম্প্রদায়ের জন্য বড় হুমকি।[৬০] ফলশ্রুতিতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাহমুদ গ্রুপ ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯–এর বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ দায়ের করে এই কারণে, আইনটি অভিবাসীদের কোন ‘বোধগম্য ভিন্নতা’ ছাড়াই শ্রেণীবদ্ধ করেছে এবং বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ভাবে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করেছে।[৬১] দলটি কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও সমর্থন করেছিল।[৫৯]
২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা সম্পর্কে অক্টোবরে আরশাদ মাদানি বলেন, “জেলা প্রশাসনকে জবাবদিহি না করে দেশে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।”[৬২] ২০২০ সালের অক্টোবরের উম্মিদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার নেতৃত্বে জমিয়ত দিল্লি দাঙ্গায় অভিযুক্ত মুসলমানদের মামলাগুলো লড়ে এবং দিল্লি হাইকোর্ট ১৬টি জামিনের আবেদন গ্রহণ করে।[৬২]
যৌতুকের কারণে আয়েশা নামে এক যুবতীর আত্মহত্যার ভিডিও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে[৬৩] জমিয়তের পুনে সার্কেল ২০২১ সালের মার্চ মাসে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে একটি প্রচারণা শুরু করে।[৬৪] জমিয়তের আলেমরা বলেন, মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করতে তারা জুমার নামাজকে একটি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করবেন।[৬৪]
২০২১ সালের জুনে আসামের মুখ্যমন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির ঘোষণা দিলে জমিয়তের আসাম শাখা ৫ জুলাই একটি বিবৃতিতে জানায়, “সরকার জোর করে এটি বাস্তবায়ন করলে জমিয়ত সমর্থন করবে না।”[৬৫] সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম কাসেমি বলেন, “সংখ্যালঘুদের উপর জন্ম নিয়ন্ত্রণ নীতি আরোপ করা যাবে না এবং জনসংখ্যা নীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপর একটি আইন থাকা উচিত।”[৬৫]
২০২১ সালের জুন মাসে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের গুজরাত শাখা কোভিড-১৯ টিকা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে একটি শিবিরের আয়োজন করে। ভাবনগর এবং পালনপুরের মতো অঞ্চলগুলো থেকে ৬০ জন আলেম এই শিবিরে অংশ নেয়।[৬৬] জমিয়তের সাথে যুক্ত স্থানীয় আলেম ইমরান ধেরিওয়ালা বলেন, “টিকা নিয়ে সরকারের প্রতি সম্প্রদায়ের গভীর অবিশ্বাস রয়েছে, কিন্তু জনগণের বিশ্বাস আল্লাহ যেকারো মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেন এবং কেউ টিকা না নিলেও তিনি তাকে রক্ষা করেন।” তিনি আরও বলেন, “আমরা মানুষের কাছ থেকে এই ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করছি। কারণ ইসলামের শিক্ষায় একজন ব্যক্তির জীবন রক্ষার জন্য ওষুধের প্রয়োজন আছে; এইভাবে টিকাকরণ প্রয়োজন ছিল এবং আমরা এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।”[৬৬] জমিয়তের আরশাদ অংশের সভাপতি আরশাদ মাদানি বলেন, “যা মানুষের জীবন বাঁচায় তা জায়েজ। আমাদের টীকা নেওয়া উচিত এবং কোভিড-১৯ থেকে নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের সবাইকে রক্ষা করা উচিত।”[৬৭]
দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া ২০২২ সালের ২২ জুন একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জমিয়তের দুটি উপদল একটি একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে যা খুব শীঘ্রই বাস্তবায়িত হতে পারে।[৬৮] ২০২২ সালের ১৬ জুলাই দ্য হিন্দু প্রতিবেদন দিয়েছে, "কনিষ্ঠ মাদানীর উপদলটি জমিয়তের সভাপতি হিসেবে জোষ্ঠ্য মাদানীর অধীনে কাজ করতে সম্মত বলে জানা গেছে।"[৬৯] ২০২২ সালের ২৮ মে মাহমুদ মাদানীর আমন্ত্রণে আরশাদ মাদানী দেওবন্দে জমিয়তের একটি সাধারণ সভায় যোগদান করেন। তার আমন্ত্রণ গ্রহণকে পুনর্মিলনের দিকে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে।[৬৯] দেওবন্দের সভায় আরশাদ মাদানী ব্যক্ত করেন যে, "জমিয়তকে একত্রিত হতে হবে যাতে আমাদের কণ্ঠস্বর শক্তিশালী হতে পারে।"[৬৯]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ ১৯৭০ সালে ইদারা মাবাহিছে ফিকহিয়্যাহ প্রতিষ্ঠা করে এবং মুহাম্মদ মিয়া দেওবন্দি এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন।[১৮][৭০] প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের মার্চ মাসে তাদের পঞ্চদশ ফিকহি সেমিনারের আয়োজন করে।[৭১] সেমিনারে গুগল অ্যাডসেন্স, পেটিএম নগদ অর্থ এবং মোবাইল ও ইন্টারনেট সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় ইসলামি আইনে অনুমোদিত কিনা? আলোচনা করা হয়। এতে সাঈদ আহমদ পালনপুরী এবং শাব্বির আহমাদ কাসেমিসহ মুসলিম ফকিহরা উপস্থিত ছিলেন।[৭১]
২০১৮ সালের জুলাই মাসে জমিয়ত যুব ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়। এর লক্ষ্য তরুণদের সাম্প্রদায়িক সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন আত্মরক্ষা কৌশলের প্রশিক্ষণ প্রদান করা।[৭২] এটিকে “পাইলট প্রকল্প” বলা হয়। জানা যায়, জমিয়ত প্রতি বছর প্রায় ১২.৫ লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ দেবে বলে আশা করছে এবং ২০২৮ সাল নাগাদ একশটিরও বেশি ভারতীয় জেলার প্রায় ১২৫ লাখ যুবক জমিয়ত যুব ক্লাবে যোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।[৭২][৭৩] মাহমুদ মাদানি বলেন, ক্লাবটি স্কাউট ও গাইডের মত তরুণদের প্রশিক্ষণ দেবে। তাদের বিভিন্ন উপায়ে শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।[৭৩]
জমিয়তের একটি হালাল ঘোষণাকারী সংস্থা রয়েছে যা ‘জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ হালাল ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত।[৭৪] এটি ২০০৯ সালে স্থাপিত হয় এবং ২০১১ সালে মালয়েশিয়ার ইসলামিক উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক “মাংস, মাংসজাত পণ্য এবং কসাইখানায় হালাল শংসাপত্র প্রদানের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও কর্তৃত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান” হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়।[৭৪] ২০২০ সালের এপ্রিলের তথ্যানুযায়ী, এর সচিব হলেন নিয়াজ আহমদ ফারুকী।[৭৫]
জমিয়ত জাতীয় উন্মুক্ত বিদ্যালয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় সংস্থার অনুরূপ।[৭৬] শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত কর্মী এবং পরিকাঠামো সরবরাহ করে যার মাধ্যমে তারা জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় সংস্থার অধীনে দেওয়া কম্পিউটার, গণিত, বিজ্ঞান, ভাষা এবং অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করতে পারে। বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের উচ্চমানের এবং সমসাময়িক একাডেমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কারণ প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী মাদ্রাসা থেকে স্নাতক হয়, কিন্তু তাদের মাঝে প্রায়শই পর্যাপ্ত সমসাময়িক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা এবং দক্ষতার অভাব থাকে।[৭৬][৭৭]
জমিয়ত বি. টেক., এম. টেক, বিএসসি আইটি এবং অন্যান্য মেডিকেল ও প্রকৌশল কোর্সের মত পেশাদার কোর্স গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে।[৭৮] ২০১২ সাল থেকে তালেমি ইমদাদি ফান্ডের মাধ্যমে আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের এই বৃত্তি প্রদান করা হয়।[৭৮]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের লিগ্যাল সেল ইনস্টিটিউটও রয়েছে, যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত মুসলমানদের আইনি লড়াই করতে সহায়তা করা হয়।[৭৯][৮০] ২০০৭ সালে আরশাদ মাদানি এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত সমগ্র ভারতে ১৯২টি মামলায় খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি সহায়তা করেছে।[৮০] মাদানি বলেন, ভারতে বিভিন্ন অভিযোগে নিরীহ লোকদের তুলে নিয়ে নিয়মিত কারাগারে রাখা হয় দেখে এবং আইনি লড়াইয়ে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তাদের পরিবার তাদের সম্পদ ও বাড়ি বিক্রি করে এবং তাদের সঞ্চয় ব্যয় করে ইত্যাদি দেখে তিনি প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন।[৮০] ২০১৯ সালের মে মাসে দি নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, “প্রথম তিনটি মামলা যা লিগ্যাল সেল গ্রহণ করে, সেগুলো হল: ২০০৬ মুম্বাই উপনগরীয় রেলে বোমা হামলা, ২০০৬ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ এবং ২০০৭ সালে ঔরঙ্গাবাদ অস্ত্র বহন মামলা।”[৮০] ২০০৮ সালের মুম্বই জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত ফাহিম আনসারী ও সাবাউদ্দিনের আইনজীবী ছিলেন শহীদ আজমী।[৮১][৮২] আজমি ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।[৮৩] ইনস্টিটিউট অভিযুক্ত উভয়কে ট্রায়াল কোর্টে এবং তারপর হাইকোর্টে সহায়তা করে। হাইকোর্ট তাদের বেকসুর খালাস বহাল রাখে এবং দুজনই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে মুক্তি পান।[৮১] আরেক মামলায় ইনস্টিটিউট ২০০৬ সালে মালেগাঁও বিস্ফোরণের অভিযোগে অভিযুক্ত ৯ জন মুসলিম যুবককের পক্ষালম্বন করে এবং ২০১৬ সালে তারা সবাই খালাস পায়।[৮৪][৮৫]
অন্যান্য যে সকল মামলায় ইনস্টিটিউট আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনে আইনি সহায়তা প্রদান করেছে তার মধ্যে রয়েছে: মুলুন্দ বিস্ফোরণ মামলা, গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া বিস্ফোরণ মামলা এবং ১৩/৭ মুম্বই ত্রি বিস্ফোরণ।[৮১] ইনস্টিটিউটের সমর্থন কেবল মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা ২০১২ সালে একজন হিন্দু ব্যক্তিকে সাহায্য করে, যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও পরে তাকে খালাস দেওয়া হয়।[৮১] ১১ জন মুসলিম ২৫ বছর কারাগারে কাটানোর পর ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ইনস্টিটিউটের সহায়তায় বিশেষ টিএডিএ আদালতে বেকসুর খালাস পায়।[৮৬] ২০২১ সালের জুন মাসে নয় বছর কারাগারে কাটানোর পর ইউএপিএ অভিযোগ থেকে দুজনকে মুক্ত করা হয় এবং দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য তাদের লিগ্যাল সেলের গুলজার আজমিকে ধন্যবাদ জানাতে দেখা যায়।[৮৭]
লিগ্যাল সেল ইনস্টিটিউটের প্রধান গুলজার আজমি বলেন, “সন্ত্রাসীদের ফাঁসি দিলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু আমাদেরকে কষ্ট দেয় তখন যখন নিরপরাধ মানুষের নামে মিথ্যা সন্ত্রাসবাদী মামলা করা হয়।”[৮৮] সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টিটিউট ২০২১ সালের জুলাই মাসে সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড কর্তৃক গ্রেফতার হওয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে সাহায্য করছে বলে জানা গেছে। আরশাদ মাদানি এই মামলার বিষয়ে বলেন, “মুসলিম যুবকদের জীবন ধ্বংস করার জন্য সন্ত্রাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। নিরীহ মুসলমানদের সম্মানজনক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আইনি লড়াই অব্যাহত থাকবে।”[৮৯] ২০২১ সালের জুনে উমর গৌতমকে বেআইনিভাবে ধর্মান্তরকরণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়, যিনি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান। জমিয়ত তার মুক্তিতে আইনি সহায়তা প্রদান করেছে।[৯০]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের একটি প্রকাশনা বিভাগও রয়েছে যার মাধ্যমে সংগঠনটি ‘ইসলাম মে ইমামত আওর ইমারাত কা তাসাউউর’ (ইসলামে নেতৃত্ব ও আমিরাতের ধারণা), ‘হিন্দুস্তান আওর মাসলায়ে ইমারাত’ (ভারত ও আমিরাত সমস্যা) এবং ‘ইসলাম দ্য বিনেভোলেন্ট ফর অল কনস্ট্রাকটিভ প্রোগ্রামস অব জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ’ (জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সকলের জন্য পরোপকারী গঠনমূলক প্রোগ্রাম) ইত্যাদি বই প্রকাশ করেছে।[৯১][৯২]
কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রথম সভাপতি এবং হুসাইন আহমদ মাদানি ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় সভাপতি হন।[৯৩] আসআদ মাদানি ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পঞ্চম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে তার ভাই আরশাদ মাদানি স্থলাভিষিক্ত হন।[৯৪] ২০০৮ সালের মার্চ মাসে জমিয়ত আরশাদ ও মাহমুদ গ্রুপে বিভক্ত হয়।[৩৯][৪০] মাহমুদ মাদানি ২০২১ সালের ২৭ মে মাহমুদ গ্রুপের সাবেক সভাপতি উসমান মনসুরপুরীর মৃত্যুর পর অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হন এবং আরশাদ মাদানি আরশাদ গ্রুপের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৯৫][৯৬] ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাহমুদ মাদানি মাহমুদ গ্রুপের স্থায়ী সভাপতি নিযুক্ত হন।[৯৭]
জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আহমদ সাইদ দেহলভি এবং অবিভক্ত জমিয়তের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদ মাদানি, যিনি পরবর্তীতে মাহমুদ গ্রুপের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হন।[৪০][১২][৯৮] মাহমুদ গ্রুপের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হলেন হাকিমউদ্দিন কাসেমি।[৯৮] ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে মাসুম সাকিব কাসেমি আরশাদ গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন।[৯৯]
১৯২০ সালে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ সাদিক করাচিভি করাচিতে জমিয়তের একটি রাজ্য শাখা প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজীবন এর সভাপতি ছিলেন।[১০০] জমিয়তের এখন সারা ভারতে রাজ্য শাখা রয়েছে। বর্তমানে এটি ভারতীয় মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সংগঠন।[১০১] নিখিল ভারতীয় সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চার প্রতিষ্ঠাতা বদরুদ্দিন আজমল আসাম রাজ্য শাখার সভাপতি।[৫৮] পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সভাপতি।[১০২]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.