Loading AI tools
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলাদেশের মাটিতে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একাধিক ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিক, লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন।[1][2][3] এই আক্রমণের ঘটনাগুলির সম্ভাব্য কারণ হল সমসাময়িক বাংলাদেশে চলমান দ্বন্দ্ব। এর এক দিকে আছেন ধর্মনিরপেক্ষ জনসমাজ, যারা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য বজায় রাখতে চান, ও অন্যদিকে আছেন ইসলামবাদী জনসমাজ যারা বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান।[4][5][6] যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল-এর বিচারকাজগুলি, যেগুলিতে সাম্প্রতিক অতীতের বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে,[7][8][9][10] সেগুলিও এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি করেছে।[11][12]
প্রথমদিকে এইসব হত্যাকাণ্ড ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের উপর হলেও, ধীরে ধীরে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ অন্যান্য লক্ষবস্তুতে আক্রমণ করে। সমকামী অধিকারকর্মী[3], বাউল সাধক, শিক্ষক[13], হিন্দু পুরোহিত [14],বৌদ্ধ ভান্তে[15], প্রভৃতিরা চরমপন্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এছাড়াও ইসলামী সন্ত্রাসবাদীরা হামলার শিকার হয় মাজারের খাদেম,[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] শিয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি,[16] আহমদীয়া ইমাম,[17] এবং সুফি সাধকও[18]। শিয়া সম্প্রদায়ের মিছিলে [16][19] এবং ঈদের পরে দেশের বৃহত্তর জামাত হওয়া শোলাকিয়ার ময়দানেও তারা হামলা করে।[20] রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রথমদিকে এইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য খোদ হত্যার স্বীকার হওয়া ব্যক্তিদেরই দায়ী করলেও [21][22][23] পরবর্তীতে হলি আর্টিজানে বিশজন বিদেশী নাগরিকের মৃত্যুর [24] পর প্রশাসন কিছুটা সতর্ক হয়, এরপর জঙ্গীবিরোধী বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে আটক করে।[24]
বাংলাদেশ সরকার ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠীর দাবি অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদেরই গ্রেফতার শুরু করে।[25][26][27] একারণে বাংলদেশ সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।[28][29] ২০১৬ সালের ১৮ জুন থেকে, বাংলাদেশ পুলিশ কথিত জঙ্গি গ্রেফতারের অভিযান চালিয়ে একসপ্তাহের ভিতরে প্রায় এগারো হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা শুরু করে।[30] রাষ্ট্রের একাজটিও সমালোচনার মুখে পড়ে।[31]
এর কিছুদিন পরে ২০১৬ সালের ২ জুলাই, মোট ৪৮ জন লোক, যাদের মধ্যে ২০ জন অন্য দেশের নাগরিক ছিলেন, তারা এক জঙ্গি হামলায় নিহত হয়।
২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার, তৎকালীন ধর্মনিরপক্ষতাবাদী দল আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, এই ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ এ পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যম স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক তদন্ত শুরু করে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (তৎকালীন বিরোধী দলের সাথে জোটবদ্ধ একটা পার্টি) নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ট্রাইব্যুনাল দ্বারা যাবজ্জীবন জেল হয়, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ লেখক এবং ব্লগারদের একাংশ এই সাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তারাই পরবর্তীকালে একতাবদ্ধ হয়ে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গঠন করেন। এই মঞ্চ থেকেই সরকার যেন আইন সংশোধন করে আপিল করতে পারে, তার দাবী উঠে। আন্দোলনকারীরা এরপর ৭১ এ জামাতে ইসলামী নামক দল; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এর বিরুদ্ধে যে কার্যক্রম করেছে, তার জন্য সেই দলের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবী জানায়।[32]
শাহবাগের সংক্ষিপ্তকালীন অহিংস প্রতিবাদের পর, এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইসলামী দলগুলো সহিংস প্রতিবাদ শুরু করে। ইসলামী নেতারা ট্রাইব্যুনাল কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নেতাদের মুক্তি দেওয়ার দাবী জানায়,[32] তারা বিকল্প হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের নাস্তিক ঘোষণা করে, তাদের ফাসির দাবী জানায়। তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্ল্যাসফেমী আইন প্রণয়ন করতে সরকারের কাছে দাবী করে।[33][34] ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের মুখপাত্র ইমরান সরকার, এবিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, এ সহিংসতা প্রাথমিকভাবে ব্লগারদের উপর হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হলো, ব্লগারদের প্রভাব রাজনীতিতে সুষ্পষ্ট হচ্ছে, যা এই রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে প্রধান বাধা।[35]
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে একটি গ্রুপ নিজেদের ইসলামের হেফাজতকারী বলে ঘোষণা দিয়ে ৮৪ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ধর্মনিরপেক্ষবাদী ছিল। সেই ৮৪ জনের মধ্যে নয়জন ইতোমধ্যে খুন হয়ে গেছেন এবং অন্যরা নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।[36] আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বেশিরভাগ আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে[37][38][39][40] পুলিশের মতে এই আনসারুল্লাহর সদস্যদের সাথে আল-কায়েদা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গভীর সংযোগ আছে।[41] গোষ্ঠীটি সরকার দ্বারা বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত অবস্থায় আছে[42] অন্যান্য কিছু আক্রমণ অখ্যাত কিছু চরমপন্থী দলের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।
শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী আহমেদ রাজিব হায়দারের হত্যার পর সরকার প্রথমদিকে ব্লগারদের নিরাপত্তা দিলেও, ইসলাম কটূক্তির অভিযোগে সরকার বেশ কিছু সেকুলার ব্লগারকে গ্রেফতার করে এবং তাদের বেশকিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়।[43] ইমরান এইচ সরকারের মতে, "আসছে নির্বাচনে জয় পাওয়ার জন্য সরকার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিই বেছে নিয়েছে, স্বল্প সংখ্যক মোল্লার দাবী মানার মাধ্যমে সরকার নিজেকে ইসলামপন্থী হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে এবং নিজের ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে চাইছে।"[44]
সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তার মা ব্যক্তিগতভাবে অভিজিতের বাবাকে শোক জানিয়েছেন। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন যে এ বিষয়ে তার প্রকাশ্যে কথা বলার মতো অবস্থা নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কেউ নাস্তিক বলুক এটা আমরা চাই না। আমাদের মৌলিক যে বিশ্বাস তা পরিবর্তিত হবে না। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি।’ সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘আমাদের বিরোধীরা আমাদের বিরুদ্ধে সব সময় ধর্মের কার্ডটি খেলে। আমরা অভিজিতের হত্যার বিষয়ে প্রকাশ্যে শক্ত অবস্থান নিইনি, এটি কেবল একটি ধারণা, বাস্তবতা নয়।[45]
অধ্যাপক জাফর ইকবাল অভিজিৎ হত্যার পর আরেকজন ব্লগার অনন্ত হত্যার পর, জয়ের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে বলেন, “হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেইটমেন্ট দিয়েছেন, তা মৌলবাদীদের জন্য একটা গ্রিন সিগনাল। দেখে মনে হচ্ছে, তোমরা (জঙ্গিরা) এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও, সরকার কিছুই করবে না। একজন একজন করে মারা হবে, সরকার কোনো কথা বলবে না।” প্রশাসনের সমালোচনা করে এই শিক্ষক বলেন, “হত্যাকারীদের প্রশাসন ধরতে পারছে না, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা সরকারের ব্যর্থতা।” প্রধানমন্ত্রীর ছেলে যা বলেছেন, তা মানতে আমি রাজি না। আমি তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ জানাই। এদেশে প্রত্যেকটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাদেরকে মেরে ফেললে তা সেনসিটিভ ব্যাপার হয় না।" প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শিক্ষক জাফর ইকবাল বলেন, “তোমরা স্বীকার করে নাও সরকারের কাছ থেকে বিশেষ কিছু পাবা না। তোমরা যারা সত্যি কথা বল, তোমাদের যে কোনো সময় মেরে ফেলা হবে, আমাদের মেরে ফেলা হবে, সরকার কিছুই করবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে।”[46]
২০১৬ সালের ৭ জুন বাংলাদেশের বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অভিযোগ করে বলেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এই সব হত্যাকাণ্ডের সাথে সংযোগ আছে, এবং এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের একটা অংশ, যেখানে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত।[47][48] ইসরাইলের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র পরবর্তীকালে এ নিয়ে কথা বলেন, তিনি তার বিবৃতিতে এই অভিযোগ নাকচ করে দেন এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অভিযোগকে "utter drivel"(একেবারেই নির্বোধের মত কথা) বলে অভিহিত করেন[47]
মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানসহ দু’জন হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি জুলহাজ রূপবান নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর তিনি সমকামীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতেন। এটা আমাদের সমাজের সঙ্গে মানানসই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর আমিও আগেই বলেছি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে বা বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারো নেই। সবাইকে সংযত হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার অনুরোধ করছি।’[49]
নাজিমুদ্দিন সামাদের মৃত্যুর পর বিবিসি বাংলাকে মন্ত্রী বলেন, "ব্লগে আপত্তিজনক লেখা লিখেছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন আছে"। আপত্তিকর লেখা লিখলেই কি হত্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এই প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। "আমি সে কথা বলতে চাইনি...আগের যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে তাদের ব্লগ যদি দেখেন, এভাবে মানুষের ধর্মে আঘাত দেওয়া, বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া, পৃথিবীর কোনো দেশেই তা গ্রহণযোগ্য নয়"।[23]
বৌদ্ধ ভিক্ষু ধাম্মা ওয়াসা ওরফে উ গাইন্দ্যা হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ওই দিন দুপুরেই ঘটনাস্থলে না গিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বলেন, "এটি একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা'৷ এর সঙ্গে তাঁর (ভিক্ষু) আত্মীয়-স্বজন জড়িত রয়েছে বলে মনে করছি৷"[50] বান্দরবান রাজগুরু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মহাথের উচহ্লা ভান্তে বলেছেন, "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ত দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, নয়ত তাঁর মাথা খারাপ৷ নইলে তিনি এ কথা কেন বললেন যে স্বজনরা জড়িত? দেশের একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁর প্রতিটি কথা সারা বিশ্ব শোনে৷" [50]
সমালোচনার মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, "কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে৷ এর জবাবও দিয়েছেন অধ্যক্ষ মহাথের উচহ্লা ভান্তে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "আমরা চাই, মুখ ফসকেও যেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো কথা না বলেন৷ আমরা চাই তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ হবে লোহার মতো শক্ত৷ আর চাই প্রতিটি আইনি ব্যবস্থায় বিশ্ববাসী যেন বুঝতে পারে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শান্তিতে আছে৷" [50]
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় এর হত্যার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না৷ দিলে তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷[21]
নীলাদ্রি চট্টপাধ্যায় হত্যার পর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান জন্মাষ্টমীতে হিন্দুদের সাথে মত বিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা সহ্য করা হবে না। এদেশে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার কারও নেই। ধর্ম পালন করবেন না, করবেন না। কিন্তু অন্যের ধর্মে আঘাত দিতে পারবেন না। এটা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা সহ্য করা হবে না।[51]
সামাদ হত্যার পর, পহেলা বৈশাখে বঙ্গভবনে মত বিনিময় সভায় শেখ হাসিনা বলেন, "মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়।" তিনি আরো বলেছেন, "কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা কখনো গ্রহণযোগ্য না। আমার ধর্ম আমি পালন করি। আমার ধর্ম সম্পর্কে কেউ যদি নোংরা কথা লেখে, সেটা আমরা কেন বরদাশত করব? এখন একটা ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে, ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেই তারা হয়ে গেল মুক্তচিন্তার। আমি তো এখানে মুক্তচিন্তা দেখি না। আমি এখানে দেখি নোংরামি, পর্ন। এত নোংরা নোংরা লেখা কেন লিখবে? যাকে আমি নবী মানি, তাঁর সম্পর্কে নোংরা কথা কেউ যদি লেখে, সেটা কখনো আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের যাঁরা আছেন, তাঁদের সম্পর্কে কেউ যদি লেখে, এটাও কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এই সমস্ত নোংরা কথা, পর্নের কথা কেন লিখবে? আমি তো মনে করি, এটা সম্পূর্ণ নোংরা মনের পরিচয়, বিকৃত মনের পরিচয়। এটা কোনো ধর্ম পালন নয়। এটা সম্পূর্ণ তাদের চরিত্রের দোষ এবং তারা বিকৃত মানসিকতায় ভোগে। এ জন্য তারা এ ধরনের লেখে। আশা করি, এই ধরনের লেখা কেউ লিখবেন না। আমি একজন মুসলমান হিসেবে প্রতিনিয়ত আমার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেখানে কেউ যদি লেখে, এতে আমার নিজেরও কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য কোনো অঘটন ঘটলে দোষ সরকারের ওপর আসবে কেন? সবাইকে সংযমতা নিয়ে চলতে হবে। সবাইকে একটা শালীনতা বজায় রেখে চলতে হবে। অসভ্যতা কেউ করবেন না। অসভ্যতা করলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আমরা নেব না।’ [22]
হত্যার শিকার হওয়া এসব লেখকদের উপর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী এরপরে সমান্তরালে বলেন, ‘আর মানুষ খুন করার মধ্যে কোনো সমাধান নাই। একজন লিখল, আরেকজন খুন করে সেটার প্রতিশোধ নেবে, এটা তো ইসলাম ধর্ম বলেনি। বিচারের দায়িত্ব আল্লাহ তাদের দেননি। একজন লিখল তাকে খুন করে ফেলতে হবে। এ বিচার তো আল্লাহ তাকে দেননি। এ বিচার আল্লাহ করবেন। আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন, তিনি শেষ বিচার করবেন। তো, আল্লাহর ওপর কি তাদের ভরসা নাই? আল্লাহর ওপর যাদের ভরসা নেই, তারাই এসব খুন-খারাবি করে। কারণ তারা আল্লাহ-রাসুল মানে না।[22]
প্রকাশক হত্যার পর, নেদারল্যাণ্ডস সফর থেকে আসা প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার ধর্ম নিয়ে কেউ যদি বিকৃত লেখা লেখে। নোংরামী করে, নোংরামী লেখা লেখে। সেটা আমার সেন্টিমেন্টে লাগবে। আমি একটা ধর্মে বিশ্বাস করি, আমি আল্লাহ নবী করিম (স.)কে মানি। হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বললে তাদের লাগবে। খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে বললে তাদের লাগবে।"[52]
লেখালেখির ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিধি-নিষেধ না থাকার কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, “লেখালেখি বন্ধ করতে বলা হয়নি, লেখালেখিতে সতর্ক করা হয়নি। লেখালেখিতে সতর্ক হওয়া আর কিছুই না, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে যেন লেখালেখি হয়। তিনি আরো বলেন, "বিকৃত করে লেখা কোনো মানবিক গুণ না। সেটা বিকৃত। মনে হচ্ছে যেন, বিকৃত লালসা চরিতার্থ...। সেগুলো বন্ধ করতে হবে। লিখতে বন্ধ করতে বলা হয়নি।" [52]
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় এর হত্যার পরে রবিবার, পুলিশের আইজি বলেন, ‘‘ব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না৷ লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না৷ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ-ও মনে করিয়ে দেন যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে ১৪ বছরের শাস্তির বিধান আছে বাংলাদেশে৷ [21]
পুলিশ সুপার ইমামদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, 'ধর্ম নিয়ে যে কটূক্তি করবে তার শাস্তি নিশ্চিত। কেননা যার যার ধর্ম তার তার কাছে পবিত্র। সুতরাং কারো ধর্মকে কেউ খাটো করে দেখবো না।' [53]
কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও), যেমনঃ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টাস উইথআউট বর্ডাস, পেন ইন্টারন্যাশনাল, পেন কানাডা, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট; রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিককে রক্ষা করতে না পারার জন্য এবং আক্রমণ গুলোর বিরুদ্ধে যথাযথভাবে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়, তীব্র সমালোচনা করে,[54] তাদের মতে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এবং মুক্তচিন্তার পরিস্থিতি ক্রমশ বিপদসংকুল হয়ে উঠছে।[55][56][57][58]
সালমান রুশদি, মার্গারেট এটউড এবং ইয়ান মার্টেল সহ ১৫০ জন গ্রন্থাকার ২০১৫ সালের ২২ শে মে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় পিটিশন করেন, তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবী জানান ব্লগারদের উপর যেভাবে মৃত্যু নেমে আসছে, সেটা অতিসত্ত্বর বন্ধ করতে হবে, এই অধ্যায়ের যবনিকা যে কোনো উপায়ে টানতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে তারা বলেন, " যা ইচ্ছা করেন, কিন্তু যেভাবে হোক এটা নিশ্চিত করেন, বিগত তিনমাসে যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে তার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয়, এবং সেইসব হত্যাকারীর যেন ন্যায্য বিচার হয়।"[59]
মানবাধিকার সংস্থার যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসাইন ২০১৬ সালের ১৩ জুন উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বলেন, "আমি বাংলাদেশে নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোকে দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, মুক্তচিন্তার মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং এলজিবিটি কর্মীরা।"[60]
২০১৬ সালের ১৪ই জুন প্রায় এক লক্ষ বাংলাদেশী মুসলিম ইমাম, ধর্মীয় গবেষক ফতোয়া দেন যে, "অমুসলিম, সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের হত্যা করা, ইসলামে নিষেধ"।[61]
২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি স্বঘোষিত কট্টরপন্থী নাস্তিক আসিফ মহিউদ্দীন,[62] ঢাকার মতিঝিলে তার অফিসে ছুরিকাঘাতে আহত হন। তিনি অবশ্য সে যাত্রায় বেচে যান।[62] মহিউদ্দীন, অনলাইনের কার্যক্রমের জন্য ববস পুরস্কার বিজয়ী হন, তিনি চরমপন্থীদের করা হিট লিস্টের শীর্ষে ছিলেন।[63] চরমপন্থী ইসলামি গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এর দায় স্বীকার করে, মহিউদ্দীনের মতে, যারা তার উপর আক্রমণ চালিয়েছে, তিনি তাদের সাথে পরে দেখা করেছেন, এবং তারা তাকে বলেছে, "তুমি ইসলাম ত্যাগ করেছ, তুমি মুসলিম নও তুমি কোরানের সমালোচনা করো, আমাদের এটা করতেই হত"।[64] রিপোর্টাস উইথ আউট বর্ডারস (দেশে দেশে মুক্তচিন্তার মানুষদের রক্ষা করতে গঠিত সংগঠন) এবিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, মহিউদ্দীন এবং অন্য যারা ধর্মীয় চরমপন্থার বিরোধিতা করেন, তারা একেবারে পরিষ্কারভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আছেন।[63]
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নাস্তিক ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার খুন হন। তিনি সেই সময় ঢাকার সন্নিকটে মিরপুরে তার বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন। তার মৃতদেহ যখন পাওয়া যায়, তখন তা দেখে মনে হচ্ছিল সেটা রক্তের বন্যার উপর শায়িত হয়ে রয়েছে।[65] তার ছিন্নভিন্ন দেহকে তার বন্ধুরা প্রথমে চিনতেই পারেনি।[66] এর পরের দিন, তার কফিন শাহাবাগ চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে লক্ষাধিক লোক তার মৃতদেহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।[67]
হায়দার শাহবাগ আন্দোলনের একজন আয়োজক ছিলেন। তিনি এবং সেই আন্দোলনের সাথে জড়িত অন্যরা যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড এবং[65] বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র ফ্রন্ট ইসলামী ছাত্র শিবিরের নিষিদ্ধতা চেয়েছিলেন "[68] হায়দার এর ফ্যামিলীর মতে, হায়দার তার ব্লগে যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচারের জন্য সোচ্চার ছিলেন,[68] এবং বলিষ্ঠ কন্ঠে বাংলাদেশ জাম্যাতে ইসলামি পার্টির সমালোচনা করতেন।[67] শাহাবাগ আন্দোলনের মানুষরা তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ বলে আখ্যা দেয়।".[68]
২০১৩ সালের ৭ মার্চ রাতে সানিউর রহমান আক্রমণের স্বীকার হন, ঢাকার মিরপুরে পুরবী সিনেমা হলের সামনে আনুমানিক নয়টার দিকে যখন তিনি হাটছিলেন, দুইজন মানুষ চাপাতি হাতে তাকে আকষ্মিক আক্রমণ করেন, স্থানীয় সহকারী পুলিশের সাথে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তার ঘাড়ে, ডান পায়ে, বাম হাতে, মাথায় চোট নিয়ে যান।[69] সানিউর শাহবাগ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন যেমন: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করতেন।[70]
২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিউল ইসলাম, রাজশাহী শহরে তার বাড়ি যাওয়ার পথে, কিছু তরুণের দ্বারা ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে গুরুতর আহত হন। তিনি বাউল মতবাদেরঅনুসারী ছিলেন।[71] তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর, তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চরমপন্থী মুসলিম গ্রুপ 'আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২' এর দায় স্বীকার করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়েবসাইটে তারা ঘোষণা দেয় যে, "আমাদের মুজাহিদীনরা (যোদ্ধা) আজ এক মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগকারী) কে তার প্রাপ্য সাজা দিয়েছে। এই মুরতাদ নারী শিক্ষার্থীদের তার বিভাগে 'বোরকা' পড়তে নিষেধ করত।"[40] সেই ওয়েবসাইটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দ্বারা পরিচালিত একটি পত্রিকার সূত্র ধরে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করে যে, "অধ্যাপক শফিউল ইসলাম, বিভাগীয় প্রধান হবার পর তার শিক্ষকদের নির্দেশনা দেন যে, যাতে তারা ক্লিন শেভ থাকেন এবং কুর্তা পায়জামা পরিধান না করেন। তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরিধান করায় নিষেধাজ্ঞা থাকায়, তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বোরকা ত্যাগ করেন।[40]
শফিউল ইসলামের একজন কলিগের সুত্রানুসারে, অধ্যাপক ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু নারীদের; বোরকার ন্যায় সম্পূর্ণ মুখ আচ্ছাদনকারী পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, পরীক্ষার সময় বোরখার সুবিধা নিয়ে তারা নকল করতে পারে।[13]
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রকৌশলী এবং বিখ্যাত বাংলাদেশী ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ ঢাকাতে দুর্বৃত্তদের দ্বারা চাপাতি হাতে হামলার স্বীকার হন।[43][72] অভিজিৎ এবং তার স্ত্রী আনুমানিক রাত ৮:৩০ এর দিকে রিকশা করে একুশে বই মেলা থেকে আসছিলেন।[43] তারা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তন এর কাছে আসেন, তখনি দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হন।
২০১৫ সালের ৩০ মার্চ আরেকজন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, ঢাকার তেজগাঁওতে অভিজিৎ রায়ের মত খুন হন। পুলিশ দুইজন সন্দেহভাজনকে গ্রেতার করেন, এবং তাদের কাছ থেকে মাংস কাটার ছুরি উদ্ধার করেন। সন্দেহভাজনরা বলেন, "রহমানকে তারা খুন করেছে কারণ ওয়াশিকুর ইসলামবিরোধী শ্লেষাত্মক লেখা লিখতেন।".[73] সন্দেহভাজনরা পুলিশকে এটা নিশ্চিত করেছে যে, তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য এবং তারা নিলয়কে খুন করার আগে পনেরদিন ধরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছেন, কীভাবে খুন করতে হয়।[74]
ইমরান সরকার সাংবাদিকদের বলেন, "অভিজিৎ এর মত ওয়াশিকুর আলোচিত ব্লগার ছিলেন না... কিন্তু তার মুক্তচিন্তা এবং প্রগতিশীলতার কারণেই তিনি খুন হন। তারা এমন মানুষদের লক্ষ্য করে তাদের কাজ চালাচ্ছে, যাদের কাছে সহজে পৌঁছানো যায়, যাদেরকে সুযোগ পাওয়া মাত্রই আক্রমণ করা সহজ হয়। ধর্মীয় মৌলবাদীদের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্লগারদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করা।"[35] ইমরান সরকারের বক্তব্যানুযায়ী, ওয়াশিকুর এর হত্যা সেই অপরাজনীতিরই অংশ যার মুল এজেন্ডা, রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইসলামকে প্রবেশ করানো, বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই..... একারণে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগাররাই প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং যখন মুলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করার কথা, তারাও ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদের সাথে আপোস করেছে, যা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং প্রশাসনও ব্লগারদের নিরাপত্তা দিতে যা করণীয় তা করতে অসমর্থ।".[35]
সাংবাদিক রক্ষা কমিটির একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে যে, ওয়াশিকুরের মৃত্যু বর্তমান বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পরিস্থিতি কতটা নির্যাতনের মুখে তাই প্রমাণ করে।[75]
অনন্ত বিজয় দাশ নাস্তিক ব্লগার ছিলেন,[36] ছিলেন চরমপন্থী দের করা তালিকার মধ্যেও। ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটে চারজন মুখোশধারীরহামলায় তিনি নিহত হন।[36] অনন্ত মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন, তিনি তিনটি বই লিখেছিলেন, যার একটি ছিল বিজ্ঞানের উপর, একটি বিবর্তনের উপর এবং অপর একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবের উপর। তিনি সিলেটের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান ছিলেন।[76][77] তিনি যুক্তি নামক একটা সাময়িকের সম্পাদক ছিলেন।[77]
অনন্ত বিজয় পূর্ব সতর্কতা হিসেবে সুইডিশ পেনের (মানবাধিকার সংগঠন) দ্বারা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু সুইডিশ সরকার তাকে ভিসা দেয় নি, কারণ তাদের মনে হয়েছিল, তিনি একবার সেখানে গেলে আর ফিরবেন না।[78]
আইনজীবী সারা হোসেন অভিজিৎ এবং অনন্ত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, "তারা মুক্তচিন্তার উপর বিশ্বাসী ছিলেন, মুক্তচিন্তাকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবার জন্য লিখতেন। তারা সুষ্পষ্টভাবেকোনো ধর্ম কেন অনুসরণ করেন না, বা করা উচিত নয়, তা নিয়ে লিখতেন।"[79] মানবাধিকার সংগঠনের এশিয়ান ডিরেক্টর ব্রাড এডামস অনন্তের হত্যা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, "এই সমস্ত কাপুরুষিত হত্যাকাণ্ডগুলো শুধুমাত্র আক্রান্তকে নীরব করছে না, বরং সেইসব মানুষ যারা ধর্মীয় ব্যাপারে স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে, তাদেরকেও এক ভয়ানক বার্তা দিচ্ছে।" [80]
গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়: "রাফি বাদাউ, যাকে সৌদি আরবে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে, বেত্রাঘাত করা হয়েছে, ঠিক তার মতই সাহসী অনন্তকে হতে হয়েছে খুনের স্বীকার , যার কোনো দোষতো ছিলই না, বরং চারিত্রিক সততা এবং সত্য বলার সাহস ছিল। এটা সেই গুণ যার সামনে ধর্মীয় মৌলবাদী, ধর্মান্ধরা দাড়াতে পারে না। "[78] সম্পাদকীয়টি শেষ হয়েছে এই বলে যে, " চরমপন্থি জিহাদীরা ৮০ জন মুক্তমনা লেখকের তালিকা করেছে, যাদেরকে তারা মারতে চায়। এইভাবে জনসম্মুখে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা চরমমানের নৃশংসতারই একটি সংজ্ঞা। প্রশাসনের অবশ্যই আরো কিছু করতে হবে, যাতে করে মুক্তচিন্তার মানুষদের রক্ষা করা যায়। "[78]
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়,[81] নীলয় চ্যাটার্জি নামে পরিচিত[82] এবং তিনি লেখালেখির সময় নিলয় নীল নামটি ব্যবহার করতেন। নীলয় ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ছয়জন মানুষ চাপাতি হাতে তার উপর বাসায় হামলা চালায়। ঢাকা সংলগ্ন গোরানে তার বাসা ছিল এবংসেখানে তার মৃত্যু হয়।[83] পুলিশের ভাষ্য মতে আততায়ীরা তার স্ত্রকে ধোকা দিয়ে বাসায় ঢকে।[81] এবং তারপর হত্যা করে। নিলয় হত্যার কয়েকদিন আগে পুলিশের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন কিন্তু পুলিশ কোনো ধরনর ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি।[84] তিনি বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদীসমিতির সম্পাদক ছিলেন এবং ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করেন।[85] নিলয়; বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার লেখকদের ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন।[83] তিনি সংযুক্ত ছিলন শাহবাগ আন্দোলনের সাথে।[86] তিনি অনন্ত বিজয় দাশ এবং অভিজিৎ রায় হত্যার পর তাদের বিচর চেয়ে আন্দোলন করেছিলেন।[87][88]আল কায়েদার শাখা আনসার-আল-ইসলাম বাংলাদেশ,[83] নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করে।[89]
যুক্তরাজ্য তাৎক্ষণিক ভাবে এই হত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করে এবং এই হত্যার পিছনে যারা জড়িত; তাদের গ্রেফতারের দাবী জানায়।[90] অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, তারা বিবৃতি দেয়, প্রশাসনের এই মুহুর্তে দায়িত্ব হচ্ছে, এটাই নিশ্চিত করা যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর না ঘটে।[91] জার্মান সরকার,[92] বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,[93] হিউম্যান রাইটস ওয়াচ,[94] বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, গণজাগরণ মঞ্চ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।[95]
লেখিকা তসলিমা নাসরিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, "শেখহাসিনার সরকার নৈতিকভাবে দোষী। তারা দোষীদের ইচ্ছাকৃতভাবেই ধরছে না, এবং তারা মুক্তচিন্তার মানুষদের ভিতরে ভয়ের চাষ করতে চাচ্ছে।"[96]
জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণাধার ৪৩ বছর বয়সী ফয়সাল আরেফিন দীপন [97] মৌলবাদীদের দ্বারা ২০১৫ সালের ৩১ শে অক্টোবর মৃত্যুর মুখে ঢলে পরেন। তিনি বিজ্ঞানমনষ্ক-যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায়ের বিশ্বাসের ভাইরাস প্রকাশ করেন।[98] তিনি তার প্রকাশনা রুমেই নিহত হন। একইদিনে অন্য আরেকজন প্রকাশক আহমেদ রশীদ চৌধুরী এবং রনদীপন বসু ও তারেক রহমান নামক দুইজন লেখক অন্য প্রকাশনা রুমে ছুরিকাহত হন। এই তিনজনকেই হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং এদের মধ্যে একজন গুরুতর ভাবে আহত হন।[99] ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারীতে আদালত দীপন হত্যা মামলায় আট জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।[100]
৪৩ বছর বয়সী শুদ্ধস্বর প্রকাশনার মালিক আহমেদ রশীদ চৌধুরী ২০১৫ র ফেব্রুয়ারিতে (এই মাসেই অভিজিৎ রায় মারা গিয়েছেন) নাস্তিক লেখকদের বই প্রকাশ করার জন্য এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মৃত্যুর হুমকি পান। ২০১৫ এর ৩১ অক্টোবর গুপ্তহত্যাকারীরা চাপাতি দ্বারা তাকে আক্রমণ করে, তাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। আনসার-আল-ইসলাম এর দায় স্বীকার করে।[101][102]
নাজিমুদ্দিন সামাদ (মৃত্যু- ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র এবং উদারপন্থী ব্লগার (ফেসবুকেই সক্রিয় থাকতেন) ছিলেন, সেকুলারিজম এর ধারক হওয়ায় এবং অনলাইনে তা ছড়ানোর সন্দেহভাজন ইসলামিস্টদের দ্বারা, ঢাকায় খুন হন।[103][104] দুর্বৃত্তরা সামাদের উপর চাপাতি হাতে হামলা করে, এবং তাকে হত্যা করে।[105][106] গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার এ বিষয়ে বলত গিতে বলেন, এই হত্যা সরকারেরই একপ্রকার চাল ছিল, যাতে করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুর হত্যার ঘটনা থেকে সাধারণ জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে সরানো যায়।[106][107] সাইট ইন্টেলিজেন্স মনিটরিং গ্রুপ অনুসারে, আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (AQIS) এর বাংলাদশ বিভাগ আনসার আল ইসলাম স্বীকার করে যে, সংগঠনটির সদস্যরা প্রতিশোধ নেবার জন্য এই হত্যাকাণ্ডটি চালায়। এখানে বলা হয়, নাজিমুদ্দিন সামাদ, ঈশ্বর, নবী এবং ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন।[108]
মুহম্মদ জাফর ইকবাল সিলেট শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের গুণী সাহিত্যিক। সাহিত্যাঙ্গনে তার লেখা শিশু-কিশোরদের জন্যই বেশি। এছাড়াও অসংখ্য সায়েন্স ফিকশনের রচয়িতা তিনি। ২০১৮ সালের ৩ মার্চ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠান চলার সময় মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক আক্রমণে ছুরিকাহত হয়েছিলেন। অধ্যাপক জাফর ইকবালের মাথায়, কাঁধে এবং হাতে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাত লেগেছিল।[109] ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রীকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের নামে মোবাইলে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাসির রায়ের পক্ষে, কিছু ব্লগারদের ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ।[110] এরপর থেকেই এ আন্দোলনের যারা উদ্যোক্তা ছিলেন তারা জঙ্গীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়। বেশকিছু মানুষকে জঙ্গীরা হত্যা করতে সমর্থ হয়।
২০১৩ সালের ২ মার্চ শনিবার রাতে সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জগৎজ্যোতি তালুকদার হত্যার স্বীকার হন। আহত হন আরেক যুবলীগ নেতা জুয়েল আহমদ। তালুকদারকে সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকায় হত্যা করা হয়। এ সময় তাদের ব্যবহৃত প্রাইভেট কারটিও আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হত্যার প্রতিবাদে সোমবার কালো পতাকা মিছিল করে সিলেট গণজাগরণ মঞ্চ। ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র একটি দল তাকে হত্যা করেছে বলে তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা অভিযোগ করেছেন। সহকর্মীদের মতে, জগৎজ্যোতি তালুকদার ছিলেন সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের গণজাগরণ মঞ্চের নিয়মিত মুখ। প্রতিদিন তরুণদের নিয়ে মঞ্চে আসতেন তিনি। মঞ্চের সংগঠক ও দলীয় সহকর্মীদের অভিযোগ, এ কারণে জামায়াত-শিবিরের খুনি চক্র তাকে হত্যা করে। ‘জগৎজ্যোতির ঘাতকদের ক্ষমা নেই, জগৎজ্যোতির ক্ষয় নেই’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই মিছিল করা হয়।[111] এ ঘটনায় ওই বছরের ৫ মার্চ সিলেট জামায়াতের শীর্ষ তিন নেতা হাফিজ আব্দুল হাই হারুন, ফখরুল ইসলাম ও সিরাজুল ইসলাম শাহীনকে হুকুমের আসামী ও সাবেক শিবির নেতা গাজি নাছিরকে প্রধান আসামী করে কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল ৩৩ জামায়াত-শিবির নেতাকে অভিযুক্ত করে জগৎজ্যোতি হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে খুব একটা অগ্রগতি তো হয়ই নি, বরং ২০১৩ সালের ১০ জুন বুধবার সিলেটে, জগৎজ্যোতি হত্যা মামলার দুই আসামি উবায়দুল হক শাহীন ও ফয়জুল হককে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক জোটের প্রার্থী বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে দেখা গেছে। তারা দুজনই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।[112]
বগুড়া জেলা সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক, বগুড়ার শেরপুর ডিগ্রি কলেজে গণিত বিভাগের প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে (৪৭) ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে সদর থানার পেছনে সেলিম হোটেলের সামনে হত্যা করা হয়। নিহতের ছোট ভাই সামছুদ্দিন সোলায়মান সাধু সদর থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। জাকারিয়া বাবু বগুড়ার গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ছিলেন।[113][114] [115]
এককভাবে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ বিশেষ করে নাস্তিকদের হত্যার পর, এসব জঙ্গীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু আরো সম্প্রসারিত হয়, তাদের লক্ষ্যবস্তুতে এবার নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, (ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ বাংলাদেশে আগেও হত, কিন্তু তা হত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গোটা গোষ্ঠীর উপরে, কিন্তু কোনো বিশেষ ব্যক্তি যেমনঃ পুরোহিত, ভান্তে এটা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন) বাঙালি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি পালনকারী-এধরনের কোনো প্তিনিধি, অন্যান্য কর্মী।[15]
২০১৫ সালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ব্যাপক বিস্তার পরিলক্ষিত হয়, প্রাথমিকভাবে মনে করা হত, ২০১৫ সালে জঙ্গীবাদের প্রথম বলী; বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়, কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায়, অভিজিৎ রায়ের পূর্বে চট্টগ্রামের নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলি দেবী চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাকে হত্যার ধরন অন্যান্য লেখক-ব্লগারদের মতই ছিল।
নুরুল ইসলাম ফারুকী একজন বাংলাদেশী ইসলামী পণ্ডিত, ব্যাবসায়ী, মিডিয়া কর্মী ও ইসলাম প্রচারক। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তার নিজের বাড়িতে তাকে খুন করে পালিয়ে যায়।[116][117] ২৭ আগস্ট, ২০১৪ তারিখে ফারুকীর রাজাবাজার অফিসে ৮-১০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি আসে।[117] এর আগে একজন মহিলা বারবার ফোন করে ফারুকীর সাথে সাক্ষাত করতে চাচ্ছিলো। বারবার অনুরোধের কারণে মাওলানা ফারুকী সেই মহিলাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন। প্রায় দুই ঘণ্টার আলাপে সেই মহিলাকে অনেক ভীতসন্ত্রস্ত ও অস্বাভাবিক মনে হয়েছিলো।[117] ফারুকী পরিবারের ধারণা সেই মহিলার সাথে খুনীদের সম্পর্ক আছে। মহিলাটি চলে যাওয়ার পর কিছু যুবক ফারুকীর কাছে আসে ইসলাম ও হজ্জ্ব বিষয়ে কথা বলার জন্য। কিন্তু যুবকদের দল বাসায় ঢুকে অস্ত্র বের করে ফারুকীর কাছে টাকা দাবী করে।[117][118] এরপর তারা ফারুকীর হাত-পা কাপড় দিয়ে বেধে ফেলে ও হত্যা করে পালিয়ে যায়।[118] তবে ফারুকীর পরিবার অক্ষত ছিলো।[118]
২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ থানার তেলিপট্টি লেইন এলাকায় অঞ্জলিকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে দুর্বত্তরা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।[119]
পুলিশের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, অঞ্জলি দেবীর সাথে পরিবারিক কিংবা প্রশাসনিক কোন বিরোধের তথ্য তারা পায়নি। তবে তাদের সামনে এসেছে বছরখানেক আগে নার্সিং কলেজে হিজাব পরার আন্দোলনের কথা। ওই আন্দোলনে থাকা ছাত্রীদের উসকানি দিয়েছিল শিবির। ছাত্রীদের একটি অংশ এবং কয়েকজন শিক্ষক হিজাব পড়ার আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল।[120]
শিক্ষার্থী সুফিয়া সুলতানা বলেন, ‘হিজাব পরা না পরা নিয়ে ২০১২ সালে কলেজে একবার আন্দোলন হয়েছিল। তবে তাতে অঞ্জলি ম্যাডামের কোনো ভূমিকা ছিল না, তিনি অত্যন্ত নীতিবান ছিলেন।’ সুফিয়া সুলতানা এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করেন[121]
হিজাব পড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির পর সেবা পরিদপ্তরের পরিচালক বরাবরে ২০১২ সালে একটি চিঠিও পাঠান নার্সিং কলেজের শিক্ষকরা। নিজেদের আতংকের কথা জানিয়ে অঞ্জলি দেবীসহ ১০ জন শিক্ষক স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৬ জুনের পর থেকে কিছু সংখ্যক মুসলিম ছাত্রীরা ড্রেসের সাথে হিজাব পরিধান করছিল। ড্রেস কোড অনুযায়ী হিজাব পড়তে নিষেধ করায় ছাত্রীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, শিক্ষক এবং ফেসবুক ও ইন্টারনেটসহ বিভিন্নভাবে তথ্য সরবরাহ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে হাসপাতালের পরিচালকসহ স্বাচিপ নেতা ও ডিন নেতৃবৃন্দ, ফৌজদারহাট নার্সিং কলেজের শিক্ষক, চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের শিক্ষক, সেবা তত্ত্ববধায়ক এবং সকল বর্ষের মুসলিম ছাত্রীদের উপস্থিতিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু ২০১২ সনের ১৪ জুলাই মো. রেজা নামের এক ব্যক্তি শিক্ষিকা অঞ্জলি দেবীকে একটি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। যদিও বা বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ অফিসিয়াল। বর্তমানে তা সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকের দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে। যা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের পরামর্শে অধ্যক্ষসহ আমার প্রত্যেক ব্যাচের ছাত্রীদের একটি প্রতিবেদন প্রচার মাধ্যমকে দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু ছাত্রীরা কোন প্রতিবেদন দেয়নি। এতে বুঝা যায় কোন বিশেষ মহল নার্সিং কলেজের ছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করছে, যার কারণে তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করছে এবং ভবিষ্যতে এটি হুমকি স্বরূপ। সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন হয়েছে তা শুরুতে সমাধান না করলে ভবিষ্যতে সবাইকে এর মাশুল দিতে হবে ।সেবা পরিদপ্তরে চিঠি দেয়ার পর ২০১২ সালের ১৮ জুলাই নিজেদের হয়রানি করছে দাবি করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান পরিষদের কাছেও একটি চিঠি দিয়েছিলেন অঞ্জলি দেবীসহ নার্সিং কলেজের আটজন হিন্দু শিক্ষিকা। তবে নার্সিং কলেজের শিক্ষকরা কেনই বা নিজেদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছিলো সেই ব্যাপারে মুখ খোলেনি।[122]
কুনিও হোশি (星邦男 'হোশি কুনিও') একজন ৬৬ বছর বয়স্ক জাপানী বৃদ্ধ ছিলেন। তিনি আইওয়াতে প্রেফেকচারের বাসিন্দা ছিলেন। অক্টোবরের ২০১৫ তে বাংলাদেশের রংপুরে গুলিবিদ্ধ হন।[123][124] হোশি হিতা কুচি এবং গোলাম কিবরিয়া নামক ছদ্মনামেও তিনি পরিচিত ছিলেন।[125] হোসি ২০১১ সালে প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আসেন এবং এরপর প্রতিবছরই আসতেন।[126] তিনি সর্বশেষ ২০১৫ সালে জুনে (মৃত্যুর চারবছর পূর্বে) বাংলাদেশে আসেন, রংপুর থেকে কিছুটা দুরে গ্রাম্য অঞ্চলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ঘাতকরা তাকে তিনবার গুলিবিদ্ধ করেন। পুলিশের তথ্য অনুসারে হোশি বিত্তবান ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন তার অবস্থার উন্নয়নের জন্য, এখানে জীবনব্যবস্থার মুল্য জাপান থেকে কম হওয়ায় এবং এখানের মৃত্তিকা উর্বর হওয়ায় তিনি ভেবেছিলেন, এখান থেকে কৃষিকাজ করে তিনি লাভবান হবেন।[127] ইরাকের ইসলামিক স্টেট এবং ISIL; টুইটারে হোশিওর খুনের দায় স্বীকার করেন।[128][129] তার খুনীরা এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, তাদের হিসেবে ভুল হয়েছে এবং তারা জানত না যে, কুনী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তারা যদি জানত, কুনী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাহলে তারা তাকে হত্যা করত না।[15] বাংলাদেশের জাপানিজ অ্যাম্বাসি বাংলাদেশকে অনুরোধ করে, তার মৃতদেহ যেন ইসলামিক রীতিনীতি অনুসরণ করে এখানেই (বাংলাদেশ) কবর দিয়ে দেওয়া হয়। তাকে বাংলাদেশেই অবশেষে দাফন করা হয়।[130]
২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গ্রুপ- বয়স্ক হিন্দু পুরোহিত কে শিরঃচ্ছেদ করে হত্যা এবং তার দুই সহকারী পুজারীকে; গুরুতর ভাবে জখম করার দায় স্বীকার করেছিল। এই ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলাদেশের উত্তরে পঞ্চগড় জেলায়।[131]
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ.এফ.এম. রেজাউল করিম সিদ্দিক গুপ্তঘাতকের দ্বারা (যাদের আজো শনাক্ত করা যায় নি) হত্যার স্বীকার হন। তিনি সেসময় রাজশাহী শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলেন।[132] আইএসআইএল পরবর্তীকালে এই খুনের দায় স্বীকার করে।[133]
শিক্ষক সিদ্দিকের খুনের দুই দিন পরে (২৫ এপ্রিল,২০১৬), জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু তনয় মজুমদার গুপ্তঘাতকের দ্বারা ছুরিকাহত হন,তারা ঢাকার কাছেই কলাবাগানে অবস্থিত মান্নানের অ্যাপার্টমেন্টে ভাঙচুর করেন। মান্নান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এলজিবিটি পত্রিকা রুপবানের সম্পাদক এবং ইউ.এস.এইডের তিনি একজন কর্মী ছিলেন। আইএসআইএল এই হত্যার দায় স্বীকার করে।[134]
২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল, টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামক হিন্দু দর্জি ;দুইজন মৌলবাদীর আক্রমণের স্বীকার হন এবং মারা যান। ত্বড়িৎ গতিতে, আতঙ্কবাদীদের গ্রুপের মাধ্যমে; ইসলামিক স্টেট এই খুনের দায় স্বীকার করে।[135]
২০১৬ সালের ৭ মে; সন্দেহভাজন ইসলামী জঙ্গীরা ৬৫ বছর বয়স্ক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সুফিসাধক মোহাম্মদ শহিদুল্লাহকে ময়মংসিংহের আমবাগানে হত্যা করেন।[18]
২০১৬ সালের ১৬ মে; বান্দরবান জেলায়-৭৫ বছর বয়সী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ভিক্ষু; মাওং সু ইউ চ্যাক মৃত্যুর মুখে পতিত হন। ইসলামিক স্টেটকে এই খুনের পিছনে দায়ী বলে সন্দেহ করা হয়।[136]
২০১৬ সালের ২০ মে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে গুরুতর আহত এবং গ্রাম্য ডাক্তারকে খুন করা হয়। ৫৫ বছর বয়সী মীর সানাউর রহমান ছিলেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর তার বন্ধু সাইফুজ্জামান (৪৫) গুরুতর আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রক্তাক্ত চাপাতি উদ্ধার করেন।[137] মীর সানাউর রহমান তার গ্রামবাসীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতেন।[15]
২০১৬ সালের ২৫ মে; ৬৮ বছর বয়সী ব্যবসায়ী, দেবাশীষ চন্দ্র প্রামাণিক, ঢাকা জেলার গাইবান্ধায় তার নিজের জুতার দোকানে খুন হন। আইএসআইএল এর দায় স্বীকার করে, এটা ছিল বাংলাদেশেই একসপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় দায় স্বীকারমুলক বিবৃতি।[138]
২০১৬ সালের ৭ জুন, আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নামক এক হিন্দু পুরোহিত, খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলায় নির্মমভাবে জবাই হন। তার হত্যায় তিনজন মৌলবাদী মুসলিম অংশ নিয়েছিলেন।[14]
২০১৬ সালের ১০ জুন, নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে নামক একজন ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ নিহত হন। তিনি একজন সন্নাসী ছিলেন এবং কিছু দুর্বৃত্ত দ্বারা, তিনি তার আশ্রমের কাছেই আক্রান্ত হন। তার মৃত্যুর জন্য মৌলবাদী মুসলিমদেরই সন্দেহ করা হচ্ছে।[139]
২০১৬ সালের ১৫ই জুন, মাদারীপুর জেলায়; তিনজন চাপাতি সহযোগে দুর্বৃত্ত; রিপন চক্রবর্তী নামের একজন হিন্দু কলেজ শিক্ষককে, তার বাসায় আক্রমণ করেন। তিনি সে যাত্রায় প্রাণে বেচে যান ঠিকই, কিন্ত গুরুতর ভাবে আহত হন।[140] এই তিন আক্রমণকারীর একজন ছিলেন গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম, তিনজন পালাবার সময়, এলাকার সাধারণ জনতা একে ধরে ফেলে এবং পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।[141]
২০১৬ সালের ১ জুলাই সাতক্ষীরা জেলায়, মোটরসাইকেলে আরোহণকারী; সন্দেহভাজন তিন চরমপন্থী মুসলিম দ্বারা হিন্দু ধর্মের উপাসনালয়-মন্দিরের কর্মী শ্যামানন্দ দাস নিহত হন।[142] সুরেন্দ্র সরকার এবং তারেক সাহা নামে আরো দুইজন সনাতন ধর্মাবলম্বী আহত হন, বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর চরমপন্থী মুসলিমের দিকে থাকলেও তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় নি।[143]
২০১৬ সালের ২ জুলাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কৃষক; আওয়ামীলীগের ৭ম ওয়ার্ডের প্রেসিডেন্ট মং সুই লুং মারমা বান্দরবানে গুপ্ত হত্যার স্বীকার হন। আইএস এই গুপ্তহত্যার দায় স্বীকার করে। লুং মারমা যে স্থানে খুন হন, তার কাছেই অন্য আরেক জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পূর্বেও মারা গিয়েছেন।[144]
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতের সাড়ে ৯:২০ এর দিকে ছয়জন জঙ্গী কুটনৈতিক পাড়া-গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারীতে প্রবেশ করে এবং প্রবেশ করেই এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। তারা বোমা বর্ষণ করে এবং কয়েক ডজন মানুষকে জিম্মি করে। ১৭ জন বিদেশী, দুইজন পুলিশ অফিসার এবং পাঁচজন অস্ত্রধারী সহ মোট ২৮ জন মারা যায়। একজন বন্দুকধারীকে গ্রেফতার করা হয়, এবং ১৩ জন জিম্মিকে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং সমন্বয়ক বাহিনী দ্বারা মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে ৬ জঙ্গীই বাংলাদেশের নাগরিক ছিল।
আরিফ রায়হান দীপ (মৃত্যু ২ জুলাই, ২০১৩) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল রাতে শহীদ স্মৃতি হলের মসজিদের ইমাম হলের বাবুর্চিদের দিয়ে খিচুড়ি রান্না করিয়ে মতিঝিলে অবস্থানরত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের জন্য পাঠান, তখন দীপসহ কয়েক শিক্ষার্থী এর প্রতিবাদ করেন। ওই রাতেই শিক্ষার্থীরা বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিষদের পরিচালক দেলোয়ার হোসেনকে জানান। পরে প্রশাসন ইমাম আব্দুল আলিমকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়। এরপর ফেসবুকের গ্রুপে দীপকে নিয়ে আজেবাজে লেখা হয়, এবং ফোনে হুমকি দেয়া হয়। এরপর ৯ এপ্রিল সকালে নজরুল ইসলাম হলের ছাত্র দীপকে হলে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এতে মাথায় ও পিঠে গুরুতর জখম হন দীপ। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় তিন মাস পর ২ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[145][146]
১৯৯০ সালের গ্রন্থাকার তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত হয়ে উঠেন, "তার কবিতায় যৌনতাকে বলিষ্ঠভাবে চিত্রায়িত করার জন্য, নিজেকে স্বঘোষিতভাবে নাস্তিক বলার জন্য এবং তার ধর্মবিদ্বেষী জীবনযাপনের জন্য"।[147] তিনি পত্রিকায় তার কলামে ধর্মীয় মৌলবাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠা, সরকারের নির্লিপ্ততার তীব্র সমালোচনা করতেন। ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে উন্মত্ত জনতা, তার বই যেসব বইয়ের দোকান সংরক্ষণ করত, সেখানে আক্রমণ করা শুরু করে। একই বছরে তিনি বইমেলায় আকস্মিক আঘাতের সম্মুখীন হন, এবং তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে তার উপন্যাস লজ্জা বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়ানো র অভিযোগে সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়।[148] ১৯৯৩ সালের ২৩ এ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুর জন্য ফতোয়া জারী করা হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তার পাসপোর্ট ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে ফেরত দেওয়া হয়, এর পরই তিনি ফ্রান্সে চলে যান, এবং ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৯৪ সালের ৪ঠা জুলাই তার বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারী করা হয় এবং তিনি গ্রেফতার এড়াতে লুকিয়ে পরেন।[147] আগস্টের ৩ তারিখ তার জামিন হয়, এবং নাসরিন সুইডেন পালিয়ে যান। সেখানে কিছু বছর তিনি নির্বাসনে থাকেন। ১৯৯৮ সালে তিনি তার গুরুতর অসুস্থ মাকে দেখতে বাংলাদেশে আসেন, কিন্তু বিক্ষোভ এবং হুমকি ধামকির মুখে তাকে পুনরায় লুকিয়ে পরতে বাধ্য করা হয়। ২০০৫ সালে তিনি ভারতে চলে যান, এবং সেখানের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতেই অবস্থান করলেও ২০১৫ সাল থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন।[147] .[149][150]
১৯৯৯ সালের ১৮ ই জানুয়ারি বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমানকে তার লেখালেখির জন্য হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলাম নামক একটি সংগঠন তারই বাসভবনে খুন করার পরিকল্পনা করে, তবে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।[151]
২০০৩ সালে বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থাকার এবং সমালোচক হুমায়ুন আজাদ পাক সার জমিন সাদ বাদ নামে; রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামাতে ইসলামের সমালোচনা করে একটি বই লিখেন। হুমায়ুন এটা প্রকাশ করার পরপরই মৌলবাদী দলগুলো থেকে প্রচুর সংখ্যক মৃত্যুর হুমকি পেতে থাকেন।[152] ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন একুশে বইমেলায় একদল দুর্বৃত্তের চাপাতি সহকারে হামলায় আক্রমণের স্বীকার হন। এই আক্রমণের এক সপ্তাহ পূর্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাইদী, হুমায়ুনের রাজনৈতিক ব্যাঙ্গাত্মক বই পাকসার জমিন সাদ বাদকে নিষিদ্ধ এবং আজাদের একাজের জন্য তাকে ব্ল্যাসফেমী আইনে অভিযুক্ত করার দাবী তুলেন।[153]
২০০৪ সালের ১২ই আগস্ট আজাদ, জার্মানির মিউনিখে তার নিজ এপার্টমেন্টে মারা যান। মৃত্যুর একসপ্তাহ পূর্বে জার্মানিতে তিনি ১৯ শতকের রোমান্টিক কবি হাইনরিখ হাইনে এর উপর গবেষণা করতে আসেন।[154] তার পরিবার এজন্য তদন্তের দাবী জানিয়েছিলেন। তাদের অভিযোগ যারা আজাদকে বইমেলার সম্মুখে হামলা করেছে, তাদেরই হুমায়ুনের মৃত্যুতে ভূমিকা আছে।[152]
২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল জামাতে-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশের সুরা মজলিসের সদস্য সালাহউদ্দিন; র্যাব কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে ধৃত হয়। তিনি হুমায়ুন আজাদ হত্যার সন্দেহভাজন হিসেবেই গ্রেফতার হন। সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩৩ কেসের অভিযোগ ছিল। তার অন্য আরেকটি খুনের মামলায় ফাসির রায় হয়।[155]
২০১৩ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশ ডিটেক্টিভ ব্যুরো; চরমপন্থী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এর পাঁচ সদস্যকে; আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা মামলায় গ্রেফতার করেন।[156] পাঁচজনের প্রত্যেকেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা তাদের অপরাধ ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে স্বীকার করেন।[68]
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল মেজবাহউদ্দীন নামে বুয়েটের স্থাপত্য প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। মেজবাহ হেফাজত সমর্থক বলেও পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।[145][146]
ফারুকী হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে ২৯ আগস্ট পুলিশ সন্দেহভাজন মহিলাকে আটক করে। নারায়ণগঞ্জ এর রূপগঞ্জের সেই মহিলার নাম মাহবুবা। বাংলাদেশ আহলে হাদিস আন্দোলনের সাথে জড়িত মোজাফফর বিন মুহসীনকে এই হত্যার আসামি সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। পরে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।[106][117]
চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের শিক্ষিকা অঞ্জলি রানী দেবী হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয়মাস পর ২০১৫ সালের ১৩ জুন শনিবার রাতে নগরীর জিইসি মোড় থেকে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জামিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার সাবেক ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাকে (৪৮) আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ[119] এর পরে এখন পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতিই দেখা যায় নি।[121]
২০১৫ সালের ২ মার্চ র্যাব অভিজিৎ রায় হত্যার সন্দেহভাজন হিসেবে, চরমপন্থী ইসলামিস্ট ফারাবি সাফিউর রহমানকে গ্রেফতার করেন। পুলিশের ধারণা ফারাবি অভিজিৎ এর অবস্থান, পরিচিতি, পারিবারিক ছবি বিভিন্ন মানুষের কাছে ছড়িয়েছেন।[157] ফারাবি বিভিন্ন সময় অভিজিৎকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগের মাধ্যমে হুমকি দিতেন। তিনি তার ফেসবুকের একটি ভিন্ন পোস্ট এবং কমেন্টের মাধ্যমে বলেছিলেন যে, অভিজিৎ যখন ফিরে আসবেন, তখন তাকে হত্যা করা হবে।[158][159]
২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট পুলিশের ভাষ্যমতে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে যারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়, এবং পুলিশের ধারণা এই দুজন নীলয় নীল হত্যায় জড়িত ছিলেন।[160]
২০১৫ সালের ১৮ই আগস্ট আনসারুল বাংলা টিমের সদস্য;- তৌহিদুর রহমান নামক ব্রিটিশ নাগরিক সহ দুইজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের ভাষ্যমতে এই তিনজন "অভিজিৎ ও অনন্ত বিজয় হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী" ছিলেন।[161]
২০১৬ সালের ২০ জুন শুক্রবার রাতে জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুর হতাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে তিনজন কে আটক করা হয়। এই তিনজনই শিবির ক্যাডার ছিলেন। এরা হলেন, বগুড়ার সারিয়াকান্দির নারচি তরফদারপাড়ার মুল ঘাতক মাইনুর ইসলাম ফকির (২১), শিবগঞ্জের সাতআনা কিচক গ্রামের সরকারি আযিজুল হক কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র মহসিন আলী (২১) এবং বগুড়া শহরের সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজের ছাত্র হাবিবুল্লাহ নাঈম (১৯)। মাইনুর জানান, এর সাথে স্থানীয় দুই শীর্ষ শিবির নেতা জড়িত আছেন। জামিলনগরে তাকে একটি বাড়ি দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। রাত ৯টার দিকে ভিকটিম প্রভাষক বাবু পান খাওয়ার জন্য প্রেস থেকে সেলিম হোটেলের সামনে আসলে অনুসরণকারী এক শিবির নেতা তার গালে থাপ্পড় দেন। এরপর মাইনুরকে বলেন, "মার শালাকে"। মাইনুর প্রথমে তার (বাবু) পাজর ও পরে কানের নিচে চাকু ঢুকিয়ে দেন। বাবু মাটিতে লুটিয়ে পড়লে শিবিরের অন্য নেতাকর্মীরা তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। পরে শিবির নেতারা মাইনুরকে তিন হাজার টাকা দিয়ে এক মাসের জন্য শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেন। এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও হত্যায় অংশ নেওয়া অন্য শিবির নেতাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি পুলিশ সুপার।[113] পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মহসিন ও নাঈম ছাত্রশিবিরের কর্মী এবং মাইনুর পেশাদার খুনি। সে ছাত্রশিবিরের হয়ে বিভিন্ন খুন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। সে ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বগুড়া রেটিনা কোচিং সেন্টারে নৈশ প্রহরী হিসেবে চাকরি করে। কিন্তু তার সাহসিকতার কারণে শিবির নেতারা তাকে ২০১১ সালে ‘কিলার’ হিসেবে সংগঠনে টেনে নেয়। পরবর্তী সময়ে বগুড়া আযিযুল হক কলেজ শাখা শিবিরের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার তত্ত্বাবধানে থেকে হরতাল, অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিলসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ককটেল, পেট্রলবোমা হামলা ও আগুন দেওয়ার মতো নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে মাইনুর। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মাইনুর জানায়, সে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের সময় পেট্রলবোমা নিক্ষেপ, গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ যাবতীয় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের হোতা ছিল এবং সে বগুড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে তিন থেকে চার'শ হাতে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।[114][115]
২০১৬ সালের ১৬ই অক্টোবর ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে মোঃ রশিদুন নবী ভূইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিই নাজিমুদ্দিন হত্যার প্রধান আসামি। কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদুন্নবী জানিয়েছেন, নাজমুদ্দিন হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি বাসা ভাড়া নেয়া হয়। তিনিসহ পাঁচজন এই হত্যায় অংশ নেয় । তাদের মধ্যে চারজনের হাতে চাপাতি ও একজনের হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ৬ এপ্রিল রাতে রাশিদুন নবীর নেতৃত্বে ৫ জঙ্গি নাজিমউদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।'[162][163][164]
এ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টা ও জুলহাস মান্নান-মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও গ্রেফতারকৃত রাশিদুন নবী জড়িত ছিল বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে বলেও জানান সিটিটিসি প্রধান।[165]
আহমেদ রাজীব হায়দারের হত্যা মামলা "দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের" অধীনে চলেছিল।[166] ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর (তিন বছর পরে) আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সদস্য এমডি.ফয়সাল বিন নাইম এবং রেদওয়ানুল আজাদ রানাকে রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। আদালত ফয়সাল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছে, সে মাংস কাটার ছুড়ি দিয়ে রাজিবকে আঘাত করে।[167] রানা আত্মগোপনে থাকলেও তার সাজার রায় তার অনুপস্থিতিতেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাকসুদুল হাসান নামে আরেক অপরাধীকে যাবজ্জীবন জেল দেওয়া হয়েছে।[168] আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ সদস্য যথা: কলহবাদী ধর্মীয় নেতাঃ- মুফতি জসিম উদ্দীন রাহমানি পাচ থেকে দশ বছরের জন্য জেলের সাজা পান।[169] অন্য জনের তিন বছরের জন্য জেল হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.