প্রাচীন মিশরীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম হলো বহুঈশ্বরবাদী আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব জটিল ধর্ম ব্যবস্থা এবং প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, অনেক দেবতার মত তাদের দেবতা সর্বত্র উপস্থিত এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, যা একটি মিথস্ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে গঠিত। আচার -অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রার্থনা ও নৈবেদ্য সাজিয়ে দেবতাদের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করা হত। মিশরের শাসক ফারাওদের কেন্দ্র করে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলন গড়ে ওঠে, ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তারা ঐশ্বরিক ক্ষমতারও অধিকারী বলে বিশ্বাস করত জনগণ এবং দেবতাদের কাছে পৌঁছার মাধ্যম হিসাবে মনে করত । আচার-অনুষ্ঠান ও পূজার মাধ্যমে দেবতাদের টিকিয়ে রাখতে বাধ্য করা হত, মাআত,দেবতাকে বিশ্বাস করত মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক হিসেবে, ইসফেটকে বিশৃঙ্খলা প্রতিহতকারি হিসেবে । রাষ্ট্র, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং মন্দির নির্মাণের জন্য প্রচুর সম্পদ উৎসর্গ করত ।
যে কোন ব্যক্তি নিজস্ব প্রয়োজনে দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারত, সাহায্যের জন্য আবেদন বা প্রার্থনার মাধ্যমে অথবা যাদুর মাধ্যমে দেবতাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করত । যদিও এই অনুশীলনগুলো আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা ছিল, তবুও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল ধর্ম বিশ্বাসের সাথে। মিশরীয় ইতিহাসে ফারাওদের মর্যাদা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে জনপ্রিয় ধর্মীয় ঐতিহ্য আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে ,মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরে তাদের আত্মারা বেঁচে ওঠে এবং তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের এই প্রচেষ্টা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুশীলনের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে - মৃতদেহ এবং আত্মা সংরক্ষণের জন্য সমাধি নির্মাণ, কবরের জিনিসপত্র সংরক্ষণ এবং অর্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে।
ধর্মের এই শেকড় প্রোথিত ছিল মিশরের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে, ৩৫০০ বছর ধরে । সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস পাল্টে যায়, কারণ নির্দিষ্ট দেবতাদের গুরুত্ব হ্রাস-বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জটিল সম্পর্কৈ পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন সময়ে, সূর্য দেবতা রা, স্রষ্টা দেবতা আমুন এবং মাতৃদেবী আইসিস সহ নির্দিষ্ট কিছু দেবতা অন্যদের উপরে প্রধান্য পায় । সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য, ফারাও আখেনাতেনের দ্বারা প্রবর্তিত ধর্মতত্ত্বে,লোকেরা বিশ্বাস করে, একক দেবতা, আটেন, ও ঐতিহ্যবাহী প্যান্থিয়নকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম এবং পৌরাণিক কাহিনী প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে , যার প্রমাণ অনেক লেখা ও স্মৃতিস্তম্ভে পাওয়া যায় ।
"প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে" বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলো মিশরীয় সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। মিশরীয় ভাষায় ধর্মের আধুনিক ইউরোপীয় ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো একক রূপ ছিল না। প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, বিশ্বাস এবং অনুশীলনের একটি বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে গঠিত,সাধারণের বিশ্বাস ছিল এমন, যা মানব জীবন এবং ঐশ্বরিক জগতের মধ্যে একটি সেঁতুবন্ধন। ঐশ্বরিক রাজ্যে বসবাসকারী দেবতারা পৃথিবীতে বসবাস করত, মিশরীয়দের এই ধারণাও ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । [১]
মিশরীয়দের বিশ্বাস
মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, প্রকৃতির বিষ্ময়কর ঘটনাবলি তাদের নিজেদের মধ্যে ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় শক্তির প্রবাহ। [১] দেবীর শক্তি বিভিন্ন উপাদানে এবং প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের ভেতর বিরাজমান । মিশরীয়রা সর্বদেবতার মন্দির বা প্যান্থিয়নে বিশ্বাস করত, যার ভেতর অন্তর্ভূক্ত ছিল প্রকৃতি এবং মানব সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের ধর্মীয় অনুশীলন ছিল এই ঘটনাগুলোকে টিকিয়ে রাখার, মন্দিরকে সুসংহত করা এবং মানুষের সুবিধার দিকে নজর রাখা। [২] এই বহু-ঈশ্বরবাদ ব্যবস্থা ছিল খুবই জটিল, কারণ কিছু দেবতাকে বিশ্বাস করা হত সর্বত্র বিদ্যমান এবং কিছু দেবতার একাধিক পৌরাণিক ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে, অনেক প্রাকৃতিক শক্তি, যেমন সূর্য, একাধিক পৌরানিক দেবতার সাথে যুক্ত ছিল। বৈচিত্র্যময় প্যানথিয়ন মহাবিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী দেবতা থেকে শুরু করে অতি সীমিত বা স্থানীয় ক্ষুদ্র দেবতা বা "দানব" পর্যন্ত ভূমিকা রাখত। [৩] এতে বিদেশী সংস্কৃতি থেকে গৃহীত দেবতা এবং কখনো কখনো মানুষও অন্তর্ভুক্ত ছিল: মৃত ফারাওদেরকে ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করা হতো এবং মাঝে মাঝে, ইমহোটেপের মতো বিশিষ্ট সাধারণ মানুষও দেবী হয়ে ওঠে। [৪]
শিল্পে দেবতাদের প্রতীকী চিত্র ব্যবহার করে আক্ষরিকভাবে বোঝানো হয়নি যে, দেবতারা কীভাবে আবির্ভূত বা দৃশ্যমান হতে পারে, কারণ বিশ্বাস করা হত দেবতাদের প্রকৃত প্রকৃতি রহস্যময়। এর পরিবর্তে, মূর্তিগুলোর প্রতীকী চিত্র ব্যবহার করে প্রকৃতিতে প্রত্যেক দেবতার ভূমিকা নির্দেশ করার জন্য বিমূর্ত রূপ দেওয়া হয়। [৫] কখনো আবার মূর্তির স্থির চিত্র ছিল না এবং অনেক দেবতার একাধিক রূপকে একটি প্রতিকৃতিতে চিত্রিত করা হত । [৩]
মিশরের নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য বিশেষ কিছু দেবতা নির্দিষ্ট ছিল ,যেখানে তাদের বিশ্বাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি, এই গোষ্ঠিগুলো সময়ের সাথে বদলে যেতে থাকে এবং যা কোন দেবতাসংঘ থেকে উদ্ভূত নয়।উদাহরণস্বরূপ, দেবতা মন্টু ছিলেন থিবস শহরের আদি পৃষ্ঠপোষক। তবে মধ্য রাজ্যের সময় অতিবাহিতকালে, তিনি আমুনের কারণে স্থানচ্যূত হয়েছিলেন, যিনি অন্যত্র উদ্ভূত হতে পারেন। ভিন্ন ভিন্ন দেবতার জাতীয় জনপ্রিয়তা এবং গুরুত্ব একইভাবে ওঠানামা করেছে। [৬]
দেবতাদের আন্তঃসম্পর্ক ছিল জটিল, যা আংশিকভাবে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তির মিথস্ক্রিয়া প্রতিফলিত করে। মিশরীয়রা প্রায়ই এই সম্পর্ককে প্রতিফলিত করার জন্য দলগত দেবতাদের একত্রিত করত। এছাড়াও, একটি সাধারণ পারিবারিক সংমিশ্রণ ছিল পিতা, মাতা এবং শিশুর সমন্বয়ে গঠিত ত্রয়ী দেবতা, যাদের একত্রে পূজা করা হতো। কিছু দলের গুরুত্ব ছিল বেশি। এরকম একটি দল, এনিয়েড, যা নয়টি দেবতাকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসে একত্রিত করেছিল এবং তা ছিল সৃষ্টি, রাজত্ব এবং পরকালের পৌরাণিক ক্ষেত্রে জড়িত । [৩]
দেবতাদের মধ্যে সম্পর্ক সমন্বিততার প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করা যেতে পারে, যেখানে দুই বা ততোধিক ভিন্ন দেবতা একটি যৌগিক দেবতার সাথে যুক্ত ছিল। এই প্রক্রিয়াটি ছিল এক ঈশ্বরের উপস্থিতির স্বীকৃতি স্বরূপ, যখন দ্বিতীয় ঈশ্বর প্রথম ঈশ্বরের ভূমিকা গ্রহণ করেন। দেবতাদের মধ্যে এই সংযোগ ছিল সাধারণ, এবং দুই দেবতাকে স্থায়িভাবে একত্রিত করার প্রতিনিধিত্ব করা যায়নি, এ কারণে, কিছু দেবতা একাধিক সমন্বয়বাদ সংযোগ প্রকাশ করতে পারে। [৭] কখনো কখনো, সমন্বয়বাদ একই রকম বৈশিষ্ট্যযুক্ত দেবতাদের একত্রিত করে।আবার, এটি ভিন্ন প্রকৃতির দেবতাদেরকে যুক্ত করে, যেমন লুকানো শক্তির দেবতা আমুনকে সূর্যের দেবতা রা এর সাথে যুক্ত করা হয়। ফলস্বরূপ , আমুন-রা দেবতা প্রকৃতির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে দৃশ্যমান শক্তি, সমস্ত কিছুর পিছনে থাকা শক্তিকে একত্রিত করেছিলেন। [৩]
অনেক দেবতাকে এপিথেট উপাধি দেওয়া হত, যা অন্য যেকোন দেবতার চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশ করে , প্রাকৃতিক শক্তির বাইরে এক ধরনের ঐক্যের পরামর্শ দেয়। এটি বিশেষ কিছু দেবতার ক্ষেত্রে সত্য, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিশরীয় ধর্মে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। যেমন, এর মধ্যে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষক দেবতা হোরাস, সূর্য-দেবতা রা এবং মা-দেবী আইসিস । [৩] নতুন রাজ্যের সময় অনুযায়ি (১৫৫০ –১০৭০ খ্রীঃপূর্ব ), আমুন এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।সে সময়ের ধর্মমত অনুযায়ি, আমুনের উপস্থিতি এবং সমস্ত কিছুর উপর শাসন করার বিষয়ে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে তাকে, অন্য যে কোনো দেবতার চেয়ে বেশি ঐশ্বরিক এবং সর্বব্যাপী শক্তিকে মূর্ত করে তোলে। [১]
সূর্য দেবতা
চিত্র
মহাবিশ্ব সম্পর্কে মিশরীয় ধারণা মা'আতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, যা ইংরেজি শব্দ "সত্য", "ন্যায়বিচার" এবং " আদেশ" সহ বেশ কয়েকটি ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি মহাবিশ্বের স্থির, চিরন্তন ক্রম, উভয় মহাবিশ্ব ও মানব সমাজে এবং প্রায়ই একটি দেবী হিসাবে মূর্তিমান ছিল । মিশরীয়রা বিশ্বাস করত,মাআত বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে,। মিশরীয়দের বিশ্বাস মতে, মাআত বিশৃঙ্খলা শক্তির হুমকির মধ্যে ছিল, তাই সমাজের সকলেই তাকে ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা মনে করত। মানবিক স্তরে এর অর্থ হল, সমাজের সকল সদস্যের সহযোগিতা এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করা। মহাজাগতিক স্তরে এর অর্থ হল প্রকৃতির সমস্ত শক্তির বিষয়-দেবতাদের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা। [৮] এর পরবর্তী লক্ষ্য ছিল মিশরীয় ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। মিশরীয়রা পূজার মাধ্যমে দেবতাদের টিকিয়ে রাখতে এবং বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে চেয়েছিলএবং প্রকৃতির চক্রকে স্থায়িভাবে আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদনের মাধ্যমে মহাবিশ্বে মাআত এর মর্যাদা বজায় রাখতে চেয়েছিল। [১] [৯]
মহাজগত সম্পর্কে মিশরীয় দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সময়ের ধারণা, যা মাআতের রক্ষণাবেক্ষণের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল। সময়ের রৈখিক উত্তরণে, একটি চক্রাকার চিত্রণ পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যেখানে মা'আত পর্যায়ক্রমে নানান ঘটনা দ্বারা বর্ণিত হয়েছে, যা মূল সৃষ্টিকে প্রতিধ্বনিত করে । এই ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল বার্ষিক নীল নদের বন্যা এবং এক রাজা থেকে অন্য রাজার উত্তরাধিকার, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সূর্য দেবতা রা-এর দৈনিক যাত্রা। [১] [১০]
যখন মিশরীয়রা মহাবিশ্বের আকৃতির কথা চিন্তা করত,তারা পৃথিবীকে ভূমির সমতল বিস্তৃতি হিসাবে দেখত,যা দেবতা গেব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যার উপরে সংযুক্ত রয়েছে আকাশ দেবী নাট । তাদের দুজনকে আলাদা করা হয়েছিল বাতাসের দেবতা শু দ্বারা । পৃথিবীর নীচে একটি সমান্তরাল আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং আন্ডারস্কাই রয়েছে, এবং আকাশের ওপারে নু দেবতার অসীম বিস্তৃতি রয়েছে,যেখানে বিশৃঙ্খলা এবং আদিম জলাবদ্ধ অতল গহ্বর যা সৃষ্টির আগে বিদ্যমান ছিল। [১১] [৭] মিশরীয়রা ডুয়াত নামক একটি স্থানেও বিশ্বাস করত, এটি মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের সাথে সংযুক্ত একটি রহস্যময় এলাকা, যা পাতাল বা আকাশে থাকতে পারে। রা দেবতা প্রতিদিন আকাশের নীচে এবং পৃথিবীর উপর দিয়ে ভ্রমণ করতেন এবং রাতে তিনি ভোরবেলা পুনর্জন্মের জন্য দুআতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতেন। [১২]
মিশরীয়দের বিশ্বাস মতে, এই মহাবিশ্বে তিন ধরনের সংবেদনশীল প্রাণীর বসবাস ছিল: যার এক প্রকার ছিল দেবতা; অন্য প্রকার ছিল মৃত মানুষের আত্মা, যারা ঐশ্বরিক রাজ্যে বিদ্যমান ছিল এবং দেবতারা অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিল; তৃতীয় শ্রেণী মানুষ, এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফেরাউন, যারা মানব এবং ঐশ্বরিক রাজ্যের সেতুবন্ধন করেছিলেন। [১০]
নতুন রাজ্য
চিত্র
ফারাও
মিশরবিদরা দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক করেছেন যে, ফারাওকে দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা যায় কিনা? মনে করা হয় যে, মিশরীয়রা রাজকীয় কর্তৃত্বকে একটি ঐশ্বরিক শক্তি হিসাবে দেখত। যদিও তারা স্বীকার করত যে, ফারাও মানুষ এবং মানুষের মতই দুর্বল , তারা একই সাথে তাকে একজন দেবতা হিসাবে ও দেখা হত, কারণ রাজত্বের ঐশ্বরিক শক্তি তার মধ্যে অবতীর্ণ ছিল। তাই তিনি মিশরের মানুষ এবং দেবতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছেন । [৩] তিনি ছিলেন মানব সমাজে ন্যায়বিচার ও সম্প্রীতি বজায় রেখে , মন্দির এবং পূজো দিয়ে দেবতাদের টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে মাআতকে সমুন্নত রাখার মূল চাবিকাঠি । এসব কারণে তিনি রাষ্ট্রীয় সকল ধর্মীয় কর্মকাণ্ড দেখাশুনা করতেন। [১] এমনকি, ফারাও এর বাস্তব জীবনের প্রভাব এবং সম্মান সরকারী লেখা এবং চিত্রণে তার চিত্রপট থেকে ভিন্ন হতে পারে এবং নতুন রাজ্যের শেষের দিকে তার ধর্মীয় গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। [৩] [১৩]
অনেক বিশিষ্ট দেবতার সাথেও রাজা যুক্ত ছিলেন। তিনি সরাসরি হোরাসের সাথে চিহ্নিত হতেন, যিনি নিজেই রাজত্বের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং তাকে রা-এর পুত্র হিসাবে দেখা হত , যিনি প্রকৃতিও সমাজকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করতেন । রাজা আমুনের সাথেও নতুন রাজ্যে যুক্ত ছিলেন, যা ছিল মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তি। [৫] মৃত্যুর পর রাজা নিজে সম্পূর্ণরূপে দেবতায় পরিণত হতেন। এই রাজ্যে, তিনি সরাসরি রা-এর সাথে পরিচিত ছিলেন এবং মৃত্যু ও পুনর্জন্মের দেবতা ও হোরাসের পৌরাণিক পিতা ওসিরিসের (দেবতার) সাথেও যুক্ত ছিলেন। [৩] মৃত ফারাওদের দেবতা হিসেবে পূজার জন্য মর্গে অনেক মন্দির নিবেদিত ছিল। [৯]
১৯তম রাজবংশ
মৃত্যু এবং পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্বাস মিশরীয় ধর্মতত্ত্বকে শক্তিশালী করেছিল- মানুষের অধিকারে একটি কা অথবা জীবনী-শক্তি, যা মৃতদেহকে চূড়ান্তভাবে ছেড়ে দেয়। কা তার জীবনে, ভরণ-পোষণ পেত খাদ্য এবং পানীয় থেকে । বিশ্বাস করা হত যে, মৃত্যুর পরে কষ্ট সহ্য করার জন্য, কাকে অবশ্যই খাদ্যের প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে, যার আধ্যাত্মিক মূল কথা হল তাকে অবশ্যই খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তির একটি বিএ ছিল,যা প্রত্যেকের জন্য অনন্য আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের উপর স্থাপিত। [১০] কা-এর বিপরীতে, মৃত্যুর পরেও তার দেহ ব-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। মিশরীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল বা-কে দেহ থেকে ছেড়ে দেওয়া, যাতে সে অবাধে চলাফেরা করতে পারে এবং কা- এর সাথে এটি পুনরায় যুক্ত হতে পারে, যাতে সে আখ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি, এটিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, মৃত ব্যক্তির দেহ সংরক্ষণ করতে হবে, কারণ মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, বা আখ হিসাবে সকালে আবির্ভূত হওয়ার আগে নতুন জীবন লাভ করার জন্য প্রতি রাতে তার দেহে ফিরে আসে। [১০]
মা আত
চিত্র
বিশ্বাস করা হত যে , প্রাথমিক যুগে মৃত ফেরাউন আকাশে আরোহণ করতেন এবং তারার মধ্যে বাস করতেন । [১৪] ওল্ড কিংডম (২৬৮৬ – ২১৮১ খ্রিস্টপূর্ব), সময়ের পরে এমনকি, তিনি সূর্য দেবতা রা- এর দৈনিক পুনর্জন্মের সাথে এবং যমপুরির শাসক ওসিরিসের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, কারণ এই দেবতারা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। [৫]
নতুন রাজ্য বিকাশের পর, পরকাল সম্পর্কে মিশরীয়দের বিশ্বাস জন্মে , আত্মাকে একটি চূড়ান্ত বিচারের মধ্য দিয়ে যাওয়ার আগে ডুয়াটে অতিপ্রাকৃত বিভিন্ন রকম বিপদ এড়াতে হয়, যা "হৃদয়ের ওজন" নামে পরিচিত, যা ওসিরিস এবং মূল্যায়নকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। মাআত এই বিচারে, দেবতাদের জীবিত অবস্থায় মৃত ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপকে (হৃদয়ের প্রতীক) মাআতের পালকের সাথে তুলনা করেছেন, তিনি বা তিনি(নারী) মাআত অনুসারে আচরণ করেছেন কিনা তা নির্ধারণ করতে। যদি মৃত ব্যক্তির যোগ্য বিচার করা হয়, তবে তার বা তার (নারী) কা বা আখ এ সংযুক্ত হয়ে যায়। [১৫] অনেকের সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ি, আখের 'স এর সাথে সহাবস্থান ছিল। প্রায়ই মৃতদেরকে ওসিরিসের রাজ্যে বাস করার কথা বলা হয়, যেখানে প্রেতপুর একটি মদ্যপ এবং মনোরম ভূমি। [৫] পরবর্তী জীবনের সৌর দৃষ্টি, যেখানে মৃত আত্মা রা-এর সাথে তার প্রতিদিনের যাত্রায় জাকজমকতার সাথে তারা ভ্রমণ করে, যা অন্যান্য মানুষের কাছেও এভাবে প্রসারিত হতে পারে। মধ্য ও নতুন রাজ্যের সময়কালে, এই ধারণা ছিল যে, আখ জীবিত জগতেও ভ্রমণ করতে পারে এবং সেখানকার কিছু জাদুকরী ঘটনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এই ধারণাই প্রচলিত হয়ে ওঠে। [১৬]
চিত্র
নতুন রাজ্যের সময় ফারাও আখেনাতেন সূর্য-ডিস্ক আতেনের পক্ষে অন্যান্য দেবতাদের রাষ্টীয় উপাসনা বাতিল করে। ইতিহাসে এটিকে সত্যিকারের একেশ্বরবাদী সৃষ্টিকর্তার প্রথম উপাসনা হিসাবে দেখা হয়, যদিও অ্যাটেনিস্ট ধর্মতত্ত্বের বিশদ বিবরণ এখনো অস্পষ্ট এবং এটি যে একেশ্বরবাদী ছিল তা বিতর্কিত। উপাসনা থেকে একজন দেবতা ব্যতীত অন্যদের বহিস্কার ছিল মিশরীয় ঐতিহ্যে একটি আমূল প্রবর্তন। কেউ কেউ আখেনাতেনকে একেশ্বরবাদের পরিবর্তে একাকীত্ব বা হেনোথিজমের অনুশীলনকারী হিসাবে দেখেন, [১৭] যেহেতু তিনি সরাসরি অন্যান্য দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি; তিনি শুধু আতেন ছাড়া অন্য সকল দেবতার উপাসনা থেকে বিরত ছিলেন। আখেনাতেনের উত্তরসূরিদের মাধ্যমে মিশর তার ঐতিহ্যবাহী ধর্মে প্রত্যাবর্তন করে এবং আখেনাতেন নিজেই একজন ধর্মদ্রোহী হিসেবে নিন্দিত হন। [৭] [১০]
যখন মিশরীয়দের কোন একীভূত ধর্মগ্রন্থ ছিল না, তারা বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় লেখা তৈরি করেছে। একত্রে পৃথক গ্রন্থগুলো মিশরীয় ধর্মে অনুশীলন করা হত এবং বিশ্বাসের বিস্তৃতি ছিল, কিন্তু এখনো তা অসম্পূর্ণ এবং উপলব্ধি প্রদান করে। [১৮]
রা দেবতা
মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীর উদ্দেশ্যে ছিল, প্রকৃতিতে দেবতাদের কার্যকলাপ এবং ভূমিকা বর্ণনা করা এবং তা ব্যাখ্যা করা । তাদের বর্ণিত ঘটনার বিবরণ এমন, তাদের রহস্যময় ঐশ্বরিক ঘটনাপ্রবাহ , বিভিন্ন স্বর্গীয় প্রতীকী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পরিবর্তিত হতে পারে, তাই অনেক পুরাণ বিভিন্ন ধরণের এবং বিরোধপূর্ণ সংস্করণে বিদ্যমান। [১৯] পৌরাণিক উপাখ্যানগুলো খুব কমই সম্পূর্ণরূপে লেখা হয়েছে, এবং পাঠ্যগুলোতে শুধু একটি বৃহত্তর পৌরাণিক কাহিনীর পর্ব বা ইঙ্গিত থাকে। [২০] মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীর জ্ঞান, বেশিরভাগই স্তবগান থেকে উদ্ভূত, যা বিশেষ দেবতার ভূমিকায় বর্ণিত , আচার ও জাদু গ্রন্থ থেকে উদ্ভূত এবং তা পৌরাণিক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডকে বর্ণনা করে এবং শেষকৃত্যের পাঠ্য থেকে পরবর্তী জীবনে অনেক দেবতার ভূমিকা উল্লেখ করে। কিছু তথ্যের ইঙ্গিত ধর্মনিরপেক্ষ পাঠ্যবইয়ে প্রদান করা হয়েছে। [১৮] সবশেষে, প্লুটার্কের মতো গ্রীক এবং রোমানরা মিশরীয় ইতিহাসের শেষের দিকে বিদ্যমান কিছু মিথ লিপিবদ্ধ করেন। [১৫]
মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সৃষ্টি মিথ । এই গল্প অনুসারে, বিশৃঙ্খলার আদিম সাগরে পৃথিবী একটি শুষ্ক স্থান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। কারণ, পৃথিবীর জীবনে সূর্য খুবই অপরিহার্য, রা-এর প্রথম উদয়ের প্রকাশিত মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করে। পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন উপায়ে সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে: আদিম দেবতা আতুমের এমন উপাদানে রূপান্তর, যার আদলে বিশ্ব গঠিত , বুদ্ধিজীবী দেবতা পতাহের সৃজনশীল বক্তৃতা এবং আমুনের লুকানো শক্তি হিসাবে কাজ করে। [১০] সবশেষে এই বৈচিত্র সৃষ্টির কাজে মাআতের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়- চক্রের প্যাটার্নকে প্রতিনিধিত্ব করে। [৯]
সমস্ত মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওসিরিস মিথ । [১] এতে ঐশ্বরিক শাসক ওসিরিসের কথা বলা হয়েছে, যাকে তার ঈর্ষান্বিত ভাই সেট দ্বারা হত্যা করা হয় , যে দেবতা প্রায়ই বিশৃঙ্খলার সাথে যুক্ত। [১৫] ওসিরিসের বোন এবং স্ত্রী আইসিস তাকে পুনরুত্থিত করেন, যাতে তিনি তার উত্তরাধিকারী হোরাসকে গর্ভধারণ করতে পারেন। ওসিরিস তখন প্রেতপুরে প্রবেশ করেন এবং মৃতদের শাসক নিযুক্ত হন। বড় হওয়ার পর, হোরাস সেটকে পরাজিত করে নিজেই রাজা হন। [২২] অরাজকতার সাথে সেটের সম্পর্ক , ওসিরিস এবং হোরাসকে সঠিক শাসক হিসেবে চিহ্নিত করে, ফারাওদের উত্তরাধিকারের জন্য একটি যুক্তি প্রদান করে এবং শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসাবে চিত্রিত করে। একই সময়ে, ওসিরিসের মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম মিশরীয় কৃষি চক্রের সাথে সম্পর্কিত ছিল, যেখানে নীল নদের বন্যার কারণে ফসল বৃদ্ধি পেত এবং মৃত্যুর পরে মানব আত্মার পুনরুত্থানের জন্য একটি টেমপ্লেট (মাপনদন্ড নিয়ামক) এর যোগান দিত ।[১৫]
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক মোটিফ (সঙ্গীতের অন্তরঙ্গ বিষয়) ছিল প্রতি রাতে দুআতের মাধ্যমে রা-এর ভ্রমণ। এই ভ্রমণের সময়, রা এর সাথে ওসিরিসের দেখা হত , যিনি আবার পুনর্জন্মের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছেন, যাতে তার জীবন পুনর্জীবন লাভ করে । এছাড়াও তিনি প্রতি রাতে বিশৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্বকারী সর্প দেবতা অ্যাপেপের সাথে যুদ্ধ করেছেন। অ্যাপেপের পরাজয় এবং ওসিরিসের সাথে সাক্ষাতের পরদিন সকালে সূর্যের উদয় নিশ্চিত করত, এটি এমন একটি ঘটনা যা পুনর্জন্ম এবং বিশৃঙ্খলার উপর শৃঙ্খলার বিজয়কে প্রতিনিধিত্ব করে। [১৫]
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পদ্ধতিগুলো বারংবার পাপিরিতে লেখা হত, যা আচার পালনকারীদের জন্য নির্দেশনা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এই ধর্মীয় আচার বিষয়ক পুস্তকগুলো প্রধানত মন্দিরের গ্রন্থাগারে রাখা হত। মন্দিরগুলো নিজেরাও এই জাতীয় পাঠ্যের সাথে খোদাই করা হত, বিভিন্ন চিত্র সহযোগে ।, এই শিলালিপিগুলো আচার পাপিরির বিপরীতে নির্দেশনা হিসাবে তৈরি করা হয়নি, তবে বাস্তবে, লোকেরা সেগুলো সম্পাদন করা বন্ধ করে দিলেও প্রতীকীভাবে আচারগুলোকে স্থায়ি করার উদ্দেশ্যে ছিল। [৭] জাদুকরী পাঠ্যগুলো একইভাবে আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেয়, যদিও এই আচারগুলো দৈনন্দিন জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের জন্য ব্যবহৃত বানানের অংশ ছিল, তাদের জাগতিক উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও। এই গ্রন্থগুলোর অনেকটা মন্দিরের গ্রন্থাগারে উদ্ভূত হত এবং পরে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত । [২০]
মিশরীয়রা কবিতার আকারে লেখা অসংখ্য প্রার্থনা ও প্রশস্তি গান রচনা করত। প্রশস্তি এবং প্রার্থনা একই রূপ কাঠামোকে অনুসরণ করে তৈরি এবং প্রশস্তিগুলো প্রধানত যে উদ্দেশ্যে পরিবেশন করে তার দ্বারা উভয়কে আলাদা করা হয়। প্রশস্তিগুলো বিশেষ দেবতার প্রশংসা করার জন্য লেখা হত। [২৩] পাপিরি এবং মন্দিরের দেয়ালে এ সব লেখা হত এবং মন্দিরের শিলালিপিতে লেখা আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে আবৃত্তি করত । [৭] যার বেশিরভাগ কাঠামো একটি নির্দিষ্ট সাহিত্যিক সূত্র অনুসারে গঠন করা হয়, যা প্রদত্ত দেবতার প্রকৃতি, দিক এবং পৌরাণিক কার্যাবলি ব্যাখ্যা করার জন্য নকশা করা হয়েছে। [২৩] যেখানে অন্যান্য মিশরীয় ধর্মীয় লেখার তুলনায় মৌলিক ধর্ম সম্পর্কে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং নতুন রাজ্যে ধর্মীয় বিষয় গুরুত্ব পায়, একই নকশা অনুসরণ করে ঈশ্বরের কাছে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন, আশীর্বাদ, সাহায্য বা অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই ধরনের প্রার্থনা নতুন রাজ্যের আগে বিরল ছিল, যা ইঙ্গিত করে যে, পূর্ববর্তী সময়ে কোনো দেবতার সাথে এই ধরনের সরাসরি ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়া সম্ভব ছিল না, বা অন্তত লিখিতভাবে প্রকাশ করার সম্ভাবনা কম ছিল। এগুলো মূলত মূর্তির শিলালিপি এবং পবিত্র স্থানে ভক্তিমূলক অর্ঘ হিসাবে রেখে যাওয়া স্টেলা থেকে পরিচিত। [২৪]
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাপকভাবে সংরক্ষিত মিশরীয় লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পাঠ্যগুলি ,যাতে মৃত্যুর পর আত্মারা একটি আনন্দদায়ক পরিবেশে পরকালে পৌঁছে যায়, এ বিষয় নিশ্চিত করার জন্য নকশা করা হয়েছে। [১০] এর মধ্যে রয়েছে প্রাচীনতম পিরামিড টেক্সট । এগুলো পুরানো রাজ্যের সময় রাজকীয় পিরামিডের দেয়ালে খোদাই করা শত শত বানানের একটি মুক্ত সংগ্রহ, যার উদ্দেশ্য সঠিকভাবে ফারাওদের পরকালে দেবতাদের সাথে যোগ দেওয়ার উপায় সরবরাহ করা । [২৫] বর্ণগুলো বিভিন্ন বিন্যাস এবং সংমিশ্রণে প্রদর্শিত এবং যা কয়েকটি পিরামিডের মধ্যে চিত্রিত। [৫]
পুরানো রাজ্যের শেষের দিকে, পিরামিড পাঠ্যের স্তুতি নতুন দেহের শেষকৃত্যের মন্ত্র সমাধিতে প্রদর্শিত হতে শুরু করে, যা প্রাথমিকভাবে কফিনে খোদাই করা হত । লেখার এই সংগ্রহটি কফিন টেক্সটস নামে পরিচিত, এবং এটি রাজকীয়তার জন্য সংরক্ষিত ছিল না, অ-রাজকীয় কর্মকর্তাদের সমাধিতে খোদাই করা হত । [১৪] নতুন রাজ্যে, কিছু নতুন শেষকৃত্য পাঠের আবির্ভাব ঘটে, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল বুক অফ দ্য ডেড । যা পূর্ববর্তী বই থেকে ভিন্ন, এতে বিস্তৃত চিত্র বা ভিগনেট থাকে। [২৫] বইটি প্যাপিরাসে কপি করা হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা হত, তাদের সমাধিতে রাখার জন্য। [২২]
কফিন পাঠ্যগুলোতে পাতালপুরের বিশদ বিবরণ রয়েছে এবং কীভাবে সেখানে বিপদ কাটিয়ে উঠতে হবে, তার নির্দেশাবলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। নতুন রাজ্যে, এই তথ্য রয়েছে বুক অফ গেটস, বুক অফ ক্যাভার্নস এবং আমদুয়াত সহ বেশ কয়েকটি "নেদারওয়ার্ল্ডের বই" এ । [১০] মন্ত্রের মুক্ত সংগ্রহের বিপরীতে, নেদারওয়ার্ল্ড (অধোভূবন) বইগুলো রা'র দুআতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এবং সাদৃশ্য অনুসারে, মৃত ব্যক্তির আত্মার মধ্য দিয়ে, মৃত আত্মার যাত্রার কাঠামোগত চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলো মূলত ফারাওনিক সমাধিতে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে তৃতীয় মধ্যবর্তী সময়কালে আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। [২৫]
আইসিস মন্দির
মিশরীয় ইতিহাসের শুরু থেকে মন্দিরগুলো বিদ্যমান ছিল। তারা মৃত ফারাওদের আত্মা এবং পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের নিবেদিত মন্দিরগুলো পরিবেশন করার জন্য মৃতদেহ মন্দির উভয়ই অন্তর্ভুক্ত করত , যদিও পার্থক্যটি অস্পষ্ট ছিল কারণ দেবত্ব এবং রাজত্ব খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। [৯] মন্দির প্রাথমিকভাবে সাধারণ জনগণের উপাসনার স্থান হিসাবে উন্মুক্ত ছিল না এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুশীলনের জন্য জটিল অধ্যায় ছিল। এর বদলে, রাষ্ট্র-চালিত মন্দিরে দেবতাদের আবাস হিসাবে কাজ করত, যেখানে তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করা শারীরিক ব্যক্তির চিত্রের যত্ন নেওয়া হত এবং অর্ঘ প্রদান করা হত । এই পরিষেবাটি দেবতাদের টিকিয়ে রাখার জন্য আবশ্যক বলে মনে করা হত , যাতে তারা নিজেরা মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। [২৬] এভাবে, মন্দিরগুলো ছিল মিশরীয় সমাজের কেন্দ্রবিন্দু, এবং বিশাল সম্পদ তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিবেদিত ছিল, যার মধ্যে রাজতন্ত্রের দান এবং তাদের নিজস্ব সম্পত্তি ছিল। ফারাওরা প্রায়ই দেবতাদের সম্মান করার জন্য বাধ্যবাধকতার অংশ হিসাবে তাদের প্রসারিত করত, যাতে অনেক মন্দির বিশাল আকারে বৃদ্ধি পায়। [২৭] যাইহোক, সমস্ত দেবতাদের মন্দিরে তাদের উৎসর্গ করার রেওয়াজ ছিল না, কারণ সরকারের ধর্মমতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেবতা শুধু সামান্য উপাসনা পেতেন এবং অনেক গৃহস্থালী দেবতাই মন্দিরের আচার অপেক্ষা জনপ্রিয় পূজার মধ্যমনি ছিলেন। [২৭]
প্রাচীন মিশরীয় মন্দিরগুলো ছিল ছোট, অস্থায়ী কাঠামো, কিন্তু পুরাতন এবং মধ্য রাজ্যের মাধ্যমে তাদের নকশা আরো বিস্তৃত হয় এবং সেগুলো ক্রমান্বয় পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় । নতুন রাজ্যে, মৌলিক মন্দিরের বিন্যাস আবির্ভূত হয়, যা পুরাতন এবং মধ্য রাজ্যের মন্দিরগুলোর সাধারণ উপাদান থেকে উদ্ভূত । এই পরিকল্পনা তখন থেকে নির্মিত বেশিরভাগ মন্দিরের জন্য ব্যবহার করা হত এবং বর্তমানে টিকে থাকা বেশিরভাগ মন্দিরই এভাবে নির্মিত। এই নীতি পরিকল্পনায়, মন্দিরটি একটি কেন্দ্রীয় শোভাযাত্রার পথ ধরে তৈরি করা হত, যা আদালত এবং হল একটি সিরিজের মধ্য দিয়ে গভীর অরণ্যে নিয়ে যায়, যেখানে মন্দিরের দেবতার মূর্তি অবস্থিত। মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র অংশে ফারাও এবং সর্বোচ্চ পদমর্যাদার পুরোহিতদের জন্য প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ ছিল। মন্দিরের প্রবেশদ্বার থেকে অভয়ারণ্য পর্যন্ত যাত্রাপথ, মানব জগৎ থেকে ঐশ্বরিক রাজ্যে যাত্রা হিসাবে দেখা হত , মন্দির স্থাপত্যে উপস্থিত জটিল পৌরাণিক প্রতীকবাদের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। [৭] মন্দির ভবনের বাইরের দিকের প্রাচীরটি ঠিক ছিল। উভয় মন্দিরের প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করার জন্য কর্মক্ষেত্র এবং গুদামজাত এলাকা সহ অনেকগুলো সহায়ক ভবন ছিল এবং যেখানে মন্দিরের পবিত্র লেখা সেই পাঠাগার এবং জাগতিক রেকর্ড রাখা হয়েছে এবং যা অনেক বিষয়ে শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। [২৭]
ফারাওদের দায়িত্ব ছিল তাত্ত্বিকভাবে মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনা করা , কারণ তিনি ছিলেন দেবতাদের কাছে মিশরের সরকারী প্রতিনিধি। মূলত, আচার-অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব সবসময় পুরোহিতদের দ্বারা সম্পাদিত হত। পুরাতন এবং মধ্য রাজ্যের সময়, পুরোহিতদের আলাদা কোন শ্রেণী ছিল না; এর বদলে, সরকারী অনেক কর্মকর্তা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার আগে, বছরের কয়েক মাস এই ক্ষমতায় কাজ করতেন । শুধু , নতুন রাজ্যে, পেশাদার যাজকত্ব ব্যাপক আকার ধারণ করে, যদিও অনেক নিম্ন-পদস্থ যাজক তখনো অস্থায়ি হিসেবে ছিলেন। সবাই তখনো রাষ্ট্র দ্বারা নিযুক্ত ছিলেন, এবং ফারাও তাদের নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন । [২৮] যাইহোক, মন্দিরের সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরোহিতদের প্রভাবও বৃদ্ধি পেতে থাকে, যতক্ষণ না এটি ফারাওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে। তৃতীয় মধ্যবর্তী সময়ের রাজনৈতিক বিভাজনে (১০৭০ – ৬৬৪ খ্রিস্টপূর্ব), কর্নাকের আমুনের মহাযাজকরা এমনকি উচ্চ মিশরের কার্যকর শাসক হয়ে ওঠেন। [২৭] মন্দিরের কর্মচারীদের মধ্যে পুরোহিত ছাড়া অন্যান্য অনেক লোককে অন্তর্ভুক্ত করা হত , যেমন মন্দিরের অনুষ্ঠানগুলোতে সঙ্গীতশিল্পী এবং গীতিকার। মন্দিরের বাইরে কারিগর এবং অন্যান্য শ্রমিকরা ছিল, যারা মন্দিরের প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করতে সাহায্য করত, সেইসাথে কৃষকরা যারা মন্দিরের রাজ্যে কাজ করত। মন্দিরের প্রয়োজনে সমস্ত আয়ের অংশ দিয়ে দেওয়া হত । তাই বড় মন্দিরগুলো ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কখনো কখনো সেখানে হাজার হাজার লোককে নিয়োগ করত। [২৭]
চিত্র- অনুষ্ঠান
স্টেলা
রাষ্ট্রীয় ধর্ম অনুশীলনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল দেবতার ধর্মের সাথে জড়িত মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐশ্বরিক রাজত্ব সম্পর্কিত অনুষ্ঠান। পরবর্তী আচারের মধ্যে ছিল রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান এবং সেড উত্সব, যা ফারাওয়ের শক্তির একটি আনুষ্ঠানিক পুনঃপ্রতিষ্ঠাকরণ, তাদের রাজত্বকালে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত হত । [২৯] সারা দেশে সংঘটিত আচার সহ মন্দিরের অসংখ্য আচার-অনুষ্ঠান ছিল এবং তা একক মন্দির বা একক দেবতার মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতিদিন কিছু সঞ্চালিত হত , অন্যগুলো বার্ষিক বা বিরল অনুষ্ঠানে সংঘটিত হত । [৩০] সবচেয়ে সাধারণ মন্দিরের আচার অনুষ্ঠান ছিল সকালের পূজা , যা সারা মিশর জুড়ে প্রতিদিন মন্দিরে চলত। এতে, একজন উচ্চ-পদস্থ পুরোহিত বা মাঝে মাঝে ফারাও, নৈবেদ্য সহ উপস্থাপন করার আগে দেবতার মূর্তিটিকে ধুয়ে, অভিষিক্ত করে এবং বিশেষ পোশাক পরিধান করে নিত। অতপর, যখন দেবতা নৈবেদ্যের আধ্যাত্মিক সারাংশ গ্রাস করত, তখন অন্যান্য জিনিসগুলো নিজেরাই পুরোহিতদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য নিয়ে যেত। [২৯]
দূরে অবস্থিত মন্দিরের আচার-অনুষ্ঠান, বা উৎসবের সংখ্যা ছিল সীমাহীন, যা প্রতি বছর ডজন ডজন ঘটত। এই উৎসবগুলো দেবতাদের কাছে সাধারণ অর্ঘ্যের বাইরে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন নির্দিষ্ট পৌরাণিক কাহিনীর পুনর্বিন্যাস বা বিশৃঙ্খলা শক্তির প্রতীকী ধ্বংস। [৩১] এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই পুরোহিতদের দ্বারা উদযাপন করা হত এবং মন্দিরের ভিতরেই সংঘটিত হত। [৩০] যাইহোক, কার্নাকে উদযাপিত ওপেট উৎসবের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির উৎসব ছিল উল্লেখযোগ্য স্থান। যেমন দেবতার মন্দির দেখার জন্য একটি মডেল বারকে অভয়ারণ্যের বাইরে দেবতার মূর্তি বহনের শোভাযাত্রা। সাধারণ মানুষ শোভাযাত্রা দেখার জন্য জড়ো হত এবং কখনো কখনো এই অনুষ্ঠানে দেবতাদের দেওয়া নৈবেদ্যের অংশ গ্রহণ চলত। [২৮]
ষাঁড়ের চিত্র
এপিস
অনেক পবিত্র স্থানে, মিশরীয়রা পৃথক প্রাণীদের পূজা করত, যেগুলোকে তারা বিশ্বাস করত বিশেষ দেবতার প্রকাশ হিসেবে। এই প্রাণীগুলো নির্বাচন করা হত নির্দিষ্ট কিছু চিহ্নের উপর ভিত্তি করে এবং তাদের বিশ্বাসের যোগ্যতা অর্জনে নির্দেশ করে। পূজার প্রাণীদের মধ্যে কিছু সারা জীবনের জন্য তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে, যেমন এপিস ষাঁড় মেমফিসে Ptah এর প্রকাশ হিসাবে পূজা করা হত। কিছু প্রাণী অনেক কম সময়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। এই ধর্মবিশ্বাস পরবর্তী সময়ে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনেক মন্দির এমন সব প্রাণীর মজুত সংগ্রহ করতে শুরু করে, যেখান থেকে একটি নতুন ঐশ্বরিক আবির্ভাব বেছে নেওয়া যায়। [৭] ছাব্বিশতম রাজবংশের মাঝে একটি নতুন প্রথার বিকাশ ঘটেছে, যখন মানুষ নির্দিষ্ট প্রজাতির যে কোনো একটি সদস্যকে মমি করা শুরু করে, যা দেবতা প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে। লক্ষ লক্ষ মমি করা বিড়াল, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীকে মিশরীয় দেবতাদের সম্মানে মন্দিরে সমাহিত করা হত। [২২] [৩২] উপাসকরা একজন নির্দিষ্ট দেবতার পুরোহিতদের অর্থ প্রদান করতেন এবং মৃত্যুর পর সেই দেবতার সাথে প্রাণীটিকে মমি করতেন এবং মমিটি দেবতার উপাসনা কেন্দ্রের কাছে একটি কবরস্থানে স্থাপন করা হত ।
মিশরীয়রা দেবতাদের কাছে জ্ঞান বা নির্দেশনা চাইতে ওরাকল (দৈববাণী) ব্যবহার করত। মিশরীয় ওরাকল প্রধানত পরিচিতি লাভ করে নতুন রাজ্য থেকে, যদিও তারা অনেক আগে থেকে এর সাথে পরিচিত ছিল। রাজাসহ সব শ্রেণীর মানুষ ওরাকলের কাছে প্রশ্ন করে সমাধান চাইত । [৩৩] ওরাকলের সাথে পরামর্শ করার সবচেয়ে সাধারণ উপায় ছিল, উৎসব মিছিলে ঐশ্বরিক মূর্তি বহন করার সময় তার কাছে একটি প্রশ্ন করা এবং বার্কের গতিবিধি থেকে একটি উত্তর ব্যাখ্যা করা। অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে ছিল পূজার প্রাণীদের আচরণ ব্যাখ্যা করা, লট আঁকা বা মূর্তির সাথে পরামর্শ করা, যার মাধ্যমে একজন পুরোহিত স্পষ্টতই কথা বলত। ঈশ্বরের ইচ্ছা নির্ণয় করার মাধ্যম সেই পুরোহিতদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলত, যারা ঈশ্বরের বার্তার কথা বলতেন এবং ব্যাখ্যা করতেন। [৩৪]
যদিও রাষ্ট্রীয় উপাসানয় মিশরীয়রা বিশ্বের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল, সাধারণ মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় অনুশীলন ছিল- তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। [৩৫] ধর্মের জনপ্রিয়তা সরকারী উপাসনার তুলনায় কম প্রমাণ রেখেছে, যেহেতু এই উপাসনার বেশিরভাগ মিশরীয় জনসংখ্যার ধনী অংশ দ্বারা অনুষ্ঠিত হত , সেজন্য তা জনগণের অনুশীলনকে প্রতিফলিত করতে ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। [৩৬]
জনপ্রিয় ধর্মীয় অনুশীলনের মধ্যে ছিল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন চিহ্নিত করা অনুষ্ঠান । জন্ম প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বিপদের কারণ এবং নামকরণ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল, কারণ নামটিকে একজন ব্যক্তির পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে ধরা হত । অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মৃত্যুকে ঘিরে, কারণ তারা এর বাইরে আত্মার বেঁচে থাকায় নিশ্চিত ছিল। [৭] অন্যান্য ধর্ম- চর্চায় ক্ষেত্রে দেবতাদের ইচ্ছাকে বোঝার জন্য বা তাদের জ্ঞানের সন্ধান করার চেষ্টা করা হত। যেমন স্বপ্নের ব্যাখ্যা, যা ঐশ্বরিক রাজ্যের বার্তা হিসাবে দেখা হত এবং ওরাকলের পরামর্শ গ্রহণ করত । মানুষ মায়াবি আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সুবিধা আদায়ের জন্য দেবতাদের আচরণকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করত। [৩৭]
স্বতন্ত্র মিশরীয়রাও দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করত এবং তাদের ব্যক্তিগত উপহার প্রদান করত। এই ধরনের ব্যক্তিগত ধার্মিকতার প্রমাণ নতুন রাজ্যের পূর্বে খুবই কম ছিল।এটি সম্ভবত অরাজকীয় ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উপর সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধের কারণে ঘটেছে, যখন মধ্য ও নতুন রাজ্যের সময় শিথিল ছিল।পরবর্তীতে, ব্যক্তিগত ধার্মিকতা নতুন রাজ্যে আরো বেশি শক্তিশালি হয়ে ওঠে, যখন বিশ্বাস করা হত যে, দেবতারা ব্যক্তিগত জীবনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন, অন্যায়কারীদের শাস্তি দেন এবং ধার্মিকদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। [২৪] সরকারী মন্দিরে ব্যক্তিগত প্রার্থনা এবং পূজার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল, যদিও তাদের কেন্দ্রীয় কার্যক্রম সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ ছিল। মিশরীয়রা প্রায়ই মন্দিরের দেবতাকে নিবেদনের জন্য জিনিসপত্র এবং মন্দির প্রাঙ্গণে স্থাপন করার জন্য প্রার্থনা সহ খোদাই করা জিনিস দান করত। প্রায়ই তারা মন্দিরের মূর্তির সামনে ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করত বা তাদের ব্যবহারের জন্য আলাদা করে রাখত । [৩৬] তবুও মন্দির ছাড়া, জনসাধারণ পৃথক স্থানীয় চ্যাপেল ও ব্যবহার করত, যা আনুষ্ঠানিক মন্দিরের চেয়ে ছোট ছিল কিন্তু আরো গ্রহণযোগ্য। এই চ্যাপেলগুলো অনেক বেশি ছিল এবং সম্ভবত নানা সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। [৩৮] অনেক পরিবারের দেবতা বা মৃত আত্মীয়দের উত্সর্গ করার জন্য তাদের নিজস্ব ছোট মন্দির ছিল। [৩৫]
এই পরিস্থিতিতে, আমন্ত্রিত দেবতারা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রে থাকা আরাধ্য দেবতাদের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় অনেক দেবতা, যেমন উর্বরতা দেবী তাওয়ারেট এবং গৃহ রক্ষাকারী বেস, তাদের নিজস্ব কোনো মন্দির ছিল না। এমনকি, আমুন এবং ওসিরিস সহ অন্যান্য অনেক দেবতা জনপ্রিয় এবং সরকারী উভয় ক্ষেত্রেই ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। [৫] কিছু ব্যক্তি বিশেষভাবে একক দেবতার প্রতি অনুগত হতে পারে। প্রায়ই তারা তাদের নিজস্ব অঞ্চলের সাথে বা ব্যক্তি জীবনে তাদের ভূমিকার সাথে যুক্ত দেবতাদের পক্ষপাত করত। যেমন, দেবতা Ptah তার মেমফিসের উপাসনা কেন্দ্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা পূজা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকের চেয়ে বেশি দেশব্যাপী শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন। [১৮]
চিত্র
" জাদু " শব্দটি সাধারণত মিশরীয় শব্দ হেকাকে অনুবাদ করতে ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ জেমস পি অ্যালেনের মতে, "পরোক্ষ উপায়ে মায়া বা ছলনার দ্বারা কোনকিছু ঘটানোর ক্ষমতা"। [১০]
হেকাকে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা বলে বিশ্বাস করা হত, এমন শক্তি যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল এবং যা দেবতারা তাদের ইচ্ছামত কাজ করার জন্য ব্যবহার করত। মানুষও এটি ব্যবহার করতে পারে, এবং জাদুবিদ্যার অনুশীলন ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। বাস্তবে, মন্দিরগুলোতে সঞ্চালিত নিয়মিত আচার -অনুষ্ঠানকে জাদুকরী হিসাবে গণ্য করা হত । [২০] লোকেরা প্রায়ই ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে জাদুর কৌশল ব্যবহার করত। যদিও এ বিষয় অন্য লোকেদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তবে কোনো জাদুকে নিজের মধ্যে শত্রু হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি।এর পরিবর্তে, যাদুকে প্রাথমিকভাবে মানুষের জন্য নেতিবাচক ঘটনার প্রতিরোধ কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসাবে দেখা হত । [৩৯]
যাদু পুরোহিতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। যেহেতু, মন্দিরের পাঠাগারে বিপুল পরিমান জাদুবিদ্যার পাঠ্য থাকত, তাই যাদুবিদ্যার জ্ঞান বক্তা পুরোহিতদের দ্বারা আত্মস্থ করা হত, যারা এই গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করত । পুরোহিতরা প্রায়ই তাদের মন্দিরের বাইরে কাজ করত, সাধারণ লোকদের কাছে তাদের যাদুকররা পরিষেবা প্রদান করত। অন্যান্য পেশায় ও সাধারণত তাদের কাজের অংশ হিসাবে যাদু ব্যবহার করত, যার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা, ভাগ্য গণনা এবং যাদুকরী তাবিজ প্রস্তুতকরণ। এটাও সম্ভব যে, কৃষকরা তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যে জাদু ব্যবহার করত , কিন্তু এই জাদুবিদ্যা মৌখিকভাবে ব্যবহার করা হত, এর সীমিত প্রমাণ রয়েছে। [২০]
ভাষা হেকার সাথে এমনভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল যে, লেখার দেবতা থথকে কখনো কখনো হেকার উদ্ভাবক বলা হত। [২০] অতএব, যাদুতে প্রায়ই লিখিত বা কথ্য মন্ত্র অন্তর্ভূক্ত ছিল, যদিও এগুলো সাধারণত আচার-অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিল। প্রায়ই আচার অনুষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত কার্য সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত দেবতাকে আহ্বান করে, হেকার তার শক্তি ব্যবহার করে দেবতাকে কাজ করতে বাধ্য করে। কখনো কখনো পৌরাণিক কাহিনীতে একটি চরিত্রের ভূমিকায় অনুশীলনকারী বা আচারের বিষয়কে প্রতিফলিত করে, এইভাবে দেবতাকে সেই ব্যক্তির প্রতি পৌরাণিক কাহিনীর মতো আচরণ করতে প্ররোচিত করে।
আচার-অনুষ্ঠানে সহানুভূতিশীল জাদুও যুক্ত করে, এমন বস্তু ব্যবহার করে, যা বিশ্বাসের সাথে যাদুর উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। মিশরীয়রা সাধারণত এমন বস্তু ব্যবহার করত, যেগুলোকে তাদের নিজস্ব হেকা দিয়ে আবদ্ধ বলে মনে করা হত, যেমন জাদুকরী প্রতিরক্ষামূলক তাবিজগুলি সাধারণ মিশরীয়রা প্রচুর পরিমাণে পরিধান করত। [২০]
চিত্র- অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া
সমাধীর পূর্বে অনুষ্ঠান
চিত্র
যেহেতু, আত্মার বেঁচে থাকার প্রয়োজন বলে বিবেচিত হত , তাই দেহের সংরক্ষণ ছিল মিশরীয় শেষকৃত্য অনুশীলনের একটি মূল অংশ। আসলে, মিশরীয়রা তাদের মৃতদের মরুভূমিতে সমাধিস্থ করত, যেখানে শুষ্ক অবস্থা প্রাকৃতিকভাবে দেহকে মমি করে । প্রাথমিক রাজবংশীয় যুগে, তারা বৃহত্তর সুরক্ষার জন্য সমাধি ব্যবহার করা শুরু করে এবং দেহটি বালির ক্ষয়কারী প্রভাব থেকে নিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং যা প্রাকৃতিক ক্ষয় সাপেক্ষ ছিল। এভাবে, মিশরীয়রা তাদের বিস্তৃত সুগন্ধি প্রথার বিকাশ ঘটায়, যাতে মৃতদেহকে কৃত্রিমভাবে শুষ্ক করা হয় এবং কফিনে রাখার জন্য মোড়ানো হয়। [২২] প্রক্রিয়ার গুণমান খরচ অনুসারে পরিবর্তিত হত এবং যারা এটি বহন করতে পারেনি, তাদের ও মরুভূমির কবরে সমাহিত করা হত। [৫]
একবার মমিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, মৃত ব্যক্তির বাড়ি থেকে মমিকে শেষকৃত্যের সমাধিতে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং বিভিন্ন পুরোহিতরা অন্তর্ভুক্ত থাকত। সমাধিস্থের আগে, পুরোহিতরা মৃত ব্যক্তির সংবেদন পুনরুদ্ধার করতে এবং তাকে অর্ঘ গ্রহণ করার ক্ষমতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খোলার অনুষ্ঠান সহ বেশ কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন করতেন। এরপর, মমিকে কবর দেওয়া হত এবং সমাধিটি সিল করা হত। [১৪] পরবর্তীতে, আত্মীয়স্বজন বা ভাড়াটে যাজকরা নিয়মিত বিরতিতে কাছাকাছি একটি মর্চুরি চ্যাপেলে মৃত ব্যক্তিকে খাদ্য অর্ঘ দিতেন। সময়ের সাথে সাথে, পরিবারগুলো কারণবশতঃ দীর্ঘ-মৃত আত্মীয়দের উপহারকে অবহেলা করত এবং বেশিরভাগ মর্চুরি উপাসনা কেবল এক বা দুই প্রজন্ম স্থায়ি হত । [১৪] যাইহোক, যখন ধর্ম স্থায়ি হয় , জীবিতরা কখনো কখনো মৃত আত্মীয়দের সাহায্যের জন্য চিঠি লিখত, এই বিশ্বাসে যে, মৃতরা জীবিতদের জগতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন দেবতারা করত। [৫]
মিশরীয়দের প্রথম সমাধি ছিল মাস্তাবাস, আয়তক্ষেত্রাকার ইটের কাঠামো, যেখানে রাজা এবং অভিজাতদের সমাধিস্থ করা হত । তাদের প্রত্যেকটিতে একটি ভূগর্ভস্থ সমাধি কক্ষ এবং মৃতদেহের আচার অনুষ্ঠানের জন্য মাটির উপরে একটি পৃথক চ্যাপেল ছিল। পুরাতন রাজ্যে মাস্তাবা পিরামিডের উন্নতি করেছে, যা মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীর আদিম ঢিবির প্রতীক। পিরামিড রাজকীয়তার জন্য সংরক্ষিত ছিল এবং তাদের স্তরে বসা বড় মর্চুয়ারি মন্দিরের সাথে ছিল। মধ্য রাজ্যের ফারাওরা পিরামিড তৈরি করতে থাকে, কিন্তু মাস্তাবাসের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ক্রমান্বয়ে , পর্যাপ্ত উপায়ে সাধারণ লোকদেরকে পাথর কাটা সমাধিতে সমাধিস্থ করা হত , যার কাছাকাছি আলাদা মর্চুরি চ্যাপেল ছিল, এমন পদ্ধতি যা সমাধিতে ডাকাতির জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নতুন রাজ্যের শুরুতে এমনকি ফারাওদেরও এই ধরনের সমাধিতে সমাহিত করা হত এবং ধর্মের পতন না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল। [১৪]
সমাধিতে মৃত ব্যক্তির প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য মালামালের একটি বিশাল বৈচিত্র্য-সমাহার থাকতো, যাতে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেহের বিকল্প হিসাবে কাজ করে। [১৫] কারণ বিশ্বাস করা হত যে, মৃত ব্যক্তিকে পরবর্তী জীবনে কাজ করতে হবে, ঠিক যেমন ইহ জীবনে কাজ করতে হয়েছে, দাফনে প্রায়ই মৃত ব্যক্তির জায়গায় কাজ করার জন্য মানুষের ছোট মডেল অন্তর্ভুক্ত ছিল। [১৪] প্রাথমিক রাজকীয় সমাধিতে পাওয়া মানব বলিদান সম্ভবত ফারাওকে তার পরবর্তী জীবনে সেবা করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। [৪০]
ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সমাধিতে আসবাবপত্র, পোশাক এবং অন্যান্য দৈনন্দিন জিনিসপত্রও থাকতে পারে, যা ছিল পরবর্তী জীবনে ব্যবহারের জন্য , তাবিজ এবং অন্যান্য মালামালের সাথে আত্মিক জগতের বিপদের বিরুদ্ধে যাদুকরী সুরক্ষা প্রদান করা যায়। [১৪] দাফনের অন্তর্ভুক্ত শেষকৃত্যের পাঠ্য দ্বারা আরো সুরক্ষা প্রদান করা হত । সমাধির দেয়ালেও শিল্পকর্ম রয়েছে, যেমন মৃত ব্যক্তির খাবার খাওয়ার ছবি, বিশ্বাস করা হয় যে, মর্গের প্রস্তাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে যাদুকরীভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে দেয়। [২২]
চিত্র
চিত্র
নামবার
নামবার প্যালেট
চিত্র
মিশরীয় ধর্মের সূচনা প্রাগৈতিহাস কাল থেকে প্রসারিত, যদিও এর প্রমাণ পাওয়া যায় শুধু বিক্ষিপ্ত এবং অস্পষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড থেকে। পূর্ববংশীয় যুগে যত্ন সহকারে কবর দেওয়া থেকে বোঝা যায় যে, এই সময়ের লোকেরা কোনো না কোনো পরকালে বিশ্বাস করত। একই সময়ে, প্রাণীদের আনুষ্ঠানিকভাবে সমাধিস্থ করা হত , এই অনুশীলন- যা পরবর্তী ধর্মে পাওয়া জুমরফিক দেবতার বিকাশকে প্রতিফলিত করতে পারে। [৩] মানুষের আকারে দেবতাদের প্রমাণ কম স্পষ্ট এবং এই ধরনের দেবতা প্রাণীর আকৃতির তুলনায় ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। মিশরের প্রতিটি এলাকায় নিজস্ব পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিল, সম্ভবত ছোট সম্প্রদায়গুলো একে অপরকে জয় করত বা শোষণ করত, পরাজিত এলাকার দেবতা, অন্য দেবতার পুরাণে অন্তর্ভুক্ত হত, বা সম্পূর্ণরূপে এর দ্বারা প্রভাবিত হত । ফলে একটি জটিল প্যান্থিয়ন তৈরি হত, যেখানে কিছু দেবতা শুধু স্থানীয়ভাবে গুরুত্ব পায়, অন্যরা আরো সার্বজনীন তাৎপর্য বিকাশ করে। [৩] [৫]
প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য যে পরামর্শ উপস্থাপন করেছে, তা হল - মিশরীয় ধর্ম ব্যবস্থা পূর্ব আফ্রিকান জনসংখ্যার সাথে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সখ্যতা ছিল এবং মেসোপটেমিয়া বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে উদ্ভূত না হয়ে আফ্রিকান উপস্তর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। [৪১] [৪২] [৪৩] [৪৪]
প্রাথমিক রাজবংশের সময়কাল খ্রিঃপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে মিশরের একত্রিকরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল । এই ঘটনাটি মিশরীয় ধর্মকে রূপান্তরিত করে , কারণ কিছু দেবতা জাতীয় পর্যায় গুরুত্ব পেয়েছিলেন এবং ঐশ্বরিক ফেরাউনের বিশ্বাস, ধর্মীয় কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। [৩] হোরাসকে রাজার সাথে তুলনা করা হত এবং উচ্চ মিশরীয় শহর নেখেনে তার সাধনা কেন্দ্র ছিল, সে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল অ্যাবিডোস, যেখানে প্রথম দিকের শাসকরা বড় সমাধীসৌধ তৈরি করেছিলেন। [২৭]
ওল্ড কিংডমের সময়, প্রধান দেবতাদের পুরোহিতরা তাদের পৌরাণিক কাহিনীর সাথে যুক্ত সকল সেবকদের জাতীয় মন্দিরে সংগঠিত করার চেষ্টা করত এবং একক ধর্মীয় কেন্দ্রে উপাসনা করত , যেমন হেলিওপলিসের এননিয়াড, যা আতুম, রা, ওসিরিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের ধর্মানুষ্ঠান এবং সেট একক সৃষ্টি পুরাণ । [৫] যার দ্বারা পিরামিড, বৃহৎ সমাধি মন্দির কমপ্লেক্স সহ, ফারাওদের সমাধি মাস্তাবাসকে প্রতিস্থাপিত করেছে। যেখানে পিরামিডগুলো আকারে বড় ,সেই তুলনায় দেবতাদের মন্দিরগুলো ছোট ছিল, যার দ্বারা বোঝা যায় দেবতাদের উপাসনার ক্ষেত্রে , সে সময়ে সাধারণ ধর্মের চেয়ে ঐশ্বরিক রাজার ধর্মের গুরুত্ব বেশি ছিল। এই সময়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আচার এবং স্থাপত্য পরবর্তী সময়ে দেবতাদের উপাসনায় ব্যবহৃত মন্দির এবং আচারগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করত। [৭]
পিরামিড
প্রাচীন মিশরীয়রা সূর্যকে শক্তিশালী জীবনী শক্তি হিসেবে মনে করত। সূর্য দেবতা রা-কে প্রাথমিক রাজবংশীয় যুগ (৩১০০-২৬৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে উপাসনা করা হত, কিন্তু এটি পুরাতন রাজ্যে (২৬৮৬-২১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিল না, একসময় রা মিশরীয় সর্ব দেবতার মন্দিরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, এবং সূর্য দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।যে ক্ষমতা [৪৫] পুরাতন রাজ্যের প্রথম দিকে, রা-এর প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং হেলিওপোলিসে তার উপাসনালয়টি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হয়ে ওঠে। [৪৬] পঞ্চম রাজবংশের রা ছিলেন মিশরের সবচেয়ে প্রভাবশালি দেবতা, যাকে রাজত্ব ও পরবর্তী জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, তিনি মিশরীয় ইতিহাসের বাকি অংশ ধরে রেখেছিলেন। [৫] একই সাথে, ওসিরিস একজন গুরুত্বপূর্ণ পরকালীন দেবতা হয়ে ওঠে। এই সময়ে প্রথম লেখা পিরামিড টেক্সটগুলি পরকালের সৌর এবং ওসিরিয়ান ধারণাকে প্রতিফলিত করে, যদিও এতে পুরানো ঐতিহ্যের অংশ বাকি রয়েছে। [৪৭] প্রাথমিক মিশরীয় ধর্মতত্ত্ব বোঝার জন্য পুস্তকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। [৫]
রা 'ডানাযুক্ত চাকতির '- মতো প্রতীক গ্রহণ করে। বাজপাখির একটি ডানা সহ সৌর চাকতিটি মূলত হোরাসের প্রতীক ছিল এবং বেহদেতের ডেল্টা শহরে তার ধর্মের সাথে যুক্ত ছিল। পুরাতন রাজ্যের সময় চাকতির উভয় পাশে পবিত্র কোবরা যোগ করা হয়। ডানাযুক্ত চাকতির প্রতিরক্ষামূলক তাৎপর্য ছিল এবং মন্দিরের ছাদে আনুষ্ঠানিক প্রবেশদ্বারে পাওয়া যেত।
খ্রিস্টপূর্ব ২২ শতকে, পুরাতন রাজ্যটি ফার্স্ট ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ডের ব্যাধিতে ভেঙে পড়ে। অবশেষে, থিবসের শাসকরা মধ্য রাজ্যে মিশরীয় জাতিকে পুনরায় একত্রিত করেন ( ২০৫৫-১৬৫০ খ্রিস্টপূর্ব)। এই থেবান ফারাওরা প্রাথমিকভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষক দেবতা মন্টুকে জাতীয় গুরুত্বের জন্য উন্নীত করেছিল, কিন্তু মধ্য রাজ্যের সময়, আমুনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কাছে তিনি হেরে যান। [৫] নতুন মিশরীয় রাষ্ট্রে, ব্যক্তিগত ধার্মিকতা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং লিখিতভাবে আরো স্বাধীনতা পায়, এই ঝোঁক নতুন রাজ্যে অব্যাহত ছিল। [৪৮]
মধ্যবর্তী রাজ্যটি দ্বিতীয় মধ্যবর্তী সময়কালে ভেঙে পড়ে ( ১৬৫০-১৫৫০ খ্রিঃ পূর্ব), তবে দেশটি আবার থেবান শাসকদের দ্বারা পুনরায় একত্রিত হয়, যারা নতুন রাজ্যের প্রথম ফারাও ছিলেন। নতুন শাসনের অধীনে, আমুন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় দেবতা হয়ে ওঠে। তিনি রাজত্বের দীর্ঘস্থায়ি পৃষ্ঠপোষক রা-এর সাথে একত্রিত হয়েছিলেন এবং থিবেসের কার্নাকের মন্দিরটি মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। আমুনের সম্মান কিছুটা থিবসের গুরুত্বের কারণে হয়েছিল, তবে এটি পেশাদার যাজকত্বের ধারাবাহিকতার কারণেও হয়েছিল। তাদের পরিশীলিত ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা,যা আমুনের সার্বজনীন শক্তির বিশদ বিবরণ তৈরি করেছিল। [৫] [১]
এ সময়ের মধ্যে বাইরের লোকেদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে নিকট প্রাচ্যের দেবতাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে গ্রহণ করা হত । একই সময়ে, পরাধীন নুবিয়ানরা মিশরীয় ধর্মীয় বিশ্বাসকে গ্রহণ করে এবং বিশেষ করে তারা আমুনকে তাদের নিজস্ব দেবতা হিসাবে গ্রহণ করে। [৫]
চিত্র-আখেনাতেন
নতুন রাজ্যে ধর্মীয় শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়, যখন আখেনাতেন সম্মত হন এবং আমুনকে রাষ্ট্রীয় দেবতা হিসাবে আতেন এর স্থলে প্রতিস্থাপন করা হয় । অন্যান্য দেবতার আনুষ্ঠানিক উপাসনা বাদ দেওয়া হয় এবং মিশরের রাজধানী আমর্নাতে নতুন শহরে স্থানান্তরিত করেন। মিশরীয় ইতিহাসের এই অংশ, আমর্না পিরিয়ড, হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে, আখেনাতেন অভূতপূর্ব মর্যাদা দাবি করে : শুধু তিনিই আতেনের উপাসনা করতে পারতেন এবং জনসাধারণ তাদের উপাসনা তাঁর দিকে পরিচালিত করত। Atenist ব্যবস্থার বিকাশে পৌরাণিক কাহিনীতে পরকালের বিশ্বাসের অভাব ছিল এবং আতেনকে দূরের ও নৈর্ব্যক্তিক বলে মনে হত, নতুন আদেশটি এ কারণে সাধারণ মিশরীয়দের কাছে সাড়া জাগায়নি। [৫] এইভাবে, অনেকে নির্জনে ঐতিহ্যবাহী দেবতাদের উপাসনা করতে থাকে। তবুও , অন্যান্য দেবতার প্রতি রাষ্ট্রীয় সমর্থন প্রত্যাহার, মিশরীয় সমাজকে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত করেছে। [৪৯] আখেনাতেনের উত্তরসূরিরা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করে এবং শেষপর্যন্ত, তারা সমস্ত আতেনের মূর্তগুলো ভেঙে ফেলে। [৫]
আমর্না যুগের আগে, জনপ্রিয় ধর্ম, তাদের উপাসক এবং দেবতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আখেনাতেনের পরিবর্তন এই প্রবণতাকে পাল্টে দেয়, একবার সনাতন ধর্ম পুনরুদ্ধার করা হলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জনসাধারণ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, দেবতারা দৈনন্দিন জীবনে অনেক বেশি সরাসরি জড়িত। আমুন, সর্বোচ্চ দেবতা, মিশরের প্রকৃত শাসক, মানব ভাগ্যের চূড়ান্ত বিচারক হিসাবে দেখা হয়। এসময় ফারাও এবং লোকজন কম ঐশ্বরিক ছিল. সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে ওরাকলের গুরুত্ব বাড়তে থাকে, যেমন ওরাকলের দোভাষী, যাজকত্বের সম্পদ ও প্রভাব বাড়তে থাকে । এই প্রবণতা সমাজের ঐতিহ্যগত কাঠামোকে ক্ষুণ্ণ করে এবং নতুন রাজ্যের ভাঙ্গনে ভূমিকা রাখে। [৪৯]
চিত্র
চিত্র
আনুবিস
চিত্র
রোমান মূর্তি
খ্রিস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দে , মিশর আগের সময়ের তুলনায় অনেকটাই দুর্বল পড়ে এবং বেশ কিছুকাল ধরে বিদেশীরা দেশটি দখলে রাখে এবং ফারাওয়ের অবস্থানে আসন গ্রহণ করে। ফেরাউনের গুরুত্ব ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে এবং জনপ্রিয় ধর্মানুরাগের উপর জোর বাড়তে থাকে। প্রাণী সম্প্রদায়ের উপাসনা, মিশরে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, সম্ভবত সেই সময়ের অনিশ্চয়তা এবং বিদেশী প্রভাবের প্রতিক্রিয়া হিসাবে। [৫] আইসিস সুরক্ষা, জাদু এবং ব্যক্তিগত পরিত্রাণের দেবী হিসাবে আরো জনপ্রিয় এবং মিশরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। [৩]
খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে , মিশর টলেমাইক রাজবংশের (৩০৫-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অধীনে একটি হেলেনিস্টিক রাজ্যে পরিণত হয়, যা ফেরাওনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় , ঐতিহ্যগত ধর্ম বজায় রাখে এবং অনেক মন্দির নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করে। রাজ্যের গ্রীক শাসক শ্রেণী মিশরীয় দেবতাদেকে, তাদের নিজেদের দেবতা হিসেবে গ্রহণ করে। [৫০] এই আন্তঃ-সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদ থেকে আবির্ভূত হয় সেরাপিস, একজন দেবতা যিনি ওসিরিস এবং অ্যাপিসকে গ্রীক দেবতার বৈশিষ্ট্যের সাথে একত্রিত করেন এবং গ্রীক জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে । তবুও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুটো বিশ্বাস ব্যবস্থা আলাদা ছিল এবং মিশরীয় দেবতারা মিশরীয়ান হিসেবেই থেকে যায়। [৫]
৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ হওয়ার পর টলেমাইক-যুগের বিশ্বাসের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে, টলেমাইক রাজারা দূরের সম্রাটদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হত। [৫০] আইসিস ধর্ম সম্প্রদায় মিশরের বাইরে গ্রীক ও রোমানদের কাছেও পরিচিতি লাভ করে এবং হেলেনাইজড আকারে সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। [৫] মিশর সাম্রাজ্য দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে সরকারী মন্দিরগুলো ক্ষয়ে যেতে থাকে এবং তাদের কেন্দ্রীয় প্রভাব ছাড়াই ধর্মীয় অনুশীলন খণ্ডিত এবং স্থানীয় হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে, খ্রিস্টধর্ম সমস্ত মিশরে ছড়িয়ে পড়ে এবং খ্রিস্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে, খ্রিস্টান সম্রাটদের আদেশ এবং খ্রিস্টানদের ধর্মীয় কার্যকলাপ, ঐতিহ্যগত(বহুঈশ্বরবাদী) বিশ্বাসকে বিলুপ্ত করতে থাকে।
এরপরেও , ঐতিহ্যবাহী মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল। ফিলাই শহরের মন্দিরে প্রচলিত উপাসনা মিশরের সক্রিয় খ্রিস্টানকরণ সত্ত্বেও অন্তত ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। বাস্তবে, পঞ্চম শতাব্দীর ঐতিহাসিক প্রিসকাস ৪৫২ সালে, রোমান সেনাপতি ম্যাক্সিমিনাস, ব্লেমিয়েস এবং নোবেডসের মধ্যে একটি চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আইসিস-এর কাল্ট ইমেজে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছিল। [৫১] [৫২] [৫৩]
ষষ্ঠ শতাব্দীর ঐতিহাসিক প্রকোপিয়াসের মতে, বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান এর আদেশ অনুসারে স্থানীয় সেনাপতি নার্সেস দ্য পারসারমেনিয়ান কর্তৃক ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলের মন্দিরগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। [৫৪] এই ঘটনাটিকে প্রচলিতভাবে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের সমাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাইহোক, এ নিয়ে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়, জিতসে ডিজকস্ট্রার একটি বড় গবেষণার পরে, যুক্তি দেন যে ফিলেতে সংগঠিত পৌত্তলিকতা পঞ্চম শতাব্দীতে শেষ হয়েছিল, এই সত্যটির উপর ভিত্তি করে যে, সেখানে সক্রিয় পৌত্তলিক যাজকত্বের শেষ শিলালিপি প্রমাণটি ৪৫০ এর দশকে। [৫১] [৫৩] এরপরেও, সনাতন (পুরাতন) ধর্মের কিছু আনুষ্ঠানিকতা ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল বলে ধারণা করা হয়, আফ্রোডিটোর ডায়োসকোরাস থেকে ৫৬৭ শতকেথেবাইডের গভর্নরের কাছে একটি আবেদনের ভিত্তিতে। [৫৫] [৫৩] চিঠিটি একজন নামপরিচয়হীন ব্যক্তির বিষয়ে সতর্ক করে (পাঠ্যটি তাকে "কাঁচা মাংস ভক্ষক" বলে), যিনি বাড়ি লুণ্ঠন এবং রাজস্ব কর চুরির পাশাপাশি, সম্ভবত ফিলাই-এর মন্দিরগুলোকে উল্লেখ করেছে "অভয়ারণ্যে" পৌত্তলিকতা পুনরুদ্ধার বলে। . [৫৫] [৫৩]
যখন কিছু সময়ের জন্য এ ধর্ম জনগণের মধ্যে অব্যাহত ছিল, মিশরীয় প্রাচীন ধর্ম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। [৩৪]
তিউনিসিয়ার সোসে দেয়ালের চিত্রঃ রোমান মোজাইক ক্যালেন্ডার হারমানুবিস,আইসিস- গ্রীক আইওকে, আনুবিস, সেরাপিস
চিত্রঃ আইসিসের রোমান মার্বেল মূর্তি, সাদা- কালো ।
মিশরীয়রা যেসব ধর্ম মন্দির এবং সমাধি নির্মাণ করেছে, তা প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত, যা অন্যান্য সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। ফারাও যুগে এর অনেকগুলো প্রতীক ছিল, যেমন স্ফিংস এবং ডানাযুক্ত সৌর ডিস্ক, ভূমধ্যসাগর এবং নিকটবর্তী পূর্বের অন্যান্য সংস্কৃতি এর দ্বারা গৃহীত হয়, যেমন বেস এর মতো কিছু দেবতা। এ সব চিহ্নিত করে সংযোগ তৈরি করা কঠিন। এলিসিয়ামের গ্রীক ধারণাটি পরবর্তী জীবনের মিশরীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত হতে পারে। [১] প্রাচীন মিশরের শেষ দিকে, নরকের খ্রিস্টান ধারণাটি সম্ভবত ডুয়াটের কিছু চিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। মিশরীয় বিশ্বাস গ্রীক এবং রোমানদের দ্বারা বিকশিত বেশ কয়েকটি রহস্যময় বিশ্বাস ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে বা জন্ম দিয়েছে, যারা মিশরকে রহস্যময় জ্ঞানের উৎস হিসাবে বিবেচনা করত। হারমেটিসিজম, যেমন, থোথের সাথে জড়িত গোপন জাদুবিদ্যার ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত। [৫৬]
আধুনিক যুগ
চিত্র
প্রাচীন বিশ্বাসের অনেক চিহ্ন, আধুনিক সময়ে মিশরীয় লোক ঐতিহ্যে ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে, কিন্তু আধুনিক সমাজে এর প্রভাব ১৭৯৮ সালে মিশর ও সিরিয়ায় ফরাসি অভিযান এবং তাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও ছবি দেখার সাথে বৃদ্ধি পায়। যে কারণে, পশ্চিমারা মিশরীয় বিশ্বাস নিজে থেকেই অধ্যয়ন করতে শুরু করে এবং মিশরের ধর্মীয় ধারণা ও বিশ্বাস পশ্চিমা শিল্পে গ্রহণ করে নেয় । [৫৬] [১৫] মিশরীয় ধর্ম তখন থেকেই জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। মিশরীয় বিশ্বাসের প্রতি ক্রমাগত আগ্রহের কারণে, ২০ শতকের শেষের দিকে, কেমেটিজমের কম্বল শব্দের অধীনে চলে যাওয়া বেশ কয়েকটি নতুন ধর্মীয় দল, প্রাচীন মিশরীয় ধর্মের বিভিন্ন পুনর্গঠনের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। [৫৭]
ধর্মের বর্ণনা
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.