Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
২০১২-এর আইসিটি স্কাইপ বিতর্ক বা স্কাইপ কেলেঙ্কারি হলো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত বাংলাদেশী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেল ফাঁসের ঘটনা।[1] একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালে এই কথোপকথন সংগঠিত হয়েছিলো।
দি ইকোনমিস্টের মতে, রেকর্ডিং এবং ইমেলগুলো নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কার্যনির্বাহীর উপর দ্রুত বিচারের জন্য চাপ এবং হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিল। নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে তাকে তলব করা হয়েছিল, কারণ জিয়াউদ্দিন তাকে ট্রাইব্যুনালের জন্য দলিল প্রস্তুত করতে সহায়তা করেছিলেন এবং নিজামুল হকের হয়ে বিস্তারিত সুপারিশ করেছিলেন তিনি। জিয়াউদ্দিন প্রসিকিউটর জায়েদ-আল-মালুম সহ অন্যান্য প্রসিকিউটরদেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন আর প্রসিকিউটররা কীভাবে তাদের মামলা চালাবে সে সম্পর্কেও সে নিজামুল হককে অবহিত করেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে বিচারক, উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রপক্ষের মধ্যে অনৈতিক সংযোগ তৈরী হয়েছিল।[1]
২২ আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর ২০১২ সালের মধ্যে ১ ঘণ্টার একটি কথোপকথন এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৩০ টিরও বেশি ই-মেইল দি ইকোনমিস্ট এ প্রকাশ করা হয়।[1] বাংলাদেশী সংবাদপত্র আমার দেশও এই কথোপকথন গুলো খুজে পায় এবং ডিসেম্বরে সম্পূর্ণ লিখিতলিপি একটি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। ১৩ ডিসেম্বর একটি আদালতের আদেশে বাংলাদেশি সংবাদপত্রগুলোকে এই কথোপকথনের সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, আর সেসময় আমার দেশ কে আদালত নিষিদ্ধ করে, ফলে তারা আর এটি নিয়ে পরে কিছু প্রকাশ করতে পারেনি।[2]
১১ ই ডিসেম্বর ২০১২ এ, নিজামুল হক ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করে আইসিটি-১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। জামায়াতে ইসলামী এই ট্রাইব্যুনালের বাতিলের দাবি করা সত্ত্বেও আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন যে, নিজামুল হকের পদত্যাগ বিচার কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্ত করবে না।[3] ১৩ ডিসেম্বর, তদানীন্তন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের প্রধান (আইসিটি -২) ফজলে কবিরকে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করা হয়।[4] পুনর্বিচারের দাবি করে আসামীদের আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়।[5]
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত সন্দেহভাজনদের বিচারের জন্য ২০০৯ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল এগারো জনকে সন্দেহভাজন হিসাবে অভিযুক্ত করে; তারা ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, জামায়াতে ইসলামীর নয় জন, বিএনপি থেকে দুজন ও আওয়ামী লীগের শূন্য। স্কাইপ বিতর্ক চলাকালীন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী ও গোলাম আযমের বিচার আইসিটি -১ এ চলছিল এবং দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিচার প্রায় সমাপ্তের পথে ছিলো।[1]
ডিসেম্বর ২০১২-তে, আইসিটি -১ এর প্রিজাইডিং জজ মোহাম্মদ নিজামুল হক দি ইকোনমিস্টের দু'জন সদস্যকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য একটি আদেশ পাস করেন এবং দাবি করেন যে তারা কীভাবে ই-মেইলগুলি পেল এবং তার মধ্যে এবং আইনজীবী জিয়াউদ্দিন এর মধ্যে কথোপকথনের বিষয়টিও তারা কীভাবে পেল? দ্য ইকোনোমিস্ট এর কাছে থাকা নথিগুলো সম্পর্কে হকের সাথে যোগাযোগ করার পরেই এই আদেশ এসেছিল। এই আদেশে আহমদ জিয়াউদ্দিনকে বিচারকদের সহায়তা করার জন্য বিশেষজ্ঞ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, ব্যাখ্যা করা হয় যে, ট্রাইব্যুনালের নতুন আইনের জন্য বিচারকদের গবেষণা সহায়তার প্রয়োজন পরে।[1][10] ৯ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকা কথোপকথনের প্রতিবেদন এবং প্রতিলিপি প্রকাশ করা শুরু করে এবং দি ইকোনমিস্ট ১৫ ডিসেম্বর আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দি ইকোনমিস্টের মতে, স্কাইপ কথোপকথন এবং ই-মেইল থেকে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কার্যনির্বাহীকরণের জন্য চাপ এবং হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিল। ১৪ ই অক্টোবর নিজামুল হক ও জিয়াউদ্দিনের মধ্যে কথোপকথনের সময় নিজামুল হক সরকারকে উল্লেখ করে বলেন,
গভর্নমেন্ট রায়ের জন্য পাগল হইয়া গেছে। সাঈদীরটা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে রায় দেতে পারবো। গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া। তারা একটা রায় চায়।[1]
১৫ ই অক্টোবর, নিজামুল হক বর্ণনা করেন যে, কীভাবে সরকারের একজন সদস্য "এই সন্ধ্যায় আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি আমাকে এই রায় দ্রুত পাস করতে বলেছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, 'আমি কীভাবে এটি করতে পারি?" ... তিনি বলেছিলেন,' দ্রুত চেষ্টা করুন আপনি যেমনি পারেন।[1] দি ইকোনমিস্ট আরও জানায় যে এই যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রাসেলস-ভিত্তিক আইনজীবী জিয়াউদ্দিনের প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে। ২৮ আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর, দু'জনেই প্রতিদিন প্রায় ২০ মিনিটের সমতুল্য কথা বলেছিলেন। জিয়াউদ্দিন নিজামুলের ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে তার কাছে হাজির হয়েছিলেন। ১২ ই মে, জিয়াউদ্দিন হককে "গোলামআজামচার্জসফাইনালড্রাফ্ট (GhulamAzamChargesFinalDraft)" নামে একটি নথি প্রেরণ করেন এবং পরের দিন ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসাবে একটি স্বতন্ত্র নথি জারি করে। নিজামুল হকের সহকর্মী বিচারক শাহিনুর ইসলামের ভবিষ্যতের ব্যাপারেও জিয়াউদ্দীন হক পরামর্শ দিয়ে বলেন, "যদি তিনি না থামেন তবে তাকেও যেতে হবে, কারণ এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।"[1]
দি ইকোনমিস্ট আরও বলে যে, এই কথোপকথনের মাধ্যমে জানা যায় যে, জিয়াউদ্দিন প্রধান প্রসিকিউটর জায়েদ-আল-মালুম সহ অন্যান্য বিচারক এবং প্রসিকিউটরদের সাথে একই বিষযগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ১১ ই ডিসেম্বর ২০১১-এ তিনি গোলাম আজমের বিরুদ্ধে মামলায় মালুম ও অন্য একজন প্রসিকিউটরকে সহায়তা দিয়েছিলেন এবং এই পরামর্শ নিজামুল হকের কাছে পাঠান তিনি। প্রসিকিউটররা তাদের অভিযোগ গঠনের পরেও, জিয়াউদ্দিন অভিযোগগুলোর বিষয়ে নিজামুল হককে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া আব্যাহত রাখেন।[1]
কথোপকথনের সময়, তাদের একজন বা দুজনই বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে "দুর্নীতিগ্রস্ত" বলে উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করার আগে জাহাঙ্গীর হোসেন তার নিজের পক্ষে আদালতে একটি আবেগময় বক্তব্য দিয়েছিলেন (হক তখন অনুপস্থিত ছিলেন)। হক এবং জিয়াউদ্দিন দ্বারা তার চরিত্রের কালিমা লেপন নিয়ে তিনি আপত্তি জানান। তিনি আমার দেশের স্কাইপ কথোপকথনের প্রচারের বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন। হোসেন বলেন, বিএনপি সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানকে (বর্তমানে আমার দেশের সম্পাদক) নিয়ে জড়িত একটি মামলায় বসার জন্য তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। হোসেন বলেছিলেন যে মাহমুদুর রহমানের নামটি বড় শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়।[11]
আহমেদ জিয়াউদ্দিন হলেন একজন বাংলাদেশী আইনজীবী এবং আন্তর্জাতিক আইন আদালতের বিশেষ একাডেমিক, যিনি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে থাকেন এবং সেখানেই কর্মরত আছেন। তাঁর জন্ম পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন ঢাকায়, যেখানে তিনি কলেজ ও আইন বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন এবং তাঁর ভাই ছিলেন মোহাম্মদ নিজামুল হকের বন্ধু। তারা একে অপরকে বহু বছর ধরে চেনেতেন।[5] জিয়াউদ্দিন ব্রাসেলসের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক,[12] যেখানে তিনি বাংলা সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পূর্ণকালীন পরিচালক হিসেবে আছেন।[13] বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে তারা "দায়মুক্তির অন্তর্নিহিত সংস্কৃতি" অভিহিত করা প্রচারণা তার সংস্থা ইতি ঘটায়।[5][13]
জিয়াউদ্দিন আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে রোম চুক্তির পক্ষে ছিলেন বলে খ্যাতি লাভ করেন, যেখানে তিনি এশীয় সরকারদের এই চুক্তিটি স্বাক্ষর ও অনুমোদনের জন্য তদবির করেছিলেন।[14][15][16] জিয়াউদ্দিন ২০০১ সাল থেকে কোয়ালিশন ফর দ্য এশীয় নেটওয়ার্ক ফর দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (সিআইসিসি) সমন্বয়ক হিসাবে যুক্ত ছিলেন এবং ইউনাইটেড নেশনস-এর সদস্য দেশগুলিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রোম সংবিধানে স্বাক্ষর করার জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালান। তিনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো এশীয় দেশসমূহকে এই চুক্তি স্বাক্ষর করানো এবং তারপরে চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য কাজ করেছিলেন[16][17][18] বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করে এবং পরে ২০১০ সালে এটি অনুমোদিত হয়। একই বছরে বাংলাদেশের রোম সংবিধানের অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল।[19]
যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালীন জিয়াউদ্দিন প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের পরামর্শ দিতেন। তিনি অভিযুক্ত গোলাম আযমের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগও খসড়া করেছিলেন।[13] স্কাইপ বিতর্ক প্রকাশ্যে আসার কয়েক সপ্তাহ আগে, জিয়াউদ্দিন ২০১২ সালের নভেম্বরে হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের স্টেটস অ্যাসেমব্লিউ স্টেটস পার্টির একটি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামির পক্ষে ডিফেন্স অ্যাটর্নি ছিলেন টবি ক্যাডম্যান তিনি এই প্রক্রিয়াটির সর্বাধিক সমালোচক ছিলেন।
১১ ই ডিসেম্বর ২০১২, নিজামুল হক তার ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করে আইসিটি -১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ট্রাইব্যুনাল বাতিল করতে জামায়াতে ইসলামীর দাবি সত্ত্বেও আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন যে, হকের পদত্যাগ বিচারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে না। তিনি বলেন যে হক কোনভাবেই অনুচিত আচরণ করেনি এবং আইনের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করার অধিকার তার ছিল।[3][20] ১৩ ডিসেম্বর, তদানীন্তন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের প্রধান (আইসিটি -২) প্রধান ফজলে কবিরকে নতুন চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়।[4]
১৯ ডিসেম্বর, বিবাদি একটি আবেদন জমা দেয়।[21] প্রধান আইনজীবী জায়েদ-আল-মালুমকে অপসারণের জন্যও একটি আবেদন করা হয়েছিল। আইসিটি -১ এ বিএনপির এমপি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আবেদনটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার মামলা স্থগিতের দাবি জানান।[22] ৩ জানুয়ারী, পুনর্বিচারের জন্য আসামীদের আবেদন বাতিল হয়ে যায়। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ১১ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে রিমান্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যার মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা, এবং শাহবাগের বিক্ষোভের বিষয়ে আমার দেশ থেকে আসা অন্যান্য প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল।[8] এশীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে যে তারা জেনেছে যে রহমানকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে।[2]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.