Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম হল প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতিগুলির ধর্মীয় বিশ্বাস। প্রাগৈতিহাস অর্থাৎ লিখিত ইতিহাসের পূর্ববর্তী পর্যায়টি মানবজাতি বহুসংখ্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল; মানব ইতিহাসের ৯৯ শতাংশেরও বেশি অংশ সংঘটিত হয়েছিল কেবলমাত্র পুরাপ্রস্তরযুগেই। প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতিগুলি সমগ্র বিশ্ব জুড়ে পরিব্যাপ্ত ছিল এবং এগুলির অস্তিত্ব বজায় ছিল ২৫ লক্ষেরও বেশি বছর; এই সব সংস্কৃতির ধর্মীয় বিশ্বাসও ছিল বহুসংখ্যক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং এই সব ধর্মবিশ্বাসের বিস্তারিত বিবরণ লিখিত আকারে রক্ষিত না হওয়ায় এগুলি নিয়ে গবেষণা একটি কঠিন কাজ।
ধর্ম বিষয়টিকে বোঝার ক্ষমতা সম্ভবত প্রথম জাগরিত হয়েছিল হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স বা শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষের মধ্যে। যদিও কোনও কোনও গবেষক নিয়ান্ডারথাল ধর্মের অস্তিত্বের কথা অনুমান করেন এবং অন্ততপক্ষে হোমো নালেডি প্রজাতির মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরল কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগের (৩০০,০০০ – ৫০,০০০ বছর আগে) বিরল ও বিতর্কিত প্রমাণগুলিকে বাদ দিলে বলতে হয় যে, ধর্মের উদ্ভব নিশ্চিতভাবে ঘটেছিল প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগে। এই যুগের ধর্ম ছিল সম্ভবত শামান-কেন্দ্রিক, যে ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রে ছিল গুহ্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশেষ ধর্মগুরুদের সমাধি অবস্থায় প্রবেশের বিষয়টি। এই প্রথাগুলির সম্বন্ধে জানা গিয়েছে পুরাপ্রস্তরযুগের শিল্পীদের রেখে যাওয়া সমৃদ্ধ ও জটিল শিল্পকর্মগুলি (বিশেষত তাদের সৃষ্ট বিশদ গুহা শিল্প ও রহস্যময় ভেনাস পুত্তলিকা) নিয়ে চর্চার মাধ্যমে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০০ অব্দ নাগাদ প্রথম কৃষি বিপ্লব জীবিকানির্বাহের প্রধান উপায় হিসেবে কৃষিব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা দান করে এবং এরই ফলে নব্যপ্রস্তরযুগের সূচনা ঘটে। পূর্ববর্তীয় পুরাপ্রস্তরযুগীয় সমাজের বিপরীতে নব্যপ্রস্তরযুগীয় সমাজে পুরোহিততন্ত্র ও অসাম্যবাদের উদ্ভব ঘটে এবং তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যেও অনেক পরিবর্তন আনা হয়। নব্যপ্রস্তরযুগীয় ধর্ম সম্ভবত পুরাপ্রস্তরযুগীয় ধর্মের তুলনায় অধিকতর নৈর্মিতিক ও কেন্দ্রীভূত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল এবং সম্ভবত এই যুগেই পূর্বপুরুষ পূজার উদ্ভব ঘটে। এই পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে ছিল ব্যক্তির নিজস্ব পূর্বপুরুষের পূজা এবং সেই সঙ্গে সমগ্র গোষ্ঠী, উপজাতি বা জনবসতির পূর্বপুরুষের পূজা। নব্যপ্রস্তরযুগীয় ধর্মের একটি বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য হল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রস্তরবৃত্ত, যার স্টোনহেঞ্জ অংশটি বর্তমানে সর্বাধিক পরিচিত। তাম্রযুগীয় ধর্মের মাধ্যমে অন্তিম নব্যপ্রস্তরযুগের বিশেষভাবে সুপরিচিত একটি অংশ হল প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় পুরাণ। এই ধর্মটি ছিল প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষী প্রথম জাতিগোষ্ঠীর ধর্ম। আদি যুগের ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষীদের অনুরূপ ধর্মীয় উপাদানগুলির মাধ্যমে এই ধর্মটিকে আংশিকভাবে পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে।
ব্রোঞ্জযুগীয় ও লৌহযুগীয় ধর্মগুলিকে আংশিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলির মাধ্যমে বোঝা গেলেও, পুরাপ্রস্তরযুগীয় ও নব্যপ্রস্তরযুগীয় ধর্মগুলির তুলনায় অনেক ভালোভাবে বোঝা যায় লিখিত বিবরণের সাহায্যে। ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগে কোনও কোনও সমাজে লিখনপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং তাদের রচনায় যে সব সমাজে লিখনপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি তাদের বিবরণও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আধুনিক পুনর্নির্মাণবাদীরা প্রাগৈতিহাসিক ধর্মের যুগগুলির সংস্কৃতির উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। বর্তমান কালে অনেক প্যাগান ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে প্রত্নৈতিহাসিক ব্রোঞ্জ ও লৌহযুগীয় সমাজগুলির প্রাক্-খ্রিস্টীয় রীতিনীতিগুলির ভিত্তিতে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ হল লিখিত বিবরণের পূর্বকালীন মানব ইতিহাস। এই ক্ষেত্রে লিখিত প্রমাণের অভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়,[1] যার ফলে ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।[2] প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম সম্পর্কে গবেষণার বৃহত্তর অংশেরই ভিত্তি ঐতিহাসিক (সাহিত্য-সংক্রান্ত) ও নৃকুলবিদ্যা-সংক্রান্ত প্রমাণ থেকে কৃত অনুমানগুলি। উদাহরণস্বরূপ, পুরাপ্রস্তরযুগীয় ও আধুন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজগুলির ধর্মের মধ্যে আংশিক সাদৃশ্যগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।[3] প্রত্নতাত্ত্বিক যুক্তিবিচারে সাদৃশ্য বিচারের উপযোগিতা তাত্ত্বিকভাবে জটিল ও বিতর্কিত হলেও প্রাগৈতিহাসিক ধর্মের প্রেক্ষিতে এটি পারিপার্শ্বিক প্রমাণের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী উপায় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। যেমন, অনেক প্রাগৈতিহাসিক সমাজে ও আধুনিক শিকারী-সংগ্রাহকদের মধ্যে লাল গিরিমাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে।[4]
সকল মানব সংস্কৃতিতেই ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে।[5] কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম নিয়ে গবেষণা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের আগে জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বে একটি প্রবর্তক প্রভাব সম্ভবত প্রাগৈতিহাসিক মানবজাতির ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম দিকের গবেষণাকে বাধাগ্রস্থ করেছিল। কারণ, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই শাখায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণকারী ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীরা ধর্মকে নিজেদের বিবর্তন-ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রের সম্মুখে একটি বিপদ বলে মনে করতেন।[6]
রক্ষণশীল ধর্মবিশ্বাস ও শাস্ত্র অধ্যয়নের ভিত্তিতে একবিংশ শতাব্দীর ভাষ্যকারদের কাছে ধর্মের যে গঠনটি পরিচিত প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম তার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। বরং পরবর্তীকালের শিকারী-সংগ্রাহকদের ধর্মের মতো প্রাগৈতিহাসিক ধর্মও শামানবাদ ও তূরীয় অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছিল।[3][7] সেই সঙ্গে সর্বপ্রাণবাদের প্রভাবও সম্ভবত এই ধর্মের উপর পড়েছিল। বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে সর্বপ্রাণবাদের উদ্ভব আরও আগে ঘটেছিল।[8] প্রাগৈতিহাসিক ধর্মের প্রকৃতি এতটা অনুমানমূলক হওয়া সত্ত্বেও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি ইঙ্গিত করে যে সেই যুগের ধর্মের ধারণার মধ্যে ভর হওয়া, দেবদেবীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগসাধন ও শামানবাদের অন্যান্য নিশ্চিত চিহ্ন সুস্পষ্ট ছিল। এই সব প্রমাণ এতটাই পাকাপোক্ত যে কোনও কোনও লেখক শ্যামানবাদ প্রত্নতত্ত্ববিদ নেইল প্রাইসের কথা অনুসরণ করে বলেন যে, এই সব প্রবণতা ও পদ্ধতি এক অর্থে মানবমনে স্থায়ী ভাবে গেঁথে রয়েছে।[9]
বিবর্তনশীল মানুষের মনে কখন ধর্মের ধারণাটির উদ্ভব ঘটে সেই প্রশ্ন বহু দশক ধরে জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের কৌতুহল জাগিয়ে আসছে।[10][11] সামগ্রিক বিচারে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বা কীভাবে মানব বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন ঘটেছিল সেই সম্পর্কে সাম্প্রতিক জ্ঞান কোনওটাই এমন ইঙ্গিত করে না যে আদি হোমিনিনরা[টীকা 1] আধ্যাত্মিক বিশ্বাস অবধারণের ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিল। অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগে (প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১২,০০০ বছর আগে) ধর্মের অস্তিত্ব নিশ্চিত ছিল বলেই জানা যায়, অন্যদিকে আদি ও মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগের ধর্ম “কিংবদন্তির রাজ্যে অবস্থান করে”।[13]
প্রথম দিকের গবেষণায় জীবাশ্ম প্রমাণ থেকে জ্ঞাত প্রথম হোমিনিন অস্ট্রালোপিথেকাস-দের শিকারের ধরনটিকে পরিশীলিত মনে করা হত। এই শিকারের ধরনগুলি বিচার করে আধুনিক শিকারী-সংগ্রাহকদের শিকারের ধরনটি অনুমান করে নেওয়া হয়েছিল এবং তার ফলে নৃতত্ত্ববিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অস্ট্রালোপিথেকাস-দের ধরন অনুযায়ী মিলিয়ে এই ধরনের শিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জটিল আচারগুলির কথা জানার চেষ্টা করতেন। এই ধরনের অনুমান পরে ভুল প্রমাণিত হয় এবং যে সকল প্রমাণ থেকে অস্ট্রালোপিথেকাস ও আগুনের মতো অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম উন্নত শিকারীদের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল সেগুলিকে কাকতালীয় বলে মনে করা হয়। বেশ কয়েক দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অস্ট্রালোপিথেকাস ধর্মবিশ্বাসের ধারণাটির বিরোধিতা করেন।[13] আচার-অনুষ্ঠান উদ্ভবের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় হোমিনিন গণ হোমো-র মধ্যে। এই গণটির উদ্ভব ঘটেছিল ২০ থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগে। আধুনিক মানব, তাদের পূর্বপুরুষ ও নিকটতম আত্মীয়েরা সবাই এই গণেরই অন্তর্গত।[11][14]
কখন আচার-অনুষ্ঠানগুলি ক্রমে ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হল সেই নির্দিষ্ট প্রশ্নটি সহজ উত্তরকে কৌশলে পরিহার করে চলে। আদি হোমো হোমিনিনরা যে আদি ও মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগে অন্যদের ছাপিয়ে উঠেছিল তা আপাতদৃষ্টিতে সাংস্কৃতিক স্থিরতার বিশেষভাবে সুদীর্ঘ একটি যুগ (হোমো-র উদ্ভব থেকে আজ থেকে ৫০,০০০ বছর পূর্বের সময়কাল পর্যন্ত)।[15] যন্ত্রপাতি ব্যবহারকারী প্রথম হোমিনিন হোমো হ্যাবিলিস-দের মধ্যে ধর্মানুশীলনের কোনও গুরুতর প্রমাণ পাওয়া যায় না।[13] হোমো ইরেকটাস-এর উদ্ভবের পর ছবিটি জটিল হয়ে পড়ে। মনে করা হয় যে, হোমো ইরেকটাস হল সেই বিন্দু যেখানে পৌঁছে হোমিনিনদের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ জেগে উঠেছিল। এদের মধ্যেই ঠিক বর্তমান শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে যেমন আগ্রাসন প্রতিহত করার বৌদ্ধিক ক্ষমতা রয়েছে তেমন ক্ষমতা এবং নৈতিক দায়িত্বের একটি বোধ জাগ্রত হয়। হোমো ইরেকটাস-দের মধ্যে আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভবকে “ধর্মীয় সক্ষমতার সম্পূর্ণ বিকাশ হিসেবে দেখা উচিত না” হলেও এটি তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে একটি পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন সূচিত করে।[16] গবেষকদের আগ্রহের আরেকটি বিষয় হল হোমো ইরেকটাস-দের মধ্যে নরখাদকবৃত্তি ও আচারমূলক অঙ্গচ্ছেদের প্রমাণগুলি। জাভায় ও চীনা ঝৌকৌদিয়ান প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া মাথার খুলিগুলিতে খুলির মস্তিষ্কাধারে এমনভাবে ক্ষতিসাধনের প্রমাণ পাওয়া যায়, যেটিকে নরখাদকবৃত্তির উদ্দেশ্যে মস্তিষ্ক অপসারণের সঙ্গে যুক্ত কোনও পদ্ধতি মনে করা হয়। ঠিক একই রকম রীতি শিকারী-সংগ্রাহকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। সম্ভবত অধিকতর স্পষ্টভাবে এই প্রত্নক্ষেত্রগুলিতে এবং অন্যত্রও বেশ কিছু সংখ্যক হোমো ইরেকটাস খুলিতে এমন চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে যা ইঙ্গিত করে যে পূর্বনির্ধারিত কোনও প্রক্রিয়ায় খুলির থেকে চামড়া ও মাংস কেটে নেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার সম্পাদনা সম্ভবত কাকতালীয় নয়, বরং তা আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল।[11][17]
শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষ যে ধারায় এসেছে সেই ধারাটির উদ্ভব ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৫০০,০০০ বছর আগে।[18] শ্রেণিবিন্যাসের সূত্র অনুযায়ী আধুনিক মানুষকে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই শ্রেণিবিন্যাস বিতর্কিত, কারণ এটি প্রথাগত উপপ্রজাতি শ্রেণিবিন্যাসের পরিপন্থী; অন্য কোনও হোমিনিনকে হোমো সেপিয়েন্স-এর অবিতর্কিত সদস্য হিসেবে ধরা হয় না। হোমো সেপিয়েন্স ইডালটু-র ২০০৩ সালের দেওয়া বর্ণনাটি হোমো সেপিয়েন্স উপপ্রজাতির একটি আপেক্ষিকভাবে স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ক্রিস স্ট্রিংগার প্রমুখ লেখকের মতে এটি বিতর্কিত বিষয়।[16][19] নিয়ান্ডারথাল বিষয়টিও একটি শ্রেণিবিন্যান-সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি করেছে। শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষের নিকট আত্মীয় রূপে নিয়ান্ডারথালদের হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস বা হোমো সেপিয়েন্স নিয়ান্ডারথালেনসিস শ্রেণিবিন্যাস বহু দশক-ব্যাপী বিতর্কের একটি বিষয়। নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রা আন্তঃপ্রজননে সক্ষম ছিল, যে বৈশিষ্ট্যটি একই প্রজাতির অন্তর্গত সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং আধুনিক মানব জিনোমের প্রায় ২ শতাংশ নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ দ্বারা গঠিত। যদিও নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের প্রত্যক্ষ সন্তানদের মধ্যে নেতিবাচক নির্বাচনের অস্তিত্ব ছিল, ঠিক যেমন খচ্চর প্রভৃতি সংকর প্রজাতির হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতার ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই কারণে সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীরা নিয়ান্ডারথালদের একটি হোমো সেপিয়েন্স উপপ্রজাতি হিসেবে শ্রেণিবিন্যাসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে থাকেন।[20]
ধর্মের প্রতিনিধি ও মুখবন্ধ হিসেবে নিয়ান্ডারথাল আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষণাটি মৃত্যু ও সমাধিদান-সংক্রান্ত রীতিনীতি-কেন্দ্রিক। প্রায় ১৫০,০০০ বছর আগে প্রথম অবিতর্কিত সমাধিদানের ঘটনাগুলি নিয়ান্ডারথালদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাবে সমাধিক্ষেত্রগুলি থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত আচারগুলি অনুধাবন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সমাধি দ্রব্য ও হাড়ের উপর অস্বাভাবিক চিহ্নাঙ্কন অন্তেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের কথা ইঙ্গিত করে। অন্ত্যেষ্টি ছাড়াও ক্রমশ এমন প্রমাণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ইঙ্গিত করে যে নিয়ান্ডারথালেরা রঞ্জক পদার্থ, পালক এবং পশুপাখির নখ দিয়েও অলংকার প্রস্তুত করা শুরু করেছিল।[21] অলংকারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন না থাকায় এটি বোঝা যায় শুধুমাত্র আধুনিক শিকারী-সংগ্রাহকদের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে। আধুনিক শিকারী-সংগ্রাহকদের ক্ষেত্রে অলংকার অনেক ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক গুরুত্বসম্পন্ন আচার-অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত।[22] একই সময়কালের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের বিপরীতে নিয়ান্ডারথাল সমাজে এক উল্লেখযোগ্য স্থিরতা লক্ষিত হয়। বহু শতাব্দী থেকে সহস্রাব্দ পর্যন্ত এদের যন্ত্রপাতির নকশায় পরিবর্তন খুব কমই এসেছিল।[21] বংশাণু ও খুলির প্রমাণ থেকে পরিজ্ঞাত তথ্য অনুযায়ী নিয়ান্ডারথালদের স্ক্লেরোটিক ও সাদামাটা মনে করা হয়। যা শুধু সমসাময়িক কেন আধুনিক হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের মধ্যেও দেখা যায় না।[16] আরও বিস্তারিতভাবে বললে, নিয়ান্ডারথাল আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে শিক্ষাদানের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে অনুমান করা হয়, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই ধরনের সাংস্কৃতিক কঠিনীভবন সম্ভব হয়েছিল। চিন্তাভাবনা, জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে অর্থোপ্র্যাক্সির প্রাধান্য এই শিক্ষণ প্রণালীর মধ্যে নিহিত ছিল।[21] এই বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দেখা যায় না, যেগুলিকে শিল্পকলা, সংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক কৌতুহলের একটি সম্প্রসারিত অংশ মনে করা হয়।[16]
ব্রায়ান হেইডেন প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে, নিয়ান্ডারথালদের সমাধিদানের রীতিটি পরলোক ও পূর্বপুরুষ পূজায় বিশ্বাসের ইঙ্গিতবাহী।[23] এছাড়াও হেইডেন মনে করতেন যে, নিয়ান্ডারথালরা ভাল্লুক পূজা করত। নিয়ান্ডারথাল জনবসতিগুলির পার্শ্ববর্তী এলাকায় গুহা ভাল্লুকের দেহাবশেষ আবিষ্কার এবং শীতল আবহাওয়ায় বসবাসকারী শিকারী-সংগ্রাহক সমাজগুলিতে এই ধরনের পূজার ব্যাপকতা থেকে এই ধরনের তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে। সমগ্র বিংশ শতাব্দী জুড়ে গুহায় খননকার্য চালিয়ে নিয়ান্ডারথাল জনবসতিগুলিতে অথবা সেগুলির আশেপাশে প্রচুর ভাল্লুকের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এগুলির মধ্যে আছে স্তুপীকৃত খুলি, মানুষের সমাধিস্থলের আশেপাশে ভাল্লুকের হাড় ও পশুচর্ম প্রদর্শনীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কঙ্কালের অবশেষের সজ্জা।[24] ইনা উন প্রমুখ অন্যান্য প্রত্নতত্ত্ববিদেরা “ভাল্লুক কাল্ট”-এর প্রমাণগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। উনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নিয়ান্ডারথালেরা ছিল প্রাক্-ধর্মীয় জনগোষ্ঠী এবং তাদের জনবসতির আশেপাশে ভাল্লুকের দেহাবশেষ পাওয়া নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। কারণ, গুহাভাল্লুকেরা স্বভাবতই গুহায় বাস করে এবং তাই সেখানে তাদের হাড় খুঁজে পাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই।[13] বৃহত্তর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে পুরাপ্রস্তরযুগীয় ধর্মে ভাল্লুক পূজা একটি প্রধান বিষয় ছিল না।[25]
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বংশাণুবিদ্যা ও স্নায়ুবিজ্ঞান-সংক্রান্ত গবেষণার ফলে ধর্মের উৎপত্তির বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ সম্ভব হয়েছে। ২০১৮ সালে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ মার্গারেট বুন র্যাপাপোর্ট হোমিনিডি, নিয়ান্ডারথাল, হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স ও হোমো সেপিয়েন্স ইডালটু-দের মধ্যে ইন্দ্রিয়-সংক্রান্ত, স্নায়ু-সংক্রান্ত ও বংশাণু-সংক্রান্ত পার্থক্যগুলি নিয়ে বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের মস্তিষ্ক ও জিনোমের একটি স্বতন্ত্র ক্ষমতা রয়েছে যার বলে এরা ধর্ম বিষয়টিকে অনুধাবন করতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রসারিত পার্শ্বকরোটি খণ্ডক, বৃহত্তর অবধারণ নমনীয়তা এবং পরহিত ও আগ্রাসন উভয়েরই এক অস্বাভাবিক রকমের প্রশস্ত ধারণক্ষমতা বিশেষভাবে সহায়ক হয়। র্যাপাপোর্টের তত্ত্ব অনুযায়ী, ঠিক যে কারণে প্রাগৈতিহাসিক হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের যন্ত্রপাতি ও শিল্পকর্ম সমসাময়িক নিয়ান্ডারথালেদের থেকে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও বিস্তারিত, সেই কারণেই হোমিনিনদের মধ্যে একমাত্র হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রাই ধর্ম অনুধাবনের ক্ষমতা অর্জন করেছিল। কারণ যন্ত্রপাতি, শিল্পকলা ও ধর্মবোধ সবই ছিল এক স্বতন্ত্র বোধের ফসল।[16]
মানব ইতিহাসের ৯৯ শতাংশেরও বেশি সময় পুরাপ্রস্তরযুগ বা প্রাচীন প্রস্তরযুগের অন্তর্গত। প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অব্দ নাগাদ সমাপ্ত হওয়া এই পুরাপ্রস্তরযুগেই হোমো গণটির উদ্ভব ঘটে, মানবজাতির বিবর্তন ঘটে এবং শিল্পকলা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিরও উদ্ভব ঘটে।[26] পুরাপ্রস্তরযুগ সাধারণভাবে আদি, মধ্য ও অন্তিম পর্যায়ে বিভক্ত। আদি পুরাপ্রস্তরযুগে (২৫ লক্ষ বছর পূর্ববর্তী – খ্রিস্টপূর্ব ৩০০,০০০ অব্দ) পাথরের যন্ত্রপাতির উদ্ভব, অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো হ্যাবিলিস ও হোমো ইরেকটাস-এর বিবর্তন এবং আফ্রিকা থেকে মানবজাতির প্রথম নিষ্ক্রমণ ঘটে। মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০,০০০ – খ্রিস্টপূর্ব ৫০,০০০ অব্দ) আপাতদৃষ্টিতে শিল্পকলা ও সংস্কৃতির উৎপত্তি ঘটে এবং সেই সঙ্গে নিয়ান্ডারথাল ও শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষেরও উদ্ভব ঘটে। অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৫০,০০০ – খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অব্দ) সংস্কৃতির একটি স্পষ্ট উন্নতি সাধিত হয়, সূক্ষ্ম ও বিস্তারিত শিল্পকলা, অলংকার ও বস্ত্রের উদ্ভব ঘটে এবং হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।[27][28][টীকা 2]
অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগের পূর্বকালীন ধর্ম অনুমানমূলক[13] এবং নির্দিষ্টভাবে বললে আদি পুরাপ্রস্তরযুগের ধর্মানুশীলনের কোনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।[27] এমনকি আচার-অনুষ্ঠানের অস্তিত্বের সর্বাপেক্ষা ঢিলে প্রমাণটিও আজ থেকে ৫০০,০০০ বছর আগেকার। যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদ গ্রেগরি জে. হুইটম্যানের মতে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাবেই তাদের ধর্মানুশীলনের সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।[31] হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-এর উদ্ভবের অনেক আগের সময়কাল এই পুরাপ্রস্তরযুগে আদি হোমিনিনরা গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করা শুরু করলে নিজেদের আবেগজাত প্রতিক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সেগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। তাদের সহযোগিতামূলক পরিচয়ের প্রারম্ভিক বোধই পরবর্তীকালে ধর্মের সামাজিক দিকটির ভিত্তি প্রস্তুত করে।[32]
প্রথম হোমিনিন অস্ট্রালোপিথেকাস-রা[টীকা 3] ছিল প্রাক্-ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। বিংশ শতাব্দীর ধর্মের ইতিহাসবিদ মার্সিয়া এলিয়াড মনে করতেন যে, মানুষের বিবর্তনের ধারার এই আদিতম শাখাতেও “নিশ্চিত ধর্মীয় সচেতনতা”র উদ্ভব ঘটেছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রালোপিথেকাসদের সম্পর্কে যা কিছু ধারণা করা গিয়েছে তা থেকে মনে হয় এরা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার জন্য যে বিমূর্ত চেতনার প্রয়োজন হয় তা এদের মধ্যে ছিল না।[13][16] আদি পুরাপ্রস্তরযুগের সকল হোমিনিনদেরই আধ্যাত্মিক বোধে অক্ষম মনে করা হলেও কোনও কোনও লেখক অন্তত অস্ট্রালোপিথেকাস-দের যুগ থেকে এদের মধ্যে কিছু আচরণের সন্ধান পান, যেগুলিকে আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে ধরা যায়। ডারহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক পল পেটিট ইথিওপিয়ার হাদারের কাছ থেকে সংগৃহীত অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস-এর একটি গোষ্ঠী এএল ৩৩৩ জীবাশ্মগুলি পরীক্ষা করে জানান যে, সেগুলিকে সম্ভবত একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত কোনও আচার পালনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে আনা হয়েছিল।[35] আদি পুরাপ্রস্তরযুগের পরবর্তীকালীন অবশেষগুলিকেও অন্তেষ্টিক্রিয়া-সংক্রান্ত আচার, বিশেষত নরখাদকবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ব্যাখ্যা করা হয়। যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদ কিট ডব্লিউ. ওয়েসলার বলেছেন যে, “আদি পুরাপ্রস্তরযুগের বিস্তারিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না যা থেকে সেই যুগের মানুষদের সমৃদ্ধ কল্পনাশক্তি বা আধুনিক মানুষের সম পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়”। এই প্রসঙ্গে তিনি সিমা ডে লস হিউসোসের হোমো হেইডেলবারজেনসিস অস্থি এবং জার্মানি থেকে চীন পর্যন্ত প্রসারিত প্রমাণগুলিকে আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় মানবজাতির নরখাদকবৃত্তির নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[36]
বিভিন্ন অঞ্চলের আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় প্রত্নক্ষেত্রগুলিকে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত বহু সংখ্যক মাথার খুলিতে দেখা যায় যে মস্তিষ্কাধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অপসারিত হয়েছিল। হেইডেন প্রমুখ লেখকেরা এই চিহ্নগুলিকে ধর্মীয় গুরুত্বসম্পন্ন নরখাদকবৃত্তির লক্ষণ মনে করেন। নরখাদকবৃত্তিকে “সর্বাপেক্ষা কৃপণ ব্যাখ্যা” আখ্যা দিয়ে হেইডেন সেটিকে শিকারী-সংগ্রাহকদের আচরণের সঙ্গে তুলনা করেন। উল্লেখ্য, লিখিত ঐতিহাসিক বিবরণে বলা হয়েছে যে শিকারী-সংগ্রাহকদের কাছে মস্তিষ্ক-ভক্ষণ আধ্যাত্মিক গুরুত্ব বহন করত। বিস্তারিতভাবে বললে, তিনি মাথার খুলির এই অঙ্গহানির বিষয়টিকে আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় আচার হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন।[37] এই ধারণার বিপরীত অবস্থানে উনের মতে, নরখাদকবৃত্তির তত্ত্বটির যথেষ্ট তথ্যের অভাব রয়েছে। মাথার খুলিতে অঙ্গহানিমূলক নকশাগুলিকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সহস্রাধিক বা লক্ষাধিক বছর ধরে সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হওয়া খুলির অংশ হিসেবেই। নরখাদকবৃত্তির ধারণাটির ক্ষেত্রেও তিনি মনে করেছেন যে এই রীতিটির সঙ্গে শিকারী-সংগ্রাহকদের নরখাদকবৃত্তির পরিবর্তে শিম্প্যাঞ্জিদের মস্তিষ্ক-ভক্ষণেরই তুলনা চলে।[13] ২০১০-এর দশকে প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার নতুন পদ্ধতিগুলির কারণে পুরাপ্রস্তরযুগের নরখাদকবৃত্তি নিয়ে গবেষণা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। নতুন পদ্ধতিতে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে অধিকতর ক্ষেত্রে পুরাপ্রস্তরযুগীয় নরখাদকবৃত্তির পিছনে ধর্মীয় কারণ অপেক্ষা সাধারণ ক্ষুন্নিবৃত্তিই প্রধান হয়ে উঠেছিল।[38]
অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগে ধর্ম যুক্ত হয়েছিল প্রতীকবাদ ও স্থাপত্যের সঙ্গে। অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগের একটি বিশেষ প্রত্নবস্তু সাংস্কৃতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। এগুলিকে বলা হয় ভেনাস পুত্তলিকা, বাকে নগ্ন স্ত্রীলোকের খোদাই-করা মূর্তি যা দেবতা, উর্বরতার চিহ্ন বা আচারগত ফেটিশ বস্তু বলে অনুমান করা হয়।[39] প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় ভেনাস পুত্তলিকার অস্তিত্বের তত্ত্বও প্রস্তাব করেছেন। বেরেখাট র্যামের ভেনাস এমনই একটি অতিমাত্রায় অনুমানমূলক মূর্তি। এটি ৩০০,০০০ থেকে ৩৫০,০০০ বছর আগেকার একটি স্কোরিয়া, [টীকা 4] এই মূর্তিটির বিভিন্ন খাঁজকে এক নারীর দেহ ও মুণ্ডর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করা হয়। স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির সাহায্যে জানা গিয়েছে যে বেরেখাট র্যামের ভেনাসের খাঁজগুলি সমসাময়িক চকমকি পাথরের যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি জিনিসগুলির খাঁজেরই অনুরূপ। পেটিট মনে করেন যে, এই পুত্তলিকাটিকে শিল্পসুষমামণ্ডিত কীর্তি বলা না গেলেও এটিকে এবং তান-তানের ভেনাস প্রভৃতি অন্যান্য আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় অনুমানমূলক ভেনাস পুত্তলিকাগুলির সমসাময়িক ধর্মতত্ত্বে কোনও ভূমিকা ছিল কিনা তা নিয়ে আরও খতিয়ে দেখা উচিত।[42] এই পুত্তলিকাগুলি তৈরি করেছিল সম্ভবত হোমো হেইডেলবার্জেনসিস-রা, যাদের মস্তিষ্কের আকার নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের থেকে খুব পিছনে ছিল না। এই ধরনের আদিম হোমিনিনদের শিল্পবোধ বিশ্লেষণের জন্য তাদের কাজগুলি পরীক্ষা করে দেখা হয়।[43]
আদি পুরাপ্রস্তরযুগের সর্বশেষ পর্যায়ে একটি জ্ঞান-সম্বন্ধীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছিল। আগুনের মতো বিপ্লবাত্মক প্রযুক্তির উদ্ভব এবং সেই সঙ্গে মানব বিবর্তনের বিস্তারিত বিকাশের এক প্রকৃত শৈশবাবস্থার উন্মেষের ফলে মা ও জাতকের পারস্পরিক বন্ধনের উন্নতি সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। শেষ কয়েক শত সহস্র বছরের পর্যায়ে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে হোমিনিনদের এক এক জীব হিসেবে দেখা যায় যখন তারা যতটা তাদের পারিপার্শ্বিক দ্বারা প্রভাবিত হত ততটাই পারিপার্শ্বিককে প্রভাবিত করত। পরবর্তীকালে আদি পুরাপ্রস্তরযুগীয় হোমিনিনরা নিজেদের প্রাকৃতিক শক্তিগুলির থেকে রক্ষা করার জন্য বায়ুপ্রবাহরোধী ছাউনি নির্মাণ করে; এছাড়া তারা অদ্ভুত প্রাকৃতিক বস্তু সংগ্রহ করত এবং লাল গিরিমাটির মতো রঞ্জক পদার্থের ব্যবহার শুরু করে। এই ধরনের পরিবর্তন প্রজাতি-স্তরীয় বিবর্তনমূলক অগ্রগতির সঙ্গে যুগপৎ সংঘটিত হয়নি, এগুলি হোমো হেইডেলবার্জেনসিস ও হোমো ইরেকটাস উভয়ের ক্ষেত্রেই লক্ষিত হয়েছে।[44] বিভিন্ন লেখকেরা এই ধরনের পরিবর্তনগুলিকে সংশয়ের নানা স্তর থেকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। কেউ কেউ এগুলিকে এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব হিসেবে দেখেন, আবার কেউ কেউ এগুলিকে সাদামাটাভাবে সূচনার সূচনা বলে উল্লেখ করেন। এই ধরনের পরিবর্তনের পূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করা কঠিন হলেও এটা বোঝা যায় যে এগুলি স্পষ্টতই সেই দিকে জ্ঞানসম্বন্ধীয় সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছিল যা কালক্রমে ধর্মের রূপ ধারণ করে।[13][37][44]
মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগটি ছিল একই সীমানার মধ্যে নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের (শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষ) জনবসতির যুগ। হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের উৎপত্তি আফ্রিকায় এবং নিয়ান্ডারথালদের উৎপত্তি ঘটেছিল ইউরেশিয়া অঞ্চলে। ধীরে ধীরে হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রা ইতিপূর্বে নিয়ান্ডারথাল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে বিস্তার লাভ করে এবং কালক্রমে তাদের অপসারিত করে এবং অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগের সূচনা ঘটায়।[45] নিয়ান্ডারথালদের অবধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায় না, বিশেষত সে ক্ষমতাগুলি পরবর্তীকালে ধর্মের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল সেগুলি বহুলাংশে অজানাই থেকে গিয়েছে।[11] নিয়ান্ডারথালদের ধর্ম-সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় তাদের গুহার ব্যবহার-কেন্দ্রিক সম্ভাব্য আচার[46] ও তাদের সমাধিদানের প্রথাটির কথা আলোচনা করা হয়।[47] সেই সঙ্গে আলোচনা করা হয় লিখিত ইতিহাসে প্রাপ্ত হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স শিকারী-সংগ্রাহক উপজাতিগুলির ধর্মানুশীলনের কথা। নিয়ান্ডারথালদের জীবনযাত্রা প্রণালী এদেরই অনুরূপ ছিল বলে মনে করা হয়।[3][22] নৃতত্ত্ববিদদের একাংশ নিয়ান্ডারথালদের প্রাক্-ধর্মীয় জনগোষ্ঠী মনে করেন। এই নৃতত্ত্ববিদদের মতে, নিয়ান্ডারথালদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে তাদের সৃজনশীলতা বা অতিলৌকিকতার বোধের অভাবেরই ইঙ্গিত পাওয়া যায়[11] এবং যথেষ্ট অনুসন্ধান ব্যতিরেকেই নিয়ান্ডারথাল-সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলির উপর ধর্মীয় উদ্দেশ্যের কথা অনুমান করা হয়।[13] শুধু তাই নয়, এই নৃতত্ত্ববিদরা দেখান যে, নিয়ান্ডারথাল নরকঙ্কালের যে অবশেষগুলি পাওয়া গিয়েছে সেগুলির বংশাণু ও স্নায়ুবিজ্ঞান-সম্বন্ধীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমেও বোঝা যায় যে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্ম বিষয়টিকে বোঝার মতো জ্ঞানসম্বন্ধীয় জটিলতার উদ্ভব ঘটেনি।[16]
নিয়ান্ডারথালরা ইউরোপে প্রাধান্য বিস্তার করলেও মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগীয় হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রা রাজত্ব করত আফ্রিকায়। সমসাময়িককালের নিয়ান্ডারথালদের মতো মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগীয় হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের মধ্যেও ধর্মের নিশ্চিত চিহ্ন কমই পাওয়া যায়। সেই যুগের হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-দের শিল্পকলা, যন্ত্রপাতি ও শৈলীগত অভ্যাসগুলির মধ্যে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও ধর্মানুশীলনের জন্য যে জটিলতার প্রয়োজন হয় তার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।[48] যদিও মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগ একটি দীর্ঘ সময় এবং এই যুগের হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-রা ছিল পৃথগ্বিধ। মানবজাতি কীভাবে আচরণগতভাবে ও অবধারণশক্তির দিক থেকে পরিশীলিত হয়ে উঠেছিল তা নিয়ে আচরণগত আধুনিকতার মডেলগুলির মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তা সে অন্তিম পুরাপ্রস্তরযুগের সহসা উত্থানের দিক থেকেই হোক বা মধ্য পুরাপ্রস্তরযুগের শেষ লক্ষ বছরের ধীর প্রক্রিয়ার দিক থেকেই হোক। দ্বিতীয় তত্ত্বটির সমর্থকেরা ১৫০,০০০ – ৫০,০০০ বছর আগের ক্রমবর্ধমান সাংস্কৃতিক, আচারগত ও আধ্যাত্মিক পরিশীলনের প্রমাণগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।[49]
নব্য প্রস্তরযুগ ব্রোঞ্জ যুগের সবচেয়ে নিকটবর্তী সময়। এই সময়কার ধর্ম সম্পর্কে কোনো সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায় না। তাই নব্য প্রস্তরযুগীয় ধর্ম সম্পর্কে জানতে পুরাতত্ত্বের উপরেই নির্ভর করতে হয়।
জ্যাক কভিনের মতে, নব্য প্রস্তরযুগীয় বিপ্লব ছিল "প্রতীকী বিপ্লব" নামে চিহ্নিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। তার মতে "ধর্মে"র জন্ম হয়েছিল নব্য প্রস্তরযুগে। তিনি বলেছেন, নব্য প্রস্তরযুগের মানুষের চিন্তাভাবনার একটি পরিবর্তন এসেছিল পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এই পরিবর্তনের একাধিক স্তর দেখা যায়।[50] এই যুগের প্রাপ্ত মূর্তিগুলি দেখিয়ে তিনি বলছেন দেবীপূজা ও ষাঁড়ের পূজার ধারণাটি এই যুগের অবদান। দর্শন ও দ্বৈতসত্ত্বার ক্রমবিবর্তনের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারণাও এযুগের অবদান।[51]
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দে মধ্য ইউরোপে নির্মিত সার্কুলার এনক্লোজারস নামে পরিচিত নির্মাণগুলিকে ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের স্থান মনে করা হয়। গসেক সার্কেলে নরবলির চিহ্ন পাওয়া যায়। এই ধরনের অনেক নির্মাণের প্রবেশপথটির সঙ্গে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ সংক্রান্তির সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সঙ্গে এক রেখায় নিবদ্ধ। এর থেকে বোঝা যায় সেই সময় একটি চান্দ্রসৌর পঞ্জিকা অনুসরণ করা হত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দে ইউরোপে নির্মিত মেগালিথিক স্থাপত্যগুলির নির্মাণ শুরু হয়েছিল। সমগ্র নব্য প্রস্তরযুগ এবং ব্রোঞ্জ যুগের প্রথম দিক পর্যন্ত এই ধরনের স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল।
নারীবাদী পুরাতত্ত্বের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মারিজা গিমবুটাসের মতে, নব্য প্রস্তরযুগীয় ইউরোপে "দেবীপূজা" কেন্দ্রিক একটি "নারীকেন্দ্রিক" সমাজ গড়ে উঠেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে প্রতিস্থাপন করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে গিমবুটাসের মত আজকের যুগে বহুল সমর্থন পায় না।[52]
প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগীয় প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্ম (যেটি পুনর্নির্মিত) এবং প্রমাণিত প্রাচীন সেমিটিক দেবদেবীরা ছিলেন পরবর্তী প্রাচীন প্রস্তরযুগীয় ধর্মেরই কিছু কিছু প্রথার অনুবর্তন।
সৌর বজরার ছবি, বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া সৌর ক্রুশ, ব্রোঞ্জের কুঠারের ভাণ্ডার, পরবর্তীকালের কাস্তে, তথাকথিত চন্দ্র মূর্তি, বিরাট সোনার টুপি, নেব্রা আকাশ-চাকতি, টুমুলাসের কবরখানা এবং আর্নফিল্ড সংস্কৃতির শবদাহের স্থান থেকে অনুমান করা হয় ব্রোঞ্জ যুগীয় ইউরোপে ধর্মের অস্তিত্ব ছিল।
ভূমধ্যসাগর, নিকট প্রাচ্য, ভারত ও চীনে যখন লৌহ যুগের প্রমাণ পাওয়া যায়, অধিকাংশ লৌহযুগীয় ইউরোপ (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দ থেকে অনুপ্রবেশ পর্যায় পর্যন্ত)) পড়ে প্রাগৈতিহাসিক পর্বে। হেলেনীয় ও রোমান যুগীয় জাতিবিজ্ঞান গ্রন্থগুলিতে অ-ভুমধ্যসাগরীয় ধর্মব্যবস্থাগুলির বর্ণনা কমই পাওয়া যায়।
মেরুদেশীয় ধর্মগুলি (সাইবেরিয়ার পশুপূজন ধর্ম, ফিনিক পুরাণ) ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান ধর্ম, আমেরিকান আদিবাসী ধর্ম ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ধর্মসমূহের ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক যুগ শেষ হয়েছে আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব ও ইউরোপীয় উপনিবেশের যুগে। এই ধর্মগুলির অধিকাংশই প্রথম বর্ণিত হয়েছে খ্রিস্টীয়করণের প্রেক্ষাপটে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.