তিব্বত সাম্রাজ্য
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
তিব্বত সাম্রাজ্য সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ের পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য বর্তমান তিব্বত , পাকিস্তানের পূূর্বাংশ , ভুটান ও নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইয়ার্লুং উপত্যকার গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সন আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং ৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ সম্রাট গ্লাং-দার-মার মৃত্যুতে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
তিব্বত সাম্রাজ্য বোদ བོད་ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
৬০০–৮৪২ | |||||||||
![]() ৭৮০ হতে ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সাম্রাজ্যের বিস্তার | |||||||||
রাজধানী | লাসা | ||||||||
প্রচলিত ভাষা | তিব্বতী ভাষা | ||||||||
ধর্ম | তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম, বোন ধর্ম | ||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||
ইতিহাস | |||||||||
• গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সন দ্বারা স্থাপিত | ৬০০ | ||||||||
• গ্লাং-দার-মার মৃত্যু | ৮৪২ | ||||||||
| |||||||||
বর্তমানে যার অংশ | Bhutan China India Nepal Pakistan |
সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও সাম্রাজ্য স্থাপনা
সারাংশ
প্রসঙ্গ
লাসার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত ইয়ার্লুং উপত্যকার বিভিন্ন গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে একজন গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সন আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে ঐ উপত্যকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সমস্ত গোষ্ঠীদের একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করেন। এইভাবে তাঁর রাজ্য লাসা সহ মধ্য তিব্বত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বহু যুদ্ধে জয়ী তাঁর রণ অভিজ্ঞ সৈন্যবাহিনীর সমর্থনে তিনি এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গঠন করতে সক্ষম হন, যার ফলে তিব্বত মালভূমির বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্রিত হয়। [১] :৫ গ্নাম-রি-স্রোং-ব্ত্সনকে ৬১৮ অথবা ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহীদের দ্বারা বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যা করা হলে তাঁর পুত্র স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পো এই বিদ্রোহ দমন করে পরবর্তী সম্রাট হন। [২] :১৯ [৩] :৪৪৩
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পোর মন্ত্রী ম্যাং-মাং-পো-র্জে ঝাংঝুং রাজ্যের সাহায্যে উত্তর পূর্ব তিব্বতে বসবাসকারী সুমপা জাতিকে পরাজিত করেন।[৪] জিউ ট্যাংশু গ্রন্থে বলা হয়েছে যে ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াংটং বা ঝাংঝুং ও অন্যান্য চিয়াং জাতি তিব্বতের অধীনস্থ হয়। এরপর সম্রাট ঝাংঝুং রাজ্য ও নিজের রাজ্যকে মিলিত করে তুয়ুহুন রাজ্যকে পরাজিত করেন। [৫][৬]
৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পো ট্যাং সম্রাটের নিকট দূত মারফৎ সোনা ও রেশম পাঠিয়ে চীনের যে কোন একজন রাজকুমারীকে বিবাহ করার প্রার্থনা করেন। কিন্তু এতে ট্যাং সম্রাট ট্যাং তাইজং আপত্তি করলে তিনি তুয়ুহুন রাজ্য ও সোংঝৌ নামক ট্যাং সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশ আক্রমণ করেন। [৭]:১৬৮-১৬৯ ট্যাংদের লেখা রচনাতে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পো পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ট্যাং সম্রাট ট্যাং তাইজং তাঁর বিবাহের প্রার্থনা স্বীকার করেন। [৮]:৩ কিন্তু তিব্বত থেকে প্রাপ্ত রচনা থেকে যায় যে তিব্বতী সেনা চীনাদের পরাজিত করলে ট্যাং তাইজং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ওয়েংচেন গোংঝুকে তাঁর হাতে দিতে বাধ্য হন। [৭]:১৬৮-১৬৯
সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পোর পৌত্র খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সান সিংহাসনে বসলে ট্যাং সাম্রাজ্যের সঙ্গে তিব্বতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সান তাঁর পিতামহ স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পোর মতো ট্যাং সম্রাটের কাছে কোন চীনা রাজকুমারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহের অনুমতি প্রার্থনা করেন, কিন্তু চীনারা তা মানতে অস্বীকার করেন। [৯]:৭, ৮৫ এরপর খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সান পূর্বে তুয়ুহুন রাজ্য ও পশ্চিমে ঝাংঝুং রাজ্যে তিব্বতের শাসনকে আরো শক্তিশালী করা শুরু করেন। [১০]:২৩১
৬৬২ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সান পশ্চিম তুর্কী খাগানাতের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এই দুই শক্তি ৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কাশগর ও ৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে খোটান দখল করে। ৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের নিকট তুর্কী নুশিবাই পরাজয় স্বীকার করে[২]:৩২ যার ফলে ওয়াখান উপত্যকা দখলে চলে আসে। [১০]:২৩২ ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতী বাহিনী চীনের অধিকারে থাকা তারিম নদীর পশ্চিম উপত্যকা ও আকসু দখল করে নেয়। [২]:৩৪-৩৬
খ্রি-মাং-স্লোন-র্ত্সানের মৃত্যুর পরেই ঝাংঝুং রাজ্যে বিদ্রোহ শুরু হলে খ্রি-দুস-স্রোং-ব্ত্সনের মাতা সাম্রাজ্ঞী খ্রি-মা-লোদ-খ্র্ল-স্তেং ও ম্গার বংশের মন্ত্রীদের শক্ত শাসনে সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়। [২][১১]:৩২
৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতী সৈন্যবাহিনী গানসু প্রদেশের সানঝৌ, কুওঝৌ, হেঝৌ, দিয়েঝৌ, মিগং ও ডানলিং আক্রমণ করে। চীনারা লংঝিতে তিব্বতীদের পরাজিত করে। লি জিংজুয়ানের নেতৃত্বে চীনারা কোকো নরের নিকটে পরাজিত হয়।[১১]:৩১ ৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিব্বতীদের দখলে সমগ্র তারিম নদী উপত্যকা চলে আসে।[২]:৪৩
৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ট্যাং সাম্রাজ্যের মিন নদীর তীরে আর্নঙ্গের দুর্গ দখল করে নেয়। [৮]:১৯ এই সময় ইর হ্রদ অঞ্চলে বসবাসকারী ইরহে জাতি[১২]:১৩৬ ট্যাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য তিব্বতের অধীনে চলে আসে। [১০]:২৩৩ এই সময় তিব্বতীরা পূর্বে সংঝু ও লিয়াংঝৌ, দক্ষিণে ভারত, পশ্চিমে কাশগর ও উত্তরে তুর্কীদের এলাকা পর্যন্ত তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।[n ১]
৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েই ডাইজিয়ার নেতৃত্বে চীনা বাহিনী তিব্বত আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়। [৮]:২২ ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে দুই জন তিব্বতী সেনাপতি তাঁদের বাহিনী নিয়ে চীনাদের সঙ্গে যোগ দিলে চীনাদের দখলে তারিম নদী উপত্যকা চলে আসে। [৮]:২২ পশ্চিম তুর্কী খাগানাতের জুঙ্গারিয়ার দুলু জাতির খাগান আশিনা তুইজি তিব্বতীদের সাথে লেংজুয়ানে চীনাদের পরাজিত করেন।[১০]:২৩৫ পরের বছর খ্রি-দুস-স্রোং-ব্ত্সন লিনতাও এবং লিয়াংঝৌ দখল করে নেন। [৯]:৯২ ৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্বেত ও কালো মাইওয়া জাতিদের কর প্রদানে বাধ্য করেন। [১২]:১৩৬[১৩][১৪]
ম্গার বংশের মন্ত্রীরা ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ভাঙন ধরাতে পারে, তার আশঙ্কা করে সম্রাট খ্রি-দুস-স্রোং-ব্ত্সন ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শিকারে বেরোনোর নাম করে তাঁর অনুগামীদের ম্গার বংশের সদস্যদের আক্রমণের আদেশ দেন। এরপর নিজে উত্তরে সৈন্যবাহিনী নিয়ে গিয়ে ম্গার-খ্রি-ব্রিংয়ের সম্মুখীন হলে বিনা যুদ্ধে খ্রি-ব্রিং আত্মসমর্পণ করেন ও জিউ ট্যাংসু গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী আত্মহত্যা করেন। [৮]:১১[১০] এরপর খ্রি-দুস-স্রোং-ব্ত্সন মন্ত্রীদের ওপর সম্রাটের কর্তৃত্বের আইন প্রচলন করেন। [১০]
অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে মাইওয়া জাতিদের সঙ্গে যুদ্ধে খ্রি-দুস-স্রোং-ব্ত্সনের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র ল্হা-বাল-পো কিছুদিনের জন্য সিংহাসনে বসলেও [১৫]:৪২ ল্হা-বাল-পোকে সরিয়ে সাম্রাজ্ঞী খ্রি-মা-লোদ-খ্র্ল-স্তেং শিশু খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সানকে সম্রাট ঘোষণা করেন এবং প্রকারান্তরে নিজেই রাজত্ব করেন। খ্রি-মা-লোদ-খ্র্ল-স্তেং ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মারা গেলে খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সান সিংহাসন লাভ করেন। [৯]:৯২
৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতী সৈন্য কাশগর,[১০]:২৪৬, ৭২০ খ্রিষ্টাব্দে উইঘুর প্রদেশ [১০]:২৪৮ ও জিউ ট্যাংসু গ্রন্থের মতে ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে গিলগিট (তিব্বতী: ব্রু শা) আক্রমণ করেন। লাদাখ ও বালটিস্তান তিব্বত সাম্রাজ্যের অধিকারে ছিল কিনা তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। [৯]:৯৯[১০]:২৪৩
৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সান স্বয়ং তুয়ুহুন রাজ্য নিজের অধিকারে রেখে ট্যাং সাম্রাজ্যের গুয়াঝৌ দুর্গ অধিকার করে নেন। এরফলে উত্তরে পশ্চিম তুর্কী খাগানাত ও পশ্চিমে তাজিগ পর্যন্ত ট্যাং সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকার সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। [১৫]:৪৮[১৬]:৩৫৪ ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে ট্যাং সৈন্যরা তিব্বতীদের হঠিয়ে দিতে সমর্থ হয়।[১০]:২৪৯ ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে ট্যাং সাম্রাজ্যের সঙ্গে তিব্বত সাম্রাজ্যের শান্তি চুক্তি স্থাপিত হয়।[১০]:২৪৫ চীনারা ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে আনরং দুর্গ ও ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে শিপু দুর্গ দখল করে নিতে সক্ষম হন। [১০]:২৪৯ ৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কোরীয় সেনাপতি গাও জিয়াংঝির নেতৃত্বে চীনা সৈন্য তিব্বতীদের পরাজিত করে। [১০]:২৪৮
৭৪৮ থেকে ৭৫২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নানঝাও রাজ্যের শাসক গেলুওফেং ট্যাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিব্বত সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে। [১৬]:৩৫৪ ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে নানঝাও রাজ্যের রাজা গেলুওফেং সম্রাটকে সম্মান জানান। ৭৫৪ ও ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত সাম্রাজ্য তাঁকে চীনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করে। [১০]:২৫০[১৭]
৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে সির দরিয়ার উত্তরে তিব্বতী সৈন্যরা আরব ও কার্লুক জাতিদের ট্যাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে টালাসের যুদ্ধে সহায়তা করে। এই নির্ণায়ক যুদ্ধের ফলে ট্যাং সাম্রাজ্যের পশ্চিমে সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায়।[১০]:২৪৯
অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
ঝোল-র্দো-রিংস ফ্যি-মা নামক স্তম্ভে উৎকীর্ণ রয়েছে যে ৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাল-ল্দোং-ত্সাব এবং লাং-ম্যেস-জিগ্স নামক দুইজন মহামন্ত্রী খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সানকে হত্যা করেন।[১৮]:৭ খ্রি-ল্দে-গ্ত্সুগ-ব্ত্সানের মৃত্যুর পর তাঁর বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পুত্র খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান তিব্বতের সম্রাট হয়ে এই দুই মন্ত্রীর বিদ্রোহ দমন করেন। [১০]:২৫৪[১৯]:৭,৯
সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সানের মু-ত্রি-ব্ত্সান-পো, মু-নে-ব্ত্সান-পো, মু-তিগ-ব্ত্সান-পো এবং খ্রি-ল্দে-স্রোং-ব্ত্সান নামক চার পুত্র ছিল। এঁদের মধ্যে বড় মু-ত্রি-ব্ত্সান-পো কম বয়সে মারা যান। খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান ৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনের উত্তরাধিকার তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মু-নে-ব্ত্সান-পোকে দিয়ে যান।[২০]:১০১ মু-নে-ব্ত্সান-পোর রাজত্বের সঠিক সময়কাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য যথেষ্ট নয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে তাঁর রাজত্ব মাত্র দেড় বছর টিকে ছিল। আবার অনেকে মনে করেন যে তিনি ৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। [১১]:৪৬মু-নে-ব্ত্সান-পোর স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ফোয়োংসার সৌন্দর্য্যে ঈর্ষান্বিত সম্রাটের মাতা ত্সেফোংসার নির্দেশে মু-নে-ব্ত্সান-পোকে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয়।[২১] মু-নে-ব্ত্সান-পোর কোন সন্তান না থাকায় তাঁর পরবর্তী ভাই মু-তিগ-ব্ত্সান-পো সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। কিন্তু এক বর্ষীয়ান মন্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে মু-তিগ-ব্ত্সান-পোকে ভুটান সীমান্তের নিকটে ল্হোডাক খার্চুতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। [১১]:৪৭ এর ফলে ৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে মু-নে-ব্ত্সান-পোর কনিষ্ঠ ভ্রাতা খ্রি-ল্দে-স্রোং-ব্ত্সান তিব্বতের পরবর্তী সম্রাট হন।[৮][১১]:৪৮[১৯]:৪৪[২০]:১৩১
নবম শতাব্দীর প্রথমার্ধ
সারাংশ
প্রসঙ্গ
খ্রি-ল্দে-স্রোং-ব্ত্সানের আমলে তিব্বতী সৈন্যরা পশ্চিমদিকে আরবদের আক্রমণ অব্যাহত রাখেন ও তাঁরা সমরকন্দ অবরোধ করেন। তুর্কিস্তানের তিব্বতী শাসক আরব খালিফা আল মামুনকে মূল্যবান রত্নে সজ্জিত সোনার মূর্তি উপহার দেন।[১১]:৪৮ ৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে খ্রি-ল্দে-স্রোং-ব্ত্সানের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র গ্লাং-দার-মা বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী হওয়ায় তাঁকে রাজ্যভার না দিয়ে কনিষ্ঠ পুত্র খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়।[১১]:৪৮
তিব্বত সাম্রাজ্য খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানের শাসনকালে সর্বাধিক বিস্তারলাভ করে। এই সময় তিব্বতী সেনাবাহিনী চীন ও নেপালের কিছু অংশ ছাড়াও খোটান, বালটিস্তান, ব্রুঝা, হুঞ্জা, ঝাংঝুং, ইয়ুগুর, কামিলং[২২]:১৭, জিনজিয়াং ও গানসু অধিকারে আনে।[২৩] খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানের সেনাপতি ঝাং-'ব্রো-স্তাগের সামরিক নেতৃত্বে তিব্বত সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করতে থাকে। ৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উইঘুর খাগানাতের রাজধানী ওর্দু বালিক এবং ৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনা শহর ইয়ানঝৌ আক্রমণ করেন।[২]:১৬৫-১৬৭[৮]:১৫০ ৮২১ খ্রিষ্টাব্দে ঝাং-'ব্রো-স্তাগ চীনাদের প্রচন্ডভাবে আক্রমণ করে তাঁদের শান্তিস্থাপনে বাধ্য করেন।[২২]:১৮ তিব্বতীরা উইঘুর খাগানাত ও নানঝাও রাজ্যের সাথেও শান্তি স্থাপন করেন।[২]:১৫০,১৫১
তিব্বতী প্রবাদানুসারে দুই বোন ধর্মাবলম্বী মন্ত্রীর খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানকে হত্যা করে তাঁর বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী ভাই গ্লাং-দার-মাকে সিংহাসনে বসান।[১১]:৫১ আবার কোন কোন মতে, মালদ্রো মন্দিরের সিঁড়ি থেকে দুর্ঘটনাবশতঃ পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে জিন ট্যাংশু গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রোগগ্রস্ত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে।[২৪] দুনহুয়াং থেকে প্রাপ্ত একটি পুঁথিতে সম্রাট খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানেরখ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সানের আরোগ্য কামনার একটি প্রার্থনা লিপিবদ্ধ থাকায় সর্বশেষ তত্ত্বটি সম্বন্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়।[২৫] ঝু জি (১১৩০-১২০০) দ্বারা রচিত টোংকিয়ানকাংমু নামক গ্রন্থে উল্লিখিত আছে যে, সম্রাট তাঁর রাজত্বকালের বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকতেন এবং ৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।[২৬]:৪৭১ টোংকিয়ানকাংমু[২৬]:৪৭২ ও জিন ট্যাংশু গ্রন্থে ৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের উইঘুর খাগানাতের[২৭] এক মহামারীর কথারও উল্লেখ রয়েছে।
কথিত আছে, পরবর্তী তিব্বত সম্রাট গ্লাং-দার-মা তিব্বত সাম্রাজ্যে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে দ্বিমত রয়েছে।[২৮][২৯] পদ্মসম্ভবের পঁচিশজন শিষ্যের মধ্যে একজন ল্হা-লুং-দ্পাল-গ্যি-র্দো-র্জে বৌদ্ধ ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে গ্লাং-দার-মাকে হত্যা করেন। [২]:১৬৮[২০]:৭১ গ্লাং-দার-মার মৃত্যুর পর দুই স্ত্রীর দুই পুত্র য়ুম-ব্র্তান এবং ওদ-স্রুং সাম্রাজ্যের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করলে তিব্বত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে।[২০]:৭১
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার
সারাংশ
প্রসঙ্গ
স্রোং-ব্ত্সন-স্গাম-পোর রাজত্বে তিব্বতে প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম প্রবেশ করে। তিনি লাসা শহরে জোখাং সহ বহু বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন।[১৮]:৭৫[৩০] লাসা শহরকে তিনি সুসজ্জিত করে রাজধানীর মর্যাদা দেন। [৩১][৩২] এছাড়াও নেদংয়ের খ্রা-ব্রুগ বৌদ্ধবিহার তিনি নির্মাণ করান। তাঁর আমলে প্রথম বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করা শুরু হয়। [৩৩]
৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান ই-চৌ অঞ্চলে কোরীয় চান গুরু কিম হো-শাংয়ের নিকটে একটি দলকে পাঠালে সিচুয়ান শহরে কিম হো-শাংয়ের কাছ থেকে তিনটি চীনা বৌদ্ধ পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। [৩৪] ৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট চীনে দ্বিতীয় দল পাঠান। স্বা পরিবার গোষ্ঠীর গ্সাল-স্নানের নেতৃত্বে এই দল ই-চৌ অঞ্চলে চেংদুর পাও টাং বৌদ্ধবিহারের প্রতিষ্ঠাতা চান গুরু পাও-টাং ঊ-চুর (চীনা: 無住) নিকট হতে বৌদ্ধ শিক্ষা নিয়ে আসেন। [৩৪] খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সানের আমন্ত্রণে ভারত থেকে শান্তরক্ষিত, পদ্মসম্ভব ও বিমলমিত্র তিব্বত গমন করে সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শান্তরক্ষিত ও পদ্মসম্ভব সম-য়ে বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন, শান্তরক্ষিত ও বিমলমিত্র সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মগুলি অনুবাদ করেন। [২০]:৬৬ সম্রাট খ্রি-স্রোং-ল্দে-ব্ত্সান সম-য়ে বৌদ্ধবিহারে ৭৯২ থেকে ৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই বছর ব্যাপী লাসা পরিষদ নামে এক ধর্মীয় বিতর্কসভার আয়োজন করেন। এই বিতর্ক চৈনিক বৌদ্ধধর্মের প্রতিভূ হিসেবে চান গুরু হেশাং মোহেয়ান এবং ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রতিভূ হিসেবে শান্তরক্ষিতের শিষ্য কমলশীলের মধ্যে সংগঠিত হয়। বিতর্কের শেষে কমলশীল বিজয়ী ঘোষিত হলে তিব্বতে চীনা বৌদ্ধ ধর্মের পরিবর্তে ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার হয়।[২০]:৬৬
খ্রি-গ্ত্সুগ-ল্দে-ব্র্ত্সান তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারকারী তিনজন ধর্মরাজার মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি নেপাল, চীন, কাশ্মীর ও খোটান থেকে বহু কারিগর, পণ্ডিত ও অনুবাদককে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন। তিনি বহু সংস্কৃত শব্দের তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করার কাজে উৎসাহ প্রদান করে বহু তিব্বতী সাহিত্য ও অনুবাদকর্মের সৃষ্টিতে সহায়তা করেন।[১০]:২৯৬,২৯৭[১১]:৪৯ সমস্ত অনুবাদ সংস্কৃত থেকে করার জন্য তিনি নির্দেশ জারী করেন।[৩৫] তিনি 'উ-শাং-র্দো নামক স্থানে নয়তল বিশিষ্ট মন্দির নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের নিচের তিনটি তল পাথরের, মাঝের তিনটি তল ইটের ও ওপরের তিনটি তল কাঠ দিয়ে তৈরী হয়েছিল। এর ছাদটি ছিল সোনা দিয়ে তৈরী। এর ওপরের তিনটি তলায় বৌদ্ধ পুঁথি, চোর্তেন ও চিত্রকলা দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল।[১০]:২৯৬,২৯৭[৩৬]
পাদটীকা
- At that time, Tufan obtained Yangtong, Dangxiang as well as other Chiang people tribal territories. To the east it extended to Liangzhou, Songzhu, and so forth, and to the south it extended to India. On the west they attacked and took over four military governments such as Guici (Kucha), Sule (Kashgar), and so forth, while to the north they extended as far as over 10,000 li to the Tujue (Turks) area. Since the Han and the Wei dynasties, the western barbarians had seen no prosperity comparable to these days' prosperity."[৮]:১৯
তথ্যসূত্র
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.