সুয়েজ খাল
কৃত্তিম খাল উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কৃত্তিম খাল উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সুয়েজ খাল (ইংরেজি: Suez Canal, আরবি: قناة السويس) মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি কৃত্তিম সামুদ্রিক খাল। এটি সুয়েজের ইস্তমাসের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত করেছে এবং আফ্রিকা ও এশিয়াকে বিভক্ত করেছে। খালটি সিল্ক রোডের অংশ যা ইউরোপকে এশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে।
Suez Canal | |
---|---|
স্থানাঙ্ক | ৩০°৪২′১৮″ উত্তর ৩২°২০′৩৯″ পূর্ব |
বিশেষ উল্লেখ | |
দৈর্ঘ্য | ১৯৩.৩ কিমি (১২০.১ মাইল) |
জলযানের সর্বোচ্চ প্রস্থ | ৭৭.৫ মি (২৫৪ ফু ৩ ইঞ্চি) |
জলযানের সর্বোচ্চ নাব্যতা | ২০.১ মি (৬৬ ফু) |
জলকপাট | None |
নৌ-চালনা কর্তৃপক্ষ | Suez Canal Authority |
ইতিহাস | |
নিমার্ণ শুরু | ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ |
নিমার্ণ শেষ | ১৭ নভেম্বর ১৮৬৯ |
ভূগোল | |
আরম্ভস্থল | Port Said |
সমাপ্তিস্থল | Suez Port |
১৮৫৮ সালে ফার্দিনান্দ দে লেসেপস খালটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে সুয়েজ খাল কোম্পানি গঠন করেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত খালটির নির্মাণ কাজ চলে। ১৭ নভেম্বর ১৮৬৯ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে খোলে দেওয়া হয়। এটি দিয়ে জাহাজ ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর হয়ে উত্তর আটলান্টিক এবং উত্তর ভারত মহাসাগরের মধ্যে সরাসরি চলাচল করে, এর ফলে দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ ভারত মহাসাগরকে এড়িয়ে চলা যায় এবং আরব সাগর থেকে লন্ডন পর্যন্ত যাত্রার দূরত্ব প্রায় ৮,৯০০ কিলোমিটার (৫,৫০০ মাইল) কমে গেছে। অর্থাৎ ২০ নট (৩৭ কিমি/ঘন্টা; ২৩ মাইল/ঘন্টা) বেগের ক্ষেত্রে ১০ দিন থেকে ২৪ নট (৪৪ কিমি/ঘন্টা; ২৮ মাইল/ঘন্টা) বেগের ক্ষেত্রে ৮ দিন সময় বেঁচে যায়।[1] খালটি পোর্ট সৈয়দের উত্তর টার্মিনাস থেকে সুয়েজ শহরের বন্দর তৌফিকের দক্ষিণ টার্মিনাস পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর এবং দক্ষিণ অ্যাক্সেস-চ্যানেল সহ এর দৈর্ঘ্য ১৯৩.৩০ কিমি (১২০.১১ মাইল)। ২০২০ সালে ১৮,৫০০টিরও বেশি জাহাজ খালটি অতিক্রম করেছে (প্রতিদিন গড়ে ৫১.৫ টি)।[2]
মূল খালটিতে বাল্লা বাইপাস এবং গ্রেট বিটার লেকের স্থানগুলি সহ একটি এক লেনের জলপথ রয়েছে।[3] এতে অ্যালোইস নেগ্রেলির পরিকল্পনা অনুসারে সমুদ্রের পানি অবাধে প্রবাহিত হওয়ার বাধা দেওয়ার জন্য কোন জলকপাট ব্যবস্থা নেই। সাধারণত বিটার লেকের উত্তরের খালের পানি শীতকালে উত্তরে এবং গ্রীষ্মকালে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। হ্রদের দক্ষিণে সুয়েজে জোয়ার-ভাটার সাথে প্রবাহ পরিবর্তিত হয়।[4]
দশ বছর ধরে খননের পর পথটি ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়। উত্তরে ইউরোপ থেকে দক্ষিণে এশিয়া, উভয়প্রান্তে পণ্যপরিবহনে সুয়েজ খাল একটি জলপথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এতে করে সম্পূর্ণ আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হয়না। খালটি উন্মুক্ত হবার পূর্বে, কখনো কখনো পণ্য জাহাজ থেকে নামিয়ে মিশরের স্থলপথ অতিক্রম করে, ভূমধ্যসাগর হতে লোহিত সাগরে এবং লোহিত সাগর হতে ভূমধ্যসাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজে পারাপার করা হত। এর ব্যপ্তি ভূমধ্যসাগরের পোর্ট আবু সাঈদ হতে লোহিত সাগরের সুয়েজ (আল-সুওয়েজ) পর্যন্ত। ফার্দিনান্দ দে লেসেপ্স নামক একজন ফরাসি প্রকৌশলী এই খাল খননের উদ্যোক্তা।
যদিও খালটি মিশরীয় সরকারের সম্পত্তি, তবে জুলাই ১৯৫৬ পর্যন্ত ইউরোপীয় অংশীদাররা যাদের বেশিরভাগ ব্রিটিশ এবং ফরাসি এই রেয়াতি সংস্থার মালিক ছিল এবং এটি পরিচালনা করতো, পরবর্তীতে মিশরের রাষ্ট্রপতি জামাল আবদেল নাসের এটিকে জাতীয়করণ করলে ১৯৫৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের সুয়েজ সংকট দেখা দেয়।[5] খালটি মিশরের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ[6] (এসসিএ) পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে। কনস্টান্টিনোপল কনভেনশনের অধীনে এটি "শান্তির সময়ের মতো যুদ্ধের সময়ও প্রতিটি বাণিজ্য বা যুদ্ধ জাহাজ পতাকার পার্থক্য ছাড়াই" ব্যবহার করতে পারবে।[7] তবুও খালটি একটি নৌ-হ্রস্বতর পথ এবং চোকপয়েন্ট হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগর উভয়ের উপকূলরেখা এবং ঘাঁটি সহ নৌবাহিনীর (মিশর এবং ইসরায়েল) সুয়েজ খালের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ছয় দিনের যুদ্ধের শুরুতে মিশর সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেওয়ার পর ৫ জুন ১৯৭৫ সালে খালটি পুনরায় চালু হওয়ার আগে আট বছর বন্ধ ছিল।[8]
মিশরীয় সরকার ২০১৪ সালে খালের পরিবহন-সময় ত্বরান্বিত করার জন্য ৩৫ কিমি (২২ মাইল) বল্লা বাইপাস সম্প্রসারণ ও প্রসারিত করার জন্য নির্মাণ কাজ শুরু করে। সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ছিল সুয়েজ খালের ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রতিদিন জাহাজ চলাচল ৪৯ থেকে ৯৭ এ বর্ধিত করা।[9] ৫৯.৪ বিলিয়ন মিশরীয় পাউন্ড (৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্পটি মিশরীয় সত্তা এবং ব্যক্তিদের জন্য একচেটিয়াভাবে জারি করা সুদ-বহনকারী বিনিয়োগ সার্টিফিকেট দিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছিল। সম্প্রসারিত "নিউ সুয়েজ খাল" ৬ আগস্ট ২০১৫ তারিখে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্ভোধন করা হয়।[10]
সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে নতুন পার্শ্ব চ্যানেলটি খুলে দেয়। সুয়েজ খালের পূর্বপার্শ্বের সম্প্রসারণের উত্তর দিকে অবস্থিত, এই পার্শ্ব চ্যানেলটি পূর্ব টার্মিনালকে টার্মিনাল থেকে নোঙর ফেলা এবং নোঙর ছাড়া জাহাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। যেহেতু পূর্বদিকের কন্টেইনার টার্মিনালটি খালের উপরই অবস্থিত, তাই নতুন পার্শ্ব চ্যানেল নির্মাণের আগে কনভয় চলাকালে টার্মিনালে নোঙর ফেলা বা নোঙর উঠানো সম্ভব ছিল না।[11]
প্রাচীন পশ্চিম-পূর্ব খালগুলি নীল নদ থেকে লোহিত সাগরে প্রবাহিত হওয়ার সুবিধার্থে নির্মিত হয়েছিল। [12][13][14] একটি ছোট খাল দ্বিতীয় সেনুস্রেত[15] বা দ্বিতীয় রামসেস-এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।[12][13][14] সম্ভবত প্রথমটির একটি অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে আরেকটি খাল[12][13] দ্বিতীয় নেকোর শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল, তবে একমাত্র সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী খালটি উদ্ভাবন এবং সম্পন্ন করেছিলেন প্রথম দারিয়াস।[12][13][14]
জেমস হেনরি ব্রেস্টেড এর মতে মিশরের ষষ্ঠ রাজবংশ প্রথম প্রপাত দিয়ে একটি খাল নির্মাণের প্রথম প্রচেষ্টা চালায় তবে মিশরের দ্বাদশ রাজবংশের তৃতীয় সেনুস্রেত এটি সমাপ্ত করেন।[16]
পৌরাণিক সেসোস্ট্রিস (সম্ভবত মিশরের দ্বাদশ রাজবংশের ফারাও দ্বিতীয় সেনুস্রেত বা তৃতীয় সেনুস্রেত[15][16]) ফারাওদের খাল নামে পরিচিত প্রাচীন খাল নির্মান করে, এটি নীল নদকে লোহিত সাগরের সাথে মিলিত করে (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৯৭-১৮৩৯), খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৪৮-এর কাছাকাছি সময়ে একটি সেচ খাল তৈরি করা হয়েছিল যা বন্যা মৌসুমে নৌচলাচলের যোগ্য ছিল এবং এটি নীল নদের ব-দ্বীপের পূর্বদিকে ওয়াদি তুমিলাত নামে একটি শুষ্ক নদী উপত্যকায় বয়ে নিয়ে যায়।[17] (কথিত আছে যে প্রাচীনকালে লোহিত সাগর উত্তর দিকে বিটার লেক[12][13] এবং তিমসাহ হ্রদ[18][19] পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।)
বর্তমানে প্রতিদিন ৪৯টি জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত করে। তবে ২০২৩ সাল নাগাদ নতুন সুয়েজ খাল তৈরি হলে সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন ৯৭টি জাহাজ যাতায়াত করতে সক্ষম হবে।
নতুন সুয়েজ খাল হল সুয়েজ খাল এর একটি শাখা।যা নতুন করে খনন করে নির্মাণ করা হয়েছে সুয়েজ খালের সমান্তরালে । ৩৭ কিলোমিটারের মতো খনন করা হয়েছে, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘দ্বিতীয় লেন’। এ ছাড়া খালটিকে আরও গভীর এবং ৩৫ কিলোমিটারের মতো প্রশস্ত করা হয়েছে।এই নতুন রাস্তার ফলে জাহাজগুলোর অপেক্ষার সময় ১৮ ঘণ্টা থেকে ১১ ঘণ্টায় নেমে আসবে। বর্তমানে দৈনিক ৪৯টি জাহাজ চলে এ খাল দিয়ে। সরকার আশা করছে ২০২৩ সালের মধ্যে এই খাল দিয়ে চলবে দৈনিক ৯৭টি জাহাজ। এ ছাড়া ২০২৩ সাল নাগাদ সুয়েজ খাল থেকে বর্তমান আয় ৫ শ ৩০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১৩ শ ২০ কোটি ডলার হবে বলে আশা করছে সরকার। তবে বিশ্লেষকদের মতে জাহাজ থেকে আয় খালের সক্ষমতার ওপর নয় বরং বিশ্বের ব্যবসায়ের সংখ্যার ওপর নির্ভর করবে।
২০২১ সালের ২৩ মার্চ, আনুমানিক ০৫:৪০ ইউটিসি ( স্থানীয় সময় ৭:৪০) এ, সুয়েজ খালের উভয় পাশ অতি বৃহৎ গোল্ডেন-ক্লাস মালবাহী জাহাজ এভার গিভেন দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এভারগ্রিন মেরিন পরিচালিত জাহাজটি মালয়েশিয়া থেকে নেদারল্যান্ডসে যাত্রাপথে তীব্র বাতাসের দরুন চড়ার মাটিতে আটকে পড়ে। মাটিতে আটকে পড়ার পর এভার গিভেন পাশে সরে আসে, এতে খালটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও খালের দৈর্ঘ্যের কিছুটা পুরোনো একটি সরু চ্যানেল দ্বারা সমান্তরালকৃত, যেটিকে এখনো বাধা পেরোনোর জন্যে বাইপাস হিসেবে ব্যবহার করা যায়, উক্ত ঘটনাটি খালের এমন একটি সেকশনে ঘটে যেটিতে কেবল একটিই চ্যানেল ছিল। ঘটনাস্থলের অবস্থান ছিল ৩০.০১৫৭৪° উত্তর ৩২.৫৭৯১৮° পূর্ব।
ঘটনার প্রাক্কালে, বহু অর্থনীতিবীদ এবং ব্যবসা বিশেষজ্ঞ বাধাটি দ্রুত নিষ্পত্তি না করতে পারলে এর প্রভাব সম্পর্কে অভিমত জানান, তারা বলেন যে সুয়েজ খাল বিশ্ব বাণিজ্যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই ঘটনার জন্যে স্বভাবতই বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে যেহেতু আটকে পড়া পণ্যগুলোর নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর খাল অতিক্রম করার কথা ছিল।
তাৎক্ষণিক ফলাফল হিসেবে, পণ্যগুলোর ভেতর তেল পরিবহন সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে যেহেতু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মজুদ গন্তব্যে পৌঁছার উপায় না থাকায় আটকা পড়ে ছিল।
আন্তর্জাতিক শিপিং চেম্বার (আই সি এস) ধারণা করে যে প্রতিদিন ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সমমূল্যের কার্গো সুয়েজ খাল অতিক্রম করে থাকে।
বলা হয়েছিল এই অবরুদ্ধতা সারা বিশ্বের কার্গো সময়সূচিতে প্রভাব ফেলতো। পরিবহণ কোম্পানিগুলো এও বিবেচনা করছিলো যে তাদের জাহাজগুলোকে কেপ অফ গুড হোপের দীর্ঘতর পথ দিয়ে ঘুরিয়ে আনবে কিনা। এরকমটা করা প্রথম জাহাজটি ছিল এভার গিভেনের ভগ্নী জাহাজ এভার গ্রিট।
মার্চের ২৯ তারিখ, একটি মেরিটাইম সেবা সরবরাহকারী সংস্থা ইঞ্চকেপ জানায়, জাহাজটি পুনরায় ভাসতে শুরু করে। অল্প কয়েক ঘন্টার ভেতর, কার্গো ট্রাফিক আগের মত হয়ে পড়ে যার ফলে ৪৫০টি জাহাজের আটকে পড়ার সমাধান হয়ে যায়। এভার গিভেন সফলভাবে খালের বাইরে পার হয়ে যাবার পর যে জাহাজটি সফলভাবে খাল অতিক্রম করেছে সেটি হলো ওয়াই এম উইশ যেটি একটি হংকং ভিত্তিক মালবাহী জাহাজ।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.