Loading AI tools
রংপুর জেলায় অবস্থিত একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
রংপুর জিলা স্কুল বাংলাদেশের রংপুর জেলায় অবস্থিত একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এটি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের প্রাচীনতম বিদ্যালয়গুলির একটি। ১৯৩২ সালে শতবর্ষ হলেও তা ১৯৩৭ সালের ১১ এপ্রিল বিদ্যালয়টি প্রথম শতবর্ষ উদ্যাপন করে।[১]
রংপুর জিলা স্কুল | |
---|---|
অবস্থান | |
কাচারি বাজার রোড (ডিসির মোড়), রংপুর ৫৪০০ | |
স্থানাঙ্ক | ২৫.৭৫৭৪১১° উত্তর ৮৯.২৪২৮৫২° পূর্ব |
তথ্য | |
ধরন | সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় |
নীতিবাক্য | জ্ঞানই শক্তি |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৮৩২ |
বিদ্যালয় বোর্ড | মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, দিনাজপুর |
বিদ্যালয় জেলা | রংপুর জেলা |
ইআইআইএন | ১২৭৩৭২ |
প্রধান শিক্ষক | মো: আবুল কালাম আজাদ |
কর্মকর্তা | ১৩ |
শিক্ষকমণ্ডলী | ৫৫ |
শ্রেণি | ৩য়–১০ম |
লিঙ্গ | বালক |
শিক্ষার্থী সংখ্যা | আনু. ১৮০০ |
ভাষা | বাংলা |
শিক্ষায়তন | ১৫.৬৬ একর |
রং | খাঁকী এবং সাদা |
ক্রীড়া | ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি, নাট্যকার, কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক আনিসুল হক,পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা, সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (বীরবিক্রম),লেফটেনেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ আতিকুর রহমান (আর্মি চীফ অব স্টাফ) |
ইআইআইএন | ১২৭৩৭২ |
ওয়েবসাইট | www |
১৮২৮ সালের জনশ্রুতি অনুযায়ী, ধারণা করা হয় ১৮২৫ সালে রংপুর জিলা স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৩২ সালে অখণ্ড বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক "জমিদারদের স্কুল" নামে বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রাথমিকভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো খড়ের তৈরি একটি আটচালা ঘরে (বর্তমান মূল ভবনের উত্তর-পূর্বে পুরাতন ইঁদারার কাছাকাছি এর অবস্থান ছিল)। পরবর্তীকালে কোচবিহার রাজার উদ্যোগে একটি দালান নির্মাণ করা হয়।[১] বিদ্যালয়টি ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
"জমিদারদের স্কুলের" প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু কৃষ্ণকুমার সেন। এটি উত্তরবঙ্গের প্রথম বিদ্যালয় এবং শুরু থেকেই এখানে সমগ্র উত্তরবঙ্গ—বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্জনের জন্য আসতে থাকে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর স্কুলটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত এবং প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যক্ষ অনুদান প্রাপ্ত হয়।
১৮২৩ সালে গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের এর পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠার নীতি এবং ১৮৩৫ সালের শিক্ষানীতির (এতে ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, আইন সর্বোপরি পাশ্চাত্যশিক্ষা প্রদানের সুপারিশ করা হয়) আওতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত ব্রিটিশ ভারতের প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষাবিভাগ ১৮৬২ সালে রংপুরের বিখ্যাত জমিদার স্কুল "রংপুর জিলা স্কুলে" রূপান্তরিত করে।[১] সেসময়ে স্কুলটি ২,৬১৬ রুপি বার্ষিক অনুদান পেত।[২] উল্লেখ্য যে ‘জেলা’ বা ‘জিলা’ শব্দটি আরবি শব্দ ‘জিলা’ (ضلع) হতে আগত যেটি বাংলায় ‘জেলা’তে রূপান্তরিত। শব্দটি মুঘল আমল হতেই ‘প্রশাসনিক বিভাগ’ অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।[৩][৪] ইংরেজরাও শব্দটি গ্রহণ করে যেটির ইংরেজি রূপ ‘ZILLA’। অর্থাৎ ‘রংপুর জিলা স্কুল’ এর অর্থ ‘প্রশাসনিক বিভাগ বা জেলা রংপুরের বিদ্যালয়’।
১৮৭৩ সালে রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল একশত ষাট জন। এন্ট্রাস পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র চারজন। এন্ট্রাস পরীক্ষায় ঐ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় একজন প্রথম বিভাগ, দুইজন দ্বিতীয় বিভাগ, একজন তৃতীয় বিভাগ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে রংপুর জিলা স্কুল বৃহত্তর বাংলার প্রায় ৩৪টি স্কুলের মধ্যে ভাল ফলের জন্য ‘দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ’ (Second Grade College) এর মর্যাদা পায়। সে সময়ের প্রধান শিক্ষক বাবু চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য অধ্যক্ষ এবং বিখ্যাত পণ্ডিত যাদেশ্বর তর্করত্ন সংস্কৃত বিষয়ের অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। নানা কারণে চার বছর পর কলেজের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ১৮৮৪ সালে ৩৩৩ জন, ১৮৯৯ সালে ৩৬৭ জন[২] এবং ১৯০১ সালে ৩৮৫ ছিল। এ সময় রংপুর জিলা স্কুল প্রথম শ্রেণির বিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়। ১৯০৪ সালে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়।
জমিদারবর্গ শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তার জন্য সম্মিলিত ভাবে ‘ভিক্টোরিয়া স্কলারশিপ’ চালু করেন। ১৮৭৪ সালে রংপুরের ফতেহপুর পরগনার (বর্তমান পীরগঞ্জ উপজেলার) জমিদার ধরপৎ সিং তার পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য ‘দয়াল সিং রৌপ্য পদক’ চালু করেন। তার মৃত্যুর পর এ ব্যবস্থা চালু রাখেন তার স্ত্রী নিস্তারিণী দেবী। জেলার অন্য জমিদার কালীপ্রসন্ন সেন, দ্বারিকানাথ রায় চৌধুরী, কাকিনার জমিদার (বর্তমান লালমনিরহাট জেলায় অবস্থিত) প্রমুখ মিলে আট টাকা হারে উপবৃত্তি চালু করেন। সে অর্থ সরকারি বৃত্তি-বঞ্চিত দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল।
এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন কুণ্ডীর জমিদার রাজমোহন রায় চৌধুরী (১৭৮৭-১৮৪৭)।[২] তারপর তারই ছোট ভাই কাশীচন্দ্র রায় চৌধুরী ও কালিচন্দ্র রায় চৌধুরী এ দায়িত্ব পালন করেন। ইংরেজির পরিবর্তে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য পরবর্তী সেক্রেটারি তুষভাণ্ডারের জমিদার রমনী মোহন রায় চৌধুরী (১৮৮০-১৯৮৭) সরকারের নিকট আবেদন করেন। তার আবেদন ও সাংবাদিকদের ব্যাপক লেখালেখির পর আবেদন মঞ্জুর হয়। রংপুর জিলা স্কুল সহ প্রদেশের অনেক স্কুলে বাংলা চালু হয় এবং ‘বাংলা স্টাইপেন্ড স্কুল’ স্থাপনের সূচনা ঘটে। স্কুলের গেট সে সময় পশ্চিমমুখী ছিল ও উত্তর দিকেও একটি গেট ছিল। ষাটের দশকের শেষের দিকে স্কুলটি পাইলট স্কুল ভুক্ত হয় এবং ‘রংপুর জিলা (পাইলট) স্কুল’ হিসাবে চলে।[৫][৬][৭][৮][৯][১০][১১]
১৮৭৫ সালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিদ্যালয় ভবনটি পুড়ে যায়। তখন প্রায় এক বছর রংপুরের কেরানিপাড়ার প্রমুখ বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিবর্গের বাসভবনে চলে একাডেমিক কাজ। পরের বছর কুচবিহারের মহারাজার উদ্যোগে তারই দানকৃত দ্বিতল ভবনে ক্লাস চলে। এই ভবনটি ছিল জরাজীর্ণ, সে কারণে জেলাপরিষদ ভবনেও ক্লাস হত। শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতায় পাশেই জনৈক মি. রেইনির সিল্ক গোডাউনেও (বর্তমান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে কোথাও) একাডেমিক কাজ চলত।
উল্লেখ্য যে, রংপুরের জেলাপরিষদ ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ডিমলার (বর্তমান নীলফামারী জেলার একটি স্থান) ধনাঢ্য জমিদার রাজবল্লভ রায় চৌধুরীর বাগান বাড়িতে। ঐ বছরই রংপুরের তৎকালীন জেলা কালেক্টর মি. নাথিয়েল স্মিথ ও কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ার একচল্লিশ জন উদ্যোগী জমিদারবর্গের সহায়তায় প্রায় ১৭,৮০০ টাকা তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় বিদ্যালয় ফান্ডে নতুন ভবনের জন্য ১৯,০০০ টাকা জমা হয়। এরপর স্থানীয় জমিদারবর্গ বিশেষত স্থানীয় জমিদার রাধাবল্লভ রায় চৌধুরী, শ্যামপুরের জমিদার দ্বারিকানাথ রায় চৌধুরী ও তাজহাটের মহারাজার আনুকূল্যে ফান্ডে অর্থের পরিমাণ দাড়ায় ২৫,০০০ টাকা। নতুন ভবনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩০,০০০ টাকা। সম্ভবত ব্রিটিশ সরকার বাকি টাকার যোগান দিয়েছিল।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৮৮৩ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার অ্যাশলি ইডেন ১৫.৬৬ একর জমির উপর সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বর্তমান প্রধান ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।[২] ব্রিটিশ আর মুঘল স্থাপত্য রীতির সুনিপুণ মিশ্রণে এটি একটি অসাধারণ স্থাপত্য শিল্প। এখানে উল্লেখ করা যায় যে সম্ভবত বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের পুরাতন পাকুড় গাছ দুটি এর অনেক পূর্বেই, স্কুলের যাত্রা শুরুর দিকে রোপণ করা হয়েছিল যার মধ্যে আজও একটি বর্তমান আছে।[১২]
১৯১১ সালে দূরের ছাত্রদের জন্য স্কুলের পিছনের মাঠের পশ্চিম পাশে ব্রাহ্মণ ছাত্রাবাস ও ক্ষত্রিয় ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয় যা যথাক্রমে শুধু হিন্দু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ছিল। যার একটিতে সর্বমোট ৪৯০০ টাকা ব্যয় হয়েছিল। ১৯১৫ সালে আরও চারটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয় (বর্তমান পুরাতন দ্বিতল ভবনের প্রথম পর্যায়ে এই চারটি কক্ষ নির্মিত হয়)। ১৯১৯ দূরের মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত হয় মুসলিম ছাত্রাবাস। হোস্টেল তত্ত্বাবধায়কের জন্যও আবাসন ব্যবস্থা এর সাথেই ছিল।
স্বাধীনতা উত্তরকালে রংপুর জিলা স্কুলের অবকাঠামোগত কলেবর আরও বৃদ্ধি পায়। মূল ভবনের সাথে দ্বিতীয় ভবনের পূর্ণ সংযোগ হয়। দ্বিতীয় ভবনের পিছনে (উত্তরে) কর্মমুখী শিক্ষার একটি ল্যাবরেটরি তৈরি হয়। উত্তর-পূর্ব কোণে প্রধান শিক্ষকের একতলা বাসভবন নির্মিত হয়। পূর্বের সীমানা উঁচু করা হয় এবং হোস্টেল সুপারের আলাদা বাসভবন নির্মিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রুস্তম আলী খানের সময়কালে বিদ্যালয়ের নিজ উদ্যোগে প্রধান ভবনের উত্তরে মসজিদ নির্মিত হয়। শিক্ষকদের সহায়তায় ছাত্রদের নকশায় তিন সপ্তাহের টিফিনের টাকা দিয়ে শহীদ মিনার নির্মিত হয়। তখন টিফিন ফি ছিল দুই টাকা। মিনারের চারপাশে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ জোহার মাজারে নির্মিত বাগানের আদলে বাগান তৈরি করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে কর্মমুখী শিক্ষা ল্যাবরেটরির পূর্বে তৃতীয় ভবন এবং ২০০১ সালে দ্বিতীয় ভবনের পশ্চিমে দ্বিতল একাডেমিক ভবন নির্মিত হয়। ২০০২ সালে (২৪শে মার্চ, ১০ই চৈত্র, ১৪০৮ বঙ্গাব্দ) অডিটোরিয়াম ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও তৎকালীন শিক্ষাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল আলমের উপস্থিতিতে তারই বর্ষীয়ান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোঃ গোলাম রব্বানী কর্তৃক স্থাপিত হয় এবং ২০০৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর (৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪১১ বঙ্গাব্দ) তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধিত হয়। এ সময় বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রবেশদ্বারটিও নির্মিত হয়। একই আদলে রংপুর সরকারি কলেজের প্রবেশদ্বারটিও নির্মিত হয়। ২০০৭ সালে ডিবেটিং ক্লাব নির্মাণ করা হয়।
যে সব খ্যাতনামা ব্যক্তি এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হল:
রংপুর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্নভাবে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদান রেখে চলছে। তারই ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি ভাষা অধিকার আদায় ও ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রমিছিল বের করার মাধ্যমে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রমিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল আনুমানিক ১১টায় রংপুরের কারমাইকেল কলেজের কিছু ছাত্রনেতার নেতৃত্বে রংপুর জিলা স্কুলের প্রধান ফটক হতে ছাত্রমিছিল বের করা হয়। মিছিলে রংপুর জিলা স্কুলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মিছিলটি রংপুর শহর প্রদক্ষিণ করার সময় জেলা পরিষদের সামনে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। ফলে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আবার তারা পাবলিক লাইব্রেরির সামনে একত্রিত হয়। জিলা স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করায় সরকারি নির্দেশে তাদের বের হতে দেয়া হয় নি। তবুও কিছু ছাত্র শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে গোপনে মিছিলে যোগ দেয়।
সেই সময়ের প্রতিবাদী ছাত্রদের কজন হলেন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (বীরবিক্রম), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোঃ ইউনুস, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মুকিতুর রহমান, পেট্রোবাংলার পরিচালক মারুফ খান, রংপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোঃ আব্দুল গণি, রাজা রামমোহন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও সমাজকর্মী মনোয়ার হোসেন, গৌস আহমদ চুন্নু, নাট্য ব্যক্তিত্ব নগেন বর্মণ, অধ্যাপক শফিকুর রহমান খান,ভাষা সৈনিক সুফী মোতাহার, মোঃ আফজাল প্রমুখ।[১৪]
১৯৭১ সালে রংপুর জিলা স্কুলে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প ছিল। রংপুর জিলা স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন যথাক্রমে আহমেদ মকসেদ আলী এবং আব্দুল কাদের মন্ডল। স্কুলের কার্যক্রম যথানিয়মে চলত তবে ছাত্র উপস্থিতি অতি নগণ্য ছিল। রংপুর জিলা স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীর নাম নিচে দেয়া হল যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলেন:
পূর্বের মতো বর্তমানেও রংপুর জিলা স্কুল অত্র অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসাবে অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত। ২০০০ সালের পূর্বে ও পরে রংপুর জিলা স্কুল বহুবার জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে। শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে তিনবার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন মোঃ কুদ্দুস আলী। ২০০২ ও ২০০৩ সালে এই স্কুলের শিক্ষক যথাক্রমে বাবু সুবোধচন্দ্র দেবনাথ ও শহীদুল হক জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি-শিক্ষকের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে অনেকেই বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন। এক্ষেত্রে আবুল কালাম আজাদ, গোলকিপার শান্টু, মহসিন, ইকবাল, স্বপন, মজনু, ফিরোজ, খোকন, জাকিউল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বছরের শুরুতেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় যাতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। শিক্ষার্থীরা আন্তঃশ্রেণি খেলার পাশাপাশি প্রায়ই আন্তঃজেলা ও আন্তঃবিভাগীয় খেলায় অংশ নেয়। এই স্কুলের খেলোয়াড়গণ প্রায়ই জাতীয় পর্যায়েও চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া বার্ষিক মিলাদ মাহফিল, সরস্বতী পূজা, অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হয়। রংপুর জিলা স্কুল স্কাউটিং এ পরপর রাষ্ট্রপতি পদক পায়। দু এক বছর পরপরই শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্কাউটে জিলা স্কুলের পক্ষে সম্মানজনক পদক প্রাপ্ত হচ্ছে, বিদেশ-ভ্রমণ করছে। ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ সালে জাতীয় স্কুল বিতর্কে প্রথম স্থান এবং আরও দু’চার বার রানারআপ হয়েছে।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে স্কুলে দুটি অধিবেশনে (শিফ্ট) শিক্ষাদান করা হচ্ছে যথা: প্রভাতী অধিবেশন এবং দিবাকালীন অধিবেশন। সকাল ৭.৩০ থেকে প্রভাতী অধিবেশন এবং দুপুর ১২.০০ থেকে দিবা অধিবেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। । আবার শ্রেণির চারটি করে শাখা রয়েছে যথা ‘ক’ শাখা, ‘খ’ শাখা, ‘গ’ শাখা, ‘ঘ’ শাখা। ‘ক’ ও ‘গ’ শাখার পাঠ প্রভাতী অধিবেশনে এবং ‘খ’ ও ‘ঘ’ শাখার পাঠ দিবা অধিবেশনে প্রদান করা হয়। অভিজ্ঞ এবং দক্ষ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে স্কুলটিতে উচ্চমানের শিক্ষা প্রদান করা হয়। এটি বালক বিদ্যালয় হলেও এখানে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও শিক্ষকতা করেন। ১৩ জন কর্মচারী, ৫২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা, ২ জন সহ-প্রধান শিক্ষক, ১ জন প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন (২০১৩)।[২১]
প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন বিদ্যালয়টির বর্তমানে জমির পরিমাণ ১৫.৬৬ একর।[২] বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ভবন সহ (প্রধান ভবন) একাডেমিক ভবনের সংখ্যা ৬টি। স্কুলে ১টি মিলনায়তন, ১টি মসজিদ, ১টি হোস্টেল, ১টি গ্যারেজ, ১টি ডিবেটিং ক্লাব ঘর, ১টি অব্যবহৃত ছাত্রাবাস, ১টি অভিভাবক শেড, প্রধান শিক্ষকের বাসভবন, হোস্টেল তত্ত্বাবধায়কের বাসভবন ও সম্মুখে ২টি খেলার মাঠ, ১টি বাস্কেটবল কোর্ট, পশ্চাৎ অংশে ১টি পুকুর, গাছে ঘেরা প্রাঙ্গণ রয়েছে।
এই বিদ্যালয়ে উঁচুমানের পাঁচটি বিজ্ঞানাগার, ১,০০০ পুস্তকসম্বলিত একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার[২], একটি সুবিশাল কম্পিউটার ল্যাবরেটরি, একটি ডিবেটিং ক্লাব ও সুবৃহৎ ও আধুনিক মিলনায়তন রয়েছে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা, কর্মমুখী শিক্ষা, কৃষি শিক্ষার প্রায়োগিক পাঠসমূহ সাধারণত বিজ্ঞানাগারে পড়ানো হয়। বিদ্যালয়ে পুকুর রয়েছে যাতে সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিদ্যালয়ে প্রতিবছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ে কিছু জাতীয় সংস্থার শাখা চালু আছে যথা:
দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসন ব্যবস্থা আছে। এটি স্কুল প্রাঙ্গণের ভেতরেই অবস্থিত যা ‘রংপুর জিলা স্কুল হোস্টেল’ নামে পরিচিত। এতে আসন পেতে শ্রেণি-শিক্ষকের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক বরাবর আবেদন করতে হয়।
রংপুর জিলা স্কুল যেহেতু বৃহত্তর রংপুর ও এর আশেপাশের এলাকার প্রথম স্কুল তাই স্বাভাবিকভাবেই শুরু থেকেই পড়াশোনার ক্ষেত্রে জিলা স্কুল অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে, যা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত নথি পাওয়া যায়, যাতে দেখা যায় যে প্রতি বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বোর্ডের মেধা তালিকায় (প্রথম থেকে বিংশ) এই স্কুলের ছাত্রের নাম আছে। ১৯৮০ সালে ৩ জন, ১৯৮১ সালে ৫ জন, ১৯৮২ সালে ২ জন, ১৯৮৩ সালে ২ জন—এভাবে প্রতি বছরই প্রথম বিশ জনের তালিকায় জিলা স্কুলের ছাত্রের নাম থাকছে যা আজও অব্যাহত। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বৃত্তি পরীক্ষাতেও ফল খুবই ভাল। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে এস.এস.সি.পরীক্ষায় রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্র রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। ২০০৪ সালে প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় এ বিদ্যালয় ‘রংপুর অঞ্চল’ এ ছেলেদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে।[২২]
স্কুলটিতে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয়। সাধারণত ৩য়, ৬ষ্ঠ ও ৯ম শ্রেণিতে (৬ষ্ঠ ও ৯ম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে) ছাত্র ভর্তি করা হয়। স্কুলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে হয়। যেসব ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে তারাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।
সরকারি স্কুল হওয়ায় এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ অনেক কম। প্রতি মাসে বেতনের সাথে টিফিন ফি নেয়া হয়। হোস্টেলের ছাত্রদের আলাদা ফি দিতে হয়।
স্কুলের নির্দিষ্ট পোশাক হল সাদা শার্ট (ফুলহাতা বা হাফহাতা দুটোই গ্রহণযোগ্য), খাকি রঙের ফুল প্যান্ট ও সাদা কেড্স ও মোজা। এছাড়া শীতকালে নীল রঙের সোয়েটারও পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। শার্টের বাম পকেটে স্কুলের মনোগ্রামযুক্ত ব্যাজ এবং কাঁধে প্রভাতী অধিবেশনে নীল রঙের কাঁধ-ব্যাজ ও নেমপ্লেট এবং দিবা অধিবেশনে মেরুন রঙের কাঁধ-ব্যাজ ও নেমপ্লেট থাকা পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৫ সাল হতে ছাত্রদের পরিচয়পত্র প্রদান করা হচ্ছে। শার্ট ইন করে পরতে হয় এবং কালো বেল্ট পরা আবশ্যক।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিদ্যালয় মাঠে নাটোরের রাণী ভবাণীর গোবিন্দগঞ্জ স্টেটের বর্ধন কুটির জমিদার ‘বর্ধন কুটি’ ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করেন। ১৯২২ সালের নথি থেকে জানা যায় টুর্নামেন্টে প্রধান শিক্ষক বাবু প্রমথনাথ ভট্টাচার্য সেক্রেটারি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. এলিস সভাপতি ছিলেন। এই টুর্নামেন্টে জিলা স্কুল মাঠে এক আনন্দমেলার সৃষ্টি হয়। কথিত আছে এই টুর্নামেন্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পারতো না। সেমিফাইনালেই কোন না কোন অজুহাতে খেলা পেছানো হতো। এমনকি ক্রীড়ামোদীদের অনুরোধেও খেলার তারিখ পেছানো হত। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ‘হার্ডিন্জ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ জিলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হত। টুর্নামেন্টে কুচবিহারের রাজার দল সহ দূর-দূরান্তের ফুটবল দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে কুচবিহার মহারাজার দল ও কাকিনার জমিদারের ফুটবল দলের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়ে ছিল। সেবারের প্রতিযোগিতা শেষ পর্যায়ে পৌঁছায় নি। বিদ্যালয় পর্যায়ে ‘কে কে ফুটবল টুর্নামেন্ট’ চালু ছিল। এতে জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্ররা অংশ নিতো। জমিদার দ্বারিকানাথ রায় চৌধুরীর পুত্র কুমার কালীনাথ রায় চৌধুরীর নামেই চলত এই টুর্নামেন্ট। যার পরিচালনা কমিটিতে জেলা কালেক্টর ও জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক সভাপতি ও সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন। স্কুলের সংগ্রহশালায় কে কে ফুটবল টুর্নামেন্টের একটি শিল্ড পাওয়া যায় যাতে দেখা যায় যে রংপুর জিলা স্কুল ১৯৩৪ সালে রানার আপ হয়েছিল।জাতীয় স্কুল টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় রংপুর জিলা স্কুল একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.