Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আচার্য হেমচন্দ্র ছিলেন একজন জৈন পণ্ডিত ও কবি। তিনি ব্যাকরণ, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান ও সমসাময়িক ইতিহাসের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। জীবদ্দশায় তিনি একজন মহাপণ্ডিতের স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। তাকে ‘কলিকালসর্বজ্ঞ’ (কলিযুগের সব কিছু জানেন যিনি) উপাধি অর্জন করেছিলেন।
আচার্য হেমচন্দ্র | |
---|---|
প্রাতিষ্ঠানিক নাম | আচার্য হেমচন্দ্র সুরি |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | চঙ্গদেব ১০৮৮ (টীকা দেখুন) ধন্ধুকা |
মৃত্যু | ১১৭৩ (টীকা দেখুন) আহ্নিলওয়াড় পাটণ |
ধর্ম | জৈনধর্ম |
পিতামাতা | চাচিঙ্গা, পাহিনি |
সম্প্রদায় | শ্বেতাম্বর |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
দীক্ষা | সোমচন্দ্র টীকা দেখুন খম্ভাত দেবচন্দ্রসুরি কর্তৃক |
অধুনা ভারতের গুজরাত রাজ্যের ধন্ধুকা অঞ্চলে এক কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে হেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন সূত্রে তার ভিন্ন ভিন্ন জন্মসন উল্লিখিত হয়েছে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে তিনি ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[note 1][1] তার পিতা চাচিঙ্গা ছিলেন একজন মোধ বানিয়া বৈষ্ণব এবং মাতা পাহিনী ছিলেন একজন জৈন।[2][3] হেমচন্দ্রের নামকরণ করা হয়েছিল চঙ্গদেব। তার বাল্যকালে জৈন সন্ন্যাসী দেবচন্দ্রসুরি ধন্ধুকে এসেছিলেন। তিনি হেমচন্দ্রের বুদ্ধিমত্তা দেখে খুশি হন। তিনি হেমচন্দ্রকে শিষ্য করতে চেয়েছিলেন। হেমচন্দ্রের মা ও মামা তাতে রাজি হলেও, তার বাবা তাতে রাজি ছিলেন না। তবুও দেবচন্দ্রসুরি হেমচন্দ্রকে নিয়ে খম্ভাতে আসেন এবং সেখানে মাঘ শুক্লা চতুর্থী তিথিতে হেমচন্দ্রকে সন্ন্যাস দীক্ষা দেন। হেমচন্দ্রের সন্ন্যাস নাম হয় সোমচন্দ্র। খম্ভাতের শাসক উদয় মেহতা বা উদয়ন দেবচন্দ্রসুরিকে এই অনুষ্ঠানে সাহায্য করেন।[2][3] তিনি ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র ও ব্যাকরণ শিক্ষা করেন এবং জৈন ও অন্যান্য ধর্মের ধর্মশাস্ত্রগুলিতে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি অধুনা রাজস্থান রাজ্যের নাগাউরে জৈনদের শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের আচার্য পদ লাভ করেন এবং তার নামকরণ করা হয় আচার্য হেমচন্দ্র সুরি।[2][3][4]
সেই সময় আহ্নিলওয়াড় পাটণ থেকে গুজরাত শাসন করতেন সোলাঙ্কি রাজবংশের রাজারা। হেমচন্দ্র ঠিক কবে প্রথম আহ্নিলওয়াড় পাটণে এসেছিলেন, তা জানা যায় না। জৈন সন্ন্যাসীরা বছরে আট মাস পরিব্রাজকের জীবন যাপন করেন এবং বর্ষাকালের চার মাস চতুর্মাস উপলক্ষ্যে এক জায়গায় বাস করেন। হেমচন্দ্রও চতুর্মাস উপলক্ষ্যেই আহ্নিলওয়াড় পাটনে অবস্থান করেছিলেন এবং সেখানেই তার অধিকাংশ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[2][3]
সম্ভবত ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তার সঙ্গে সিদ্ধরাজ জয়সিংহের (সম্ভাব্য জীবৎকাল ১০৯২-১১৪১ খ্রিষ্টাব্দ) পরিচয় ঘটে। এরপরই সোলাঙ্কি রাজসভায় তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ১১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন সিদ্ধরাজ মালব জয় করেন, তখন ধর থেকে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি ভোজের রচনাবলিও নিয়ে আসেন। একদিন সিদ্ধরাজ সরস্বতী-কণ্ঠাভরণ (যেটি লক্ষণ প্রকাশ নামেও পরিচিত) নামে সংস্কৃত ব্যাকরণ সংক্রান্ত একটি সন্দর্ভ আবিষ্কার করেন। এই গ্রন্থটি পাঠ করে তিনি এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি রাজসভার পণ্ডিতদের একটি সহজ ও সরল ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনার অনুরোধ জানান। হেমচন্দ্র সিদ্ধরাজকে কাশ্মীর থেকে আটটি শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণ সন্দর্ভ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেন। সেগুলি অধ্যয়ন করে তিনি পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের আদলে একটি নতুন ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন।[2][3] তিনি নিজের ও রাজার নামানুসারে এই গ্রন্থটির নামকরণ করেন সিদ্ধ-হেম-শব্দানুশাসন। গ্রন্থটি পাঠ করে সিদ্ধরাজ এতটাই খুশি হন যে, তিনি আদেশ দেন, গ্রন্থটি হাতির পিঠে চড়িয়ে যেন আহ্নিলওয়াড় পাটণের রাস্তায় পরিক্রমা করানো হয়।[5] হেমচন্দ্র এই ব্যাকরণ গ্রন্থটির উদাহরণ বর্ণনার জন্য সোলাঙ্কি রাজবংশের ইতিহাস একটি মহাকাব্যের আকারে রচনা করেন। এই গ্রন্থটির নাম হল দ্ব্যশরায় কাব্য।[3]
প্রভাচন্দ্র অনুসারে, সিদ্ধরাজ একবার তার ভ্রাতুষ্পুত্র কুমারপালকে হত্যা করতে যান। কারণ, জ্যোতিষীরা তাকে জানিয়েছিল, কুমারপালের হাতেই তার রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। হেমচন্দ্র পাণ্ডুলিপির একটি স্তুপের মধ্যে কুমারপালকে লুকিয়ে রেখে তাকে রক্ষা করেন।[2] যদিও এই ধরনের ঘটনার উল্লেখ ভারতীয় লোকসাহিত্যে প্রায়শই দেখা যায়। এই ঘটনাটির ঐতিহাসিকতা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাছা বিভিন্ন সূত্রে সিদ্ধরাজের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন দেখানো হয়েছে।[2]
হেমচন্দ্র কুমারপালের (১১৪৩-১১৭৩) উপদেষ্টা হয়েছিলেন।[2][3] কুমারপালের রাজত্বকালে গুজরাত সংস্কৃতির একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। জৈন অনেকান্তবাদ দর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়ে হেমচন্দ্র নিজের উদারমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তা দেখে কুমারপাল অভিভূত হয়েছিলেন।[4] কুমারপাল ছিলেন শৈব। তিনি সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। কিছু লোক হেমচন্দ্রের সম্মান বৃদ্ধিতে ঈর্শান্বিত হয়ে কুমারপালের কাছে অভিযোগ জানান যে, হেমচন্দ্র অত্যন্ত অহংকারী লোক। তিনি হিন্দু দেবদেবীদের সম্মান করেন না। এমনকি শিবকেও প্রণাম করেন না। কুমারপাল যখন মন্দির উদ্বোধন করেন, তখন সেই অনুষ্ঠানে হেমচন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হেমচন্দ্র নিজেই শিবলিঙ্গকে প্রণাম করে বলেন:
যিনিই জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের কারণ আসক্তি ও ঘৃণার মতো অন্ধতাকে ধ্বংস করেন, আমি তাঁকেই প্রণাম করি; তা সে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব বা জিন যেই হোন না কেন।[4]
শেষ পর্যন্ত রাজা হেমচন্দ্রের অনুগত ভক্তে পরিণত হন এবং জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন।[2][4]
১১২১ সাল থেকে হেমচন্দ্র নিজেকে তরঙ্গে একটি জৈন মন্দির নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করেন। কুমারপালকে প্রভাবিত করে তিনি জৈনধর্মকে গুজরাতের সরকারি ধর্মে পরিণত করান এবং রাজ্যে পশুহত্যা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করান। এর ফলে ধর্মের নামে পশুবলি গুজরাত থেকে সম্পূর্ণ উঠে যায়। এরই ফলশ্রুতিতে হেমচন্দ্রের ৯০০ বছর পরেও গুজরাতে দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল থাকা সত্ত্বেও গুজরাতবাসী মূলত দুগ্ধজাত নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করেন।[2][3]
হেমচন্দ্র তার মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী ছয় মাস আগে থেকেই করেছিলেন। শেষ দিনগুলিতে তিনি উপবাস করতেন। এই জৈন প্রথাটির নাম সল্লেখনা। আহ্নিলওয়াড় পাটনেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সাল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, তিনি ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াত হন।[1]
হেমচন্দ্র ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী লেখক। তিনি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ব্যাকরণ, কাব্য, ভাষাবিজ্ঞান, অভিধান, বিজ্ঞান ও ন্যায় সংক্রান্ত গ্রন্থ এবং ভারতীয় দর্শনের প্রায় সকল শাখার উপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এই সংস্কৃত ব্যাকরণটি পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থের আদলে লিখিত। এতে ছয়টি অধ্যায় রয়েছে। প্রত্যেকটি অধ্যায় ভোজের ব্যাকরণের আদলে চারটি ভাগে বিভক্ত। সিদ্ধ-হেম-শব্দানুশাসন গ্রন্থে ছটি প্রাকৃত ভাষাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলি হল: প্রামাণ্য প্রাকৃত (প্রকৃতপক্ষে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত), শৌরসেনী, মাগধী, পৈশাচী, অন্যক্ষেত্রে অনুল্লিখিত চুলিকাপৈশাচী ও অপভ্রংশ (প্রকৃতপক্ষে গুর্জর অপভ্রংশ, যেটি সেই সময় গুজরাত ও রাজস্থান অঞ্চলে প্রচলিত ছিল এবং যেটি থেকে গুজরাতি ভাষার উৎপত্তি ঘটে)। তিনি অপভ্রংশের বিস্তারিত ব্যাকরণ রচনা করেন এবং সেটি ভালোভাবে বোধগম্য করে তোলার জন্য লোকসাহিত্য থেকে প্রচুর উদাহরণ দেন। এটিই একমাত্র অপভ্রংশ ব্যাকরণ, যার কথা জানা যায়।[3]
ব্যাকরণ ব্যাখ্যার জন্য তিনি দ্ব্যশরায় কাব্য নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। এটি সোলাঙ্কি রাজবংশের ইতিহাস। এই গ্রন্থটি সমসাময়িক যুগের গুজরাত অঞ্চলের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রও বটে।[3]
ত্রিষষ্টি-শলাকা-পুরুষ-চরিত্র বা চৌষট্টি মহৎ ব্যক্তির জীবনী হল চব্বিশজন তীর্থঙ্কর এবং শলাকাপুরুষ নামে পরিচিত জৈন দর্শনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাতাদের একটি জীবনীমূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তাদের সন্ন্যাস এবং জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভের ইতিবৃত্তের সঙ্গে সঙ্গে জৈন প্রভাবের কিংবদন্তিমূলক প্রসারের কথাও জানা যায়। এই গ্রন্থটি এখনও জৈনধর্মের আদি ইতিহাস সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্য তথ্যসূত্র।[3] এই গ্রন্থের ‘পরিশিষ্টপর্ব’ বা ‘স্থবিরাবলীচরিত’ নামে পরিচিত নির্ঘণ্ট অংশটি তার নিজের ব্যাখ্যা। এই নির্ঘণ্টটি যথেষ্ট গভীরতাসম্পন্ন একটি সন্দর্ভও বটে।[3] ত্রিষষ্টি-শলাকা-পুরুষ-চরিত্র গ্রন্থটি দ্য লাইভস অফ দ্য জৈন এল্ডার্স নামে ইংরেজি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে।[6]
কাব্যানুপ্রকাশ গ্রন্থটি কাশ্মীরি অলংকারবিদ মন্মতের কাব্যপ্রকাশ গ্রন্থের আদলে রচিত। এই গ্রন্থে তিনি আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্ত প্রমুখ অন্যান্য পণ্ডিতদের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন।[3]
অভিধানচিন্তামণি (বা 'অভিধানচিন্তামণিনামমালা') হেমচন্দ্রের রচিত চারটি প্রসিদ্ধ অভিধান বা কোষের (এনসাইক্লোপিডিয়া) মধ্যে একটি। ৬ কাণ্ডের এই কোষের মধ্যে প্রথম কাণ্ড কেবল জৈন দেবদেবী ও জৈনমতের ধর্মীয় শব্দসমূহ নিয়ে সমৃদ্ধ। এটি ছাড়া অন্যান্য কাণ্ডগুলো হচ্ছে দেব, মর্ত্য, ভূমি বা তির্যক, নারক ও সামান্য। 'অভিধানচিন্তামণি' গ্রন্থে তার স্ববিরচিত "যশোবিজয়" নামে টীকা রয়েছে, এটা ছাড়াও 'ব্যুৎপত্তিরত্নাকর' (দেবসাগকরণি) এবং 'সারোদ্ধার' (বল্লভগণি) নামে প্রসিদ্ধ টীকা রয়েছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন ছন্দের ১৫৪২টি শ্লোক রয়েছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন অর্থবোধক শব্দগুলি নিয়ে তিনি অনেকার্থ কোষ নামে আরেকটি অভিধান রচনা করেন। দেশি-শব্দ-সংগ্রহো বা দেশি-নাম-মালা হল স্থানীয় বা অ-সংস্কৃত শব্দের একটি অভিধান। নিগন্থু সেস হল একটি উদ্ভিদবিজ্ঞান সংক্রান্ত অভিধান।[3]
হেমচন্দ্র তার পূর্বসূরি গোপালের অনুসরণে ফিবোনাচ্চি রাশিমালার একটি আদি পাঠ দিয়েছিলেন। ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দে ফিবোনাচ্চির (১২০২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রায় ৫০ বছর আগে এটি প্রকাশিত হয়।[7][8]
তার অন্যান্য রচনাগুলি হল ছন্দানুশাসন (ছন্দ),অলংকার চূড়ামণি (অলংকার শাস্ত্রের টীকা), যোগ-শাস্ত্র (যোগ সংক্রান্ত সন্দর্ভ),[2] প্রমাণ-মীমাংসা (ন্যায়শাস্ত্র) ও বীতরাগ-স্তোত্র (প্রার্থনা)।[3]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.