Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
প্রাকৃতিক নির্বাচন এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো জনগোষ্ঠীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এটি ডারউইনীয় বিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি।
যেকোন জনগোষ্ঠীতেই প্রাকৃতিকভাবে প্রকরণ উৎপন্ন হয়, এর ফলে কিছু কিছু প্রাণী টিকে থাকতে সমর্থ হয় ও প্রজননে অপেক্ষাকৃত বেশি সফল হয়। প্রজননগত সাফল্য নির্ধারণকারী উপাদানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ, যা চার্লস ডারউইন বিস্তারিতভাবে তাঁর যৌন নির্বাচন তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রাকৃতিক নির্বাচন মূলত বহির্বৈশিষ্ট্যর (ফেনোটাইপ) উপর কাজ করে কিন্তু বহির্বৈশিষ্ট্যর বংশাণুগত ভিত্তি, যা প্রজননগত সাফল্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, জনগোষ্ঠীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে। (দেখুন: অ্যালিল কম্পাঙ্ক)। এভাবে ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে প্রাণীরা তাদের আপন পরিবেশের (Ecological niche) জন্য বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন প্রজাতিতে রুপান্তরিত হয়। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক নির্বাচন এমন একটি প্রক্রিয়া (তবে একমাত্র প্রক্রিয়া নয়) যার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী হতে নতুন প্রজাতির উদয় ঘটে। এটি এমন এক ছাঁকনি যার ভেতর দিয়ে শুধু উপকারী প্রকরণগুলোই গমন করতে পারে। কৃত্রিম নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষই এই "ছাকনি"-র ভূমিকা পালন করে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন আধুনিক জীববিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। ডারউইন প্রথম তার অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস[1] গ্রন্থে এই শব্দটি প্রবর্তন করেন, যেখানে তিনি একে কৃত্রিম নির্বাচনের (যেই প্রক্রিয়ায় মানুষ তার পছন্দের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বংশবৃদ্ধি করার জন্য নির্বাচন করে) সাথে তুলনা করেছেন। ডারউইনের এই তত্ত্ব প্রবর্তনের সময় বংশগতিবিদ্যা অজানা ছিল। ধ্রুপদী বংশগতিবিদ্যা আর আণবিক বংশগতিবিদ্যার সাথে ডারউইনীয় বিবর্তনের মিলনকে বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণ বলে। অভিযোজনমূলক বিবর্তনের প্রাথমিক ব্যাখ্যা এখনও প্রাকৃতিক নির্বাচন।
যেকোন জনগোষ্ঠীতেই প্রাকৃতিকভাবে প্রকরণ উৎপন্ন হয়। অনেক প্রকরণই প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করে না (যেমন, মানুষের চোখের রঙ), কিন্তু কিছু কিছু করে। একটি খরগোশ অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী হলে সহজেই শিকারীর হাত থেকে পালাতে পারবে, কোন শৈবাল সালোকসংশ্লেষণে বেশি পারদর্শী হলে অন্যদের চেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠবে। কোন প্রকরণ প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করলে তার প্রজননের হারকেও প্রভাবিত করবে; তবে মাঝে মাঝে দু’টো একই সাথে প্রভাবিত নাও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত আসলে একটি প্রাণীর সারা জীবনের প্রজননগত সাফল্যই গুরুত্ব বহন করে।
যেমন, যুক্তরাজ্যে হালকা ও গাঢ় রঙের peppered moth পাওয়া যেত। শিল্প বিপ্লবের সময় গাছের গুড়িতে বসবাস করা পতঙ্গগুলোর উপর ধূলো পড়ায় সেগুলোর রঙ গাঢ় হয়ে গিয়েছিল, এতে করে তারা সহজেই শিকারীর হাত থেকে নিস্তার পেত। এভাবে গাঢ় রঙের peppered moth বেশি করে সন্তান রেখে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। প্রথম গাঢ় রঙের পতঙ্গটি ধরার পঞ্চাশ বছর পর কারখানা-সমৃদ্ধ ম্যানচেস্টার এলাকায় প্রায় সব পতঙ্গ গাঢ় রঙের ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালে Clean Air Act পাস হওয়ার পর পরিবেশ অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় গাঢ় রঙের পতঙ্গগুলো দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ায় শিকারীদের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিল। এতে করে গাঢ় রঙের পতঙ্গগুলো আবার দুর্লভ হয়ে পড়ে। এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি বাস্তব উদাহরণ।
যেসব বৈশিষ্ট্য প্রাণীকে প্রজননগত সুবিধা প্রদান করে, সেসব বৈশিষ্ট্য একই সাথে দায়যোগ্য হলে, অর্থাৎ, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হলে, পরবর্তী প্রজন্মে দ্রুতগামী খরগোশ অথবা সুদক্ষ শৈবাল একটু বেশি অনুপাতে উপস্থিত থাকবে। একে পার্থক্যযুক্ত প্রজনন বা differential reproduction বলে। এভাবে এমনকি যৎসামান্য প্রজননগত সুবিধাগুলোও বহু প্রজন্ম পরে জনগোষ্ঠীতে আধিপত্য বিস্তার করবে, একটি প্রাণীর প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রজননগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য “নির্বাচন” করে জৈব বিবর্তন ঘটিয়ে থাকে। চার্লস ডারউইন প্রথম এই ব্যাপারটি বর্ণনা করেন এবং নামকরণ করেন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটি বংশগতিবিদ্যার চেয়ে পুরনো। আধুনিক ভাষায় বললে- প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রাণীর ফিনোটাইপ বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচন করে কিন্তু আদতে এই বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনোটাইপ নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। ফিনোটাইপ আসলে জিনোটাইপ এবং জিনের বাহক যা প্রাণীটির পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত হয় (দেখুন: জিনোটাইপ ও ফিনোটাইপের পার্থক্য)।
বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণ এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বংশগতিবিদ্যাকে সংযুক্ত করেছে। যদিও একটি পরিপূর্ণ জৈব বিবর্তন তত্ত্বকে সূত্রবদ্ধ করার জন্য জিনগত প্রকরণের কারণ (যেমন পরিব্যক্তি ও যৌন জনন) এবং অন্যসব বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার (যেমন জিন প্রবাহ বা জেনেটিক ড্রিফট) ব্যাখ্যা প্রয়োজন, আপাতঃদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনই প্রকৃতিতে সবচেয়ে জটিল অভিযোজনগুলোর পেছনে দায়ী বলে মনে হচ্ছে।
"প্রাকৃতিক নির্বাচন" শব্দটির অর্থ প্রেক্ষাপটের উপর সামান্য নির্ভরশীল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একে উদ্ধারিক (হেরিটেবল) বৈশিষ্ট্যের উপর কার্যকরী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, কারণ এই বৈশিষ্ট্যগুলোই সরাসরি জৈব বিবর্তনে অংশগ্রহণ করে। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন “অন্ধ”, এই অর্থে যে ফিনোটাইপ (শারীরিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য) দায়যোগ্য (হেরিটেবল) না হওয়া সত্ত্বেও প্রজননগত সাফল্য প্রদান করতে পারে (উদ্ধারিক নয়, এমন সব বৈশিষ্ট্য পরিবেশের প্রভাবেও উদ্ভূত হতে পারে)।
ডারউইনের প্রাথমিক ব্যবহার[1] অনুসারে শব্দটি দূরদৃষ্টিহীন নির্বাচনের বিবর্তনীয় পরিণতি ও বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া, দু’টো বিষয়কেই নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়।[2][3] মাঝে মাঝে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও প্রভাবের মাঝে পার্থক্যটা উল্লেখ করা উপকারী; এই পার্থক্যটা যখন আলাদা গুরুত্ব বহন করে, তখন বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক নির্বাচনকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন- “সেসব প্রক্রিয়া যা প্রজননশীল প্রাণীকে নির্বাচন করে”। নির্বাচনের বস্তু উদ্ধারিক কিনা, তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। একে মাঝে মাঝে “ফিনোটাইপীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন” হিসেবে অভিহিত করা হয়।[4]
কোন বৈশিষ্ট্য প্রজজনগত সাফল্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলে নির্বাচনী শক্তি তার পক্ষে কাজ করে, এর বিপরীত হলে নির্বাচনী শক্তি তার বিপক্ষে কাজ করে। একটি বৈশিষ্ট্য নির্বাচিত হলে এর সাথে আরও অনেক বৈশিষ্ট্য নির্বাচিত হতে পারে যেগুলো আদতে প্রজননগত সাফল্যকে প্রভাবিত করে না। এটি প্লেয়োট্রপি কিংবা জিন সংযোগের (gene linkage) কারণে ঘটতে পারে।[5]
যোগ্যতার ধারণাটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়। ব্যাপকভাবে বললে- যোগ্যতমরাই টিকে থাকে, যা প্রায়ই “সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট” শব্দসমষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতই এই শব্দটির সঠিক অর্থ অতি সূক্ষ্ম, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার পরের বইগুলোতে শব্দটি এড়িয়ে গিয়েছেন (তাঁর "দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ" গ্রন্থে শব্দটির বিভিন্ন অর্থ নিয়ে আলোচনার জন্য একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় নিবেদিত করা হয়েছে)। আধুনিক বিবর্তন তত্ত্ব একটি প্রাণীর জীবনকাল নয়, তার প্রজননগত সাফল্য দিয়েই যোগ্যতাকে সংজ্ঞায়িত করে। একটি প্রাণী যদি অন্য আরেকটি প্রাণীর অর্ধেক জীবনকাল বেঁচে থাকে কিন্তু দ্বিগুণ সংখ্যক সন্তান-সন্ততি রেখে যায়, যারা পূর্ণবয়ষ্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে, তবে তার জিনই জনগোষ্ঠীতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে।
যদিও প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যক্তির উপর কাজ করে, তথাপি দৈবের প্রভাবের কারণে একটি জনগোষ্ঠীর ভেতরে কোন প্রাণীর কেবল গড় যোগ্যতাকেই সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব। একটি বিশেষ জিনোটাইপের যোগ্যতা একই জিনোটাইপ ধারণকারী অন্য প্রাণীদের উপর তার গড় প্রভাবের উপর নির্ভর করে। খুবই অল্প যোগ্যতার অধিকারী জিনোটাইপ তাদের ধারককে প্রায় নিঃসন্তান থাকতেই বাধ্য করে- এর উদাহরণ cystic fibrosis এর মত অনেক মনুষ্য জিনগত রোগ।
যোগ্যতা যেহেতু একটি গড় সংখ্যা, তাই এও সম্ভব যে কোন উপকারী পরিব্যক্তি (mutation) ধারণ করা সত্ত্বেও একটি প্রাণী অন্য কোন কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। যোগ্যতা পরিবেশের উপরও গভীরভাবে নির্ভরশীল। যেকোন সাধারণ জনগোষ্ঠীতে কাস্তে-কোষ রক্তাল্পতার (সিকল-সেল অ্যানিমিয়া) যোগ্যতা কম হলেও এটি যেহেতু ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেহেতু এটি এমন সব জনগোষ্ঠীতে যোগ্যতা বৃদ্ধি করে যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি।
প্রাকৃতিক নির্বাচন যেকোন উদ্ধারিক বৈশিষ্ট্যের উপর কাজ করে, আবার নির্বাচনী চাপ যেকোন পরিবেশগত কারণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে- যেমন যৌন নির্বাচন, একই বা ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সাথে প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। তার মানে এই না যে প্রাকৃতিক নির্বাচন সবসময় একটি বিশেষ দিকে তাড়িত হয় কিংবা অভিযোজনীয় বিবর্তনের জন্ম দেয়; প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রায়ই স্বল্প যোগ্যতার প্রাণীদের বিলুপ্ত করে জনগোষ্ঠীর বিদ্যমান অবস্থা টিকিয়ে রাখে।
নির্বাচনের একক ব্যক্তি হতে পারে, অথবা জৈব সংগঠনের যেকোন পর্যায়ও হতে পারে- যেমন জিন, কোষ, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী (kin group) ইত্যাদি। প্রাকৃতিক নির্বাচন কি গোত্রের উপর কাজ করে নাকি প্রজাতির উপর কাজ করে বড় অনাত্মীয় গোষ্ঠীর জন্য উপকারী অভিযোজন উৎসাহিত করে- এটি নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। সাধারণত প্রাকৃতিক নির্বাচনকে জন্ম পরবর্তী ফিনোটাইপের উপর ক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে দেখা হয়, তাই ভ্রুণকোষ উর্বরকরণ কিংবা জিনগত পরিব্যক্তির আগে আণবিক স্তরে ক্রিয়াশীল নির্বাচনী শক্তিকে গতানুগতিক প্রাকৃতিক নির্বাচন বলা যাবে কিনা- তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কিছু বিজ্ঞান-সাংবাদিক পরিব্যক্তির নির্বাচনকে "প্রাক-নির্বাচন" আখ্যা দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন ও জিন নির্বাচনের মাঝে পার্থক্য করেন।[6]
জিনের উপর নির্বাচন কাজ করে যেমন জিনের যোগ্যতা বাড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি সেই জিনের ধারকের যোগ্যতাকে কমিয়েও দিতে পারে, যাকে বলে “আন্তঃজিনোমিক সংঘাত”। সব শেষে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন নির্বাচনী চাপের সম্যক প্রভাবই প্রাণীর সামগ্রিক যোগ্যতাকে নির্ধারণ করে, যার ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলাফলও নির্ধারিত হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচন জীবনকালের প্রত্যেকটি পর্যায়ে ঘটে। প্রজনন করতে হলে একটি প্রাণীকে অবশ্যই পূর্ণবয়ষ্ক হতে হবে, এসব প্রাণীর উপর ক্রিয়াশীল নির্বাচনকে বলে ভায়াবিলিটি সিলেকশন। অনেক প্রজাতিতে প্রাপ্তবয়স্কদের পরষ্পরের সাথে যৌনসঙ্গীর জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয় এবং এই প্রতিযোগিতায় বিজেতারাই পরবর্তী প্রজন্মের অভিভাবক হয়। কোন প্রাণী যখন একাধিকবার প্রজনন করতে পারে, তখন জীবনের প্রজননশীল পর্যায়ে প্রাণী যত বেশি সময় বাঁচবে, তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যাও তত বেশি হবে- একে বলে সারভাইভাল সিলেকশন।
পুরুষ ও স্ত্রী প্রজাতির উর্বরতা (যেমন, কিছু কিছু ড্রসোফিলা প্রজাতির বিশাল শুক্রাণু)[8] “উর্বরতা নির্বাচন” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হ্রাস পেতে পারে। উৎপন্ন হওয়া জননকোষগুলোর টিকে থাকার যোগ্যতা একেকটার একেক রকম হতে পারে, আবার বিভিন্ন হ্যাপ্লয়ড জননকোষের মাঝে মায়োটিক তাড়নার মত আন্তঃজিনোমিক সংঘাতের ফলে “জননকোষীয় নির্বাচন” এর মত প্রক্রিয়ারও উদ্ভব ঘটতে পারে। পরিশেষে, কিছু ডিম্ব-শুক্র সমবায় অন্যগুলোর চেয়ে বেশি সুসংগত হতে পারে- একে বলে সঙ্গতিমূলক নির্বাচন।
“পরিবেশগত নির্বাচন” ও “যৌন নির্বাচন” এর মাঝে পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। “পরিবেশগত নির্বাচন” বলতে পরিবেশগত প্রভাব বোঝায়(যেমন, প্রতিযোগিতা, শিশুহত্যা, পরিবার নির্বাচন(kin selection) ইত্যাদি) যেখানে “যৌন নির্বাচন” বলতে যৌনসঙ্গীর জন্য প্রতিযোগিতাকে ইঙ্গিত করে।[9]
যৌন নির্বাচন একই লিঙ্গের প্রাণীদের প্রতিযোগিতার উপর যেমন কাজ করতে পারে, তেমনি একাধিক যোগ্য সঙ্গী থেকে সবচেয়ে যোগ্য সঙ্গীটির কোন একটি বিশেষ লিঙ্গ দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার উপরও কাজ করতে পারে। সাধারণত স্ত্রী প্রাণীটি একাধিক পুরুষ প্রাণী হতে একজন যৌনসঙ্গী নির্বাচন করে। যেহেতু সন্তান লালন-পালনে স্ত্রী প্রাণীটির বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি, তাই সে সবচেয়ে উন্নতমানের জিনের ধারক পুরুষ প্রাণীটিকেই সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করে। কিছু কিছু প্রজাতিতে অবশ্য পুরুষরা স্ত্রী সঙ্গী নির্বাচন করে, যেমনটি Syngnathidae পরিবারের মাছ ও বেশ কিছু পাখি ও উভচর প্রজাতির মধ্যে দেখা যায়।[10]
কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য শুধু একই প্রজাতির কোন বিশেষ লিঙ্গে পর্যবেক্ষিত হয়, উদাহরণ হিসেবে কিছু পুরুষ পাখির আকর্ষণীয় পুচ্ছরাজির কথা বলা যায়, যা যৌন নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। পুরুষ হরিণের বিশাল বড় শিং থাকে যা ব্যবহার করে তারা স্ত্রী হরিণের আনুগত্য জয় করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সাধারণত আন্তঃলৈঙ্গিক নির্বাচনকে সেক্সুয়াল ডাইমরফিজম এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়, যার মধ্যে লিঙ্গভেদে আকারের ভিন্নতা অন্তর্গত।[11]
অণুজীবের মধ্যে জীবাণু-নাশকের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কর্তৃক পেনিসিলিন আবিস্কৃত হওয়ার পর হতে ব্যাকটিরিয়াজনিত রোগের বিরুদ্ধে জীবাণু-নাশক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ব্যাকটিরিয়ার প্রাকৃতিক জনগোষ্ঠীগুলোর জিনোমে পরিব্যক্তির কারণে ব্যাপক প্রকরণ থাকে। জীবাণু-নাশকের সংস্পর্শে বেশিরভাগ ব্যাকটিরিয়া মারা যায়, কিন্তু কিছু কিছুর জিনে এমন পরিব্যক্তি থাকতে পারে যার ফলে সে জীবাণু-নাশকটির প্রতি সহনশীল হয়ে পড়তে পারে। জীবাণু-নাশকটির কার্যকাল সংক্ষিপ্ত হলে এসব ব্যাকটিরিয়া এ যাত্রা বেঁচে যাবে। জনগোষ্ঠী হতে অভিযোজনে ব্যর্থ জীবগুলোর এরুপ বিতাড়নই প্রাকৃতিক নির্বাচন।
এই বেঁচে যাওয়া ব্যাকটিরিয়া এরপর পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দিবে। জীবাণু-নাশকের সাথে সমম্বয়হীন পূর্ব প্রজন্মের ব্যাকটিরিয়াগুলো বিলুপ্ত হয়ে পড়ায় এই নতুন জনগোষ্ঠীতে জীবাণু-নাশকটির প্রতি সহনশীল আরও বেশি ব্যাকটিরিয়া থাকবে। একই সাথে নতুন নতুন পরিব্যক্তি ঘটবে এবং অস্তিমান জেনেটিক প্রকরণে নতুন নতুন প্রকরণ যুক্ত হবে। স্বতঃস্ফূর্ত পরিব্যক্তি খুবি দুর্বল, এবং উপকারী পরিব্যক্তি আরও দুর্বল। তবে ব্যাকটিরিয়ার জনগোষ্ঠীগুলো এতই বড় যে কারও না কারও উপকারী পরিব্যক্তি থাকবেই। নতুন পরিব্যক্তিগুলো যদি তাদের সহনশীলতা বাড়াতে পারে, তবে পরের বার জীবাণু-নাশকের সম্মুখীন হলে তাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পাবে।
যথেষ্ট সময় থাকলে এবং বারংবার জীবাণু-নাশকটির সংস্পর্শে আসলে জীবাণু-নাশকটির প্রতি সম্পূর্ণভাবে সহনশীল এক নতুন ব্যাকটিরিয়া জনগোষ্ঠীর উদয় ঘটবে। এই নতুন জনগোষ্ঠীটি বিদ্যমান পরিবেশের প্রতি অভিযোজিত হলেও তার পূর্বপুরুষদের জীবাণু-নাশকমুক্ত পরিবেশের প্রতি অভিযোজিত হবে না। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে এমন দু'টি জনগোষ্ঠী উদ্ভূত হবে যারা নিজেদের পরিবেশের প্রতি পূর্নভাবে অভিযোজিত হলেও অন্য পরিবেশে ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারবে না।
জীবাণু-নাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহারের ফলে অনেক অণুজীব জীবাণু-নাশকের প্রতি সহনশীল হয়ে পড়েছে, মেথিসিলিন-বিরোধী Staphylococcus aureus (MRSA) তার ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিরোধক্ষমতার কারণে এখন "সুপারবাগ" হিসেবে অভিহিত হচ্ছে।[12] এর প্রতিকার হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিশালী জীবাণু-নাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু এর প্রতিও সহনশীল MRSA সাম্প্রতিককালে আবিস্কৃত হয়েছে।[13]
এটি বিবর্তনীয় অস্ত্রযুদ্ধের একটি উদাহরণ- গবেষকরা যতই শক্তিশালী জীবাণু-নাশক তৈরী করছেন, ততই নতুন নতুন প্রজাতির সহনশীল ব্যাকটিরিয়া বিবর্তিত হচ্ছে। উদ্ভিদ ও পতঙ্গকূলে কীটনাশক প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। অস্ত্রযুদ্ধ সবসময় মনুষ্যসঞ্চারিত হয় না; সামোয়ার এক দ্বিপে Hypolimnas bolina প্রজাতির এক প্রজাপতির জিনোমে এক বিশেষ জিনের প্রসার পরিলক্ষিত হয়েছে যা Wolbachia ব্যাকটিরিয়ার পুরুষ-নিধন প্রক্রিয়াকে দমন করে- পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটতে লেগেছে মাত্র পাঁচ বছর।[14]
ডারউইনের প্রায় ১০০০ বছর আগে ইরাকের একজন মুসলিম বিজ্ঞানী আল জাহিজ প্রাকৃতিক নির্বাচনের (বিবর্তন মতবাদ) স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তখন তেমন প্রচার লাভ করতে পারেনি। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল প্রবক্তা আল জাহিজ। তিনি তার লেখা 'কিতাব আল-হায়ওয়ান' (দ্যা বুক অফ অ্যানিমেলস) অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই'তে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আল-জাহিজের এসব ধারণা তার পরবর্তী অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন। ধারণা করা হয় চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসও হয়তো তার ঐ তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।[15]
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অভিযোজনমূলক বিবর্তন, অনন্য বৈশিষ্ট্য ও প্রজাত্যায়ন ঘটার পূর্বশর্ত হল জনপুঞ্জে উদ্ধারিক প্রকরণের উপস্থিতি যার ফলে যোগ্যতার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পরিব্যক্তি, সমন্মীকরণ(recombination) এবং কেরিওটাইপের(ক্রোমজোমের সংখ্যা, আকার, আয়তন ও অভ্যন্তরীণ সজ্জা) পরিবর্তনের ফলে জেনেটিক প্রকরণ উদ্ভূত হয়। এসব পরিবর্তনের ফলে ভাল-খারাপ দু'ধরনের প্রভাবই পরিলক্ষিত হতে পারে, তবে বড় ধরনের প্রভাব সাধারণত দেখা যায় না। অতীতে বেশিরভাগ জেনেটিক পরিবর্তনই (প্রায়) নিরপেক্ষ ধরা হত কারণ পরিবর্তনগুলো ডিএনএর সেসব অংশে ঘটত যা প্রোটিন উৎপাদনে কোন ভূমিকা রাখে না বা সমার্থক উপকল্পন(synonymous substitution) ঘটাতো। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত করছে যে এসব নন-কোডিং ডিএনএর অনেক পরিব্যক্তি ক্ষতিকর প্রভাব আরোপ করে।[16][17] যদিও পরিব্যক্তির হার ও যোগ্যতার উপর তার প্রভাব মূলত প্রাণীর উপর নির্ভরশীল, তবে মানুষের উপর পরিচালিত জরিপ থেকে দেখা গিয়েছে যে অধিকাংশ পরিব্যক্তির হালকা ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।[18]
যোগ্যতার সংজ্ঞামতে, যোগ্যতর প্রাণীগুলো পরবর্তী প্রজন্মে অধিক সংখ্যাক সন্তান রেখে যেতে পারবে, কিন্তু স্বল্প যোগ্য প্রাণীগুলো হয় প্রজননে অক্ষম হবে নয়ত সন্তান পয়দা করার আগেই মারা যাবে। এর ফলে যোগ্যতা বৃদ্ধিকারী এলেলগুলো পরবর্তী প্রজন্মে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং যোগ্যতা হ্রাসকারী এলেলগুলো ক্রমশঃ বিলীন হয়ে যায়। নির্বাচনী শক্তিগুলো প্রজন্মান্তরে একই থাকলে উপকারী এলেলগুলো সংখ্যায় বাড়তেই থাকে আর অপকারী এলেলগুলো পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। প্রত্যেক প্রজন্মে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন নতুন পরিব্যক্তি ও সমন্মীকরণের ফলে ফেনোটাইপের বর্ণচ্ছটা বিস্তৃত হয়। সেই কারণে প্রত্যেক প্রজন্মে সেসব এলেলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যাদের বৈশিষ্ট্য নির্বাচনের দ্বারা অনুগৃহীত হয়েছিল, এতে করে ওই বৈশিষ্ট্যগুলো তীব্র হতে থাকবে।
কিছু কিছু পরিব্যক্তি তথাকথিত নিয়ামক জিনে ঘটে থাকে। এসব জিনে যেকোন পরিবর্তন ফেনোটাইপের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, কারণ এই জিনগুলো আরও অনেক জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়ামক জিনের বেশিরভাগ(তবে সব নয়) পরিব্যক্তির ফলে ভ্রুণকোষটি বেঁচে থাকতে অক্ষম হয়। তবে অমারাত্মক পরিব্যক্তি মানুষের HOX জিনগুলোতে পরিলক্ষিত হয়, যার ফলে পাঁজর অথবা আঙ্গুলের সংখ্যা সাধারণের চেয়ে বেশি হয়। ওরকম কোন পরিব্যক্তি যোগ্যতা বৃদ্ধি করলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে ওই অনন্য বৈশিষ্ট্যটি জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে।
বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো অপরিবর্তনীয় নয়; এক পরিবেশে কোন বৈশিষ্ট্যের যোগ্যতা বেশি হলে অন্য পরিবেশে তা কমও হতে পারে। ওই বৈশিষ্ট্যের পক্ষে নির্বাচনী চাপের অনুপস্থিতিতে ধীরে ধীরে ওটি পরিবর্তিত হতে পারে কিংবা হ্রাস পেতে পারে, পরবর্তীতে ওটি প্রাণীর দেহে বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায়ও থাকতে পারে। একে বিবর্তনীয় বোঝা বলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গাদি সীমিতভাবে কাজ করতে পারে, কিংবা অন্য কোন উপকারী বৈশিষ্ট্যের সাথে একসাথে বিবর্তিত হয়ে ভিন্ন কোন কাজ করতে পারে, যাকে বলে প্রাকঅভিযোজন(preadaptation)। বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের একটি বিখ্যাত উদাহরণ হল blind mole rat এর চোখ, যা এখন দর্শনকাজে ব্যবহৃত না হলেও প্রাণীটিকে আলো ও অন্ধকারের পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে।
প্রজাত্যায়নের জন্য প্রয়োজন নৈর্বাচনিক প্রজনন, যার ফলে জিন প্রবাহ হ্রাস পায়/নৈর্বাচনিক প্রজনন যেসব কারণে ঘটতে পারে- ১) ভৌগোলিক অন্তরণ ২) আচরণগত অন্তরণ অথবা ৩) আবাসভূমির বিচ্ছিন্নতা। উদাহরণস্বরুপ, ভৌত পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে(বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতার ফলে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা বা অন্তরণ) ১ ঘটবে, কুটবেশের(camouflage) পরিবর্তনের ফলে ২ ঘটবে এবং প্রজনন কালের বদলের ফলে ৩ ঘটবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
কালের প্রবাহে এই দু'টো উপদলের মধ্যে আমূল বিকিরণ ঘটে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি সৃষ্টি হতে পারে, এর পেছনে নির্বাচনী চাপের ভিন্নতা যেমন থাকতে পারে, তেমনি একেক জনপুঞ্জে একেকরকম পরিব্যক্তির উদয়ের ভূমিকাও থাকতে পারে। "ফাউন্ডার এফেক্ট" বা স্থাপক প্রভাবের ভূমিকাও অগ্রহ্য করা যায় না, অর্থাৎ, বিকিরণের সময় উপদলগুলোর যেকোন একটার মধ্যে কিছু সম্ভাব্য উপকারী এলেল থাকতে পারে। প্রজাত্যায়নের এক স্বল্প-পরিচিত প্রক্রিয়া হল সঙ্করীকরণ, যা উদ্ভিদের মধ্যে ভালভাবেই পরিলক্ষিত হয়েছে এবং cichlid পরিবারের মাছের মত প্রজাতি-সমৃদ্ধ প্রাণীগোত্রের মধ্যেও মাঝে মাঝে লক্ষ করা যায়। এরকম দ্রুত গতির প্রজাত্যায়ন "পাংচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়াম" নামক এক বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করতে পারে, যা বলে যে বিবর্তনীয় পরিবর্তন(বিশেষ করে প্রজাত্যায়ন) সাধারণত দীর্ঘকাল বিরতির পর হঠাত করে ঘটে থাকে।
জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে দু'টো উপগোত্রের জেনোমের মধ্যে বিসঙ্গতি বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ও দু'টো উপগোত্রের মাঝে জিন প্রবাহ হ্রাস পায়। জিন প্রবাহ তখনই বন্ধ হবে যখন প্রত্যেকটি উপগোত্রকে তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দানকারী পরিব্যক্তিগুলো প্রোথিত হবে। কেবল দু'টো পরিব্যক্তিই প্রজাত্যায়ন ঘটাতে পারে: প্রত্যেকটি পরিব্যক্তি যদি আলাদাভাবে ঘটলে নিরপেক্ষ কিংবা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে কিন্তু একসাথে ঘটলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে এ দু'টো জিন নিজ নিজ উপগোত্রের জিনপুঞ্জে প্রোথিত হলে দু'ট প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন জনপুঞ্জের জন্ম দিবে। প্রজাতির প্রচলিত সংজ্ঞামতে এই দু'টো জনপুঞ্জ আলাদা প্রজাতি হিসেবে গণ্য হবে।
বেশ কিছু প্রাচীন দার্শনিক ধারণা করেছিলেন যে প্রকৃতি আপাতঃদৃষ্টিতে দৈবক্রমে ব্যাপক জৈববৈচিত্র্য সৃষ্টি করে এবং কেবলমাত্র তারাই বেঁচে থাকে যারা নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় এবং প্রজনন করতে সফল হয়; এমপিডোকলস[19] এবং তাঁর ভাবশিষ্য লুক্রেশিয়াস[20] হলেন প্রখ্যাত কিছু উদাহরণ, তাছাড়া এরিস্টটল প্রাসঙ্গিক কিছু ধারণাকে পরবর্তীতে পরিমার্জিত করেছিলেন।[21] আল-জাহিজ পরে অস্তিত্বের লড়াইকে বর্ণনা করেছিলেন এবং প্রস্থাপন করেছিলেন যে পরিবেশগত কারণে প্রাণীদের দেহে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে পারে যার ফলে তারা অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে।[22][23][24]
আবু রায়হান বিরুনি কৃত্রিক নির্বাচন বর্ণনা করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে প্রকৃতিতেও একই ঘটনা ঘটে।[25] ১৮ শতকে Pierre Louis Maupertuis[26] সহ চার্লস ডারউইনের দাদা ইরাসমাস ডারউইনও একই রকম ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। এই অগ্রদূতরা ডারউইনবাদের উপর প্রভাব ফেললেও চার্লস ডারউইন পরবর্তী বিবর্তনীয় দর্শনে এঁদের অবদান খুবই সীমিত।
১৯ শতকের প্রারম্ভেও পশ্চিমা সমাজগুলো একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যকার পার্থক্যগুলোকে তাদের প্লেটোনীয় আদর্শ হতে বিচ্যুতি হিসেবে দেখত। তবে ভূতত্ত্বে সমরুপতাবাদ এ ধারণাটি প্রবর্তন করেছিল যে সরল, দুর্বল শক্তি দীর্ঘকাল ধরে নিরন্তর কাজ করে ভূপৃষ্ঠে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এই তত্ত্বের সাফল্য ভূতাত্ত্বিক সময়ের ব্যাপকতার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করেছিল, এবং এর ফলে এই বিষয়টা মানুষের কাছে ক্রমশঃ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল যে প্রজন্মান্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আপাতঃ অপ্রত্যক্ষ পরিবর্তন প্রজাতির মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে।
১৯ শতকের প্রারম্ভে জঁ-বাতিস্ত লামার্ক প্রস্তাব করেছিলেন যে অর্জিত বৈশিষ্ট্যও বিবর্তনকে চালনা করতে পারে; একটি প্রাণীর জীবনকালে অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো তার বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে, যার ফলে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটতে পারে।[27] এই মতবাদ পরে লামার্কবাদ হিসেবে পরিচিত হয়েছে এবং স্তালিনবাদী সোভিয়েত জীববিজ্ঞানী ট্রোফিম লাইসেঙ্কোর জেনেটিক্স-বিরোধী চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।
১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন অভিযোজন ও প্রজাত্যায়নের ব্যাখ্যা হিসেবে তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তাঁর সংজ্ঞামতে প্রাকৃতিক নির্বাচন হল "এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রত্যেকটি তুচ্ছ প্রকরণ, যদি উপকারী হয়, সংরক্ষিত হয়"।[28] বিষয়টি সহজ কিন্তু শক্তিশালি:পরিবেশের সাথে সুষ্ঠুভাবে অভিযোজিত প্রাণীগুলোরই বেঁচে থাকার ও প্রজনন করার সম্ভাবনা বেশি। যতক্ষণ তাদের মাঝে প্রকরণ থাকবে, ততক্ষণ তাদের মধ্যে একটি নির্বাচনি প্রক্রিয়া কাজ করবে যা বেছে বেছে শুধু সবচেয়ে উপকারী প্রকরণগুলোকেই নির্বাচন করবে। প্রকরণগুলো যদি উত্তরাধিকারসূত্র প্রাপ্ত হয়, তাহলে পার্থক্যযুক্ত প্রজননগত সাফল্যের কারণে একটি প্রজাতির বিবর্তন ঘটবে, এবং কোন প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে যথেষ্ট পরিমাণে আলাদা হলে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রজাতি হিসেবে গণ্য হবে।[29]
বিগল যাত্রার পর্যবেক্ষণগুলো ডারউইনকে প্রভাবিত করেছিল, আরও প্রভাবিত করেছিল রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ রেভারেন্ড টমাস মালথুসের An Essay on the Principle of Population, যাতে তিনি লিখেছিলেন যে খাদ্যসম্ভারের পাটিগণিতীয় বৃদ্ধির ফলে কোনরকম নিয়ন্ত্রণপ্রবণতার অনুপস্থিতিতে একটি জনগোষ্ঠী জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকবে; সুতরাং প্রাকৃতিক সম্পদের অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কিছু জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিণতি থাকবে, যার ফলে "অস্তিত্বের লড়াই" পরিলক্ষিত হবে।[30] ডারউইন যখন ১৮৩৮ সালে মালথুসের কাজ পড়া শুরু করলেন, তখন তিনি তাঁর প্রকৃতিবিদ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতার ফলে "অস্তিত্বের সংগ্রাম" উপলদ্ধি করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে জনগোষ্ঠীর আয়তন প্রাকৃতিক সম্পদ সম্ভারের চেয়েও বড় হয়ে গেলে "উপকারী প্রকরণের সংরক্ষিত হওয়া ও অপকারী প্রকরণের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে."[31]
অরিজিনের চতুর্থ অধ্যায়ে প্রাপ্ত ডারউইনের ধারণাগুলোর সারমর্ম নিম্মে দেওয়া হল:
একবার কাজ করার মত একটা তত্ত্ব পাওয়ার পর ডারউইন সেটিকে জনসম্মুখে প্রকাশ করার আগে তার পক্ষে প্রমাণ জড়ো করা ও পরিমার্জিত করার ব্যাপারে যত্নশীল ছিলেন। ডারউইন যখন তাঁর বিখ্যাত বইটি লিখছিলেন, তখনই আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে চার্লস লায়েলের কাছে পাঠানোর জন্য ডারউইনের কাছে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছিলেন। লায়েল আর যোসেফ ডাল্টন হুকার ওয়ালেসকে না জানিয়েই তাঁর প্রবন্ধ ও অন্য প্রকৃতিবিদদের কাছে পাঠানো ডারউইনের অপ্রকাশিত পত্রগুলোকে একসাথে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এবং On the Tendency of Species to form Varieties; and on the Perpetuation of Varieties and Species by Natural Means of Selection শিরোনামের প্রবন্ধটি ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে লিনিয় সমাজের সভায় পাঠ করা হয়েছিল। ডারউইন ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তাঁর অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থে তাঁর প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণে ডারউইন স্বীকার করেছিলেন যে উইলিয়াম চার্লস ওয়েলস ১৮১৩ সালে এবং প্যাট্রিক ম্যাথিউ ১৮৩১ সালে একইরকম মত প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই সেগুলোকে বিস্তৃত করেননি কিংবা কোন খ্যাত বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় উপস্থাপন করেননি।[32]
ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনকে কৃষকদের প্রজননের জন্য শস্য কিংবা পশু নির্বাচনের সাথে তুলনা করেছিলেন, এবং একে তিনি "কৃত্রিম নির্বাচন" আখ্যা দিয়েছিলেন; তাঁর প্রথম দিকের পান্ডুলিপিতে তিনি এক "প্রকৃতি" এর কথা বলেছিলেন যে এই নির্বাচনের কাজটি করবে। সেই সময়ে জিন প্রবাহের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণাটি জ্ঞাত ছিল না, এবং ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন খুব সম্ভবত কাহিনীর একটি অংশ মাত্র:"আমি নিশ্চিত যে [এটি] পরিবর্তনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে, কিন্তু একচেটিয়া নয়।"[33] চার্লস লায়েলের কাছে ১৮৬০ সালের সেপটেম্বরের এক চিঠিতে ডারউইন আফসোস করে বলেছিলেন যে "প্রাকৃতিক নির্বাচন" শব্দটি ব্যবহার না করে "প্রাকৃতিক সংরক্ষণ" ব্যবহার করা উচিত ছিল।[34]
ডারউইন ও তাঁর সমসাময়ীক ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রাকৃতিক নির্বাচন আদতে "প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন" এর সমার্থক ছিল। "অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিজ" প্রকাশের পর শিক্ষিত সমাজ স্বীকার করে নিয়েছিল যে বিবর্তন কোন না কোনভাবে ঘটেছে। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া হিসেবে বিতর্কিত রয়ে গিয়েছিল, একারণে যে এটি জীবজন্তুর পর্যবেক্ষিত বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাখ্যায় দৃশ্যত দুর্বল ছিল, এবং একারণে যে বিবর্তনের সমর্থকরাও প্রক্রিয়াটির "অনির্ধারিত" ও অ-প্রগতিশীল প্রকৃতি গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল[35]- এই দ্বিধাই মূলত বিবর্তনবাদের গ্রহণযোগ্যতার প্রতি সবচেয়ে বড় বাধা ছিল।[36]
তবে কিছু কিছু চিন্তাবিদ সোৎসাহে ডারউইনের তত্ত্বকে গ্রহণ করেছিলেন; ডারউইনের লেখা পড়ার পর হার্বার্ট স্পেন্সার "সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট" শব্দমালাটি প্রস্তাব করেন, যা তত্ত্বটির সারমর্ম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।[37]
১৮৬৯ সালে প্রকাশিত অন দ্যা অরিজিন অব স্পিসিজের পঞ্চম সংস্করণে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে স্পেন্সারের বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছিল:"But the expression often used by Mr. Herbert Spencer, of the Survival of the Fittest, is more accurate, and is sometimes equally convenient."[38]
জীববিজ্ঞানের বাইরের মানুষ এখনও বাক্যাংশটি ব্যবহার করলেও আধুনিক জীববিজ্ঞানীরা শব্দটি কৌশলগত কারণে এড়িয়ে চলেন।[39]
প্রাকৃতিক নির্বাচন বংশগতির ধারণার উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, কিন্তু এই ধারণাটি বংশগতিবিদ্যার সূচনার আগেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। যদিও আধুনিক বংশগতিবিদ্যার জনক অস্ট্রীয় যাজক গ্রেগর মেন্ডেল ডারউইনের সমকালীন ছিলেন, তাঁর কর্ম বিংশ শতাব্দির প্রারম্ভের আগে অন্ধকারে ছিল। গ্রেগর মেন্ডেলের বংশগতির সূত্রসমূহের সাথে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের একাঙ্গীকরণ করার পরই কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
রোনাল্ড ফিশার(যিনি এর জন্য প্রয়োজনীয় গাণিতিক ভাষা ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের জেনেটিক তত্ত্ব প্রণয়ন করেছিলেন)[2], জে.বি.এস. হ্যালডেন(যিনি "cost of natural selection" এর ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন)[40], সিওয়াল রাইট(যিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রকৃতি ও অভিযোজনের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন)[41], {7/থিওডসিয়াস ডবঝান্সকি(যিনি প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন যে পরিব্যক্তি জিনগত প্রকরণ সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য মূল্যবান রসদ প্রদান করে)[42], উইলিয়াম হ্যামিল্টন(যিনি পরিবার নির্বাচন বা kin selection আবিষ্কার করেন), আর্ন্সত মার(যিনি প্রজাত্যায়নের জন্য প্রজননগত বিচ্ছিন্নতার অশেষ গুরুত্ব তুলে ধরেন)[43] সহ আরও অনেকে তাঁদের কর্মের দ্বারা বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণ সাধন করেন।
এই সংশ্লেষণ প্রাকৃতিক নির্বাচনকে বিবর্তন তত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
এডাম স্মিথ ও কার্ল মার্ক্সের পাশাপাশি ডারউইনের কর্ম ১৯ শতকের বৌদ্ধিক জগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। সম্ভবত বিবর্তন তত্ত্বের সবচেয়ে মৌলিক দাবি হল যে অত্যন্ত জটিল অবয়বসমূহ, যা একে অপরের চেয়ে ভিন্ন এবং অনেকাংশেই নির্ভরশীল, সরলতম সব অবয়ব থেকে কিছু সরল নিয়ম অনুসরণ করে বিবর্তিত হয়েছে। এই দাবি ডারউইনের ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের অনুপ্রাণীত করার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধচারণেও ইন্ধন জুগিয়েছিল। স্টিফেন জে গুল্ডের মতে[44], পশ্চিমা দর্শনের কিছু অত্যন্ত মৌলিক ভিত্তিকে সিংহাসনচ্যুত করার মধ্যেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের চমকপ্রদতা নিহিত রয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্ব "আশরাফুল মাখলুকাত" আর পরমকারণবাদের(teleology) মত প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসমূহকে বাতিল করেছিল।
দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট তাঁর "Darwin's Dangerous Idea" গ্রন্থে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে "সর্বগ্রাসী অম্ল" আখ্যা দিয়েছেন, যাকে কোন পাত্রে আটকে রাখা যায় না এবং যা ক্রমশঃ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের গন্ডি পেরিয়ে প্রায় সব একাডেমিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন বিবর্তনীয় গণনাকরণ(evolutionary computation), কোয়ান্টাম ডারউইনবাদ, বিবর্তনীয় অর্থনীতি, বিবর্তনীয় জ্ঞানতত্ত্ব, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান এবং বিশ্বতত্ত্বীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন(cosmological natural selection)।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই সীমাহীন প্রয়োগযোগ্যতাকে সর্বজনীন ডারউইনবাদ আখ্যা দেওয়া হয়ছে।
ঊনবিংশ শতকে আধুনিক ভ্রুণবিদ্যার অন্যতম জনক উইলহেল্ম রুক্স « Der Kampf der Teile im Organismus » শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন যেখানে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে ভ্রূনের বিভিন্ন অংশের মাঝে ডারউইনীয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একটি প্রাণী বেড়ে উঠতে পারে এবং এই প্রতিযোগিতা অণু থেকে শুরু করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝেও বিস্তৃত হতে পারে। সাম্প্রতিককালে জঁ-জাক কুপিয়েক এই তত্ত্বকে হালনাগাদ করেছেন। এ আণবিক ডারউইনবাদ অনুসারে, আণবিক স্তরে আপতনের(chance) ফলে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় যার ফলে কোষ বিক্রিয়াগুলো বিকাশমান ভ্রুণের উপর একটি নির্দিষ্ট বিন্যাস চাপিয়ে দেয়।
বিবর্তনের তত্ত্বের সামাজিক প্রয়োগ অশেষ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জার্মান দার্শনিক ও সমাজতন্ত্রের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ১৮৭২ সালে লিখেছিলেন, "ডারউইন জানতেন না তিনি মানবসমাজকে নিয়ে কী তীব্র স্যাটায়ার রচনা করেছেন যখন তিনি দেখিয়েছেন যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা বা টিকে থাকার সংগ্রাম, যাকে এতদিন অর্থনীতিবিদরা মানবসমাজের সর্বোচ্চ ঐতিহাসিক প্রাপ্তি হিসেবে দাবি করে আসছিলেন, আসলে প্রাণিজগতের অতি স্বাভাবিক একটি চিত্র"।[45] প্রাকৃতিক নির্বাচনকে "প্রগতিশীল" বা বৌদ্ধিক এবং সভ্যতার উৎকর্ষের প্রতি সহায়তাকারী হিসেবে ব্যাখ্যা করে একদা উপনিবেশবাদ এবং সুপ্রজননবিদ্যার(eugenics) পাশাপাশি আরও অনেক সামাজিক-রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মসূচীকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল, যাকে এখন বলা হয় সামাজিক ডারউইনবাদ। কনরাড লরেন্তজ্ প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাপেক্ষে প্রাণীদের আচরণ(বিশেষ করে গোত্র নির্বাচন) বিশ্লেষণ করার জন্য ১৯৭৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তবে ১৯৪০ সালে জার্মানীতে তিনি নাৎসি রাষ্ট্রের পলিসি সমর্থন করে কিছু লেখালেখি করেছিলেন, যা তিনি নিজেই পরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, "মানবজাতির অধঃপতন ঠেকাতে চাইলে কোন না কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবশ্যই দৃঢ়তা, বীরত্ব ও সামাজিক উপকারিতা প্রভৃতি গুণগুলোকে নির্বাচন করতে হবে। আমাদের বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এই কর্ম অনেকাংশে সম্পন্ন করেছে।"[46] অনেকে আবার মনে করেন মানবসমাজ ও সংস্কৃতি জৈববিবর্তনের অনুরুপ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তিত হয়।[47]
সাম্প্রতিককালে নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে প্রথমে সমাজ জীববিদ্যা(Sociobiology) এবং পরে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের উদয় ঘটেছে, যা মানুষের মনস্তত্ত্বকে প্রাচীন পরিবেশে মানুষের পূর্বসূরীদের অভিযোজন দ্বারা ব্যাখ্যা করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ নোম চম্স্কি এবং স্টিভেন পিংকারের গবেষণা, যেখানে তাঁরা দাবি করেছেন যে প্রাকৃতিক ভাষার ব্যাকরণ আয়ত্ত করার জন্য মানুষের মস্তিষ্ক অভিযোজিত হয়েছে।[48] অজাচার বিরোধিতা এবং জেন্ডার রোলের মত সামাজিক কাঠামো ও মানব আচরণকেও আদি পরিবেশে অভিযোজন হিসেবে দেখা হচ্ছে রিচার্ড ডকিন্স প্রথম জৈববিবর্তনের সাথে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের তুলনা করে মিম ধারণার উৎপত্তি করেন- মিম হল সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একক, অনেকটা জীবজগতের জিনের মত। ড্যানিয়েল ডেনেট সহ অন্য দার্শনিকরা মানুষের চেতনার মত জটিল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে ব্যাখ্যা করার জন্য মিম ধারণাটি ব্যবহার করেছেন।[49] সমাজ-সংস্কৃতির বিস্তৃত ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচনের এরুপ ব্যবহার সর্বজনবিদিত হয়নি এবং এখনও বিতর্কিত রয়ে গিয়েছে।[50]
১৯২২ সালে আলফ্রেড লতকা প্রস্তাব করেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে একটি ভৌত প্রক্রিয়া যাকে কোন সিস্টেম শক্তি ব্যবহার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়[51]; এই একই ধারণাটি পরে হাওয়ার্ড ওডাম "সর্বোচ্চ ক্ষমতা নীতি" নামে প্রকাশ করেন। "সর্বোচ্চ ক্ষমতা নীতি" এর মতে, যেসব বিবর্তনীয় সিস্টেম কার্যকর শক্তি রুপান্তরের হার বৃদ্ধি করে, সেসব সিস্টেম নির্বাচনী সুবিধা অর্জন করে। এই ধারণাগুলো ফলিত তাপগতিবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
প্রাকৃতিক নির্বাচন "কৃত্রিম প্রাণ" এর মত অনেক গণনাকরণ পদ্ধতিকে অনুপ্রাণীত করেছে। কৃত্রিম প্রাণ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সিমুলেট করতে পারে, এবং এটি যেকোন সত্ত্বাকে ফিটনেস ফাংশন দ্বারা সংজ্ঞায়িত কোন বিশেষ পরিবেশে অভিযোজিত করার ক্ষেত্রেও বেশ দক্ষ[52]। যেমন, '৭০ এর দশকে জন হল্যান্ড আর ডেভিড গোল্ডবার্গ জেনেটিক এলগরিদম নামক এক প্রকার হিউরিস্টিক অপটিমাইজেশন এলগরিদম প্রবর্তন করেছেন যা সম্ভাব্যতা ফাংশন দ্বারা সংজ্ঞায়িত সমাধানের পুঞ্জে প্রজনন ও পরিব্যক্তি সিমুলেট করে সবচেয়ে অনুকূল সমাধাটি শনাক্ত করে।[53] এই এলগরিদমগুলো সেসব সমস্যাগুলোতে বিশেষভাবে উপকারী যেগুলোর সমাধান ল্যান্ডস্কেপ খুব রুক্ষ অথবা যেগুলোর প্রচুর আঞ্চলিক মিনিমা রয়েছে।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা বংশগতিবিদ্যার চেয়েও পুরনো। আমরা এখন দায়যোগ্যতার পেছনের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক ভালভাবে জানি, যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভিত্তি।
প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রাণীর ফেনোটাইপ অথবা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের উপর ক্রিয়া করে। ফেনোটাইপ জেনোটাইপ অথবা জিনের গঠন এবং প্রাণীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রায়ই কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর কাজ করে, সেক্ষেত্রে "জেনোটাইপ" এবং "ফেনোটাইপ" একে অপরের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়।
যখন কোন জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন প্রাণী একই জিনের বিভিন্ন সংস্করণ বহন করে, তখন ওই প্রত্যেকটি সংস্করণকে এলেল বলে। এই জিনগত প্রকরণই ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্যসমূহের ভিত্তি। একটা প্রচলিত উদাহরণ হল চোখের রঙের জন্য কিছু বিশেষ জিন মিশ্রণ যা মানুষের ক্ষেত্রে, কাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি রঙের চোখ সৃষ্টি করতে পারে। একই জনপুঞ্জের সদস্যরা সবাই যদি একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের এলেল বহন করে এবং এই অবস্থা যদি সুস্থিত হয়, তবে বলা হয়ে থাকে যে এলেলটি জনপুঞ্জে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য শুধু একটি জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়, কিন্তু বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যের পেছনেই একাধিক জিনের ভূমিকা থাকে। ওই জিনসমষ্টির যেকোন একটি পরিবর্তিত হলে ফেনোটাইপে খুবই ক্ষুদ্র পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে পারে; এই জিনসমষ্টির মধ্যে প্রকরণ এভাবে সম্ভাব্য ফেনোটাইপের একটি পরম্পরা সৃষ্টি করতে পারে।[54]
একটি বৈশিষ্ট্যের কোন উপাদান যদি দায়যোগ্য হয়, তবে নির্বাচনের ফলে সেই বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন প্রকরণের জন্য দায়ী এলেলগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তিত হবে। এই এলেল ফ্রিকোয়েন্সির উপর নির্বাচনের প্রভাবকে ভিত্তি করে নির্বাচনকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।[55]
সদিক নির্বাচন ঘটে যখন একটি বিশেষ এলেলের যোগ্যতা অন্য এলেলের চেয়ে বেশি হয় এবং এর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। এই প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত্য এলেলটি জিনপুঞ্জে প্রোথিত না হবে এবং জনপুঞ্জের প্রত্যেকটি প্রাণীর ওই নির্দিষ্ট ফেনোটাইপ না থাকবে। জীবাণু-নাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও দিকনির্দিষ্ট নির্বাচনের উদাহরণ।
তবে সদিক নির্বাচনের চেয়ে সুস্থিতিকরণ নির্বাচন বা stabilizing selection(পরিশোধনকারী নির্বাচন বা purifying selection এর সাথে গুলিয়ে ফেলা চলবে না[56][57]) বেশি ঘটে, যা ফেনোটাইপের উপর নেতিবাচক প্রভাব প্রয়োগকারী এলেলের সংখ্যা জিনপুঞ্জে কমিয়ে দেয়, অর্থাৎ, স্বল্প যোগ্য প্রাণী সৃষ্টিকারী এলেলসমূহকে বিলুপ্ত করে। এলেলটি জিনপুঞ্জ হতে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত্য এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। পরিশোধনকারী নির্বাচনের ফলে প্রোটিন-কোডিং জিন এবং নিয়ামক অনুক্রম(regulatory sequence) প্রভৃতি কার্যকরী জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো জিনপুঞ্জে সংরক্ষিত হয়, কারণ ক্ষতিকর প্রকরণগুলো ঋণাত্মক নির্বাচনের ফলে বিলুপ্ত হয়।
এছাড়াও সুষমকরণ নির্বাচন(balancing selection) নানা রুপে কাজ করে যার ফলে কোন এলেল প্রোথিত না হলেও বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে সে জিনপুঞ্জে বিচরণ করে। এটা ডিপ্লয়ড(যাদের দু'জোড়া ক্রোমজোম থাকে) প্রজাতিতে ঘটতে পারে যখন হেটেরোজাইগোটদের(যাদের ক্রোমজোমের কোন নির্দিষ্ট স্থান বা লোকাসে দু'টো ভিন্ন এলেল থাকে) যোগ্যতা হোমোজাইগোটদের(লোকাসে যখন দু'টো একই এলেল থাকে) চেয়ে বেশি হয়। একে হেটেরোজাইগোট সুবিধা বলে, যার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হল কাস্তে কোষ ব্যাধির জন্য দায়ী জিনের শুধু একটি কপি বহন করা কিছু হেটেরোজাইগোট মানুষ, যারা এর ফলে প্রাকৃতিক ভাবেই ম্যালেরিয়ার প্রতি সহিষ্ণু। বহুমুখী নির্বাচন বা diversifying selection এর ফলেও এলেল প্রকরণ টিকে থাকতে পারে কারণ এই প্রক্রিয়ায় গড় মান থেকে যেকোন দিকে বিচ্যুত জেনোটাইপগুলোই নির্বাচিত হয়। অবশেষে, সুষমকরণ নির্বাচন ফ্রিকোয়েন্সি-নির্ভরশীল নির্বাচন এর মাধ্যমেও ঘটতে পারে, যেখানে একটা ফেনোটাইপের ফ্রিকোয়েন্সী আরেকটা ফেনোটাইপের ফ্রিকোয়েন্সীর উপর নির্ভর করে। ক্রীড়াতত্ত্ব বা Game theory এসব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গোত্র নির্বাচন এবং ব্যতিহার পরার্থপরতা(reciprocal altruism) এর বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।[58][59]
জিনগত প্রকরণের একটা বড় অংশেরই কোন দর্শনীয় প্রভাব নেই, এগুলো যোগ্যতাকেও খুব একটা প্রভাবিত করে না; মুটু কিমুরা প্রথম তাঁর আণবিক বিবর্তনের নিরপেক্ষ তত্ত্বে দাবি করেন যে জিনগত বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী অধিকাংশ প্রকরণই কোন দৃশ্যত প্রভাব আরোপ করে না। জিনগত প্রকরণ যদি যোগ্যতাকে প্রভাবিত করে না, তবে নির্বাচন ওই প্রকরণের ফ্রিকোয়েন্সীকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে না। এর ফলে ক্রোমজোমের ওই লোকাসগুলোতে জিনগত প্রকরণ অন্যসব লোকাসের চেয়ে বেশি হবে।[55] তবে বেশ কিছু সময় ধরে যদি পরিব্যক্তি না ঘটে, তবে ওই লোকাসগুলো থেকে জিন প্রবাহের ফলে প্রকরণ বিলুপ্ত হবে।
ভুলভাবে অভিযোজিত হওয়া প্রাণীরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে বিলুপ্ত হয়, এর ফলে ওই ভুল অভিযোজনের জন্য দায়ী পরিব্যক্তিগুলোও বিলুপ্ত হয়- অর্থাৎ, প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনগত প্রকরণ কমিয়ে দেয়। একই সাথে আবার নতুন নতুন পরিব্যক্তি ঘটে, এর ফলে পরিব্যক্তি-নির্বাচন ভারসাম্যতা সৃষ্টি হয়। এই দু'টো প্রক্রিয়ার ফলাফল পরিব্যক্তির হার আর নির্বাচনের শক্তির উপর নির্ভর করে, নির্বাচনের শক্তি আবার পরিব্যক্তিটি কিরকম প্রতিকূল তার উপর নির্ভর করে। অতএব, পরিব্যক্তির হার কিংবা নির্বাচনী চাপে পরিবর্তন ঘটলে পরিব্যক্তি-নির্বাচন ভারসাম্যতাও পরিবর্তন হয়।
দু'টো এলেলের লোকাস যখন সংযুক্ত হয় অথবা ক্রোমজোমে একে অপরের নিকটে অবস্থান করে, তাহলে জিন সংযুক্তকরণ ঘটে। জননকোষ তৈরীর সময় জিন সমন্বীকরণের ফলে এলেল পুনর্বিন্যাস্ত হয়। তবে দু'টো এলেলের মধ্যে পুনর্বিন্যাস ঘটবে কিনা তা তাদের মধ্যকার দূরত্বের উপর নির্ভর করে; এলেলগুলো যত কাছাকাছি থাকবে, তাদের পুনর্বিন্যাস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত কম। এর ফলে নির্বাচন যখন একটি এলেলের উপর কাজ করে, তখন তার কাছাকাছি এলেলগুলোও নির্বাচনের প্রভাবের মধ্যে পড়ে যায়; এভাবে নির্বাচন জিনোমের প্রকরণকে প্রভাবিত করে।
নির্বাচনী সম্মার্জন(selective sweep) ঘটে যখন কোন এলেল ধনাত্মক নির্বাচনের ফলে জিনপুঞ্জে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। এলেলটির প্রচলন যত বাড়বে, এর সাথে সংযুক্ত নিরপেক্ষ কিংবা সামান্য ক্ষতিকর এলেলগুলোর প্রচলনও তত বাড়বে। একে জেনেটিক হিচহাইকিং বলে। কঠিন নির্বাচনী সম্মার্জনের ফলে জিনোমের কোন অঞ্চলে হয়ত কেবল ওই নির্বাচিত হ্যাপলোটাইপ ছাড়া আর কোন এলেলই থাকবে না।
নির্বাচনী সম্মার্জন ঘটেছে কিনা বোঝার জন্য সংযুক্তকরণ ভারসাম্যহীনতা(linkage disequilibrium) অথবা জিনপুঞ্জে কোন নির্দিষ্ট হ্যাপলোটাইপের প্রাবল্য পরিমাপ করা হয়। সাধারণত জিন সমন্বীকরণের ফলে হ্যাপলোটাইপের মধ্যকার এলেলগুলো পুনর্বিন্যাস্ত হয় এবং কোন হ্যাপলোটাইপই জিনপুঞ্জে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। তবে নির্বাচনী সম্মার্জনের সময় কোন বিশেষের এলেলের জন্য নির্বাচন এর পারিপার্শ্বিক এলেলগুলোকেও নির্বাচন করবে। সুতরাং, কোথাও সংযুক্ত ভারসাম্যহীনতা খণ্ডের উপস্থিতি নির্দেশ করে যে সেই খণ্ডে সাম্প্রতিককালে নির্বাচনী সম্মার্জন ঘটেছে, এবং এই তথ্য ব্যবহার করে নির্বাচনের সাম্প্রতিক কার্যস্থলগুলো শণাক্ত করা সম্ভব।
পৃষ্ঠদেশ নির্বাচন(Background selection) আবার নির্বাচনী সম্মার্জনের সম্পূর্ণ বিপরীত। কোন বিশেষ লোকাসে যদি লাগাতারভাবে পরিশোধনকারী নির্বাচন ক্রিয়া করে, তবে সংযুক্ত প্রকরণগুলোও সেই লোকাসের এলেলের সাথে সাথে দূর হয়ে যাবে এবং জিনোমের ওই অঞ্চলে সম্যক বৈচিত্র্য কমে যাবে। পৃষ্টদেশ নির্বাচন যেহেতু নতুন কোন ক্ষতিকারক পরিব্যক্তির ফলে ঘটে, যা যেকোন হ্যাপলোটাইপে যেকোন সময় ঘটতে পারে, তাই এটি কোন পরিষ্কার সংযুক্তকরণ ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে না, যদিও অল্পবিস্তর সমন্বীকরণের ফলে এটি হালকা ঋণাত্মক সংযুক্তকরণ ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।[60]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.