মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী (হাফেজ্জী হুজুর নামেও পরিচিত; ১৮৯৫ – ৭ মে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ; ১৩১৩ – ৮ রমজান ১৪০৭ হিজরি) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামি পণ্ডিত ও সুফিবাদী রাজনীতিবিদ। সারাজীবন আধ্যাত্মিক সাধনা, জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষাবিস্তারে কাটানোর পর শেষ বয়সে তিনি রাজনীতিতে আগমন করেন।[5] জীবন সায়াহ্নে তার রাজনীতিতে আগমনকে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[6] তিনি খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সকলকে তওবা করার ডাক দিয়ে দুইটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি দলটির ১ম আমীর ছিলেন। তাকে তওবার রাজনীতির প্রবর্তক বলা হয়।[2][7] তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।[8] এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং সেজন্য তিনি সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।[9] তাকে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেওবন্দি আলেম বিবেচনা করা হয়।[3]
আমীরে শরিয়ত মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী | |
---|---|
১ম আমীর, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন | |
কাজের মেয়াদ ২৯ অক্টোবর ১৯৮১ – ৭ মে ১৯৮৭ | |
উত্তরসূরী | আহমাদুল্লাহ আশরাফ |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | ১৮৯৫ লুধুয়া, রায়পুর |
মৃত্যু | ৭ মে ১৯৮৭ ৯১–৯২) সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা | (বয়স
সমাধিস্থল | মাকবারায়ে হাফেজ্জী হুজুর |
জাতীয়তা |
|
রাজনৈতিক দল | বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন |
অন্যান্য রাজনৈতিক দল | সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ |
দাম্পত্য সঙ্গী |
|
সন্তান | ৪ ছেলে ও ৬ মেয়ে; আহমাদুল্লাহ আশরাফ ও আতাউল্লাহ হাফেজ্জী সহ |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী | |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
পিতামাতা |
|
আখ্যা | সুন্নি |
ব্যবহারশাস্ত্র | হানাফি |
আন্দোলন | দেওবন্দি |
প্রধান আগ্রহ | |
উল্লেখযোগ্য ধারণা | তওবার রাজনীতি[2] |
উল্লেখযোগ্য কাজ | |
শিক্ষক | আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, ইজাজ আলী আমরুহী, কারী মুহাম্মদ তৈয়ব, বদরে আলম মিরাটি |
অন্য নাম | হাফেজ্জী হুজুর[3] |
ঊর্ধ্বতন পদ | |
এর শিষ্য | আশরাফ আলী থানভী[4] |
যাদের প্রভাবিত করেন |
মাজাহির উলুম সাহারানপুর ও দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে তিনি দেওবন্দের অনুকরণে বড় কাটরা মাদ্রাসা, লালবাগ মাদ্রাসা, ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, মাদ্রাসায়ে নূরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।[10] কথিত আছে, হাজার হাজার হাফেজী ও কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।[3] তিনি আশরাফ আলী থানভীর খলিফা ছিলেন। আধ্যাত্মিক সংগঠন মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল। তার শিষ্যদের মধ্যে আজিজুল হক, সৈয়দ ফজলুল করিম, ফজলুল হক আমিনী, আবদুল হাই পাহাড়পুরী অন্যতম।[11]
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
মুহাম্মদুল্লাহ ১৮৯৫ সালে সাবেক নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার লুধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[12][13] তার পিতার নাম ইদ্রিস ও মাতা খাদিজা। তার দাদা আকরামুদ্দিন সৈয়দ আহমদ বেরলভির খলিফা ছিলেন।[14] ৯ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তার বোনের সংখ্যা ৫ জন।[15] শুরুতে চাচা ইউনুসের কাছে তিনি কুরআন ও ফার্সির প্রাথমিক কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। ইশ্বরচন্দ্র পণ্ডিতের কাছে বাংলা ভাষার পাঠ নেন।[16] দুলারচর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফতেপুর উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল পড়ার পর তিনি চন্দ্রগঞ্জের বায়তুল আমান জামে মসজিদ মাদ্রাসায় মৌলভি ওসমানের কাছে পড়াশোনা আরম্ভ করেন।[17] তারপর কিছুকাল লাকসামের নবাববাড়ি মাদ্রাসা[18] ও খিলবাইছা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে ১৯১৩ সালে তিনি পানিপথে চলে যান।[19] পানিপথে কারী আব্দুস সালাম ও কারী আকতার হুসাইনের কাছে তিনি কুরআনের হেফজ ও তাজবিদ অধ্যয়ন করেন।[20] হাফেজ হওয়ার পর তার শিক্ষক তাকে ‘হাফেজ্জী’ বলে ডাকতে শুরু করেন। তখন থেকে তিনি এই উপাধিতে প্রসিদ্ধি পান।[21] পানিপথে অবস্থানকালে আশরাফ আলী থানভীর সাথে তার পরিচয় ঘটে।[22] ১৯১৬ সালে পানিপথ ত্যাগ করে তিনি থানা ভবন চলে যান, থানভীর পরামর্শে ভর্তি হন মাজাহির উলুম সাহারানপুর মাদ্রাসায়।[23] মাজাহির উলুমে অধ্যয়নকালে তিনি নিয়মমাফিক থানা ভবন যেতেন এবং থানভীর সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিকতা চর্চা করতেন। এ পথে তার সঙ্গী ছিলেন শামসুল হক ফরিদপুরী।[24] মাদ্রাসার নিয়মতান্ত্রিক ক্লাসের পাশাপাশি তিনি সাহারানপুরের প্রসিদ্ধ কারী আব্দুল মালেকের কাছে কেরাত শাস্ত্রের উচ্চতর সনদ লাভ করেন।[25] থানা ভবন গেলে তিনি থানভীর বহু খলিফা ও শিষ্যদের কেরাত শিক্ষা দিতেন। ১৯২০ সালের ৮ জুন মাহমুদ হাসান দেওবন্দির কারামুক্তি উপলক্ষে আয়োজিত ঐতিহাসিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি দেওবন্দির সাথে মুসাফাহা করেন।[26] ১৯২৩ সালে তিনি মাজাহির উলুমে দাওরায়ে হাদিস (স্নাতক) সমাপ্ত করে মাতৃভূমি বাংলায় চলে আসেন।[27][28] ১৯২৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করে উচ্চতর অধ্যয়ন শুরু করেন।[29] দেওবন্দে তিনি আনোয়ার শাহ কাশ্মীরির কাছে হাদিস ও ইজাজ আলী আমরুহীর কাছে ফিকহ শাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করেন।[30] তার অন্যান্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: বদরে আলম মিরাটি, কারী মুহাম্মদ তৈয়ব, রসূল খান প্রমুখ।[31] দেওবন্দে ১ বছর পড়ে তিনি থানভীর সান্নিধ্যে খানকাহ এমদাদিয়ায় চলে যান, ৬ মাস সেখানে অবস্থান করেন।[32][33]
কর্মজীবন
শামসুল হক ফরিদপুরীর চিঠি পেয়ে থানভীর অনুমতিতে তিনি থানা ভবন থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসেন এবং মাদ্রাসায়ে বাহরুল উলুম বর্তমানে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।[34] শিক্ষকতাকালে রায়পুর নিবাসী হাফেজ ত্বহার কন্যা সিদ্দিকা খাতুনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।[35] ১৯৩০ সালে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের সাথে হাফেজ্জী, ফরিদপুরী ও আবদুল ওয়াহহাব পীরজীর মতানৈক্য দেখা দেয়। তাই তারা তিনজন মিলে বাগেরহাটের এক অজ পাড়াগাঁ গজালিয়ার একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো মাদ্রাসা পুনরায় আবাদ করেন।[36] পল্লী এলাকায় মাদ্রাসাটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় তারা ১৯৩৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম, বড় কাটরা প্রতিষ্ঠা করেন।[37] ইতিমধ্যে তার স্ত্রীবিয়োগ হওয়ায় তিনি হাফেজ ত্বহার ষষ্ঠ কন্যা খাদিজা খাতুনের সাথে দ্বিতীয়বারের মত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।[38] এ সংসারে তার ৪ ছেলে ও ৫ মেয়ে জন্মগ্রহণ করে।[39] এরপর তিনি হজ্জে গমন করেন। হজ্জ থেকে ফেরার কিছুদিন পর থানভী তাকে খেলাফত প্রদান করেন। খেলাফত প্রাপ্তির পর তিনি আমভাবে মুরিদ করতেন না।[40]
তিনি লালবাগ শাহী মসজিদের ইমাম ছিলেন। বড় কাটরা মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি এই মসজিদে তিনি একটি আদর্শ হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। হেফজখানার শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি পানিপথের পদ্ধতি অনুসরণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রচলিত সকল হেফজখানায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।[41] এছাড়াও বর্তমানে সারাদেশে প্রচলিত মক্তব শিক্ষা ও কুরআন হিফজের বিশাল পরিধির পেছনে তার বিশেষ অবদান রয়েছে।[2]
বড় কাটরা মাদ্রাসা পরিচালনা নিয়ে মাদ্রাসার পরিচালক আবদুল ওয়াহহাব পীরজী ও শামসুল হক ফরিদপুরীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে ফরিদপুরী মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি নেন।[42] তিনি ফরিদপুরীকে তার প্রতিষ্ঠিত লালবাগ শাহী মসজিদ সংলগ্ন হেফজখানায় আমন্ত্রণ জানান। ফরিদপুরী আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে তিনি বড় কাটরা মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি নিয়ে ফরিদপুরীর সাথে ১৯৫০ সালে জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ প্রতিষ্ঠা করেন।[43] ১৯৫৬ সালে ফরিদপুরীর সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ।[44] ১৯৬৫ সালে একক প্রচেষ্টায় তিনি কামরাঙ্গীরচরে জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।[45] মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।[46]
১৯৭৮ সালের ২৫ মে তার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিসমিল্লাহ যুক্ত করা সহ সংবিধানের নানাবিধ সংস্কারের জন্য তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের কিছু সমস্যা তুলে ধরেন। ২৯ মে তার মৌখিক বক্তব্যগুলো আরও পূর্ণাঙ্গ অবয়বে বর্ণনা করে রাষ্ট্রপতিকে একটি খোলা চিঠি দেন।[47][6] ১৯৮০ সালে তাকি উসমানি প্রথমবারের মত ঢাকায় আগমন করলে তিনি তাকে মাদ্রাসায় আমন্ত্রণ জানান এবং তার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হককে একটি চিঠি দেন।[48]
রাজনৈতিক জীবন
১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সৃষ্ট শূন্যপদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার রাজনীতিতে আগমন।[49] জীবন সায়াহ্নে তার রাজনীতিতে আগমনকে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[6] তার রাজনীতিতে আগমনের পূর্বে বাংলাদেশের আলেম সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা ছিল, তার সূচিত তওবার রাজনীতি এই ধারণাটি পাল্টে দেয়।[6][50] আলেমদের পক্ষ থেকে নির্বাচনে লড়ার জন্য তিনি ঢাকার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একত্রিত করে কয়েকবার বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮১ সালের ২৪ আগস্ট তিনি প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[51] ২৫ আগস্ট লালবাগ শাহী মসজিদে তার প্রার্থীতার কথা বিঘোষিত হয়।[52] নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে তার মার্কা ছিল বটগাছ।[53] জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ সহ অনেকেই তাকে সমর্থন করে।[54] ২৫ সেপ্টেম্বর বায়তুল মোকাররম চত্বরে তার উদ্বোধনী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।[55] ২০ অক্টোবর তিনি ১৮ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন।[56] ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে তার শেষ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।[57] ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তবে এ নির্বাচনে তিনি কারচুপির অভিযোগ তুলেন।[58] তৃতীয় স্থান অধিকার করলেও কিছু প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দলের চেয়ে বেশি ভোট পাওয়ায় তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে খুবই আলোচিত হয়ে উঠেন।[53]
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন
১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর শায়েস্তা খান হলে তিনি একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামে তার নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন।[59] এরপর তিনি ইসলাম ও স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের সবাইকে তওবার আহ্বান জানান।[59] বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এরশাদ সরকার বিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও দলটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মিছিল, সমাবেশ, বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে।[60]
আন্তর্জাতিক ফোরামে
১৯৮১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও দল গঠনের পর তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক আলােচিত হন এবং কূটনৈতিক মহলসহ বিদেশেও তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।[61] এসময় তিনি ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া ও আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ পান।[62] সেসময় ইরান ও ইরাকের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। তিনি পরামর্শ সভা ডেকে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ দুটির যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় নিয়ে আলােচনার উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে তিনি ইরান–ইরাক শান্তি মিশন শুরু করেন।[61] ১৯৮২ সালের ২ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি ইরান গমন করেন। ৩ সেপ্টেম্বর ইরানের মেহেরাবাদ বিমানবন্দরে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর এক প্রতিনিধি দল কর্তৃক বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। আটদিনের ইরান সফরে ৫ সেপ্টেম্বর তিনি ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকারের সাথে বৈঠক করেন। ৬ সেপ্টেম্বর ইরানি বিপ্লবের দ্বিতীয় ব্যক্তি আয়াতুল্লাহ মোন্তাজেরির সাথে বৈঠক করেন।[63] ৭ সেপ্টেম্বর ইরানের রাষ্ট্রপতি আলী খামেনেয়ীর সাথে বৈঠক করেন।[64] বৈঠকের পর আসরের ওয়াক্তে আলী খামেনেয়ী তাকে তেহরান মসজিদে ইমামতির জন্য এগিয়ে দেন। ৮ সেপ্টেম্বর তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর সাথে সাক্ষাৎ করেন।[65] ১০ সেপ্টেম্বর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠিত বিশাল জুমার নামাজে তার পক্ষ থেকে আজিজুল হক খুতবা প্রদান করেন।[66] ১২ সেপ্টেম্বর তিনি ইরান ত্যাগ করে হজ্জে চলে যান। ৫ অক্টোবর শান্তি মিশনের বার্তা নিয়ে তিনি ইরাক গমন করেন। ইরাকের তথ্যমন্ত্রী ও ওয়াকফ মন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর ৯ অক্টোবর তিনি রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাদ্দাম হোসেন তাকে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করেন, তিনিও তার উত্তর দেন।[67]
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাতে তিনি ইরান–ইরাকের ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ বন্ধ এবং কুরআন –সুন্নাহর ভিত্তিতে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানান।[68] ইরান ও ইরাক শান্তি স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হলেও চুক্তিটি কার্যকর হয় নি। তার শান্তিমিশন সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে শান্তি মিশনের ব্যাপারে উভয় দেশের সরকার প্রধান ও নীতি নির্ধারকদের ভুল বােঝাবুঝির শিকার হওয়া ছাড়াও দেশ দুটির মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দীর বৈরী সম্পর্ক এবং শিয়া–সুন্নি আকিদাগত পার্থক্যও বিরাট ভূমিকা রেখেছে।[68] তার এই শান্তি মিশন নিয়ে অধ্যাপক আখতার ফারুক মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর শীর্ষক একটি বই রচনা করেন।[69]
১৯৮৫ সালের জুলাই–আগস্টে কালিম সিদ্দিকীর উদ্যোগে লন্ডন মুসলিম ইনস্টিটিউট আয়ােজিত ৫ দিন ব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন। প্রায় একশটিরও অধিক দেশের বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ এ সম্মেলনে যােগদান করেন। উক্ত সেমিনারে খেলাফত কায়েমের লক্ষ্যে তিনি ৫ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।[68]
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন
১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই তিনি একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি সহ ৩৪ দল এই বৈঠকে যোগদান করে।[70] বৈঠক থেকে তিনি সরকারকে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা সহ তিন দফা দাবি পেশ করেন এবং তা বাস্তবায়নে ৬ মাস সময় বেঁধে দেন।[71][72] সময়সীমা ঘনিয়ে এলে ১৪ ডিসেম্বর তিনি একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন।[73] এই সম্মেলন থেকে দাবি বাস্তবায়িত না হলে তিন দফায় নিজের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন।[74] ১৩ ডিসেম্বর তিনি এরশাদকে খোলা চিঠি দেন।[72] ১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর তার নেতৃত্বে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদে ১০টি দল যোগ দেয়।[75] ২৬ অক্টোবর পরিষদের দেশব্যাপী দুআ দিবস ঘোষিত হয়। এইদিন বায়তুল মুকাররম চত্বরে পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে মোহাম্মদ আব্দুল জলিল তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন।[76]
এরশাদ সরকার ঘােষিত নীতি এবং কর্মসূচির ব্যাপারে জনগণের মতামত নেয়ার উদ্দেশ্যে গণভােট গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তার রাজনৈতিক দল খেলাফত আন্দোলন থেকে বিরােধিতা করেন। গণভােট অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ পূর্বে ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ বায়তুল মােকাররমে আহুত খেলাফত আন্দোলনের সমাবেশ সরকারের বাধার মুখে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সরকার খেলাফত আন্দোলন এবং সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে এবং নেতা কর্মীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। এসময় সরকার তাকে গৃহবন্দি করে রাখে।[77]
সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ
তার নেতৃত্বে ১০টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠন উপলক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়ােজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন,
“ | সংগ্রাম পরিষদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের কুরআন–সুন্নাহ ভিত্তিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা এবং আশু লক্ষ্য হচ্ছে অনতিবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানাে, হক্কানী উলামায়ে কেরাম, ইসলামি চিন্তাবিদ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন, বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘােষণা। | ” |
— [78] |
তিনি এরশাদ সরকারের শাসনকে অবৈধ অনৈসলামিক শাসন আখ্যা দেন এবং তাকে উৎখাত করার জন্য সবাইকে জিহাদে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।[78]
১৯৮৪ সালের ১১ অক্টোবর মানিক মিয়া এভিনিউতে জনদলের জনসভায় ইসলামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এরশাদের আহ্বানের পর সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জরণ উঠে এরশাদের আহ্বানে বিরােধীদলের আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য এই পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে পরিষদের অন্যতম নেতা আব্দুর রহিম বলেন, এরশাদের আহ্বানের কারণে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়নি।[78] পরবর্তীতে এ জোটের নামকরণ করা হয় খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ।
১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এরশাদ বিরোধী অন্যান্য দলগুলো এই নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
“ | প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমি এক নীতির ওপর অটল আছি। এ সরকারের কোন পদক্ষেপই চ্যালেঞ্জহীন হতে দেইনি। তাই নির্বাচনে তাকে (এরশাদকে) মােকাবেলার জন্যেই প্রার্থী হয়েছি। | ” |
— [79] |
নির্বাচনে তিনি ১৫১০৪৫৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। শতকরা হিসেবে যা ৫.৬৯%।[80]
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৯৮৭ সালের ২৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তিনি পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ৭ মে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[81] ৮ মে জাতীয় ঈদগাহে আহমাদুল্লাহ আশরাফের ইমামতিতে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাকে মাদ্রাসায়ে নূরিয়া সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।[82] আবু সাঈদ চৌধুরী, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, মুহাম্মদ আবদুল মান্নান প্রমুখ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।[7]
ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ গুলিস্তানের নগর ভবন সংলগ্ন ফিনিক্স রোডের নাম পরিবর্তন করে ‘মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) রোড’ নামকরণ করেছিলেন।[2] তবে ২০১৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নামকরণ বাতিল করে।[83] তার স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্জুমানে খোলাফায়ে হাফেজ্জী হুজুর, হাফেজ্জী হুজুর সেবা সংস্থা, হাফেজ্জী হুজুর রহমাতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ কমপ্লেক্স, লালবাগ হাফেজী হুজুর সারণি কেল্লার মোড়, হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) গবেষণা ফাউন্ডেশন, হাফেজ্জী হুজুর ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি ইত্যাদি।
২০০৫ সালে হাফেজ্জী হুজুর স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।[84] ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) : তাঁর রাজনীতি ও সমাজ সংস্কার’ শীর্ষক একটি পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তার জীবন-কর্মের উপর অন্যান্য কাজ সমূহের মধ্যে রয়েছে: ‘আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.–নাসীম আরাফাত’, ‘হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. জীবনী–মুহাম্মদ আবদুল হক’, ‘মধ্যপ্রাচ্যে হাফেজ্জী হুজুর–আখতার ফারূক’, ‘আমীরে শরীয়ত হযরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.–সালাহ উদ্দীন জয়নাল ও মুজিবুর রহমান হামিদী’, ‘কারামতে হাফেজ্জী হুজুর রহ.–ফখরুল ইসলাম’, ‘ছোটদের হাফেজ্জী হুজুর রহ.–মো. খালেদ’, ‘হেদায়েতে মাজালিসে হাফেজ্জী হুজুর রহ.–মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ’, ‘হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা–হাফেজ্জী হুজুর ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি’, ‘হাফেজ্জী হুজুরের গোলটেবিল বৈঠক–হাবিবুর রহমান, ‘হাফেজ্জী রহ. রচনা সমগ্র–হাফেজ্জী হুজুর গবেষণা ফাউন্ডেশন’ ইত্যাদি।[85]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.