Loading AI tools
দ্বিতীয় ইসলামী খিলাফত (৬৬১-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
উমাইয়া সাম্রাজ্য (আরবি: الأموية, trans.আল-উমাইয়া) ইসলামের খেলাফত ধংশের পর গড়ে ওঠা প্রথম সাম্রাজ্য।(আবু দাউদ ৪৬৪৬,তিরমিজি ২২২৬) এটি উমাইয়া রাজবংশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান খিলাফত লাভের মাধ্যমে উমাইয়া পরিবার প্রথম ক্ষমতায় আসে। তবে উমাইয়া বংশের শাসন মুয়াবিয়া কর্তৃক সূচিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। ফলে সিরিয়া উমাইয়াদের ক্ষমতার ভিত্তি হয়ে উঠে এবং দামেস্ক তাদের রাজধানী হয়। উমাইয়ারা মুসলিমদের বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখে। ককেসাস, ট্রান্সঅক্সানিয়া, সিন্ধু, মাগরেব ও ইবেরিয়ান উপদ্বীপ (আন্দালুস) জয় করে মুসলমান বিশ্বের আওতাধীন করা হয়। সীমার সর্বোচ্চে পৌছালে উমাইয়া খিলাফত মোট ৫.৭৯ মিলিয়ন বর্গ মাইল (১,৫০,০০,০০০ বর্গ কি.মি.) অঞ্চল অধিকার করে রাখে। তখন পর্যন্ত বিশ্বের দেখা সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে এটি সর্ববৃহৎ ছিল। অস্তিত্বের সময়কালের দিক থেকে এটি ছিল পঞ্চম।[5]
উমাইয়া সাম্রাজ্য الأموية আল-‘উমাউইয়াহ্ (আরবি) | |||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
৬৬১–৭৫০ | |||||||||||||||
পতাকা | |||||||||||||||
উমাইয়া সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সীমা | |||||||||||||||
অবস্থা | সাম্রাজ্য | ||||||||||||||
রাজধানী | দামেস্ক (৬৬১–৭৪৪) হারান (৭৪৪–৭৫০) | ||||||||||||||
নির্বাসনে রাজধানী | কর্ডোবা (৭৫৬–১০৩১) | ||||||||||||||
প্রচলিত ভাষা | আরবি (সরকারি ভাষা) – কিবতি, গ্রীক, ফারসি (আবদুল মালিকের শাসন পর্যন্ত কিছু অঞ্চলের সরকারি ভাষা) – আরামায়িক, আর্মেনীয়, বার্বার, আফ্রিকান রোমান, জর্জিয়ান, হিব্রু, তুর্কি, কুর্দি | ||||||||||||||
ধর্ম | ইসলাম | ||||||||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||||||||
বাদশা | |||||||||||||||
• ৬৬১–৬৮০ | প্রথম মুয়াবিয়া | ||||||||||||||
• ৭৪৪–৭৫০ | দ্বিতীয় মারওয়ান | ||||||||||||||
ইতিহাস | |||||||||||||||
• মুয়াবিয়ার খিলাফত দখল | ৬৬১ | ||||||||||||||
৭৫০ | |||||||||||||||
আয়তন | |||||||||||||||
৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ (১৩২ হিজরি) | ১,৫০,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৫৮,০০,০০০ বর্গমাইল) | ||||||||||||||
জনসংখ্যা | |||||||||||||||
• ৭ম শতাব্দী | 34000000 | ||||||||||||||
মুদ্রা | স্বর্ণ দিনার ও দিরহাম | ||||||||||||||
| |||||||||||||||
বর্তমানে যার অংশ | তালিকা
|
কিছু মুসলিমের কাছে উমাইয়াদের কর সংগ্রহ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনৈতিক ঠেকে। অমুসলিম জনগণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত এবং তাদের বিচারিক কার্যক্রম তাদের নিজস্ব আইন ও ধর্মীয় প্রধান বা নিজেদের নিযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা চালিত হত।[6] তাদের কেন্দ্রীয় সরকারকে জিজিয়া কর দিতে হত।[6] বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবদ্দশায় বলেন যে প্রত্যের ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মপালন করবে ও নিজেদের শাসন করতে পারবে। এ নীতি পরবর্তীতেও বহাল থাকে।[6] হযরত উমর ফারুক (রা.) কর্তৃক চালু হওয়া মুসলিম ও অমুসলিমদের জন্য কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলতে থাকে।[6][6] হযরত আমির মুয়াবিয়া (রাঃ) এর স্ত্রী মায়সুম (এজিদের মা) ছিলেন একজন খ্রিষ্টান। রাষ্ট্রে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল। উমাইয়ারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে ধারাবাহিক যুদ্ধে জড়িত ছিল।[6][6][6] গুরুত্বপূর্ণ পদে খ্রিষ্টানদের বসানো হয় যাদের মধ্যে কারো কারো পরিবার বাইজেন্টাইন সরকারে কাজ করেছিল। খ্রিষ্টানদের নিয়োগ অধিকৃত অঞ্চলে বিশেষত সিরিয়ার বিশাল খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর প্রতি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ নীতি জনগণের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয় এবং সিরিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে স্থিতিশীল করে তোলে।[7][8]
আরব গোত্রগুলোর মধ্যকার বিরোধের কারণে সিরিয়ার বাইরের প্রদেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিশেষত দ্বিতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধ (৬৮০-৬৯২) ও বার্বার বিদ্রোহের (৭৪০-৭৪৩) সময়। দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের সময় উমাইয়া গোত্রের নেতৃত্ব সুফয়ানি শাখা থেকে মারওয়ানি শাখার হস্তান্তর হয়। ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সম্পদ ও লোকবল কমে আসায় তৃতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্তভাবে আব্বাসীয় বিপ্লবের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়। পরিবারের একটি শাখা উত্তর আফ্রিকা হয়ে আন্দালুস চলে যায় এবং সেখানে উমাইয়া সাম্রাজ্য (আন্দালুস) প্রতিষ্ঠা করে। এ খিলাফত ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল এবং আন্দালুসের ফিতনার পর এর পতন হয়।
উমাইয়া পরিবার (বনু আবদ শামস নামেও পরিচিত) ও মুহাম্মদ (সা.) উভয়েই আবদ মানাফ ইবনে কুসাইয়ের বংশধর এবং তারা মক্কার অধিবাসী ছিলেন। আবদ মানাফের পুত্র হাশিমের বংশে মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে উমাইয়ারা আবদ মানাফের আরেক পুত্র আবদ শামশের বংশধর। উমাইয়া আবদ শামসের পুত্রের নাম। দুই পরিবার নিজেদের একই বংশ কুরাইশের দুটি ভিন্ন গোত্র হিসেবে বিবেচনা করত (যথাক্রমে হাশিম ও উমাইয়া)। শিয়াদের মতে উমাইয়া আবদ শামসের পালক পুত্র তাই তার সাথে আবদ শামসের কোনো রক্ত সম্পর্ক নেই। উমাইয়ারা পরবর্তীতে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সম্মান হারায়।[9]
উমাইয়া ও হাশিমিদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা.) এর আসার পূর্ব থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল। বদরের যুদ্ধের পর তা আরো বিরূপ অবস্থায় পড়ে। এ যুদ্ধে উমাইয়া গোত্রের তিনজন শীর্ষ নেতা উতবা ইবনে রাবিয়াহ, ওয়ালিদ ইবনে উতবাহ ও শায়বা দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় হাশিমি গোত্রের আলি ইবন আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও উবাইদাহ ইবনুল হারিসের হাতে নিহত হয়।[10] এ ঘটনার ফলে উমাইয়ার নাতি আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলামের প্রতি বিরোধিতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। বদর যুদ্ধের একবছর পর আবু সুফিয়ান আরেকটি যুদ্ধ মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিয়ে মদিনার মুসলিমদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলেন। পন্ডিতদের মতে এই যুদ্ধটি মুসলিমদের প্রথম পরাজয় যেহেতু এখানে মক্কার তুলনায় মুসলিমদের ভালো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও উতবা ইবনে রাবিয়ার মেয়ে হিন্দ হামজার লাশ কেটে তার কলিজা বের করে খাওয়ার চেষ্টা করে।[11] উহুদের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পাঁচ বছর পর মুহাম্মাদ (সা.) মক্কা বিজয় করেন[12] এবং সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের পর আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। এসময় তাদের পুত্র ও পরবর্তী খলিফা মুয়াবিয়াও ইসলাম গ্রহণ করেন।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে খলিফা মুয়াবিয়া (শাসনকাল ৬৬১-৬৮০) রাজবংশীয় কায়দার প্রথম শাসক হলেও তিনি উমাইয়া রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক। উমাইয়া গোত্রের সদস্য উসমান ইবনে আফ্ফানের খিলাফতের সময় উমাইয়া গোত্র ক্ষমতায় আসে। উসমান তার গোত্রের কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন উসমানের শীর্ষ পর্যায়ের উপদেষ্টা মারওয়ান ইবনুল হাকাম যিনি সম্পর্কে উসমানের তুতো ভাই ছিলেন। তার কারণে হাশিমি সাহাবিদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরী হয় কারণ মারওয়ান ও তার পিতা আল-হাকাম ইবনে আবুল আসকে মুহাম্মাদ (সা.) মদিনা থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছিলেন। উসমান কুফার গভর্নর হিসেবে তার সৎ ভাই ওয়ালিদ ইবনে উকবাকে নিযুক্ত করেন। হাশিমিরা তার প্রতি অভিযোগ করে যে তিনি মদপান করে নামাজের ইমামতি করেছিলেন।[13] উসমান মুয়াবিয়াকে বিশাল এলাকার কর্তৃত্ব দিয়ে সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে তার অবস্থান সংহত করেন[14] এবং তার পালক ভাই আবদুল্লাহ ইবনে সাদকে মিশরের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। উসমান নিজের কোনো উত্তরসুরি মনোনীত করে যাননি তাই তাকে রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় না।
৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে প্রথম মুয়াবিয়া সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। এসময় আরো ২৫,০০০ মানুষ প্লেগে মারা যায়।[15][16] আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধের সময় সমুদ্রের দিক থেকে বাইজেন্টাইন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়া মনোফিসিট খ্রিষ্টান, কপ্ট ও জেকোবাইট সিরিয়ান খ্রিষ্টান নাবিক ও মুসলিম সৈনিকদের নিয়ে একট নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। ৬৫৫ তে মাস্তুলের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন নৌবাহিনী পরাজিত হয় এবং ভূমধ্যসাগরের দিক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।[17][18][19][20][21]
প্রথম মুয়াবিয়া একজন সফল গভর্নর ছিলেন। তিনি সাবেক রোমান সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি অনুগত ও নিয়মানুবর্তী বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি আমর ইবনুল আসের বন্ধু ছিলেন। আমর ইবনুল আস মিশর জয় করেন ও পরবর্তীকালে খলিফা তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন।
কুরআনে ও মুহাম্মাদ (সা.) এর হাদিসে জাতিগত সমতা ও ন্যায়বিচারের ব্যাপারে উল্লেখ করা আছে এবং বিদায় হজ্জের ভাষণেও তিনি একথা বলেন।[22][23][24][25][26][27][28] গোত্রীয় ও জাতিভিত্তিক পার্থক্যকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যুর পর পুরনো গোত্রীয় ভেদাভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রোমান-পারসিয়ান যুদ্ধ ও বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের পর পূর্বে সাসানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক শাসিত ইরাক ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য কর্তৃক সিরিয়ার মধ্যকার বিরোধ তখনও বহাল ছিল। প্রত্যেকেই নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী নিজেদের অঞ্চলে পেতে আগ্রহী ছিল।[29] পূর্ববর্তী খলিফা উমর গভর্নরদের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন এবং তার গোয়েন্দারা তাদের উপর নজর রাখত। গভর্নর বা কমান্ডাররা সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠছে এমন প্রতীয়মান হলে তিনি তাদেরকে তাদের অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতেন।[30]
প্রথমদিকের মুসলিম সেনারা শহর থেকে দূরে নিজস্ব ক্যাম্পে অবস্থান করত। উমরের ভয় ছিল যে তারা হয়ত সম্পদ ও বিলাসিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে এবং এর ফলে তারা আল্লাহর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে এবং সম্পদ গড়ে তুলতে পারে ও রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।[31][32][33][34] উসমান ইবন আফ্ফান যখন খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়েন প্রথম মুয়াবিয়ার আত্মীয় প্রথম মারওয়ান তার সচিব হিসেবে শূণ্যস্থান পূরণ করেন এবং এসব কঠোর নিয়মে শিথিলতা আনেন। মারওয়ানকে ইতিপূর্বে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কিছু মিশরীয়কে খলিফা উসমানের বাসগৃহ দেখিয়ে দেন। পরে এই মিশরীয়রা খলিফা উসমানকে হত্যা করে।[35]
উসমানের হত্যাকান্ডের পর আলি খলিফা নির্বাচিত হন। তাকে এরপর বেশ কিছু সমস্যা সামাল দিতে হয়। আলি মদিনা থেকে কুফায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। ৬৫৬ থেকে ৬৬১ পর্যন্ত চলমান সংঘাতকে প্রথম ফিতনা (“গৃহযুদ্ধ”) বলে ডাকা হয়। সিরিয়ার গভর্নর ও খলিফা উসমানের আত্মীয় মুয়াবিয়া চাইছিলেন যে হত্যাকারীদের যাতে গ্রেপ্তার করা হয়। মারওয়ান সবাইকে প্ররোচিত করেন এবং সংঘাত সৃষ্টি করেন। মুহাম্মাদ (সা.) এর স্ত্রী আয়িশা এবং তার দুই সাহাবি তালহা ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম দোষীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আলিকে বলতে বসরা যান। মারওয়ান ও অন্যান্য যারা সংঘাত চাইছিল তারা সবাইকে লড়াই করতে প্ররোচিত করে। উটের যুদ্ধে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই হয়। এ যুদ্ধে আলি বিজয় অর্জন করেন।
এ যুদ্ধের পর আলি ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সিফফিনের যুদ্ধ হয়। কোনো এক পক্ষে বিজয়ী হওয়ার আগেই যুদ্ধ থেমে যায় এবং দুপক্ষে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে একমত হয়। যুদ্ধের পর আমর ইবনুল আস মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে ও আবু মুসা আশয়ারি আলির পক্ষ থেকে আলোচক নিযুক্ত হন। সাত মাস পর ৬৫৮ এর ফেব্রুয়ারিতে আধরুহ নামক স্থানে সাক্ষাত করেন। আমর ইবনুল আস আবু মুসা আশয়ারিকে এ মর্মে রাজি করান যে দুপক্ষই লড়াই বন্ধ করবে এবং একজন নতুন খলিফা নিযুক্ত করা হবে। আলি ও তার সমর্থকরা এ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে যান। এ ঘটনা মুয়াবিয়ার কাছে খলিফার মর্যাদা কমানোর সমতুল্য ছিল। আলি এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানালেও মীমাংসা মেনে নেয়ার ব্যাপারে নিজেকে বাধ্য অবস্থায় দেখতে পান। এর ফলে আলির অবস্থান তার নিজের সমর্থকদের মধ্যেও দুর্বল হয়ে পড়ে। আলির সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে চাপ সৃষ্টিকারীরা ছিল সবচেয়ে কঠোর প্রতিবাদকারী। তারা আলির বাহিনী থেকে বের হয়ে যায় এবং “একমাত্র আল্লাহর প্রতি” স্লোগান দিতে থাকে। এ দল খারিজি নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে আলি ও খারিজিরা মুখোমুখি হয়। আলি যুদ্ধে জয়ী হলেও ক্রমাগত সংঘর্ষ তার অবস্থানের উপর প্রভাব ফেলছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে কিছু সিরিয়ান মুয়াবিয়াকে বিদ্রোহী খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে।[36]
৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে আলি একজন খারিজির হাতে নিহত হন। সে বছর ছয় মাস পর হাসান ইবনে আলি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মুয়াবিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। হাসান-মুয়াবিয়া চুক্তি মোতাবেক হাসান মুয়াবিয়াকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এ শর্তে যে তিনি জনগণের প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করবেন, তাদের নিরাপদ রাখবেন এবং নিজের মৃত্যুর পর কোনো রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করবেন না।[37][38] এ ঘটনার ফলে খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসনের অবসান হয়। এরপর মুয়াবিয়া চুক্তির বাইরে গিয়ে উমাইয়া রাজবংশের সূচনা করেন এবং দামেস্কে রাজধানী স্থাপন করেন।[39]
৬৮০ তে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে পুনরায় সংঘাত শুরু হয় যা দ্বিতীয় ফিতনা নামে পরিচিত।[40] ব্যাপক লড়াইয়ের পর উমাইয়া রাজবংশ প্রথম মারওয়ানের হাতে এসে পড়ে।
৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত সিরিয়ে উমাইয়াদের খলিফার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তবে উমাইয়ারা কর্ডোবাতে (আল আন্দালুস, বর্তমান পর্তুগাল ও স্পেন) আমিরাত হিসেবে ও পরবর্তীকালে খিলাফত হিসেবে ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসন পরবর্তী ৫০০ বছর বিভিন্ন রূপে টিকে ছিল যেমন, তাইফা, বার্বার রাজ্য ও গ্রানাডা রাজ্য।
৭১২ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ইন্দুজ নদীসহ সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল জয় করেন। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের জয় উমাইয়া খিলাফতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিজয় ছিল। রাজস্থানের যুদ্ধের পর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া থেমে যায়। আরবরা ভারত আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু উত্তর ভারতের রাজা নাগাভাতা ও দক্ষিণ ভারতের সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাদের পরাজিত করেন। আরব লেখকদের ভাষ্যমতে এরপর খলিফা মাহদি ভারত বিজয়ের পরিকল্পনা বাদ দেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে এবং বিশেষত ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে ইবেরিয়ার তাইফা পদ্ধতির আওতায় গ্রানাডা আমিরাত স্বাধীনতা বজায় রাখে। উত্তরের খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোকে কর প্রদানের মাধ্যমে তারা টিকে ছিল। ১০৩১ থেকে তারা দক্ষিণে বিস্তৃত হতে শুরু করে।
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি কর্ডোবার নাসরি রাজ্যের পতনের মাধ্যমে ইবেরিয়ায় মুসলিম শাসনের সমাপ্তি হয়। গ্রানাডার শেষ মুসলিম শাসক দ্বাদশ মুহাম্মদ যিনি বোয়াবদিল নামে পরিচিত, আরাগনের রাজা দ্বিতীয় ফার্ডিনেন্ড ও কাস্টিলের রানি প্রথম ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মুয়াবিয়ার রাজবংশ “সুফিয়ানি” (আবু সুফিয়ানের বংশধর) ৬৬১ থেকে ৬৮৪ পর্যন্ত শাসন করে। মুয়াবিয়ার শাসনকালকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বাহ্যিক বিস্তৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাম্রাজ্যের ভেতরে শুধু একটি বিদ্রোহের রেকর্ড আছে। হুজর ইবনে আদি কুফ্যার এই বিদ্রোহ করেন। হুজর ইবনে আদি নিজের আলির বংশধরদের খিলাফতের দাবিদার বলে সমর্থন জানান। কিন্তু ইরাকের গভর্নর জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান তার আন্দোলন সহজেই দমন করেন।
মুয়াবিয়া সিরিয়ার খ্রিষ্টানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে উৎসাহিত করেন[41] এবং তার একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন জন অব ডেমাস্কাসের পিতা সারজুন। একই সময় তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যান। তার শাসনামলে রোডস ও ক্রিট অধিকৃত হয় এবং কনস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু আক্রমণ পরিচালিত হয়। ব্যর্থ হওয়ার পর এবং বড় ধরনের খ্রিষ্টান উত্থানের ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি বাইজেন্টাইনদের সাথে শান্তি অবস্থায় আসেন। মুয়াবিয়া উত্তর আফ্রিকা (কাইরাওয়ানের প্রতিষ্ঠা) ও মধ্য এশিয়া (কাবুল, বুখারা ও সমরকন্দ জয়) সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম ইয়াজিদ তার উত্তরাধিকারি হন। অনেক নামকরা মুসলিম ইয়াজিদের ক্ষমতালাভের বিরোধী ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুহাম্মদ (সা) এর এক সাহাবির ছেলে আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের ও চতুর্থ খলিফার পুত্র হুসাইন ইবনে আলি। ফলশ্রুতিতে ঘটে যাওয়া সংঘাত দ্বিতীয় ফিতনা বলে পরিচিত।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের মক্কার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করেন। ইয়াজিদের বিপক্ষে হুসাইনের অবস্থানের কথা শুনে কুফার জনগণ হুসাইনের কাছে তাদের সমর্থন নেয়ার জন্য আবেদন জানায়। হুসাইন তার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পাঠান। এ খবর ইয়াজিদের কাছে পৌছলে তিনি বসরার শাসক উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার জনগণকে হুসাইনের নেতৃত্বে সমবেত হওয়া থেকে নিবৃত্ত করার দায়িত্ব দেন। উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিম বিন আকিলের পাশে থাকে জনতাকে প্রতিহত করতে সক্ষম এবং তাকে গ্রেপ্তার করেন। উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের উপর হুসাইনকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শুনে মুসলিম বিন আকিল তাকে অনুরোধ করেন যাতে হুসাইনকে কুফায় না আসার ব্যাপারে জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করেন। আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের আমৃত্যু মক্কায় থেকে যান। পরে তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন ৷ হুসাইন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার পরিবারসহ কুফায় যাবেন। সমর্থনের অভাবের বিষয়ে তার এসময় জানা ছিল না। হুসাইন ও তার পরিবারকে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী রুখে দেয়। এসময় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আমরু বিন সাদ, শামার বিন জিয়ালজোশান ও হুসাইন বিন তামিম। তারা হুসাইন ও তার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সাথে লড়াই করে হত্যা করে। হুসাইনের দলে ২০০ জন মানুষ ছিল যাদের অধিকাংশ ছিল নারী। এদের মধ্যে হুসাইনের বোন, স্ত্রী, মেয়ে ও তাদের সন্তানরা ছিল। নারী ও শিশুদেরকে যুদ্ধবন্ধী হিসেবে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। হুসাইনের মৃত্যু ও তার পরিবারের বন্দী হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে জনগণের সমর্থন তার দিক থেকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বন্দী করে রাখা হয়। এরপর তাদের মদিনা ফিরে যেতে দেয়া হয়। বেঁচে যাওয়া একমাত্র পুরুষ সদস্য ছিলেন আলি ইবনে হুসাইন জয়নুল আবেদিন। অসুস্থতার কারণে কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার সময় তিনি লড়াই করতে পারেননি।[42]
মক্কায় অবস্থান করলেও হুসাইনের মৃত্যুর পর আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের আরো দুটি প্রতিপক্ষ দলের সাথে যুক্ত হন। এর একটি মদিনা ও অন্যটি বসরা ও আরবের খারিজিরা সংঘটিত করে। মদিনা ছিল হুসাইনসহ মুহাম্মদ(সা) ও তার পরিবারের বাসস্থান, তার মৃত্যু ও পরিবারের বন্দী হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিরাট আকারে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি হয়। ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াজিদ আন্দোলন দমন করতে সেনাবাহিনী পাঠান। হাররাহর যুদ্ধে সেনারা মদিনার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে। মদিনার মসজিদে নববী ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইয়াজিদের সেনারা এগিয়ে গিয়ে মক্কা অবরোধ করে। অবরোধের এক পর্যায়ে আগুনে কাবার ক্ষতি হয়। কাবা ও মসজিদে নববীর ক্ষতিসাধনের ঘটনা পরবর্তী ইতিহাসবিদদের কাছে বেশ সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
অবরোধ চলার সময় ইয়াজিদ মৃত্যুবরণ করেন এবং উমাইয়া সেনারা দামেস্কে ফিরে আসে। আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের মক্কার নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। তিনি নিজেকে সাধীন খলিফা ঘোষণা করেন ৷ ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া (শাসনকাল ৬৮৩-৮৪) তার উত্তরসুরি হন কিন্তু সিরিয়ার বাইরে খলিফা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন না। তার মৃত্যুর পর তার ভাই খালিদ সিংহাসনে আরোহন করলেও তিনি নাবালক থাকায় মারওয়ানের কাছে খমতা হস্তান্তর করলে সুফিয়ানি বংশের পতন ঘটে৷ সিরিয়ার ভেতর দুটি দল তৈরী হয়, একটি হল কায়সদের দল, এরা আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরকে সমর্থন করত, আরেকটি হল কুদাদের দল যারা প্রথম মারওয়ানকে সমর্থন করত। মারওয়ানের সমর্থকরা মারজ রাহিতের যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং ৬৮৪ তে মারওয়ান খলিফার পদে আরোহণ করেন।
মারওয়ানের প্রথম কাজ ছিল এসময় ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে খলিফা হিসেবে স্বীকৃত আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরের বিদ্রোহী দলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। মারওয়ান মিশর অধিকার করেন ও নয় মাস শাসন করার পর ৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
মারওয়ানের পর তার পুত্র আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান (শাসনকাল ৬৮৫-৭০৫) খলিফা হন। তিনি খিলাফতের উপর উমাইয়াদের কর্তৃত্ব সংহত করেন। তার শাসনের প্রথমদিকে কুফাভিত্তিক আল-মুখতারের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।তিনি কারবালা হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন ৷ আল-মুখতার আলির আরেক পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়াকে খলিফা হিসেবে দেখতে চাইতেন। তবে বিদ্রোহের সাথে ইবনুল হানাফিয়ার কোনো সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায় না। আল-মুখতারের সেনারা ৬৮৬তে উমাইয়াদের সাথে ও ৬৮৭তে আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরের সেনাদের সাথে লড়াই করে এবং পরাজিত হয়। পরে তিনি শহিদ হন ৷ ফলে তার বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া সেনারা পুনরায় ইরাক অধিকার করে৷ ও ৬৯২ সালে মক্কা দখল করে। আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের হামলায় নিহত হন।
আবদুল মালিকের শাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রক নির্মাণ। লিখিত দলিলে অস্পষ্টতা থাকলেও সম্পূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়েছে বলে ধরা হয়। অর্থাৎ এটি আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়েরের সংঘর্ষের সময় নির্মাণ করা হয়েছিল।
আবদুল মালিককে প্রশাসনকে কেন্দ্রিভুত করা ও আরবিকে সরকারি ভাষা করার কৃতিত্ব দেয়া হয়। তিনি স্বতন্ত্র মুসলিম মুদ্রা চালু করেন। ইতিপূর্বে বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় মুদ্রা ব্যবহার হত। আবদুল মালিক বাইজেন্টানটিয়ামের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। সেবাস্টপলিসের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হয় এবং আর্মেনিয়া ও ককেসিয়ান ইবেরিয়ায় কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্টা করা হয়।
আবদুল মালিকের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম আল ওয়ালিদ (শাসনকাল ৭০৫-১৫) খলিফা হন। আল ওয়ালিদ একজন দক্ষ নির্মাতা ছিলেন। তিনি মসজিদে নববী ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন।
আবদুল মালিক ও আল ওয়ালিদ উভয়ের শাসনের সময়কার একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। অনেক ইরাকি উমাইয়া শাসনের বিরোধি ছিল। শান্তি বজায় রাখার জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিরিয়া সেনাদের ইরাকে নিয়ে আসেন। নতুন গেরিসন শহর ওয়াসিতে তাদের স্থান দেয়া হয়। বিদ্রোহ দমনে এই সেনারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আল ওয়ালিদের পর তার ভাই সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক (শাসনকাল ৭১৫-১৭) খলিফা হন। তার শাসনকালে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করা হয়। অবরোধ ব্যর্থ হলে বাইজেন্টাইন রাজধানী জয়ে আরবদের উৎসাহে ভাটা পড়ে। তবে অষ্টম শতকের প্রথম দুই দশক খিলাফত ক্রমাগতভাবে বিস্তৃত হচ্ছিল যা পশ্চিমে ইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে পূর্বে ট্রান্সঅক্সানিয়া ও উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সুলায়মানের পর তার তুতো ভাই উমর ইবনে আবদুল আজিজ (শাসনকাল ৭১৭-২০) খলিফা হন। উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে তার স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। তিনি একমাত্র উমাইয়া খলিফা যাকে প্রচলিত অর্থে সম্রাট হিসেবে নয় বরং প্রকৃত অর্থে খলিফা বিবেচনা করা হয়।
উমরকে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয়। উমাইয়া শাসনের সময় অধিকাংশ জনতা ছিল খ্রিষ্টান, ইহুদি, জরস্ট্রিয়ান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। তাদেরকে জিজিয়া নামক কর দিতে হত। এ কর মুসলিমদের উপর ছিল না। ফলে রাজস্ব সংগ্রহের দিক থেকে ব্যাপকভাবে ইসলাম গ্রহণ সমস্যার সৃষ্টি করছিল। কিছু বিবরণী থেকে জানা যায় প্রাদেশিক শাসকরা ধর্মান্তরে নিরুৎসাহিত করছিলেন। উমর কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন তা স্পষ্ট না, কিন্তু সুত্র মতে তিনি আরব ও অনারবদের প্রতি একই নীতি অবলম্বন করেন এবং ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা অপসারণ করেন।
উমরের মৃত্যুর পর আবদুল মালিকের আরেক পুত্র দ্বিতীয় ইয়াজিদ (শাসনকাল ৭২০-২৪) খলিফা হন। ইয়াজিদ খিলাফতের সীমানার ভেতরের খ্রিষ্টান ছবি মুছে ফেলার আদেশ দেন। ৭২০ এ ইরাকে ইয়াজিদ ইবনুল মুহাল্লাবের নেতৃত্ব আরেকটি বড় আকারের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
আবদুল মালিকের আরেক পুত্র হিশাম ইবনে আবদুল মালিক (শাসনকাল ৭২৪-৭৪৩) এরপর খলিফা হন। তার দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল শাসনকাল সামরিক অভিযান সংক্ষিপ্তকরণের কারণে চিহ্নিত করা হয়। হিশাম উত্তর সিরিয়ার রিসাফাতে তার দরবার স্থাপন করেন। এটি দামেস্কের চেয়ে বাইজেন্টাইন সীমান্তের বেশি কাছে ছিল। বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পুনরায় শুরু হয় এবং কনস্টান্টিনোপল শেষবার অবরোধ করে ব্যর্থ হওয়ার পর তা শেষ হয়। নতুন অভিযানের মধ্যে ছিল আনাতোলিয়ায় সফল অভিযান। এক্রোইননের যুদ্ধে পরাজয়ের পর আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সীমানা বিস্তৃতি হয়নি।
হিশামের শাসনের সময় ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে টুরসের যুদ্ধে ফ্রেঙ্কদের কাছে আরব সেনাদের পরাজয়ের পর পশ্চিমদিকে সীমানা সম্প্রসারণ সমাপ্ত হয়। ৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় বার্বার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এটিকে খুব কষ্টে দমন করা হয়। ককেসাসে খাজারদের সাথে লড়াই চূড়ান্তে পৌছায়। আরবরা ডেরবেন্টে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরী করে এবং উত্তর ককেসাসে বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালায়। কিন্তু যাযাবর খাজারদের পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। সংঘর্ষ খুবই রক্তাক্ত ছিল। ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে আরব সেনারা আরাদাবিলের যুদ্ধে পরাজিত হয়। মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ, পরবর্তীতে দ্বিতীয় মারওয়ান, ৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে শেষপর্যন্ত অভিযান সমাপ্ত করেন। তারা ভলগা পর্যন্ত পৌছালেও খাজাররা তাদের আওতার বাইরে ছিল।
হিশাম পূর্বদিকেও পরাজয়ের সম্মুখিন হয়। তার সেনারা তোখারিস্তান ও ট্রান্সঅক্সানিয়া জয় করার চেষ্টা করে। দুটি এলাকাই ইতোমধ্যে আংশিকভাবে অধিকৃত হয়। কিন্তু এগুলো শাসন করা কষ্টসাধ্য ছিল। এসময় আরেকবার অনারবদের ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়, বিশেষত ট্রান্সঅক্সানিয়ার সোগডিয়ানদের ক্ষেত্রে। ৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে পিপাসার দিনে উমাইয়াদের পরাজয়ের পর খোরাসানের গভর্নর আশরাস ইবনে আবদুল্লাহ আলসুলামি ইসলামে ধর্মান্তরিত সোগডিয়ানদের কর মওকুফের প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু যখন এ কথা খুবই বেশি জনপ্রিয়তা পায় ও রাজস্বের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রতীয়মানে হয় তখন তিনি তা তুলে নেন। ৭৩১ ডিফাইলের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পর খোরাসানি আরবদের বিরোধ বৃদ্ধি পায়। আলহারিস ইবনে সুরায়জ একটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এবং বলখ অধিকার করেন। তবে মার্ভ অধিকার করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনার পর আলহারিসের কার্যক্রম শেষ হয়ে গিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় কিন্তু অনারব মুসলিমদের অধিকারের প্রশ্নটি উমাইয়াদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি করে।
হিশামের পর দ্বিতীয় ইয়াজিদের পুত্র দ্বিতীয় আল-ওয়ালিদ (শাসনকাল ৭৪৩-৪৪) খলিফা হন। তার ব্যাপারে বলা হয় যে তিনি ধর্মীয় দিকের চেয়ে বরং পার্থিব সুখভোগের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। বিরোধিদের মৃত্যুদন্ড দানে ও কাদারিয়াদের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে দ্রুত তিনি অনেকের শত্রুতে পরিণত হন।
৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ওয়ালিদের এক পুত্র তৃতীয় ইয়াজিদ দামেস্কে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। তার সেনারা দ্বিতীয় আল-ওয়ালিদকে হত্যা করে। তৃতীয় ইয়াজিদ দয়াপ্রদর্শনের জন্য সুনাম অর্জন করেন এবং কাদারিয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। শাসনের ছয় মাসের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইয়াজিদ তার ভাই ইব্রাহিমকে তার উত্তরসুরি মনোনীত করেন। কিন্তু প্রথম মারওয়ানের নাতি দ্বিতীয় মারওয়ান (শাসনকাল ৭৪৪-৫০) উত্তর দিক থেকে একটি সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসেন ও ৭৪৪ এর ডিসেম্বরে দামেস্কে প্রবেশ করেন। এখানে তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। মারওয়ান তাৎক্ষনিকভাবে উত্তরে বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত হারানে তার রাজধানী সরিয়ে নেন। সিরিয়ায় শীঘ্রই বিদ্রোহ দেখা দেয়, সম্ভবত রাজধানী স্থানান্তরের কারণে। ৭৪৬ এ মারওয়ান পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে হিমস ও দামেস্কে চারপাশের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলেন।
ইরাক ও ইরানের খারিজিদের কাছ থেকে মারওয়ান প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। তারা প্রথমে দাহহাক ইবন কায়স আল শায়বানি ও পরে আবু দুলাফকে বিদ্রোহী খলিফা হিসেবে মনোনীত করে। মারওয়ান ইরাকে পুনরায় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন কিন্তু এসময় খোরাসানে আরো বড় হুমকির জন্ম হয়।
আব্বাসীয় পরিবার কর্তৃক পরিচালিত হাশিমিয়া আন্দোলন উমাইয়া খিলাফতকে উৎখাত করে। আব্বাসীয়রা হাশিমি গোত্রের সদস্য ছিল। তবে হাশিমিয়া শব্দটি আলির নাতি ও মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়ার পুত্র আবু হাশিম থেকে এসেছে বলে মনে হয়। কিছু সূত্রমতে আব্বাসীয় পরিবারের প্রধান আবু হাশিম ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি মুহাম্মদ ইবনে আলি তার উত্তরসুরি মনোনীত করে যান। আল-মুখতারের ব্যর্থ বিদ্রোহের সমর্থকদের নিয়ে আব্বাসীয়রা এগিয়ে যায়। তারা নিজেদেরকে মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়ার সমর্থক হিসেবে তুলে ধরে।
৭১৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া হাশিমিয়া কর্মকাণ্ড খোরাসানে অনুগত লোক খুজতে থাকে। তারা মুহাম্মদ এর পরিবারের একজন সদস্যের জন্য সমর্থনের ডাক দেয়। তবে আব্বাসীয়দের কথা বলা হয়নি। এই কার্যক্রম আরব ও অনারব (মাওয়ালি) উভয়ের মধ্যেই সফল হয়। তবে দ্বিতীয় দলটি আন্দোলনের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৭৪৬ এর দিকে আবু মুসলিম খোরাসানে হাশিমিয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কালো পতাকার অধীনে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু করেন। তিনি শীঘ্রই খোরাসানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, এর উমাইয়া গভর্নর নাসর ইবনে সায়ারকে বহিষ্কার করেন এবং পশ্চিমদিকে একটি সেনাবাহিনী পাঠানো হয়। ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কুফা হাশিমিয়াদের হস্তগত হয়। এটি ইরাকে উমাইয়াদের শেষ শক্ত ঘাঁটি ছিল। ওয়াসিতে অবরোধ করা হয় এবং সে বছরের নভেম্বরে আবুল আবাস কুফার মসজিদে খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এর ফলে মারওয়ান তার সেনাদেরকে হারান থেকে ইরাকের দিকে পরিচালিত করেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি দুই বাহিনী জাবের যুদ্ধে মুখোমুখি হয় এবং উমাইয়ারা পরাজিত হয়। এপ্রিলে দামেস্ক আব্বাসীয়দের হাতে এসে পড়ে এবং আগস্টে মারওয়ানকে মিশরে হত্যা করা হয়।
বিজয়ীরা সিরিয়ায় উমাইয়াদের কবরগুলোকে অবমাননা করা শুরু করে। শুধু দ্বিতীয় উমরের কবরের প্রতি কিছু করা হয়নি। উমাইয়া পরিবারের বাকি সদস্যদের অনুসরণ করা হয় ও হত্যা করা হয়। আব্বাসীয়রা উমাইয়া পরিবারের সদস্যদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলে আশিজন ক্ষমা গ্রহণ করতে আসে এবং সবাইকে হত্যা করা হয়। হিশামের একজন নাতি প্রথম আবদুল রহমান বেঁচে যান এবং আল-আন্দালুস রাজ্য স্থাপন করেন এবং কর্ডোবা খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রেভিট-অরটনের মতে উমাইয়াদের পতনের কারণ ছিল ইসলামের দ্রুত প্রসার। উমাইয়া শাসনামলে ব্যাপক মাত্রায় ধর্মান্তরের কারণে পারসিয়ান, বার্বার, কপ্ট ও আরামায়িকরা ইসলাম গ্রহণ করে। এই অনারবরা যারা মাওয়ালি বলে অবিহিত হত, প্রায় সময় তাদের আরব শাসকদের চেয়ে অধিক শিক্ষিত ও মার্জিত হত। নতুন ধর্মান্তরিতদের প্রতি সব মুসলিমের জন্য সমতার নীতির কারণে রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যায়। প্রেভিট-অরটনের এও বলেন যে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যকার জাতিবিদ্বেষের কারণে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।[43]
মুয়াবিয়ার প্রথম কাজ ছিল সাম্রাজ্যের জন্য একটি দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার চালু করা। পূর্ববর্তী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এমন প্রদেশে তিনি পূর্বতন নীতি চালু রাখেন। সরকারকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও সামরিক, কর সংগ্রহ এবং ধর্মীয় প্রশাসন। প্রত্যেকটি শাখা আরো বেশ কিছু শাখা, অফিস ও বিভাগে বিভক্ত ছিল।
সমগ্র সাম্রাজ্যে ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। উমাইয়া শাসনের সময় সীমান্ত বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়। প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর থাকত। প্রদেশের ধর্মীয়, সেনা, পুলিশ ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ প্রাদেশিক গভর্নরের অধীনে কাজ করত। স্থানীয় খরচ প্রদেশের সংগৃহীত কর থেকে মেটানো হত। অতিরিক্ত কর দামেস্কের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হত। পরবর্তী সময় কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিক্ষয় হলে প্রাদেশিক গভর্নররা অতিরিক্ত কর পাঠাতে গড়িমসি করে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে যায়।[44]
সাম্রাজ্যের দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষ আরব কর্মীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে যায়। ফলে মুয়াবিয়া বিজিত অঞ্চলগুলোতে পূর্ববর্তী সরকারি কর্মীদের দায়িত্বে বহাল রাখেন। ফলে স্থানীয় সরকারের অধিকাংশ দলিল গ্রীক, কপ্টিক ও ফার্সিতে লিপিবদ্ধ হত। আবদুল মালিকের সময় নিয়মিতভাবে সমস্ত সরকারি দলিলপত্র আরবিতে লেখা শুরু হয়।[44]
বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যে পূর্ব থেকেই মুদ্রা ব্যবস্থা চালু ছিল। উমাইয়া আমলেও একই ব্যবস্থা বহাল থাকে। আগে থেকে চলা মুদ্রাগুলো চলতে থাকে। তবে এগুলোর উপর কুরআনের আয়াত অঙ্কিত করা হয়। পাশাপাশি উমাইয়া সরকার নিজস্ব মুদ্রা চালু করে। এগুলো পূর্বের মুদ্রাগুলোর মতই ছিল। ইতিহাসে এটিই মুসলিম শাসক কর্তৃক প্রথম নিজস্ব মুদ্রা চালুর ঘটনা। স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হত দিনার ও রৌপ্যমুদ্রাকে বলা হত দিরহাম।[44]
প্রশাসনিক কাজে খলিফাকে সহায়তা করার জন্য কেন্দ্রে ছয়টি দপ্তর ছিল, দিওয়ান আল খারাজ, দিওয়ান আল রাসাইল, দিওয়ান আল খাতাম, দিওয়ান আল বারিদ, দিওয়ান আল কুদাত, দিওয়ান আল জুন্দ।
এই বিভাগ সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা তদারক করত। সেসাথে নতুন করারোপ ও সংগ্রহ ব্যবস্থা করা এ বিভাগের কাজ ছিল।
এ বিভাগের কাজ ছিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অফিসারদের কাছে আদেশ জারি করা। এটি সকল বিভাগের কাজকে সমন্বয় করত এবং প্রধান সচিবালয় হিসেবে কার্যনির্বাহ করত।
রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রের সংরক্ষণের জন্য মুয়াবিয়া এ বিভাগটি সৃষ্টি করেন। স্বাক্ষর ও গন্তব্যে পাঠানোর আগে প্রতিটি দাপ্তরিক নথিপত্রের একটি কপি সংরক্ষণ করে রাখা হত। এর ফলে আবদুল মালিকের সময় দামেস্কে একটি আর্কাইভ গড়ে উঠে। আব্বাসীয় শাসনের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ বিভাগটি টিকে ছিল।
মুয়াবিয়া একটি ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। আবদুল মালিক এটিকে সাম্রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত করেন এবং ওয়ালিদ এর পূর্ণ ব্যবহার করেন। আবদুল মালিক নিয়মিত ডাকবিভাগ গঠন করেন। উমর ইবনে আবদুল আজিজ খোরাসান মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ক্যারাভেনসরাই স্থাপন করে এর উন্নতি সাধন করেন। খলিফার কাছ থেকে প্রদেশের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য সময় ব্যবধানে ঘোড়া বদল করা হত। পুরো মহাসড়ক ১২ মাইল (১৯ কিমি) ব্যবধানের কয়েকটি ধাপে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেকটি ধাপেই ডাক পরিবহনের জন্য ঘোড়া, গাধা ও উট রাখা থাকত। প্রথমদিকে এটি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য চালু করা হলেও পর্যটকরাও এ থেকে উপকৃত হয়। ডাক পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়ার গাড়িগুলো দ্রুত সেনা পাঠানোর কাজেও ব্যবহৃত হত। এগুলো একই সময় ৫০ থেকে ১০০ জন সেনা পরিবহন করতে পারত। গভর্নর ইউসুফ বিন উমরের সময় ইরাকের ডাক বিভাগের জন্য বছরে ৪০,০০,০০০ দিরহাম খরচ হত।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিচারের কাজ মুহাম্মদ ও খলিফারা ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ব্যাপক হওয়ার পর খলিফা উমর পৃথক বিচারবিভাগ চালু করেন এবং ২৩ হিজরি/৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে প্রথম কাজি নিযুক্ত করা হয়। ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের পর উমাইয়া খলিফা হিশাম ও দ্বিতীয় ওয়ালিদের সময় মিশরের বেশ কিছু বিচারক একের পর একজন দায়িত্বপালন করেন।
উমরের সময় আরব ও অন্য জাতিগোষ্ঠীর মুসলিম সৈনিকদের ভাতা প্রদানের নীতি উমাইয়াদের সময় পরিবর্তন হয়। উমাইয়ারা সক্রিয় ভূমিকা না রাখলেও ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা রাখে। হিশাম এ ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে শুধু তাদের ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। বাইজেন্টাইনদের আদলে সেনাবাহিনীকে সংস্কার করা হয় এবং পাঁচটি অংশে বিভক্ত করা হয়, যথাক্রমে, মধ্যভাগ, দুই প্রান্ত, সম্মুখভাগ ও পশ্চাতভাগ। কুচকাওয়াচ বা যুদ্ধক্ষেত্রে একই গঠনবিন্যাস অনুসরণ করা হত। দ্বিতীয় মারওয়ান পুরনো বিভাগ বাতিল করেন এবং নতুন প্রথায় কুরদুস নামক সুসংঘটিত দলের সৃষ্টি করেন। উমাইয়া সেনারা তিনটি ভাগে বিভক্ত থাকত, যথাক্রমে, পদাতিক, অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ। আরব সেনারা গ্রীক কায়দায় পোশাক ও অস্ত্রে সজ্জিত থাকত। উমাইয়া অশ্বারোহীরা সমান ও গোলাকার সেডল ব্যবহার করত। গোলন্দাজরা আরাদাহ (বেলিস্টা), মেনজানিক (মানগোনাল) ও দাবাবাহ বা কাবশ (বেটারিং রেম) ব্যবহার করত। ভারি যন্ত্রপাতি ও মালামাল উটের পিঠে করে সেনাবাহিনীর পিছনে থাকত।
উমাইয়া খিলাফতের সময় প্রধান চারটি সামাজিক শ্রেণী ছিলঃ
মুসলিম আরবরা সমাজের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করত। ইসলামে সকল মুসলিমের সমান অবস্থান থাকলেও আরব মুসলিমরা নিজেদের সমাজের উপরের অবস্থানে রাখে।
মুসলিমদের মধ্যে এ বিভাজন সাম্রাজ্যজুড়ে সমস্যার সৃষ্টি করে। ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্যে অনারব জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আরব মুসলিমদের মত সমান অধিকার না থাকার ফলে নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরী হয়। সে সাথে ধর্মান্তরিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অমুসলিমদের কাছ থেকে সংগৃহিত করের পরিমাণ কমে আসে। ৭৪০ এর দশকে আব্বাসীয় বিপ্লবের আগ পর্যন্ত এ সমস্যা চলতে থাকে।[45]
অমুসলিমদের মধ্যে ছিল খ্রিষ্টান, ইহুদি, জরস্ট্রিয়ান ও পৌত্তলিক বার্বার যাদের জিম্মি বলা হত। মুসলিম শাসনের প্রতি অনুগত থাকার শর্তে তারা তাদের সামাজিক অধিকার ভোগ করত। তাদের নিজস্ব আদালত ছিল এবং সাম্রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল ছিল। সরকারি দপ্তরে সর্বোচ্চ পদ না পীও অনেক অমুসলিম প্রশাসনিক পদে আসীন ছিল। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের মধ্যে এসময় অনেক বড় মাপের ধর্মতাত্ত্বিকের আবির্ভাব হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে ফলে অমুসলিমদের মধ্যে চিন্তাবিদের সংখ্যা কমে যায়।[46]
টেমপ্লেট:History of the Levant উমাইয়া খিলাফতকে সাম্রাজ্য বিস্তার ও এরূপ বিস্তারের ফলে সৃষ্ট প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া উমাইয়ারা নতুন ধর্মান্তরিত মুসলিমদের (মাওয়ালি) তুলনায় পুরনো আরব পরিবারগুলো বেশি সম্মান বজায় রাখতে সচেষ্টা ছিল। ফলে তারা ইসলামের বিশ্বজনীনতা থেকে দূরত্বে অবস্থান করতে থাকে এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহীদের প্রতিও একই আচরণ করে। জি. আর. হাউটিং এর মতে, "ইসলামকে বিজয়ীদের ধর্ম হিসেবে দেখা হত"।[47]
উমাইয়া শাসনের সময় আরবি প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। রাষ্ট্রীয় দলিল ও মুদ্রা আরবিতে জারি করা হত। ব্যাপক মাত্রায় ধর্মান্তরকরণ সমাজে বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যার জন্ম দেয়। উমাইয়ারা জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রক ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ নির্মাণ করে।
পরবর্তী ইসলামি ইতিহাসবিদদের কাছে উমাইয়ারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। তারা উমাইয়াদের প্রকৃত খিলাফতের পরিবর্তে রাজতন্ত্র চালুর জন্য দোষারোপ করেন। তবে আধুনিক আরব জাতীয়তাবাদীরা উমাইয়া শাসনের সময়কে আরবদের স্বর্ণযুগ বলে থাকে। এটি বিশেষত সিরিয়ান জাতীয়তাবাদী ও বর্তমানের সিরিয়া রাষ্ট্রের সাথে মেলে যাদের কেন্দ্র উমাইয়াদের মতই দামেস্ক। প্যান আরব রং হিসেবে যে চারটি রং বিভিন্ন আরব দেশের জাতীয় পতাকায় অঙ্কিত আছে তাকেও উমাইয়াদের প্রতিনিধিত্বশীল ধরা হয়।
সুন্নি পন্ডিতরা একমত যে মুয়াবিয়ার পরিবার ও তার পিতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও তার মা হিন্দ বিনতে উতবা ইসলামের বিরোধী ছিল। মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা বিজয়ের পর তারা মুসলিম হন। আরব অভিজাতদের ভেতর সেসময় উমাইয়ারা বেশ প্রভাব ফেলে এবং চূড়ান্তভাবে রাশিদুন খিলাফত বিলুপ্ত করা হয় এবং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সুন্নি পন্ডিতরা ইসলাম গ্রহণকারী অনারব মুসলিমদের উপর মাওয়ালি প্রথা চালু রাখার জন্য উমাইয়াদের দোষারোপ করেন। শাসক অভিজাত আরবদের কাছে নতুন ইসলাম গ্রহণকারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হত এবং তাদেরকে অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য কর দিতে হত। সে-সাথে তারা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে কাজের সুযোগ পেত না।[48]
মুয়াবিয়ার পরবর্তী অধিকাংশ শাসকের ব্যাপারে সুন্নি পন্ডিতরা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন এবং তাদের মতে তারা উম্মাহকে সংকটে ফেলেছিলেন। ব্যতিক্রমদের মধ্যে অন্যতম হলেন উমর ইবনে আবদুল আজিজ। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর তাকে সবচেয়ে মহৎ খলিফা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি পূর্বসূরিদের অন্যায় নীতি মাওয়ালিদের জিজিয়া কর বিলুপ্ত করেন।
উমাইয়াদের ব্যাপারে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি শিয়া গ্রন্থ “সুলহ আল হাসানে” বর্ণিত করা আছে।[49][50] কিছু সূত্র মতে আলি তাদেরকে সর্বাপেক্ষা খারাপ ফিতনা বলেছেন।[51] উমাইয়া শাসনামলে প্রতিটি মসজিদে জুমার নামাজের খুৎবায় আলির ওপর অভিসম্পাত বর্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল।
টেমপ্লেট:আল আন্দালুসের ইতিহাস
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.