Loading AI tools
প্রাচীন মিশরীয় পৌরাণিক গল্প উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ওসাইরিসের অতিকথা হল প্রাচীন মিশরীয় পুরাণে সর্বাপেক্ষা বিশদ ও প্রভাবশালী উপাখ্যান। এই অতিকথার মূল উপজীব্য বিষয়টি হল মিশরের আদ্যকালীন রাজা তথা দেবতা ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ড ও তার পরিণতিতে ঘটা ঘটনাসমূহ। ওসাইরিসকে খুন করে তার ভাই সেত অন্যায়ভাবে সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। অন্যদিকে ওসাইরিসের স্ত্রী আইসিস তার স্বামীর খণ্ডবিখণ্ড দেহ পুনরায় সংযুক্ত করে তাঁকে মরণোত্তর অবস্থাতেই স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম করে তোলেন। এর ফলে জন্ম হয় ওসাইরিস ও আইসিসের পুত্র হোরাসের। গল্পের অবশিষ্টাংশের কেন্দ্রবিন্দু হোরাস। প্রথমে তিনি ছিলেন নিজের মায়ের দ্বারা রক্ষিত এক দুর্বল শিশু; কিন্তু পরবর্তীকালে সিংহাসনের অধিকার প্রসঙ্গে সেতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। দু’জনের প্রবল সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল হোরাসের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এই বিজয়ের ফলেই সেতের অন্যায় শাসনের অন্তে মিশরে মাত (মহাজাগতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা) পুনঃস্থাপিত হয় এবং ওসাইরিসের পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়াটিও সমাপ্ত হয়।
অতিকথাটি সেটির অন্তর্নিহিত জটিল প্রতীকতত্ত্ব সহ রাজপদ ও উত্তরাধিকার, শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার দ্বন্দ্ব এবং বিশেষভাবে মৃত্যু ও পরকাল-সংক্রান্ত প্রাচীন মিশরীয় ধারণাগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সেই সঙ্গে এই অতিকথাটিতে এর কেন্দ্রীয় চার দেবদেবীর মৌলিক চরিত্র বর্ণনা করেছে। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে এই দেবদেবীদের পূজার অনেক উপাদানই এই অতিকথা থেকে উৎসারিত।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্বিংশ শতাব্দীতে অথবা তার আগেই ওসাইরিসের অতিকথাটি সেটির মূল আকারটি ধারণ করেছিল। এই অতিকথার অধিকাংশ উপাদানের উৎস মিশরীয়দের ধর্মীয় ধ্যানধারণা। কিন্তু হোরাস ও সেতের মধ্যে সংঘর্ষের ধারণাটি সম্ভবত আংশিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল মিশরের আদি রাজবংশীয় বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের আঞ্চলিক সংঘর্ষের ঘটনাগুলি থেকে। এই উপাখ্যান যে ঘটনাগুলির জন্ম দিয়েছিল তার প্রকৃতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন গবেষকগণ। কিন্তু কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি।
এই অতিকথার অংশবিশেষ বিভিন্ন ধরনের মিশরীয় গ্রন্থ, অন্ত্যেষ্টি লিপি, জাদুমন্ত্র, ছোটোগল্প ইত্যাদিতে উল্লিখিত হয়েছে। সেই জন্য এই উপাখ্যানটি অন্যান্য সকল প্রাচীন মিশরীয় অতিকথার তুলনায় অনেক বেশি বিশদ ও সুসংহত আকার ধারণ করেছিল। অথচ কোনও মিশরীয় সূত্রেই অতিকথাটির সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় না। উৎসসূত্রগুলির মধ্যেও ঘটনাগুলি সম্পর্কে বহু বৈচিত্র্যময় পাঠান্তর লক্ষিত হয়। গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে, বিশেষত প্লুটার্কের আইসিস ও ওসাইরিস প্রসঙ্গে রচনাটিতে, অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা সর্বত্র মিশরীয় বিশ্বাসগুলিকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে না। প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে অধিকাংশ জ্ঞানের অবলুপ্তির পরও এই সব রচনার মধ্যে দিয়ে ওসাইরিসের উপকথাটি নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং আজও এটি একটি সুপরিচিত কাহিনি।
ওসাইরিসের অতিকথাটি প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং জনসাধারণের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।[1] এই জনপ্রিয়তার একটি কারণ হল অতিকথাটির প্রাথমিক ধর্মীয় অর্থ, যা ইঙ্গিত করে যে কোনও মৃত ব্যক্তিই এক সুখকর পরলোকে উপনীত হতে পারেন।[2] অপর কারণটি হল এই অতিকথার চরিত্রগণ ও তাঁদের আবেগ অন্যান্য অধিকাংশ মিশরীয় অতিকথার তুলনায় বাস্তব ব্যক্তিত্বদের জীবনের অধিকতর স্মৃতিবাহী, যার আবেদন জনসাধারণ্যে অনেক বেশি ছিল।[3] মিশরতত্ত্ববিদ জে. গাওয়িন গ্রিফিথসের মতে, নির্দিষ্টভাবে বললে ওসাইরিস, আইসিস ও হোরাসের মধ্যে যে সম্পর্ক এই অতিকথায় প্রদর্শিত হয়েছে, তা পারিবারিক বিশ্বস্ততা ও অনুরক্তির এক বলিষ্ঠ ধারণা ব্যক্ত করে।[4]
এই বহুব্যাপী আবেদনের সঙ্গে অতিকথাটি অন্য যে কোনও অতিকথার তুলনায় প্রাচীনতর গ্রন্থগুলিতে এবং মিশরীয় সাহিত্য শৈলীর এক ব্যক্তিক্রমী ধরনের প্রশস্ত ধারায় উল্লিখিত হয়েছে।[1] এই উৎসসূত্রগুলিতে যতটা বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়, তাও সচরাচর ক্ষেত্রে লক্ষিত হয় না।[2] প্রাচীন মিশরীয় অতিকথাগুলি অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট; অতিকথাগুলির অন্তর্নিহিত ধর্মীয় রূপকটি স্পষ্ট আখ্যানভাগটির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।[5] প্রত্যেকটি লিপিতেই একটি করে অতিকথা বা অতিকথার খণ্ডাংশ পাওয়া যায়। এই অতিকথাগুলিকে খাপ খাওয়ানো হত নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের সঙ্গে। তাই বিভিন্ন লিপিতে একই অতিকথার ঘটনাপ্রবাহের পরস্পরবিরোধী পাঠও পাওয়া যায়।[6] ওসাইরিসের অতিকথাই এই রকম বিভিন্ন পন্থায় ব্যবহৃত হয়েছিল বলে এটিতেও প্রায়শই পরস্পরবিরোধী পাঠান্তর লক্ষিত হয়। তা সত্ত্বেও খণ্ডাংশগুলিকে একত্রিত করলে সামগ্রিকভাবে এটিকে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ কাহিনির রূপ দান করা যায়, যা অধিকাংশ মিশরীয় অতিকথার ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।[7]
ওসাইরিসের অতিকথাটির আদিতম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্বিংশ শতাব্দীতে পঞ্চম রাজবংশের শেষভাগে নির্মিত পিরামিডগুলির সমাধিকক্ষের দেওয়ালে চিত্রিত প্রথম অন্ত্যেষ্টি লিপি পিরামিড লিপিগুলিতে। পরস্পর বিসদৃশ মন্ত্র বা "বাচনভঙ্গি"-র সমন্বয়ে লিখিত এই লিপিগুলিতে যে ধারণাগুলি পাওয়া যায়, অনুমিত হয় সেগুলি আরও পূর্ববর্তী যুগের।[8] লিপিগুলির বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট পিরামিডে সমাহিত ফ্যারাওয়ের পরকাল হওয়ায় এগুলিতে প্রায়শই রাজপদ ও পরকালের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ওসাইরিসের অতিকথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।[9] মৃত্যু, ওসাইরিসের অঙ্গ-সংযোজনা ও হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্বের মতো কাহিনির প্রধান উপাদানগুলি পিরামিড লিপির বাচনভঙ্গিগুলিতে পাওয়া যায়।[10] মধ্য রাজ্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০৫৫-১৬৫০ অব্দ) শবাধার লিপি ও নতুন রাজ্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১০৭০ অব্দ) মৃতের বইয়ের মতো পরবর্তীকালে লিখিত অন্ত্যেষ্টি লিপিগুলিতেও এই অতিকথাটির বিভিন্ন উপাদান লক্ষিত হয়।[11]
অন্যান্য ধরনের ধর্মীয় সাহিত্যেও এই অতিকথাটির প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ মধ্য রাজ্যের সাহিত্য নাটকীয় রামেসিয়াম প্যাপিরাস ও আইখেরনোফ্রেত কেন্দ্রস্তম্ভের নাম করা যেতে পারে। প্যাপিরাসটিতে প্রথম সেনুসরেতের রাজ্যাভিষেকের বিবরণ পাওয়া যায়, অন্যদিকে স্টেলাটিতে খোইয়াকের বার্ষিক উৎসবের ঘটনাগুলির পরোক্ষ ইঙ্গিত ধৃত হয়েছে। দুই উৎসবের আচার-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে ওসাইরিসের অতিকথাটির বিভিন্ন উপাদানের পুনরাভিনয় করা হয়েছিল।[12] এই অতিকথাটির সর্বাপেক্ষা সম্পূর্ণ প্রাচীন মিশরীয় বিবরণটি হল অষ্টাদশ রাজবংশের সমসাময়িককালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১২৯২ অব্দ) শিলালিপিতে প্রাপ্ত ওসাইরিসের মহাস্তোত্র। এই লিপিটিতে সমগ্র কাহিনিটির একটি সাধারণ রূপরেখা পাওয়া গেলেও তাতে বিস্তারিত বিবরণ অল্পই ছিল।[13] আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসসূত্র হল মেমফিসীয় ধর্মতত্ত্ব নামে একটি ধর্মীয় আখ্যান, যাতে ওসাইরিসের মৃত্যুর একটি বিবরণ এবং হোরাস ও সেতের বিবাদের একটি সিদ্ধান্তও উল্লিখিত হয়েছে। যে রাজপদকে ওসাইরিস ও হোরাসের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হত তাকে এই আখ্যায়িকায় মেমফিসের সৃষ্টিকর্তা দেবতা পিতাহ্-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।[14] সুদীর্ঘকাল ধরে এই সাহিত্যকর্মটিকে পুরনো রাজ্যের সমসাময়িক (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৬-২১৮১ অব্দ) মনে করা হত এবং অতিকথাটির ক্রমবিকাশের আদি স্তরের তথ্যউৎস হিসেবে বিবেচনা করা হত। যদিও ১৯৭০-এর দশক থেকে মিশরতত্ত্ববিদগণ এটিকে সর্বপ্রাচীন ক্ষেত্রে নতুন রাজ্যের রচনা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।[15]
ওসাইরিসের সম্মানে আয়োজিত আচার-অনুষ্ঠানগুলিও তথ্যের অন্যতম প্রধান সূত্র। নতুন রাজ্য, টলেমীয় যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩-৩০ অব্দ) ও রোমান যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) নির্মিত মন্দিরগুলির দেওয়ালে আচার-সংক্রান্ত এই লিপিগুলির কয়েকটি পাওয়া যায়।[16] এই পরবর্তীকালীন আচার-সংক্রান্ত লিপিগুলির যেগুলিতে আইসিস ও নেফথিসকে তাঁদের ভ্রাতার মৃত্যুতে বিলাপ করতে দেখা যায়, সেগুলিকে অন্ত্যেষ্টি লিপির মধ্যে অভিযোজিত করা হয়েছিল। এই লিপিগুলিতে দুই দেবীর অনুনয়ের উদ্দেশ্য ছিল ওসাইরিসের পুনর্জাগরণ—এবং সেই সূত্রে মৃত্য ব্যক্তিরও—যাতে তিনি আবার জীবন লাভ করতে পারেন।[17]
সকল শ্রেণির মিশরীয়রা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে জাদুমন্ত্রের ব্যবহার করত। এই মন্ত্রগুলিও অতিকথাটির কিছু অংশের গুরুত্বপূর্ণ উৎসসূত্র। এগুলি থেকেই জানা যায় যে, হোরাসের উপর বিষপ্রয়োগ করা হলে অথবা তিনি অন্য কোনওভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে আইসিস তাঁকে আরোগ্যদান করেন। মন্ত্রগুলিতে রোগীকে হোরাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যাতে রোগী দেবীর প্রয়াসের থেকে সুফল অর্জন করতে পারেন। যে প্যাপিরাস অনুলিপিগুলি থেকে মন্ত্রগুলির কথা জানা যায় সেগুলি চিকিৎসা-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশিকার কাজ করত। এই সব মন্ত্র কিপ্পাস নামে পরিচিত এক বিশেষ ধরনের উৎকীর্ণ পাথরের স্টেলা গঠন করত। আরোগ্যপ্রার্থী ব্যক্তিরা এই সব কিপ্পি-র উপর জল ঢালতেন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, লিপি-সংবলিত এই স্টেলাগুলিতে জল ঢাললে সেই জল আরোগ্যদানকারী শক্তি দ্বারা পরিপূরিত হয় এবং সেই জল পান করলে তাদের অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভ সম্ভবপর হয়। মধ্য রাজ্যের যুগ থেকে আচার-মূলক জাদুদণ্ডগুলিতে জাদু দ্বারা রক্ষিত এক বিপণ্ণ শিশুর বিষয়টি উৎকীর্ণ হতে থাকে। কিন্তু এরও বেশ কয়েক শতাব্দী আগে অধিকতর বিশদ আরোগ্যদায়ী মন্ত্রগুলিতে নির্দিষ্টভাবে এই বিষয়বস্তুটিকে ওসাইরিসের অতিকথার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল।[18]
অতিকথার কয়েকটি পর্ব এমন কিছু লেখালিখিতেও নথিবদ্ধ রয়েছে যেগুলি সম্ভবত বিনোদনের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। এই ধরনের সাহিত্যকর্মের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব"। দুই দেবতার মধ্যে সংঘাতের একাধিক পর্ব এই হাস্যরসাত্মক রচনায় পুনর্কথিত হয়েছিল। এটির রচনাকাল বিংশ রাজবংশের রাজত্বকাল (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১৯০-১০৭০ অব্দ)।[19] পুনর্কথনটিতে সংশ্লিষ্ট দেবতাদের চরিত্রগুলি স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। মিশরতত্ত্ববিদ ডোনাল্ড বি. রেডফোর্ডের মতে, "হোরাসকে চিত্রিত করা হয়ে শারীরিকভাবে দুর্বল, কিন্তু চতুর দুষ্ট ভূত-জাতীয় চরিত্র হিসেবে, সেথ [সেত] একজন শক্তিশালী পুরুষ হয়েও সীমিত বুদ্ধির ভাঁড়, রে-হোরাখতি [রা] একজন পক্ষপাতদুষ্ট গোমড়া-মুখো বিচারক এবং ওসাইরিস একজন কঠোর সমালোচক ও স্পষ্টভাষী বদরাগী ব্যক্তি।"[20][21] গল্পটির প্রকৃতি অপ্রতিরূপক হলেও এটিতেই দুই দেবতার সংঘাতের অনেক প্রাচীনতম পর্বই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং অনেক পরবর্তীকালীন বিবরণগুলির অনুরূপে অনেক ঘটনাই একই ক্রমে বিন্যস্ত হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে মূল কাহিনিটি যখন লিখিত হয়েছিল তখনই এই কাহিনির প্রথাগত ঘটনাক্রমটিও তার রূপ গ্রহণ করেছিল।[22]
যে সব প্রাচীন গ্রিক ও রোমান লেখকেরা প্রাচীন মিশরের শেষ পর্যায়ে মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসটিকে বিবৃত করেছেন, তাঁদের লেখাতেও ওসাইরিসের অতিকথার অনেকখানি অংশ নথিবদ্ধ হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হেরোডোটাস তার ইতিহাস গ্রন্থে মিশরের বর্ণনায় এই অতিকথার অংশবিশেষ উল্লেখ করেন। চার শতাব্দী পরে ডায়াডোরাস সিকুলাস তার বিবলিওথিকা হিস্টোরিকা গ্রন্থে অতিকথাটির একটি সার-সংক্ষেপ প্রদান করেন।[23] খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে[24] প্লুটার্ক তার আইসিস ও ওসাইরিস প্রসঙ্গে রচনায় এই অতিকথাটির সর্বাপেক্ষা সম্পূর্ণ প্রাচীন বিবরণটি দিয়েছিলেন।[25] প্লুটার্জের বিবরণের ভিত্তিতেই আধুনিককালের জনপ্রিয় সাহিত্যে প্রায়শই এই অতিকথাটির পুনর্কথন করা হয়ে থাকে।[26] তবে এই সকল ধ্রুপদি সাহিত্যিকের রচনায় মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসের একটি বিকৃত বিবরণ পাওয়াই সম্ভব।[25] উদাহরণস্বরূপ, আইসিস ও ওসাইরিস প্রসঙ্গে রচনায় মিশরীয় বিশ্বাসের এমন অনেক ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যেগুলি প্রভাবিত হয়েছিল গ্রিক দর্শনের বিভিন্ন ধারার দ্বারা এবং অতিকথার বর্ণনায় কিছু কিছু অংশের বিবরণ মিশরীয় প্রথায় পাওয়া যায় না। গ্রিফিথসের মতে, এই বিবরণের বেশ কয়েকটি উপাদান গ্রহণ করা হয়েছিল গ্রিক পুরাণ থেকে এবং রচনাটি সামগ্রিকভাবে সরাসরি মিশরীয় তথ্য উৎসের ভিত্তিতে লেখা হয়নি।[27] অপরপক্ষে গ্রিফিথসের সহকর্মী জন বেইনেস বলেছেন যে, মন্দিরগুলিতে হয়তো অতিকথাটির এমন কিছু লিখিত বিবরণ ছিল যা পরে হারিয়ে যায় এবং এমনও হতে পারে যে প্লুটার্ক তার আখ্যানে সেই সব সূত্রই ব্যবহার করেছিলেন।[28]
উপাখানটির শুরুতে দেখা যায়, ওসাইরিস মিশর শাসন করছেন। তার এই রাজপদ তিনি ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা রা অথবা আতুমের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ওসাইরিসের রানি আইসিস, ওসাইরিস ও তার হত্যাকারী সেত ছিলেন পৃথিবীর দেবতা গেব ও আকাশের দেবী নুটের সন্তান। মিশরীয় তথ্যউৎসগুলিতে ওসাইরিসের রাজত্ব সম্পর্কে অতি অল্প তথ্যই পাওয়া যায়; এগুলির মূল উপজীব্য তার মৃত্যু এবং মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাসমূহ।[29] ওসাইরিসকে যুক্ত করা হয়েছে জীবনদায়ী শক্তি, ন্যায়সম্মত রাজপদ এবং মাত-এর (আদর্শ প্রাকৃতিক বিন্যাস, যার রক্ষণাবেক্ষণ ছিল প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য) শাসনের সঙ্গে।[30] সেতকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করা হয়েছিল হিংসা ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে। সেই কারণে ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ড ছিল শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে সংগ্রাম এবং মৃত্যু দ্বারা জীবন ব্যাহত হওয়ার প্রতীক।[31]
অতিকথাটির কোনও কোনও পাঠে ওসাইরিসকে হত্যার পিছনে সেতের উদ্দেশ্যটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পিরামিড লিপিতে উল্লিখিত একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে, ওসাইরিস একবার সেতকে লাথি মেরেছিলেন; সেত সেই লাথিরই প্রতিশোধ নেন।[32] অন্যদিকে শেষ পর্যায়ের একটি লিপিতে পাওয়া যায় যে, ওসাইরিস নেফথিসের সঙ্গে যৌনসংগম করেছিলেন। নেফথিস ছিলেন জেব ও নুটের চতুর্থ সন্তান তথা সেতের স্ত্রী। সেই কারণেই দুঃখ পেয়েছিলেন সেত।[2] হত্যাকাণ্ডের কথা প্রায়শই পরোক্ষে ইঙ্গিত করা হলেও কখনও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, লিখিত শব্দের এমন ক্ষমতা আছে যা বাস্তবকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই তারা ওসাইরিসের মৃত্যুর মতো গভীরভাবে নেতিবাচক ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ এড়িয়ে গিয়েছিল।[33] ক্ষেত্রবিশেষে তারা ওসাইরিসের মৃত্যুটিকে সর্বাংশে অস্বীকারও করেছে। যদিও ওসাইরিস-সংক্রান্ত বহুসংখ্যক প্রথার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি খুনই হয়েছিলেন।[34] কোনও কোনও ক্ষেত্রে লিপিগুলিতে পাওয়া যায় যে, সেত কুমির বা ষাঁড়ের মতো কোনও বন্য জন্তুর রূপ ধারণ করে ওসাইরিসকে হত্যা করেন। আবার কোনও কোনও লিপিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ওসাইরিসের মৃতদেহ জলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল অথবা তাঁকে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, যারা নীল নদের জলে ডুবে মারা যেত, তাদের পবিত্র বলে গণ্য করা হত। এই বিশ্বাসের উৎস ছিল ওসাইরিসকে ডুবিয়ে মারা-সংক্রান্ত ধারণাটি।[35] এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচয়ও ভিন্ন। যেমন কখনও দেখা যায় যে, হোরাসের এক জ্যেষ্ঠ রূপ হারোয়েরিসকে হত্যা করেছিলেন সেত এবং তারপর হোরাসের অপর রূপ, যিনি ছিলেন আইসিসের গর্ভে হারোয়েরিসেরই পুত্র, তিনি সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলেন।[36]
নতুন রাজ্যের শেষ দিকে একটি নতুন ধারণা বিকাশলাভ করতে শুরু করে। মনে করা হতে থাকে, সেত ওসাইরিসের দেহটি খণ্ড খণ্ড করে সমগ্র মিশরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সারা দেশ জুড়ে ওসাইরিসের কাল্ট কেন্দ্রগুলি দাবি করতে থাকে যে, ওসাইরিসের মৃতদেহ বা সেই দেহের নির্দিষ্ট কোনও অংশ সেই কেন্দ্রগুলির কাছে পাওয়া গিয়েছিল। কথিত ছিল, এই দেহখণ্ডের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক বিয়াল্লিশ। প্রত্যেকটি খণ্ডকে মিশরের বিয়াল্লিশটি নোম বা প্রদেশের এক একটির সমতুল্য জ্ঞান করা হত।[37] এইভাবেই রাজপদের দেবতা তার রাজ্যের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হন।[35]
ওসাইরিসের মৃত্যুর পর হয় রাজ্যে একটি অরাজক কালের সূচনা ঘটেছিল অথবা সেত নিজে রাজপদ অধিকার করেছিলেন। এদিকে আইসিস নেফথিসের সহায়তায় তার স্বামীর মৃতদেহের অনুসন্ধান করতে থাকেন।[37] ওসাইরিসের অনুসন্ধানরতা অথবা তার জন্য বিলাপরতা দুই দেবীকে প্রায়শই বাজপাখি অথবা চিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়।[39] এর কারণ সম্ভবত চিল গলিত শবের অনুসন্ধানে বহু দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করে[40] এবং মিশরীয়রাও চিলের বিলাপসূচক ডাককে শোকবিলাপের সঙ্গে যুক্ত করত; অথবা এর কারণ ছিল দুই দেবীকে হোরাসের সঙ্গে যুক্ত করা হত, যাঁকে প্রায়শই বাজপাখি প্রতীকের দ্বারা উপস্থাপনা করা হত।[39] নতুন রাজ্যের যুগে যখন ওসাইরিসের মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণকে মিশরকে উর্বরতাদানকারী নীল নদের বার্ষিক বন্যার সঙ্গে যুক্ত করা হতে শুরু হয়, তখন নীল নদের জলকে আইসিসের শোকাশ্রুর[41] অথবা ওসাইরিসের দেহ থেকে নির্গত তরলের সঙ্গে তুলনা করা হতে থাকে।[42] এইভাবে নদীর জলে বা বন্যার পরে জন্মানো গাছপালায় যে জীবনদায়ী দিব্য শক্তি আছে বলে মিশরীয়রা মনে করত তার প্রতীক হয়ে ওঠেন ওসাইরিস।[43]
দেবীদ্বয় ওসাইরিসের দেহটি খুঁজে বের করে পুনরায় জোড়া লাগান। প্রায়শই দেখা যায় তারা এই কাজ করেছিলেন থোথ (জাদুবিদ্যা ও আরোগ্যদানের ক্ষমতায় মহীয়ান দেবতা) ও আনুবিসের মতো (মমিকরণ ও অন্ত্যেষ্টি প্রথার দেবতা) অন্যান্য দেবতাদের সহায়তায়। ওসাইরিসকেই প্রথম মমি করা হয়েছিল। দেবতারা যে তার শরীরকে পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন তা-ই মিশরীয় মমিকরণ প্রথার পৌরাণিক ভিত্তি। এই প্রথার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যপরবর্তী ক্ষয় রোধ ও তার গতি পরিবর্তন। উপাখ্যানের এই অংশে প্রায়শই কয়েকটি সম্প্রসারিত পর্ব পাওয়া যায়, যেখানে সেত ও তার অনুগামীরা মৃতদেহটিকে নষ্ট করার চেষ্টা করছেন এবং আইসিস ও তার সঙ্গীরা সেটিকে রক্ষা করছেন। ওসাইরিসের শরীরটি জোড়া সম্পূর্ণ হলে আইসিস তার সন্তান ও ন্যায়সম্মত উত্তরাধিকার হোরাসকে গর্ভে ধারণ করেন।[44] শবাধার লিপিতে উল্লিখিত একটি দ্ব্যর্থক মন্ত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে আইসিস বিদ্যুতের একটি ঝলকানির দ্বারা গর্ভবতী করেছিলেন।[45] অন্যদিকে অন্যান্য সূত্রে দেখা যায়, আইসিস পাখির রূপেই তার পাখা দিয়ে ওসাইরিসের শরীরে শ্বাস ও জীবন বাতাস করে তার সঙ্গে যৌনসংগম করেন।[37] ওসাইরিসের পুনরুজ্জীবন আপাতদৃষ্টিতে স্থায়ী নয়। এই পর্যায়ের পরে উপাখ্যানে তাঁকে শুধুমাত্র দুয়াতের (মৃতদের দূরবর্তী ও রহস্যময় রাজ্য) শাসকরূপেই উল্লেখ করা হয়েছে। শুধুমাত্র দুয়াতেই জীবিত থাকলেও তিনি ও যে রাজপদের তিনি প্রতীক তা এক অর্থে তার পুত্রের মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল।[46]
প্লুটার্ক লিখিত একীভূত বিবরণটিতে অতিকথাটির প্রধানত এই অংশটির অনেক উপাদান সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু বহু দিক থেকেই তা জ্ঞান মিশরীয় উৎসসূত্রগুলির অনুরূপ নয়। এই পাঠটিতে দেখা যায়, সেত (মিশরীয় দেবদেবীদের অনেকের গ্রিক নাম ব্যবহার করতে গিয়ে প্লুটার্ক যাঁকে "তাইফন" নামে উল্লেখ করেছেন) সুনির্দিষ্টভাবে অনুল্লিখিত বাহাত্তর জন সহযোগীকে সঙ্গে ওসাইরিসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং সেই ষড়যন্ত্রে প্রাচীন ইথিওপিয়ার (নুবিয়া) রানিও যোগ দিয়েছিলেন। সেতের একটি সুনির্মিত সিন্দুক ছিল, যা ওসাইরিসের আকারের সঙ্গে একেবারে মিলে যেত। তারপর একদিন এক ভোজসভায় তিনি ঘোষণা করলেন যে, যে সেই সিন্দুকটির সঙ্গে মাপসই হবেন তাঁকেই তিনি সিন্দুকটি উপহার দেবেন। অতিথিগণ সকলেই সেই শবাধারটি মধ্যে শুয়ে দেখলেন, কিন্তু ওসাইরিস ছাড়া কারও সঙ্গেই সেটি মাপসই হল না। ওসাইরিস সিন্দুকটির মধ্যে শুতেই সেত ও তার সহকারীরা দড়াম করে তার ঢাকাটি ফেলে সেটিকে সিল করে দিয়ে নীল নদে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ওসাইরিসের মৃতদেহটি ভিতরে নিয়েই সিন্দুকটি সমুদ্রে ভেসে এল এবং শেষে বিবলোস শহরে গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে সিন্দুকটিকে ঘিরে একটি গাছ বেড়ে উঠল। বিবলোসের রাজা গাছটি কেটে এনে সেটি দিয়ে নিজের প্রাসাদে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করলেন। সিন্দুকটি রয়ে গেল সেই স্তম্ভের ভিতরেই। স্বামীর দেহটি উদ্ধার করতে আইসিসকে গাছের ভিতর থেকে সিন্দুকটি সরাতে হত। সিন্দুকটি নিয়ে তিনি গাছটিকে বিবলোসেই ফেলে গেলেন। সেখানে গাছটি স্থানীয়দের পূজার একটি বস্তুতে পরিণত হল। মিশরীয় তথ্যউৎসগুলি থেকে এই পর্বটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু প্লুটার্কের সমসাময়িক কালে এবং অন্ততপক্ষে নতুন রাজ্যের আমলে বিবলোসে গড়ে ওঠা আইসিস ও ওসাইরিসের কাল্টটির একটি কারণতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।[47]
প্লুটার্ক এও বলেছেন যে, আইসিস শবদেহটি উদ্ধার করার পরেই সেত সেটি চুরি করে ছিন্নভিন্ন করে দেন। আইসিস সেই ছিন্নভিন্ন অংশগুলিকে খুঁজে বের করে এবং পুরুষাঙ্গ ব্যতীত সকল অঙ্গই সমাধিস্থ করেন। পুরুষাঙ্গটি তিনি খুঁজে পাননি, কারণ সেটি নদীতে মাছে খেয়ে নিয়েছিল। তাই আইসিসকে জাদুবিদ্যার সাহায্যে সেটিকে পুনর্গঠন করতে হয়। প্লুটার্কের মতে, এই কারণেই মিশরীয়দের কাছে মাছ খাওয়া একটি ট্যাবু। মিশরীয় বিবরণগুলিতে অবশ্য রয়েছে যে, ওসাইরিসের পুরুষাঙ্গটি অক্ষত অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছিল। প্লুটার্কের গল্পটির কিছু অংশের একমাত্র নিকট সাদৃশ্য লক্ষিত হয় নতুন রাজ্যের সমসাময়িক কালের লোককাহিনি "দুই ভাইয়ের উপাখ্যান"-এ। এই গল্পটির সঙ্গে ওসাইরিসের অতিকথার কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।[48]
প্লুটার্কের বিবরণের শেষ পার্থক্যটি হল হোরাসের জন্ম। হোরাসের যে রূপটি তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ তুলেছিল সেটি আইসিসের গর্ভে এসেছিল এবং জন্মগ্রহণ করেছিল ওসাইরিসের মৃত্যুর আগেই। আইসিসের সঙ্গে ওসাইরিসের মরণোত্তর মিলনের ফলে জন্ম হয়েছিল হারপোক্রেটস নামে এক অপূর্ণকালিক ও দুর্বল দ্বিতীয় শিশুর। এখানে অতিকথাটির প্লুটার্ক কথিত পুনর্কথনে মিশরীয় প্রথায় প্রাপ্ত হোরাসের সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি রূপকে স্বতন্ত্র স্থান দেওয়া হয়।[49]
মিশরীয় বিবরণগুলিতে যায়, অন্তঃসত্ত্বা আইসিস নীল নদের বদ্বীপে একটি প্যাপিরাস ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। কারণ সেত ছিলেন গর্ভস্থ শিশুটির কাছে বিপদ। এই স্থানটিকে বলা হত আখ-বিতি, মিশরীয় ভাষায় যার অর্থ "নিম্ন মিশরের রাজার প্যাপিরাস ঝোপ"।[50] গ্রিক লেখকেরা এই স্থানটিকে বলতেন খেম্মিস এবং তাঁদের ইঙ্গিত অনুযায়ী স্থানটি ছিল বুটো শহরের কাছে।[51] কিন্তু অতিকথায় দেখা যায়, স্থানটির বাস্তব অবস্থানের তুলনায় একটি নির্জন ও নিরাপদ স্থান হিসেবে এটির প্রতীকতত্ত্ব-সংক্রান্ত প্রকৃতিটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।[52] মিশরীয় শিল্পকলায় এটির প্রায়শই উল্লেখের মাধ্যমে ঝোপটির বিশেষ মর্যাদার অঙ্গিত করা হয়েছে; কারণ, মিশরীয় পুরাণের অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটটি যৎসামান্যই বর্ণিত বা চিত্রিত হত। এই ঝোপের মধ্যেই আইসিস হোরাসের জন্ম দেন এবং তাঁকে বড়ো করে তোলেন। সেই কারণে ঝোপটিকে "হোরাসের নীড়"-ও বলা হত।[37] মিশরীয় শিল্পকলায় নিজের শিশুকে শুশ্রুষাকারিনী আইসিসের রূপটি ছিল একটি অত্যন্ত সাধারণ বিষয়বস্তু।[50]
কোনও কোনও লিপিতে দেখা যায়, আইসিস বৃহত্তর জগতে ভ্রমণ করছেন। তিনি সাধারণ মানুষদের মধ্যেও বিচরণ করছেন, যারা তার পরিচয় জানে না। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের সাহায্যের জন্য আবেদনও জানাচ্ছেন। এটিও একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। কারণ মিশরীয় পুরাণে দেখা যায় দেবতারা ও মানুষেরা সাধারণত আলাদাই থাকেন।[53] অতিকথাটির প্রথম পর্যায়ে দেখা যায়, অন্যান্য দেবতারা তাঁকে সাহায্য করছেন, তার অনুপস্থিতিতে তার পুত্রকে রক্ষা করেন।[37] একটি জাদুমন্ত্রে পাওয়া যায়, আইসিস যখন হোরাসের যখন সাহায্যের অনুসন্ধানে রত ছিলেন সেই সময় অপ্রধান বৃশ্চিক দেবতারাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত এবং তাঁকে পাহারা দিত। এক ধনী রমণী আইসিসকে সাহায্য করতে অস্বীকার করলে তারা সেই রমণীর পুত্রকে দংশন করে প্রতিশোধ নেয় এবং তার ফলে সেই নিষ্পাপ শিশুটিকে আরোগ্য দান করতে আইসিসের সহায়তা আবশ্যক হয়ে পড়ে।[53] এই উপাখ্যানটির নৈতিক বার্তাটি হল এই যে, দরিদ্র ধনবানের তুলনায় অনেক বেশি সৎ হতে পারে। এছাড়া এটি আইসিসের পক্ষপাতহীন ও সদয় চরিত্রটিকেও বর্ণনা করে।[54]
অতিকথার এই পর্যায়ে দেখা যায়, হোরাস এক বিপন্ন শিশু এবং বিপদ তাঁকে চারিদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। যে সব জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত লিপিগুলিতে হোরাসের শৈশবকে তাদের আরোগ্যদায়ী মন্ত্রগুলির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলিতে বিছের কামড় থেকে সাধারণ পেটের ব্যথার মতো বিভিন্ন রকমের অসুখের উল্লেখ পাওয়া যায়।[55] এইভাবেই বিভিন্ন ধরনের অসুখের জন্য নির্দিষ্ট মন্ত্রের প্রথাটি গড়ে উঠেছিল।[56] প্রায়শ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে শিশু দেবতাটিকে সাপে কামড়াচ্ছে। এই বিষয়টি মিশরীয়দের সর্পদংশন এবং সাপের বিষ ছড়িয়ে পড়ার ভয়টিকে প্রতিফলিত করে।[37] কোনও কোনও লিপিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এই সব প্রতিকূল জীবজন্তুকে সেতই নিয়োগ করেছিলেন।[57] আইসিস নিজের জাদুশক্তির প্রয়োগে তার পুত্রকে রক্ষা করেন অথবা রা বা গেবের মতো দেবতাদের কাছে পুত্রকে আরোগ্যদান করার জন্য প্রার্থনা করেন বা তাঁদের ভয় দেখান। উপাখ্যানের প্রথম ভাগে তাঁকে যেমন বিলাপকারিণীর মৌল আদর্শ হিসেবে দেখানো হয়েছে, তেমনই হোরাসের শৈশবে তাঁকে দেখা যায় এক আদর্শ স্নেহময়ী মা হিসেবে।[58] জাদুবিদ্যা-মূলক চিকিৎসা-সংক্রান্ত লিপিগুলির মাধ্যমে পুত্রকে আরোগ্যদানের জন্য তার প্রয়াসকে যে কোনও রোগীকে আরোগ্যদানের উপায় হিসেবে উপস্থাপনা করা হত।[52]
অতিকথার পরবর্তী পর্যায়ের সূত্রপাত ঘটছে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হোরাস সেতের থেকে মিশরের সিংহাসন দাবি করছেন। তাঁদের সংঘাত প্রায়শই সহিংস হয়ে উঠছে। কিন্তু কে রাজপদের উত্তরাধিকার তা নির্ধারণ করার জন্য মিশরীয় দেবতাদের সভা ইন্নিয়াদের সম্মুখে আইনগত বিচারসভার বিবরণও পাওয়া যায়। সভায় বিচারকের ভূমিকা পালন করছেন ওসাইরিস ও সেতের পিতা গেব, যিনি তাঁদের পূর্বে সিংহাসনের অধিকারী ছিলেন; অথবা সৃষ্টিকর্তা দেবতা রা বা আতুম, যাঁরা ছিলেন রাজপদের স্রষ্টা।[59] অন্যান্য দেবতারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছেন: থোথ প্রায়শই বিবাদে যুক্তিপ্রয়োগে বিরোধ দূর করার চেষ্টা করছেন[60] দিব্য বিচারকদের সহকারীর কাজ করছেন। যেমন "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" উপাখ্যানে দেখা যায়, আইসিস থোথের দক্ষতা ও জাদুশক্তিকে ব্যবহার করছে নিজ পুত্রের সহায়তার কাজে।[61]
হোরাস ও সেতের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে দু’টি পরস্পরবিরোধী উপায়ে দর্শানো হয়েছে। উভয় দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অন্ততপক্ষে অতিকথাটির আদিতম উৎসসূত্র পিরামিড লিপিগুলিতে। এই লিপিগুলির কয়েকটি মন্ত্রে দেখা যায়, হোরাস হলেন ওসাইরিসের পুত্র ও সেতের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ডই হোরাস ও সেতের সংঘাতের প্রধান প্রণোদনা। অন্য একটি ধারায় হোরাস ও সেতকে দুই ভাই হিসেবে দেখানো হয়েছে।[62] এই অসঙ্গতি পরবর্তীকালের অনেক সূত্রউৎসেই রয়ে গিয়েছে। সেগুলিতে দুই দেবতাকে একই লিপির ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দুই ভাই অথবা খুল্লতাত-ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[63]
দুই দেবতার এই সংঘাত অনেকগুলি পর্বে বিভক্ত। "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে যে, দুই দেবতাই অন্যান্য বিভিন্ন দেবতার কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন তাঁদের বিবাদে মধ্যস্থতা করার জন্য এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিজয়ী হওয়ার জন্য তারা নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতাও যেমন করেছেন তেমন হিপোপটেমাসের রূপ ধরে মল্লযুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়েছেন। এই বিবরণে দেখা যায়, একের পর এক প্রতিযোগিতায় হোরাস সেতকে পরাজিত করছেন এবং অন্যান্য অধিকাংশ দেবতা হোরাসকেই সমর্থন করছেন।[64] তবু এই বিবাদ চলে আশি বছর ধরে। এর কারণ সৃষ্টিকর্তা দেবতা বিচারকের আসনে বসে সেতের পক্ষপাতী ছিলেন।[65] পরবর্তীকালের আচার-সংক্রান্ত লিপিগুলিতে দেখা যায়, এই সংঘাত এক মহাযুদ্ধের আকার নিচ্ছে যেখানে দুই দেবতাই অনুগামীদের জড়ো করছেন।[66] দেবরাজ্যে এই দ্বন্দ্ব দুই প্রতিযোগীর বাইরেও প্রসারিত হয়ে পড়ে। এক সময় দেখা যায়, সেত যখন হোরাসের সঙ্গে যুদ্ধে রত সেই সময় আইসিস সেতের উদ্দেশ্যে হারপুন নিক্ষেপ করেন। কিন্তু সেই হারপুন হোরাসকেই আঘাত করে ক্রোধে উন্মত্তা আইসিস নিজের মাথাই কেটে ফেলেন।[67] থোথ একটি গোরুর মাথা দিয়ে আইসিসের মস্তক পুনঃস্থাপিত করেন। এইভাবেই গোরুর শিং-বিশিষ্ট যে শিরাবরণীটিকে আইসিসের মাথায় প্রায়শই দেখা যায়, সেটির উৎস-সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিটির উদ্ভব ঘটে।[68]
সংঘাতের একটি প্রধান পর্ব হল সেত কর্তৃক হোরাসের যৌন হেনস্থা। এই ধর্ষণের আংশিক উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগীর সম্মানহানি ঘটানো। কিন্তু সেতের অন্যতম প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ তার প্রবল ও বাছবিচারহীন যৌনাকাঙ্ক্ষার নিরিখে এটির মধ্যে একটি সমকামী আকাঙ্ক্ষার নিহিত ছিল।[69] এই পর্বটির আদিতম বিবরণ মধ্য রাজ্যের একটি খণ্ডিত প্যাপিরাসে দেখা যায়, এই যৌনসংগমের সূচনায় সেত হোরাসকে সংগমের প্রস্তাব দিচ্ছেন। হোরাস এই শর্তে রাজি হচ্ছে যে, সেত হোরাসকে নিজের শক্তির কিছু অংশ দেবেন।[70] এই সংগমের ফলে হোরাস বিপদে পড়েন। কারণ মিশরীয় বিশ্বাসে বীর্য হল বিষের মতোই শক্তিশালী ও বিপজ্জনক পদার্থ। কোনও কোনও লিপিতে পাওয়া যায়, সেতের বীর্য হোরাসের বীর্যে প্রবেশ করলে হোরাস অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" উপাখ্যানে পাওয়া যায় যে, হোরাস সেতের বীর্য হাতে ধরে ফেলে সেতকে প্রতিহত করেন। আইসিস এই দুর্ব্যবহারের জবাব দুর্ব্যবহারের মাধ্যমেই দেন। যে লেটুস-পাতা হোরাস খান তাতে তিনি হোরাসের বীর্য মাখিয়ে দেন। সেই বীর্য খন হোরাসের কপালে একটি সোনালি চাকতির আকারে আবির্ভূত হয়, তখনই হোরাসের পরাজয় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়ে যায়। তার গর্ভসঞ্চার ঘটে এবং তার ফলে তিনি চাকতিটির "জন্ম দেন"। "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" উপাখ্যানে দেখা যায়, থোথ চাকতিটি নিয়ে নিজের মস্তকে স্থাপন করছেন। অন্যান্য বিবরণের ইঙ্গিত অনুযায়ী, থোথ স্বয়ং এই অস্বাভাবিক জন্মপ্রক্রিয়ার দ্বারা জাত হয়েছিলেন।[71]
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে দুই প্রতিযোগীর উপরই সংঘাতটি অপরিহার্য অঙ্গহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল: হোরাস সেতের অণ্ডকোষ আহত করেন অথবা চুরি করেন এবং সেত হোরাসের একটি, ক্ষেত্রবিশেষে দু’টি চোখই উপড়ে নেন।[72] সেতের অঙ্গহানি তার পৌরুষ ও শক্তিমত্তার ক্ষয়ের সূচক।[73] হোরাসের চক্ষু উৎপাটন অবশ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চুরি-যাওয়া হোরাসের চোখ মিশরীয় ধর্মে বহু বৈচিত্র্যময় ধারণাসমূহের প্রতীক। হোরাসের একটি প্রধান ভূমিকা আকাশের দেবতা হিসেবে। সেই জন্য কথিত ছিল যে, তার ডান চোখটি হল সূর্য এবং বাঁ চোখটি চাঁদ। হোরাসের চোখ চুরি বা ধ্বংসকে তাই চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির কালে অথবা গ্রহণের সময় চাঁদের অন্ধকার হয়ে যাওয়ার সমতুল্য জ্ঞান করা হত। হোরাস তার হারানো চোখটি পুনরুদ্ধার করেছিলেন অথবা আইসিস, থোথ ও হাথোরের মতো অন্যান্য দেবদেবীরা সেটি পুনরুদ্ধার করে তাঁকে আরোগ্যদান করেছিলেন।[72] মিশরতত্ত্ববিদ হারমান তে ভেলদে মনে করেন যে, অণ্ডকোষ হারানোর ঘটনাটি হোরাসের কাছে সেতের বীর্য হারানোর একটি পরবর্তীকালীন পাঠান্তর এবং সেতের গর্ভধারণের পর তার মাথায় যে চাঁদ-সদৃশ চাকতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল সেটিই হল হোরাসের চোখ। এমতাবস্থায় অঙ্গহানি ও যৌন হেনস্থার পর্ব দু’টি একক উপাখ্যান সৃষ্টি করে, যে উপাখ্যানে দেখা যায় সেত হোরাসকে যৌন হেনস্থা করছেন এবং তার কাছেই নিজের বীর্য হারাচ্ছেন, হোরাস দুর্ব্যবহারের জবাব দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে দিয়ে সেতের গর্ভসঞ্চার ঘটাচ্ছেন এবং হোরাসের চোখ সেতের মাথায় আবির্ভূত হলে তিনি সেই চোখের অধিকারী হচ্ছেন। থোথ যেহেতু তার অন্যান্য দায়িত্বের সঙ্গে চাঁদেরও দেবতা, সেই হেতু তে ভেলদের মতে, চোখের রূপে থোথের আবির্ভাব এবং বিবদমান দুই দেবতার মধ্যস্থ হওয়া সঙ্গত।[74]
সকল ক্ষেত্রেই হোরাসের চোখের সম্পূর্ণ আকারে পুনঃস্থাপন চাঁদের পূর্ণ ঔজ্জ্বল্যে ফিরে আসা,[75] হোরাসের রাজপদে প্রত্যাবর্তন[76] ও মাত-এর আরও অনেক দিকের প্রতীক।[77] কোনও কোনও ক্ষেত্রে হোরাসের চক্ষু পুনঃস্থাপনের সঙ্গে সেতের অণ্ডকোষ পুনঃস্থাপনের কথাও জানা যায়। এইভাবে বিবাদের সমাপ্তির কাছে পৌঁছে দুই দেবতাই পূর্ণতা ফিরে পান।[78]
অতিকথাটির অন্য অনেক অংশের মতোই এটির সিদ্ধান্তটিও জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রায়শই দেখা যায়, হোরাস ও সেত তাঁদের মধ্যে রাজ্য ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। মিশরীয়রা তাদের জগতে যে বিভিন্ন মৌলিক দ্বৈতকে দেখত, এই বিভাজনকে সেগুলির সমতুল্য ধরে নেওয়া যায়। কোথাও দেখা যায়, হোরাস নীল নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা উর্বর ভূখণ্ডটি অর্থাৎ মিশরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রটিকে লাভ করছেন এবং সেত পাচ্ছেন ঊষর মরুভূমি অথবা সেগুলির সঙ্গে যুক্ত বিদেশি রাজ্যগুলিকে। আবার কোথাও দেখা যায় হোরাস পৃথিবীতে রাজত্ব করছেন এবং সেত আকাশে বাস করছেন। আবার এও দেখা যায় যে, দুই দেবতা দেশের দুই প্রথাগত বিভাগ উচ্চ ও নিম্ন মিশর পাচ্ছেন; সেক্ষেত্রে প্রত্যেক দেবতাকেই তাঁদের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এদিকে মেমফিসীয় ধর্মতত্ত্ব মতে, বিচারক গেব প্রথমে রাজ্যটিকে দুই ভাগ করে দুই দাবিদারকে প্রদান করছেন এবং তারপর মত পরিবর্তন করে হোরাসকেই এককভাবে নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করছেন। এই শান্তিপূর্ণ মিলনের মাধ্যমে হোরাস ও সেত মিটমাট করে নিচ্ছেন এবং তারা যে দ্বৈতগুলি প্রতীক তাও একটি একীভূত এককের মধ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের দ্বারা তুমুল বিবাদের পর শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপিত হচ্ছে।[79]
অতিকথাটির একটি পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে হোরাসকে একক বিজয়ী হিসেবে দর্শানো হয়েছে।[80] এই পাঠটিতে দেখা যায়, সেত তার প্রতিযোগীর সঙ্গে মিটমাট করেননি, বরং সম্পূর্ণরূপেই পরাজিত হয়েছিলেন।[81] কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি মিশর থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন, এমনকি ধ্বংসপ্রাপ্তও হচ্ছেন।[82] মিশরের ইতিহাসের পরবর্তীকালের সূত্রউৎসগুলিতে তার পরাজয় ও অবমাননার বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছিল। এই সময়কালে বিশৃঙ্খলা ও অমঙ্গলকে উত্তরোত্তর সমতুল্য জ্ঞান করা হচ্ছিল এবং মিশরীয়রাও আর সেতকে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করছিল না।[81]
দেবতাদের এক বিশাল বিজয়োৎসবের মধ্য দিয়ে হোরাস সিংহাসনে আরোহণ করেন। শেষ পর্যন্ত মিশরও এক ন্যায়সঙ্গত রাজাকে পায়।[83] সেত যে অন্যায় করেছিলেন সেই ব্যাপারে দেবতাদের সিদ্ধান্ত ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ডের দ্বারা কৃত অন্যায়টিকে সংশোধন করে এবং যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুর পর ওসাইরিসের পুনঃস্থাপনার কাজ চলছিল তাকে সম্পূর্ণ করে।[84] কোথাও দেখা যায়, শাস্তি হিসেবে সেতকে ওসাইরিসের মৃতদেহটিকে সমাধিতে বহন করে নিয়ে যেতে হচ্ছে।[85] নতুন রাজাকে তার পিতার অন্ত্যেষ্টি-সংক্রান্ত আচারগুলি পালন করতে হত এবং মৃত পিতার আত্মার ভরণপোষণের জন্য খাদ্যও উৎসর্গ করতে হত—প্রায়শই তার মধ্যে হোরাসের চোখও থাকত, যেটিকে এই দৃষ্টান্তে জীবন ও প্রাচুর্যের প্রতীক গণ্য করা হত।[86] কোনও কোনও সূত্রউৎস মতে, কেবলমাত্র এই ক্রিয়াগুলির মাধ্যমেই ওসাইরিস পরলোকে সম্পূর্ণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন এবং মৃতদের রাজার স্থানটি অধিকার করেন, যা জীবিতদের রাজা হিসেবে তার পুত্রের ভূমিকার সমান্তরাল একটি রূপ। তারপর থেকে ওসাইরিস মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণের প্রাকৃতিক চক্রগুলির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। এই চক্রগুলির মধ্যে ছিল শস্যের বার্ষিক বৃদ্ধি, যা তার নিজের পুনর্জীবনলাভের ঘটনাটির সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্কযুক্ত[87]
ওসাইরিসের অতিকথাটি প্রথম পাওয়া যায় পিরামিড লিপিগুলিতে। এগুলির অধিকাংশ মৌলিক উপাদানই নিশ্চিতরূপে লিপিগুলি লিখিত হওয়ার আগেই কোনও এক সময় রূপ পরিগ্রহ করেছিল। এই উপাখ্যানের স্বতন্ত্র খণ্ডাংশগুলি—ওসাইরিসের মৃত্যু ও পুনর্জীবনলাভ, হোরাসের শৈশব এবং সেতের সঙ্গে হোরাসের সংঘাত—সম্ভবত পুরাণরচনার পৃথক পৃথক পর্যায়ে সৃষ্ট হয়েছিল। যদি তাই হয়, তাহলে নিশ্চিতরূপেই এই খণ্ডাংশগুলি একক কাহিনির একীভূত হতে শুরু করেছিল পিরামিড লিপিগুলির সমসাময়িক কালে। এই পিরামিড লিপিগুলিতে উক্ত খণ্ডাংশগুলিকে ঢিলেঢালাভাবে যোগ করা হয়েছে। যে কোনও ক্ষেত্রেই অতিকথাটি বিভিন্ন প্রকার প্রভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।[3] কাহিনিটির অধিকাংশেরই ভিত্তি ধর্মীয় ধ্যানধারণা[88] এবং মিশরীয় সমাজের সাধারণ প্রকৃতি: রাজপদের দিব্য প্রকৃতি, এক রাজা থেকে অপর রাজায় উত্তরাধিকারের আবর্তন,[89] মাত রক্ষার সংগ্রাম,[90] এবং মৃত্যুকে অতিক্রম করার প্রয়াস।[3] দৃষ্টান্তস্বরূপ, মৃত ভ্রাতার প্রতি আইসিস ও নেফথিসের বিলাপ সম্ভবত আলারমূলক বিলাপের আদি প্রথার প্রতীক।[91]
যদিও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিমতও রয়েছে। ওসাইরিসের উৎসটি বহু বিতর্কিত[42] এবং তার মৃত্যুর অতিকথাটির ভিত্তিটিও কিছুটা অনিশ্চিত।[92] এই বিষয়ে একটি প্রভাবশালী উপপ্রমেয়র জনক নৃতত্ত্ববিদ জেমস ফ্রেজার। ১৯০৬ সালে তিনি বলেছিলেন প্রাচীন নিকট প্রাচ্য জুড়ে অন্যান্য "মরণশীল ও পুনরুজ্জীবনশীল দেবতা"দের মতো ওসাইরিসকেও সমষ্টিগতভাবে উদ্ভিজজগতের মূর্তিরূপ হিসেবে দেখা শুরু হয়েছিল। তার মৃত্যু ও পুনর্জন্মলাভের ভিত্তিও তাই ছিল গাছপালার বাৎসরিক মৃত্যু ও পুনঃবৃদ্ধিলাভ।[93] অনেক মিশরতত্ত্ববিদই এই ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জে. গাওয়িন গ্রিফিথস ওসাইরিস ও তার অতিকথাটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে বলেন যে, ওসাইরিসের উৎস মৃতদের দিব্য শাসক রূপে এবং উদ্ভিদজগতের সঙ্গে তার যোগটি ছিল এই অতিকথার একটি অপ্রধান পর্যায়।[94] এদিকে তুলনামূলক ধর্মবিদ্যার গবেষকেরা "মরণশীল ও পুনরুজ্জীবনশীল দেবতা"র সর্বব্যাপী ধারণাটির অথবা অন্ততপক্ষে এই জাতীয় সকল দেবতা একই ধাঁচের বলে ফ্রেজার যে মত পোষণ করতেন, সেই মতে সমালোচনা করেন।[93] অধিকতর সাম্প্রতিক কালে মিশরতত্ত্ববিদ রোজালি ডেভিড ওসাইরিসকে নীল নদের প্লাবনের পর গাছপালার বার্ষিক পুনর্জন্মের মূর্তিরূপ বলেই মত প্রকাশ করেছেন।[95]
আরেকটি চলতে থাকা বিতর্কের বিষয় হল হোরাস ও সেতের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি। মিশরতত্ত্ববিদগণ প্রায়শই এটিকে মিশরের প্রাগৈতিহাসিক বা প্রাচীন যুগের রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। যে ঘটনায় বিবদমান গোষ্ঠীগুলি রাজ্যকে ভাগ করত এবং প্রায়শই যেভাবে হোরাস ও সেতকে যুগ্মভাবে উচ্চ ও মিশরের একীকরণের সঙ্গে যুক্ত করা হত, তা ইঙ্গিত করে যে এই দুই দেবতা দেবতা দেশের কোনও রকম বিভাজনের প্রতিনিধিত্ব করতেন। মিশরীয় বিশ্বাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে ইতিহাসের গোড়ার দিকে মিশর একক রাজ্য ছিল, যখন দক্ষিণের একটি উচ্চ মিশরীয় রাজ্য উত্তরের নিম্ন মিশর জয় করেছিল। উচ্চ মিশরের শাসকেরা নিজেদের "হোরাসের অনুগামী" বলতেন এবং হোরাস একীকৃত রাষ্ট্র ও তার রাজন্যবর্গের অভিভাবক দেবতায় পরিণত হয়েছিলেন। এদিকে হোরাস ও সেতকেও সহজে দেশের দুই অর্ধের সঙ্গে তুল্যজ্ঞান করা যায় না। দুই দেবতার বেশ কয়েকটি কাল্ট কেন্দ্র উভয় অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল এবং হোরাসকে প্রায়শই নিম্ন মিশর ও সেতকে উচ্চ মিশরের সঙ্গে যুক্ত করা হত।[36] ১৯৩০ সালে কার্ট সেথি এই সব বৈষম্যের যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন তা এই বিষয়ের সর্বাধিক পরিচিত ব্যাখ্যাগুলির অন্যতম। তার মতে, ওসাইরিস প্রকৃতপক্ষে ছিলেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঐক্যবদ্ধ মিশরের এক মানব শাসক। উচ্চ মিশরের সেত-উপাসকদের একটি বিদ্রোহের আগে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। তারপর নিম্ন মিশরে হোরাসের অনুগামীরা বলপূর্বক আবার দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন। হোরাসের বিজয়লাভের অতিকথাটি এই ঘটনা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়। এরপর হোরাসের পূজকদের নেতৃত্বাধীন উচ্চ মিশর আদি রাজবংশীয় যুগের গোড়ার দিকে আবার প্রাধান্য অর্জন করে।[96]
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে গ্রিফিথস দুই ভাই ও কাকা-ভাইপো রূপে হোরাস ও সেতের পরস্পরবিরোধী চিত্রণের উপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন যে, মিশরীয় পুরাণের আদি পর্যায়গুলিতে দুই ভাই ও সমান যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে হোরাস ও সেতের সংঘাত আদিতে ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ডের পর্বটির থেকে আলাদা ছিল। পিরামিড লিপিগুলি রচিত হওয়ার কিছু সময় আগে এই দুই কাহিনি একক ওসাইরিসের অতিকথায় যুক্ত হয়। এই যোগকরণের সঙ্গে দেবতাদের বংশবৃত্তান্তও জড়িয়ে পড়ে এবং হোরাস-সেত সংঘাতের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি এমনভাবে পাল্টে যায় যে হোরাস পরিণত হন ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধগ্রহণকারী পুত্রে। প্রতিযোগীদের সম্পর্কের পরস্পরবিরোধী চরিত্রটি বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রথাতেও যে ছিল তার চিহ্ন পাওয়া যায়। ওসাইরিসের অতিকথার সঙ্গে সম্পর্কহীন লিপিগুলিতেও এই পরস্পরবিরোধিতার আভাস রয়েছে। এই লিপিগুলিতে দেখা যায় হোরাস হলেন আইসিস ও ওসাইরিসের পরিবর্তে দেবী নুট বা হাথোরের পুত্র। তাই ওসাইরিসের হত্যাকাণ্ডের শিকড় ঐতিহাসিক ঘটনাবলিতে নিহিত, এই তত্ত্ব গ্রিফিথস প্রত্যাখ্যান করেছেন।[97] জান অ্যাজমান[63] ও জর্জ হার্ট[98] প্রমুখ অধিকতর সাম্প্রতিক গবেষকেরাও এই উপগ্রমেয়টি গ্রহণ করেছেন।
গ্রিফিথ হোরাস-সেতের সংঘাতের একটি ঐতিহাসিক উৎসের অনুসন্ধান করেছেন এবং মিশরের প্রাক্-রাজবংশীয় দু’টি পৃথক একীকরণকে তর্কের খাতিরে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। এই বক্তব্য সেথির তত্ত্বেরই অনুরূপ।[99] তবু বিষয়টি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। তার আংশিক কারণ হোরাস ও সেতের অন্যান্য রাজনৈতিক যোগসূত্র ছবিটিকে আরও জটিল করে তুলেছে।[100] উচ্চ মিশর একক শাসকের অধীনে থাকারও আগে এই অঞ্চলের প্রধান দু’টি শহর ছিল সুদূর দক্ষিণে নেখেন ও তার অনেক মাইল উত্তরে নাকাদা। নেখেনের অভিভাবক দেবতা ছিলেন হোরাস। সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই নেখেনের শাসকেরাই নাকাদা সহ সমগ্র উচ্চ মিশরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সেত যুক্ত ছিলেন নাকাদার সঙ্গে। তাই সম্ভবত এই দুই দেবতার সংঘাতের মধ্যে দিয়ে খুব ক্ষীণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে পরস্পর সুদূরবর্তী দুই শহরের অতীত শত্রুতার বিষয়টি। অনেক পরবর্তীকালে, দ্বিতীয় রাজবংশের শাসনকালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৮৯০-২৬৮৬ অব্দ) শেষ ভাগে রাজা পেরিবসেন তার "সেরেখ"-নামটি লেখার ক্ষেত্রে হোরাসের প্রতিনিধিত্বকারী প্রথাগত বাজপাখি চিত্রলিপির পরিবর্তে সেত পশু ব্যবহার করেন। তার উত্তরসূরি খাসেখেমওয়ি হোরাস ও সেত দুইই ব্যবহার করেছেন তার সেরেখে লেখার ক্ষেত্রে। এই প্রমাণের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে, দ্বিতীয় রাজবংশের আমলে হোরাস-রাজার অনুগামী ও পেরিবসেনের নেতৃত্বাধীন সেত-উপাসকদের মধ্যে একটি সংঘাত বেধেছিল। খাসেখেমওয়ির দুই প্রাণী প্রতীক ব্যবহার তাই দুই গোষ্ঠীর পুনর্মিলন তথা অতিকথাটির সিদ্ধান্তের উপনীত হওয়ার প্রতীক।[36]
এই ঘটনাগুলিকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতে হারমান তে ভেলদে মনে করেন যে, দুই দেবতার সংঘাতের ঐতিহাসিক শিকড়টি এতটাই অস্পষ্ট যে তা অতিকথাটি বোঝার ব্যাপারে বিশেষ ফলপ্রসূ নয় এবং তা এটির ধর্মীয় অর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণও নয়। তিনি বলেছেন যে, হোরাস ও সেতের অতিকথাটির উৎস প্রাগৈতিহাসিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছে।[88]
মিশরীয় সংস্কৃতিতে ওসাইরিসের অতিকথাটির প্রভাব ছিল অন্য কে কোনও অধিকথার তুলনায় বৃহত্তর ও অনেক বেশ সুদূরপ্রসারিত।[1] সাহিত্যে এই অতিকথাটি যে শুধুমাত্র "হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্ব" ইত্যাদি কাহিনি পুনর্কথনের ভিত্তি তাই নয়, এটি অধিকতর দূরসম্পর্কীয় কাহিনিরও ভিত্তি। "দুই ভাইয়ের গল্প" নামে একটি লোককথার প্রধান চরিত্রেরা দেবতা নয়, মানুষ। কিন্তু এই গল্পেও ওসাইরিসের উপকথার অনেক অনুরূপ উপাদান পাওয়া যায়।[101] এই গল্পে দেখা যায়, একটি চরিত্রের পুরুষাঙ্গ মাছে খেয়ে নিচ্ছে, পরে সে মারা যাচ্ছে এবং পুনর্জীবন লাভ করছে।[102] "সত্য ও মিথ্যার উপাখ্যান" নামে আরেকটি গল্পে হোরাস ও সেতের দ্বন্দ্বকে একটি রূপক কাহিনি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই গল্পের চরিত্রগুলি সত্য ও মিথ্যার সঙ্গে যুক্ত দেবতার পরিবর্তে সরাসরি সত্য ও মিথ্যার মূর্তিরূপ।[101]
অন্ততপক্ষে পিরামিড লিপির সময় থেকেই রাজারা আশা করতেন যে, মৃত্যুর পর তারা ওসাইরিসের জীবনপ্রাপ্তি এবং মৃতদের রাজ্যে তার শাসনের সমকক্ষ হতে পারবেন। মধ্য রাজ্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০৫৫-১৬৫০ অব্দ) গোড়ার দিক থেকে রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কহীন সাধারণ মিশরীয়রাও মনে করত যে, ওসাইরিসকে পূজা করে এবং তার অতিকথার আংশিক ভিত্তিতে প্রবর্তিক অন্ত্যেষ্টি সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তারই মতো মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারবে। এইভাবেই ওসাইরিস মিশরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরলোক দেবতায় পরিণত হন।[104] শুধুমাত্র সৎ ব্যক্তিরাই পরলোকে উপনীত হতে পারেন এমন একটি ধারণাও এই অতিকথার দ্বারা প্রভাবিত হয়। নতুন রাজ্যের আমলে এই ধারণাটি বিশেষ প্রাধান্য অর্জন করে। সমবেত দেবতারা ওসাইরিস ও হোরাসকে ন্যায়সঙ্গত রাজা বলে রায় দিয়েছিলেন এবং ওসাইরিসের মৃত্যুর অন্যায়টিকে নাশ করেছিলেন। তাই মৃতের আত্মাকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হয় তার মৃত্যুটিকে নাশ করার জন্য।[84] মৃতের রাজ্যের শাসক ও মাত-এর সঙ্গে যুক্ত এক দেবতা হিসেবে ওসাইরিস এই মরণোত্তর বিচারসভার বিচারক হতেন এবং যারা তার উদাহরণ অনুসরণ করত তাদের মৃত্যুপরবর্তী জীবন দান করতেন।[105] নতুন রাজ্যের আমদুআত ও দরজাসমূহের বইয়ের মতো অন্ত্যেষ্টি লিপিগুলিতে রা-কে কোনও মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই লিপিগুলিতে বলা হয়েছে যে, তিনি দুআতে ভ্রমণ করেন এবং ঊষাকালে পুনর্জন্মলাভের জন্য ওসাইরিসের সঙ্গে মিলিত হন।[106] এইভাবে ওসাইরিসকে যে শুধুমাত্র মৃতদের পুনর্জন্ম দানে সক্ষমই মনে করা হত তাই নয়, মনে করা হত যে তিনি জীবনের উৎস সূর্য ও মাত-এরও পুনর্নবীকরণ ঘটান এবং সেই সূত্রে সমগ্র জগৎকে পুনরায় নতুন করে তোলেন।[107]
ওসাইরিসের গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে তার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। মধ্য রাজ্যের শেষ দিকে অ্যাবিডোস শহরে ওসাইরিসের প্রধান উপাসনাকেন্দ্রটির কাছে অবস্থিত প্রথম রাজবংশের শাসক দিজেরের বহু-শতাব্দীপ্রাচীন সমাধিটিকে ওসাইরিসের সমাধি হিসেবে দেখা হতে থাকে। সেই হেতু এটি ওসাইরিস উপাসনার একটি প্রধান স্থানে পরিণত হয়। পরবর্তী ১,৫০০ বছর ধরে একটি বার্ষিক উৎসব শোভাযাত্রা ওসাইরিসের প্রধান মন্দিরটি থেকে সমাধিস্থল অবধি যেত।[108] সারা মিশরের রাজা ও সাধারণ মানুষ সেই শোভাযাত্রার পথের ধারে বেদিযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাসনাস্থল নির্মাণ করেছিলেন, যেগুলি সেনোট্যাফ হিসেবে ব্যবহৃত হত। তারা মনে করতেন, এই কাজের মাধ্যমে পরলোকে ওসাইরিসের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়ে উঠবে।[109]
আরেকটি জাতীয় স্তরের প্রধান অন্ত্যেষ্টি-সংক্রান্ত উৎসব মিশরীয় পঞ্জিকার খোইআক মাসে বেশ কয়েক দিন ধরে পালিত হত। মধ্য রাজত্বের আমলে এই উৎসবটির সঙ্গে ওসাইরিসের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।[110] খোইআক মাসের উৎসবটির সময় ওসাইরিসের প্রতীকচিহ্ন দিজেদ স্তম্ভ আচারপূর্বক ঋজুভাবে উত্তোলিত করা হত, যা ছিল ওসাইরিসের পুনঃস্থাপনের প্রতীক। টলেমীয় যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫-৩০ অব্দ) মধ্যেই এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এক "ওসাইরিস শয্যা"-য় বীজ বপনের আচারটি। এই ওসাইরিস শয্যা ছিল মমির আকৃতিবিশিষ্ট একটি মাটির বিছানা, যার মাধ্যমে ওসাইরিসের পুনরুজ্জীবনকে গাছপালার মরসুমি বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত করা হত।[111]
অতিকথাটির ধর্মীয় গুরুত্ব অন্ত্যেষ্টি-সংক্রান্ত বিষয়ের বাইরেও প্রসারিত হয়েছিল। মৃত ব্যক্তির পরিবারবর্গ অথবা ভাড়াটে পুরোহিত মৃতের উদ্দেশ্যে খাদ্য উৎসর্গ করতেন। শবাগারে উৎসর্গিত এই জাতীয় দ্রব্যসামগ্রী যুক্তির হিসেবে যুক্ত ছিল ওসাইরিসের প্রতি হোরাসের চক্ষু উৎসর্গের পৌরাণিক ধারণাটির সঙ্গে। সাদৃশ্যবিচারে অতিকথার এই পর্বটি মানব ও দিব্য জগতের এক সত্ত্বার অন্যান্য আদানপ্রদানেরও সমতুল। মন্দিরের দ্রব্য উৎসর্গের আচারগুলিতে দায়িত্বনির্বাহী পুরোহিত নিজে হোরাসের ভূমিকা গ্রহণ করতেন, দেবতার প্রতি প্রদক্ষ উপহারগুলিকে মনে করা হত হোরাসের চোখ এবং যে দেবতাকেই সেই সব উপহার দেওয়া হোক না কেন, তাঁকে ক্ষণিকের জন্য ওসাইরিসের তুল্য জ্ঞান করা হত।[112]
অতিকথাটি জনপ্রিয় ধর্মকেও প্রভাবিত করেছিল। একটি উদাহরণ হল হোরাসের শৈশবের ভিত্তিতে রচিত জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত আরোগ্যদায়ী মন্ত্রগুলি। রক্ষাকারী প্রতীক রূপে হোরাসের চোখের আরেকটি ব্যবহার দেখা যেত ব্যক্তিগত অমঙ্গলদূরকারী কবচ হিসেবে। এই চোখের পুরাণকথিত পুনঃস্থাপন এটিকে সুস্বাস্থ্যের একটি সাধারণ প্রতীক হিসেবে সেই উদ্দেশ্যে যথাযথ করে তুলেছিল।[113]
জীবিত রাজাকে ঘিরে গড়ে ওঠা আদর্শবাদটিও ওসাইরিসের অতিকথাটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মিশরীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওসাইরিসের অতিকথার ঘটনাগুলি ঘটেছিল মিশরের অস্পষ্ট প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনও এক সময়ে এবং ওসাইরিস, হোরাস ও তাঁদের দিব্য পূর্বসূরিদের মধ্যেই ছিলেন তুরিন রাজকীয় ক্যাননের মতো মিশরের অতীত রাজন্যবর্গ।[114] আদ্যকালীন রাজা এবং রাজপদের মূর্তিরূপ হিসেবে হোরাসকে সকল মিশরীয় শাসকের পূর্বসূরি ও উদাহরণস্বরূপ মনে করা হত। হোরাস কর্তৃক নিজ পিতার সিংহাসনে আরোহণ এবং পরলোকে পিতার আত্মার ভরণপোষণের সুবন্দোবস্ত করার কাজটি তার সমকক্ষ হওয়ার জন্য সকল ফ্যারাও-উত্তরসূরিদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল।[115] মনে করা হত যে, হোরাসের মতো প্রত্যেক নতুন রাজাও পূর্ববর্তী রাজার মৃত্যুর পর মাত-এর পুনর্নবীকরণ ঘটান। ফ্যারাওদের রাজ্যাভিষেকের সময় পালিত আচারগুলিতে ওসাইরিসের সমাধিদানের পরোক্ষ ইঙ্গিত করা হত এবং নতুন রাজার সিংহাসনারোহণ উদযাপনের স্তোত্রগুলি ছিল হোরাসের সিংহাসনারোহণ উদযাপনের স্তোত্রগুলির সমতুল্য।[83]
ওসাইরিসের অতিকথাটির ফলে প্রায়শই সেতকে এক ধ্বংসকারী ক্ষতিকারক দেবতা হিসেবে দেখা হত। যদিও মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসের অন্যান্য উপাদানগুলিতে সেতের কিছু ইতিবাচক দিকও উল্লিখিত হয়েছে। তবু ওসাইরিসের অতিকথায় তার চরিত্রের অমঙ্গলজনক দিকটিই প্রাধান্য পায়।[116] শিল্পকলায় তিনি ও হোরাস প্রায়শই পাশাপাশি স্থাপিত হতেন শুভ ও অশুভ, বুদ্ধি ও সহজাত প্রবৃত্তি এবং অতিকথায় কথিত বিশ্বের যে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল তারা শাসন করেছেন সেগুলি চিত্রিত করার জন্য। মিশরীয় প্রজ্ঞা লিপিগুলিতে দুই চরিত্রের পার্থক্যটি হল একজন আদর্শ ব্যক্তি ও তার বিপরীত প্রকৃতির কোনও ব্যক্তির পার্থক্য—শান্ত ও সুবুদ্ধিসম্পন্ন "স্বল্পভাষী" ও আবেগতাড়িত ও ধ্বংসপ্রবণ "মাথা-গরম লোক"—এবং একটি বিবরণে এই দুই চরিত্রকে বলা হয়েছে হোরাস-শ্রেণির ও সেত-শ্রেণির লোক। এদিকে দুই দেবতাকে প্রায়শই এক বৈরিতামুক্ত সামগ্রিকতার অংশ হিসেবেও দেখা হয়। কোনও কোনও স্থানীয় কাল্টে তাঁদের একযোগে পূজা করা হত। শিল্পকলাতেও তাঁদের প্রায়শই দেখা যায় উচ্চ ও নিম্ন মিশরের প্রতীকগুলিকে একসঙ্গে বাঁধছেন। এটি দেশের ঐক্যের প্রতীক। অন্ত্যেষ্টি লিপিগুলিতে তাঁদের হোরাস ও সেতের মস্তকবিশিষ্ট একক দেবতা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা আপাতদৃষ্টিতে দুয়াতের রহস্যময় ও সর্ববেষ্টনকারী প্রকৃতিটির প্রতীক।[117]
সামগ্রিক দিক থেকে সেতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি অনিশ্চয়তা ছিল। শেষে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ অমঙ্গলজনক এক দেবতা হিসেবে দেখা হতে শুরু করা হয়। এই রূপান্তর আরও প্রণোদিত হয়েছিল ওসাইরিসের অতিকথাটির প্রসঙ্গের তুলনায় বিদেশি রাজ্যগুলির প্রতি সেতের যোগের সূত্রে।[116] তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে সেতের আনুষ্ঠানিক নির্মূলীকরণ সংক্রান্ত বহু-প্রচলিত মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠানগুলি অতিকথাটির সঙ্গেই প্রায়শ যুক্ত হত।[118]
ওসাইরিসের শরীর রক্ষা ও পুনঃস্থাপনার জন্য আইসিস ও নেফথিস উভয়কেই পরলোকে মৃতের রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে গণ্য করা হত।[119] ওসাইরিসকে অথবা কোনও মৃত ব্যক্তির মমিকে রক্ষাকারিণী আইসিস ও নেফথিসের শিল্পরূপটি অন্ত্যেষ্টি-সংক্রান্ত শিল্পকলায় প্রায়শই দেখা যেত।[120] খোইআক মাসের উৎসবে আইসিস ও নেফথিসের বিলাপ এবং তাঁদের নিহত ভ্রাতার শরীর পুনঃস্থাপন ও পুনরুজ্জীবনের উল্লেখ করা হত এবং সম্ভবত আচারগতভাবে ঘটনাগুলির পুনরাভিনয়ও করা হত।[121] হোরাসের মা হিসেবে আইসিসকে রাজকীয় আদর্শবাদ অনুযায়ী সকল রাজার মাও মনে করা হত এবং কথিত ছিল যে, রাজাদের দিব্য বৈধতার প্রতীক হিসেবে তিনি রাজাদের স্তন্যপান করাতেন।[122] জনসাধারণের কাছে তার রক্ষাকারিণী চরিত্রটির ভিত্তিতে সৃষ্ট আবেদনের উদাহরণ হিসেবে জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত আরোগ্যদায়ী মন্ত্রগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। শেষ পর্যায়ে আইসিসকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী জাদুশক্তির অধিকারিণী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল এবং মনে করা হত তার মাতৃসুলভ আসক্তি সকলের প্রতিই প্রসারিত হয়। রোমান যুগে তিনি মিশরের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবীতে পরিণত হন।[123] সন্তান-সহ দেবীর মূর্তিই তার পূজার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত। উদাহরণস্বরূপ, এই ছবিগুলিতে গৃহস্থালীতে তার প্রতি উৎসর্গিত পূজাবেদির প্যানেল চিত্রকলায় দেখা যায়। এই সব ছবিতে আইসিসের মূর্তির সঙ্গে আদি খ্রিস্টীয় মূর্তিতে যিশু-সহ মেরির ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। সম্ভবত আইসিসের ছবিগুলির একটি প্রভাব খ্রিস্টীয় শিল্পকলার উপরেও পড়েছিল।[124]
খ্রিস্টের জন্মের অব্যবহিত পূর্বের কয়েক শতাব্দীতে আইসিসের পূজা মিশর ছাড়িয়ে ভূমধ্যসাগরীয় জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেই অঞ্চলের সর্বাধিক জনপ্রিয় দেবদেবীদের অন্যতম। আইসিসের এই নতুন বহু-সাংস্কৃতিক রূপটির মধ্যে অন্যান্য দেবদেবীদের বৈশিষ্ট্যগুলি অঙ্গীভূত হয়ে গেলেও স্ত্রী ও মা রূপে তার আদি পৌরাণিক প্রকৃতিটিই তার প্রধান আবেদন থেকেই যায়। হোরাস ও ওসাইরিস যেহেতু গল্পের কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র, তাই তারাও আইসিসের সঙ্গে প্রসার লাভ করেছিলেন।[125] আইসিসের গ্রিক ও রোমান কাল্টগুলির মাধ্যমে আইসিস ও ওসাইরিসের প্রতি উৎসর্গিত দীক্ষা-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানের একটি ধারা গড়ে উঠেছিল। এগুলির ভিত্তি ছির মিশরীয় পরকাল-সংক্রান্ত বিশ্বাসের রঙে জারিত গ্রিকো-রোমান রহস্য আচারসমূহ।[126] দীক্ষিত ব্যক্তি এমন এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতেন যে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি পাতালে ছদ্ম-অবতরণ করতেন। এই আচারের কিছু উপাদানের সঙ্গে মিশরীয় অন্ত্যেষ্টি লিপিতে উল্লিখিত সূর্যের সঙ্গে ওসাইরিসের একীভবনের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।[127] মিশরীয়দের মতো আইসিসের গ্রিক ও রোমান ভক্তেরাও মনে করত যে, দেবী যেভাবে ওসাইরিসকে রক্ষা করেছেন, তেমনি পরলোকে তিনি মৃতদের রক্ষা করেন[128] এবং তারা বলত যে এই দীক্ষা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গেলে তারা নিশ্চিতভাবে এক আশীর্বাদধন্য পরলোক প্রাপ্ত হবে।[129] প্লুটার্ক ওসাইরিসের অতিকথাটির একটি বিবরণ রচনা করেছিলেন এক গ্রিক নারী-পুরোহিতের প্রতি।[130]
প্লুটার্ক প্রমুখ ধ্রুপদি লেখকদের রচনার মাধ্যমে ওসাইরিসের অতিকথা-সংক্রান্ত জ্ঞান সংরক্ষিত হয়েছিল এমনকি খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগের পরবর্তীকালেও, যখন মিশরীয় ধর্ম সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আদিতে যে লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে অতিকথাটি নথিবদ্ধ ছিল তাও হারিয়ে গিয়েছিল। অতিকথাটি প্রাচীন মিশর সম্পর্কে পাশ্চাত্য ধারণার একটি প্রধান অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। আধুনিক কালে যখন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসকে বোঝার জন্য মূল মিশরীয় সূত্রউৎসগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলির সাহায্য নেওয়া হয়, সেই অবস্থায় অতিকথাটি এখনও নতুন ধারণাকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে। তার প্রতিফলন দেখা যায় কথাসাহিত্য থেকে গবেষকদের অনুমান ও নব্য ধর্মীয় আন্দোলনগুলিতেও।[131]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.