Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মিশরের পুরাতন রাজত্ব বা প্রাচীন রাজত্ব -এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের এক বৃহদংশ (মোটামুটি ২৭০০ - ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। মিশরের প্রাচীন সভ্যতার পুরো সময়কালকে সাধারণভাবে যে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, পুরাতন রাজত্ব হল তার মধ্যে প্রাচীনতম। সাধারণভাবে ৩য় থেকে ৬ষ্ঠ রাজবংশের শাসনকালকে এই সময়কালের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। ৩য় রাজবংশের সূচনাকাল থেকে এই সময়কালের শুরু[1][2] (১ম ও ২য় রাজবংশের রাজত্বকালকে বলা হয় আদি রাজত্বের যুগ[2]; early dynastic period) ও ৬ষ্ঠ রাজবংশের শেষে ৭ম রাজবংশের শুরুতে প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন যুগের সময়ে এর শেষ।[2]
মিশরের পুরাতন রাজত্ব | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
২৭০০ খ্রিপূ–২২০০ খ্রিপূ | |||||||||
রাজধানী | মেমফিস | ||||||||
প্রচলিত ভাষা | প্রাচীন মিশরী ভাষা | ||||||||
সরকার | Divine, Absolute Monarchy | ||||||||
ফারাও | |||||||||
• c. 2686–c. 2649 BC | Djoser (first) | ||||||||
• c. 2184–c. 2181 BC | Last king depends on the scholar, Neitiqerty Siptah (6th Dynasty) or Neferirkare (7th/8th Dynasty) | ||||||||
ইতিহাস | |||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ২৭০০ খ্রিপূ | ||||||||
• বিলুপ্ত | ২২০০ খ্রিপূ | ||||||||
|
এখানে বলে রাখা ভালো যে মিশরের প্রাচীন ইতিহাসকে এইভাবে বিভিন্ন রাজত্বের যুগে ভাগ করার ঐতিহ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিকদের থেকে শুরু হয়েছে। প্রাচীন মিশরের অধিবাসীদের পক্ষে এই ধরনের কোনও যুগ পরিবর্তনের আভাস জানাও সম্ভব ছিল না। সেখানে আদি রাজত্বের যুগ থেকে পুরাতন বা প্রাচীন রাজত্বের যুগে উত্তরণের মধ্যে ধারাবাহিকতায় কোনওরকম ছেদ সংঘটিত হয়নি। রাজধানী থেকে গিয়েছিল এক, এমনকি রাজার প্রাসাদও। শুধু তাই নয় আদি যুগের তথাকথিত শেষ রাজার সাথে পরবর্তী পুরাতন রাজত্বের যুগের তথাকথিত প্রথম দুই রাজার আত্মীয়তা ও সেই সূত্রে স্বাভাবিক উত্তরাধিকারের সম্পর্কও ছিল (যে কারণে এক্ষেত্রে এক যুগ থেকে আরেক যুগে উত্তরণের নির্দিষ্ট দিন, ক্ষণ, বছরের উল্লেখ সবসময়েই কিছুটা বিতর্কিত হতে বাধ্য)। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিকরা এই দুই যুগের মধ্যে ভাগ করেছিলেন মূলত বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে; সমাজ ও অর্থনীতির উপরও স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাবও ছিল ব্যাপক ও যুগান্তকারী।[3]
প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে এই যুগকে পিরামিডের যুগ বা পিরামিড নির্মাতাদের যুগ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মিশরের তৎকালীন রাজধানী মেমফিসের নিকটবর্তী অঞ্চলে এইসময়ে একের পর এক বৃহদাকার পিরামিড নির্মিত হয়। তৃতীয় রাজবংশের সময় থেকেই এইধরনের বৃহৎ নির্মাণকার্যের সূচনা ঘটেছিল। চতুর্থ রাজবংশের আমলে তা বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে। মিশরের সুবিখ্যাত খুফুর পিরামিড, খাফ্রীর পিরামিড, মেনকাউরির পিরামিড, প্রভৃতি এই আমলেরই কীর্তি।[4] এই পিরামিডগুলির বিশালত্ব থেকে সহজেই অনুমেয় এইসব পিরামিডের নির্মাতা ফারাওদের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাংগঠনিক ক্ষমতা,যার বলে সেই যুগেও এইধরনের বিশালকায় নির্মাণের উপযোগী উপাদান ও শ্রমশক্তিকে এক জায়গায় করা সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি এইসব নির্মাণগুলিকে খুঁটিয়ে দেখলে একদিকে যেমন সেই যুগের মিশরের নির্মাণকৌশল ও শিল্পের ক্রমবিবর্তন আমাদের চোখে পড়ে, অন্যদিকে বোঝা যায় মৃতকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস এই যুগের মিশরীয়দের সংস্কৃতিকে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এইসময়ের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে লিখিত কোনও উপাদান খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের মতে তাই আক্ষরিক অর্থেই মিশরের এই যুগের ইতিহাস পাথরের ঐ সুবিশাল নির্মাণগুলির মধ্যেই লিখিত।[4] তাঁদের আরও মতে এইসময় থেকেই মিশরের রাজারা (আমরা জানি না তখন তাঁরা ফারাও বলে অভিহিত হতেন কিনা) ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও জীবন্ত দেবতা হিসেবে পূজিত হতে শুরু করেন ও সেই হিসেবে প্রজাদের সমস্ত সেবা ও সম্পত্তির দাবিদার হিসেবে গণ্য হন।[5]
এই যুগের মিশরের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে আমাদের মূল উপাদান এই যুগে তৈরি বিভিন্ন বিশাল বিশাল পিরামিড ও মন্দিরসমূহ। কালের নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপে স্বাভাবিকভাবেই এদের অনেকগুলিই বর্তমানে যথেষ্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবু তাদের অবশেষ এখনও আমাদের সামনে অনেক তথ্যই তুলে ধরে। বিশেষত ষষ্ঠ রাজবংশের সময়ে নির্মিত পিরামিড ও কবরস্থাগুলিতে যেসব ফলক ও শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার থেকে আমরা সেই যুগের মিশরের মানুষের মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কিত বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে পারি।[6]
পিরামিডগুলির কাছাকাছি প্রায়শই বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর কবরও খুঁজে পাওয়া গেছে। এইসব কবরগুলিতে বেশিরভাগ সময়ই অনেক খোদাই করা চিত্র ও চিত্রলিপির খোঁজ মিলেছে। তবে পিরামিড থেকে দূরে অবস্থিত এইসব কবরগুলিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান নিয়ে এখনও পর্যন্ত গবেষণা হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। যাইহোক, পুরাতন রাজত্বের শেষের দিকের সময়ের এইরকমের বেশ কিছু সুসজ্জিত কবর খুঁজে পাওয়া গেছে।[6][7]
পুরাতন রাজত্বের সময়কালীন বসতিস্থলগুলিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য এখনও পর্যন্ত খুব একটা চালানো হয়নি। গিজার পিরামিডগুলির নিকটস্থ অঞ্চলেই একমাত্র অতি সম্প্রতি এরকম একটি বসতিতে খননকার্য পরিচালিত হয়েছে। অন্যদিকে এই যুগের অল্প কিছু মন্দির নিয়েই খুঁটিয়ে গবেষণা হয়েছে। পরবর্তীকালের মন্দিরগুলির তুলনায় দেখা গেছে এই যুগের মন্দিরগুলি প্রায়শই বেশ ছোট ও কম সুসজ্জিত। তবে কায়রো থেকে ১৫ কিলোমিটার মতো দূরে ৫ম রাজবংশের সময়কালীন যে দু'টি সূর্যমন্দিরে খননকার্য চালানো হয়েছে, সেগুলি ছিল তুলনায় যথেষ্টই বৃহৎ।[8] পুরাতন রাজত্বের যুগের লিখিত প্যাপিরাস তেমন কিছু উদ্ধার হয়নি। তবে আবুসিরে ৫ম রাজত্বের সময়কালীন বেশ কিছু প্যাপিরাস পাওয়া গেছে, যার থেকে রাজাদের স্মৃতিমন্দির এবং সূর্যমন্দিরের প্রশাসন, পূজার্চনা, পুরোহিতদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ, ধর্মাচরণ, প্রভৃতি বিষয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি।[9]
মূল নিবন্ধ - মিশরের তৃতীয় রাজবংশ
মিশরে আদি রাজত্বের যুগ (প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকাল) শেষ হয়ে পুরাতন রাজত্বের যুগের সূচনা ঘটে তৃতীয় রাজবংশের রাজত্বকালেই (মোটামুটি ২৭০০ - ২৬২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। মূলত পিরামিডনির্মাণকেন্দ্রিক তৎপরতাকে কেন্দ্র করেই ঐতিহাসিকরা এই যুগবিভাজন করে থাকেন। নাহলে অনেক ঐতিহাসিকেরই মতে প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের শাসনকালের সরাসরি ধারাবাহিকতাতেই তৃতীয় রাজবংশের শাসনকালকেও চিহ্নিত করা সম্ভব; কারণ রাজনৈতিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই দুই যুগের মিলের পরিমাণ সত্যিই চোখে পড়ার মতোই।[10] তাছাড়া দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় রাজবংশের রাজত্বকালের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এমনকী রাজবংশেরও তেমন কোনও পরিবর্তন হয়েছিল বলা যায় না, কারণ তৃতীয় রাজবংশের প্রথম রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে সরাসরিই তার পূর্ববর্তী রাজবংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন।
তবে তৃতীয় রাজবংশের রাজাদের ক্রমপর্যায় ও উত্তরাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটা মুশকিল অনুভূত হয় ; এর কারণ হল পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত তালিকাতে ফারাওদের জন্মসময়কালীন নামের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তার সাথে এইসময়ের হোরাসনামগুলিকে প্রায়শই মেলানো সম্ভব হয় না। এইসময়ের যে পাঁচ থেকে ছয়জন রাজার হোরাসনাম পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একমাত্র নেতিয়েরি-খেতকে ফারাও জোসের হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে যে সেখেমখেত, খাবা ও সানাখৎ'এর নাম পাওয়া যায়, তাদের সঠিক পরিচয় নিয়ে এখনও সংশয় থেকে গেছে। এই রাজবংশের শেষ ফারাও হুনিকে সাধারণভাবে হোরাসনাম কাহেদিয়েৎ বলে মনে করা হয়, তবে এই চিহ্নিতকরণও পুরোপুরি সন্দেহাতীত নয়। এখনও পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এই রাজবংশের রাজত্বকাল মোটামুটি ৫০ - ৭৫ বছর স্থায়ী ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।[11][12]
ফারাও জোসের ছিলেন এই রাজবংশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজা। তাঁর আমলেই সাক্কারায় সুবিখ্যাত স্টেপ পিরামিড সহ একাধিক প্রস্তরনির্মিত সৌধ নির্মিত হয়। মানবেতিহাসে এইধরনের সৌধের প্রথম নির্মাতা হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ্য।[13] এই রাজবংশের আমল প্রাচীন মিশরের প্রস্তরনির্মিত সৌধসমূহের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাল হিসেবেই চিহ্নিত। এইধরনের সুবিশাল নির্মাণকার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত এবং সচল প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এই আমলের একজন প্রসিদ্ধ আমলা ছিলেন ইমহোটেপ; তিনি ছিলেন ফারাও'এর পরামর্শদাতা ও অন্যতম প্রধান নির্মাতা। তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে পরবর্তীকালে তিনি এমনকী দেবতা হিসেবেও পূজিত হতে শুরু করেন। ফারাও জোসেরের আমল থেকে পিরামিড ও অন্যান্য সৌধের গায়ে অলঙ্করণ ও প্রতিলিপি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের সূক্ষতা চোখে পড়ে, তা স্বাভাবিকভাবেই এই আমলকে পূর্ববর্তী আমলের থেকে পৃথক রূপে চিহ্নিত করে থাকে।
এই আমলের মিশরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই যে, নীল নদের দুই তীরবর্তী পূর্ববর্তী নোমগুলি এইসময়েই তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব হারিয়ে ফারাও'এর বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় ও তাদের পূর্ববর্তী স্বাধীন শাসকরা নিজ নিজ অঞ্চলে ফারাও'এর প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন বা কর সংগ্রাহকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ফারাও এইসময় থেকেই দেবতা হিসেবে পূজিত হতে শুরু করেন। মিশরীয়দের ধারণা ছিল যে নীল নদে যে বার্ষিক বন্যা হয়, যা তাদের কৃষিকার্য ও ফসল উৎপাদনের জন্য ছিল অপরিহার্য, তা ফারাওই নিয়ন্ত্রণ করেন। মহাবিশ্বে সময় চক্রাকারে আবর্তিত হয়, পৃথিবীতে ঋতুচক্র তারই প্রতিফলন। ফারাও পৃথিবীতে এই সময়চক্রের স্থায়িত্ব ও সাম্যের নিয়ন্তা। তারা এইসময় নিজেদের দেবতাদের দ্বারা বিশেষভাবে চিহ্নিত ও নির্বাচিত মানবগোষ্ঠী বলেই মনে করত।[14]
মূল নিবন্ধ - মিশরের চতুর্থ রাজবংশ
ফারাও স্নোফ্রুর হাত ধরে চতুর্থ রাজবংশের (২৬২০ - ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সূচনা ঘটে। তিনি সম্ভবত পূর্ববর্তী ফারাও হুনিরই এক সন্তান ছিলেন। মোটামুটি ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে এই রাজবংশের সাতজন ফারাও রাজত্ব করেন। এদের মধ্যে চারজন - স্নোফ্রু, খুফু, খাফরে ও মেনকাউরে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় (১৮ - ৩০ বছর) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।[15]
এই রাজবংশের আমলকে প্রাচীন মিশরের অন্যতম স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। মিশরের বড় বড় ও বিখ্যাত পিরামিডগুলির অনেকগুলিই এই আমলেই নির্মিত। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফারাও স্নোফ্রু। তাঁকে অনেকেই একজন আদর্শ ফারাও হিসেবে গণ্য করে থাকেন। তিনি সাম্রাজ্যের প্রভূত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন, এমনকী লিবিয়া ও নুবিয়ার মতো দূরদেশেও তিনি অভিযান চালান। সাম্রাজ্যের সীমানারক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সীমান্তদুর্গও তৈরি করান। এছাড়া মেইদম ও দাহ্শুরে তিনি পরপর তিনটি বড় পিরামিড তৈরি করান; নির্মাণরীতি ও কৌশলের দিক থেকে এই তিনটি পিরামিডকে পুরনো স্টেপ পিরামিড ও পরবর্তীকালের তুলনামূলক আধুনিক পিরামিডগুলির মধ্যবর্তী পর্যায়ের বলে মনে করা হয়। তাঁর বংশধর হিসেবে পরবর্তী ফারাও হন খুফু। গিজার মালভূমি অঞ্চলকে তিনি পিরামিডনির্মাণস্থল হিসেবে বেছে নেন ও সেখানে ১৪৬.৫৯ মিটার উঁচু যে পিরামিডটি তৈরি করান, সেটি আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পিরামিড হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর আমলের এই বিশাল নির্মাণকার্যের কারণে অনেক ঐতিহাসিকই তাঁকে, তাঁর বাবা স্নোফ্রুর বিপরীতে, একজন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর ও যশলোভী সম্রাট হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন; কিন্তু বাস্তবে তিনি যে মিশরীয়দের দ্বারা এমনকী প্রাচীন মিশরের শেষ যুগ পর্যন্ত পূজিত হতেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর দুই পুত্র জেদেফ্রে ও খাফরে, তাঁর পর একে একে ফারাও হন। জেদেফ্রে প্রথম ফারাও হিসেবে নিজেকে রে'র পুত্র বলে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে খাফরে তাঁর বাবার তৈরি পিরামিডের পাশে আরও একটি বিশাল পিরামিড তৈরি করান। পরবর্তী ফারাও বিখেরিস সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানতে পারা যায় না। তাঁর পর সিংহাসনে বসেন ফারাও মেনকাউরে। গিজার তৃতীয় ও ক্ষুদ্রতম পিরামিডটি তাঁর তৈরি। এই রাজবংশের ষষ্ঠ তথা শেষ ফারাও ছিলেন শেপসেসকাফ। তুরিনে প্রাপ্ত ফারাওদের তালিকয় এছাড়াও থামফথিস নামে আরেক ফারাও'এর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সমকালীন অন্যান্য তথ্যপ্রমাণাদিতে এই নামের কোনও ফারাও'এর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।[15][16]
এই রাজবংশের আমলে যে ব্যাপক নির্মাণকার্য পরিচালিত হয়, তার জন্য এমন এক জটিল ও দক্ষ প্রশাসনের প্রয়োজন, যা এর আগে মিশরে কখনও গড়ে ওঠেনি। এইসময়ে প্রশাসনের ক্রমাগত বিস্তার ঘটে এবং "রাজকীয় কার্য দপ্তর" নামক একটি বিশেষ বিভাগই তৈরি হয় যার কাজই ছিল শুধুমাত্র এইসব নির্মাণকার্যের তদারক করা। এই বিভাগের প্রশাসনিক দায়িত্ব মোটেই কম ছিল না। এইসব দায়িত্বের মধ্যে পড়ত - বড় বড় ও জটিল প্রাকৌশলিক চাহিদা বিশিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করা, তার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক নিয়োগ করা, নির্মাণস্থলের কাছাকাছি সেই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য আবাসস্থল নির্মাণ ও তাদের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা, নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও মালপত্র রাখার ব্যবস্থা করা, নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় বড় বড় পাথর ও অন্যান্য সামগ্রী দূরদূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে মেমফিস অঞ্চলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে (হাতনুব, ফায়ুম, ওয়াদি হামামাত, সিনাই, প্রভৃতি) যেসব পাথর খাদান থেকে এইসব পাথর উত্তোলন করা হত, সেগুলির দেখভাল ও উন্নয়নও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল ফারাও'এর হাতে। তাঁর দৈব ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে এইসময়ে যেসব বিশাল নির্মাণকার্য পরিচালিত হয়, আগে কখনওই তা এই মাত্রায় দেখা যায়নি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চপদে সাধারণত রাজপুত্র বা রাজপরিবারের লোকেরাই নিযুক্ত হতেন। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসেবেও তাঁদের অনেকসময় নিয়োগ করা হত।[17][18]
মূল নিবন্ধ - মিশরের পঞ্চম রাজবংশ
পঞ্চম রাজবংশের (২৫০৪ - ২৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শাসকরা আগের রাজবংশগুলির তুলনায় আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। সমকালীন বা তৎপরবর্তী মিশরের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী লেখাপত্রে যেমন তাঁদের পরিচয় মেলে, তাঁদের আমলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকেও তা যাচাই করা সম্ভব হয়। আবুসিরে অবস্থিত ছোট ছোট পিরামিডগুলি ও বিশেষ করে সূর্যদেবতা রা বা রে-র মন্দির তাঁদের শাসনামলের সাক্ষ্যবহন করে।
ফারাও উসেরকাফের (২৪৯৪ - ২৪৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) হাতে এই রাজবংশের সূচনা। তাঁর পরে সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র সাহুরে (২৪৮৭ - ২৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তিনি পুন্ত অভিমুখে এক বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন বলে জানতে পারা যায়। তাঁর পরে ফারাও হন তাঁর পুত্র নেফেরিরকারে কাকাই (২৪৭৫ - ২৪৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ); ফারাওদের রাজকীয় উপাধি গ্রহণের ঐতিহ্য তাঁর আমল থেকেই শুরু হয়। তাঁর পরের দু'জন সল্প সময়ের ফারাও'এর নাম আমরা জানতে পারি - তাঁর পুত্র নেফেরেফ্রে (২৪৫৫ - ২৪৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও শেপসেসকারে; দ্বিতীয়জনের বংশপরিচয় সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানা যায় না।[15] যাইহোক, শেপসেসকারে যতদূর সম্ভব নেফেরেফ্রে'র ভাই নিউসেরে ইনির হাতে মারা যান। ইনি দীর্ঘ ২৪ বছর (২৪৪৫ - ২৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বা তারও বেশি রাজত্ব করেন। আবুসিরে তাঁর আমলে প্রচুর নির্মাণকার্য পরিচালিত হয়। এছাড়া গিজাতেও তিনি নূতন করে রাজকীয় নির্মাণে হাত দেন। এরপরে একে একে ফারাও হন মেনকাউহোর কাইউ (২৪২১ - ২৪১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), জেদকারে ইসেসি (২৪১৪ - ২৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং উনাস (২৩৭৫ - ২৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। শেষোক্তজন ছিলেন এই রাজবংশের শেষ ফারাও।[1]
এইসময় ফারাওদের প্রকৃত ক্ষমতা কিছুটা হ্রাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে অভিজাত শ্রেণি ও প্রশাসনিক আধিকারিকদের ক্ষমতা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। ফারাওও তাঁদের উপরে অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সমসাময়িক নানা লিখিত ফলক ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে আমরা এই তথ্য জানতে পারি।
এইসময় মিশরের বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য প্রসার লক্ষ করা যায়। আবলুস কাঠ, গন্ধরস লোবান প্রভৃতি সুগন্ধি দ্রব্য, সোনা তামা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ধাতু, ইত্যাদির বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জাহাজশিল্পেরও প্রসার ঘটে, যাতে খোলা সমুদ্রে বাণিজ্যাভিযান সম্ভব হয়। লেবানন থেকে সে'সময় মিশরে সিডার কাঠ আমদানি করা হত; লোহিত সাগর বরাবর পুন্ত থেকে (যতদূর সম্ভব আজকের সোমালিয়া) আমদানি হত সোনা, আবলুস কাঠ, হাতির দাঁত, সুগন্ধি রেজিন, প্রভৃতি। তবে সে' যুগে জাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে লোহার পেরেক, গজাল, ক্ল্যাস্প বা এমনকী কাঠের গোঁজও ব্যবহৃত হত না; বড় বড় কাঠ বা তক্তাকে মোটা দড়ি বা কাছি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে একসঙ্গে করে তৈরি হত জাহাজের খোল।
উনাসের পিরামিডগাত্রে আমরা যে চিত্রলিপির দেখা পাই, তা উদ্ধার হওয়া পিরামিডগাত্রে লিখিত লিপির মধ্যে প্রাচীনতম। আমাদের হাতে এসে পৌঁছনো মানুষের লিখিত ধর্মীয় লেখারও তা প্রাচীনতম উদাহরণ।
মূল নিবন্ধ - মিশরের ষষ্ঠ রাজবংশ
সংস্কৃতিগত দিক থেকে বিচার করলে ষষ্ঠ রাজবংশের রাজত্বকাল (২৩৪৭ - ২২১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পঞ্চম রাজবংশেরই ধারাবাহিক উত্তরাধিকার বহন করে। এই আমলে প্রশাসনিক কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তার সাথে সারা দেশের বিভিন্ন অংশে প্রশাসক নিযুক্ত হবার ফলে তাদের কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে। এইসব আঞ্চলিক প্রশাসকদের সাথে অনেকসময়েই ফারাও'এর আর কোনও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল না। তারউপর এইসব প্রশাসক পদগুলিও ধীরে ধীরে পারিবারিক উত্তরাধিকার কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। ফলে তাদের উপর ফারাও'এর নিয়ন্ত্রণ যত কমতে শুরু করে, কেন্দ্রীয় প্রশাসন ততই দুর্বল হতে থাকে, এইসব আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্রের গুরুত্বও ততই বাড়তে শুরু করে। লিবিয়া, নুবিয়া ও প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের সাথে সাথে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ক্ষমতা আরও হ্রাস পায়।
কিন্তু তাসত্ত্বেও নীল নদের নিয়মিত বাৎসরিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও মরেইস হ্রদ পর্যন্ত খালখনন (২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ) তখনও পর্যন্ত ছিল এক অতি প্রয়োজনীয় বিশাল কর্মকাণ্ড, যার জন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অস্তিত্বের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ফারাও দ্বিতীয় পেপির দীর্ঘ রাজত্বকালের (২২৭৮ - ২১৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শেষের দিকে আভ্যন্তরীন গণ্ডোগোল মাথাচাড়া দেয়; তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয় তা কিছুদিনের মধ্যেই গোটা দেশকেই গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
আধুনিক গবেষণা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নীল নদের নিয়মিত বাৎসরিক বন্যা ব্যাহত গেলে, তার প্রভাব মিশরীয় সভ্যতার উপর ব্যাপকভাবে পড়ে; সম্ভবত তার ফলেই পুরাতন রাজত্বের পতন ত্বরাণ্বিত হয়।[19][20] মোটামুটি ২২০০ - ২১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এর ফলে নীল নদের স্বাভাবিক নিয়মিত বন্যা প্রায় বন্ধই হয়ে যায়।[21] দুই থেকে তিন দশক ধরে এই পরিস্থিতি চলার ফলে গোটা দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যায়; কেন্দ্রীয় প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।[22] সে' সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এইধরনের প্রভাব অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা, যেমন সুমের ও সিন্ধু সভ্যতার উপরও লক্ষ করা সম্ভব।
কেন্দ্রীয় প্রশাসন ভেঙে পড়লে প্রথম অন্তর্বর্তী যুগের সূচনা ঘটে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.