Loading AI tools
পুরীর হিন্দু মন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বিমলা মন্দির হল ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দির চত্বরে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির। এটি দেবী বিমলার মন্দির। হিন্দুরা এই মন্দিরটিকে একটি শক্তিপীঠ (শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র প্রধান তীর্থগুলির অন্যতম) মনে করেন।
বিমলা মন্দির | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
জেলা | পুরী |
অবস্থান | |
অবস্থান | জগন্নাথ মন্দির চত্বর |
রাজ্য | ওড়িশা |
দেশ | ভারত |
স্থাপত্য | |
ধরন | কলিঙ্গ স্থাপত্য (দেউল) |
ওয়েবসাইট | |
http://www.jagannath.nic.in/ |
বিমলা মন্দির জগন্নাথ মন্দির চত্বরের ভিতরের অংশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশেই পবিত্র জলাধার রোহিণীকুণ্ড অবস্থিত। মন্দিরটি পূর্বমুখী এবং বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত। এই মন্দির "দেউল" স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ দেখা যায়: বিমান (গর্ভগৃহ-সংবলিত অংশ), জগমোহন (সভাকক্ষ), নাট-মণ্ডপ (উৎসব কক্ষ) ও ভোগ-মণ্ডপ (ভোগ নিবেদনের কক্ষ)। ২০০৫ সালে মন্দিরটি সংস্কার হয়। বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর শাখা এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
বিমলা মন্দিরটি জগন্নাথ মন্দির চত্বরের একটি ছোটো মন্দির হলেও শাক্ত ও তান্ত্রিকদের কাছে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। তারা মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও এই মন্দিরটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তান্ত্রিক মতে, বিমলা জগন্নাথের শক্তি এবং মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী। ভক্তেরা মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজা করার আগে বিমলাকে পূজা করেন। জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে নিবেদন করার পরেই মহাপ্রসাদ হিসেবে গণ্য হয়। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) উদযাপিত দুর্গাপূজা এই মন্দিরের প্রধান উৎসব।
বিমলার আদিমূর্তিটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত।[1] বর্তমান মন্দিরটি সম্ভবত সম্ভবত খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে আগের মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত হয়েছে।[1][2] জগন্নাথ মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে নির্মিত যে নৃসিংহ মন্দিরটি আছে, তার সঙ্গে বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যগত মিল দেখা যায়।[1] মাদলা পাঁজি অনুসারে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজা প্রথম যযাতি (খ্রিস্টীয় ৯২২–৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রিস্টীয় ১০২৫–১০৪০)–উভয়েই "যযাতি কেশরী" নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী–বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের প্রস্তরখণ্ডটি–সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। এগুলি সম্ভবত সেই প্রথম মন্দিরের অংশ ছিল, যার ধ্বংসাবশেষের উপর বর্তমান মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। এই মন্দিরটিকে মন্দির চত্বরের প্রধান মন্দির জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও পুরনো বলে মনে করা হয়।[2]
মনে করা হয়, হিন্দু দার্শনিক ও সন্ত আদি শঙ্কর (খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী) বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন। দ্য জগন্নাথ টেম্পল অ্যাট পুরী গ্রন্থের লেখক স্টারজার মতে, প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব–এই ত্রিমূর্তি পূজার কেন্দ্র। উক্ত তিন দেবতার শক্তিগণ তথা হিন্দু দেবমণ্ডলীর তিন প্রধান দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও (বিমলার মূর্তিতে) এখানে পূজিত হতেন।[3] খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে শাক্ত শ্রীবিদ্যা-উপাসকদের ভাল প্রভাব ছিল। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম এই মন্দির চত্বরে প্রাধান্য অর্জন করলে শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক প্রভাব কমে যায়। তবে এই প্রভাব একেবারে লুপ্ত হয়নি। তান্ত্রিক "পঞ্চমকার" উপচারের পরিবর্তে মন্দিরে নিরামিষ ভোগ ও দেবদাসী নৃত্যের প্রথা চালু হয়। অবশ্য মাছ ভোগ দেবার প্রথাও প্রচলিত ছিল।[4] রাজা নরসিংহদেব (শাসনকাল ১৬৩২–৪৭ খ্রিষ্টাব্দ) মন্দিরে মাছ ও মাংস ভোগের প্রথা বন্ধ করে দেন।[3] যদিও পরবর্তীকালে এই প্রথা আংশিকভাবে চালু করা হয়েছিল। বর্তমানে, বিশেষ বিশেষ দিনে বিমলাকে মাছ ও মাংস ভোগ দেওয়া হয়।
বিমলা মন্দির জগন্নাথ মন্দির চত্বরের ভিতরের দিকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এবং জগন্নাথের মিনারের পশ্চিম কোণের ডান দিকে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশে রোহিণীকুণ্ড নামে একটি জলাধার রয়েছে। এটিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করেন।[1][2] মন্দিরটি বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত। বিমলা মন্দির "দেউল" স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন। এই মন্দিরের চারটি অংশ দেখা যায়: বিমান (যে অংশে গর্ভগৃহ অবস্থিত), জগমোহন (সভাকক্ষ), নাট-মণ্ডপ (উৎসব কক্ষ) ও ভোগ-মণ্ডপ (ভোগ নিবেদনের কক্ষ)। ২০০৫ সালে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর সার্কেল।
বিমান হল একটি রেখ দেউল (শম্বুকাকার চিনির ডেলার মতো আকৃতিবিশিষ্ট একটি দীর্ঘাকার ভবন)। বিমলা মন্দিরের বিমানটির উচ্চতা ৬০ ফুট (১৮ মি)। এটি ১৫ ফুট (৪.৬ মি) আয়তনের বর্গাকার আকৃতিবিশিষ্ট। মন্দিরটি ২ ফুট (০.৬১ মি) উচ্চতার একটি বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। বেদীটি পদ্ম ও অন্যান্য ফুল পাতা ও অন্যান্য ছবিতে চিত্রিত। বিমানের বাইরের দেওয়ালটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত (ভিত্তি থেকে শীর্ষভাগ পর্যন্ত): "পাভাগ", "তলজঙ্ঘা", "বন্ধন", "উপর জঙ্ঘা" ও "বারান্দা"। দেওয়ালের প্রথম অংশের কুলুঙ্গি ও সংযোগরক্ষাকারী জায়গাগুলিতে "খখর মুন্ডি" (এক ধরনের কুলুঙ্গি), পুথিচিত্র, ফুল-পাতার ছবি, সংগমরত যুগল ও নাগের (সর্প-পুরুষ) ছবি অলংকৃত রয়েছে। দ্বিতীয় অংশের কুলুঙ্গি ও যোগাযোগরক্ষাকারী জায়গাগুলিতে "খখর মুন্ডি", "সিংহবিদল" (একটি সিংহমুখী জন্তু), "গজবিদল" (সিংহ-মর্দনকারী একটি হস্তিমুখী সিংহ), জালিচিত্র, পুথিচিত্র, "শিক্ষাদান" চিত্র (ঋষিগণের উপদেশ দানের দৃশ্য) ও "কীর্তিমুখ" (একটি দানব মুখ) এবং অষ্ট দিকপাল (দিকের দেবতা) ও কয়েকটি দেবীমূর্তি চিত্রিত আছে। বাইরের দেওয়ালের তৃতীয় অংশে দুটি আনুভূমিক তলে "অলসকন্যা" (সুন্দরী নারী), পুথিচিত্র এবং পদ্ম ও অন্যান্য ফুলের মোটিফ খোদাই করা আছে। চতুর্থ অংশের কুলুঙ্গি ও সংযোগরক্ষাকারী জায়গায় "পীঢ়া-মুন্ডি" (এক ধরনের কুলুঙ্গি), "সিংহবিদল", কামোদ্দীপক দৃশ্যাবলি, "অলসকন্যা", পুথিচিত্র, জালিচিত্র, ফুলের নকশা এবং দিকপালদের স্ত্রী, নাগ ও তাদের স্ত্রী নাগিনীগণ সহ অন্যান্য দেবীমূর্তি খোদিত আছে। দিকপাল ও তাদের স্ত্রীদের নিজ নিজ বাহন-সহ যাঁরা যে দিকের অধিপতি তাদের সেই দিকেই রাখা হয়েছে।[2]
পার্শ্বদেবতাদের মূর্তিগুলি তিন দিকের বাইরের দেওয়ালে ("বড়") কেন্দ্রীয় কুলুঙ্গিতে রাখা আছে: দক্ষিণে মহিষাসুর-বধকারিনী অষ্টভূজা দুর্গা ও পশ্চিমে শিবের উপর দণ্ডায়মান ষড়ভূজা চামুণ্ডা। উত্তরের কুলুঙ্গিটি খালি। সম্ভবত এখানে যে দেবীমূর্তিটি ছিল, সেটি চুরি হয়ে গিয়েছে। পার্শ্বদেবতাদের বেদীর আনুভূমিক পাটাতনে গজলক্ষ্মী মূর্তি দেখা যায়। কুলুঙ্গির চারদিক পুথিচিত্র ও "কীর্তিমুখ" মোটিফ এবং কুলুঙ্গি-প্রতি দু-জন সখির চিত্রে শোভিত। বাইরের দেওয়ালের সবচেয়ে উপরের অংশটিতে দশটি আনুভূমিক তলে পুথিচিত্র, কীর্তিমুখ এবং পদ্ম ও অন্যান্য ফুলের মোটিফ দেখা যায়। বিমানের মধ্যে "গর্ভগৃহ" অংশটি রয়েছে। এই অংশের উপরিভাগ "পঞ্চরথ" শৈলীতে নির্মিত। শীর্ষভাগ খাঁজবিশিষ্ট।[2]
বিমলার মূর্তি রাখা আছে কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে। এটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে নির্মিত একটি কক্ষ। এখানকার দেওয়ালে কোনো ছবি দেখা যায় না।[1] বিমলার কেন্দ্রীয় মূর্তিটির উপরের ডান হাতে একটি জপমালা এবং নিচের ডানহাতে বরদামুদ্রা; অন্যদিকে নিচের বাঁ হাতে একটি কুম্ভ (সম্ভবত অমৃতকুম্ভ) আছে। উপরের বাঁ হাতের বস্তুটি নিয়ে তীব্র মতভেদ আছে। এছাড়া একটি নারীমূর্তি, একটি নাগিনী, একটি মৎস্যকন্যা, একটি নাগ-পাশ ও অন্যান্য কয়েকটি বস্তু রয়েছে। বিমলার হাতে এমন কোনো অস্ত্র নেই যেগুলি সচরাচর দুর্গার হাতে দেখা যায়। মূর্তিটি একটি সিংহাসনে রাখা থাকে। মূর্তির দুই পাশে বিমলার দুই সখি ছায়া ও মায়ার মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি লাক্ষা দিয়ে নির্মিত বলে শোনা যায়। এটির উচ্চতা ৪ ফুট (১.২ মি)-এর কিছু বেশি।[5][1][2]
গর্ভগৃহের দরজাটি থেকে একটি সিঁড়ি উঠে যাচ্ছে জগমোহনে। এখানে বেদীর গায়ের ফ্রেমে অপ্সরা-পরিবেষ্টিত গজলক্ষ্মী-মূর্তি দেখা যায়। বেদীর উপরের ফ্রেমে নবগ্রহ অঙ্কিত আছে। দরজার দুপাশের পাটাতনে পুথিচিত্র, লতাপাতা, ফুল ও ক্রীড়ারত বালকের ছবি দেখা যায়। দরজার ধারে দুটি দ্বারপাল মূর্তি দেখা যায়।[2]
জগমোহন বা মুখশালাটি হল একটি পীঢ় দেউল (পিরামিড-আকৃতির ছাদ-বিশিষ্ট একটি বর্গাকার ভবন)। জগমোহনটির ভিত্তি বর্গাকার। উচ্চতা ৩৫ ফুট (১১ মি)। জগমোহনটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ২ ফুট (০.৬১ মি) উঁচু বেদীর উপর। বেদীটির গায়ে ফুলের নকশা ও পুথিচিত্র দেখা যায়। বাইরের দেওয়ালটি বিমান অংশটির মতোই পাঁচ ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশের কুলুঙ্গি ও সংযোগরক্ষাকারী জায়গাগুলিতে "খখর মুন্ডি" কুলুঙ্গি (কামোদ্দীপক দৃশ্য সংবলিত), নাগ-ভাস্কর্য সংবলিত স্তম্ভ, পুথিচিত্র, জালিচিত্র ও ফুলের নকশা দেখা যায়। "তলজঙ্ঘা" অংশটিতে দেবী-মূর্তিগুলি বাদে বিমানের দ্বিতীয় অংশের মতো একই ধরনের মোটিফ দেখা যায়। দেওয়ালের তৃতীয় অংশে তিনটি আনুভূমিক তল দেখা যায়। চতুর্থ অংশের দেওয়ালটিও বিমানের চতুর্থ অংশের দেওয়ালেরই মতো; শুধু এখানে নাগ ও দেবীমূর্তিগুলি দেখা যায় না। দেওয়ালের সবার উপরের অংশটিতে সাতটি আনুভূমিক তল দেখা যায়। এর কেন্দ্রীয় অংশটি নর্তকী, সংগমরত নারীপুরুষ, হাতি ও হরিণের ভাস্কর্য, পুথিচিত্র ও জালিচিত্র দ্বারা শোভিত। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের গবাক্ষ বা চিত্রিত খিলানগুলি রাজসভা ও শিক্ষাদান দৃশ্য দ্বারা চিত্রিত। এর দুই ধারে জানলা দেখা যায়। জানলার চৌকাঠে পুথিচিত্র, জালিচিত্র, নৃত্যরত বালকের মূর্তি, ফুলের নকসা, লতা-পাতার নকশা ও নর্তকীমূর্তি দেখা যায়। এই অংশের মাথায় একটি পিরামিড-আকৃতির শিখর রয়েছে। ভিতরের অংশে কোনো অলংকরণ নেই। জগমোহনে দুটি দরজা রয়েছে। একটি বিমানের গর্ভগৃহের দিকের দরজা ও অন্যটি নাটমণ্ডপের দিকের দরজা।[2]
নাটমণ্ডপটি হল একটি পীঢ়া দেউল। এটির উচ্চতা ২২ ফুট (৬.৭ মি)। মণ্ডপটি আয়তাকার। এটি দৈর্ঘ্যে ৩৫ ফুট (১১ মি) ও প্রস্থে ১৮ ফুট (৫.৫ মি)। সম্ভবত বিমান ও জগমোহন নিয়েই মূল মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। নাটমণ্ডপটি পরবর্তীকালে যুক্ত হয়। এটি ৩.৫ ফুট (১.১ মি) উচ্চতাবিশিষ্ট একটি বেদীর উপর দা&ড়িয়ে আছে। নাটমণ্ডপের বাইরের দেওয়ালে কোনো অলংকরণ দেখা যায় না। এটির উপরে একটি ছোটো পিরামিড-আকৃতির চূড়া দেখা যায়। নাটমন্দিরটির চারটি দরজা রয়েছে। দরজা চারটি দেওয়ালের চার দিকে অবস্থিত। নাটমণ্ডপের ভিতরের দেওয়ালে পট্টচিত্র শৈলীর ওড়িশি চিত্রকলা দেখা যায়। এখানে দশমহাবিদ্যা সহ মোট ষোলোজন হিন্দু দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে।[2]
ভোগমণ্ডপটিও একটি পীঢ়া দেউল। এটির উচ্চতা ২০ ফুট (৬.১ মি)। এটি বর্গাকার। এর প্রতিটি দিক ১৫ ফুট (৪.৬ মি)। এই মণ্ডপটি একটি ৪ ফুট (১.২ মি) উঁচু বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের দেওয়ালের পাঁচটি অংশই অলংকৃত। ভোগমণ্ডপের উপর একটি ছোটো শিখর দেখা যায়। ভিতরের দেওয়ালের পশ্চিম অংশের কুলুঙ্গিগুলিতে অষ্টভূজ গণেশ ও ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি দেখা যায়। ভোগমণ্ডপেও চার দিকে চারটি দরজা দেখা যায়। প্রতি দরজায় দুইজন দ্বাররক্ষিণীর মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দিকের দরজাটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[2]
ভোগমণ্ডপের প্রবেশপথের বাইরে একটি ৪ ফুট (১.২ মি) গজসিংহ (বিমলার বাহন) দেখা যায়। এই মূর্তিটি একটি হাতির মূর্তির উপর বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়ের প্রতীক। এই অংশের উপরে একটি চ্যাপ্টা ছাঁদ রয়েছে।[1][2]
বিমলা মন্দিরটিকে একটি শক্তিপীঠ মনে করা হয়। এই মন্দিরটিকে ওড়িশার শাক্ত সম্প্রদায়ের প্রধান মন্দির মনে করা হয়।[6] প্রত্যেকটি শক্তিপীঠে শিবকে ভৈরব রূপে পূজা করার নিয়ম প্রচলিত আছে। ভৈরব হলেন শক্তিপীঠের প্রধান দেবীর স্বামী।[7]
শাক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিমলা হলেন পুরুষোত্তম (পুরী) শক্তিপীঠের প্রধান দেবী।[2] বিষ্ণু বা কৃষ্ণের (কৃষ্ণকে সাধারণভাবে বিষ্ণুর অবতার মনে করা হয়) রূপ জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব মনে করা হয়। ভৈরব সাধারণভাবে শিবের একটি রূপ হলেও, এক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়। তাই এই মন্দিরে বিষ্ণু ও শিবকে অভিন্ন মনে করা হয়, যা এক অর্থে একটি একেশ্বরবাদী ধারণা। একইভাবে শিবের পত্নী বিমলা ও বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মীও এখানে এক।[1] অন্যদিকে, তান্ত্রিক মতে, জগন্নাথকে বিষ্ণুর রূপ মনে করা হয় না। এই মতে তিনি শিব-ভৈরব।[8]
জগন্নাথ মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে জগন্নাথ, বলভদ্র (কৃষ্ণের দাদা, যাঁকে শিব মনে করা হয়) ও সুভদ্রার (কৃষ্ণ ও বলভদ্রের ছোটো বোন) মূর্তি আছে। জগন্নাথ-কেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাসে, লক্ষ্মী জগন্নাথের পত্নী। অন্যদিকে বিমলাকে জগন্নাথের তান্ত্রিক পত্নী ও মন্দির চত্বরের রক্ষয়িত্রী মনে করা হয়।পুরান মতে দেবী পার্বতীর আদেশে বিষ্ণু ও লক্ষ্মী ,বলরাম ও সুভদ্রা মন্দিরে থাকেন। [9][2]
বিমলাকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী অর্থাৎ দেবী পার্বতী বলে উল্লেখক করা হয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের দুর্গাপূজায় তাকে একাধারে শিব ও বিষ্ণুর শক্তি মনে করা হয়। নতুন দিল্লির জাতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত কোণার্ক সূর্যমন্দিরের একটি পাথরে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী) বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী বা বিজয়লক্ষ্মী রূপে অঙ্কণ করা হয়েছে।[10][2]
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, প্রজাপতি দক্ষের কন্যা সতী পিতার আপত্তি সত্ত্বেও শিবকে বিবাহ করেছিলেন। পরে দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেই যজ্ঞে দক্ষ শিব ও সতীকে আমন্ত্রণ জানাননি। তবুও সতী যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। দক্ষ সতীকে উপেক্ষা করেন এবং শিবের নিন্দা করেন। স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে আত্মহত্যা করেন। শিব ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। শিবকে শান্ত করতে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১ খণ্ড করেন। এই টুকরোগুলি পৃথিবীর এক এক স্থানে পড়ে এক একটি শক্তিপীঠের জন্ম দেয়।[7]
শক্তিপীঠগুলির সংখ্যা নিয়ে ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে মতভেদ আছে। কয়েকটি গ্রন্থে বিমলা মন্দিরকে শক্তিপীঠ বলা হয়েছে। আবার এই পীঠকে একাধিক নামেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কালিকা পুরাণ গ্রন্থে তন্ত্র-সাধনার কেন্দ্র হিসেবে যে চারটি পীঠের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি চার দিকে অবস্থিত। এর মধ্যে পশ্চিম দিকের পীঠটি হল ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন (বর্তমান ওড়িশা) অঞ্চলের কাত্যায়নী (বিমলা)। এই পীঠের ভৈরব হলেন জগন্নাথ। হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থে অনুরূপ একটি তালিকায় উড্র (ওড্র বা ওড়িশা) পীঠের ভৈরবী কাত্যায়নী ও ভৈরব জগন্নাথের উল্লেখ পাওয়া যায়।[11][12]
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের "পীঠনির্ণয়" বা "মহাপীঠনির্ণয়" অংশে উৎকলের (বর্তমান ওড়িশা) বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলা হয়েছে। এই পীঠের প্রধান দেবী বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। এই পীঠে সতীর নাভি পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বইটির অন্য একটি অংশে যদিও এই পীঠকে একটি উপপীঠ বা অপ্রধান পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সতীর "উচ্ছিষ্ট" বা খাদ্যের অবশিষ্টাংশ পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্দিরটির অবস্থান হিসেবে নীলাচল নামটির উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, নীলাচল হল জগন্নাথ মন্দির চত্বরের প্রথাগত নাম।[13] শিবচরিত গ্রন্থে নীলাচল বা নীলপর্বতকে উপপীঠ এবং এই পীঠের দেবী বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[14]
তন্ত্রগ্রন্থ কুব্জিকাতন্ত্র মতে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধি নামে একধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা যায় বলে তান্ত্রিকরা বিশ্বাস করেন।[15] দেবীভাগবত পুরাণ, প্রাণতোষিণী তন্ত্র ও বৃহন্নীলতন্ত্র বিমলা মন্দিরকে ১০৮ পীঠের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে।[16][17] মৎস্য পুরাণ গ্রন্থে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলাকে পীঠশক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বামন পুরাণ মতে, এটি একটি পবিত্র তীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থেও বিমলা ও জগন্নাথকে পীঠদেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেবীর ১০৮টি পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টোত্তরশত গ্রন্থেও পুরুষোত্তমের বিমলার নাম পাওয়া যায়।[17] দেবী পুরাণ মতে, এই পীঠে সতীর পা পড়েছিল।[18][1][2]
ওড়িশাবাসী হিন্দুরা বিমলা মন্দিরকে প্রধান শাক্ত তীর্থ মনে করেন। ভক্তেরা প্রতিদিন এই মন্দিরে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-ভুক্ত দেবীমাহাত্ম্যম্, আদি শঙ্কর রচিত দেব্যাপরাধক্ষমাপণ স্তোত্রম্ ও পুরুষোত্তম রক্ষিত রচিত বিমলাষ্টকম্ পাঠ করেন।[1] জগন্নাথ মন্দিরের নিয়ম অনুসারে, মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজার আগে বিমলাকে পূজা করতে হয়।[8][19] বিমলার "তীর্থ" বা পবিত্র জলাধার রোহিণীকুণ্ডের জল পবিত্র মনে করা হয়।[19] তান্ত্রিকদের কাছে বিমলা মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।[2]
দুর্গাপূজা বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব। প্রতি বছর আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ষোলো দিন ধরে দুর্গাপূজা উদ্যাপিত হয়।[8] দুর্গাপূজার শেষ দিন, অর্থাৎ বিজয়াদশমীতে পুরীর গজপতি-বংশীয় রাজা (ইনি নামমাত্র রাজা) বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপে পূজা করেন। নতুন দিল্লি কোণার্ক শিলালেখ-এ এই পূজার প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালেখের তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন।[20] জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মেয়েদের "দুর্বল-হৃদয়" মনে করা হয়। তাই বিমলার ধ্বংসাত্মিকা রূপ মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হয় বলে, বিমলা মন্দিরে দুর্গাপূজা মেয়েদের দেখতে দেওয়া হয় না।[1]
সাধারণত বিমলার জন্য আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বিমলা জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ খান।[1] জগন্নাথ মন্দিরে নিবেদিত নিরামিশ ভোগই বিমলাকে নিবেদন করা হয়। জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে নিবেদন করার পরই তা মহাপ্রসাদের মর্যাদা পায়। ভোগে নারকেল বাটা, পনির ও মাখন সহ শুকনো ভাত দেওয়া হয়।[19][1] প্রথামাফিক গোবর্ধন মঠের প্রধান পুরীর শঙ্করাচার্য গোবর্ধন মঠ ও জগন্নাথ মন্দিরের এক পাত্র মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি পান।[20]
হিন্দুধর্মে দেবতাকে উচ্ছিষ্ট প্রসাদ নিবেদন করা নিষিদ্ধ। তবে জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ পৌরাণিক আখ্যান আছে। শিব একবার বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন, বিষ্ণুর খাবার থালা থেকে কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট মাটিতে পড়েছে। শিব সেই উচ্ছিষ্ট তুলে খান। সেই সময় তার অসাবধানে দাড়িতে কিছু উচ্ছিষ্ট লেগে যায়। কৈলাশে ফেরার পর নারদ তার দাঁড়িতে বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট দেখে তা খেয়ে ফেলেন। শিবের পত্নী পার্বতী এতে ক্ষুণ্ণ হন। বিষ্ণুর প্রসাদে নিজের ন্যায্য অংশ না পাওয়ায় তিনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে বিষ্ণুর কাছে নালিশ করেন। বিষ্ণু তাকে শান্ত করে বলেন, কলিযুগে তিনি বিমলা রূপে নিত্য তার উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পাবেন।[1]
বিমলাকে যখন আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়, তখন সেই ভোগ রান্নার ব্যবস্থা আলাদা করে করা হয়। দুর্গাপূজার সময় বিমলাকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। সেই সময় বিমলা মন্দিরে পশুবলি হয়। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, দুর্গাপূজার সময় বিমলা ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করেন; তাই সেই সময় তাকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ নিবেদন করা উচিত। দুর্গাপূজার সময় খুব ভোরে গোপনে পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের পুকুর থেকে মাছ ধরে এনে তা রান্না করে তান্ত্রিক মতে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। জগন্নাথের বৈষ্ণব ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই "বিমলা পারুষ" বা বিমলার আমিষ প্রসাদ পান। বিমলা মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবরা একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।[1]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.