Loading AI tools
হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
অনসূয়া (সংস্কৃত লিপ্যন্তরের আন্তর্জাতিক বর্ণমালা: অনসূয়া, अनसूया "দ্বেষ ও ঈর্ষা মুক্ত"), দেবী অনসূয়া নামেও পরিচিত, হিন্দু কিংবদন্তীতে অত্রি নামে এক প্রাচীন ঋষির স্ত্রী ছিলেন।[1][2] রামায়ণের বর্ণনানুসারে, তিনি তার স্বামীর সাথে চিত্রকূট বনের দক্ষিণ পরিধিতে একটি আশ্রমে বাস করতেন।[3][4] তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং সর্বদা অনাড়ম্বরভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মানুশীলন করতেন। এর ফলে তিনি কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। কাহিনী অনুসারে, অনসূয়া আকাশে ঝড় তুলেছিলেন, দেবতাদের অস্বীকার করেছিলেন এবং মন্দাকিনী নদীকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছিলেন।[5]
সীতা এবং রাম যখন নিজেদের বনবাস-নির্বাসনের সময় অনসূয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন, তিনি তাদের প্রতি খুবই মনোযোগী ছিলেন এবং সীতাকে এমন একটি লেপন দিয়েছিলেন যা চিরকাল তার সৌন্দর্য বজায় রাখার মতো উপযোগী ছিল।[3][6][7][8] অনসূয়া সীতাকে বলেছিলেন যে, রাজপ্রাসাদের সুখ ত্যাগ করে রামের সঙ্গে বনবাসী হয়ে তিনি সঠিক কাজ করেছেন। তিনি আরো বলেন, একজন নারীর সবচেয়ে ভাল বন্ধু হলো তার স্বামী, যে তাকে সর্বদা রক্ষা করে, এছাড়া আর কেউ হতে পারে না।[9] তিনি ত্রিমূর্তি- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মধ্যে বিষ্ণুর ঋষি অবতার দত্তাত্রেয়; শিবের অবতার একরোখা-রাগান্ধ ঋষি দুর্বাসা এবং ব্রহ্মার অবতার চন্দ্রাত্রির মাতা ছিলেন।[1][3][10] তিনি চন্দ্রদেবতা চাঁদেরও মাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন ঋষি কর্দম এবং দেবাহুতির কন্যা।[3][11][12] ঋষি কপিল ছিলেন তার ভাই এবং শিক্ষক। হিন্দু ধর্মানুসারে তিনি সতী অনসূয়া অর্থাৎ পবিত্র স্ত্রী অনসূয়া হিসেবে পূজিত হন। তিনি হিন্দু পুরাণের অন্যতম পবিত্র চরিত্র হিসেবে বিবেচিত।[5] হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দুষ্মন্তের স্ত্রী ও সম্রাট ভরতের মা শকুন্তলার প্রিয়সখীদের একজন ছিলেন অনসূয়া।
অনসূয়া দুটি অংশ নিয়ে গঠিত: অন এবং অসূয়া। অন একটি নেতিবাচক উপসর্গ এবং অসূয়া অর্থ ঈর্ষা। অর্থাৎ, অনসূয়া অর্থ দাঁড়ায় ঈর্ষা বা হিংসা থেকে মুক্ত।[13]
অনসূয়ার পরিবারের কাহিনী ভাগবত পুরাণের তৃতীয় স্কন্দে উল্লিখিত রয়েছে। ঋষি কর্দম, স্বয়ম্ভু মনুর কন্যা দেবাহুতিকে বিবাহ করেছিলেন।[12] তাদের দশটি সন্তান ছিল; এক পুত্র এবং নয়টি কন্যা। পুত্রের নাম মহর্ষি কপিল (বিষ্ণুর অবতার)। অনসূয়া সেই নয় কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় এবং অন্যতম ছিলেন।[12] অন্য কন্যারা হলেন: কালা, শ্রদ্ধা, মানিনী (হাবির্ভূ নামেও পরিচিতা), গীতা, ক্রিয়া, খ্যাতি, অরুন্ধতী এবং শান্তি। কন্যাদের বিবাহ হয়েছিল যথাক্রমে ঋষি মরীচি, অঙ্গীরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ এবং অথর্বের সাথে।[14] অনসূয়ার বিবাহ হয়েছিল মহর্ষি অত্রির সাথে।[3][15]
ঋষি নারদ তার স্তোত্র এবং শ্লোকে অনসূয়ার প্রশংসা করেছিলেন। সেই কারণে লক্ষ্মী পার্বতী এবং সরস্বতী অনসূয়ার কাছ থেকে পাতিব্রত্য শিখতে চেয়েছিলেন। তারা তাদের পতিদের অনুরোধ করেছিলেন অনসূয়ার কাছে গিয়ে তার অনুমতি নিয়ে আসতে, যাতে তারা মানবীরূপে তার কাছে যেতে পারেন। ত্রিদেব ঋষির ছদ্মবেশে অনসূয়ার কাছে গেলেন এবং সেখানে ভিক্ষার মাধ্যমে পত্নীদের জন্য অনুমতি চাইলেন। অনসূয়া যখন তাদের পরিচর্যা করতে গেলেন, তখন তার চোখের মাতৃসুলভ ভালবাসা দেবতাদের ছয় মাস বয়সী শিশুতে পরিণত করল। এরপরে অনেক দিন কেটে গেল, তিন দেবী পতিদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু যখন দেবতারা ফিরলেন না, তারা অনসূয়ার কুটিরে গিয়ে দেখেন দেবতারা শিশুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। দেবীগণ অনসূয়াকে অনুরোধ করেছিলেন, তাদের পতিদের স্বাভাবিক করে তোলার জন্য। একটি কথন অনুযায়ী, দেবতারা মিশে গিয়ে অনসূয়ার ত্রিমস্তকধারী পুত্রে রূপান্তরিত হলেন।[2][3][7]
পৈঠান অঞ্চলের কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণ পুরুষ ঘরে একনিষ্ঠ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, এক যৌনকর্মীর কাছে আসতেন। পরে যখন তিনি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন, পতিতা তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হন, তার স্ত্রী তখনও তার প্রতি যত্নশীল এবং নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। কৌশিক তখনও সেই পতিতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং একদিন তিনি নিজের পত্নীকে সেই পতিতার কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। সেই শহরে, ঋষি মাণ্ডব্যকে একজন অপরাধীর পরিবর্তে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং বনে একটি সূচ্যগ্র বস্তুর উপর তিনি শুয়ে ছিলেন। রাতে পত্নীর সঙ্গে গভীর বনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় কৌশিক ঋষির শরীরে হোঁচট খেয়ে পড়েন। ঋষি তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সূর্যোদয়ের আগেই তার মৃত্যু ঘটবে। অভিশাপ আটকাতে, কৌশিকের পত্নী নিজের ভালবাসার শক্তিতে সূর্যোদয় হতে দেননি, এর ফলে স্বর্গে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। দেবতারা সাহায্য প্রার্থনা করে ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন। ব্রহ্মা তখন অনসূয়ার কাছে গিয়েছিলেন এবং কৌশিকের স্ত্রীকে বোঝাতে বলেছিলেন, যাতে তিনি সূর্যোদয়ের অনুমতি দেন। অনসূয়া কেবলমাত্র কৌশিকের স্ত্রীকে বুঝিয়ে সূর্যোদয় ঘটিয়েছিলেন তাই নয়, ঋষির অভিশাপ অনুযায়ী কৌশিকের মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। ব্রহ্মা অনসূয়ার প্রতি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং পরে তার গর্ভে চন্দ্রাত্রি হয়ে জন্ম নেন।[3]
কিছু সময় পরে, রাহু সূর্যকে গলাধঃকরণ করে, এর ফলে সারা পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যায়। বহু বছরের কঠোর তপস্যার ফলে অত্রি এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, সেই ক্ষমতার বলে তিনি রাহুর কবল থেকে সূর্যকে মুক্ত করেছিলেন। ফলে বিশ্ব পুনরায় আলোকিত হয়েছিল। দেবতারা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, শিব ও বিষ্ণু যথাক্রমে দুর্বাসা ও দত্তাত্রেয় রূপে অত্রি এবং অনসূয়ার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।[3]
অন্য এক কিংবদন্তি অনুসারে, অত্রি কুলা পর্বতমালায় এক ভয়ংকর তপস্যা করেছিলেন। ফলে পুরো বিশ্বে আগুন ধরে গিয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তার এই সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বর প্রদান করতে চেয়েছিলেন। অত্রি বরদান হিসেবে তাদের অনুরোধ করেন তার সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে। ব্রহ্মপুরাণ অনুসারে, অত্রি তিন পুত্র এবং এক কন্যা, শুভাত্রেয়ীর জন্য অনুরোধ করেছিলেন।[3]
দেবী অনসূয়ার আশ্রম চিত্রকূটে অবস্থিত।[12] এটি মন্দাকিনী নদীর উজানে, শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার (৯.৯ মা) দূরে, ঘন অরণ্যের মাঝে অবস্থিত। এখানে সারাদিন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে। এখানেই ঋষি অত্রি, তার স্ত্রী অনসূয়া এবং তাদের তিন পুত্র (যারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের তিন অবতার ছিলেন) বাস করতেন এবং কথনে বলা হয়, তপস্যা করতেন।[3][12]
আদিকবি বাল্মীকি তার রামায়ণে লিখেছেন যে, এক সময় চিত্রকূটে দশ বছর যাবৎ বৃষ্টি হয়নি। সেখানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, এবং প্রাণী ও পাখিদের খাওয়া ও পান করার মত কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। সতী অনসূয়া কঠোর ও নিবিড় তপস্যা করেন এবং মন্দাকিনী নদীকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনেন।[11] মন্দাকিনীর জলধারায় সবুজ ও বনভূমি পুনর্জীবিত হয়েছিল এবং সকল ঋষি ও প্রাণীজগতের দুর্গতি নিবারণ হয়েছিল।[3][12][16]
সতী অনসূয়ার আশ্রমটি, বর্তমানে এক অত্যন্ত শান্ত জায়গায় অবস্থিত। এখানে পাহাড়ের বিভিন্ন স্রোত একত্রিত হয়ে মন্দাকিনী নদী গঠন করেছে। কথিত আছে যে রাম ও সীতা মহর্ষি অত্রি এবং সতী অনসূয়ার সাথে দেখা করতে এই স্থানটি পরিদর্শন করেছিলেন। এখানেই সতী অনসূয়া সীতাকে সতীত্বের মহিমা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। ঘন দণ্ডক অরণ্য এই জায়গা থেকেই শুরু হয়। এই অঞ্চল রাবণের শাসনাধীন ছিল। রাবণ খর এবং বিরাধের মতো শক্তিশালী রাক্ষসকে এর শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। রাক্ষসদের অত্যাচারে স্থানটিতে সন্ত্রাসপূর্ণ হয়ে থাকত।[3][17]
অনসূয়ার কাহিনী নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৩৬ সালে তেলুগু ভাষায় অনসূয়া নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন চিত্তজালু পুলায়া।[18] পরবর্তীকালে সতী অনসূয়া শিরোনামে ১৯৫৭ এবং ১৯৭১ সালে দুটি চলচ্চিত্র তেলুগু ভাষায় নির্মিত হয়েছিল।[3] ১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন কাদেরু নাগভূষণম।[19] এটিতে অঞ্জলি দেবী এবং গুম্মাদি ভেঙ্কটেশ্বর রাও অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭১ সালের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন বি. এ. সুব্বা রাও।[20] যমুনা রামনারাও অনসূয়ার চরিত্রে, শারদা সুমতির চরিত্রে এবং তাদপল্লী লক্ষ্মী কান্ত রাও মহর্ষি অত্রির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রটির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পি. আদিনারায়ণ রাও।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.