Remove ads
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সমকামিতার জীববৈজ্ঞানিক কারণ সম্বন্ধে বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ উভয়ের নিকট সমভাবে কৌতূহল থাকলেও এখনো পর্যন্ত সমকামপ্রবণতার সুনিশ্চিত জীববৈজ্ঞানিক কার্যকারণ সূত্র আবিষ্কৃত হয় নি। সমকামিতার সাথে বিজ্ঞান বিশেষ করে জীববৈজ্ঞানিক (প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে জীববিজ্ঞান ও যৌন অভিমুখিতা বলা হয়) সম্পর্ক আছে কী নেই, থাকলে কতটুকু আছে - তা নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। একজন মানুষ কেন সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তার কোনো একক নির্ণায়ক (জিন, হরমোন ইত্যাদি) অদ্যাবধি কোনো গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা সমলিঙ্গের প্রতি যৌনাকর্ষণের পেছনে সামাজিক নির্ণায়ক (social factor) ও জীববৈজ্ঞানিক উভয়বিধ কারণ যুগপৎ সক্রিয়। মানুষের স্বভাব গঠনে ক্রিয়াশীল জিন ও হরমোন এবং সামাজিক নির্ণায়কসমূহ (social factor) মিশ্রিতভাবে এই যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণ করে থাকে বলে বিজ্ঞানীগণ মত দিয়েছেন।[১][২][৩]
একটি অনুকল্প মতে, অন্ততপক্ষে পুরুষ সমকামী না বিষমকামী হবে তা নির্ধারণ জন্মের পরে পরিবেশ করতে পারে না, করার সম্ভাবনাও দুর্বল।[৪] যৌন অভিমুখিতা ব্যাখার ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের তত্ত্বসমূহ বেশ জনপ্রিয়।[১] এতে বংশানুক্রমিক বিষয়ের (genetic factor) জটিল অন্তক্রিয়া সহ মস্তিষ্ক এবং মাতৃগর্ভকালীন প্রাথমিক জীবনের পরিবেশ (early uterine environment) নিয়েও আলোচনা করা হয়।[৫] এই বিষয়গুলো জিন, জন্মপূর্বে মার্তৃগর্ভে হরমোন এবং মস্তিষ্কের গঠনের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং ব্যক্তির বিষমকামী, সমকামী, উভকামী ও নিষ্কামী যৌন-অভিমুখিতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হয়। বিভিন্ন জীবের মধ্যে বিষমকামিতা দেখা যাওয়ার কারণ বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কারণ যৌন প্রজননের ফলে জীব বংশ বিস্তারের মাধ্যমে তার বংশের ধারা সহজে বজায় রাখতে পারে।[৬][৭] সমকামিতার ক্ষেত্রে বংশের ধারা যেহেতু যৌন প্রজননের মাধ্যমে রক্ষিত হয় না, তারপরেও যুগ যুগ ধরে সমকামিতা বিভিন্ন জীবের মধ্যে দেখা যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। যেমন আত্মীয়দের সহায়তা করা (কিন সিলেকশন) এবং শারীরিকভাবে সক্ষম (ইনক্লুসিভ ফিটনেস) বা এমন জিন যা ভালো ও খারাপ দুই রকম প্রভাব ফেলে (অ্যান্টাগনিস্টিক প্লিওট্রপি) এরকম জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সমকামিতা জীবের মধ্যে দেখা যায় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
বিকাশশীল ভ্রূণের উপর হরমোন প্রভাবের দরুন যৌন অভিমুখিতার বিকাশ প্রভাবিত হয়; এটাই বিজ্ঞান মহলে সবচেয়ে প্রভাবশালী অনুকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।[৪][৮] সহজ ভাষায়, বিকাশশীল ভ্রূণমস্তিষ্ক নারীগর্ভে নারী হিসেবে শুরুতে অবস্থান করে। পুরুষের ওয়াই ক্রমোজমের প্রভাবে পরবর্তীতে ভ্রুণটিতে শুক্রাশয় বিকশিত হয়। হাইপোথ্যালামাসের বাম অংশের এলাকা আইএনএএইচ৩ (তৃতীয় ইন্টারস্টিশিয়াল নিউক্লিয়াস অব দ্য এন্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাস) যৌন অভিমুখিতা কেমন হবে তা নির্ধারণে ভূমিকা রাখে এবং হাইপোথ্যালামাসের ডান অংশের এলাকা বেড স্ট্রিয়া টার্মিনালুসের (বিএসটিসি) মাঝখানের অংশ লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। উভয় এলাকাই বিকাশশীল ভ্রুণে অবিকশিত অবস্থায় থাকে এবং নারীর ভ্রুণ হিসেবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। ছেলে শিশুর ভ্রুণের ওয়াই ক্রোমোজোমে থাকা এসআরওয়াই জিনের কল্যাণে বিকশিত হওয়া পুরুষাঙ্গ থেকে প্রাথমিক অ্যান্ড্রোজেন রিসেপ্টর-সক্রিয়কারী হরমোন নিঃসৃত হয়। যদি গর্ভবতী হওয়ার ১২ সপ্তাহের মধ্যে আইএনএএইচ৩ পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্টেস্টোরন গ্রহণ করতে পারে তবে টেস্টেস্টোরন আইএনএএইচ৩ কে আরো বর্ধনশীল করার জন্য উদ্দীপ্ত করে। যার ফলে ভ্রূণ এবং ভ্রূণের মস্তিষ্ক পুরুষোচিত হয়ে উঠে সেই পুরুষ সন্তানের পরবর্তীতে নারীর প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাবে। যদি এস্ট্রোজেনের তুলনায় বেশি পরিমাণ টেস্টেস্টোরণ আইএনএএইচ৩ না পায় তবে পুরুষের সচরাচর যে আকারের আইএনএএইচ৩ দেখা যায়, একই আকৃতির আইএনএএইচ৩ ওই ভ্রুণটিতে গঠিত হবে না। এতে করে ওই আইএনএএইচ৩ সম্পুর্ণ অথবা আংশিক নারীর মত আচরণ করে। ফলে এই পুরুষ বাচ্চাটির সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ প্রগাঢ় হবে। যদিও সমকামী অথবা বিসমকামী পুরুষে আইএনএএইচ৩ এর আকারে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায়নি তবুও সমকামী পুরুষের আইএনএএইচ৩ এর কোষ ঘনত্ব বিষমকামী পুরুষের তুলনায় বেশি হতে পারে। অর্থাৎ সমকামী পুরুষের আইএনএএইচ৩ তে একক আয়তনে বেশি কোষ থাকবে। কিন্তু সমকামী এবং বিষমকামী উভয়ের আইএনএএইচ৩তে নিউরনের সংখ্যায় কোন তারতম্য নেই।[৯]
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, সমকামী পুরুষের আইএনএএইচ৩ অঞ্চলে- টেস্টেস্টোরনের মাত্রা সামান্য থাকে; অথবা টেস্টেস্টোরন পুরুষোচিত প্রভাব সৃষ্টিকালীন সময়ে প্রতিক্রিয়াতে পার্থক্য হয় অথবা গুরুত্বপূর্ণ (ক্রিটিক্যাল) সময়ে টেস্টেস্টোরনের ওঠানামা হয়। নারীর আইএনএএইচ৩ যদি স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মাত্রায় টেস্টেস্টোরন গ্রহণ করে, তবে আইএনএএইচ৩ আকারে বড় হতে হতে পুরুষের স্বাভাবিক আইএনএএইচ৩ এর আকারের ন্যায় হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই নারীরও নারীর প্রতি অর্থাৎ সম লিঙ্গে আকর্ষণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।[৪] গর্ভকালীন সময়ে টেস্টোস্টোরনের প্রভাবের মাত্রা ডান হাতের আঙ্গুলের দৈর্ঘ্যের অনুপাত (তর্জনী এবং অনামিকার দৈর্ঘ্য) দেখে বুঝা যায়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে হওয়া একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ নারী সমকামীদের আঙুলের অনুপাতের মান একই রকম বেশি; যা নারীদের টেস্টেস্টোরনের উচ্চতর মাত্রাকে নির্দেশ করে।[১০] মাতৃগর্ভে শিশুর হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন করে পরবর্তীতে শিশুর সামাজিক আচরণ কিরকম হবে- এধরনের গবেষণা অনৈতিক হওয়ায় আজ অবধি এধরনের গবেষণা করা হয়নি। ফলে মার্তৃগর্ভে হরমোনের প্রভাবেই সন্তানের যৌন অভিমুখিতায় প্রভাব পরে কিনা- এবিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া কঠিন। কিন্তু প্রাণীর উপরে এগবেষণা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে মার্তৃগর্ভে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন করলে পরবর্তীতে সন্তানের যৌন অভিমুখিতার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পরে। উদাহরণ স্বরুপ- প্রাণী মার্তৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তার সেক্স হরমোন পরিবর্তন করলে দেখা গিয়েছে, মেয়ে প্রাণী ছেলের মত আচরণ করে এবং ছেলে প্রাণী মেয়ের মত আচরণ করে। এথেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সেক্স হরমোনের প্রভাব মানুষের যৌন অভিমুখিতা এবং আচরণে প্রভাব ফেলে। তবে মানুষের উপর এধরনের গবেষণায় বিভিন্ন নৈতিক বাধা থাকায় শতকরায় কতটুকু তা পরিমাপ করা যায় নি।[৪][৮][১০][১১]
ভ্রুণের বিকাশের সময়ে মাতৃগর্ভে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াকে সমকামিতা এবং উভকামিতা উদ্ভবের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[১২] ১৯৯০ সাল থেকে হওয়া গবেষণাগুলোর মতে একজন নারীর যত বেশি ছেলে সন্তান থাকবে, পরবর্তী সন্তানের সমকামী হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকবে। গর্ভাধানের সময় মায়ের রক্ত প্রবাহে পুরুষের কোষ প্রবেশ করে, যা মায়ের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাছে ফরেন বা বিদেশী বস্তু। প্রতিক্রিয়াস্বরুপ পুরুষের কোষকে নিষ্ক্রিয় করতে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এন্টিবডি তৈরী করে। এই এন্টিবডি ছেলে শিশুর মস্তিষ্কের সেই অংশে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে, যে অংশে ছেলে শিশুর মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়। গবেষণা মতে যত বেশি ছেলে সন্তান জন্ম নিতে থাকে মায়ের এন্টিবডি তত বেশি শক্তিশালী হয়, ফলে পরবর্তী ছেলে সন্তানগুলোর নারীদের প্রতি আকর্ষণের পরিবর্তে পুরুষের প্রতি আকর্ষণের প্রবণতা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবিষয়টিকে পর্যবেক্ষকরা জন্মসূত্রে ভ্রাতৃসম্পর্কের প্রভাব বলে চিহ্নিত করেছেন। জৈব রাসায়নিক প্রমাণ হিসেবে গবেষকরা এজন্য দায়ী প্রোটিনকে শনাক্ত করেছেন।[১২][১৩] মাইকেল বেলী সমকামীতার অন্যতম কারণ হিসেবে মার্তৃগর্ভের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন।[১৪] ১৫ থেকে ২৯ শতাংশ পুরুষ সমকামীর মধ্যে এই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাকিরা জিনগত এবং হরমোন গত প্রভাবের জন্য সমকামী এবং উভকামী হয় বলে গবেষকরা মনে করেন।[১২][১৫]
১৯৯০ এর দিকে বহুল আলোচিত সামাজিকরণ তত্ত্ব মতে শিশুদের কোন জন্মগত যৌন অভিমুখিতা থাকেনা বরং জন্মের পরে পরিবেশের মাধ্যমে তা গঠিত হয়। যাইহোক, বিভিন্নসময় দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেক শিশুর শিশ্ন অপসারণ করা হয়েছিল এবং তাদেরকে এই অপারেশনের কথা না জানিয়ে মেয়ে শিশু হিসেবে বড় করা হয়েছে। সামাজিকীকরণ তত্ত্ব অনুসারে এই শিশুগুলো ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে। কিন্তু দেখা গিয়েছে এই শিশু গুলো মেয়েদের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেছে। এথেকেই অনুমান করা হয় যৌন অভিমুখিতা জন্মের পরের পরিবেশগত ফ্যাক্টর নয় বরং জন্মপূর্ব পরিবেশ যেমন হরমোন, জিন এসবের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। "সহজাত না পরিবেশগত?" (ন্যাচার অর নার্চার) এই বিতর্কে অন্তত পুরুষ সমকামিতা যে সহজাত তা নির্দেশ করে।[৪]
কারিগরি সমস্যার কারণে গ্রাফ এই মূহুর্তে অস্থায়ীভাবে অনুপলব্ধ রয়েছে। |
প্রিঅপটিক এলাকার সেক্সুয়াল ডাইমিরফিক নিউক্লিয়াস (এসডিএন-পিওএ) একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যা মানুষ এবং কিছু সংখ্যক স্তন্যপায়ী (ভেড়া, ইঁদুর ইত্যাদি) প্রাণীতে আলাদা। এই আলাদা হওয়ার কারণ নারী এবং পুরুষের হরমোনের মাত্রায় তারতম্য।[৪][১০] ইনাহ৩ মস্তিষ্কের এমন একটি এলাকা যা পুরুষে নারীর চেয়ে বড় হয়। যৌন আচরণ কেমন হবে তা মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করে। মস্তিষ্কের প্রস্থচ্ছেদ করে দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষের ইনাহ৩ বিষমকামী পুরুষের চেয়ে আকারে ছোট, যা নারীতে দেখা যায়। সায়মন লভে প্রথম এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন। যা পরবর্তীতে পুনরাবৃত্তি করার পর একই ফলাফল আসে। [১০] যাইহোক এধরনের মস্তিষ্কের প্রস্থচ্ছেদ সংশ্লিষ্ট গবেষণা কিছুটা দুর্লভ কারণ এধরনের গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকে না এবং নমুনা হিসেবে মানব মস্তিষ্কও সহজলভ্য নয়।[৪]
কারিগরি সমস্যার কারণে গ্রাফ এই মূহুর্তে অস্থায়ীভাবে অনুপলব্ধ রয়েছে। |
চার্লস রোসেলির গবেষণা মতে গৃহপালিত ভেড়ার ৬-৮% সারা জীবন ভর সমকামী আচরণ প্রদর্শন করে। ভেড়ার মস্তিষ্কের ওভাইন সেক্সুয়াল ডিমরফিক নিউক্লিয়াস (ওএসডিএন) নামক এলাকা যৌন আকর্ষণের জন্য দায়ী।[১৬]:১০৭–১১০। ভেড়ার মস্তিষ্কের প্রস্থচ্ছেদ করে দেখা গিয়েছে, বিষমকামী পুরুষ ভেড়ার তুলনায় সমকামী আচরণ প্রদর্শন করা পুরুষভেড়ার মস্তিষ্কের ওএসডিএন এলাকা ছোট এবং স্ত্রীভেড়ার মত। এই গবেষণা থেকে আরও দেখা গিয়েছে যে, ভেড়ার ওএসডিএনের আকার গর্ভকালীন সময়ে গঠিত হয়েছে, জন্মের পরে নয়। এথেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন জন্মপূর্ব হরমোন যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে এবং মস্তিষ্ককে পুরুষোচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। [৪][১১]
ইভানকা স্যাভিকের নেতৃত্বে করা একটি গবেষণায় মস্তিষ্কের ছবি প্রক্রিয়াজাতকরণ নামক একধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে মস্তিষ্কের হেমিস্ফিয়ারের তুলনা করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিষমকামী পুরুষ মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ার বাম হেমিস্ফিয়ার থেকে ২ শতাংশ বড়। যদিও গবেষকদের মতে এ পার্থক্যটি খুবই সামান্য, কিন্তু সাইমন লিভ্যের মতে এ পার্থক্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিষমকামি নারীদের দুইটি হেমিস্ফিয়ারের আকারই একই রকম ছিল। সমকামী পুরুষে দুইটি হেমিস্ফিয়ারেও একইরকম আকার দেখা গিয়েছে। পক্ষান্তরে সমকামী নারীদের বিষমকামী পুরুষ মস্তিষ্কের ন্যায় ডান হেমিস্ফিয়ারের আকার বাম হ্যামিস্ফিয়ার থেকে কিছুটা বড় দেখা গিয়েছে।[১৬]:১১২
জীবের ডিএনএর মধ্যে অবস্থিত জিনের অনুবিন্যাস জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। এপিজেনেটিক্স ডিএনএ তে অবস্থিত জিনের অনুক্রমে কোনো পরিবর্তন না করেই জিনের বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এপিজিনেটিক মার্কার নামে কিছু রাসায়নিক উপাদান ডিএনএর সাথে (অথবা ডিএনএর মুল উপাদান প্রোটিনের সাথে) সংযুক্ত হয়ে জিনের বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে এপিজেনেটিক মার্কার স্বাভাবিক ভাবে জিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে না পারলে কোষ অস্বাভাবিক আচরণ করে। বিবর্তনীয় জিন প্রকৌশলী উইলিয়াম আর রাইসের প্রবর্তিত মডেলের যুক্তি অনুসারে অস্বাভাবিক এপিজেনেটিক মার্কার বিকাশশীল ভ্রুণের মস্তিষ্কের কোষকে টেস্টেস্টোরনের প্রতি অতিপ্রতিক্রিয়াশীল বা অপ্রক্রিয়াশীল করে তোলে, যার ফলে সমকামিতার উদ্ভব হয় এবং যমজ সন্তানদের একজন সমকামী হলে অন্যজন কেন বিষমকামী হয়, তা ব্যাখ্যা করা যায়।[১৭] রাইস এবং তার সহ গবেষকেরা তাদের প্রস্তাবনায় আরো বলেন, এই এপিমার্কগুলো মানব শরীরের লিঙ্গ ভেদে স্বাভাবিক যৌনাঙ্গের গঠন, মস্তিষ্কের বিকাশ এবং হরমোনের ভুমিকা নির্ধারণে প্রভাব ফেলে এবং বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীতে সন্তান যেন তৃতীয় লিঙ্গের না হয়, তা নিশ্চিত করে। কিন্তু কখনো যদি এপিমার্কের এই কার্যক্রম ব্যাহত হয় তখন ভিন্ন যৌন আকাঙ্ক্ষা যেমন সমকামিতার উদ্ভব ঘটতে পারে[১৭] গ্যাভ্রিলেটস, ফ্রিবার্গ এবং রাইসের মতে বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিভাবে সমকামিতার উদ্ভব হল এবং এখনো কেন টিকে আছে, তার সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা এই মডেলের সাহায্যে দেওয়া যায়।[১৮] এই অনুকল্পটিকে মার্তৃকোষীয় প্রযুক্তির (stem cell Technology) সাহায্যে পরীক্ষা করা সম্ভব।[১৯]
মানুষের ঘাড়ে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোন গর্ভকালীন সময়ে রুপান্তকামিতা/সমলিঙ্গে আকর্ষণ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে তুরস্কের গবেষকগণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। সমলিঙ্গে আকর্ষণ ও রুপান্তর কাম অনুভব করে এরকম ১২ টি ক্ষেত্রে তাদের মায়ের থাইরয়েড রোগ ছিল। ভিয়েনায় অবস্থিত ইউরোপীয় মনরোগ সংস্থা কংগ্রেসে ২০১৫ সালে এই তথ্যটি উত্থাপিত হয় এবং একইবছর জার্নালে প্রকাশিত হয়[২০][২১]। থাইরয়েড বৈকল্য এবং সমকামিতার সাথে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক থেকে সমকামিতার জন্য গর্ভকালীন থাইরয়েড মডেল নামে নতুন একটি মডেলের নামকরণ করা হয়। এই তত্ত্বের প্রবক্তা তুর্কি শিশু রোগবিশেষজ্ঞ ওসমান সাবুঞ্চৌগ্লুর মতে মার্তৃগর্ভে থাইরয়েডের বৈকল্য সন্তানের যৌন আকর্ষণে অস্বাভাবিক প্রভাব ফেলতে পারে। হাসিমোটরের থাইরয়িডিটিস নামক একটি রোগে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে। ফলে তার শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে যায়। মার্তৃগর্ভে এধরনের ঘটনা ঘটলে এন্ড্রোজেন হরমোনের উপর প্রভাব পরে। এই সব বিষয়কে বিবেচনা করে সমকামিতা ও থাইরয়েডের মধ্যে সম্পর্ককে পরবর্তী আরেকটি গবেষণাপত্রে বর্ণনা করা হয়েছে[২২]। বিভিন্ন সময় দেখা গিয়েছে, নারী থেকে পুরুষ রুপান্তরকামী বা সমকামী নারীদের মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারী সিন্ড্রোমের (পিসিওস) আধিক্য লক্ষ্যণীয়। এবিষয়টিকে উল্লেখ করে পরবর্তী আরেকটা গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে জন্মপূর্ব থাইরয়েডের মাত্রার সাথে সমলিঙ্গে আকর্ষণ এবং জেন্ডার ডিসফোরিয়ার সম্পর্ক আছে। কারণ পিসিওস এবং অটোইমিউন থাইরয়িডিটিস (হাসিমোটো থাইরয়িডিটিস) একসাথে ঘটতে পারে; এবং জন্মপূর্ব থাইরয়েড তত্ত্ব মতে অটোইমিউন থকিরয়িডিটিসের কারণে গর্ভাধানের সময় থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমতে পারে।এছাড়াও দেখা গিয়েছে যেসব মায়ের থাইরয়েড বৈকল্য থাকে তাদের সন্তানদের অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এবং এরকম অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জেন্ডার ডিফোরিয়া হবার মাত্রাও অধিক। [২৩] পরবর্তীতে এরূপ আরো ৯ টি ঘটনার কথা জানা গিয়েছে।
পূর্বোক্ত গবেষণায় প্রাপ্ত এই তথ্য এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় বিষয়টিকে যেন গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়, এজন্য গবেষকরা আহ্বান জানিয়েছেন।[২৪][২৫] ২০১৫ সালে নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর জেফরি মুলান একটি মন্তব্যে জন্মপূর্ব থাইরয়েড তত্ত্বের গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করেন।[২৬] এরপরে একাধিক লেখক পুন:পুন বার থাইরয়েডের সাথে যৌনতার সম্পর্কের কথা তাদের গবেষণায় ব্যক্ত করে।[২৭][২৮][২৯][৩০] এদের মধ্যে ক্যারোসা এবং তার সহগবেষকরা উপসংহার টানেন এই বলে যে, থাইরয়েড হরমোন মানুষের যৌনতাকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। তার মতে মানুষের মস্তিষ্ক এবং জননাঙ্গ ছাড়াও থাইরয়েড গ্রন্থিকে একটি যৌন অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। [২৭] অন্ত:ক্ষরা গ্রন্তি, মস্তিষ্ক এবং আচার আচরণের মধ্যে আন্ত:ক্রিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞ দ্বারা লিখা একটি বইয়ের শেষ সম্পাদনায় থাইরয়েড-সমকামিতা সম্পর্কিত গবেষণাপত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে[৩১] সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শুধুমাত্র পুরুষ সমকামীদের জিন নিয়ে করা একটি গবেষণায় ১৪ নং ক্রমোজমে এমন একটি সুনির্দিষ্ট এলাকা গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন, যা থাইরয়েড বৈকল্যের জন্য দায়ী। যা আপাত ভাবে জন্মপূর্ব থাইরয়েড মডেলকে সমর্থনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রমাণ বলে ধরে নেওয়া হয় ।[৩২]
একাধিক জিন যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। জিনগত এবং পরিবেশগত প্রভাবের অর্থ বেশিরভাগ মানুষ ভুলভাবে বুঝেন বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন।[৪] পরিবেশগত প্রভাব বললেই অনেকে ধরে নেন সামাজিক প্রভাব যৌন অভিমুখিতার ক্রমবিকাশে ভূমিকা রাখে। অথচ বিজ্ঞানীদের ধারণা বিশেষ করে পুরুষের যৌন অভিমুখিতা তার জন্মের পরের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।[৪]গর্ভকালীন পরিবেশ কিন্তু সামাজিক পরিবেশ নয়। এই জন্মপূর্ব প্রসবকালীন পরিবেশ যেহেতু শিশুর যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই এই পরিবেশ যৌন প্রবৃত্তির সাথে জিনগত ভাবে সম্পর্কিত না হলেও এক্ষেত্রে যৌন অভিমুখিতা কেমন হবে তার সাথে জীববৈজ্ঞানিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।[৪]:৭৬ অর্থাৎ জন্মপূর্ব পরিবেশ কর্তৃক কারো যৌনতা প্রভাবিত হলে সেই যৌন পরিচয় সহজাত বা জন্মগত হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে।
যমজ সন্তান দুইধরনের হয়। একটি হল অভিন্ন বা মনোজাইগোটিক যমজ এবং অপরটি হল ভিন্ন বা ডাইজাইগোটিক যমজ। গর্ভাবস্থায় মার্তৃগর্ভে একটি ডিম্বাণু একটি শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হওয়ার পর যদি সেই কোষটি (জাইগোট) দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বড় হতে থাকে তবে সেই সন্তানরা হয় মনোজাইগোটিক যমজ। পক্ষান্তরে মার্তৃগর্ভে দুইটি ডিম্বাণু দুইটি শুক্রাণু দিয়ে একইসময়ে নিষিক্ত হয়ে বড় হতে থাকলে সেই সন্তানদ্বয় হয় ডাইজাইগোটিক যমজ। বিভিন্ন সময় যৌন অভিমুখিতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যমজদের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলো মূলত পরিবেশগত ও জিনগত কারণ তুলনা করার জন্য করা হয়ে ছিল। ১৯৯১ সালের এক গবেষণায় বেইলি ও পিলার্ড দেখেন যে যমজদের মাঝে ৫২ শতাংশ অভিন্ন যমজ ভাই (আইডেন্টিকাল বা মনোজাইগোটিক যমজ ভাই) ও ২২ শতাংশ ভিন্ন যমজেরা (ফ্র্যাটারনাল টুইন বা ডাইজাইগোটিক টুইন) সমকামিতার জন্য কনকরডেন্স দেখায়। অর্থাৎ অভিন্ন বা মনোজাইগোটিক যমজের ক্ষেত্রে একজনের মধ্যে সমকামিতা থাকলে তার অভিন্ন যমজ ভাই এর মধ্যে সমকামিতা থাকার সম্ভাবনা ৫২ শতাংশ এবং ভিন্ন বা ডাইজাইগোটিক যমজের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ২২ শতাংশ। উল্লেখ্য, তারা গবেষণার জন্য "হোমোফাইল পাবলিকেশন্স" থেকে যমজদের নিয়োগ করেন। এদের মাঝে ৫৯ জনকে প্রশ্নোত্তর করা হয়েছিল।[৩৩] মনোজাইগোটিক বলতে একই রকম সেটের জিন থাকা অভিন্ন যমজ নির্দেশ করে, এবং ডাইজাইগোটিক দ্বারা ভিন্ন যমজের প্রতি ইঙ্গিত করে হয় যেখানে জিনগুলো অযমজ ভাইদের মতই অনেকটা ভিন্ন হয়। পরবর্তী আরেকটি গবেষণায় গবেষকরা ৬১ জোড়া যমজকে প্রশ্ন করেন। সেখান থেকে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ মনোজাইগোটিক যমজদের মধ্যে ৬৬% এবং ডাইজাইগোটিক যমজদের মধ্যে ৩০% সমকামী কনকরডেন্স (একজনের মধ্যে সমকামিতা থাকলে আরেকজনের মধ্যে সমকামিতা থাকার হার) দেখায়।[৩৪] ২০০০ সালে বেইলি, ডুন এবং মার্টিন ৪,৯০১ জন অস্ট্রেলিয়ান যমজদের মাঝে গবেষণা করেন। সেই গবেষণায় দেখা যায় কনকরডেন্স দেখানোর হার পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোয় প্রাপ্ত কনকরডেন্স দেখানোর হারের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।[৩৫] তাদের গবেষণায় উঠে আসে ২০% পুরুষ মনোজাইগোটিক যমজে এবং ২৪% নারী মনোজাইগোটিক যমজে কনকরডেন্স (একজন সন্তান সমকামী হলে তার জমজ ভাই বা বোনে সমকামিতা দেখা যাওয়ার হার) দেখা যায়।
২০০৮ সালে সুইডেনের প্রাপ্ত বয়স্ক যমজদের (৭৬০০ এরও বেশি) মধ্যে[৩৬] গবেষণা করে পাওয়া যায় যে সমকামী আচরণকে জিনগত এবং স্বতন্ত্র পরিবেশগত উৎস (মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থা, শৈশবকালীন অসুস্থতা, যমজরা ভিন্ন পরিবেশে বড় হলে... ইত্যাদি) দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, যদিও ব্যক্তির যৌন অভিমুখিতায় সুনির্দিষ্টভাবে কোন নির্ণায়কটি (ফ্যাক্টর) মুখ্য ভূমিকা পালন করে তা যমজ গবেষণা থেকে জানা যায় নি। যদি যমজরা একই পরিবেশে বড় হয়ে থাকে তবে পুরুষের ক্ষেত্রে সেই একই পরিবেশগত প্রভাব (একই পরিবেশগত প্রভাব বলতে বোঝানো হচ্ছে একই পারিবারিক পরিবেশ, যমজ সন্তানের লালন পালন, যমজ সন্তানরা একই বন্ধুবান্ধবের সাথে মেলামেশা করলে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, একই স্কুলে গমন বা একই পরিবেশে তারা যদি বড় হয়) একেবারেই নেই এবং নারীদের ক্ষেত্রে তা খুবই অল্প। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে সন্তানের বিকাশে পিতামাতার ভূমিকা এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে নারী সমকামিতার দুর্বল সংযোগ থাকলেও পুরুষ সমকামিতার কোনো সংযোগ নেই- যার সাথে সুইডেনের যমজ গবেষণাটি সংগতিপূর্ণ। পরিশেষে এই গবেষণা থেকে এটাই বলা যায় জীবনের যেকোনো পর্যায়ে নারীর তুলনায় পুরুষে সমকামিতা হওয়ার ক্ষেত্রে জিন অত্যাধিক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও বলা হয়েছে, "স্বতন্ত্র পরিবেশগত প্রভাবকের কারণে যারা সমকামী অথবা বিষমকামী হয় তাদের ক্ষেত্রে সেই কারণসমূহের মধ্যে হয়ে রয়েছে মার্তৃগর্ভে জন্ম পূর্ব যৌন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মায়ের একাধিকবার গর্ভাধানের ফলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে সুনির্দিষ্ট প্রোটিনে প্রতিক্রিয়া তৈরী এবং শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের সময় স্নায়বিক কোনো পরিবর্তন"। এই গবেষণাটিতে পরিবেশগত কারণের মধ্যে এগুলোকে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরে নিলেও অন্য কোনো কারণ থাকার সম্ভাবনা খারিজ করে নি। তবে এই পরীক্ষার ফল বেশ সমালোচনার স্বীকার হয় কেননা স্বেচ্ছাসেবকেরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তাই এখানে বেশি পরিমাণে সমকামী যমজ অংশগ্রহণ করার একটা সম্ভাব্য পক্ষপাত কাজ করতে পারে;
বায়োমেট্রিক মডেলিং এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, পুরুষের মধ্যে যৌন অভিমুখিতা ৩৪-৩৯% অংশ জিনগত কারণে, ০.০০% অংশ একই পরিবেশগত কারণে (shared environment) এবং ৬১-৬৬% স্বতন্ত্র নির্দিষ্ট পরিবেশ (individual-specific environment) দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। এক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে জিনগত প্রভাব দেখা যায় ১৮-১৯%, একই পরিবেশের প্রভাব ১৬-১৭% এবং স্বতন্ত্র-নির্দিষ্ট পরিবেশের প্রভাব দেখা যায় ৬৪-৬৬%।[৩৭]
উল্লেখ্য, আমাদের আচরণকে আমাদের জিন এবং পরিবেশ প্রভাবিত করে। যে পরিবেশ আমাদেরকে প্রভাবিত করে তা মূলত দুই রকম হয়। এগুলো হচ্ছে একই পরিবেশ (Shared environment) এবং একই পরিবেশ নয় (Non-shared environment)। একই পরিবেশ বলতে পরিবেশের সেইসব প্রভাব বোঝানো হয় যা বিভিন্ন সদস্যকেই প্রভাবিত করে। আবার একই বাড়িতে ভাইদের মধ্যে (যমজ বা অযমজ) মধ্যে যে প্রভাবের ফলে একই উন্নয়নগত ও অন্যান্য ফলাফল দেখা যায় তাকেও একই পরিবেশ, বিশেষ করে পারিবারিক একই পরিবেশ (familial shared environment) বলে। অন্যদিকে পরিবেশের যে বিষয়গুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই প্রভাবিত করে তবে তা একই পরিবেশ (Non-shared environment) নয়। আবার পরিবেশের যে প্রভাব একই বাড়িতে ভাইদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটায় তাও একই পরিবেশ নয়। একই পরিবেশ নয় এরকম পরিবেশকে ব্যক্তি-নির্দিষ্ট পরিবেশও (individual-specific environment) বলা হয়।[৩৮][৩৯]
ক্রমোজম | অবস্থান | সংযুক্ত জিন | লিঙ্গ | গবেষণা১ | উৎপত্তিস্থল | তালিকা |
---|---|---|---|---|---|---|
এক্স ক্রোমোজোম | এক্সকিউ২৮ | অনুমিত
|
শুধুমাত্র পুরুষে | হ্যামার এবং তার সহকারী গবেষক ১৯৯৩ | জিনগত | |
১ নং ক্রোমোজোম | ১পি৩৬ | আরএইচ সিস্টেম
|
নারী পুরুষ দুই লিঙ্গেই | এলিস এবং তার সহকারি গবেষক ২০০৮ | সম্ভাব্য জিনগত সংযুক্তি2 | |
৪ নং ক্রোমোজোম | ৪পি১৪ | শুধুমাত্র নারীতে | গানা এবং তার সহগবেষকগণ ২০১৯ | |||
৭ নং ক্রোমোজোম | নারী-পুরুষ দুই লিঙ্গেই | গানা এবং তার সহকারী গবেষক ২০১৯ | [৪০][৪১] | |||
৮ নং ক্রোমোজোম | ৮পি১২ | এনকেএআইএন৩ | শুধু পুরুষে | মুসতানস্কি এবং তার সহকারী গবেষক ২০০৫ | ||
৯ নং ক্রমোজম | ৯কিউ৩৪ | এবিও | নারী-পুরুষ দুই লিঙ্গেই | এলিস এবং তার সহকারি গবেষক ২০০৮ | সম্ভাব্য জিনগত সংযুক্তি২ | |
১১ নং ক্রমোজম | ১১পি১৫ | ওআর৫১এসেভেন (অনুমিত ) | শুধুমাত্র পুরুষে | গানা এবং তার সহকারী গবেষক ২০১৮ | সঙ্গম অনুরক্তিতেঘ্রাণ ব্যবস্থা[৪০][৪১] | |
১২ নং ক্রমোজম | নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গেই | গানা এবং তার সহকারী গবেষক ২০১৮ | [৪০][৪১] | |||
১৩ নং ক্রমোজম | ১৩কিউ৩১ | এসএলআইটিআরকে৬ | শুধুমাত্র পুরুষে | স্যান্ডার্স এবং তার সহকারী গবেষক২০১৭ | মধ্যমস্তিষ্ক-সংযুক্ত জিন | |
১৪ নং ক্রোমোজোম | ১৪কিউ৩১ | টিএসএইচআর | শুধুমাত্র পুরুষে | স্যান্ডার্স এবং তার সহকারী গবেষক২০১৭ | ||
১৫ নং ক্রমোজোম | শুধুমাত্র পুরুষে | গানা এবং তার সহকারী গবেষক ২০১৮ | পুরুষ-টাক হওয়ার অনুক্রমের সাথে সংযুক্ত [৪০][৪১] |
1কোন সম্পর্কের জন্য প্রাথমিক গবেষণার এই ফলাফল গুলো অকাট্য প্রমাণ নয়।
2আকস্মিক/ধারাবাহিকতাহীন হওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য নয়
যৌন অভিমুখিতায় ক্রোমোজমের সংযোগ আছে কিনা এ সংক্রান্ত গবেষণা গুলো ইঙ্গিত করে; জিনোমে বিদ্যমান অসংখ্য জেনেটিক ফ্যাক্টর অভিমুখিতায় প্রভাব ফেলে। ১৯৯৩ সালে ডিন হ্যামার এবং তার সহ-গবেষকরা ৭৬ জন পুরুষ সমকামি ভাই এবং তাদের পরিবারের উপর গবেষণা করে একটি সংযোগ খুঁজে পাওয়ার দাবী করে তা প্রকাশ করেন ।[৪২] হ্যামার দেখতে পান যারা সমকামী পুরুষ, তাদের মামা, মামাত ভাইরাই; চাচা চাচাতো ভাইদের তুলনায় অধিক সমকামী। অর্থাৎ, মায়ের দিকের আত্মীয়রাই, পিতার দিকের আত্মীয়দের তুলনায় অধিক বেশি সমকামী। হ্যামার ভাবলেন, যেহেতু সংযোগটা মায়ের দিক এসেছে; তাই জিনগত পার্থক্য থেকে থাকলে; এই পার্থক্য এমন একটা ক্রমোজমে থাকবে যা পিতা বা পুরুষে; মায়ের (নারী) চেয়ে ভিন্ন। আর নারী ও পুরুষে পার্থক্য সুচক ক্রোমোজমের নাম হলো এক্স-ওয়াই ক্রমোজোম। একজন নারী এক্স-এক্স ক্রোমোজম ও একজন পুরুষ এক্স-ওয়াই ক্রোমোজম বহন করে। তাই তিনি যে সব সমকামী ভাইদের মধ্যে এরকম দেখা গিয়েছিল, তাদেরকে এক্স ক্রোমোজমের ২২ তম মার্কার ব্যবহার করে একই রকম এলিলের জন্য এক্স ক্রোমোজমের সংযোগ পরীক্ষা করা হয়েছিল। অন্য আরেক গবেষণায় ৪০ জোড়ার মধ্যে পরীক্ষা করায় ৩৩ জোড়ার মধ্যে এক্সকিউ২৮ এর দূরবর্তী এলাকায় একই রকম এলিল খুজে পাওয়া গিয়েছিল, যা কাকা-কাকাতো ভাইদের তুলনায় বেশি ছিল। এই বিষয়টাই গণমাধ্যমে "সমকামী জিন'" খুজে পাওয়া গিয়েছে এই মর্মে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে শিরোনাম হয়েছিল। স্যান্ডার্স এবং তার সহযোগীরা ১৯৯৮ সালে একইরূপ গবেষণায় দেখতে পান, মামা-মামাতো ভাইদের দিক থেকে ১৩% সমকামী হয়, যেখানে চাচা-চাচাতো ভাইদের দিক থেকে ৬% সমকামী হয়।[৪৩]
এইচইউ এবং তার সহযোগীদের দ্বারা পরবর্তী আরেকটি গবেষণায় এই গবেষণাটি পুনঃউৎপাদন করা হয়, এবং আগের উপাত্তকে সংশোধন করা হয়। এই গবেষণাটি- ৬৭% সমকামী ভাই; এক্স ক্রোমোজোমে(মাতা থেকে প্রাপ্ত) এক্সকিউ২৮ এ সম্পৃক্ত স্যম্পল শেয়ার করে, এটাই দেখায়।[৪৪] অন্য দুইটি স্টাডি (ব্যালী এবংতার সহযোগী, ১৯৯৯; এমসিকেনাইট এবং মালকম, ২০০০) ব্যর্থ হয়েছিল, মাতার দিক থেকে সমকামী ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে যে দাবী করা হয়েছিল, সেই দাবীকে প্রমাণ করতে।[৪৩] রাইস এবং তার সহযোগীরা ১৯৯৯ সালে এক্সকিউ ২৮ এর সংযোগ সংক্রান্ত গবেষণাকে পুনরুৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়।[৪৫] সকল ধরনের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বৃহত্তর বিশ্লেষণ গুলো এটাই নির্দেশ করে যে, এক্সকিউ২৮ এর সাথে একটা সুনির্দিষ্ট সংযোগ তো আছে, কিন্তু তার সাথে সাথে এটাও নির্দেশ করা হয় যে, আরো অতিরিক্ত কোনো জিন মানুষের যৌন অভিমুখিতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।[৪৬]
মুসতানস্কি ও তার সহযোগীরা (২০০৫) হ্যামার (১৯৯৩) ও এইচইউয়ের (১৯৯৫) করা গবেষণার পরিবারের সদস্যদের পুরো জিনোম স্ক্যান করেন। তারা এক্সকিউ২৮ এর সাথে কোনো সংযোগ খুঁজে পান নি।[৪৭]
২০১২ সালে ব্যাপক পরিসরে স্বাধীন গ্রুপ কর্তৃক পুরুষ সমকামিতার পিছনে কোনো জিনগত সংযোগ আছে কিনা, অন্বেষণ শুরু করা হয়।[৪৮] এই গবেষণাটি করা হয়েছিল ৪০৯ জন স্বতন্ত্র সমকামী যমজ ভাইয়ের উপর। তাদের ৩ লক্ষ একক নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম মার্কার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষণাটি দৃঢ়ভাবে হ্যামারের অন্বেষিত এক্সকিউ২৮ এর গবেষণাটিকে সমর্থন করেছিল। এক্সকিউ২৮ এর সংযোগের পাশাপাশি এটি ৮ নং ক্রোমোজোমের পেরিসেন্ট্রোমেরিক এলাকার সাথেও পুরুষ সমকামিতার সংযোগ খুঁজে পায়। গবেষকরা সমাপ্তি টানেন এই বলে, "আমাদের গবেষণা থেকে এটাই উপলব্ধ যে, জিনগত প্রকরনই সমকামী পুরুষে মনস্তাত্ত্বিক দিশার ক্রমবিকাশ ঘটায়।" নারীর যৌন অভিমুখিতার সাথে এক্সকিউ২৮ এর সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় নি।[৪৪][৪৯] যদিও এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নারীর সমকামিতার সাথেও বংশানুক্রমিক জিনগত কারণ বিদ্যমান।[৫০]
সেক্স ক্রোমোজোমের পাশাপাশি সমকামীতায় অটোজোমের জিনগত অবদান আছে, এমনটা প্রস্তাব করা হয়। একটি গবেষণায় ৭০০০ জনের অধিক অংশগ্রহণ করেন। এলিস এবং তার সহযোগীরা (২০০৮ সাল) ৭০০০ জনের উপর একটি জরিপ চালান। তারা সমকামী এবং বিষমকামীদের মধ্যে A ব্লাড গ্রুপের ফ্রিকোয়েন্সিতে একটা সুনির্দিষ্ট প্রাধান্য দেখতে পান, তারা দেখেন বিষমকামীদের তুলনায় সমকামী নারী-পুরুষদের Rh নেগেটিভ বেশি। যেহেতু উভয় রক্তের গ্রুপ এবং Rh ফ্যাক্টর জিনগত ভাবে উত্তরাধিকার সুত্রে এলিল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এলিলের অবস্থান ৯ নং ক্রোমোজোম ও ১ নং ক্রোমোজমের উপর অবস্থান করছে, তাই এই গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া যায়, সমকামিতার সাথে অটোজোমের জিনের একটি সম্ভাব্য সংযোগ আছে।[৫১][৫২]
কিছু প্রাণীর মডেল ব্যবস্থায় যৌন অভিমুখিতার জীববিজ্ঞান নিয়ে বিস্তৃতপরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। বহুল পরিচিত ফলের মাছি ড্রসোফিলিয়া ম্যালানোগস্টারে, দেখা গিয়েছে, যেসব পুরুষ ফলের মাছি সমলিঙ্গে আকৃষ্ট হয়; তারা যখন বিপরীত লিঙ্গের সাথে যৌনাচারণ করে, তখন সেই নারী ফলের মাছি প্রজননের হার তুলনামুলক বেশি থাকে। এই সংযোগটিকে গবেষকরা জিনগত কারণ বলেই মনে করেন।[৫৩] কোরিয়া এডভান্সড ইন্সটিউট সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির জিনপ্রকৌশলীর একটি দল নারী ইদুরের মত স্তন্যপায়ী প্রাণীতে একটি গবেষণা করেন। তারা সফলভাবে এমন একটি নারী ইদুর সৃষ্টি করেন, যার যৌন অভিমুখিতার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি জিনের (FucM) ঘাটতি ছিল। সেই জিন ব্যতীত নারী ইদুরটি পুরুষ ইদুরের মত স্বভাব প্রদর্শন করতে থাকে এবং নারী ইদুরের মুত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। যেসব ইদুর ফিউকোস মুটারোটাসে (FucM) জিন ধারণ করে; তারা পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়।[৫৪]
সংবাদ মাধ্যমের সাক্ষাৎকারে গবেষকরা বলেন, যৌন অভিমুখিতায় জিনের প্রভাব আছে, কিন্তু জিনই তা নির্ধারণ করে, এমনটা নয়। জিনের প্রভাব এবং জিন নির্ধারক দুইটি কখনো সমতুল্য নয়। ডিন হ্যামার এবং মাইকেল ব্যালী অনুসারে জিন দ্বারা অভিমুখিতা তৈরী হওয়া হচ্ছে, সমকামিতার অনেক গুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ।[৫৫][৫৬]
২০১৭ সালে, ন্যাচারে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১০৭৭ জন সমকামী পুরুষ ও ১২৩১ জন বিষমকামী পুরুষের জিনোম ওয়াইড এসোসিয়েশন গবেষণা করা হয়। এই গবেষণায় দুটি সুনির্দিষ্ট জিনকে পুরুষের সমকামীতার জন্য দায়ী করা হয়েছে। ১৩ নং ক্রমোজমে প্রাপ্ত একটি জিনের নাম এসএলআইটিআরকে৬ (SLITRK6) জিন। এই জিনটি ডিএনএর যে পুনর্বিন্যাস (সিকোয়েন্স) ধারণ করে; তা সমকামী পুরুষ ও বিষমকামী পুরুষে ভিন্ন।[৩২] এই গবেষণাটি পুর্বোক্ত আরো একটি গবেষণা প্রতিবেদনকে সমর্থন করে। সাইমন লিভ্যে কর্তৃক করা গবেষণাটিতে দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষের হাইপোথ্যালামাস বিষমকামী পুরুষ থেকে ভিন্ন।[৫৭] এই এসএলআইটিআরকে৬ জিনটি হাইপোথ্যালামাসের মধ্যমস্তিষ্কে সক্রিয়। গবেষকরা আরো একটি জিন খুঁজে পান, যার নাম "'থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন রিসেপ্টর'" (TSHR)। এই জিনটি ১৪ নং ক্রমোজমে অবস্থিত। এর ডিএনএ পুনর্বিন্যাস সমকামী পুরুষে বিষমকামী পুরুষ থেকে ভিন্ন।[৩২] থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন রিসেপ্টর থাইরয়েডকে উদ্দীপ্ত করে এবং গ্রেভ রোগ টিএসএইচআর এর কার্যক্রম ব্যাহত করে। পূর্বে করা গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, গ্রেভ রোগ সমকামী পুরুষে; বিষমকামী পুরুষের তুলনায় বেশি দেখা যায়।[৫৮] গবেষণা থেকে এটাও দেখা গিয়েছে, গড়পরতায় সমকামী পুরুষের ওজম বিষমকামীদের তুলনায় কম হয়। অনুমান করা হয়, টিএইচএসআর অতিসক্রিয়তার জন্যই সমকামী পুরুষে ওজন হ্রাস পায়।[৫৯][৬০]
২০১৮ সালে, গানা এবং তার সহযোগীরা পুরুষ ও নারীর যৌন অভিমুখিতার উপর আরেকটি জিনোম ওয়াইড এসোসিয়েশন স্টাডি করেন। প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের উপর করা এই গবেষণার মধ্যে ২৬,৮৯০ জন মানুষ জীবনে একবারের জন্য হলেও সমলিঙ্গের মানুষের সাথে যৌনক্রিয়া করেছে। গবেষক দল দেখতে পান, যারা একবারের জন্য হলেও সমলিঙ্গের মানুষের সাথে যৌনক্রিয়ায় জড়িয়েছে, তাদের ৭, ১১, ১২ এবং ১৫ নং ক্রমোজমের চারটি প্রকরণে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য আছে। পুরুষের ১১ এবং ১৫ নং ক্রমোজমে প্রাপ্ত প্রকরণ সুনির্দিষ্ট। ১১ নং ক্রমজোমে একটি অলফ্যাক্টরী জিনের প্রকরণ অবস্থিত এবং ১৫ নং ক্রমোজমে পুরুষের টাকের জন্য দায়ী এমন জিনের প্রকরণ অবস্থিত। চারটা প্রকরণ নারী এবং পুরুষে স্বাস্থ্য বিকার, হতাশাজনক মনোবিকার এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়ার সাথে এবং শুধুমাত্র নারীতে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সাথে আন্তঃসম্পর্কিত। যাইহোক, এই চারটি প্রকরণ যৌন অভিমুখিতা কেমন হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম নয়।[৬১]
আগষ্ট ২০১৯ এ বিশাল পরিসরে ৪,৯৩,০০১ জন মানুষের জিনের উপর করা গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, শতাধিক থেকে সহস্রাধিক জিনগত প্রকরণ নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে সমকামিতার উদ্ভবের জন্য দায়ী। যার মধ্যে ৫টি সুনির্দিষ্ট প্রকরণ এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ৫ টির মধ্যে কিছু যৌনতার উপর ভূমিকা রাখে, আর কিছু যৌন হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ এবং ঘ্রাণ উদ্দীপনায় প্রভাব ফেলে। সকল প্রকরণকে একত্র করলে বলা যায় মানব যৌন আকাঙ্ক্ষার ৮-২৫ শতাংশ ক্ষেত্রকে জিন নিয়ন্ত্রণ করে। এই জিনগুলো অন্য অনেক বৈশিষ্ট্য যেমন ঝুঁকি নেওয়ার স্বভাব বা সাহসী হয়ে উঠার স্বভাবকে প্রভাবিত করে। অধিকতর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, একই জিনগত প্রকরণের সেট দ্বারা যৌন স্বভাব, আকর্ষণ, যৌন পরিচয় এবং যৌন অভিরুচি প্রভাবিত হয়। কিনসে স্কেল দ্বারা প্রস্তাবিত মত অনুযায়ী বিষমকামী থেকে সমকামী হওয়া সরলরৈখিক হলেও এই গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, সমকামিতার মত যৌন আচরণ সহস্রাধিক উপকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।[৬২]
অক্টোবর ২০২১ এ আরেকটা গবেষণাপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে সমলিঙ্গে যৌন আকর্ষণ জিনগত উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। হান চীনা জনগোষ্ঠীর ১৪৭৮ জন সমকামী পুরুষ এবং ৩৩১৩ জন বিষমকামী পুরুষের জিনগত বিশ্লেষণ থেকে দেখা গিয়েছে ২ টি জেনেটিক লোকি (এফএমআর১এনবি এবং জেডএনএফ৫৩৬) পুরুষে-পুরুষে যৌন আকর্ষণ তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[৬৩]
এই নিবন্ধটিতে একজন বিশেষজ্ঞের মনোযোগ প্রয়োজন। |
এই নিবন্ধটির রচনা সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ ব্যাকরণ, রচনাশৈলী, বানান বা বর্ণনাভঙ্গিগত সমস্যা রয়েছে। |
এই নিবন্ধটি উইকিপিডিয়ার জন্য মানসম্পন্ন অবস্থায় আনতে পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন। মূল সমস্যা হল: এখানে বলা হয়েছে বৈশিষ্ট্য গোপন করা হয়, ঠিক কী গোপন করা হয়, তা বিস্তারিত বর্ণনা করা প্রয়োজন। |
একটি গবেষণায় দেখা যায়, মায়ের জিনগত গঠন ও সমকামিতার সাথে পুত্রের যৌন অভিমুখিতার সম্পর্ক রয়েছে। নারীদের দুটি এক্স (X) ক্রোমোজোম আছে। এর মাঝে একটি "সুইচড অফ" বা নিষ্ক্রীয় যার ফলে কিছু স্বভাবী বৈশিষ্ট্য সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ভ্রুণাবস্থায় এক্স ক্রোমোজোমের এই বৈশিষ্ট্য না-দেখানোর প্রবণতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ অধারাবাহিকভাবে ঘটে। বকল্যাণ্ড এবং সহগবেষকবৃন্দ (২০০৬) জানিয়েছেন যে, সমকামি পুরুষদের মায়েদের এক্স ক্রোমোজোম অসমকামি পুরুষদের মায়েদের এক্স ক্রোমোজোমের চেয়ে অনেক বেশি তীব্রভাবে বৈশিষ্ট্য গোপন করে। ১৬ শতাংশ একজন সমকামি পুরুষের মা ও ২৩ শতাংশ দুই জন সমকামি পুরুষের মায়েরা এক্স ক্রোমোজোমের এই তীব্রতা দেখায়। অন্যদিকে সমকামি নয় এরকম পুরুষদের মায়ের ক্ষেত্রে এই হার ৪ শতাংশ মাত্র।[৬৪]
ব্ল্যানচার্ড (Blanchard) এবং ক্ল্যাসেন (Klassen) (১৯৯৭ সালে) গবেষণা করে বলেছেন, যদি পরিবারে বড় ভাই থাকে, তাহলে প্রত্যেক বড় ভাইয়ের জন্য ছোট ভাইয়ের সমকামী হবার সম্ভাবনা দাড়ায় ৩৩%।[৬৫][৬৬] এখন পর্যন্ত এটিই "যৌন অভিমুখিতা নিয়ে হওয়া গবেষণায় প্রাপ্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এপিডেমিওলজিকাল ভেরিয়াবল"।[৬৭] এটাকে যদি ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে এটা বলা যায় যে, মার্তৃজঠরে পুরুষের ভ্রুণ তৈরী হওয়ার সময় মায়ের ইমিউন সিস্টেম (রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা) সক্রিয় হয়ে উঠে, এবং ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেকে পুরুষের ভ্রুণ তৈরী হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেকবার মাতৃ ইমিউন সিস্টেম আগেরবারের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠে। গর্ভকালীন সময়ে এই মাতৃ রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাপক অনুকল্প (maternal immunization hypothesis) (MIH) মতে, এ অবস্থা শুরু হয়, যখন পুরুষ ভ্রুণ এর কোষ মায়ের মাসিকচক্রে প্রবেশ করে অথবা মা যখন সন্তানকে জন্ম দেয়।[৬৮] পুরুষ ভ্রুণ উৎপন্ন করে এইচ-ওয়াই এন্টিজেন যা নিশ্চিতভাবে মেরুদণ্ডী পর্বের প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এই ওয়াই লিঙ্কড প্রোটিনটিকে (যেহেতু এটা পুরুষের) মায়ের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চিনতে পারে না, কারণ তিনি একজন নারী। এর কারণে তার এন্টিবডি; যা তার অমরার দেয়াল ধরে চলাফেরা করে, তা (এন্টিবডির) ভ্রুণের এর প্রকোষ্ঠে ক্রমবিকশিত হয়। এখান থেকে এন্টি মেল বডি ভ্রুণীয় মস্তিষ্কের উন্নয়নের ব্লাড/ব্রেইন ব্যারিয়ার (BBB) অধিক্রমণ করে। এতে যৌন অভিমুখিতার সাথে সম্পর্কিত যৌন দ্বিমরফিক মস্তিষ্কের গঠনে (sex-dimorphic brain structures) পরিবর্তন আসে। যার ফলে ছেলে সন্তানের জন্মের পর নারীর তুলনায়; তার পুরুষের প্রতি আকর্ষণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।[৬৮] মায়ের এইচ-ওয়াই এন্টিবডি; এইচ-ওয়াই এন্টিজেনকে মনে রাখে, তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখায়। ফলে পরবর্তীতে তৈরী হওয়া প্রতিটি পুরুষ ভ্রুণ এইচ-ওয়াই এন্টিবডি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই এইচ-ওয়াই এন্টিজেনের পুরুষ ভ্রুণের মস্তিষ্কে পুরুষের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার কথা, যা মায়ের এইচ ওয়াই এন্টিবডি কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়।[৬৫]
২০১৭ সালে গবেষকরা, অধিক বড় ভাই থাকলে, কেন ছেলে সন্তানে সমকামিতা দেখা যায় এরুপ একটি জৈব কৌশল আবিষ্কার করেন। তারা মনে করেন, নিউরোলিজিন ৪-ওয়াই লিঙ্কড প্রোটিন এরুপ ভুমিকা পালন করে। তারা দেখতে পান, নারীর পুরুষের তুলনায় অধিক এন্টি- নিউরোলিজিন-৪-ওয়াই লেভেল থাকে। গবেষণা থেকে আরো দেখা যায়, ছেলে সমকামী ও তার অগ্রজ বড় ভাই আছে, এরুপ মায়ের এন্টি- নিউরোলিজিন-৪-ওয়াই এর স্তর; বিষমকামী সন্তান থাকা মায়ের চেয়ে বেশি।[৬৯]
যাইহোক, জন্মসূত্রে ভ্রার্তৃসম্পর্কিত প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারে না কেন প্রথম ছেলে সন্তানের মধ্যে সমকামিতা দেখা যায়।[৭০][৭১][৭২][৭৩]
২০০৪ সালে, ইটালির বিজ্ঞানীরা ৪,৬০০ মানুষের উপর একটি গবেষণা চালান। এরা ৯৮ জন সমকামী ও ১০০ জন বিসমকামী পুরুষের আত্মীয় ছিলেন। সমকামী পুরুষের নারী আত্মীয়দের তুলনামূলক বেশি সন্তানসন্ততি আছে বলে পরিলক্ষিত হয়। সমকামী পুরুষের নারী আত্মীয়দের অধিক সন্তানসন্ততি থাকার পাশাপাশি; সমকামী পুরুষের মায়ের দিককার আত্মীয়দের (যেমনঃ মাসি/খালা); সমকামী পুরুষদের পিতার দিকের নারী আত্মীয়দের (যেমনঃ ফুফু বা পিশি) তুলনায় বেশি সন্তান সন্ততি আছে। এতে করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, এক্স ক্রোমোজোমে করে যে জিনগত বৈশিষ্ট্য বাচ্চার মাঝে পরিবাহিত হত, তার নারীর মাঝে ঊর্বরতা এবং পুরুষের মাঝে সমকামি প্রবণতার সঞ্চার করে। এই গবেষণা তাৎপর্যপূর্ণ ও সমকামিতার সাথে জৈবিক কারণ যুক্ত আছে অনুধাবন করা গেলেও সুনির্দিষ্ট কোনো জিন যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণ করে, এমনটা বলা যায় না।[৭৪][৭৫]
সুইডেনের এক গবেষণায় [৭৬] দাবী করা হয় সমকামি ও বিষমকামীরা যৌন উদ্দীপক ঘ্রাণের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে আচরণ করে। গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, পুরুষের ঘামে থাকা টেস্টোটেরনের উপস্থিতি বিষমকামী নারী ও সমকামী পুরুষদের হাইপোথ্যালামাসের একটি অংশকে সক্রিয় করে। আবার অন্যদিকে, নারীর মূত্রের সাথে পাওয়া এস্ট্রোজেনের উপস্থিতিতে বিষমকামী পুরুষের মস্তিষ্ক ঠিক একই রকম আচরণ করে।[৭৭]
নারী ও পুরুষ লিঙ্গভেদে যেমন ভিন্ন, একইভাবে তাদের মস্তিষ্কের কিছু প্রত্যঙ্গও লিঙ্গভেদে ভিন্ন হয়। অর্থাৎ নারীর মস্তিষ্কের কিছু প্রত্যঙ্গ ও পুরুষের মস্তিষ্কের কিছু প্রত্যঙ্গ আলাদা। এছাড়া যৌন অভিমুখিতার ভিত্তিতে মস্তিষ্কের গঠনে তফাৎ আছে বলেও একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে, ডিক সোয়াব এবং মিশেল এ. হফম্যান সমকামী ও বিসমকামী পুরুষদের মস্তিষ্কের সুপারকিয়াসম্যাটিক নিউক্লিয়াসের আকারে পার্থক্য রয়েছে বলে প্রকাশ করেন।[৭৮] ১৯৯২ সালে, এলেন ও গরস্কি এন্টেরিওর কমিশারের আকারের পার্থক্যের সাথে যৌন অভিমুখিতার সম্পর্ক খুঁজে পেলেও [৭৯] তা একাধিক গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়। সেসব পরীক্ষার একটিতে দেখা যায়, মূল পার্থক্য আসলে শুধুমাত্র একটি একক বাহ্যিক কারণে ঘটে থাকে।[৮০][৮১][৮২]
পুরুষ ও নারীর মস্তিষ্কে এরুপ গাঠনিক পার্থক্য দেখার পর একটি ধারণা গড়ে উঠেছিল যে, মানুষের দুই রকম মস্তিষ্ক থাকবে। হয় নারী মস্তিষ্ক নতুবা পুরুষ মস্তিষ্ক। আর এরকম ভিন্ন মস্তিষ্কই নারী ও পুরুষের স্বভাবে ভিন্নতা তৈরী করবে। এরকম ধারণা থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছিল, তা হলো, যদি কোনো পুরুষে নারী মস্তিষ্ক থাকে, তাহলে সে হবে পুরুষ সমকামী। যদিও কিছু গবেষক এই ধারণার পিছনে কোনো শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই বলেই দাবী করেছেন। যদিও নারী-পুরুষ ভেদে মস্তিষ্কের আকারে ও মস্তিষ্কের কিছু প্রত্যঙ্গে পার্থক্য দেখা গিয়েছে, তবুও এটাই বলা যায়, নারী ও পুরুষের মস্তিষ্ক অনেক বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।[৮৩][৮৪]
সিমন লিভ্যেও মস্তিষ্কের সাথে যৌন অভিমুখিতার সংযোগ আছে কিনা; এই বিষয়ের কিছু গবেষণা করেন। তিনি হাইপোথ্যালামাসের নিউরনের চারটা গ্রুপ;- যাদেরকে আইএনএএইচ১, আইএনএএইচ২,আইএনএএইচ৩ এবং আইএনএএইচ৪ বলা হয়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। প্রাণিতে থাকা যৌন স্বভাবকে এই এলাকা সমূহ প্রভাবিত করে; এমনটা অন্যান্য গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে; কিন্তু মানুষের যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে এসব এলাকা কেমন ভূমিকা রাখে; তা জানার জন্য এগবেষণা প্রাসঙ্গিক। এ অংশের উপর গবেষণা করার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, পুর্বের তথ্য থেকে দেখা গিয়েছে, পুরুষ এবং নারীর আইএনএএইচ২ এবং আইএনএএইচ৩ এর আকারে পার্থক্য হয়।[৮৫]
তিনি হাসপাতালের ৪১ জন মৃত রোগী থেকে মস্তিষ্ক সংগ্রহ করেন। তার সংগ্রহ তিনভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম গ্রুপে ছিল ১৯ জন সমকামী পুরুষ। যারা মারা গিয়েছেন এইডস-সংক্রান্ত অসুস্থতায়। দ্বিতীয় গ্রুপে ছিল ১৬ জন পুরুষ, যাদের যৌন অভিমুখিতা অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু গবেষকরা তাদের বিষমকামী বলে অনুমান করেছেন। এই দ্বিতীয় গ্রুপের ছয়জন পুরুষ মারা গিয়েছিলেন এইডস সংক্রান্ত অসুস্থতায়। তৃতীয় গ্রুপে ছিলেন ছয়জন নারী, যাদের যৌন অভিমুখিতা বিষমকামী বলে গবেষকরা অনুমান করেছিলেন। তৃতীয় গ্রুপের একজন নারী এইডস সংক্রান্ত অসুস্থতায় মারা গিয়েছিলেন।[৮৫]
দ্বিতীয় গ্রুপের যেসমস্ত রোগীদেরকে বিষমকামী বলে অনুমান করা হয়েছে, এবং তাদের মধ্যে যারা এইচআইভি পজেটিভ ছিল, মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুসারে তাদের প্রত্যেকেই হয় ড্রাগের অপব্যবহার বা রক্ত স্থানান্তরের কারণে হয়েছিল। এদের মধ্যে দুইজন বিষমকামী; কখনো সমকামীতার মত যৌন ক্রিয়ায় (যেমনঃ পায়ুমৈথুন) যুক্ত হয়েছিলেন কিনা; চিকিৎসকের এরকম অনুমান সরাসরী প্রত্যাখান করেছিলেন। যাদেরকে বিষমকামি বলে নির্ধারণ করা হয়েছিল; তাদের প্রকৃত যৌন অভিমুখিতা কী ছিল, সেসমস্ত কোনো তথ্য পাওয়া মেডিক্যাল রেকর্ডে পাওয়া যায় নি; মোট জনসংখ্যার একটা অনুপাত হিসাব করে, তাদেরকে বিষমকামী ধরা হয়েছে।"[৮৫]
লিভ্যে আইএনএএইচ১, আইএনএএইচ২ বা আইএনএএইচ৪ এর আকারের মধ্যে পার্থক্যের কোনো প্রমাণ পান নি। কিন্তু আইএনএএইচ৩ এর আকার বিষমকামী পুরুষের গ্রুপে সমকামী পুরুষের গ্রুপের তুলনায় দ্বিগুণ বড় দেখা গিয়েছিল। এমনকি যে ছয়জন বিষমকামী কিন্তু এইডস আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, তাদেরও আইএনএএইচ৩ বড় দেখা গিয়েছিল। সমকামী পুরুষের মস্তিষ্কের আইএনএএইচ৩; বিষমকামী নারীর প্রায় সমান বলে গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে।
যাইহোক, অন্যান্য গবেষণাগুলো দেখিয়েছে যে, প্রিঅপটিক এলাকার সেক্সুয়ালি ডিমরফিক নিউক্লিয়াস, যা আইএনএএইচ৩ ধারণ করে, তা এইডসে আক্রান্ত সমকামী পুরুষে বিষমকামীর ন্যায় সমান আকারের এবং এটা নারীর তুলনায় বড়। এটা পরিষ্কারভাবে সমকামী পুরুষের; 'নারীর হাইপোথ্যালামাস থাকে', এধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। এরপরে সমকামী পুরুষদের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস যথেষ্ট বড় (বিষমকামী পুরুষে কোষে ঘনত্ব এবং নিউরনের সংখ্যা উভয়ই দ্বিগুণ)। সমকামী নারী, উভকামী পুরুষ ও উভকামী নারীর হাইপোথ্যালামাসের এই এলাকাটি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো গবেষণা করা হয় নি। যদিও এই গবেষণাটি তেমনভাবে পরীক্ষিত নয়, তারপরেও বিস্তৃত পরিসরে ডোরনারের (Dörner) স্বীকৃত অনুকল্প "সমকামী পুরুষের নারীর হাইপোথ্যালামাস থাকে" এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এই গবেষণা তীব্র সন্দেহ পোষণ করে এবং "পুরুষের নারীর চেয়ে মস্তিষ্কের কলাকৌশল ভিন্ন" হবার জন্য জন্মপুর্ব থেকে টেস্টেস্টোরেণের কার্যক্রম দায়ী; আর এ কার্যক্রম এপিজেনেটিক প্রভাবের কারণে হয়;- এমন ধারণাকেই প্রস্তাবনা করে।[৮৬][৮৭]
উইলিয়াম বাইন এবং তার কলিগগণ এই গবেষণাটি পুনরাবৃত্ত করার প্রয়াসে আইএনএএইচ১ থেকে আইএনএএইচ৪ নিয়ে এ গবেষণা পুনরায় করেন। তাদের গবেষণাটি ১৪ জন এইচআইভি-পজেটিভ সমকামী পুরুষ, ৩৪ জন বিষমকামী পুরুষ (যার দশজন এইচআইভি পজেটিভ ছিলেন) এবং ৩৪ জন সমকামী নারীর (৯ জন এইচআইভি পজেটিভ) মস্তিষ্কের উপর পরিচালিত হয়। গবেষকগণ বিষমকামী পুরুষ এবং বিষমকামী নারীর মধ্যে আইএনএএইচ৩ এর আকারের সুনির্দিষ্ট পার্থক্য খুজে পান। আইএনএএইচ৩ এর আকার সমকামী পুরুষে; বিষমকামী পুরুষের তুলনায় ছোট এবং বিষমকামী নারীর তুলনায় বড়; এমনটা দেখা যায়। যদিও এই পার্থক্যটা পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তেমন একটা উল্লেখযোগ্য নয়।[৮৮]
বাইন এবং তার সহযোগীরা আইএনএএইচ৩ এর ওজনের পাশাপাশি নিউরনের সংখ্যাও গণনা করেন। এ গণনার কাজটি লিভ্যায় করেননি। ফলাফলে দেখা গিয়েছে আইএনএএইচ৩ এর ওজন, বিষমকামী নারীর তুলনায় বিষমকামী পুরুষে সুনির্দিষ্টভাবে বেশি। সমকামী ও বিষমকামী পুরুষের নিউরনের সংখ্যায় কোনো পার্থক্য দেখা যায় নি। তবে নারী পুরুষে এই নিউরনের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হারে পার্থক্য দেখা গিয়েছে।[৮৮]
২০১০ সালে গার্কিয়া ফালগুয়েরাস এবং সোয়াবের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, "ভ্রুণ মার্তৃজঠরে থাকা অবস্থায়; মায়ের মাসিক (পিরিয়ড) চলাকালে পুরুষ শিশুর ক্ষেত্রে টেস্টেস্টোরণ প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়া করে। আর নারী ভ্রুণের ক্ষেত্রে এই হরমোনের অনুপস্থিতিতে আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ ঘটে। এইভাবেই মার্তৃগর্ভে থাকা অবস্থায় আমাদের লিঙ্গ পরিচয় (আমরা পুরুষ হব নাকি নারী) এবং যৌন অভিমুখিতা; আমাদের মস্তিষ্কের গঠনের সময় নির্ধারিত হয়। গবেষণা থেকে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি যা থেকে বলা যায়; জন্মের পর সামাজিক পরিবেশ যৌন পরিচয় বা যৌন অভিমুখিতায় প্রভাব ফেলে।"[৮৯]
সমকামিতার জন্য প্রাথমিকভাবে স্নায়বিক কলাকৌশল কীভাবে কাজ করে, তা বুঝার জন্য গৃহপালিত ভেড়াকে গবেষণামুলক মডেল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গিয়েছে, গৃহিপালিত পুরুষ ভেড়ার ৮ শতাংশ অন্য পুরুষ ভেড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষ ভেড়াই নারী ভেড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়। বেশিরভাগ প্রজাতির ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ জীবের মস্তিষ্কে একটা সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বৈশিষ্ট্যটি হল প্রিঅপটিক হাইপোথ্যালামাসে অবস্থিত সেক্সুয়াল ডিমরফিক নিউক্লিয়াস (এসডিএন) নারীর চেয়ে পুরুষে সাধারণত বড় হয়।
রোসেলি এবং তার সহগবেষকরা তাদের গবেষণায় দেখেন, পুরুষ ভেড়ার প্রতি যেসব পুরুষ ভেড়া আকৃষ্ট হয় সেই ভেড়াগুলোর প্রিঅপটিক হাইপোথ্যালামাসের এসডিএন, বিষমকামী পুরুষ ভেড়ার চেয়ে ছোট। সমকামী পুরুষ ভেড়ার এসডিএনের আকার নারী ভেড়ার সমরুপ। ভেড়ার এসডিএনের স্নায়ুর কার্যাকলাপের বিশ্লেষণ থেকে দেখা গিয়েছে বিষমকামী পুরুষ ভেড়ার তুলনায় সমকামী পুরুষ ভেড়াতে এরোম্যাটাস উৎসেচকের উপস্থিতি কম যা ইঙ্গিত করে যৌন প্রবণতা স্নায়ুতান্ত্রিকভাবে নির্ধারিত এবং হরমোনের প্রভাবে থাকতে পারে।[৯০]
প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যৌন অভিমুখিতা কেমন হবে তার একটি আগাম নির্দেশক শৈশবকালীন লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা , যা গবেষণাগুলোতে পুন:পুন উল্লেখিত হয়েছে এবং বিষমকামী এবং অবিষমকামী (উভকামী সমকামী ইত্যাদি) মানুষে যে পার্থক্য তা বোঝার ক্ষেত্রে এবিষয়টিকে শক্তিশালী জীবতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জে মাইকেল বেলীর একটি গবেষণামূলক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে: "বালকের ক্ষেত্রে শৈশবকালীন লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখা যাওয়ার কিছু ধরণ রয়েছে, যেমন: বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরা, লম্বা চুল রাখার প্রবণতা, পুতুল নিয়ে খেলা, প্রতিযোগিতামূলক এবং রুক্ষ (মারপিট, কাবাডি ইত্যাদি) খেলাগুলো খেলতে অপছন্দ করা, মেয়েদের খেলার সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা, পরিবার থেকে অল্প একটু বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় আতঙ্ক তৈরি হওয়া এবং নিজেকে নারী ভাবতে পছন্দ করা। ঠিক একই রকম ভাবে বালিকার ক্ষেত্রেও শৈশব কালীন লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখা যাওয়ার কিছু ধরন রয়েছে যেমন: বালকের মত পোশাক পরা এবং তাদের সাথে খেলার প্রবণতা, প্রতিযোগিতামূলক এবং রুক্ষ খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখানো, সাধারণত মেয়েরা যে ধরনের খেলনা পছন্দ করে বা মেকআপ করে তার প্রতি অনাগ্রহ দেখানো এবং ছেলে হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা।" এই ধরনের লৈঙ্গিক অনিশ্চিয়তার স্বভাব বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বেই তাদের মধ্যে দেখা যায়, প্রায়সময় ২ বছর বয়স থেকেই এই স্বভাব দেখা যায়। শিশুদের লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তার ব্যাপারটি তখনি নিশ্চিত হওয়া যাবে, যদি তারা কদাচিৎ নয় বরং উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলো বারংবার দেখায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সরলরৈখিকভাবে একটার পর একটা নাও দেখা যেতে পারে বরং একাধিক বৈশিষ্ট্য একত্রে দেখা যেতে পারে।[৪]
একাধিক গবেষণায় যেসব সমকামী উভকামী এবং বিষমকামীরা অংশ নিয়েছিল, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, শৈশবে তাদের আচরণ কিরুপ ছিল। এছাড়াও অন্তর্ভুক্তিমূলক কিছু গবেষণায় যেসব শিশু তীব্রভাবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখিয়েছে, তাদেরকে শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, যাতে করে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তার যৌন অভিমুখিতা কী হবে তা গবেষণায় লিপিবদ্ধ করা যায়। এধরনের গবেষণার আলোকে বলা যায়, যেসব শিশু বড় হওয়ার পর অবিষমকামী হয়, গড়পড়তায় তারা শৈশবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তার বৈশিষ্ট্য দেখায়। অতীত পর্যালোচনা করে-এরুপ একটি গবেষণার তথ্যমতে সমকামী মানুষজনের ৮৯ শতাংশ সমকামী শৈশবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখিয়েছে, পক্ষান্তরে বিষমকামী জনগোষ্ঠীর ২ শতাংশ বিষমকামী শৈশবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখিয়েছে। নারী যৌন অভিমুখিতার ক্ষেত্রেও গবেষণাটিতে লব্ধ উপাত্ত বলছে সমকামী নারীদের ৮১ শতাংশ এবং বিষমকামী নারীদের ১২ শতাংশ শৈশবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখায়। আরো বিভিন্ন ভাবে যেমন শৈশবের সংরক্ষিত ভিডিও, ছবি এবং পিতামাতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এই গবেষণালব্ধ উপাত্তকে নিশ্চিত প্রমাণ করে।[৪] এই গবেষণার সমালোচকরা এই গবেষণাটিকে সমাজে প্রচলিত বয়ানকে (সমকামী পুরুষরা মেয়েলী আচরণ এবং সমকামী নারীরা পুরুষালি আচরণ) সত্যায়িত করে মর্মে সমালোচনা করেছেন। যাইহোক, পরবর্তীতে হওয়া কোনো গবেষণা থেকেই দেখা যায় নি, উক্ত গবেষণাটিতে প্রাপ্ত ফলাফলকে অতিরঞ্জিত ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জে. মাইকেল বেইলি যুক্তি দিয়ে বলেন সমকামী পুরুষরা বেশিরভাগ সময়ই এটা স্বীকার করতে চান না যে শৈশবে তাদের মধ্যে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল৷ কারণ তারা হয়তো পিতামাতার কাছে এতে কঠোর শাসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন বা নিজের বন্ধুবান্ধবদের কাছে কটুক্তির স্বীকার হয়েছিলেন। এবং তারা হয়তো সমকামী পুরুষদের মেয়েলী আচরণকে পছন্দ করেন না। তাই তারা নিজেরাও যে শৈশবে এই আচরণ করতেন তা জোড় করে ভুলে যেতে চান।[৯১](p80) পশ্চিমা সভ্যতার সাথে সাথে পশ্চিমা সভ্যতা নয় এরকম জায়গা যেমন লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, পলিনেসিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে করা গবেষণাগুলোতেও দেখা গিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যারা অবিষমকামী, তারা শৈশবে লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা দেখিয়েছেন।[৪]
এই গবেষণা লব্ধ ফলাফল থেকে ঢালাওভাবে বলা যায় না, সকল অবিষমকামী মানুষের মধ্যেই শৈশবে উপরোল্লিখিত লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তার বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছিল, কিন্তু এই ধরনের গবেষণা এটাই ইঙ্গিত করে একজন মানুষের যৌন অভিমুখিতা কী তা জানার বহুআগেই প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় একজন অবিষমকামী শৈশবে গড়পড়তায় অন্য শিশুদের চেয়ে সুষ্পষ্টভাবে আলাদা ছিল। শৈশবে যেসব বাচ্চা লৈঙ্গিক অনিশ্চিত আচরণ করেছে, তাদেরকে এধরনের আচরণ করতে উৎসাহিত বা বাধ্য করা হয়েছে এস্বপক্ষে প্রমাণাদি খুব কম, বরং বাচ্চাদের সামাজিক প্রথা অনুসরণ বড় করা সত্ত্বেও (ছেলে ও মেয়ে শিশুর জন্য স্বতন্ত্র পোশাক, খেলনা ইত্যাদি) তাদের মধ্যে লৈঙ্গিক অনিশ্চিত স্বভাবের উদ্ভব ঘটে।[৪] চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণাগুলো থেকে দেখা গিয়েছে, ছেলেশিশুর (সর্বোচ্চ ১ বছর বয়স) সামাজিক লিঙ্গ নির্ধারণের লক্ষ্যে লিঙ্গ পরিবর্তন জনিত অস্ত্রোপচার করার পরে তাকে মেয়ে হিসেবে বড় করা সত্ত্বেও তার মধ্যে মেয়েলিপণা দেখা যায় না এবং পুরুষের প্রতি সে আকৃষ্ট হয়না।[৪]
১৯৬০ থেকে ২০০০ সময়ের মধ্যে যেসব নবজাতক ও ছেলে শিশুরা ত্রুটিপূর্ণ শিশ্ন নিয়ে জন্মাত অথবা দুর্ঘটনাবশত শিশ্ন অপসারণ করা ছাড়া উপায় ছিল না, শল্যচিকিৎসকরা তাদের লিঙ্গকে নারী হিসেবে নির্ধারণ করে অস্ত্রোপচার করতেন।[৪]:৭২–৭৩বেশিরভাগ শল্যচিকিৎসক বিশ্বাস করতেন, এই ছেলে শিশুরা ভাল থাকবে যদি তারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এবং সামাজিকভাবে নারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরকম প্রকাশিত ৭ টি ক্ষেত্রে- যাদের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল এবং যৌন অভিমুখিতা জানা গিয়েছিল; তাদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তারা নারীর প্রতিই আকৃষ্ট হয়। সাত জন ব্যক্তির মধ্যে ছয় জন ব্যক্তি শুধুমাত্র নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং অন্যজনও বেশিরভাগ সময় নারীর প্রতি, কদাচিৎ সম বা উভলিঙ্গের মানুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। এজাতীয় একাধিক গবেষণা কে পুনঃমূল্যায়ন করে সাইকোলজিকাল সাইন্স ইন দ্য পাবলিক ইন্টারেস্ট সাময়িকীতে জে মাইকেল বেইলী সহ ৬ জন গবেষক বলেন, এ থেকে প্রমাণিত হয় পুরুষের যৌন অভিমুখিতা জন্ম পূর্বে কিছুটা হলেও নির্ধারিত থাকে:
যদি পুরুষ সমকামিতা প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে যে ফলাফল পাওয়ার কথা আমরা ঠিক সেটাই পেয়েছি। যদি পুরুষের যৌন প্রবৃত্তি সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হত, তাহলে উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে মেয়ে হিসেবে বড় করা ব্যক্তিরা কোনোভাবেই মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হত না। এই গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পুরুষের যৌন অভিমুখিতাকে জন্মের পরে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে প্রভাবিত করা কতটা কঠিন।
তারা আরো যুক্তি দিয়ে বলেন, যৌন অভিমুখিতার উপর সমাজের ভূমিকা নিয়ে যে বয়ান চালু আছে, এ গবেষণা সে ধারণাকেও প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। তারা বলেন, "শিশুকালে থাকা অবস্থায় ছেলে শিশুর লিঙ্গ অপসারণ করে এবং মেয়ের মত করে প্রতিপালন করেও যদি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নারীর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা না যায়, তবে পুরুষ যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে কোন মনোসামাজিক হস্তক্ষেপের ভূমিকা থাকবে?" এরপরে আরো বলা হয় ক্লোয়িক্যাল এক্সট্রপি (অবসারণী সংস্কার) (পুংলিঙ্গে জন্মগত অস্বাভাবিকতা থাকা) অথবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে যাদের লিঙ্গ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছিল, তাদের জন্মপূর্বে এন্ড্রোজেন হরমোনের স্বাভাবিক স্তরে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায় নি। অর্থাৎ জন্ম থেকেই ওই ছেলে শিশুদের মস্তিষ্ক পুরুষোচিত হয়ে গিয়েছিল। ৭ জনের মধ্যে ৬ জনই প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নিজেদের বিষমকামী পুরুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল, যদিও তাদের অস্ত্রোপচার করে এবং সামাজিক ভাবে মেয়ে শিশু হিসেবে প্রতিপালন করা হয়েছিল। গবেষকরা এ ব্যাপারটাতে আলোকপাত করে বলেন, "পর্যাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় এই ক্ষেত্রে শিশুর পিতামাতা তাদের সন্তানকে নারী হিসেবে বড় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং নারী সুলভ আচরণ করানোর জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।"[৪]
কোয়াসি পরীক্ষণ নামে একধরণের গবেষণা আছে। প্রকৃত গবেষণায় গবেষকরা তাদের গবেষণার বিষয়বস্তুকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে গবেষণার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু কোয়াসি গবেষণায় বিভিন্ন শ্রেণি বা দলে বিভক্ত করার প্রক্রিয়াটি গবেষকদের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও গবেষকরা ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। বেইলি এবং তার সহগবেষকরা অস্ত্রোপচার করে লিঙ্গ পুন:নির্ধারণের এই প্রক্রিয়াকে কোয়াসি পরীক্ষণের প্রায় কাছাকাছি পরীক্ষণ বলে অভিহিত করেন। তাদের মতে পুরুষের সমকামিতা প্রকৃতি নির্ধারিত না সমাজ নিয়ন্ত্রিত তা এই পরীক্ষণের ফলাফল থেকে অনুধাবন করা যায়।[৪]
বিষমকামীদের যৌন আচরণের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চা প্রজননের হার কমে যায়। যা টিকে থাকার লড়াইয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন ধারণা অনুসারে বিবর্তনের হার কমাতে সমকামিতা সরাসরি জড়িত। তবুও সমকামিতা কেন টিকে গেলো, আর বিবর্তনের মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করা যায় কীভাবে এই সমস্যা সমাধানে বেশকিছু গবেষণা ভিন্ন ভিন্ন তাত্ত্বিক ও পরীক্ষণীয় ব্যাখ্যা দিয়েছে।[৭][৯২]
কিছু কিছু গবেষক[৯২] বলেন, বিষমকামীদের ভাই-বোনের মধ্যে প্রজনন না ঘটার যেরকম সুবিধে আছে ঠিক সেভাবেই সমকামিতা পরোক্ষভাবে অভিযোজিত ক্ষমতার জন্য কাজ করে। উদাহরণস্বরুপ সিকল সেল এনিমিয়া হওয়ার কারণ একটি নির্দিষ্ট অ্যালীল। এই অ্যালীলের দুইটি কপি উপস্থিত থাকলে রোগটি হয় আবার এক কপি উপস্থিত থাকলে তা ম্যালেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যা হেটেরোজাইগোসীয় সুবিধা বলে চিহ্নিত। অর্থাৎ একটি রোগ অন্য আরেকটি রোগের বিরুদ্ধে কাজ করছে। [৯৩]
কুইন্সল্যান্ড ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চের ব্রেন্ড জিয়েৎস একটি ভিন্ন তত্ত্বের প্রস্তাবনা দেন। তার প্রদত্ত তত্ত্বে যেসব পুরুষেরা নারীদের মতো (যেমন যত্ন নেওয়া, আবেগপ্রবণতা, স্নেহপ্রবণতা) বৈশিষ্ট্য দেখায় তারা নারীদের নিকট আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে এবং তাদের [নারীরূপ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনকারী] সংগম সঙ্গী পাওয়ার হার তুলনামূলকভাবে বেশি। একারণে সমকামিতা সম্পুর্ণভাবে জিন থেকে হারিয়ে যায় না।[৯৪]
২০০৮ সালে করা একটি গবেষণার গবেষকরা বলেন "বিবেচনা করার মত এমন অনেক প্রমাণ আছে যে, মানুষের যৌন অভিমুখিতা জিনগতভাবে প্রভাবিত। তাই এটা জানা যায় না কেন সমকামীতার ফলে সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা এত কম থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের জনসংখ্যায় এত অধিক হারে দেখা যায়। তারা প্রস্তাবিত অনুকল্পে বলেন, যেহেতু সমকামিতাকে নিয়ন্ত্রণকারী জিন সমকামীদের প্রজননের সফলতা হ্রাস করে, তার মানে পক্ষান্তরে, একই জিন যেসব বিষমকামীদের থাকে, তারা নিশ্চয়ই কোনো সুবিধাও পায়।" গবেষকদের গবেষণালব্ধ ফলাফল এটাই প্রস্তাবনা করে যে, "যেসব জিনের কারণে সমকামিতা দেখা যায়, সেই একই জিন বিষমকামীদের প্রজননে সফলতার সুবিধা দেয় এবং এইভাবেই বিবর্তনের ছাঁকুনিতে কীভাবে সমকামিতা টিকে রয়েছে, বা জনসংখ্যায় কেন সমকামিতা দেখা যায়, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।" [৯৫] যাইহোক, এর বিপরীতে আরো একটি বিকল্প সমাধানকে তারা উড়িয়ে দেন নি। তাদের মতে বিষমকামীরা সমকামিতার জিন বহন করায় সুবিধা পেতে পারে, এটা তাদের একটি প্রস্তাবনা হলেও, অপর প্রস্তাবনাটি হলো সমকামী-বিষমকামী যমজ সন্তানের ক্ষেত্রে, সমকামী সন্তানটিকে অপরজনের মত অনেক বেশি বিষমকামী আচরণ প্রকাশ করতে সমাজ-পরিবার কর্তৃক চাপ প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে তাদের একাধিক যৌন সঙ্গী হয় এবং এভাবেই সমকামিতার বৈশিষ্ট্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। একইসাথে গবেষকরা এটাও স্বীকার করেছ্বন, একাধিক যৌন সঙ্গী মাত্রই যে বংশবৃদ্ধিতে বিশাল সফলতা তা নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে যৌনসঙ্গীর সাথে বংশবৃদ্ধির সফলতার মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণের মত যথেষ্ট প্রমাণাদি অতীত বা বর্তমানের বিবর্তনীয় ইতিহাসে নেই।
২০০৪ সালে প্রকাশিত এক ইতালীয় গবেষণার মাধ্যমে সমকামিতা সুবিধা অনুকল্প আরো শক্ত সমর্থন পায়। এই গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষের মার্তৃকুলের আত্মীয়দের মাঝে ঊর্বরতার হার বেশি।[৭৪][৭৫] হ্যামার বিষয়টিকে উল্লেখ করে বলেন,[৯৬] যেসব নারীরা "গে জিন" বহন করেন, তাদের প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; যার ফলে মোট জনসংখ্যায় উচ্চতর ভাবেই সমকামিতা বজায় থাকে।[৭৫]
"সমকামী চাচা অনুকল্প" মতে সমকামী ব্যক্তির নিজের সন্তান না থাকলেও, আপন আত্মীয়ের সন্তানদের খাদ্য, প্রতিরক্ষা, আশ্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ এর মত ব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে, তাদের সন্তানের জিনে প্রভাব ফেলতে পারে। এই সন্তানরা ভালভাবে টিকে থাকার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তারা তাদের সমকামী চাচার শেয়ার করা জিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ভবিষ্যতের জন্য সফলভাবে সংরক্ষণ করে।[৯৭]
এই অনুকল্পটি আত্মীয় নির্বাচন মুলক তত্ত্বের একটি সম্প্রসারিত রুপ। এই অনুকল্পটি প্রস্তাবনার কারণ ছিল জীবের কিছু আচরণকে ব্যাখ্যা করা, যে আচরণ বা প্রবৃত্তিকে খোলা চোখে দেখলে টিকে থাকার পথে অন্তরায় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে পরোক্ষভাবে তা সমগ্র জীবকে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেয়। ১৯৩২ সালে জে. বি. এস হালডেন প্রাথমিক ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন এবং পরবর্তীতে জন মায়ানার্ড স্মিথ, ডব্লিউ ডি হ্যামিলটন এবং মেরী জেন ওয়েস্ট-এবারহার্ড আরো বিশদভাবে একে ব্যাখ্যা করেন।[৯৮][৯৯] এই ধারণাটি কিছু সামাজিক পোকামাকড়ের আচরণ (যেমন: পিপড়া, মৌমাছি ইত্যাদি) ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। যেখানে অধিকাংশ সদস্যই প্রজনন করে না, কিন্তু সম্পুর্ণ কলোনীকে টিকে থাকতে তারা সাহায্য করে। পক্ষান্তরে সামাজিক মনোবিজ্ঞানী ডেভিড বাস এই ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, এমন কোন পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রমাণ নেই, যা এই অনুকল্পটিকে সমর্থন করে।[১০০]
২০০১ খ্রিস্টাব্দে ইভ্যুলেশন এন্ড হিউম্যান বিহেভিয়ার সাময়িকীতে একটি জরিপ প্রকাশিত হয়। সেই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭ জন বিষমকামী এবং ৬৬ জন সমকামী পুরুষকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে দেখা যায়, সমকামী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্ক রাখার প্রবণতা কম। বিষমকামী ব্যক্তিরা পরিবারকে এবং তাদের ভাইবোনকে সমকামীদের তুলনায় অধিকতর আর্থিক সহযোগিতা করেন।[১০১] ২০০৫ সালে আর্কাইভ অব সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার সাময়িকীতে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। ইংল্যাণ্ডে বসবাস করা ৬০ জন সমকামী এবং ৬০ জন বিষমকামী ব্যক্তির উপর করা গবেষণাটিতে দেখা যায়, সমকামী এবং বিষমকামী ব্যক্তির মধ্যে পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে এবং পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য নেই।[১০২] ভাসে, পকক এবং ভ্যান্ডারলেন ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ও ভাসে এবং ভ্যান্ডারল্যান ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সামোয়ার প্যাসিফিক দ্বীপে এই তত্ত্বকে পরীক্ষণ করেন। তারা সেখানকার নারী, বিষমকামী পুরুষ এবং ফাফাফাইন পুরুষের উপর গবেষণা চালান। এই দ্বীপের যেসব মানুষ জন্মসুত্রে পুরুষ হলেও যৌন সঙ্গী নির্বাচনের দিক থেকে পুরুষকে বাছাই করে তাদের ফাফাফাইন নামে অভিহিত করা হয়। তারা সংস্কৃতিগত দিক থেকে সে সমাজে স্বতন্ত্র তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভাসে এবং ভ্যান্ডারল্যান দেখতে পান, ফাফাফাইনরা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সন্তানকে সাহায্য করতে অতীব আগ্রহী থাকলেও যেসব শিশু তাদের পরিবারের সন্তান নয়; তাদেরকে খুব একটা সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। এই পরীক্ষণটিই আত্মীয় নির্বাচন মুলক অনুকল্পের পক্ষে প্রথম প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অনুকল্পটি সমকামিতা নিয়ে সেইসব গবেষণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেই গবেষণাগুলোতে ভাই থাকার সাথে সমকামিতা দেখা যাওয়ার কারণ এবং জমজ ভাইদের মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা হয়েছে।[১০৩][১০৪][১০৫]
নৃতত্ত্ববিদ রেয়মন্ড হ্যামস উল্লেখ করেন ভাসে এবং ভ্যান্ডারলেনের করা গবেষণায় যে ফাফাফাইনের কথা উঠে এসেছে, তারা জন্মগত ভাবে পুরুষ, পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু নিজেদের জন্মগত লিঙ্গ থেকে আলাদা লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়। পক্ষান্তরে পশ্চিমা বিশ্বে সমকামীরা সমাজ ঘোষিত লিঙ্গকেই গ্রহণ করে নেয়, সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়, এবং নারী পুরুষ সমকামী বিষমকামী সবাই সমান অধিকার পায়। ফলে ফাফাফাইনদের উপর করা গবেষণার ফল সমানভাবে পশ্চিমা সমকামীদের উপর বর্তাবে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।[১০৬] যেকোনো সমাজে সমকামী পুরুষেরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের সন্তানকে বেশি যত্ন আত্তী করে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য এমন একটি সমাজের অভ্যন্তরে গবেষণা করা প্রয়োজন, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই সবাই তাদের পরিবারের খেয়াল রাখে এবং আশেপাশের সবার ভালোভাবে খোঁজ নেয়। এইকারণে জাপানকে বেছে নেওয়া হয়েছে এবং ২০১১ সালে ভ্যাসে এবং ভ্যান্ডারলেন সেখানে একটি গবেষণা করে দেখতে পান, সমকামী এবং বিষমকামী পুরুষ- উভয়ক্ষেত্রেই আত্মীয়স্বজনের সন্তানকে একই রকম স্নেহ করে। ভ্যাসে এবং ভ্যান্ডারলেন প্রমাণ উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত টানেন, যে সমাজের সংস্কৃতিই হলো পরিবারের এবং আত্মীয়-স্বজনের যত্ন করা, সেই সমাজে সমকামীরা আলাদা করে অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ হবেন না। তাদের আত্মীয়ের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের গুণাবলী প্রকাশের জন্য শুধুমাত্র সমাজ নয় বরং অন্য অনেক ফ্যাক্টর জড়িত।[১০৭] ২০১১ এবং ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে জার্নাল অব কগনিশন এন্ড কালচার দুইটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায়, কানাডীয় বিষমকামী পুরুষ ও নারীর তুলনায় সমকামী পুরুষ ও নারীরা তাদের নিকটাত্মীয়ের সন্তানের প্রতি অনেক বেশি যত্ন প্রবণ। কিন্তু আত্মীয় স্বজন যদি অনেক দূরে অবস্থান করে সেক্ষেত্রে সমকামীদের তাদের স্বজনের প্রতি এই গভীর বন্ধন কিছুটা হ্রাস পায়।[১০৮][১০৯]
কিছু গবেষণা মানুষ ও তার যৌন অভিমুখিতার মধ্যে শারীরবৃত্তের আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। প্রমাণ সমৃদ্ধ এই গবেষণাগুলো অনুযায়ীঃ
জে. মাইকেল বেইলি যুক্তি দেখান; সমকামীদের জৈবনিক মার্কার দেখা যায় কী যায় না-এর (Biological markers) পরিবর্তে প্রাক শৈশব লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তা মুলক আচরণ সমকামিতা যে সহজাত প্রবৃত্তি তার জন্য অধিকতর ভাল প্রমাণ। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন সমকামী পুরুষেরা তাদের শৈশবকালীন লৈঙ্গিক অনিশ্চয়তার জন্য যতটা না প্রশংসা বা পুরস্কার পান তার চেয়ে বেশি তিরস্কৃত হন এবং ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিও পেতে হয়। অর্থাৎ শৈশবে সমাজ কর্তৃক এই আচরণ বিকশিত হওয়ার সময় বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও সমাজে এর আধিক্য দেখে বুঝা যায়, এ আচরণ শতভাগ সহজাত প্রবৃত্তি থেকে উৎসরিত। [১৩৮]
যৌন অভিমুখিতার সাথে জিনগত বা মনস্তত্ব বিষয় এর সম্পর্ক আছে কিনা; তা নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। দ্য এডভোকেট নামক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পত্রিকার ১৯৯৬ সালের প্রতিবেদন মতে, ঐ পত্রিকার ৬১ শতাংশ পাঠক মনে করে "যদি গবেষণা থেকে সমকামিতা জৈবিকভাবে স্বীকৃত এমন দাবীর পক্ষে সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হবে।"[১৩৯] যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন এবং সুইডেনে করা একটি জরিপ থেকে দেখা গিয়েছে, যেসব ব্যক্তি সমকামিতা জন্মগত বলে বিশ্বাস করে তাদের সমকামীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর মাত্রা; যারা সমকামিতা মানুষের ইচ্ছাকৃত ধরে নেয়, তাদের তুলনায় বেশি।[১৪০][১৪১]
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কাওকে তার লিঙ্গ, বয়স ভেদে বৈষম্য করা যায় না। কিন্তু আইনের মারপ্যাচে এমন যদি কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যেখানে দেখা যায়, কারো প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে, তখন সরকার সেই আইনকে সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে[১৪২]। যদি যৌন অভিমুখিতার পক্ষে জীববৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, অর্থাৎ যৌন অভিমুখিতা ইচ্ছা করলেই পরিবর্তন করা যায় না, তাহলে সরকার লিঙ্গ বৈষম্যকারী আইনকে সহজেই অসাংবিধানিক ঘোষণা দিতে পারে।[১৪৩][১৪৪][১৪৫]
সমাজে রক্ষণশীলবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকেও যৌন সংখ্যালঘুদের সামাজিক অবস্থান শক্ত করার ক্ষেত্রে যৌন অভিমুখিতার সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওয়াশিংটন ডি.সির একটি রক্ষণশীল খ্রিস্টান দল "গেটিং ইট স্ট্রেইট" বইয়ে যুক্তি দিয়ে বলেন, গায়ের রঙ জিনগতভাবে নির্ধারিত- এরকম যুক্তির বলেই আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি কোনো বৈষম্য যেন না হয়; তা আইন করে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার মতে ভবিষ্যতে সমকামিতা জন্মগতভাবে নির্ধারিত এরকম যুক্তি তুলে সমকামীদের সাথে হওয়া বৈষম্যকে বর্ণবৈষম্যের মত আইনগত ভাবে মোকাবিলা করা হবে। পক্ষান্তরে রেভারেন্ড রবার্ট শ্নেক এর মতো সামাজিক রক্ষণবাদী ব্যক্তির মতে, যে কেউ যে কোন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তথ্য মেনে নিতে পারে। যদিও তিনি নৈতিকভাবে সমকামিতা বিরোধী।[১৪৬] জাতীয় বিবাহ সংঘের বোর্ড চ্যামার ও গল্প লেখক অরসন স্কট কার্ড সমকামিতার উপরে জীববৈজ্ঞানিক গবেষণার পক্ষে লিখেছেন। তার মতে, সমকামিতার কারণে হিসেবে জিনগত কিংবা জীববিজ্ঞানীয় কারণ নির্ধারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সমকামিদের অধিকার প্রাপ্তিতে অবদান রাখতে পারে। এই গবেষণাগুলো কোনভাবেই সমকামিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে নয় বরং প্রমাণের জন্য, সমকামিতার কোন ঔষধ নেই, কারণ এটি কোন রোগ নয়। সমকামীদের বেঁচে থাকা ও জীবনযাপনের ইচ্ছা একটি ভিন্ন ধরনের জীবনযাপন বলে তিনি অভিহিত করেন।"[১৪৭]
কিছু কিছু সমকামী আন্দোলন কর্মী সমকামিতাকে স্বাভাবিক যৌনতা থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেন, তারা সমকামিতাকে জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখার পরিবর্তে সামাজিক এবং নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পক্ষে কাজ করেন। অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্র, রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সমাজে যৌন সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য যেন হ্রাস পায় এবং তারা যেন সমাজে মর্যাদা এবং সম্মানের সাথে বেঁচে থাকে।[১৪৬] সাংবাদিক চ্যান্ডলার বার শংকা প্রকাশ করে বলেছেন, যৌন অভিমুখিতার জীববৈজ্ঞানিক ভিত্তি সমকামীদের প্রতি বৈষম্য এবং তাদের উপর হওয়া বিভিন্ন ক্ষতিকর চর্চাকে উস্কে দিতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তি সমকামী হলে তার অভিভাবক শল্যচিকিৎসা বা রাসায়নিক ঔষুধ সেবন করিয়ে তার যৌনতা পরিবর্তন করতে চাইতে পারে। অথবা সন্তান সমকামী হবে এই সম্ভাবনা থাকলে গর্ভকালীন সময়ে ভ্রুণ হত্যার মত কাজও পিতামাতা করতে পারেন। ইতিহাসে বহুকাল ধরে কনভার্সন থেরাপির মত অপবৈজ্ঞানিক চর্চার মাধ্যমে যৌন আকর্ষণ পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে।[১৪৮] সায়মন লভের কাছে এই ধরনের শংকা প্রকাশ করে আসা চিঠির প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, "সমকামিতার উপর হওয়া গবেষণা গে ও লেসবিয়ানদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে"।[১৪৬]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.