অসম চুক্তি (১৯৮৫) ভারত সরকার এবং আসাম আন্দোলন এর নেতৃত্বের মধ্যে ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট নতুন দিল্লীতে স্বাক্ষর হওয়া একটি সমঝোতা চুক্তি (ইংরেজি:Memorandum of Settlement (MoS))। [1][2] এই চুক্তির মাধ্যমে আসাম আন্দোলন এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে যা পরবর্তী সময়ে আসাম সরকার গঠন করেছিল।
যদিও এই চুক্তির মাধ্যমে আসাম আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল, চুক্তির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দফা আজ ও কার্যকর হয় নাই। যার ফলশ্রুতিতে কিছু মূল সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। [3]
আসামে বহিরাগত সমস্যার সমাধান করতে তৎকালীন আসাম রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে৷ সদৌ অসম ছাত্র সন্থা ও অসম গণ পরিষদ অসমীয়াদের এদুটি সংগঠনও সমস্যার সমাধানে আগ্রহ দেখায়৷[4]
সদৌ অসম ছাত্র সন্থা বিদেশ তথা বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত আসতে থাকা শরণার্থীদের ফলে আসামের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ২রা ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লেখেন৷
ছাত্র সংগঠনের আশঙ্কাকে যুক্তিযুক্ত মনে করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদের সাথে বৈঠকে বসতে সচেষ্ট হন৷ ১৯৮০-৮৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও গৃৃহমন্ত্রীর সঙ্গে এই আলোচনা সম্পন্ন হয়৷ ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে একাধিকবার বৈঠক হয় ও পর্যাপ্ত তথ্য আদান-প্রদান হয়৷ ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে এই বিষয়ে পুণরালোচনা হয়৷
সংবিধান, আইনি সংস্থান, আন্তর্জাতিক সম্মতি চুক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি, বদান্য বিবেচনা প্রভৃৃতি সমস্যাগুলি মাথায় রেখে উক্তবিষয়ক সমস্ত আলোচনা অগ্রসর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ আলোচ্য বিষয়গুলি নিম্নরূপ:
বিদেশী সমস্যা
১) ১লা জানুয়ারী ১৯৬৬, এই তারিখটির ওপর ভিত্তি করে বিদেশী শনাক্তকরণ এবং তাদের নাম নির্বাচনী ও নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে৷
২) ১লা জানুয়ারী ১৯৬৬ তারিখের পূর্বে আসা বা স্থানীয় অধিবাসী অথবা যাদের নাম ১৯৬৭র নির্বাচনী তালিকাতে ছিলো তাদেরকে বিধিসম্মত নির্ভুল ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ধরা হবে৷
৩) যে সমস্ত বহিরাগত ১লা জানুয়ারী ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২৪শে মার্চ ১৯৭১ এর মধ্যে বিদেশ থেকে আসামে এসেছেন তারা ১৯৪৬ এর বিদেশী শনাক্তকরণ আইন ও ১৯৬৪র বিদেশী ট্রাইবিউন্যাল আইনের আওতাভুক্ত হবে৷
৪) বিদেশী হিসাবে তালিকাবদ্ধদের শনাক্ত করে নির্বাচনী ভোটার তালিকা থেকে নাম বহিষ্করণ করা চালু থাকবে৷ বিদেশী নিবন্ধীকরণ আইন ১৯৩৯ এবং ১৯৩৯ বিদেশী নিবন্ধন নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক সন্দেহভাজন অনাগরিককে সংশ্লিষ্ট জেলার নাগরিকত্ব নিবন্ধন কার্যালয়ে আপিল করতে পারেন নিজেকে নাগরিক প্রমাণ করার জন্য৷
৫) উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যে সুষ্ঠুভাবে কাজ চালানোর জন্য ভারত সরকার উপযুক্ত নির্ভুল সরকারী যন্ত্রাদি প্রদান করবেন৷
৬) বিদেশী হিসাবে শনাক্তকরণের ১০ বছর অতিক্রম হওয়ার পর নির্বাচনী তালিকাদের বিষ্কার করা নামগুলি পুনরায় বিবেচনার মাধ্যমে পুণরুদ্ধার করা হবে৷
৭) যেসমস্ত বিদেশীকে আগে থেকেই বিতাড়িত করা হয়েছিলো কিন্তু তৎসত্ত্বেও তারা আবার পুনরায় আসামে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তাদেরকে আবার একইভাবে বিতাড়িত করতে হবে৷
৮) ২৫শে মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ, এই তারিখের পরে আসামে আসা বিদেশীডের আইন অনুসারে শনাক্তকরণ, নির্বাচনী তালিকা থেকে বহিষ্করণ ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকবে৷ এই সমস্ত বিদেশীদের বিরুদ্ধে আপৎকালীন কড়া পদ্ধতি নেওয়া হবে৷
৯) অবৈধ অভিবাসী আইন ১৯৮৩ বিষয়ে আসাম ছাত্র সংগঠনের দ্বারা আনীত বিভিন্ন জটিলতাকে ভারত সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে৷
সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতিসাধন
আসামে অসমীয়া ভাষীদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ভাষাগত দিকগুলিকে সুরক্ষা প্রদান, সংরক্ষণ ও বর্ধন করার জন্য উপযুক্ত আইনগত, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে৷
স্থানীয়দের জীবনশৈলীর উন্নতির জন্য আসামে দ্রুত সার্বিক তথা অর্থনৈতিক উন্নতিসাধনের প্রতিশ্রুতি ভারত সরকার দেবে এবং তা সফল করার চেষ্টা করবে৷ আসামে বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে সামে শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দিকগুলির ওপর জোর দিতে হবে৷
অন্যান্য সমস্যা
১) কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে ভবিষ্যতে নাগরিকত্ব সংশাপত্র বিষয়ক সমস্যাগুলি আসাম সরকার বিবেচনা করবে৷
২) আসাম গণ পরাষদ ও আসামে ছাত্র সংগঠন দ্বারা আনীত অনিয়মিত সমস্যাগুলির অভিযোগ নির্দিষ্ট করে তা পুণর্মূল্যায়ন করতে হবে৷
ভবিষ্যতে আবার অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থাকায় আন্তর্জাতিক সীমান্তকে সুগঠিত ও সুদৃৃঢ় করতে হবে, যা অবশ্যই দেওয়াল বা অন্যপ্রকার ভৌতবাধা তৈরীর মাধ্যমে করতে হবে৷ সীমান্তে সঠিক স্থানে কাঁটাতারের বেড়া বা অন্যকোনো প্রকার বাধা তেরী করতে হবে৷ নিরাপত্তার কারণে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ভূ-সীমান্ত ও নদী-সীমান্ত উভয়স্থানে পর্যাপ্ত পরিমানে সশস্ত্র সৈন্যদল মোতায়েন করতে হবে৷ সশস্ত্র বল আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ও পরবর্তীকালে অনুপ্রবেশ আটকাতে আসামে সীমান্ত বরাবর পর্যাপ্ত স্থলসীমান্ত বন্দর নির্মান করতে হবে৷
নিরাপত্তা ও নজরদারি সংক্রান্ত উপর্যুক্ত ব্যবস্থাটি লাগু করার সাথে সাথে সীমানা নিরাপত্তা বাহিনীর টহল সহজতর করার জন্য আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর বর্ডার রোড তেরী করা উচিত৷ যেখানে সম্ভব সেখানে সীমানা ও বর্ডার রোডের মধ্যবর্তীস্থানকে বাসস্থানের জন্য মুক্ত রাখা উচিত৷ নদীসীমানা বন্দরগুলিতে তীব্র নজরদারি রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ আন্তসীমান্ত অনুপ্রবেশ আটকাতে এবং অনুপ্রবেশকারীদের ধরতে সমস্ত প্রকার কার্যকর পন্থা অবলম্বন করতে হবে৷
সরকারী ভুসম্পত্তিগুলিতে অনধিকারপ্রবেশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আটকানো নিশ্চিত করতে হবে৷ এছাড়া উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে বহিরাগতদের জোরপূর্বক অনধিকারে ভূমি অধিগ্রহণ আইন করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷
আসামে বিদেশীদের দ্বারা স্থাবর সম্পত্তির জোরপুর্ব্বক দখল নেওয়া আইন প্রণয়ন করে আটকানোর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে৷
জন্ম এবং মৃৃত্যু সম্পর্কিত নথিপত্রগুলি যথাবৎ পোষন করা নিশ্চিত করতে হবে৷
স্বাভাবিকত্ব প্রত্যর্পণ
সদৌ অসম ছাত্র সন্থা এবং সদৌ আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ মিলিতভাবে আসামে উৎকণ্ঠা ফেরান এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সহযোগীতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের সমর্পিত করে৷
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার নিম্নোক্ত বিষয়গুলিতে সম্মতি দেয়:
ক) সহানুভূতির সঙ্গে তথ্য পর্যালোচনা করা হবে, রাজ্যে উৎকণ্ঠা পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী যারা তাদের উপর আপাতত সমস্ত ধরনের শাস্তিমুলক ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে এবং প্রতিশোধমূলক নিপীড়ন যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে৷
খ) অশান্তিকর পরিস্থিতি চলাকালীন নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়দের ক্ষতিপুরণ সহ স্থায়ী চাকরি ব্যবস্থা করা হবে৷
গ) আসামে উৎকণ্ঠা প্রসঙ্গে ঐ রাজ্যে সরকারী জনসেবামূলক চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে সহানুভূতিশীল বিচার বিবেচনার মাধ্যমে বয়সের সীমা বৃদ্ধি করা হবে৷ পরিকাঠামোগত, প্রশাসনিক ও প্রতিযোগীতামূলক ক্ষেত্রগুলির ব্যাপারে পুরানো নিয়মই বহাল থাকবে৷
ঘ) বিচারালয়ে আটক মামলাগুলির পুনঃসমীক্ষা করা হবে৷ এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের মামলা ছাড়াও আসামে অস্থির পরিস্থিতির সময়ে ফৌজদারী অপরাধীদের দৃৃৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা হবে৷
ঙ) নিষেধাজ্ঞামূলক কোনো বিজ্ঞপ্তি আগে থেকে দেওয়া হলে তা পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যাহার করার কথা ভাবা হবে৷
- উপর্যুক্ত সকল বিষয়ে গৃৃৃহমন্ত্রী সংযোগী মন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করবে৷
- নির্বাচনী মন্ত্রকদের ত্রুটিহীন ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনী তালিকা তৈরীর নির্দেশ দেওয়া হয়৷
- নির্বাচনী সুত্র মেনে তথ্য পর্যালোচনার সময় নির্ধারিত সময়ের থেকে আরো ৩০ দিন বৃৃদ্ধি করা হয়৷
- আসামে নির্বাচন কমিশন পরিদর্শনের জন্য কেন্দ্র থেকে পরিদর্শক পাঠানো হয়৷
- আসামে ভবিষ্যতে তৈল শোধনাগার গড়ে তোলা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
- বন্ধ হয়ে যাওয়া অশোক কাগজকল ও পাটকলগুলি আবার চালু করতে কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারকে পারিশ্রমিক দান করে ও পূর্ণ সহযোগীতা করে৷
- গুয়াহাটি শহরে একটি আই.আই.টি. প্রতিষ্ঠিত করা হয়৷