Remove ads
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চলাইটের[৫] অধীনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী এবং রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল।[৬] দীর্ঘ নয় মাসের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারীদের দ্বারা ৩০,০০,০০০ বাঙালিকে হত্যা এবং[৪] গণহত্যামূলক যৌন সহিংসতার একটি পরিকল্পিত প্রচারণায় ২,০০,০০০ থেকে ৪,০০,০০০ বাঙালি নারীকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে।[৭][৮][৯] গণহত্যার তদন্তে, জেনেভা -ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিচারক কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে পাকিস্তানের প্রচারণা দেশটির হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে নির্মূল বা জোরপূর্বক অপসারণের প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল।[১০]
১৯৭১ বাংলাদেশে গণহত্যা | |
---|---|
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশ | |
স্থান | পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) |
তারিখ | ২১ মার্চ - ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ (৮ মাস, ২ সপ্তাহ ও ৩ দিন) |
লক্ষ্য | বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু[১] |
হামলার ধরন | গণহত্যা এবং গণহত্যা ধর্ষণের মাধ্যমে জাতিগত নির্মূল |
নিহত | ৩০,০০,০০০[২][৩][৪] |
ভুক্তভোগী |
|
হামলাকারী দল | |
অপরাধী | পাকিস্তান |
কারণ | হিন্দুফোবিয়া এবং বাঙালি বিরোধী বর্ণবাদ |
ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বিচ্ছিন্ন ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের উভয় অংশের মধ্যে ১২০০ মাইলের দূরত্ব রয়ে যায়।[১১] শুধুমাত্র ভৌগোলিক দূরত্বই ছিল না; সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণার মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পূর্বাংশের বাঙালী মুসলিমদেরকে অতিমাত্রায় বাঙ্গালী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। এ ধারণা দূর করতে পশ্চিমারা বাঙালীদেরকে জোরপূর্বক সাংস্কৃতিক ভাবনা থেকে দূরে রাখার কৌশল প্রবর্তন করে।[১২]
পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই বাঙালী ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন ও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবীভাষীদের সংখ্যা ৫৫ মিলিয়ন।[১৩] পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই মুসলিমসহ সংখ্যালঘিষ্ঠ বৃহৎসংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। পশ্চিমারা তাদেরকে দ্বিতীয়-শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে মনে করতো। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে কর্মরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এ অঞ্চলকে নিচু ভূমি, নিচু ব্যক্তিদের আবাসস্থলরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন।[১৪]
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের অল্প কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নবগঠিত রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষারূপে উর্দুকে ঘোষণা দেন।[১৫] কিন্তু, ঐ সময়ে পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর কেবলমাত্র চার শতাংশ উর্দু ভাষায় কথা বলতেন।[১৬] বাংলাকে সমর্থনদানকারীরা কমিউনিস্ট, বিশ্বাসঘাতক ও রাষ্ট্রের শত্রুরূপে বর্ণনা করেন।[১৭] পরবর্তী সরকারও বাংলাকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। এরফলে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ও শাসক দল মুসলিম লিগের বিকল্পরূপে পূর্ব-পাকিস্তানে নবগঠিত আওয়ামী লিগের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পায়।[১৮] ১৯৫২ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ হয়। এ বিক্ষোভকে জোরপূর্বক দমন করা হয় ও বিক্ষোভকারীদের অনেকে নিহত হন। এ কারণে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জ্বীবিত ব্যক্তিরা তাদেরকে শহীদরূপে আখ্যায়িত করেন।[১৯] ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুতের জন্য সামরিক বাহিনীতে অতিরিক্ত ইউনিট যুক্ত করা হয়নি।[২০] এরফলে বাঙালীরা তাদের দেশকে যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের আক্রমণ থেকে অরক্ষিত দেখতে পায়।[২১][২২] এমনকি, পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কাশ্মিরকে অধিকারের বিনিময়ে পূর্বাংশকে ছেড়ে দেয়ারও চিন্তা করেছিলেন।[২৩]
১২ নভেম্বর, ১৯৭০ তারিখে সংঘটিত ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়া স্বত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী বেশ ধীরগতিতে সাড়া দেয়। ফলশ্রুতিতে ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিকধারার সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ও পূর্ব-পাকিস্তানভিত্তিক আওয়ামী লিগ জাতীয় পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু, পশ্চিম পাকিস্তানিরা সরকার গঠনে বাঁধার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন[২৪] ও সামরিক আইন জারী করেন।[২৫]
মার্চ, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নির্মূল করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে সেনা অভিযান পরিচালনা করেছিল।[২৬] পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারের আদেশক্রমে নভেম্বর, ১৯৭০ সালে পরিচালিত অপারেশন ব্লিটজের সাথে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল।
প্রকৃত পরিকল্পনায় ২৬ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে প্রধান শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে সকল বিরোধী, রাজনৈতিক কিংবা সামরিক ব্যক্তিদের একমাসের মধ্যে নির্মূলের বিষয় উল্লখে করা হয়েছিল।[২৭] তবে, পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের কাছে দীর্ঘদিনের বাঙালী প্রতিরোধের বিষয়টি বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি।[২৮] মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালীদের কাছ থেকে পতন হলে অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান পর্বটি শেষ হয়।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ৩০ লক্ষ ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন বলে দাবী করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক তদন্ত কার্যে নিয়োজিত হামুদুর রহমান কমিশন ২৬,০০০-এরও কম সাধারণ নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করে।[২৯] এ যুদ্ধবিগ্রহের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে আরও প্রায় আট থেকে দশ লক্ষ লোক ঐ সময়ে প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশ ভারতে শরণার্থীরূপে গমন করে। তাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।[৩০]
শর্মিলা বসু’র বিতর্কিত গ্রন্থ ডেড রিকনিং: মেমরিজ অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার অনুযায়ী সংখ্যাটি ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০-এর মধ্যে।[৩১][৩২] কিন্তু, তার ঐ বইটি ঐতিহাসিকদের মাঝে প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হয়।[৩১][৩৩][৩৪] ২০০৮ সালে জিয়াদ ওবারমেয়ার, ক্রিস্টোফার জে. এল. মারে এবং ইমানুয়েলা গাকিদো তাদের গবেষণাপত্র ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে যুদ্ধের ফলে সংখ্যাটি ২,৬৯,০০০-এর বেশি হবে না বলে উল্লেখ করেন। লেখকত্রয় উল্লেখ করেন যে, আপসালা বিশ্ববিদ্যালয় ও অসলোভিত্তিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পূর্বেকার ৫৮,০০০-এর তুলনায় এ সংখ্যাটি অনেক বেশি।[৩৫] বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ এ সংখ্যাটির বিষয়ে তার সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছেন।[৩৬]
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত রাজাকার, আল-শামস ও আল-বদরের ন্যায় আধা-সামরিকবাহিনী পাক সেনাদের নির্দেশনায় তাদের অনেককেই হত্যা করেছিল।[৩৭] মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে আল-বদর বাহিনী অনেককেই বাঙালী হিসেবে চিহ্নিত করে অজ্ঞাতস্থানে তুলে নিয়ে যায়।[৩৮]
বাংলাদেশে অনেকগুলো গণকবরের সন্ধান মিলেছে ও এখনো গণকবর পাওয়া যাচ্ছে। তন্মধ্যে, আগস্ট, ১৯৯৯ সালে ঢাকার মিরপুর থানার মসজিদের পার্শ্বে পাওয়া গেছে।[৩৯] বাঙালী নিধনযজ্ঞের প্রথম রাত্রেই ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রদত্ত টেলিগ্রাম বার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের এলাকায় অগণিত ছাত্র, সাধারণ নাগরিকের নিহত হবার কথা তুলে ধরা হয়।[৪০]
শুধুমাত্র বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড পশ্চিমা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে তা নয়;[৪১] বাঙালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিরাও সংখ্যালঘু অবাঙ্গালী বিহারীদের উপরও আক্রমণ পরিচালনা করেছেন।[৪২]
১৬ ডিসেম্বর, ২০০২ তারিখে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভ থেকে শ্রেণীবিহীন দলিলপত্রাদি প্রকাশ করে। এতে ঢাকা ও ভারতে অবস্থিত ইউসিস কেন্দ্র ও ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের মধ্যকার কথাবার্তা তুলে ধরা হয়।[৪০] এসকল নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে 'পরিকল্পিত গণহত্যা' ও 'গণহত্যা' পরিভাষাটি মার্কিন কর্মকর্তাগণ কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ব্যবহার করেছিল।[৪৩][৪৪] এতে ঐ সময়কার তাদের জ্ঞাতসারে প্রবাহিত ঘটনাসমূহ তারা লিপিবদ্ধ করে। পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক ঘটনাসমূহ নিক্সন প্রশাসনের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন আকারে দেখা যাবে।[৪৫]
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিটার টমসেনের মতে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ রাজনৈতিক দল জামাত-ই-ইসলামীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এ দলটির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার্থে আল-বদর ও আল-শামসের ন্যায় আধা-সামরিকবাহিনী গঠিত হয়।[৪৬][৪৭] ঐ আধা-সামরিকবাহিনী নিরস্ত্র ব্যক্তিদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ও ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়।[৪৮] রাজাকার নামে স্থানীয় সমন্বয়কারীরাও বর্বোরোচিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে।
মুসলিম লিগের সহযোগী সংগঠন নিজাম-ই-ইসলাম, জামাত-ই-ইসলামী ও জামিয়াত উলেমা পাকিস্তান নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। দলগুলোর সদস্যরাও সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে ও তাদের গোয়েন্দা সংগঠন হিসেবে অবতীর্ণ হয়।[৪৯] জামাত-ই-ইসলামীর সদস্যবর্গ ও এর কিছু নেতা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ধর্ষণে লিপ্ত হয় এবং হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠে।[৫০] আল-বদর ও আল-শামসের নির্মমতা বৈশ্বিকভাবে প্রকাশ পায় ও গণমাধ্যমগুলোর নজরে পড়ে। বেশ কয়েকটি গণহত্যা ও অগণিত ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রতিবেদন আকারে প্রচারিত হতো।[৪৭]
যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় দোসররূপে পরিচিত জামাত ই ইসলামী শীর্ষস্থানীয় বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। যুদ্ধের শুরু হবার কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপককে হত্যা করা হয়।[৫১] তবে, যুদ্ধ শেষ হবার অল্প কয়েকদিন পূর্বে সর্বাধিকসংখ্যক সুনির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা পরিচালিত হয়েছিল। অধ্যাপক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, প্রকৌশলী ও লেখককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারেরা ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। চোখ বন্ধ করে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ ও নগরীর অন্যান্য নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে হত্যা করা হয়। তন্মধ্যে, রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকাগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে এগিয়েছিল।[৫২][৫৩][৫৪][৫৫] পাশাপাশি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার আধা-সামরিক দল আল-বদর ও আল-শামস চিকিৎসক, শিক্ষক, কবি ও শিক্ষাবিদদের তালিকা প্রস্তুত করে।[৫৬][৫৭]
দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগীরা সুপরিকল্পিতভাবে ৯৯১জন শিক্ষক, ১৩জন সাংবাদিক, ৪৯জন চিকিৎসক, ৪২জন আইনজীবী ও ১৬জন লেখক-প্রকৌশলীকে হত্যা করে।[৫৪] এমনকি ১৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও অস্ত্রসজ্জিত পাকবাহিনী কিংবা তাদের দোসর কর্তৃক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নিহত হওয়া। ঐদিন তিনি মিরপুরে অস্ত্রধারী বিহারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৪ ডিসেম্বরে হত্যার শিকারে পরিণত হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়ে থাকে।[৩৭][৫৮][৫৯]
২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখ পর্যস্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। তন্মধ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন), ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), ড. এম আবুল খায়ের (ইতিহাস), ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), হুমায়ুন কবির (ইংরেজি সাহিত্য), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল হক খান, ফাইজুল মাহি, ড. সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য[৬০] ও সাইদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা); রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান (গণিত), অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমদ্দার (সংস্কৃত), অধ্যাপক মির আব্দুল কাইয়ুম (মনোবিদ্যা)-সহ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী (কার্ডিওলজিস্ট), ড. এএফএম আলিম চৌধুরী (অপথালমোলোজিস্ট), শহীদুল্লা কায়সার (সাংবাদিক), নিজাম উদ্দিন আহমেদ (সাংবাদিক),[৬১] সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), সাইদুল হাসান (সাংবাদিক), জহির রায়হান (ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক) ও রণদাপ্রসাদ সাহা (মানবতাবাদী)।[৬২][৬৩]
সাধারণতঃ নয়মাসব্যাপী যুদ্ধে ২,০০,০০০ গণধর্ষণের ঘটনার কথা বলা হয়ে থাকে।[৬৪] যুদ্ধকালীন অগণিত মহিলাকে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে।[৬৫] পুনরায় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি এবং তা বিতর্কের বিষয়। বাংলাদেশের তথ্য মোতাবেক জানানো হয়েছে যে, ২,০০,০০০ মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তারা হাজার হাজার যুদ্ধ-শিশুর জন্ম দিয়েছেন। এছাড়াও পাকবাহিনী অগণিত বাঙ্গালী মহিলাকে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে যৌন-দাসীরূপে আটকে রেখেছিলেন। অধিকাংশ তরুণীই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়েছিল।[৬৬]
সুসান ব্রাউনমিলারের অভিমত, চার লক্ষাধিক মহিলা এ ঘটনার শিকার। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের মতে, এ সংখ্যাটি অনেক কম। কিন্তু ধর্ষণের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে অস্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।[৬৭][৬৮][৬৯] ব্রাউনমিলার বলেছেন:[৭০]
খাদিজা নাম্নী তেরো বছরের কিশোরী ঢাকায় এক আলোকচিত্রশিল্পীকে স্বাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, অন্য চারজন বালিকাসহ বিদ্যালয়ে যাবার পথে একদল পাকসেনা তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদেরকে মোহাম্মদপুরের সামরিক ব্যারাকে আটকে রাখা হয় ও যুদ্ধ শেষ হবার পূর্বেকার ছয়মাস সেখানে তারা অবস্থান করতে বাধ্য হয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে ম্যালকম ডব্লিউ. ব্রাউন উল্লেখ করেছেন:[৭১]
একটি ঘটনা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় ও অনেকগুলো মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় যে, মার্চ ও এপ্রিলে ৫৬৩জন মহিলাকে সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গর্ভপাত ঘটানোর সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও কেলেঙ্কারির ভয়ে তাঁদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
সৈনিকদের লোভনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্মতিক্রমে ও ঊর্ধ্বতনদের সহায়তায় গড়ে উঠে। ১৫ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে এক গোপনপত্রে বিভাগীয় কমান্ডার নিয়াজী অভিযোগ করেন যে,
“ | এ অঞ্চলে দায়িত্বভার নেয়ার পরপরই আমি অগণিত অভিযোগ শুনেছি। তন্মধ্যে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ, নির্বিচারে লোকদেরকে হত্যা, রাষ্ট্রবিরোধী বিষয়ের উপাদান না থাকা স্বত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকায় সৈনিকদের অবস্থান অন্যতম। এছাড়াও ধর্ষণের বিষয়েও আমি অবগত হয়েছি। ১২ এপ্রিল দুই পূর্ব পাকিস্তানি মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে ও আরও দুইজনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়।[৭২] | ” |
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহিম তার রচিত গ্রন্থ আমি বীরঙ্গনা বলছি গ্রন্থে নির্যাতিতা মহিলাদের সরাসরি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধকালীন ধর্ষিতা ও নির্যাতিতা নারীদেরকে বীরাঙ্গনা নামকরণের কথা উল্লেখ আছে। যুগান্তকারী প্রচেষ্টা হলেও সামাজিকভাবে তারা অবহেলিত থেকে যান। এছাড়াও এ প্রচেষ্টাটি কতটুকু সফলতা লাভ করেছে তা বিতর্কিত।
অক্টোবর, ২০০৫ সালে শর্মিলা বসু তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ক্ষয়-ক্ষতি ও ধর্ষণের অভিযোগগুলো ব্যাপক অর্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।[২৬][৭৩] ঐ নিবন্ধের ভুল বিশেষতঃ পরিসংখ্যানগত উপাত্ত, তথ্যসূত্রের ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন।[৭৪]
২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চিলড্রেন অব ওয়ারে পাকসেনাদের ধর্ষণ কেন্দ্রের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ তুলে ধরা হয়েছে।[৭৫]
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাকসেনাদের বিশেষ লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছিলেন।[৪১][৫১] এ সময়ে ব্যাপকহারে হিন্দু পুরুষদেরকে হত্যাসহ মহিলাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। চুকনগর গণহত্যা, জাতিভাঙ্গা গণহত্যা ও শাঁখারীপাড়া গণহত্যাসহ বিভিন্নস্থানে হিন্দুদেরকে হত্যার ঘটনা দলিলপত্রে উল্লেখ রয়েছে।[৭৬] প্রাণ রক্ষার্থে ভারতে গমনকারী অগণিত শরণার্থীদের ৬০% এর অধিক হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিলেন।[৭৭] তবে পাকসেনাদের হাতে কত শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠী প্রাণ হারিয়েছেন তার প্রকৃত চিত্র জানা না গেলেও সংখ্যাটি যে ব্যাপক ছিল তা সন্দেহাতীত।[৭৮] পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সহিংসতা পরিচালিত হয় মূলতঃ হিন্দুদেরকে বিতাড়ন ও ভারতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালী সংস্কৃতিকে হিন্দু ও ভারতীয় সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা ভেবেছিলেন যে, হিন্দুদেরকে বিতাড়িত করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মাঝে প্রভাব ফেলবে।[৭৯] ঐ বছরেই বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাও তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।[৮০]
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর.জে. রুমেলের মতে,
“ | নিচেরসারির কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈনিকেরা গণহত্যা কর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। বাঙালীদের মাঝে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে তাঁরা স্বেচ্ছায় ইন্ধন জুগিয়েছেন। বাঙালীদেরকে তাঁরা প্রায়শঃই বানর ও মুরগীর বাচ্চার সাথে তুলনা করতেন। জেনারেল নিয়াজী বলেছিলেন, এ নিচু স্থানটিতে নিচু স্তরের লোক বাস করে। বাঙালীদের মাঝে অবস্থানকারী হিন্দুরা ইহুদি থেকে নাৎসিবাদে জড়িত। মুসলিম বাঙালীরা কেবলমাত্র তাঁদের ভাবধারা অনুসরণ করবে; নচেৎ মৃত্যুমুখে পতিত হবে। সৈনিকেরা যে-কাউকে হত্যা করতে পারবে। সাংবাদিক ড্যান কগিন এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্বৃতি দিয়ে বলেছেন যে, তাঁরা যে-কোন কিছুর জন্যে যে-কাউকে হত্যা করতে পারেন।[৮১] | ” |
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন সন্ত্রাসের শিকার অনেক বিহারী মুসলিম প্রাণরক্ষার্থে ভারত থেকে অভিবাসিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। ঐ সকল উর্দুভাষী ব্যক্তি বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে ও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনার্থে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় একাত্মতা পোষণ করে। ফলে স্থানীয় জাতীয়তাবাদী বাঙালীদের মাঝে বিহারী বিরোধী জনমত গড়ে উঠে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিহারীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে। তাদের কেউ কেউ রাজাকার ও আল শামসের ন্যায় আধা-সামরিকবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা বাঙালীদেরকে হত্যাসহ বাঙালীদের সম্পদ লুটতরাজ ও অন্যান্য অপরাধে শামিল হয়।[৫১]
আওয়ামীলিগপন্থী আধা-সামরিকবাহিনীকে ব্যাপকসংখ্যক বিহারী ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিধনে অভিযুক্ত করা হলেও এ সকল অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। রুডল্ফ রামেল হিসেব কষে দেখিয়েছেন যে, ১,৫০,০০০ অ-বাঙালী গণহত্যার শিকার হয়েছেন। তবে এ সংখ্যাটি সর্বনিম্ন ৫০,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫,০০,০০০ হতে পারে।[৮২] অন্যদিকে 'দ্য মাইনরিটিজ অ্যাট রিস্ক প্রজেক্ট' অনুসারে প্রায় বিহারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।[৮৩]
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে পাকবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পরও বিহারী ও তাদের দোসরদেরকে গণহত্যার কবলে পড়ার অনেকগুলো ঘটনার বিষয় ঘটে।[৮৪] ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে এ জাতীয় ঘটনা বিদেশী সংবাদসংস্থার সাংবাদিকদের সম্মুখে আলোকচিত্রে ধরা পড়ে। রাজাকার নামে পরিচিত একদল যুদ্ধবন্দীকে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও তার অধীনস্থ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলেন।[৮৫][৮৬] কিন্তু, আবদুল কাদের সিদ্দিকী পরবর্তীকালে তার রচিত গ্রন্থ 'স্বাধীনতা৭১'-এ উল্লেখ করেছেন যে, ঐ বন্দীরা দুই অ-বাঙালী মেয়েকে অপহরণ করায় তারা বেয়নেটবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়াও ঐ সময়ে কোন প্রচলিত বিচার-ব্যবস্থা ছিল না। যারফলে তারা হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন।[৮৭]
টাইম সাময়িকী ঊর্ধ্বতন এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, পোল্যান্ডে নাৎসি বাহিনীর আক্রমণের পর এটি সর্বাপেক্ষা অবিশ্বাস্য ও সংখ্যাগত দিক।[৮৮] গণহত্যা পরিভাষাটি বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা ও সংবাদপত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।[৮৯][৯০] গোত্র, সম্প্রদায়, ধর্ম কিংবা জাতীয়তাবাদী দলকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসাত্মক কার্য সাধনের বিষয়টি সঠিকতার সাথে ব্যবহার করা হয়েছিল।[৯১]
১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী কমিশনের (আইসিজে) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, উভয় পক্ষই একে-অপরের উপর পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে গণহত্যার ন্যায় কু-কর্ম করার অভিযোগ এনেছে। ঐ প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, দাবীর স্বপক্ষে ক্ষয়-ক্ষতি প্রমাণ করা কঠিন। পুরো সামরিক কার্যক্রম ও দমন-নিপীড়নমূলক কার্যক্রম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়ক বাহিনী গণহত্যায় জড়িত ছিল। এরফলে, বাঙালী জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে নির্মূল করার প্রয়াস চালানো হয়। রাজনৈতিক স্বাধীকারের বাস্তবায়ন ঘটলে হয়তোবা এ জাতিকে রক্ষা করা যেতো ও গণহত্যা কার্যক্রম সংঘটিত হতো না। প্রমাণের বিষয়টি আরও দূরূহ হয়ে পড়ে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী দোসরেরা বাঙালী জনগোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট তিনটি ভাগে বিভক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এ তিনটি অংশ হলো: আওয়ামীলিগের সদস্য, ছাত্র ও পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুধর্মীয় জনগোষ্ঠী। প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, প্রধান পরিচিত ব্যক্তিদেরকে এর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলেও যুদ্ধের শেষদিকে নির্বিচারে বাঙালীদেরকে গণহত্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। একইভাবে, ধারণা করা হয় যে, গণহত্যার ন্যায় অমানবিক অপরাধে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু জনগোষ্ঠী এর শিকারে পরিণত হয়েছিলেন।[৯২]
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ও যুদ্ধের পর বাঙালীদের হাতে অ-বাঙালীদের গণহত্যার বিষয়ে আইসিজে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রমত্ত উচ্ছৃঙ্খল জনগণের দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকারে পরিণত সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট অংশে সংঘটিত উচ্ছৃঙ্খলতা ও শত্রুতার মাধ্যমে গণহত্যার অপরাধের প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাবে প্রমাণ করা অসম্ভব।
গণহত্যা সম্মেলনে কমপক্ষে ২০ দেশের অংশগ্রহণের পর ১২ জানুয়ারি, ১৯৫১ তারিখে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। ঐ সময় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের মাত্র দুই দেশ ঐ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৮৮ সালে পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র এতে যুক্ত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর গণহত্যার অপরাধের সাথে জড়িত আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। ফলশ্রুতিতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগের বিষয়টি জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে থাকা আন্তর্জাতিক বিচারসভা কখনো তদন্তের জন্য অগ্রসর হয়নি।
এমনকি মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন এবং মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পুরোপুরি স্থগিত রাখার বিষয়ে হুশিয়ারী বার্তা প্রদান করেছিলেন।[৯৩] গণহত্যার বিষয়টিতে উপমহাদেশের বাইরে বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা উল্লেখ করেছে। গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে বাঙালীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার বিষয়টিকে বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত পাঁচটি বৃহৎ গণহত্যার অন্যতমরূপে তুলে ধরা হয়।[৯৪]
১৬ ডিসেম্বর, ২০০২ তারিখে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা সংরক্ষণাগার থেকে প্রকাশিত শ্রেণীবিহীন নথিপত্রের সংগ্রহশালা উন্মুক্ত করা হয়। এর অধিকাংশই দূতাবাসগুলোয় মার্কিন কর্মকর্তাদের এবং ঢাকা ও ভারতের ইউসিস কেন্দ্রের ও ওয়াশিংটন ডিসি’র কর্মকর্তাদের কার্যাবালীকে ঘিরে।[৪০] ঐ সকল নথিপত্রে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন কর্মকর্তাগণ পরিকল্পিত গণহত্যা পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। গণহত্যা চলাকালে ব্লাড টেলিগ্রামে তাদের জানামতে ঐ সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোর বিবরণ উল্লেখ করেছেন। এতে হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শমাফিক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন এ জাতীয় গোপনীয় অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী আড়াল করে গেছেন। কেননা, তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ও ভারতের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ছিলেন এবং পাকিস্তানকে সহায়তাকারী প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে পক্ষপাতী ছিলেন।[৯৫]
ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে বিশদভাবে বাঙালীদের স্বাধীনতায় কিসিঞ্জারের বিরোধিতার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন। ক্রিস্টোফার হিচেন্স এ সংঘাতের ফলাফলকে যে শুধুমাত্র গণহত্যা পরিভাষা ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি; বরঞ্চ অন্যান্যদের দাবীকৃত নৃশংসতাকে গণহত্যার দিকে নিয়ে যাবার অভিযোগকেও এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষক ফেলো শর্মিলা বসু বলেছেন, অনেক সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিক নৃশংস কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ও পাকিস্তানি সামরিকবাহিনী একাই এ কাজটি করেনি। ভারত ও বাংলাদেশে তার গ্রন্থটি ব্যাপকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করে। এছাড়াও তিনি মন্তব্য করেন যে, মৃত্যুর সংখ্যা অতিরঞ্জিত ছিল।[৯৬]
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান সরকার প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে "গণহত্যা এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক সকল ঘটনা এবং অবস্থার পুর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি" এবং সেই সঙ্গে "পূর্ব হাইকমান্ডের কমান্ডার কোন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে" তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বিচারপতি হামুদুর রহমান ২৩ অক্টোবর, ১৯৭৪ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে জমা দেন। অনেককাল পরে, ২০০০ সালে, প্রথমবারের মতো কমিশনের রিপোর্ট জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা হয়।
কমিশন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অযাচিত এবং উচ্ছৃঙ্খলভাবে অগ্নিসংযোগ, সারাদেশে হত্যাকাণ্ড, বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবী হত্যা এবং গণকবর দেয়া, বাঙ্গালী অফিসারদের বিদ্রোহের কারণে হত্যা, পূর্ব পাকিস্তানি অসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবস্যায়ী ও শিল্পপতিদের হত্যা, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বিপুলসংখ্যক বাঙ্গালী নারীকে ধর্ষণ এবং ইচ্ছাকৃত কারণে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত করে। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দাবীকৃত পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩০ লাখ মানুষ হত্যা এবং ২ লাখ ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। কমিশনের অভিমত হতাহতের সংখ্যা ২৬,০০০।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.