Loading AI tools
হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর চতুরানন রূপ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি (সিংহলি: වෛකුන්ථ චතුර්මූර්ති) বা বৈকুণ্ঠ বিষ্ণু হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর চতুরানন রূপ। প্রধানত কাশ্মীরে (ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাংশে) এই রূপে বিষ্ণুপূজা প্রচলিত। এই মূর্তিটি পরমেশ্বর-রূপী বিষ্ণুর প্রতীক। বৈকুণ্ঠ চতুর্মুখের চারটি মস্তকের একটি মানুষের, একটি সিংহের, বরাহের (বন্য শূকর) ও দৈত্যের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই মূর্তিতে তিনটি মস্তক দেখা যায়। সেখানে দৈত্যের মুখটি বাদ দেওয়া হয়। তবে তিন মস্তকবিশিষ্ট বিষ্ণুমূর্তিকেও বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির প্রতীক বলে গণ্য করা হয়। মূর্তিতত্ত্ব-বিষয়ক শাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি অষ্টভূজ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর চতুর্ভূজ মূর্তি নির্মিত হয়েছে। সাধারণত বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি দণ্ডায়মান অবস্থায় প্রদর্শিত হলেও কোনও কোনও মূর্তিতে তাঁকে তাঁর বাহন গরুড়ের পৃষ্ঠে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়।
চতুরানন বিষ্ণুর ধারণাটি প্রথম উল্লেখ রয়েছে হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে। তবে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির সম্পূর্ণ মূর্তিতত্ত্ব প্রথম পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত পঞ্চরাত্র শাস্ত্রে। এই মূর্তিতে গুপ্ত ও গান্ধার স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব লক্ষিত হয়। একটি ব্যাখ্যা অনুসারে, এই মূর্তির পশুমস্তকগুলি বিষ্ণুর দুই অবতার নৃসিংহ ও বরাহের প্রতীক। পঞ্চরাত্র শাস্ত্রভিত্তিক অপর একটি তত্ত্ব এই মূর্তির চারটি মস্তককে "চতুর্ব্যূহ" ধারণাটির সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই চতুর্ব্যূহ হলেন বিষ্ণুর চার "ব্যূহ" বা প্রকাশিত রূপ বাসুদেব (কৃষ্ণ), সঙ্কর্ষণ (বলরাম), প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে কাশ্মীরে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তিকে কেন্দ্র করে একটি "কাল্ট" গড়ে ওঠে। খাজুরাহোর লক্ষ্মণ মন্দির দেখে মনে হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মধ্য ভারতের চন্দেল রাজ্যেও তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল।
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যথা: "বৈকুণ্ঠ",[1][2] "বৈকুণ্ঠনাথ" (বৈকুণ্ঠের অধিপতি),[1] "চতুর্মূর্তি" (চতুর্বিধ প্রকাশ),[3] "চতুরানন" (চার মস্তকবিশিষ্ট),[4] "পরাবাসুদেব নারায়ণ",[5] "বিষ্ণু চতুর্মুখী", "বিষ্ণু চতুরানন" ও "বৈকুণ্ঠ চতুর্মুখী" (চতুরানন বৈকুণ্ঠ)।[2] বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে এই মূর্তিটিকে বলা হয়েছে "বিষ্ণু-বৈকুণ্ঠ"।[6] বিষ্ণুর "ব্যূহ" বা প্রকাশিত মূর্তির প্রতীক হিসাবে এই রূপটিকে "চতুর্ব্যূহ"ও বলা হয়।[3]
বৈকুণ্ঠ বলতে সাধারণত বিষ্ণুর বাসস্থানকে বোঝায়। কিন্তু মহাভারত ও পুরাণে এই শব্দটি বিষ্ণুর গুণবাচক একটি বিশেষ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে।[7] "বৈকুণ্ঠ" শব্দটির সুস্পষ্ট কোনও ব্যুৎপত্তিগত অর্থ জানা যায় না। তবে মনে করা হয়, শব্দটি এসেছে "বি-কুণ্ঠ" (অর্থাৎ "যা নীরস বা স্থূল নয়") শব্দটি থেকে। বেদ, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদের মতো প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থগুলিতে এই শব্দটি দেবরাজ তথা সেই যুগের সর্বোচ্চ দেবতা ইন্দ্রের বিশেষণ হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে। মহাভারতের যুগে ইন্দ্রের ভূমিকাটি গ্রহণ করেন বিষ্ণু এবং সেই সঙ্গে "বৈকুণ্ঠ" বিশেষণটিও বিষ্ণুর উপর প্রযুক্ত হয়। বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি নামের মধ্যে "বৈকুণ্ঠ" শব্দটির ব্যবহার ইঙ্গিত করে যে এই রূপটি বিষ্ণুর পরব্রহ্ম (পরম সত্য) সত্ত্বার প্রতীক।[8]
"বিষ্ণু সহস্রনাম" স্তোত্রেও "চতুর্মূর্তি" নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[9]
পঞ্চরাত্র জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির চারটি মুখের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থ অনুসারে, এই চারটি মস্তক হল বৈকুণ্ঠ, নৃসিংহ, বরাহ ও কপিল। এছাড়া এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির চার হাতে বিষ্ণুর অস্ত্রগুলিই থাকে। যথা: শঙ্খ (শাঁখ), সুদর্শন চক্র, কৌমোদকী (গদা) ও পদ্ম।[10] বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তিকে অষ্টভূজ ও চতুরানন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর মানব ("নর" অর্থাৎ মানব, অথবা "সৌম্য" অর্থাৎ শান্ত অথবা "পুরুষ") মুখটি পূর্বমুখী; সিংহ (নৃসিংহ অবতার) মুখটি দক্ষিণমুখী (বাঁদিকের ডান মস্তকটি); বরাহ মুখটি উত্তরমুখী (ডানদিকের বাঁ মাথাটি) এবং দৈত্যাকার ("কপিল" বা "রৌদ্র" অর্থাৎ হিংস্র/ভয়ংকর অথবা "রাক্ষস") মুখটি পশ্চিমমুখী (সম্মুখবর্তী)।[3][11][12][13]
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির প্রাচীনতম মূর্তিগুলির একটি গুপ্ত যুগের। আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর এই মূর্তিটি বর্তমানে মথুরা সংগ্রহালয়ে রক্ষিত। এই মূর্তিতে বরাহ ও সিংহের মস্তক দু’টি রয়েছে বিপরীত ক্রমে। যদিও এটি একটি দুর্লভ ব্যতিক্রম।[14] সামনের কেন্দ্রীয় মুখটি হাস্যরত অবস্থাতেও থাকতে পারে।[13] কখনও কখনও পিছনের মুখটি বাদ দেওয়া হয়।[15] চতুর্থ মস্তকটি অনেক ক্ষেত্রে ঘোড়ার (বিষ্ণুর হয়গ্রীব অবতার) অথবা চক্রপুরুষের (সুদর্শন চক্রের মূর্ত রূপ) হয়ে থাকে।[12][16] "কপিল" মস্তকে গোঁফ, বিরাট স্ফীত চোখ, তৃতীয় নয়ন, হাস্যরত দাঁত, লম্বা তীক্ষ্ণ দাঁত, ছোটো থুতনি, চওড়া ভুরু এবং একটি হিংস্র, নির্মম কিংবা বিষণ্ণ অভিব্যক্তি থাকতে পারে। তাঁর মাথায় সাধারণত ঋষিদের মতো জটা দেখা যায়। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁর মূর্তিতে মুকুট দেখা যায়।[4][14][17]
কপিলরূপী চতুর্থ মস্তকটিকে দুই ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। "কপিল" শব্দের আক্ষরিক অর্থ লাল। সেই কারণে এই রূপটিকে উগ্র বা ক্রুদ্ধ রূপ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। আদি প্রামাণ্য শাস্ত্রগুলিতে এই বিশেষণটি প্রযুক্ত হত অগ্নি ও সূর্যের ক্ষেত্রে।[18] অপর ব্যাখ্যা অনুসারে, বিষ্ণুর ঋষি অবতার কপিল ছিলেন সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক। কথিত আছে, কোপন স্বভাবের কপিল তাঁকে অপমান করার অপরাধে রাজা সগরের পুত্রদের ভস্ম করে দেন। জটাজুট কপিলের ন্যায় ব্রাহ্মণ ঋষিরই বৈশিষ্ট্য। অগ্নিপুরাণে এই মূর্তিটিকে চতুরানন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সেখানে প্রত্যেকটি মস্তকের প্রকৃতি বর্ণিত হয়নি। অপরাজিতাপৃচ্ছ ও রূপমণ্ডন নামে মূর্তিতত্ত্ব-সংক্রান্ত দু’টি বইতে যথাক্রমে চতুর্থ মস্তকটিকে "শ্রী" (বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী) ও "স্ত্রী" (নারী) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও কোনও ভাস্কর্যেই চতুর্থ নারী মস্তক আবিষ্কৃত হয়নি।[19] পিছনের মস্তকটি তিনটি কেন্দ্রীয় মস্তকের পিছনে জ্যোতিশ্চক্রের উপর খোদিত অবস্থায় থাকতে পারে অথবা জ্যোতিশ্চক্রের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাটিতেও থাকতে পারে।[4][14]
অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরের মূর্তিতত্ত্বে হিন্দু ত্রিদেব ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের প্রত্যেকেরই তিনটি করে মস্তক বর্ণিত হয়েছে। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান আর্ট মিউজিয়ামে প্রদর্শিত একটি ভাস্কর্যে চতুরানন ব্রহ্মার সঙ্গে তিন মস্তকবিশিষ্ট শিবের মূর্তি দেখা যায়। এই মূর্তিতে বিষ্ণুকে দেখানো হয়েছে তিনটি দৃশ্যমান মস্তকবিশিষ্ট চতুরানন রূপে।[15]
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি সাধারণত দণ্ডায়মান অবস্থায় প্রদর্শিত হয়। তিনি বহুমূল্য বস্ত্র পরিধান করেন (ভাস্কর্যে সাধারণত শুধুমাত্র একটি ধুতি থাকে[14]) এছাড়া মুকুট, বাজুবন্ধ, মণিহার ইত্যাদি অলংকারও থাকে, যা রাজকীয় প্রকৃতির পরিচায়ক। এছাড়া থাকে একটি যজ্ঞোপবীত।[20] তিনি অষ্টভূজ। শাস্ত্রমতে তাঁর বাঁদিকের চারটি হাতে থাকে গদা, তরবারি, তির ও সুদর্শন চক্র এবং ডানদিকের চার হাতে থাকে শঙ্খ, ঢাল, ধনুক ও পদ্ম।[1] যদিও শাস্ত্রে প্রায়শই তাঁকে চতুর্ভূজ রূপে বর্ণা করা হয়েছে।[3][19] এই রূপে তাঁর দুই হাতে থাকে পদ্ম ও শঙ্খ; অপর দুই হাত ডান দিকে গদাদেবী বা গদানারী (গদার নারীমূর্তি) এবং বাঁদিকে চক্রপুরুষের মস্তকে স্থাপিত অবস্থায় থাকে। এঁরা দুই জন হলে তাঁর অস্ত্রের মূর্তরূপ বা "আয়ুধপুরুষ"। এই খর্বাকৃতি মূর্তিগুলি তাঁর পায়ের দুই পাশে দণ্ডায়মান অবস্থায় থাকে। তাঁরা উপরের দিকে তাকিয়ে চামর ব্যজন করছেন। ভূদেবীর (বরাহ ও বিষ্ণুর স্ত্রী রূপে কথিত) একটি ক্ষুদ্র মূর্তি বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির দুই পায়ের ফাঁকে বেদির উপর দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখে মনে হয় তিনি দেবতার ভার ধারণ করে আছেন। দেবতার কোমরবন্ধনীতে ডানদিকে ছোরা বা তরবারি ঝোলানো থাকে। এটি কাশ্মীরি মূর্তিগুলির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। কোনও কোনও মূর্তির বিষ্ণুর পাশে বা নিচে অনুচর বা ভক্তদের মূর্তিও থাকে।[4][14][21] কোথাও আবার ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর দশ অবতারকেও পশ্চাদপটে দেখা যায়।[14]
জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে, বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি তাঁর বাহন গরুড়ের উপর উপবিষ্ট অবস্থা্তেও থাকতে পারেন।[1][10] কিন্তু এই ধরনের মূর্তি বিরল। এই ধরনের মূর্তিতে দেবতার হাতে থাকে তরবারি, পদ্ম, গদা অথবা শঙ্খ এবং চক্র। সাধারণত, গরুড়ের চারটি পালকের উপর চারটি নারীমূর্তি থাকে; বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির দুই ধারে দুই জন করে। এই নারীমূর্তিগুলির পরিচয় অস্পষ্ট। এঁদের দু’জনকে দুই দেবী (সম্ভবত বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী ও ভূমি) এবং অপর দুই জনকে দুই সহচরী বলে ব্যাখ্যা করা হয়।[22] জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির সহচরী হিসাবে লক্ষ্মী, কীর্তি, জয়া ও মায়া এই চার দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।[23] খুব অল্প ক্ষেত্রেই বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির সঙ্গে তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে দেখা যায়। তিনি দেবতার বাম উরুর উপর বসে থাকেন। জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থে এই রূপটিকে বলা হয়েছে "লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠ"।[24]
কয়েকটি বিরল ক্ষেত্রে মূর্তিতত্ত্ব-সংক্রান্ত বিবরণগুলির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির অষ্টভূজ মূর্তি নির্মিত হয়েছিল। খাজুরাহোর কেন্দারিয়া মহাদেব মন্দির, গুজরাতের সান্দেরার সিদ্ধান্ত মহাদেব মন্দির ও ঝালওয়ার সংগ্রহালয়ে এই ধরনের মূর্তি দেখা যায়।[25] নাগদার সসবাহু মন্দিরে একটি দশভূজ বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি বিগ্রহ পাওয়া গিয়েছে। মূর্তিতত্ত্ব-সংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে দ্বাদশভূজ বৈকুণ্ঠ বিগ্রহকে "অনন্ত" নামে একটি পৃথক শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। চাম্বার ব্রহ্মৌরে লক্ষণা দেবী মন্দিরে এই রকম একটি চিত্র পাওয়া গিয়েছে। এই মূর্তিটি বিষ্ণুর বিশ্বরূপ মূর্তিরই সমতুল্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বৈকুণ্ঠ মূর্তির অপর একটি ষোড়শভূজ রূপান্তরকে বলা হয় "ত্রৈলোক্যমোহন"।[26]
কোনও কোনও ভাস্কর্যে বিষ্ণুর অন্যান্য রূপের সঙ্গে বৈকুণ্ঠ রূপটিকে সংশ্লেষিত করা হয়েছে। চাম্বা থেকে প্রাপ্ত ১১৭০ খ্রিস্টাব্দের একটি ভাস্কর্যে শেষশায়ী বিষ্ণুর (শেষনাগের উপর শায়িত বিষ্ণু) বৈকুণ্ঠ রূপের তিনটি মস্তক দেখা যায়। উদয়পুরের মারকুলা দেবী মন্দিরের একটি ভাস্কর্যে ত্রিবিক্রমের (বিষ্ণুর বামন অবতার) মূর্তিতে বৈকুণ্ঠের তিনটি মস্তক দেখা যায়।[25]
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। এই গ্রন্থে এই রূপটিকে বলা হয়েছে "মূর্তিচতুষ্টয়"। কিন্তু চতুরানন ছাড়া মহাভারতে বিস্তারিত মূর্তিতত্ত্ব পাওয়া যায় না।[10] মূর্তিতত্ত্বের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থে। এটিকে সাধারণভাবে গুপ্ত যুগের (আনুমানিক খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী) গ্রন্থ মনে করা হয়।[27]
গুপ্ত যুগে নির্মিত মথুরা শৈলীর তিন মস্তকবিশিষ্ট বিষ্ণুমূর্তি আবিষ্কৃত হলেও সেই যুগের একটিও চতুরানন বিষ্ণুমূর্তি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।[27] এর থেকে গবেষকেরা মনে করে তিন মস্তকবিশিষ্ট বিষ্ণুমূর্তিকেও বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি হিসাবে গণ্য করা হত। সেখানে ভাস্করেরা চতুর্থ মস্তকটি শুধুমাত্র সুবিধার জন্য বর্জন করতেন।[27] আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৬০০-৮৫০ অব্দের মধ্যে রচিত জয়াখ্য-সংহিতা গ্রন্থে আরও একটি তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই তত্ত্ব ইঙ্গিত করে যে, গুপ্ত যুগে তিন মস্তকবিশিষ্ট বিষ্ণুমূর্তি এবং সেই যুগের বিশ্বরূপ (বিষ্ণুর অপর এক রূপ) মূর্তি দুইই অনুপ্রাণিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে কাশ্মীরে বিকশিত হওয়া বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির মূর্তিতত্ত্ব থেকে এবং তিন মস্তকযুক্ত পুরনো বিষ্ণুমূর্তিগুলির পিছনে চতুর্থ মস্তক যুক্ত করা হত।[27] কাশ্মীরে জনপ্রিয় হলেও তার বাইরে চতুরানন মূর্তি কমই দেখা যায়।[4][19]
বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির মূর্তিতত্ত্ব গান্ধার স্থাপত্যশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত। এই স্থাপত্যশৈলী উত্তরপশ্চিম ভারতে, বিশেষ করে কাশ্মীর অঞ্চলে নির্মিত ভাস্কর্যে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।[20] গান্ধার শৈলী অনুযায়ী, ভাস্কর্যের শরীর ও পদযুগল শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ হয়। ভারতীয় ধারণা অনুযায়ী, বিগ্রহের পেশিবহুল শরীর প্রাণ (প্রাণবায়ু) মণ্ডিত হয়। ধনুকের মতো বাঁকানো ভুরু ও পদ্মের আকার বিশিষ্ট চোখ ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য।[20] পায়ের কাছে পৃথিবী দেবীর উপস্থিতিও মধ্য এশীয় প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। আয়ুধপুরুষের মূর্তিটি সম্ভবত গুপ্ত শিল্পকলার বিষ্ণু মূর্তিতত্ত্বের আয়ুধপুরুষ বিগ্রহ থেকে অনুপ্রাণিত।[4] আয়ুধপুরুষ ও পৃথিবী দেবী এক মস্তকবিশিষ্ট বিষ্ণুর ক্ষেত্রেও প্রথাগত মূর্তিতত্ত্বের অংশ।[28]
মধ্যের বিষ্ণু মস্তক এবং দুই পাশে বরাহ ও নৃসিংহের মস্তক সম্ভবত স্থাপত্যের অন্যান্য সজ্জাপদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত। উদাহরণস্বরূপ, বিষ্ণু, বরাহ ও নৃসিংহের মূর্তি মন্দিরের দেওয়ালের পিছনের দিকে (পশ্চিম) এবং দুই পাশে (উত্তর/দক্ষিণ) খোদিত হয়। বরাহ (যিনি একটি কল্পের প্রারম্ভে মহাজাগতিক জলরাশি থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন), বিষ্ণু (মানবরূপী) ও নৃসিংহ (দৈত্য বিনাশকারী) যথাক্রমে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় – হিন্দু বিশ্বতত্ত্বের এই তিন কার্যেও প্রতীক হতে পারে।[29] বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হিসাবে পরমেশ্বর রূপে বিষ্ণুর প্রতীক।[5][20] বরাহ ও নৃসিংহও প্রাচীনতম দুই মূর্তি (হিন্দুশাস্ত্রে মৎস্য ও কূর্ম অবতার দু’টিকে বরাহ ও নৃসিংহের পূর্ববর্তী বলে বর্ণনা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এঁরা পরবর্তীকালে বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন)।[30] বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তিতে তাঁদের উপস্থিতিই ইঙ্গিত করে এই রূপটির উদ্ভব ঘটেছিল গুপ্ত যুগে। কারণ সেই সময় বরাহ ও নৃসিংহ কাল্ট ছিল মধ্যগগনে।[10]
অনেক লেখকই শূকর ও সিংহ মস্তক দু’টিকে বরাহ ও নৃসিংহ অবতারের মস্তক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অন্যেরা এই দুই মস্তককে যুক্ত করেছেন চতুর্বূহের সঙ্গে। যদিও এই দ্বিতীয় মতটি অত্যন্ত বিতর্কিত।[4][13][30] বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে চতুর্বূহকে বিষ্ণুর চার প্রকাশিত রূপ বাসুদেব (কৃষ্ণ), সঙ্কর্ষণ (বলরাম), প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শাস্ত্রে অবশ্য স্পষ্টভাবে দু’টি রূপকে সমান বিবেচনা করা হয়নি। অনেক আধুনিক ভারততত্ত্ববিদ ও পঞ্চরাত্র অনুগামী বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ ও পঞ্চরাত্র ধর্মগ্রন্থে চতুর্ব্যূহের সঙ্গে গুণাবলির সংযোগের ভিত্তিতে তাঁদের দু’জনের মধ্যে সংযোগ সাধন করে থাকেন। অপরপক্ষে গুণগুলিও বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির সঙ্গে সংযুক্ত। মানব মুখটি হল বাসুদেব, যিনি "বল" অর্থাৎ শক্তিমত্তা/ক্ষমতার প্রতীক; সিংহ হলেন সঙ্কর্ষণ, যিনি "জ্ঞান" বা প্রজ্ঞার মূর্ত রূপ; দৈত্যাকার রূপটি হলেন প্রদ্যুম্ন, যিনি "ঐশ্বর্য" অর্থাৎ সমৃদ্ধি/সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং বরাহ হলেন অনিরুদ্ধ বা "শক্তি"র অধিশ্বর।[4][30]
কাশ্মীর ও উত্তরপশ্চিম ভারতে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর পূর্বে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির উপস্থিতিই ইঙ্গিত করে সেই যুগে এই রূপে বিষ্ণুপূজা প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই রূপটিকে কেন্দ্র করে একটি "কাল্ট" গড়ে ওঠে। দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত রাজাবলি রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থেই এই রূপে বিষ্ণুপ্রতিষ্ঠার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই মূর্তি উৎপল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা অবন্তী বর্মনের (রাজত্বকাল: ৮৫৫-৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তাঁর রাজত্বকালে নির্মিত অনেক মন্দিরে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।[31] কাশ্মীরের কারকোটাস ও উৎপল রাজবংশের কুলদেবতা ছিলেন বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তি। কাশ্মীরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতেও এই রূপটি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল।[28]
খাজুরাহোর লক্ষণ মন্দিরটি বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির প্রতি উৎসর্গিত। এখানে দেবতার বিগ্রহ তিন মস্তকবিশিষ্ট হলেও, মন্দিরে উৎকীর্ণ লিপিটি ইঙ্গিত করে এটিকে চতুরানন গণ্য করতে হবে। এই লিপিতে একটি কিংবদন্তির উল্লেখ আছে। উক্ত কিংবদন্তি মতে, কপিল ও অন্যান্য দৈত্যরা নিজেদের শরীর যুক্ত করে দিয়ে একক রূপ ধারণ করেন। ব্রহ্মা তাদের বর দেন যে, সেই রূপের কোনও ব্যক্তিই তাদের হত্যা করতে সক্ষম হবে। তাই বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির রূপ ধারণ করেন।[12][32] খাজুরাহোতে লক্ষ্মণ মন্দিরের উপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে দশম শতাব্দীতে চন্দেল রাজ্যে বৈকুণ্ঠ চতুর্মূর্তির পূজা প্রচলিত ছিল।[24]
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে গুজরাতে বিষ্ণুর ত্রৈলোক্যমোহন রূপটি পূজিত হত।[33]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.