Loading AI tools
একজন সর্বোচ্চ উপাস্য যাকে এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা হিসাবে গণ্য করা হয় উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মনুষ্যধর্ম ও পুরাণ অনুযায়ী, সৃষ্টিকর্তা বা স্রষ্টা হলেন[note 1] পৃথিবী, বিশ্বজগত ও ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির স্রষ্টা। একেশ্বরবাদী ধর্মে ঈশ্বর ও সৃষ্টিকর্তা অভিন্ন। একাধিক একক-উপাস্যবাদে[lower-alpha 1] একজন গৌণ স্রষ্টাকে একজন ‘প্রাথমিক অতীন্দ্রিয় সত্তা’ থেকে পৃথক করে যাকে ‘প্রাথমিক সৃষ্টিকর্তা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[1]
ইব্রাহিমীয় ধর্মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন এক শক্তিশালী, সতন্ত্র ও দয়াবান সত্বা যিনি এই মহাবিশ্বের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ অনুযায়ী ঈশ্বর (সৃষ্টিকর্তা) এই জগতের পিতা। মুসলমানদের কাছে আল্লাহ (সৃষ্টিকর্তা) হলেন এক ও অদ্বিতীয় সত্বা, যিনি লা- শারিক (যার সাথে কারো তুলনা করা যায় না)। এক্ষেত্রে ইহুদিদের বিশ্বাসও মুসলমানদের অনুরুপ। বাহাই বিশ্বাসীদের মতে, সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন অদ্বিতীয় ও মহাপরাক্রমশালী যিনি এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। আর জরথুস্ত্রবাদ অনুযায়ী, অহুরা মাজদা (সৃষ্টিকর্তা) এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন।
হিন্দুদের নিকট সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন অদ্বিতীয় পরমাত্মা বা ব্রহ্ম, যিনি সকল জিনিস সৃষ্টি করে তার সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান রয়েছেন এবং জগতের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।
কিছু ধর্ম এক সৃষ্টিকারী সত্ত্বার উপরে বিশ্বাস করে না। যেমন- ইনকা ধর্ম, গ্রিক ধর্ম, চীনা ও আফ্রিকার লৌকিক ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি।
বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম কনফুসীয়বাদ, তাওবাদ, শিন্তৌ সৃষ্টিকর্তা নামক কোনো সত্ত্বার অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস করে না। তাদের মতে, সৃষ্টিকর্তা বলে কোনো স্বত্বার এতে কোনো হাত নেই। জগতের সবকিছু চিরকাল ছিলো, আছে আর থাকবে।
প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে নতুন রাজতন্ত্রের যুগে ১৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারাও আখেনাতেন এবং রানী নেফেরতিতি দ্বারা "আতেনবাদ" সূচিত হয়েছিল। তাঁরা মরুভূমিতে নিজেদের এবং তাঁদের একমাত্র সৃষ্টিকর্তার উপাসকদের জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজধানী শহর (আখেতাতেন) তৈরি করেছিল। আখেনাতেনের পিতা তাঁদের বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের অন্যান্য দেবতাদের সাথে আতেনের পূজা করতেন। তাঁর পিতার সময়ের অনেক আগে থেকেই মিশরে অনেক দেবদেবীর মধ্যে একজন দেবতা হিসেবে আতেনকে সম্মান প্রদর্শন করা হতো। ফারাওয়ের মৃত্যুর পর আতেনবাদ ম্লান হয়ে যায়। ভিন্ন মতামত থাকা সত্ত্বেও কিছু পণ্ডিত আতেনবাদকে মানব ইতিহাসে একেশ্বরবাদী ধর্মের অন্যতম প্রারম্ভিক মতবাদ বলে মনে করেন।
ইহুদি ধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে ইয়াহওয়েহ্ বা এলোহিম বলা হয়ে থাকে, যা হিব্রু ভাষার শব্দ। ইহুদিদের মাঝে সৃষ্টিকর্তাকে যারা এলোহিম নামে ডাকে তাদের এলোহীয় (Elohist) এবং যারা যিহোবা নামে ডাকে তাদের যিহোবীয় (Yahwist) বলে ডাকা হয়ে থাকে। ইহুদিরা খ্রিস্টানদের মতো ত্রিত্ববাদ এ বিশ্বাস করে না। আদি পুস্তকের সৃষ্টির আখ্যান ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মের সৃষ্টি পুরাণ[note 2]।[2] আখ্যানটি দুটি গল্প নিয়ে তৈরি, মোটামুটি আদি পুস্তকের প্রথম দুটি অধ্যায়ের সমতুল্য। প্রথমটিতে, এলোহিম (ঈশ্বর) ছয় দিনে স্বর্গ ও পৃথিবী, প্রাণী এবং মানবজাতি সৃষ্টি করেন, তারপর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন, আশীর্বাদ করেন ও পবিত্র করেন (অর্থাৎ বাইবেলের সাবাথ)। দ্বিতীয় গল্পে, ঈশ্বর যাকে এখানে ব্যক্তিগত নাম ইয়াহওয়েহ্ দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রথম মানুষ আদমকে ধূলিকণা থেকে সৃষ্টি করেন এবং তাঁকে আদনের বাগানে রাখেন যেখানে তাঁকে প্রাণীদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। অতঃপর আদমের দেহ থেকে থেকে তাঁর সঙ্গী হিসাবে প্রথম নারী ইভকে সৃষ্টি করা হয়।
আখ্যানটি মেসোপটেমীয় পুরাণের বিষয়সমূহের একটি সমান্তরাল ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং ইস্রায়েলীয় জনগণের একেশ্বরে প্রতি বিশ্বাসের প্রতি জোর দেয়।[3] তোরাহর প্রথম প্রধান ব্যাপক খসড়া (পাঁচটি পুস্তকের সিরিজ যা আদি পুস্তক দিয়ে শুরু ও দ্বিতীয় বিবরণ দিয়ে শেষ) ৭ম বা ৬ষ্ঠ শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দে (যাহ্বি উৎসমতে) রচিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে অন্যান্য লেখকদের দ্বারা বর্ধিত হয়েছিল (পণ্ডিতি উৎসমতে) অনেকটা আদি পুস্তকে মতো একটি কাজ যা আজ পরিচিত।[4] সৃষ্টির আখ্যানে দুটি উৎস চিহ্নিত করা যেতে পারে: পণ্ডিতি ও যাহ্বি।[5] সম্মিলিত আখ্যানটি সৃষ্টির মেসোপটেমীয় ধর্মতত্ত্বের একটি সমালোচনা: আদি পুস্তক একেশ্বরবাদকে নিশ্চিত করে এবং বহু-ঈশ্বরবাদকে অস্বীকার করে।[6] রবার্ট অল্টার সম্মিলিত আখ্যানটিকে বর্ণনা করেছেন "[এটি] এর প্রত্নতাত্ত্বিক রূপে অনড়, একেশ্বরবাদী সমাপ্তির সঙ্গে পুরাণের অভিযোজন"।[7]
খ্রিস্ট ধর্মমত অনুযায়ী ঈশ্বরের তিনটি রুপ বা সত্ত্বা বিদ্যমান, যাকে ত্রিত্ববাদ বলা হয়। তিনটি রুপ হলো, পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর ও পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। বাইবেলীয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পিতা হলেন স্বয়ং ঈশ্বর যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, পুত্র হলেন যিশু এবং পবিত্র আত্মা হলেন গ্যাব্রিয়েল (জিবরাইল)। বিষয়টি বোঝাতে খ্রিস্টান পণ্ডিতেরা এক্ষেত্রে ‘গাছের উপমা’ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। এই ধারণার মূল বক্তব্য হলো– একটা গাছে যেমন ফলমূল, লতাপাতা বিদ্যমান, তেমনি ঈশ্বরেরও তিনটি রূপ বিদ্যমান। একই গাছ অথচ এরই মধ্যে কত কিছু রয়েছে। তেমনি একই ঈশ্বর, কিন্তু তার ৩টি রূপ রয়েছে।
যিশু ঈশ্বরের পুত্র হলেও তাকে ঈশ্বরের মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। খ্রিস্টানদের মতে, যিশু খ্রিস্ট বিশ্বে খ্রিস্ট ধর্মের শান্তির বাণী পৌঁছে দিতে ঈশ্বর পুত্র রুপে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন। দুনিয়া ধ্বংসের আগে মশীহ রুপে তিনি পুনরায় আগমন করবেন। খ্রিস্ট ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা অনেকটা সর্বেশ্বরবাদী।
ইসলাম ধর্মানুসারে সৃষ্টিকর্তা ও ঈশ্বর আরবিতে আল্লাহ নামে পরিচিত, যিনি হলেন সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ স্রষ্টা, সবকিছুর ধারক, সবকিছুর আদেশদাতা এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিচারক। ইসলামে সৃষ্টিকে ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও করুণার একটি কাজ হিসেবে দেখা হয়, যার একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।[8] মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য পরীক্ষা করা;[9] যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তাঁরা জান্নাতে পুরস্কৃত হয়।[10]
ইসলামি শিক্ষা অনুসারে ঈশ্বর স্বর্গ ও সব সৃষ্টির উপরে বিরাজমান। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, "তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি স্বর্গের দিকে ইস্তওয়া (উপরে ওঠা) করলেন এবং সেগুলোকে সাত আকাশে পরিণত করলেন; তিনিই সবকিছুর [বিষয়ে] সর্বজ্ঞ।"[11] একইসঙ্গে ঈশ্বর সৃষ্টির কোনো কিছুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়;[12] এবং কেউই ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না।[13] ইসলামে ঈশ্বর শুধু মহিমান্বিত ও সার্বভৌমই নয়, ব্যক্তিগত ঈশ্বরও বটে।[14] আল্লাহ বিশ্বাসীদের সর্বদা তাঁকে স্মরণ করতে[15] এবং শুধুমাত্র তাঁর কাছেই চাইতে নির্দেশ দেন।[16]
ইসলাম শেখায় যে কুরআনে উল্লেখিত ঈশ্বরই একমাত্র ঈশ্বর এবং একক ঈশ্বরের উপাসনা অন্যান্য আব্রাহামিক ধর্ম যেমন খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মের সদস্যরা করে থাকেন।
যদিও বাহাই ধর্ম পৃৃথিবীর সকল ধর্মকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবুও স্বধর্মীয় বিশ্বাসমতে ঈশ্বর হলেন অবিনশ্বর, সৃষ্টিহীন সত্তা যিনি সমস্ত অস্তিত্বের উৎস।[17] বাহাই ধর্মে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে "একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বর, অচিন্তনীয়, ধরাছোঁয়ার বাইরে, সমস্ত উদ্ঘাটনের উৎস, চিরন্তন, সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান" হিসাবে।[18][19] প্রত্যক্ষভাবে অতীন্দ্রিয় ও ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও তাঁর প্রতিচ্ছবি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত হয়। বাহাইরা বিশ্বাস করে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে সৃষ্টিকর্তাকে জানার ও ভালোবাসার সামর্থ্য থাকা।[20]
জরথুস্ত্রবাদে সৃৃষ্টিকর্তাকে "অহুর মাজদা" (সর্বজ্ঞানস্বামী) বলা হয়। জরথুস্ত্রবাদীদের বিশ্বাস, আগুন হলো সৃৃষ্টিকর্তার পবিত্রতার প্রতীক। অহুরা মাজদাই এই বিশ্বজগৎ সৃৃষ্টি করেছে বলে জরথুস্ত্রবাদীদের বিশ্বাস। তাদের মতে, অহুরা মাজদা সর্বদাই অশুভ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে লিপ্ত। মানুষের কাজ ভক্তি ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে মাজদাকে এ যুদ্ধে সহায়তা করা। ফলে পরকালে শান্তি লাভ করা যাবে।
মেন্ডীয়বাদে হাইয়ি রাব্বি (প্রাচীন মেন্ডীয়: Hiia Rbia; "শ্রেষ্ঠ জীবন") বা 'চিরঞ্জীব ঈশ্বর' হলেন সর্বোত্তম ঈশ্বর যাঁর থেকে সমস্ত কিছুর উৎপন্ন হয়েছে।[21] তিনি 'প্রথম জীবন' নামেও পরিচিত, কারণ জড় জগতের সৃষ্টির সময় ইউশামিন হাইয়ি রাব্বি থেকে "দ্বিতীয় জীবন" হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিলেন।[22] কায়েস আল-সাদির মতে, "মেন্ডীয় মতবাদের নীতিগুলো হলো: একমাত্র মহান ঈশ্বর হাইয়ি রাব্বির প্রতি বিশ্বাস, সকল কিছু যাঁর পরম সম্পত্তি; তিনি সমস্ত বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, তাঁর শক্তির মাধ্যমে আত্মা গঠন করেছেন এবং এটিকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানবদেহে স্থাপন করেছেন। তাই তিনি আদম ও হাওয়াকে (বাইবেলীয় নথিতে 'ইভ') সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা হলেন প্রথম পুরুষ ও নারী।"[23] মেন্ডীয়রা ঈশ্বরকে চিরন্তন, সকলের সৃষ্টিকর্তা, এক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করে।[24] "ঈশ্বরকে এককভাবে উপাসনা করা হয় এবং মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তি হিসাবে তাঁর প্রশংসা করা হয়। তিনি সমস্ত বিশ্বজগৎ এবং সকল সৃষ্টির উপর রাজত্ব করেন।"[25]:৪০
হিন্দু ধর্মে স্রষ্টার ধারণা অনেকটাই জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। চিণ্ময়বাদ, অদ্বিতীয়বাদ, সর্বেশ্বরবাদ, আস্তিক্যবাদ সকল বিশ্বাসের সমারোহ হিন্দু দর্শনে দেখা যায়, এ কারণে হিন্দু ধর্মে সৃৃষ্টিকর্তার ধারণা অত্যন্ত সত্য হিসাবে গৃহীত, এ ধারণাকে বেদান্তবাদ বলে। অর্থাৎ এক দেবতার স্বীকারের পাশাপাশি অদ্বিতীয় বিশ্বাসী ধর্মব্যবস্থা।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবাত্মা ও পরমাত্মা শাশ্বত। অদ্বৈতবাদ অনুসারে, জীবাত্মা সর্বশেষ ব্রহ্মে বিলীন হয়। অদ্বৈত দর্শন মতে, জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতাকে অনুভব করা। যিনি এতে সক্ষম হন, তিনি মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ করেন।
হিন্দু পুরাণ মতে, ব্রহ্মা হলেন গৌণ সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সর্বোচ্চ সত্ত্বা নন।[26] বিষ্ণু হলেন আদি সৃষ্টিকর্তা। বৈষ্ণব বিশ্বাসমতে বিষ্ণু সৃষ্টির মূল কারণ হিরণ্যগর্ভ তৈরি করেন এবং সেখানে জগতের সকল কাঁচামাল সরবরাহ করেন। তিনি "চেতানাকে" “জড় জগতের” মধ্যে স্থাপন করেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু কর্তৃক প্রদত্ত সামগ্রী দিয়ে জগৎ নির্মান করেন এবং তিনি এর সৃষ্টির পালন করেন।[27]
আবার অচিন্ত্যবাদ ও ভক্তিবাদের দর্শনে ব্রহ্মের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই মতবাদ অনুসারে সম্প্রদায়বিশেষে এই এক সত্বাকেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, পরমাত্মা রূপে পূজা করা হয়। উল্লেখ্য, জীবাত্মা এখানে স্রষ্টার উপর নির্ভরশীল আর সৃৃষ্টিকর্তার প্রেম বা অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল মোক্ষ বা মহামুক্তি।
মূলত হিন্দু ধর্ম মতে সবকিছুর সৃৃষ্টি এক চিরন্তন শক্তি ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর হতে। তিনিই যখন সৃষ্টিকার্য পরিচালনা করেন তখন তার গুণবাচক নাম ব্রহ্মা, আর এই সবকিছু যখন ধ্বংস করবেন তখন তিনিই হবেন শিব।[28][29]
হিন্দুধর্মের একটি দর্শন হচ্ছে অদ্বৈতবাদ যা স্রষ্টার একত্ববাদকে এর মৌলিক ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে। এটি দ্বৈতবাদ-ভিত্তিক আস্তিক্যবাদের (প্রকৃতি-পুরুষ দুই সত্বায় বিশ্বাসের) বিরোধিতা করে এবং দাবি করে কেবল একজন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর আছেন যিনি অনন্ত এবং অস্তিত্বের বাকি অংশ থেকে আলাদা। দুই ধরনের অদ্বৈতবাদ রয়েছে, যথা- আধ্যাত্মিক অদ্বৈতবাদ: যেটি এই ধারণাটি পোষণ করে যে সকল আধ্যাত্মিক বাস্তবতাই এক; এবং বস্তুগত অদ্বৈতবাদ: যেটি এই ধারণাটি পোষণ করে যে সকল বস্তুগত বাস্তবতাসহ সবকিছুই এক এবং একই বস্তু।[30]
শিখ ধর্মের বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় দায়িত্বগুলোত মধ্যে একটি হলো ঈশ্বরকে "সৃষ্টিকর্তা" হিসাবে উপাসনা করা, যাকে ওয়াহেগুরু বলে অভিহিত করা হয়, যিনি নিরাকার, নিরন্তর এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে, অর্থাৎ নিরঙ্কার, অকাল এবং অলখ নিরঞ্জন। ধর্মটি কেবলমাত্র "সকলের জন্য একেশ্বর" বা ইক ওঙ্কার বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত।
গুরু নানকের মতে, সৃষ্টিকর্তা মানুষের সম্পূর্ণ বোধগম্যতার বাইরে; অসংখ্য গুণ আছে; অসংখ্য রূপ নেয়, কিন্তু নিরাকার হয়; এবং অসীম সংখ্যক নামে ডাকা যেতে পারে এইভাবে, "আপনার (সৃষ্টিকর্তা) নামগুলি অনেক, এবং আপনার রূপ অন্তহীন। কেউ বলতে পারবে না যে আপনার কত গৌরবময় গুণ আছে!"[31]
বহু-ঈশ্বরবাদ বলতে একের অধিক ঈশ্বর বা দেবতার প্রতি বিশ্বাসকে বোঝায়। বহু-ঈশ্বরবাদে কোনো এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বার প্রতি বিশ্বাস অনুপস্থিত। প্রকৃৃতির প্রত্যেকটা ঘটনার জন্য এসকল ধর্মে একেক জন স্বতন্ত্র সত্ত্বা বিদ্যমান। ১৬শ শতাব্দী থেকে ১৯শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পর্যন্ত ইউরোপীয় উপনিবেশায়নের ফলে একেশ্বরবাদী (সর্বেশ্বরবাদী) খ্রিস্ট ধর্মের বিস্তার ঘটতে থাকায় এসব বিশ্বাসের অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে যায়। কয়েকটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্ম হলো- প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম, প্রাচীন গ্রিক ধর্ম, প্রাচীন রোমান ধর্ম, ইনকা ধর্ম, আজটেক ধর্ম ইত্যাদি। বর্তমানে টিকে থাকা বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের মধ্যে রয়েছে- চীনা লৌকিক ধর্মবিশ্বাস, আফ্রিকার আদিবাসী ধর্মবিশ্বাস।
অনেক বহু-ঈশ্বরবাদী সৃষ্টিতত্ত্বে প্রায়শই এটা বিশ্বাস করা হয় যে জগতের সৃষ্টি প্রজননের মাধ্যমে, উদাহরণস্বরূপ, একটি আদি বীজ থেকে অঙ্কুরিত হওয়ার মাধ্যমে বা যৌন জননের মাধ্যমে যেমন- অলৌকিক জন্মের মাধ্যমে (কখনো কখনো অপুংজনি দ্বারা), দেবতা ও দেবীর বিবাহের মাধ্যমে; অথবা হিংস্রভাবে যেমন- একটি আদিম দানবকে হত্যা করার মাধ্যমে; অথবা কৃত্রিমভাবে যেমন- একটি ঐশ্বরিক স্রষ্টা বা "কারিগর" দ্বারা প্রভৃতিভাবে জগতের সৃষ্টি। কখনো কখনো বিশ্বাস করা হয় যে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একজন ঈশ্বর সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত।
প্লেটো তাঁর ডায়ালগ[lower-alpha 2] টাইমিয়াসে সৃষ্টির একটি পৌরাণিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন যাকে দিমিউর্গে (δημιουργός, "কারিগর") বা ইংরেজি উচ্চারণে ডিমিয়ার্জ (সৃষ্টিবাদ) বলা হয়। নব্য-প্লেটোবাদ ও নস্টিকবাদ[lower-alpha 3] এই ধারণাটির চর্চা অব্যাহত রাখে ও এর বিকাশ ঘটায়। নব্য-প্লেটোবাদে, ডেমিয়ার্জ পরম মৌলিকত্বের[lower-alpha 4] পর দ্বিতীয় কারণ বা দ্বিত্ববাদের[lower-alpha 5] প্রতিনিধিত্ব করে। নস্টিক দ্বৈতবাদে, ডিমিয়ার্জ হলো একটি অপূর্ণ আত্মা এবং সম্ভবত একটি মন্দ সত্তা, যা ঐশ্বরিক পূর্ণতার দ্বারা অতিক্রম করা হয়েছে। ইব্রাহিমীয় মতবাদের ঈশ্বরের ধারণার বিপরীতে, প্লেটোর ডিমিয়ার্জ আবশ্যক সৃষ্টিবাদ[lower-alpha 6] সমর্থনে অক্ষম।
বৌদ্ধ ধর্ম একজন সৃষ্টিকর্তার ধারণাকে অস্বীকার করে এবং এই বিশ্বাস পোষণ করে যে মহাব্রহ্মার মতো জাগতিক দেবতাদের একজন সৃষ্টিকর্তা বলে ভুল ধারণা করা হয়।[32] বৌদ্ধ ধর্ম দেবতাদের অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস করে ঠিকই, কিন্তু তাদের কেউই স্রষ্টা নয়। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, বিশ্বজগত পরিচালিত হয় ৫ নিয়মে। এগুলো হলো, চিত্ত নিয়ম, রীত নিয়ম, বীর্য নিয়ম, ধর্ম নিয়ম ও কর্ম নিয়ম। এগুলো এক প্রকার জাগতিক নিয়মকানুন (Universal Rules)। আর এগুলোই বৌদ্ধ ধর্মে সৃষ্টিকর্তা।
জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিত্ব প্রতিটি আত্মার বা প্রত্যেক জীবিত সত্ত্বার অন্তর্নিহিত গুণ। এই গুণের বৈশিষ্ট্য হলো শুদ্ধ জ্ঞান, অনন্ত আনন্দ এবং অন্যান্য গুণাবলির যথাযথ পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। ফলে জৈন ধর্ম কোনো স্বাধীন, শক্তিশালী ও সর্বোচ্চ সত্ত্বার (সৃষ্টিকর্তা) উপরে নির্ভরশীলতার শিক্ষা দেয় না। জৈনরা বিশ্বাস করে যে জ্ঞান ও সকল কর্মের বন্ধন থেকে সর্বোচ্চ মুক্তি লাভ করার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই নৈতিক আদর্শ পালন করতে হবে।
প্রকৃত অর্থে জৈন ধর্ম কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের উপর বিশ্বাসকে সমর্থন করে না। জৈন মতবাদ অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব এবং এর উপাদানগুলির (আত্মা, পদার্থ, স্থান, সময়, গতি ইত্যাদি) সর্বদাই অস্তিত্ব ছিল।
নাস্তিক্যবাদ বলতে বোঝায় কোনো ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার না করা এবং সম্পূর্ণ ভৌত বা প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া। নাস্তিকতা কোনো দর্শন বা বিশ্বাস নয়, বরং এটিকে বলা হয় 'বিশ্বাসের (ধর্ম) অনুপস্থিতি'।
আধুনিক নাস্তিকতা ও বস্তুবাদী বিজ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। নাস্তিকেরা বিভিন্ন ঘটনা ও তাদের অভিমতের ব্যাখ্যা দিতে বৈজ্ঞানিক উপমাসমূহ ব্যবহার করে থাকে। নাস্তিকতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিসের বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরাই সর্বপ্রথম নাস্তিকতার পক্ষে তাদের রায় প্রকাশ করেন। তৎকালীন গ্রিসের বহুঈশ্বরবাদী লোকধর্মের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকায় অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ এর বিরোধিতা করেন। এভাবেই নাস্তিক্যবাদী মতবাদের শুরু।
কাজাখ লোককাহিনি অনুযায়ী বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হলেন " জাসাগনান"।[33]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.