Loading AI tools
মৌর্য সাম্রাজ্যের ১ম সম্রাট উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (সংস্কৃত: चन्द्रगुप्त मौर्य), যিনি গ্রিকদের নিকট সান্দ্রোকোত্তোস বা আন্দ্রাকোত্তাস নামে পরিচিত ছিলেন,[2] (৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব-২৯৮ খ্রিষ্টপূর্ব) মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং মৌর্য বংশের প্রথম সম্রাট। তিনি ছিলেন প্রথম সম্রাট যিনি বৃহত্তর ভারতের অধিকাংশকে এক শাসনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া পর্যন্ত রাজত্ব করেন ও তার পরে তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে আরোহণ করেন।[3][4][5]
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য | |
---|---|
সম্রাট চক্রবর্তী | |
রাজত্ব | ৩২৪ খ্রীষ্টপূর্ব-৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব |
রাজ্যাভিষেক | ৩২৪ খ্রীষ্টপূর্ব |
পূর্বসূরি | নন্দ সাম্রাজ্যের ধননন্দ |
উত্তরসূরি | বিন্দুসার (সন্তান) |
জন্ম | ৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব পাটলিপুত্র |
মৃত্যু | ২৯৫ খ্রিস্টপূর্ব শ্রাবণবেলাগলা[1] |
দাম্পত্য সঙ্গী |
|
বংশধর | বিন্দুসার |
প্রাসাদ | মৌর্য সাম্রাজ্য |
মাতা | মুরা |
ধর্ম | সনাতন ধর্ম এবং জৈন ধর্ম |
ক্ষমতায় আসার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ বেশ কয়েকটি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল এবং সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমি নন্দ রাজবংশ দ্বারা শাসিত হত।[6] চন্দ্রগুপ্ত তার রাজত্বের শেষ পর্যন্ত তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল ব্যতিরেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থান অধিকার করতে বা পদানত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[nb 1] পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতের ইতিহাসে ইতিপূর্বে এর চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য নির্মিত হয়নি।[7][8]
চন্দ্রগুপ্ত ও তার প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে চন্দ্রগুপ্ত একটী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি শক্রিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।[9] মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তের মৌর্যের বিশাল সেনাবাহিনীতে ৪ লক্ষ সৈন্য ছিল।[nb 2]
বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি হইতে চন্দ্রগুপ্তের প্রথম জীবন সম্পর্কে অল্প কিছু ধারণা পাওয়া যায়। মোরীয় কুলের নেতা তাঁহার পিতা তাঁহার জন্মের পূর্বেই এক সংঘর্ষে প্রাণ হারান। তাঁহার নিঃসহায় মাতা পাটলিপুত্রে যান। সেখানে তাঁহার জন্ম হয়। প্রথমে একজন গোপালক ও পরে একজন শিকারী কর্তৃক প্রতিপালিত এই পিতৃ-মাতৃহীন বালক কৌটিল্য নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ চাণক্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চাণক্য তাঁহাকে তাঁহার নিজের শহর তক্ষশিলায় লইয়া যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন কলা ও বিজ্ঞানে সুশিক্ষা লাভ করেন ও ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন। চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ ও কৈশোর সম্বন্ধে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধ্রুপদী সংস্কৃত, গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক রচনা থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।[2] চন্দ্রগুপ্তের জীবনকালের ৭০০ বছর পরে রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষসে তাকে নন্দন্বয় বা নন্দের বংশধর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নন্দরাজ্যের রাণীর এক দাসী ছিল, যার নাম মুরা। একদা নন্দরাজ দাসী মুরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করে তার গর্ভসঞ্চার করেন। লোকলজ্জার ভয়ে নন্দরাজ মুরা ও তার সন্তানকে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষিপ্ত চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের সহায়তায় নন্দবংশ উৎখাত করে মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশে চন্দ্রগুপ্তকে মোরিয় নামক একটি ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপরিনিব্বাণ সুত্ত অনুসারে, মোরিয়রা উত্তর ভারতের পিপ্পলিবনের ক্ষত্রিয় গোষ্ঠী ছিলেন। মহাবংশটীকা অনুসারে, তাকে শাক্য ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে।[11][12]
চাণক্য নামক তক্ষশিলার এক কূটনৈতিক ব্রাহ্মণের নিকট শিক্ষালাভ করেন ও দুইজনে মিলে নন্দ সম্রাট ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে ও জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্টপার্বণ গ্রন্থে হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের রাজা পর্বতেশ্বর বা পর্বতকের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের মিত্রতার কথা উল্লিখিত রয়েছে। এই রাজা এবং পুরুষোত্তম একই ব্যক্তি বলে অনেক ঐতিহাসিক মত দিয়েছেন।
প্লুতার্কের বর্ণনানুসারে, বিতস্তা নদীর যুদ্ধের সময়, নন্দ সাম্রাজ্যের ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী এবং ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী ছিল। এই বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর কথা শুনে মহান আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ভারতে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।[nb 3]
চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তার সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন।[1]
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে চন্দ্রগুপ্ত তার সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ম্যাসিডনীয় সত্রপ রাজ্যগুলির দিকে নজর দেন। তিনি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু নদ উপত্যকা অঞ্চলের শাসক ইউদেমোস ও পাইথনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন বলে মনে করা হয়। রোমান ঐতিহাসিক মার্কাস জুনিয়ানিয়াস জাস্টিনাস তার বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ম্যাসিডনীয় সত্রপগুলি অধিকার করার ঘটনা উল্লেখ করেছেন।[nb 4]
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ব্যাক্ট্রিয়া ও সিন্ধু নদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশ সেনাপতি প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরের অধিকারে আসে। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষের সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর তাকে আরাখোশিয়া, গেদ্রোসিয়া ও পারোপামিসাদাই ইত্যাদি সিন্ধু নদের পশ্চিমদিকের বিশাল অঞ্চল[15][16] অঞ্চল সমর্পণ করতে[17] এবং নিজ কন্যাকে তার সাথে বিবাহ দিতে বাধ্য হন।[nb 5] চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পর প্রথম সেলেউকোস নিকাতোর পশ্চিমদিকে প্রথম আন্তিগোনোস মোনোফথালমোসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।[nb 6] চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সেলেউকোস নিকাতোরকে ৫০০টি যুদ্ধ-হস্তী দিয়ে সহায়তা করেন।[17][19][20], যা ইপসাসের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে জয়লাভে সহায়তা করে।
প্লুটার্ক বলিয়াছেন যে অ্যান্ড্রাকোটা (Androcottus) (অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্ত) সেলুকাসকে (Seleucus) ৫০০টি হস্তী উপহার দেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে তাঁহার সেনাপতিদের মধ্যে ক্ষমতার সংঘর্ষের সময়ে সেলুকাস্ ব্যাবিলনের শাসক হন। তাহার পর ভারতবর্ষে তাঁহার প্রভুর রাজ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে তিনি সিন্ধু নদ অতিক্রম করেন। এইখানে তাঁহার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে দেখা দেন চন্দ্রগুপ্ত। 'নিকাটোর' (Nikator) অর্থাৎ বিজয়ী আখ্যায় গ্রীকদের কাছে পরিচিত সেলুকাস্ক তিনটি প্রদেশ (Satrapy) ছাড়িয়া দিয়া সন্ধি করিতে হয়। এইগুলি ছিল আরাকোসিয়া (Arachosia, অর্থাৎ কান্দাহার), পারোপমিসদাঈ (Paropamisadae, অর্থাৎ কাবুল), গান্ধার, এরিয়ার (Aria, অর্থাৎ হিরাট) কিছু অংশ এবং গেড্রোসিয়া (Gedrosia, অর্থাৎ বেলুচিস্তান)। এইভাবে চন্দ্র- গুপ্তের সাম্রাজ্য ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সম্ভবতঃ বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবেই মৌর্য শাসক গ্রীক প্রতিবেশীকে ৫০০ হস্তী উপহার দেন। বন্ধুত্বের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ছিল দুই শাসক পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন: সেলুকাস্ চন্দ্রগুপ্তের শ্বশুর বা জামাতা হন।
মৌর্য বংশ এবং সেলুকাসের বংশের মধ্যে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব তিন প্রজন্ম স্থায়ী হয়। সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় মেগাস্থিনিস (Megasthenes) নামে এক দূতকে পাঠান। বিন্দুসারের শাসনকালে মৌর্য রাজসভায় দূত পাঠান সিরিয়া ও মিশরের গ্রীক রাজারা। অশোকের 'ধম্মবিজয়ে'র পরিধি সিরিয়া, মিশর, সাইরীন (Cyrene), এবং এপিরাস (Epirus) অথবা করিন্থ (Corinth)- এই সকল গ্রীক শাসিত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
এরপর চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তিনি বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্য মালভূমির সিংহভাগ দখল করতে সক্ষম হন। এর ফলে কলিঙ্গ ও দাক্ষিণাত্যের অল্পকিছু অংশ বাদে সমগ্র ভারত মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়।[1] সঙ্গম সাহিত্যের বিখ্যাত তামিল কবি মমুলনার মৌর্য সেনাবাহিনী দ্বারা দাক্ষিণাত্য আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।[21]
জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর নিকট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন ও পরবর্তীকালে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করে জৈন ধর্ম গ্রহণ করে তার সাথে দাক্ষিণাত্য যাত্রা করেন। জৈন প্রবাদানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত শ্রবণবেলগোলায় জৈন আচার সল্লেখনা বা স্বেচ্ছা-উপবাস করে দেহত্যাগ করেন।[22]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.