Loading AI tools
বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের শহীদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (১০ জুলাই, ১৯২০ - ৩০ মার্চ, ১৯৭১) একজন বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ। তার অন্যতম পরিচয় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের একজন।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (বর্তমানের বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ জেলায়। তার পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায়। তার বাবার নাম কুমুদচন্দ্র গুহঠাকুরতা এবং তিনি পেশায় ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক।
১৯৩৬ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এসসি. কোর্সে ভর্তি হন। এক বছর সেখানে পড়াশোনা করার পর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে আই.এ.-তে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাশ করেন। এরপর তিনি ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত[1] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৪২ সালে তিনি বি.এ. (সম্মান) বা স্নাতক এবং ১৯৪৩ সালে এম.এ. (মাস্টার্স) বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এম.এ. পাশ করার পরপরই ১৯৪৩ সালে গুরুদয়াল কলেজে প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে ইংরেজি বিভাগের লেকচারার পদে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক হিসেবে ফেলোশিপ নিয়ে তিনি লন্ডন গমন করেন এবং ১৯৬৭ সালে লন্ডন কিংস কলেজ থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার পদে উন্নীত হন।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের রেডিকেল হিউম্যানিজমে মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজচিন্তামূলক অনেক প্রবন্ধ লেখেন। দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজে তিনি অগ্রগণ্য বিবেচিত হতেন। সুইনবার্ণ, স্টার্জ মুর অ্যান্ড এলিয়ট নামের যে অভিসন্দর্ভ তিনি পি.এইচ.ডি-র জন্য লেখেন, তা ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়।
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অবস্থায় কর্মরত থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার সময় তিনি ঢা.বি.-এর জগন্নাথ হলে আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ ও আহত হন, এবং চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩০ মার্চ, ১৯৭১-এ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৩৪ /এ নম্বর কোয়ার্টার থেকে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামানকে বের করে এনে কোয়ার্টারের সামনেই গুলি করে। মুনীরুজ্জামান ঘটনাস্থলেই নিহত হন কিন্তু জ্যোতির্ময় মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে রক্তস্নাত অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে টেনে ঘরে নিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা, মেয়ে স্কুলছাত্রী মেঘনা আর বাড়ির কাজের মেয়ে স্বর্ণা। একটি পুরো রাত এবং পরের পুরোটা দিন আপ্রাণ চেষ্টায় ঘরের ভেতর রেখে শুশ্রূষা দিতে থাকেন। ২৭ তারিখ ভোরে কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য শিথিল হলে মরিয়া হয়ে অচেনা এক পথচারী নারীকে ডেকে একটা চিরকুট লিখে বাসন্তী গুহঠাকুরতা অনুরোধ করেন ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দিতে। চিরকুট পেয়ে হাসপাতালের কর্মীরা স্ট্রেচারে করে নিয়ে যান অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে। সেদিন দুপুরে অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে ইমার্জেন্সি থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো সার্জারি বিভাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে। তিনি ভর্তি হলেন ডা. মতিউর রহমানের অধীনে এবং ডা. আলী আশরাফের ইউনিটে। অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমানের ভাষ্যে, সঙ্গে কথা বলি, তিনি স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন সেদিনের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে। তিনি বলেন, মেরুদণ্ডে গুলি লাগায় জ্যোতির্ময়ের তখন প্যারাপ্লেজিয়া হয়ে গিয়েছিল। হাত-পা সবই ছিল অবশ। ছিল সেপটিসেমিয়া, অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তে আর দুদিন ধরে রক্তক্ষরণে তাঁর শরীরের অবস্থা ছিল সঙিন। ২৮ মার্চ জ্যোতির্ময়কে বন্ধু ডা. টি হোসেন তাঁর প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা আর সম্ভব হয়নি। ২৯ তারিখ থেকে জ্যোতির্ময়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৩০ মার্চ সকালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ডা. টি হোসেন ঢাকা মেডিকেলে অ্যাম্বুলেন্স পাঠান লাশ নিতে। কিন্তু এ ধরনের গুলি ও অপঘাতের মৃত্যু হাসপাতালে ‘পুলিশ কেস’ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকে এবং সে ক্ষেত্রে লাশ নিতে স্থানীয় থানার অথবা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন লাগে। ঢাকা মেডিকেল তখন রমনা থানার অধীনে। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রমনা থানায়ও হত্যাযজ্ঞ চালানোয় থানা তখন অকার্যকর। তা ছাড়া কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগেরও তখন পরিস্থিতি নেই। হাসপাতালে তখন টহলে আছে পাকিস্তানি সেনা। যথাযথ নিয়ম না মেনে লাশ বাইরে নেওয়া দুরূহ। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহ পড়ে থাকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায়। ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। গুমোট আর বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখে বাসন্তী গুহঠাকুরতা চলে আসেন হাসপাতাল থেকে। পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্ময়ের সন্ত্রস্ত পরিবার তাদের ড্রাইভার গোপালকে পাঠায় লাশ নেওয়ার জন্য। পরপর দুই দিন গিয়েও লাশ হাসপাতাল থেকে ছাড়াতে পারেননি গোপাল। ৫ এপ্রিল হাসপাতালে গিয়ে গোপাল জানতে পারেন ড. জ্যোতির্ময়ের লাশ হাসপাতালে নেই। লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটি কেউ বলতে পারে না। গোপালকে ভবিষ্যতে হাসপাতালে যেতেও বারণ করা হয়।
হাসপাতালে তাঁর ভর্তি নিবন্ধন নম্বর ১৪৪৪ / ১২। মৃত্যুর সময় উল্লেখ আছে ৩০ মার্চ, সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। লাশ কে নিয়েছে, এ প্রশ্নের কলামে লেখা ছিল, ‘পুলিশ’, নিচে একটি লাল দাগ দেওয়া। জ্যোতির্ময়ের লাশ তাঁর পরিবার হাতে পায়নি। লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে, আদৌ কোনো সৎকার হয়েছে কি না, তা কোনো দিন আর জানতে পারেনি পরিবার।[2]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.