Loading AI tools
বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ছিদ্দিক আহমদ (১৯০৩[lower-alpha 1] — ১৯ মে ১৯৮৭) একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, বাগ্মী, বিতার্কিক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের মহাসচিব ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অসাধারণ বাগ্মীতার কারণে তিনি খতিবে আজম বা বড় বক্তা উপাধি পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী তাকে ২২ মাস বিনাবিচারে কারাগারে বন্দী করা হয়েছিল। কারা অভ্যন্তরে কোনোরূপ সহায়ক গ্রন্থের সাহায্য ছাড়াই তিনি ৮ খণ্ডে শানে নবুয়ত রচনা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে স্বাধীন উত্তর ইসলামি রাজনীতির সূচনাকারী ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
খতিবে আজম, মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ | |
---|---|
নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি | |
অফিসে ১৯৬৫ – ১৯৮৭ | |
পূর্ব বাংলা আইনসভার সদস্য | |
অফিসে ১৯৫৪ – ১৯৫৪ | |
আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস | |
অফিসে ১৯৬৬ – ১৯৮৩ | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | ১৯০৩ |
মৃত্যু | ১৯ মে ১৯৮৭ ৮৩–৮৪) | (বয়স
সমাধিস্থল | ফয়জুল উলুম মাদ্রাসার কবরস্থান, চকরিয়া |
ধর্ম | ইসলাম |
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
সন্তান | ৭ |
পিতামাতা |
|
জাতিসত্তা | বাঙালি |
যুগ | আধুনিক |
আখ্যা | সুন্নি |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
আন্দোলন | দেওবন্দি |
প্রধান আগ্রহ | হাদীস, ফিকহ, লেখালেখি, তাসাউফ, রাজনীতি |
উল্লেখযোগ্য কাজ |
|
যেখানের শিক্ষার্থী | |
আত্মীয় | আ ফ ম খালিদ হোসেন (জামাতা) |
মুসলিম নেতা | |
যার দ্বারা প্রভাবিত | |
যাদের প্রভাবিত করেন | |
পুরস্কার | নিচে দেখুন |
ছিদ্দিক আহমদ ১৯০৩ সালে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বড়ইতলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ মুহাম্মদ ওয়াজিহুল্লাহ ও মা যোবায়দা খাতুন। দাদা মুহাম্মদ আব্দুল আলিম ও নানা আলাউদ্দিন, উভয়ই মিয়াজি [lower-alpha 2] নামে পরিচিত ছিলেন।[1]
ছিদ্দিক আহমদ কুরআন ও বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মাওলানা নাদেরুজ্জামানের কাছে। তারপর তিনি বড়ইতলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত, গৃহ শিক্ষকের নিকট পঞ্চম শ্রেণি ও চকরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যায়নের পর সাতকানিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি খিলাফত আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে তিনি চকরিয়া সাহারবিল সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি ব্যাকরণের প্রাথমিক বইগুলো সমাপ্ত করেন।[1]
এরপর তিনি আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে মিশকাত জামাত (স্নাতক) সমাপ্ত করে ১৯২৬ সালে তিনি মাজাহির উলুম, সাহারানপুরে চলে যান। এখানে তিনি দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সমাপ্ত করেন এবং তাফসীর ও ইসলামি আইনের উচ্চতর বিভাগে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে তিনি আরও উচ্চতর পড়াশোনা করেন।[2]
মাজাহির উলুম, সাহারানপুরে অধ্যয়নকালে অসুস্থতার কারণে একবার দ্বিতীয় হওয়া ব্যতীত ছাত্র জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।[1]
মাজাহির উলুম, সাহারানপুরের বার্ষিক পরীক্ষার সময় শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি ঘোষণা দেন, “যে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করবে তাকে এক সেট বজলুল মাজহুদ [lower-alpha 3] উপহার দেওয়া হবে। তিনি ভারত, পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানের ছাত্রদের পরাভূত করে এই পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৮১ সালে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভির সাথে মদিনায় তার সাক্ষাৎ হয়, শায়খুল হাদিস তাকে স্ব-লিখিত সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ উপহার দেন।[1]
উপমহাদেশে তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে: শাহ আব্দুল ওয়াহহাব, মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ [3], ইজাজ আলী আমরুহী, ইব্রাহিম বলিয়াভী, মুফতি মুহাম্মদ শফি, কারী মুহাম্মদ তৈয়ব, শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভি, জামিল আহমদ থানভী সহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তি।[4]
শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর ১৯৩০ সালে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে হাদিসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে কিছুদিন সহকারী মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৪৫ সালে তিনি চকরিয়া শাহারবিল আনওয়ারুল উলুম মাদ্রাসায় যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি চকরিয়া কাকারা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় চলে যান। ১৯৫৩ সালে তিনি নিজ গ্রাম বড়ইতলীতে মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহর নামে “ফয়জুল উলুম মাদ্রাসা” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি এই মাদ্রাসায় ছিলেন। ১৯৬৬ সালে আজিজুল হকের আহ্বানে তিনি আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার অনুবাদ ও রচনা বিভাগের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি শায়খুল হাদিস হিসেবে পদোন্নতি পান।[5] ১৯৬৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত প্রায় ১৭ বছর আমৃত্যু এই পদে ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের প্রায় চার বছর সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত জামিয়া পটিয়ার শিক্ষা সচিব ছিলেন।[1][4]
শিক্ষকতা জীবনে তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
তিনি প্রথমে মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহর কাছে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেন এবং খেলাফত প্রাপ্ত হন। তিনি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় খলিফা[lower-alpha 4] ছিলেন।[4] এছাড়াও তিনি আসগর হুসাইন দেওবন্দি ও সাতকানিয়ার আহমদুর রহমান থেকে খেলাফত পেয়েছিলেন।[1]
তিনি মাজাহির উলুম, সাহারানপুরে অধ্যায়নকালে আশরাফ আলী থানভীর সান্নিধ্যে যেতেন। দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপ্তির পর ৪০ দিন তার সান্নিধ্যে ছিলেন এবং বায়আত হয়েছিলেন।[1]
তার শিষ্যদের মধ্যে রয়েছে জিরি মাদ্রাসার ভূতপূর্ব মহাপরিচালক মুফতি নুরুল হক।[1]
সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে পাঠ বন্ধ করে তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এ সময় তিনি খিলাফত আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। ১৯৪০ সালে হুসাইন আহমদ মাদানির নেতৃত্বাধীন জমিয়ত উলামায়ে হিন্দে যোগদানের মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।[1]
১৯৪৮ সালে তিনি ও আশরাফ আলী ধরমণ্ডলী কলকাতায় হুসাইন আহমদ মাদানির সাক্ষাৎ লাভ করেন। মাদানি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে পাকিস্তানে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শ দেন।[1]
১৯৫২ সালে তিনি শাব্বির আহমদ উসমানির নেতৃত্বাধীন দিন জমিয়ত উলামায়ে ইসলামে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা আইনসভা নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পান। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট তার মনোনয়ন বাতিল করে দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কক্সবাজার-মহেশখালী-কুতুবদিয়া থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।[1] ১৯৫৫ সালে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে কিছুদিন গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। প্রায় চার বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬২ সালে তিনি সহ-সভাপতি ও ১৯৬৫ সালে সভাপতির দায়িত্ব পান।[2] ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যর্থ হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে তিনি প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন না। পরবর্তীতে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে আটটি ইসলামি দল মিলে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ। তিনি এই দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে এই জোট ভেঙে যাওয়ার পর মৃত্যু অবধি তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ছিলেন।[1][2]
স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেছিলেন। “শুধুমাত্র একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে আমি খোদার আইন প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকবে ভিন্ন জনের হাতে, আমি নিছক ক্রীড়নকে পরিণত হব। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে ক্ষমতালিপ্সুদের তালিকায় নাম লিখাতে চাই না” এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৭০ সালেও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মুতালিব মালেকের মন্ত্রীসভায় যোগদানের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।[1]
১৯৭২ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার সালাউদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক বড়ইতলী বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২২ মাস বিনা বিচারে আটকে রাখার পর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর মুক্তি দেওয়া হয়। সালাউদ্দিন মাহমুদ গ্রেফতার শব্দটির সাথে দ্বিমত করে বলেন, “তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষীয় হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল মাত্র, তাকে কখনো গ্রেফতার করা হয়নি।” [1]
কারাগারের ভেতরে তিনি আজান দিয়ে জামাতে (দলবদ্ধভাবে) নামাজ আদায় করতেন এবং সাধারণ বন্দীদের কুরআন ও হাদিসের শিক্ষাদানে নিয়োজিত থাকতেন। খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ ও ইসলামি পণ্ডিত হওয়ায় তাকে রাজবন্দীর মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। “আমার অসংখ্য কর্মী, সহযোগী ও ভক্ত কয়েদিদের জেলে রেখে আমি অপেক্ষাকৃত কোন উন্নততর ব্যবস্থাপনায় যেতে পারি না। এটা আমার রাজনৈতিক ও আধ্যাত্বিক দীক্ষার বিপরীত”, এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।[1]
কারাগারে কোনো ধরনের সহায়ক গ্রন্থের সাহায্য ছাড়াই তিনি ৮ খণ্ডে শানে নবুয়ত রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে নবী জীবনের বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।[2]
তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি হওয়া বৈষম্যের অবসান চাইতেন। তবে একটি মুসলিম দেশ ভেঙে দুই টুকরা হয়ে যাবে এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের স্বতস্ফূর্ত সহযোগিতাকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখতেন। যুদ্ধের সময় বহু হিন্দু পরিবারকে তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় ও খাবার প্রদান করেন।[1]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে চারটি মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। এই রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা এক স্তম্ভে বিশ্বাসী। এর পরিপন্থী গুলো বাতিল করা হবে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হবে। অবশিষ্ট গুলি সম্পর্কে জনগণের পছন্দ অনুযায়ী বিবেচনা করা হবে।” [1]
জাতির পিতা শব্দটিকে তিনি বিদআত আখ্যা দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের জাতির পিতা ও শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে তিনি অস্বীকার করেন।[1]
জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিশ্বাস ও আকিদার ক্ষেত্রে তাদের সাথে আমাদের বিরোধ রয়েছে এবং সে মতবিরোধ পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে আমরা সে সকল মতবিরোধকে রাজনীতিতে টেনে আনতে চাইনি। তাছাড়া আমরা মনে করেছিলাম মতবিরোধ তো মওদুদীর সঙ্গে। এরা জামায়াতে ইসলামী করেছে বলে তো আর মওদুদী হয়ে যায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আমাদের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নিজেদের মওদুদী মতবাদের সাচ্চা অনুসারী হিসেবে প্রমাণ করেছে ও প্রচার কাজে নিয়োজিত রেখেছে। তাদের সাথে কৌশলগত বিরোধ এখানে যে, তারা ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনে বিশ্বাসী আর আমরা ইসলামি আদর্শ ও উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।” [1]
রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের আমলে মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ’ ১৯৬১ জারি হয়। তিনি এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। ১৯৬৩ সালের মার্চে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে তিনি বলেন, “ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার বিরুদ্ধে এই আইনটি জোরপূর্বক আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, কুরআনে বিয়ের জন্য বয়সের কোনো পাবন্দি না থাকা সত্ত্বেও আলোচ্যে আইনে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার সম্মতিক্রমে সংঘটিত ব্যভিচারের জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। অথচ শরীয়ত অনুযায়ী বৈধ পন্থায় বিয়ের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এদিকে দ্বিতীয় বিয়ের বিরোধিতা করা হয়, অন্যদিকে নারী-পুরুষের নৈতিকতা বিরোধী অবৈধ মেলামেশার পথে কোনো বাধা নেই। ” [1]
তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি জনসংখ্যাকে আপদ মনে না করে তা জনশক্তিতে রূপান্তরের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে ছিলেন। তার একটি প্রবাদ বাক্য গণমানুষের মুখে প্রচলিত হয়ে যায়, “আগে ডেট কন্ট্রোল করুন, তারপর আমরা বার্থ কন্ট্রোল করব।” [1]
তৎকালীন সময়ে বাংলার ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যে আরবি ও উর্দু ব্যাপকভাবে চর্চিত হলেও বাংলা ও ইংরেজ চর্চা ছিল খুবই সীমিত। তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলা ও ইংরেজি আয়ত্ত্ব করেছিলেন। তিনি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং মুসলিম যুব সমাজকে বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্যের প্রতি উৎসাহিত করতেন। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলা আইনসভায় ৩ ভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকলেও তিনি সব সময় বাংলায় বক্তব্য রাখেন এবং বিতর্কে অংশ নেন।[6] তিনি ‘আঞ্জুমানে তাহাফফুজে ইসলাম’ নামক একটি ইসলামি গবেষণা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উক্ত একাডেমির মাধ্যমে কুরআন ও হাদিস সংবলিত বহু বই প্রকাশ করেছিলেন। আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আজিজুল হক মাতৃভাষায় ইসলামি সাহিত্য চর্চার নিমিত্তে একটি ইসলামি গবেষণা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলে, তিনি একাডেমির পরিচালক নিযুক্ত হন।[6] কওমি মাদ্রাসা সমূহ যেন মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব দেয় সেজন্য কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের এক ইশতেহারে তিনি বলেন, “দারসে নিজামিতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষা দেয়ার গুরুত্ব নেই। এ কারণেই আমাদের কওমি মাদ্রাসা সমূহের ফারেগ (পাশকৃত) ছাত্ররা বিশুদ্ধ বাংলা না বলতে পারে আর না লিখতে পারে! অথচ আমাদের শ্রোতা বা পাঠকগণের অধিকাংশই বাংলা বুঝে। এর ফলে ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য তাবলীগ ও দাওয়াতের পরিধি অধিক থেকে অধিক সংকোচিত হয়ে পড়ছে ”।[7] বাংলা চর্চা, কথ্য ও লিখিত আরবি ভাষার উৎকর্ষের মাধ্যমে মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইসলামি জ্ঞানে পারদর্শী ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে যুগচাহিদার প্রতি সংগতি রেখে তিনি একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করেছিলেন।[8]
পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে তিনি এর বিরুধিতা করেন এবং বিভিন্ন মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এ সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম বলেন, “মাওলানা আতহার আলি, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন, আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া, মৌলভী ফরিদ আহমদ, মাওলানা ছিদ্দিক আহমদসহ গুরুত্বপূর্ণ আলমদের নেতৃত্বে গঠিত নেজামে ইসলাম পার্টি ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করে ”।[6][9] ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জের হযরতনগরে তার রাজনৈতিক দল জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবই ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা প্রসঙ্গে।[10]
তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে তিনি ইসলামের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করার ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেরা বাগ্মীদের অন্যতম।[11] বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করার জন্য তিনি প্রায়শ জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি, শেখ সাদি, মুহাম্মদ ইকবাল ও আকবর ইলাহাবাদীর কবিতা উদ্ধৃত করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও কলা অনুষদের ডিন ড. শাব্বির আহমদ বলেন, “ মহাকবি ইকবালের চর্চা বাংলায় পরিলক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইকবালিয়াতের অন্তনির্হিত যওক সমৃদ্ধ তাড়নার বাণী তিনিই সর্বাধিক সার্থকতার সাথে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মন-মস্তিষ্কে সঞ্চারিত করেন। তত্ত্বসমৃদ্ধ বক্তব্যের মাধ্যমে আত্মার স্বরূপ উঘাটনের লক্ষ্যে প্রাচীন প্রথায় এবং শিক্ষিত তরুণদের জন্য আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ. বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে আসেন জামীর প্রেম, খসরুর পরমাত্মাগত জ্বালা ও রুমির তত্ত্বজ্ঞান। ইকবালের প্রেমাত্না দর্শনে মিঞ্চিত খুদী বা ব্যক্তিসত্তায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি মানসের যােগসূত্র সাধনকর্ম বহুলাংশে আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ.-এর অব্যাহত পরিশ্রমের ফলশ্রুতি স্বরূপ স্বীকৃতিযােগ্য। ” [12]
তার বাগ্মীতার স্বীকৃতিস্বরূপ ফেব্রুয়ারীতে ফেনী আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন মিজান ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় খতিবে আজম ও খতিবে পাকিস্তান উপাধিতে ভূষিত করা হয়।[4]
বাগ্মীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিতার্কিক। ইউসুফ ইসলামাবাদী বিতর্কে প্রায় সময় তার সহযোগী হতেন। তিনি বেরলভিপন্থী সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হককে একাধিক বিতর্কে পরাজিত করেছিলেন।[13] তিনি মোট কতটি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন তা জানা সম্ভব হয়নি। তার মধ্যে রয়েছে:[1]
নং | স্থান | বিষয় | প্রতিদ্বন্দ্বী |
---|---|---|---|
১ | আকিয়াব ও রেঙ্গুন | আল কুরআনের কি অলৌকিক ক্ষমতা আছে? | খাকসার পার্টির জনৈক প্রতিনিধি |
২ | শাহারবিল সিনিয়র মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠ, চকরিয়া | মিলাদ ও কেয়ামের অপরিহার্যতা | কালা সাইয়েদ ( লেবাননী ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান ) |
৩ | বৈলছড়ি, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম | বিদআতের সংজ্ঞা ও স্বরূপ ওহাবী পরিভাষার পটভূমি | সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক |
৪ | ফতেয়াবাদ স্কুল ময়দান | মহিলা কর্তৃক মােরগ জবাইয়ের বৈধতা | সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক |
৫ | মির্জাপুর মােহরী হাট | চিৎকার করে দরুদ পড়া | সৈয়দ মুহাম্মদ আজিজুল হক |
যুগচাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অনৈসলামিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় যুক্তিনির্ভর জবাব দান এবং কর্মীদের মধ্যে সাংগঠনিক চেতনার সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামি আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে স্বীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাক আমলে দৈনিক নাজাত, সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম, আল-হেলাল, জিন্দেগী, সওতুল ইসলাম প্রভৃতি সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন।[13]
তিনি পূর্ব বাংলা আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে নামাজের সময় দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে তিনি সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাদিয়ানীদের মোকাবেলায় তিনি খতমে নবুয়ত নামে একটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।[1][11]
তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি স্বতন্ত্র কয়েকটি বই রচনা করেছিলেন। ‘শানে নবুয়ত’ রচনা করেছিলেন কারা অভ্যন্তরে। এটির খণ্ড সংখ্যা ৮। তার অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে:[13]
তিনি দুটি বিবাহ করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর নাম চেমন আরা বেগম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম শামসুল আরেফা। তিনি সাত ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক।[1]
১৯৮৩ সালের নভেম্বরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় সাড়ে তিন বছর রোগশয্যায় থাকার পর ১৯৮৭ সালের ১৯ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন বড়ইতলীতে দ্বিতীয় পুত্র সোহাইব নোমানীর ইমামতিতে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর তার প্রতিষ্ঠিত ফয়জুল উলুম মাদ্রাসার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫[lower-alpha 5] বছর।[14]
মরণোত্তর তাকে দেওয়া সম্মাননা সমূহের মধ্যে রয়েছে:[14]
২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধীনে ড. জাফর আহমেদ ভূঁইয়ার তত্ত্বাবধানে গবেষক মুহাম্মদ নেছার উদ্দিন কর্তৃক “খতীবে আজম হযরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রা:) ও তার বিপ্লবী চিন্তাধারা ” শীর্ষক এম.ফিল. থিসিস সম্পন্ন হয়েছে।[15] ২০১১ সালে ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন “ খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ: একটি যুগ বিপ্লব উৎস ” নামে একটি জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন।[16] তার স্মরণে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন সমূহের মধ্যে খতিবে আজম গবেষণা পরিষদ অন্যতম। বহুমুখী কর্মের পাশাপাশি এটি প্রতি বছর খতিবে আজম স্মৃতি বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করে।[17][18]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.