Loading AI tools
ইতিহাসের বিভিন্ন দিক উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জৈনধর্ম হল ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন ধর্ম। জৈনরা চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের জীবনীর মধ্য দিয়ে তাঁদের ইতিহাসের রূপরেখা অঙ্কন করেন। জৈন বিশ্বাস অনুসারে, বর্তমান কালচক্রার্ধের (অবসর্পিণী যুগ) প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভনাথ। সর্বশেষ দুই তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ (২৩শ তীর্থঙ্কর, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮৭২-৭৭২ অব্দ)[১][২] ও মহাবীর (২৪শ তীর্থঙ্কর, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯-৫২৭ অব্দ)[৩] ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।[৪][৫] ২২শ তীর্থঙ্কর নেমিনাথ সম্পর্কে সীমিত ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।[৬] কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি ছিলেন কৃষ্ণের জ্ঞাতিভ্রাতা।[৭][৮] জৈনধর্ম হল চিরস্থায়িত্বের দর্শন। জৈনরা বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের ধর্ম হল একটি চিরস্থায়ী ধর্ম।[৯][১০] হেইনরিক জিমারের মতে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা চতুর্থ সহস্রাব্দেও জৈনধর্মের অস্তিত্ব ছিল। সিন্ধু উপত্যকায় পরবর্তী প্রস্তরযুগীয় একাধিক বৃহদাকার শহরের ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীগুলি পর্যবেক্ষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
জৈনধর্মের উৎসটি স্পষ্ট নয়।[১১][১২] পাশ্চাত্য গবেষক হেলমুথ ফন গ্ল্যাসেন্যাপ লিখেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের ১ম শতাব্দীটিই জৈনধর্মের উৎসকালের সর্বাধিক সময়সীমা বলে ধরা যেতে পারে। তিনি প্রথম বাইশ জন তীর্থঙ্করকে পৌরাণিক চরিত্র বলে উল্লেখ করেছেন।[১৩][১৪]
ড. বিলাস এ. সাংভি, চম্পৎ রাই জৈন, অধ্যাপক জর্জ বুলার, হারমান জেকবি, ড. হরনেল, পণ্ডিত সুখলাল সাংভি, অধ্যাপক বিদ্যালঙ্কার ও অন্যান্যরা বিশ্বাস করেন যে, জৈনধর্মই ভারতের প্রাচীনতম বিদিত ধর্মবিশ্বাস এবং সিন্ধু উপত্যকায় এই ধর্মের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাঁদের মতে, হরপ্পায় খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ‘কায়োৎসর্গ’ ভঙ্গিমার নগ্ন পুরুষমূর্তি, ‘পদ্মাসন’ ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট মূর্তি, সর্পমস্তক মূর্তি এবং ঋষভনাথের বৃষ প্রতীক জৈনধর্মের পরিচায়ক।[১৫][১৬][১৭][১৮][১৯]
জৈনধর্মের প্রাচীনত্ব প্রসঙ্গে ড. হেইনরিক জিমার লিখেছেন:
জৈনদের ধারণা তাঁদের ধর্ম সুপ্রাচীন কালের। এই ধারণার মধ্যে সত্যতা আছে। যে প্রাচীনত্বের কথা বলা হচ্ছে, সেটি প্রাক-আর্য যুগীয় তথাকথিত দ্রাবিড় পর্যায়ের। সাম্প্রতিককালে সিন্ধু উপত্যকায় পরবর্তী প্রস্তরযুগীয় একাধিক বৃহদাকার শহর (উক্ত শহরগুলির ধ্বংসাবশেষ) আবিষ্কার হওয়ার ফলে এই ধারণাটি নাটকীয়ভাবে আলোকিত হয়েছে। এই শহরগুলি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা সম্ভবত চতুর্থ সহস্রাব্দের হতে পারে।[২০]
ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ কয়েকজন গবেষক মনে করেন যে, জৈনধর্ম হিন্দুধর্মের তুলনায় অনেক প্রাচীন একটি ধর্মমত:
বেদ রচিত হওয়ার বহু পূর্বে জৈনধর্মের অস্তিত্ব ছিল। আমার এই বক্তব্যের মধ্যে আশ্চর্য কিছু নেই।
— সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, [২১]
দ্য কালচারাল হেরিটেজ অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে রয়েছে:[২২]
জৈনরা দাবি করেন তাঁদের ধর্ম অতি সুপ্রাচীন কালের। তাঁদের প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদেব। বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণ গ্রন্থদ্বয়ে তাঁকে সুপ্রাচীন কালের ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। [এছাড়া] প্রাচীনতম ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যে একটি ধর্মীয় সংঘের উল্লেখ পাওয়া যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে জৈনধর্মের সর্বাধিক প্রভাবশালী প্রচারক ছিলেন মহাবীর। জৈনদের মতে, তিনি বর্তমান কালচক্রার্ধের (অবসর্পিণী যুগ) ২৪শ তথা সর্বশেষ তীর্থঙ্কর।[২৩] মহাবীরকে অনেক সময় ভুলবশত জৈনধর্মের প্রবর্তক মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে জৈনধর্ম তাঁর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল এবং তিনি গোড়া থেকেই এই ধর্মের অনুগামী ছিলেন।[২৪]
মহাবীরের পূর্বসূরি তথা ২৩শ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ যে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন সেই বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-৭ম শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[৪][২৫][২৬][২৭]
২২শ তীর্থঙ্কর নেমিনাথ ছিলেন পার্শ্বনাথের পূর্বসূরি। জৈন বিশ্বাস অনুসারে, তিনি পার্শ্বনাথের ৮০,০০০ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯০-৯১ সালে মথুরা কঙ্কালী টিলা নামক ঢিপিতে একটি খননকার্য চালানো হয়েছিল। এই খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী পরীক্ষা করে ড. ফুরার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নেমিনাথও একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।[৬]
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ-এ প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভের উল্লেখ পাওয়া যায়। উক্ত গ্রন্থে (১০ম মণ্ডল, ১২শ অনুবাক, ১১৬ ঋক্) বলা হয়েছে:[২৮]
“ | হে রুদ্রতুল্য দেব! আপনি প্রথম জগদ্গুরুর উপাধি অর্হনত্ব প্রাপ্ত হউন। আমাদের নিকট ঋষভদেবের ন্যায় এমন এক মহৎ দেবতাকে প্রেরণ করুন, যিনি সকল শত্রুর হন্তা হইবেন! | ” |
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে এক দ্বাদশবর্ষব্যাপী দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই সময় আচার্য ভদ্রবাহু দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কর্ণাটক অঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন। ভদ্রবাহুর শিষ্য স্থূলভদ্র মগধে থেকে যান। ভদ্রবাহুর অনুগামীরা মগধে প্রত্যাবর্তন করলে অঙ্গ শাস্ত্রের প্রামাণিকতাকে কেন্দ্র করে স্থূলভদ্র ও তাঁদের মধ্যে বিবাদ বাধে। এছাড়া মগধবাসী জৈনেরা সেই সময় শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতে শুরু করেছিলেন। ভদ্রবাহুর অনুগামীদের কাছে এটি গ্রহণীয় ছিল না। তাঁদের মতে, নগ্ন থাকাই ছিল জৈন শাস্ত্রানুমোদিত বিধি। এইভাবে জৈন সমাজ দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দিগম্বর জৈনরা নগ্ন অবস্থায় থাকতেন এবং শ্বেতাম্বর জৈনরা শ্বেত বস্ত্র পরিধান করতেন।[২৯] দিগম্বরেরা বস্ত্র পরিধান করাকে জৈন মতবিশ্বাসের পরিপন্থী মনে করতেন। তাঁদের মতে, জৈন মতবাদ অনুসারে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় জীবনযাপন করতে হয়। দিগম্বর সম্প্রদায়ের দাবি, তাঁরাই প্রাচীন শ্রমণ প্রথাটিকে সংরক্ষণ করছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর গ্রিক নথিতে যে ‘জিমনোসোফিস্ট’দের (নগ্ন দার্শনিক) উপস্থিতির কথা জানা যায়, তার থেকে দিগম্বর সম্প্রদায়ের এই দাবির সমর্থন পাওয়া যায়।[৩০]
প্রথাগত বিশ্বাস অনুসারে, জৈনধর্মের মূল মতবাদ পূর্ব নামক শাস্ত্রে লিখিত ছিল। মোট চোদ্দোটি পূর্ব শাস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। জৈনদের বিশ্বাস, এই পূর্ব শাস্ত্রগুলির উৎস প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ।[৩১] মহাবীরের মৃত্যুর দুই শতাব্দী পরে একটি দ্বাদশবর্ষব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেই সময় মগধের শাসক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং জৈন সমাজের প্রধান ছিলেন ভদ্রবাহু। ভদ্রবাহু তাঁর অনুগামীদের নিয়ে দক্ষিণে কর্ণাটক অঞ্চলে চলে যান। স্থূলভদ্র নামে অপর এক জৈন প্রধান মগধে থেকে যান। এই সময় জৈন মতবাদ সম্পর্কে জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছিল। তখন পাটলীপুত্রে এক সভার আয়োজন করা হয় এবং সেই সভায় অঙ্গ নামে পরিচিত ১১টি শাস্ত্র রচনা করা হয়। স্থূলভদ্রের অনুগামীরা দ্বাদশ অঙ্গ দিট্ঠিবায় গ্রন্থে চোদ্দোটি পূর্ব শাস্ত্রের অবশিষ্টাংশ সংকলিত করেন। দিগম্বর সম্প্রদায় স্থূলভদ্র কর্তৃক সংকলিত জৈন আগমের প্রামাণিকতা অস্বীকার করে।[৩২] তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ইন্দ্রভূতি গৌতমের পর ২৩শ শিক্ষক ধরাসেনের সময় মাত্র একটি অঙ্গ শাস্ত্রের জ্ঞান ছিল। এটি ছিল মহাবীরের নির্বাণের ৬৮৩ বছর পরে। ধরাসেনের শিষ্য পুষ্পদন্ত ও ভূতবলীর সময়কালে তাও হারিয়ে যায়।[৩৩]
ধীরে ধীরে শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য শাস্ত্রগুলিও হারিয়ে যেতে শুরু করে।[৩৪] মহাবীরের নির্বাণের ৯৮০ থেকে ৯৯৩ বছর পরে গুজরাতের বল্লভীতে একটা সভা আয়োজন করা হয়। এই সভার নেতৃত্ব দেন দেবার্ধী ক্ষমাশ্রমণ।[৩৪][৩৫] সেই সময় জানা যায় দ্বাদশ অঙ্গ দিট্ঠিবায় গ্রন্থটিও হারিয়ে গিয়েছে। অপর দুটি অঙ্গ রচিত হয়।[৩৪] এই হল জৈনধর্মের সম্প্রদায় বিভাজনের প্রথাগত কাহিনি।[৩৬] শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের মতে, আটবার ‘নিহ্বান’ বা বিভাজন ঘটেছিল।[৩৭]
দিগম্বর প্রথা অনুসারে, গণধর চোদ্দোটি পূর্ব ও এগারোটি অঙ্গ জানতেন। মহাবীরের নির্বাণের প্রায় ৪৩৬ বছর পরে পূর্ব শাস্ত্রের জ্ঞান এবং ৬৮৩ বছর পরে অঙ্গ শাস্ত্রের জ্ঞান লুপ্ত হয়।[৩৮] যে গ্রন্থগুলি অঙ্গ শাস্ত্রের অন্তর্গত নয়, তাকে বলা হত অঙ্গবাহ্য। চোদ্দোটি অঙ্গবাহ্য ছিল। প্রথম চারটি অঙ্গবাহ্য শাস্ত্রের নাম সাময়িক, চতুর্বিমাশ্বিক, বন্দন ও প্রতিক্রমণ। এগুলি শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় মূলসূত্র গ্রন্থের কিছু অংশের অনুরূপ। শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের অঙ্গবাহ্য শাস্ত্রগুলি হল দশবৈকালিক, উত্তরাধ্যয়ন ও কল্পব্যবহার।[৩৯]
পার্শ্বনাথের নির্বাণের পর তাঁর শিষ্য শুভদত্ত সন্ন্যাসীদের প্রধান হয়েছিলেন। শুভদত্তের পর যথাক্রমে হরিদত্ত, আর্যসমুদ্র, প্রভা ও কেশী সন্ন্যাসীদের প্রধান হন।[৪০] উত্তরাধ্যয়ন নামক শ্বেতাম্বর ধর্মগ্রন্থে মহাবীরের শিষ্য ও কেশীর মধ্যে একটি কথোপকথনের বিবৃতি ধৃত রয়েছে। কেশী ও তাঁর অনুগামীরা মহাবীরকে তীর্থঙ্কর হিসেবে স্বীকার করে নেন এবং মহাবীরের সঙ্গে যোগ দেন।[৪১]
কথিত আছে, তীর্থঙ্করগণ ‘কেবল জ্ঞান’ (অনন্ত শুদ্ধ জ্ঞান) অর্জন করেছিলেন। মহাবীরের পর তাঁর শিষ্য সুধর্ম স্বামী জৈন সম্প্রদায়ের প্রধান হন।[৪২] আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ অব্দ পর্যন্ত তিনি জৈন সমাজের প্রধান ছিলেন।[৪৩] তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য জম্বুস্বামী সন্ন্যাসীদের প্রধান হন। তিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৩ অব্দ পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের প্রধান ছিলেন।[৪৪] জৈন বিশ্বাস অনুসারে, সুধর্ম স্বামী ও জম্বুস্বামী ‘কেবল জ্ঞান’ অর্জন করেছিলেন এবং জম্বুস্বামীর পর অদ্যাবধি কেউ তা অর্জন করেননি।
সুধর্ম স্বামীর পর পাঁচ জন ‘সূত্রকেবলী’ (যাঁরা শাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ) জৈন সমাজকে নেতৃত্ব দেন। ভদ্রবাহু ছিলেন সর্বশেষ সূত্রকেবলী।[৪৫] ভদ্রবাহুর পরে সাত জন (মতান্তরে এগারো জন) জৈন সমাজকে নেতৃত্ব দেন।[৪৪] এরপর শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান একে একে লুপ্ত হয়।
জৈনধর্মের ইতিহাস সংক্রান্ত যে তথ্যগুলি পাওয়া যায় সেগুলি অনিশ্চিত ও খণ্ডিত। জৈনদের মতে রাজা বিম্বিসার (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৮-৪৯১ অব্দ), অজাতশত্রু (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২-৪৬০ অব্দ) ও হর্যঙ্ক রাজবংশের উদয়ন জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।[৪৬] নন্দ সাম্রাজ্যেও (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪-৩২১ অব্দ) জৈনধর্ম প্রসার লাভ করেছিল।[৪৬]
প্রথাগত বিশ্বাস অনুসারে, মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২২-২৯৮ অব্দ) শেষ জীবনে ভদ্রবাহুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।[৪৭]
চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দ) বৌদ্ধ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। অশোকের শিলালিপিগুলিতে জৈনদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপিগুলিতে ‘ধম্মমহামাত্য’দের (সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত ধর্মপ্রচারক) কর্তব্য বর্ণিত আছে।[৪৮] একটি শিলালিপিতে রয়েছে:[৪৮]
দেবতাদের প্রিয় পিয়দসি এই কথা বলেছেন: আমার ধর্মমহামাত্যগণ দয়ালু ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এছাড়া তাঁরা তাঁদের সঙ্গেও যোগাযোর রাখেন যাঁরা সন্ন্যাসীদের কথা চিন্তা করেন এবং যাঁরা গৃহস্থদের কথা চিন্তা করেন। তাঁরা ধর্মীয় ভ্রাতৃসংঘের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন। আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে তাঁরা (বৌদ্ধ) সংঘের ব্যাপারেও যোগাযোগ রাখতে পারেন। একই ভাবে, আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে তাঁরা ব্রাহ্মণ এবং আজীবকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পারেন। আমি এমন ব্যবস্থাও করেছি, যাতে তাঁরা নিগন্থদের (জৈন) সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পারেন। আমি এমন ব্যবস্থা করেছি, যাতে তাঁরা (সকল) ধর্মীয় ভ্রাতৃসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।
কথিত আছে, অশোকের পৌত্র সম্প্রতি (খ্রিস্টপূর্ব ২২৪-২১৫ অব্দ) সুহস্তী নামক এক জৈন সন্ন্যাসী কর্তৃক জৈনধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তিনি উজ্জয়িনীতে বাস করতেন।[৪৯] মনে করা হয়, তিনি অনেক জৈন মন্দির স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে যে সকল মন্দিরের উৎস বিস্মৃত হয়েছিল, সেগুলিকে তাঁর নির্মিত মন্দির বলে উল্লেখ করা হত।[৪৯]
মহামেঘবাহন রাজবংশের সম্রাট খারবেল ছিলেন ধর্মসহিষ্ণু রাজা। তিনি জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। উদয়গিরির উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথের একটি মূর্তি নির্মাণ করান এবং সন্ন্যাসীদের জন্য গুহানিবাস তৈরি করে দেন।[৫০]
অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে, উজ্জয়িনীর শক্তিশালী রাজা গর্দভিল্ল (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দী) কলক নামে এক জৈন সন্ন্যাসীর ভগিনী সন্ন্যাসিনী সরস্বতীকে অপহরণ করেছিলেন। ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসী ইন্দো-সিথিয়ান শাসক শক শাহির সাহায্য প্রার্থনা করেন। শক শাহি গর্দভিল্লকে পরাজিত ও কারারুদ্ধ করেন। সরস্বতীকে উদ্ধার করা হয়। যদিও গর্দভিল্লকে ক্ষমা করা হয়।[৫১] গর্দভিল্লর পুত্র বিক্রমাদিত্য শক শাসককে বিতাড়িত করেন। জৈনরা তাঁকে তাঁদের ধর্মের পৃষ্ঠপোষক মনে করেন।[৫১] তিনি ছিলেন বিশিষ্ট জৈন সন্ন্যাসী সিদ্ধসেন দিবাকরের শিষ্য। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, শালিবাহন বিক্রমাদিত্যের শাসনের অবসান ঘটান। তিনিও ছিলেন জৈনধর্মের এক বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক।[৫২] খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত মথুরা ছিল জৈনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। খ্রিস্টীয় ১ম ও ২য় শতাব্দীর উৎকীর্ণ লিপিগুলি থেকে জানা যায় যে, তার আগেই দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈনধর্মের বিভাজন ঘটে গিয়েছিল।[৫৩]
৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে জৈন শাস্ত্র রচনার জন্য বল্লভী সভার আয়োজন করা হয়।[৫৪] দিগম্বর সম্প্রদায় এই শাস্ত্রগুলিকে অপ্রামাণিক বলে প্রত্যাখ্যান করে। জৈন সন্ন্যাসী সিলুঙ্গ সূরি যাদব রাজবংশের রাজা বনরাজকে (৭২০-৭৮০ খ্রিস্টাব্দ) লালনপালন করেছিলেন। চালুক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মূলরাজ নিজে জৈন না হলেও একটি জৈন মন্দির নির্মাণ করান।[৫৫] ভীমের (১০২২-১০৬৪ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে বিমল নামে এক জৈন গৃহস্থ আবু পর্বতের চূড়ায় অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। জৈন সন্ন্যাসী হেমচন্দ্র (জন্ম১০৮৮ খ্রিস্টাব্দ) আট বছর বয়সে সন্ন্যাসী দেবচন্দ্র কর্তৃক দীক্ষিত হন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। গুজরাতে জৈনধর্মের প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।[৫৬] হেমচন্দ্র সোলাঙ্কি রাজবংশের রাজা কুমারপালকে জৈনধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। যদিও কুমারপালের ভ্রাতুষ্পুত্র তথা উত্তরাধিকারী অজয়পাল ছিলেন শৈব। তিনি জৈনদের দমন করেন।
৪৮০ খ্রিস্টাব্দে মিহিরকুল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান। জৈনরা তাঁকে জৈনধর্মের শত্রু মনে করেন। কারণ, তিনি জৈনদের প্রতি দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন।[৫৭]
চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং (৬২৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন যে, রাজগৃহের কাছে বৈশালী, নালন্দা ও পুণ্ড্রবর্ধনে অসংখ্য জৈন বাস করতেন। তিনি তাঁর সমসাময়িক কালে কলিঙ্গকে জৈনধর্মের প্রধান কেন্দ্র মনে করতেন।[৫০]
সিদ্ধসেন দিবাকরের শিষ্য বাপ্পাভট্টি কনৌজের রাজা অমকে (খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী) জৈনধর্মে ধর্মান্তরিত করেন।[৫৭] বাপ্পাভট্টি অমের বন্ধু বাকপতিকেও ধর্মান্তরিত করেছিলেন। এই বাকপতি ছিলেন বিখ্যাত প্রাকৃত গৌড়বাহ কাব্যের রচয়িতা।[৫৮]
খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দী নাগাদ হিন্দু দার্শনিক কুমারিল ভট্ট ও আদি শঙ্কর বৈদিক ধর্ম পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করেন। কুমারিল ভট্ট বৈদিক যজ্ঞ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। আদি শঙ্কর অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন প্রচার করেন। এই সময় বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্মেরও উত্থান ঘটে। এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল মূলত দক্ষিণ ভারতে।[৫৯]
শৈব কবি সম্বন্দর, আপ্পার (খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী), সুন্দরমূর্তি ও মণিক্কবচকর জৈনদের কাছে শৈবধর্মের পরিচিতি ঘটান। তাঁদের প্রভাবে জৈন রাজারা শৈবধর্ম গ্রহণ করেন।[৬০] চোল রাজবংশের শাসকেরাও শৈবধর্মকে সমর্থন করতেন।
শৈব কিংবদন্তি অনুসারে, পাণ্ড্য রাজা কুন পাণ্ড্যন ৮,০০০ জৈন সন্ন্যাসীর গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। উত্তর আরকটের তিভাতুরের দেওয়ালে এই গণহত্যার চিত্র খোদিত রয়েছে। যদিও এই কিংবদন্তির উল্লেখ কোনও জৈন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। মনে করা হয়, শৈবরা নিজ আধিপত্য প্রদর্শনার্থে এই কিংবদন্তির রটনা করেছিলেন।[৬১][৬২][৬৩]
খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে জৈন রাজা বিজ্জলের মন্ত্রী বাসব বহু জৈনকে লিঙ্গায়েত ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। লিঙ্গায়েতরা ছিলেন জৈনদের প্রতি প্রতিকূল এক শৈব সম্প্রদায়। তাঁরা জৈনদের অনেক মন্দির ধ্বংস করেন এবং সেগুলি নিজেদের কাজে ব্যবহার করেন।[৬০]একদন্ত রামায় নামে এক সন্তও লিঙ্গায়েত ধর্ম প্রচার করেন। তিনি বিজ্জলের থেকে আব্দলুরে একটি শিব মন্দির স্থাপনের জন্য জমি গ্রহণ করেছিলেন।[৬৪] ধীরে ধীরে লিঙ্গায়েত ধর্ম প্রসার লাভ করতে থাকে। মহীশূর ও উম্মাতুরের ]]উডেয়ার]] প্রভৃতি তেলুগু ও কন্নড়ভাষী অঞ্চল (১৩৯৯-১৬১০ খ্রিস্টাব্দ) এবং কেলাডির নায়ক (১৫৫০-১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি রাজ্যের রাজধর্ম ছিল লিঙ্গায়েত ধর্ম।[৬৪] এই রাজারা জৈনদের প্রতিকূল ছিলেন। ১৬৮৩ সালে হৈলেবিডুর প্রধান জৈন বসতি অঞ্চলে তাঁরা একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। জৈনদের শৈব অনুষ্ঠান পালনে বাধ্য করা হত।[৬৫]
হৈসল রাজা বিষ্ণুবর্ধন (১১০৮-১১৫২ খ্রিস্টাব্দ) জৈনধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং রামানুজের অনুগামী হন। কথিত আছে, জৈনরা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করলে তিনি তাঁদের তপ্ত তৈলে নিক্ষেপ করতেন এবং দলিত করতেন।[৬০]
মাহমুদ গজনি (১০০১) ও মহম্মদ ঘোরি (১১৭৫) প্রভৃতি ভারত আক্রমণকারী মুসলমান শাসকেরাও জৈন সম্প্রদায়কে দমন করেছিলেন।[৬৬]
১৮৪৮ সালে আমেদাবাদে শেঠ হট্ঠিসিংহ ১৫শ তীর্থঙ্কর ধর্মনাথের একটি মন্দির নির্মাণ করান। ব্রিটিশ যুগেও ভারতে জৈনদের সংখ্যা কমতে থাকে।[৬৭] জৈন গৃহস্থরা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকেন। যাঁরা ধর্মান্তরিত হননি, তাঁরাও হিন্দুধর্মের অনুষ্ঠান পালন করতে থাকেন এবং হিন্দু দেবদেবীদের পূজা জৈনধর্মে গৃহীত হয়।[৬৮] জৈন সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এতে বিপদ সংকেত দেখেন এবং জৈনধর্ম পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন। শ্বেতাম্বর তপ গচ্ছের বিজয়ানন্দ সূরি (১৮৩৭-১৮৯৭) এবং বিজয় ধর্ম সূরি (১৮৬৮-১৯২২) ব্রিটিশ শাসনে জৈনধর্ম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[৬৮]
ভারত স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পরে বোম্বাই প্রদেশে ‘কমিটি ইনটু রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিটেবল এনডওমেন্ট’ নামে এক কমিটি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মালিকানাধীন সম্পত্তির ব্যবহারের তথ্য অনুসন্ধান করতে শুরু করে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কোনও একটি সম্প্রদায়ের হাসপাতাল প্রভৃতি অছি পরিষদ ও সম্পত্তিগুলি এসকল সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের পরিবর্তন সাধন।[৬৯] এই প্রস্তাব এবং বোম্বাই স্টেট টেম্পল এন্ট্রি বিল জৈন ও হিন্দু মন্দিরে সামাজিকভাবে অস্পৃশ্যদের প্রবেশাধিকার দেয়। জৈন মতবাদের প্রচার এবং জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজ সম্প্রদায়ের পরিচিতির প্রসারের ব্যাপারে এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।[৬৯]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.