Loading AI tools
জাতিসংঘের মহাসচিব ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দগ হামারহোল্ড (ইংরেজিতেঃ Dag Hammarskjöld; জন্মঃ ২৯ জুলাই, ১৯০৫ - মৃত্যুঃ ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১) সুইডেনের খ্যাতিমান কূটনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক ছিলেন। তার পুরো নাম ডগ হালমার আগ্নে কার্ল হামারশোল্ড। জাতিসংঘের ২য় মহাসচিব হিসেবে তিনি এপ্রিল, ১৯৫৩ থেকে সেপ্টেম্বর, ১৯৬১ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। কিন্তু বিমান দূর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে তিনি মেয়াদ পূর্তি করতে পারেননি। নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পর থেকে তিনি ছিলেন চার জন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি মরণোত্তর নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছিলেন।[1] একমাত্র জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে হামারশোল্ড কর্মরত অবস্থায় মারা যান। যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় সম্পৃক্ততাজনিত কারণে পথিমধ্যে বিমান দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যু পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি হামারশোল্ডকে আমাদের শতকের বিখ্যাত মুখপত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন।[2]
;দগ হামারহোল্ড | |
---|---|
জাতিসংঘের ২য় মহাসচিব | |
কাজের মেয়াদ ১০ এপ্রিল, ১৯৫৩ – ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১ | |
পূর্বসূরী | ট্রাইগভে লাই |
উত্তরসূরী | উ থান্ট |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | দগ হালমার আগ্নে কার্ল হামারশোল্ড ২৯ জুলাই ১৯০৫ জনকোপিং, সুইডেন |
মৃত্যু | ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬১ ৫৬) এনদোলা, রোডেশিয়া এবং নিয়াসাল্যান্ড | (বয়স
জাতীয়তা | সুইডিশ |
ধর্ম | লুথারান/চার্চ অব সুইডেন |
সুইডেনের জনকোপিং এলাকায় ডগ হামারশোল্ডের জন্ম। কিন্তু, তিনি শৈশবের অধিকাংশ সময়ই আপসালা এলাকায় ব্যয় করেন। হালমার হামারশোল্ডের চতুর্থ এবং কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। হালমার হামারশোল্ড ছিলেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তার মায়ের নাম আগ্নেজ হামারশোল্ড (বিবাহ-পূর্ব আল্মকুইস্ট)। হামারশোল্ডের পূর্ব-পূরুষগণ সুইডেন সাম্রাজ্যে চাকরি করতেন।
প্রথমে আপসালার ক্যাটেড্রালস্কোলানে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে আপসালা ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এ সময়েই হামারশোল্ড ফার্স্ট কিউরেটর বা প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছাত্রদের সংগঠন আপল্যান্ডস ন্যাশনে চাকরি করেন। পরবর্তীকালে তিনি স্টকহোম নেশনে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।
১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত হামারশোল্ড বেকারত্ব বিষয়ক সরকারি কমিটির সচিব হিসেবে কাজ করেন। এ সময় তিনি অর্থনীতি বিষয়ক কনজান্কটারস্প্রিডনিনজেন বা 'ব্যবসায়িক চক্রের বিস্তার' শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। এর মাধ্যমেই তিনি স্টকহোম ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৩৬ সালে ডগ হামারশোল্ড সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ব্যাংক সারিজেস রিক্সব্যাংক বা 'ব্যাংক অব সুইডেনের' সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন।[3] সেখানে তিনি খুব দ্রুত স্বীয় মেধাবলে পদোন্নতি ঘটান। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ ব্যাংকের সভাপতি হিসেবে আসীন ছিলেন।
এ সময়ে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৫-এর শুরুতে তিনি 'আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা' সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারের অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীভূতকরণ সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি সুইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে 'স্টেট সেক্রেটারী' হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৪৮ সালে প্যারিস সম্মেলনের মার্শাল পরিকল্পনায় প্রতিনিধিত্ব করেন। পুনরায় তিনি প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থায়ও উপস্থিত ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে হামারশোল্ড ইউনিস্ক্যানে সুইডেনের প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলের তরফে তিনি মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হলেও তিনি কখনো কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সুইডেনের প্রতিনিধি দলের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদে সুইডেনের প্রতিনিধি দলের সভাপতি নিযুক্ত হন। ২০ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ সালে সুইডিশ একাডেমীতে তার পিতার মৃত্যুজনিত শূন্য আসনে নির্বাচিত হন।
১৯৫৩ সালে ট্রাইগভে লাই জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে পদত্যাগ করেন। ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উক্ত পদের জন্য হামারশোল্ডের নাম সুপারিশ করে। আকস্মিকভাবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হন।[4] রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তিনি নিরপেক্ষভাবে মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। ফলে, ৩১ মার্চ তিনি নিরাপত্তা পরিষদের ১১ সদস্যের মধ্যে ১০ সদস্যের ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৭–১০ এপ্রিলের অধিবেশনে ৬০ ভোটের মধ্যে ৫৭ ভোট প্রদান করে তাকে নির্বাচিত করে। ১৯৫৭ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
হামারশোল্ড কর্মময় জীবনে তার নিজ দপ্তরে ৪,০০০ প্রশাসক নিয়োগ করেন এবং অধ্যাদেশ জারী করে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়ন করেন। এছাড়াও তিনি সক্রিয়ভাবে জাতিসংঘের কার্যোপযোগী পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে ক্ষুদ্রতম প্রকল্পগুলোয়ও সংশ্লিষ্টতা রেখেছিলেন নিজেকে। তার পরিকল্পনা এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ সদর দফতরে 'মেডিটেশন রুম' বা ধ্যান কক্ষ সৃষ্টি করেন। কক্ষটি নীরবতায় পরিপূর্ণ যেখানে কর্মীরা নিজেকে সকল কাজ থেকে দূরে রেখে অমনোযোগী না হয়ে তাদের বিশ্বাস, ধর্মমত প্রতিস্থাপন কিংবা ধর্ম পালন করতে সক্ষম।[5]
দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে হামারশোল্ড ইসরায়েলের সাথে আরব বিশ্বের দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিষয়াবলীর মধ্যে ১৯৫৫ সালে ১৫ জন মার্কিন পাইলটের মুক্তির বিষয়ে চীন দেশ ভ্রমণে যান। তারা জাতিসংঘের জরুরি বাহিনীর পক্ষে কোরীয় যুদ্ধে মোতায়েন ছিল। এছাড়াও, তিনি ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সমস্যায়ও অংশ নিয়েছিলেন। একই বছরে হলি সী বা ভ্যাটিকানে জাতিসংঘ বাহিনী প্রেরণের ফলে কিছু ইতিহাসবেত্তাদের কাছ থেকে প্রশংসাও কুড়ান তিনি।[6]
১৯৬০ সালে সাবেক বেলজিয়ান কঙ্গো এবং পরবর্তীকালে নতুন স্বাধীন কঙ্গো গণপ্রজাতন্ত্র কঙ্গো সমস্যায় জাতিসংঘের সাহায্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে এবং তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে। হামারশোল্ড চারবার কঙ্গো ভ্রমণ করেন। তার চেষ্টা ছিল আফ্রিকায় উপনিবেশবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা। জাতিসংঘ জরুরি বাহিনী কর্তৃক শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ সালে সোভিয়েত সরকার তার সমালোচনা করে। তারা মহাসচিবের পদ থেকে তার পদত্যাগের দাবী উত্থাপন করেন এবং তিন জনের পরিচালনায় ভেটো হিসেবে খ্যাত ত্রয়কা'র মাধ্যমে মহাসচিব নির্বাচনের দাবী জানায়। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের স্মৃতিচারণমূলক কথা[7] -
সমানভাবে উপস্থাপনের জন্য তিনটি দলের আগ্রহ নিয়ে গড়া দেশঃ সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতন্ত্র এবং সদ্য স্বাধীন দেশ।
হামারশোল্ড কাতাঙ্গা প্রদেশকে কঙ্গোর সাথে একীভূত করার জন্য সৈন্য প্রেরণে প্যাট্রিস লুমুম্বা'র অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, লুমুম্বা সোভিয়েত সৈন্যদের সহায়তায় ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে লুমুম্বাকে অপছন্দ করতেন এবং ধারণা করতেন যে তাকে হয়তোবা দপ্তর থেকে সরিয়ে ফেলবেন।[8]
সেপ্টেম্বর, ১৯৬১ সালে হামারশোল্ড যুদ্ধ বিরত জাতিসংঘ বাহিনীর সাথে মোসে তসোম্বে'র বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধকলা শিখেছিলেন। তিনি যুদ্ধ বিরতীর লক্ষ্যে আলোচনার জন্য ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর আকাশ পথে রওয়ানা হন। ডগলাস ডিসি-৬ বিমানটি উত্তর রোডেশিয়ার (বর্তমানঃ জাম্বিয়া) এনদোলা এলাকায় এটি ভূপাতিত হয়। এ দূর্ঘটনায় ডগ হামারশোল্ড-সহ অন্য পনের আরোহীর মর্মান্তিক প্রাণহানী ঘটে।
দূর্ঘটনার পর জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় যে, দূর্ঘটনাটি পরিষ্কার আকাশে পূর্বদিন আনুমানিক রাত ১টায় ঘটে।[9] জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে এ তথ্যের ফলে অনুসন্ধান কার্য্য ও উদ্ধার তৎপরতার অবসান ঘটে। কিন্তু, প্রাথমিক লক্ষণে বিমান ভূপাতিত হবার ফলে সৃষ্ট দূর্ঘটনাটি ঘটলেও বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুসন্ধান কার্য্য সম্পাদন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায় যে হয়তোবা মহাসচিব নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।[10]
হামারশোল্ডের মৃত্যুজনিত ঘটনাটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দাগ হামারশোল্ডের দূর্ঘটনার জায়গাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে ঘোষণা করার বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো'র প্রধানমন্ত্রী বলেন যে,[9]
এ মহান ব্যক্তিকে স্মরণকল্পে, যা এখন চীরতরে বিলীন হয়ে গেছেন এবং তার সহকর্মীদেরও যারা নির্লজ্জভাবে পশ্চিমা বিশ্বের বৃহৎ আর্থিক শক্তির ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন .......... সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১ সালে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.