নির্বাচন

যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনও জনসমষ্টি সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনও পদে নিযুক্ত করার জন্য একজন ব উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ

নির্বাচন

নির্বাচন হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়।[] সপ্তদশ শতক থেকে আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।[] নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভার পদগুলি পূরণ করা হতে পারে, কখনও আবার কার্যনির্বাহী ও বিচারব্যবস্থা ছাড়াও আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধি বাছাইও নির্বাচনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া আবার প্রয়োগ হয় বহু বেসরকারী সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও। ক্লাব বা সমিতি থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও কর্পোরেশন বা নিগমেও এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়।

Thumb
একটি ব্যালট বাক্স

আধুনিক গণতন্ত্রে প্রতিনিধি বাছাইয়ের উপায় হিসেবে নির্বাচনের সার্বজনীন ব্যবহার করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের আদি চেহারা এথেন্সে নির্বাচনকে যেভাবে ব্যবহার হতো তার তুলনায় এটি অনেকটাই বিপরীত। নির্বাচনকে শাসকগোষ্ঠীর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বেশিরভাগ দপ্তরই পূরণ করা হতো বাছাইয়ের মাধ্যমে। এই নির্বাচন দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া বা অ্যালটমেন্ট নামেও পরিচিত ছিল, এর মাধ্যমেই পদাধিকারীদেরও বেছে নেওয়া হতো। যেখানে নির্বাচনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই সেখানে সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু করা অথবা বর্তমান ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতাকে আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়াকেই নির্বাচনী সংস্কার বলে বর্ণনা করা হয়।

নির্বাচনের ফলাফল ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণাকে (বিশেষ করে আগাম ফলাফল আন্দাজ করার বিষয়টি) সেফোলজি বলে। নির্বাচিত করা-র মানে হলো "বাছাই করা অথবা একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া"[] এবং কোনো কোনো সময় অন্য ধরনের ব্যালট ব্যবহার হলেও যেমন গণভোটে হয়ে থাকে, তাকেও নির্বাচন হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গণভোট ব্যবস্থা রয়েছে। গণতান্ত্রিক দিক থেকে এটি সম্ভাব্যরূপে ঢুকে গেল। তাই বলা যায় যে নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবাদর্শ

দ্য স্পিরিট অব লজ’ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মন্টেসকিউই বলেছেন যে প্রজাতন্ত্র অথবা গণতন্ত্র যে কোনো ক্ষেত্রের ভোটেই হয় দেশের প্রশাসক হও অথবা প্রশাসনের অধীনে থাকো —এই দুটি অবস্থার মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ভোটারদের থাকতে হয়। নিজেদের দেশে কোন সরকার আসবে তা বাছাই করার ‘মালিক’বা ‘মাস্টার’ হিসেবে কাজ করে ভোটাররাই, ভোট দিয়ে একটি সার্বভৌম (অথবা শাসক) ব্যবস্থাকে চালু রাখে জনসাধারণই।

ইতিহাস

সারাংশ
প্রসঙ্গ
Thumb
রোমান মুদ্রায় নির্বাচনের ছবি

সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন গ্রিস ও প্রাচীন রোমে নির্বাচনের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং গোটা মধ্যযুগে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের মত শাসক বাছাই করতেও নির্বাচনের ব্যবহার হতো।[] প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। প্রাচীন ভারতের খালিফ, উঠমান এবং আলি, মধ্যযুগের গোড়ার দিকে রশিদুন খলিফৎ[] এবং বাংলার মধ্যযুগের গোড়ার দিকে পাল রাজাদের মধ্যে গোপালকে বাছাই করতে এই নির্বাচন করা হয়েছিল।[] তবে আধুনিক ‘নির্বাচন’ হলো জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচন। সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে যখন প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ধারণা এলো তার আগে পর্যন্ত অবশ্য জনসাধারণকে দিয়ে সরকারী পদাধিকারী বাছাইয়ের এই আধুনিক ‘নির্বাচন’ বিষয়টির আবির্ভাবই হয়নি।[]

নির্বাচনের ইতিহাসের অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভোটাধিকারের প্রশ্নগুলি, বিশেষ করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির ভোটাধিকার। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই, নির্বাচকমণ্ডলীতেও তাই এদেরই প্রাধান্য থাকতো, অন্যান্য বহু দেশেও এই একই ধারা চলে আসছিল।[] গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলিতে শুরুর দিকের নির্বাচনগুলিতে জমিদার অথবা শাসক শ্রেণীর পুরুষদের প্রাধান্য ছিল।[] ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল এবং তার পর থেকেই বহু দেশ মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল।[] পুরুষদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের কথা আইনগতভাবে সিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময়েই অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধা অন্তরায় সৃষ্টি করতো (নাগরিক অধিকার আন্দোলন দেখুন)।[]

কার্যকারিতাসমূহ

সারাংশ
প্রসঙ্গ

কে নির্বাচিত

যে সকল সরকারি পদের জন্য নির্বাচন হচ্ছে স্থানীয় ভিত্তিতে তা বিভিন্নরকমের হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রেও কিছু পদ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হয় না। বিশেষতঃ যেগুলির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতা অথবা ঔত্কর্ষের প্রয়োজন আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা রক্ষার স্বার্থে নির্বাচনের পরিবর্তে সচরাচর সরাসরি তাদের নিয়োগ করা হয়। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বিচারপতি নির্বাচিতই হন, আবার প্রাচীন এথেন্সে সামরিক প্রধান (মিলিটারি জেনারেল)কে নির্বাচনে মাধ্যমেই বেছে নেওয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে সোভিয়েত গণতন্ত্রের কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী এবং নির্বাচিতদের মাঝামাঝি অবস্থানে ভোটারদের একটি স্তর থাকত। যাইহোক, অধিকাংশ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে এই অপ্রত্যক্ষ্যতার স্তরটি আনুষ্ঠানিকতার থেকে বেশি কিছু নয়। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে নির্বাচিত হন এবং ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থায়, রাষ্ট্রপ্রধান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বেছে নেন (এবং বাস্তবে আইনসভা অথবা তাদের দলই এটা করে থাকে)।

নির্বাচনের ধরনসমূহ

বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন জন-প্রশাসনিক স্তর অথবা ভৌগোলিক ব্যাপ্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন হয়। সাধারণ ধরনের কিছু নির্বাচন হলো:

  • রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
  • সাধারণ নির্বাচন
  • প্রাথমিক নির্বাচন
  • উপনির্বাচন
  • স্থানীয় নির্বাচন
  • কো-অপশন

বাছাই করে গ্রহণ করা গণভোট বা রেফারেণ্ডাম (বহুবচন হলো রেফারেণ্ডামস অথবা রেফারেণ্ডা) নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত একটি গণতান্ত্রিক হাতিয়ার যাতে একটা সাধারণ নীতি অথবা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থী বা দলের বদলে নির্বাচকমণ্ডলী কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন অথবা নীতির পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের মতামত জানায়। গণভোট একটা নির্বাচনী ব্যালটের সঙ্গেও জুড়ে দেওয়া হতে পারে অথবা পৃথকভাবেও নেওয়া হতে পারে এবং সচরাচর সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল থেকেই এই গণভোট নির্দেশমূলক বা পরামর্শমূলক দুরকমই হতে পারে। সরকার সচরাচর আইনসভার মাধ্যমেই গণভোটের ডাক দেয়, যদিও বহু গণতন্ত্রেই নাগরিকের সরাসরি গণভোটের ডাক দেওয়ার অধিকার রয়েছে, যাকে ইনিশিয়েটিভস বলা হয়ে থাকে।

সুইজারল্যান্ডের মতো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে গণভোটগুলি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ, মূল সুইস ব্যবস্থা যদিও এখনও প্রতিনিধিমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই কাজ করে। বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে যে কেউই যে কোনো কিছুকেই ভোট দিতে পারে। এটা ঘনিষ্ঠভাবেই গণভোটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আকার নিতে পারে। প্রাচীন গ্রিক ব্যবস্থার স্মারকস্বরূপ, যেকোন ব্যক্তিই ঐকমত্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। সর্বসম্মতির প্রয়োজনীয়তার অর্থ হল দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা চালানো। আর ফলাফল হবে যারা প্রকৃতভাবেই উৎসাহী তারাই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে এবং তার জন্যই নির্বাচন। এই ব্যবস্থায় কোন বয়ঃসীমার প্রয়োজন হয় না কারণ শিশুরা একঘেয়েমির ফলে ক্লান্ত বোধ করে। এই ব্যবস্থাটা যদিও কেবলমাত্র তখনই বাস্তবায়নযোগ্য যদি খুব সামান্য একটা চৌহদ্দির মধ্যে এর প্রয়োগ করা হয়।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি

সারাংশ
প্রসঙ্গ

ভোটাধিকার

কারা ভোট দিতে পারবে সেই প্রশ্নটাই হলো নির্বাচনের মূল বিষয়। সাধারণত সমগ্র জনসমষ্টিই নির্বাচকমণ্ডলী হয় না। উদাহরণস্বরূপ, বহু দেশই মানসিকভাবে অসমর্থদের ভোটদান থেকে বিরত রাখে, এবং সব দেশের আইনেই ভোট দেওয়ার একটা ন্যূনতম বয়স প্রয়োজন।

ইতিহাস থেকেই জানা যায় যে বিভিন্ন সময়েই জনসমষ্টির অনেক গোষ্ঠীকেই ভোটদানের অধিকারের বাইরে রাখা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, প্রাচীন এথেন্সের গণতন্ত্রে মহিলা, বিদেশি ও ক্রীতদাসদের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও ভোটাধিকারের বিষয়টি প্রদেশগুলির উপরেই ছেড়ে দেয়। সাধারণত সেখানে সম্পত্তির মালিক শ্বেতাঙ্গ পুরুষরাই কেবলমাত্র ভোট দিতে পারত। ভোটাধিকারের বাইরে থাকা অংশকেও ভোটাধিকার দেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে নির্বাচনের অনেক ইতিহাস রয়েছে। মহিলাদের ভোটাধিকার আন্দোলন বহু দেশেই মহিলাদের ভোটাধিকার প্রদানে সহায়তা করেছে এবং মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল অবাধ ভোটদান সুনিশ্চিত করা। দণ্ডিত অপরাধী, নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে থাকা মানুষ যারা এখনও কোথাও কোথাও ভোটাধিকার পায়নি তাদের মধ্যে ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করাই হলো ভোটাধিকারের পক্ষে যাঁরা সওয়াল জবাব করেন তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

Thumb
২০০৪ এ ইটালির মিলানে এক প্রচারকর্মী পোস্টার লাগাচ্ছেন।

ভোটাধিকার সচরাচর কেবলমাত্র সেদেশের নাগরিকদেরই থাকে। এর বাইরেও আরও কিছু সীমারেখা আরোপ করা যেতে পারে। যদিও সেদেশের বাসিন্দাদের সিংহভাগই এই শর্তটি পূরণ করতে পারে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যদিও কোনো একজন পৌরভোটে ভোট দিতে পারেন যদি সেই পৌর এলাকার তিনি বাসিন্দা হন এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়নেরই একজন নাগরিক হন। এক্ষেত্রে তিনি এখন যে দেশে বাস করছেন সেই দেশেরই নাগরিকত্বেরই প্রয়োজনীয়তা নেই।

কিছু দেশে আবার ভোটাদান আইনগত ভাবে বাধ্যতামূলক, যদি কোনো যোগ্য ভোটার ভোট না দেন তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। হতে পারে সামান্য জরিমানাও।

মনোনয়ন

একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের রাজনৈতিক ক্ষমতাশীল পদে কাউকে নিয়োগ করার অধিকার প্রয়োগ বা সোজা কথায় মনোনয়নের একটা পদ্ধতি থাকা জরুরী। বহু ক্ষেত্রেই এই মনোনয়ন আবার সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলিতে আগে থেকেই বাছাই করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হয়।[]

মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে অ-দলীয় ব্যবস্থার থেকে দলীয় ব্যবস্থা ভিন্নতর হয়। একটি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র হলো একটি অ-দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এতে যে কোনো যোগ্য ব্যক্তিই মনোনীত হতে পারেন। আবার কিছু অ-দলীয় প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় মনোনয়নের (অথবা প্রচার, নির্বাচনী প্রচার) কোনো ব্যবস্থাই নেই, এতে ভোটাররা ভোটের সময় যে কাউকে বেছে নিতে পারে— আইন মোতাবেক যদিও এই ব্যবস্থায় সম্ভাব্য কিছু ব্যতিক্রম থাকে যেমন সেক্ষেত্রে বয়সের একটা ন্যূনতম মাপকাঠি বেঁধে দেওয়া থাকে। এই ক্ষেত্রগুলিতে, এটা আবশ্যিক নয় (এমনকি তা সম্ভবও নয়) যে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরা সমস্ত যোগ্য ব্যক্তির সম্পর্কে পরিচিত থাকবে, যদিও এই ব্যবস্থাগুলিতে একটা বড় ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যে নির্বাচন হয় এবং এই পরোক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্তরে সম্ভাব্য নির্বাচিতদের সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক পরিচিতি এই স্তরে থাকতে পারে (যথা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে)।

দলীয় ব্যবস্থায়, কিছু দেশে কোনো একটি রাজনৈতিক দল যতদূর সম্ভব তার সদস্যদেরই কেবলমাত্র মনোনীত করতে পারে। অথবা, একজন যোগ্য ব্যক্তি আবেদনের ভিত্তিতে মনোনীত হতে পারে। এভাবেই তার নাম ব্যালটে তালিকাভুক্ত হতে পারে।

নির্বাচনী ব্যবস্থাসমূহ

নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সাংবিধানিক বন্দোবস্ত এবং ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। যা ভোটকে বদলে দেয় একটা নির্ধারণকারী ব্যবস্থায় যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচিত হয়। প্রথম পর্যায় হলো ভোট গণনা, যার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোট গণনা ব্যবস্থা এবং ব্যালট ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ভোটিং ব্যবস্থায় এর পর গণনার ভিত্তিতে ফলাফল নির্ণয় হয়। বেশিরভাগ ব্যবস্থাকেই হয় অনুপাত নয়তো গরিষ্ঠতামূলকভাবে শ্রেণীকরণ করা যায়। আগেরগুলির মধ্যে রয়েছে দলীয়-তালিকা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অতিরিক্ত সদস্য ব্যবস্থা। পরবর্তীগুলির মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফ পি পি FPP) (আপেক্ষিক গরিষ্ঠতা) এবং নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা। বহু দেশেই নির্বাচনী সংস্কার আন্দোলন বেড়ে উঠছে, এতে অ্যাপ্রুভাল ভোটিং, সিঙ্গল ট্রান্সফারেবল ভোট, ইনস্ট্যান্ট রান অব ভোটিং অথবা কনডোরসেট ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করা হচ্ছে, কিছু দেশে ছোটখাটো ভোটে এই পদ্ধতিগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যদিও সে দেশগুলিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলিতে এখনও সেই প্রথাগত গণনা পদ্ধতিই ব্যবহার করা হচ্ছে।

স্বচ্ছ্বতা ও দায়বদ্ধতাকে গণতন্ত্রের একটা স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার ভোটদান প্রক্রিয়া এবং ভোটারের ব্যালটের বিষয়বস্তুও সচরাচর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। গোপন ব্যালট ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে একটা আধুনিক পর্যায় তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একে এখনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ ভীতিপ্রদর্শনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই গোপন ব্যালট ব্যবস্থা।

সময়সূচী নির্ধারণ

গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে এবং তারাই আদৌ ক্ষমতায় থাকবে কি না তা নিয়ে ভোটারদের রায় জানতে নির্ধারিত সময়ে তারা আবার ভোটারদের মুখোমুখি হবে। এই কারণেই বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক সংবিধানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিতভাবে নির্বাচন হওয়ার কথা বলা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রদেশে প্রতি তিন ও ছয় বছর অন্তর ভোট হয়। ব্যতিক্রমস্বরূপ, মার্কিন প্রতিনিধি সভা (ইউ এস হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস), সেখানে আবার প্রতি দু’বছর অন্তর ভোট হয়। অনেক ধরনের সময়সূচী আছে, উদাহরণস্বরূপ রাষ্ট্রপতি: আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন প্রতি সাত বছর অন্তর, ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি প্রতি ছ’বছরে, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি প্রতি পাঁচ বছরে, রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন প্রতি চার বছর অন্তর।

পূর্ব-নির্ধারিত অথবা নির্বাচনের নির্দিষ্ট দিন থাকলে তার স্বচ্ছ্বতা ও ভবিষ্যদ্বাণীর সুবিধা হয়। যদিও এর ফলে অত্যন্ত দীর্ঘ প্রচারের ঝোঁক তৈরি হয়। আবার হয়তো সেই পুর্বনির্ধঅরিত ভোটের দিনটি এমন সময় পড়লো যখন আইনসভা (সংসদীয় ব্যবস্থা) ভেঙে দেওয়া খুবই অনিশ্চিত বা সমস্যাসঙ্কুল। যেমন যদি যুদ্ধ লাগে তখন মোটেই ভেঙে দেওয়া সমীচীন নয়। অন্যান্য রাষ্ট্রে (যেমন গ্রেট ব্রিটেন) আবার সরকার তার সর্বোচ্চ মেয়াদকাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কার্যনির্বাহীরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে সেই মেয়াদকালের মধ্যে ঠিক কোন সময়ে ভোট হবে। এতে ব্যবহারিকভাবে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় টিঁকে থাকবে এবং তার হিসেবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা অনুকূল সময়ে তারা ভোট করবে (যদি না অনাস্থা প্রস্তাবের মতো বিশেষ কিছু ঘটে)। ভোটের দিনক্ষণের এই হিসেব নিকেষটা নির্ভর করে জনমত সমীক্ষায় তাদের সম্ভাবনা কেমন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাপের মতো নানা পরিবর্তনশীল বিষয়ের ওপর।

নির্বাচন সচরাচর একই দিনে হয়। সময়সূচীর আরও নমনীয়তা থাকলে আগাম ভোটও দেওয়া যেতে পারে এবং ভোটদানে গরহাজিরও থাকতে পারে কেউ। ইউরোপে ভোটারদের উল্লেখযোগ্য অংশই আগাম ভোট দিয়ে দেন।

নির্বাচনী প্রচারসমূহ

যখন নির্বাচন হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ও তাদের সমর্থকরা ভোটারদের কাছে সরাসরি আবেদনের মাধ্যমে তাদের নীতি তুলে ধরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, একেই বলা হয় নির্বাচনী প্রচার। প্রচারের জন্য সমর্থকরা হয় আনুষ্ঠানিকভাবেই সংগঠিত হয় অথবা স্বেচ্ছায় জুড়ে যায় এবং নিয়মিতভাবেই প্রচার বিজ্ঞাপনের ব্যবহার করে। রাজনৈতিক পূর্বাভাস-এর মাধ্যমে ভোটের ভবিষ্যদ্বাণী করা রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সমস্যাসমূহ

এমন বহু দেশই আছে যেখানে আইনের শাসন দুর্বল, আর সেই প্রশাসনিক দুর্বলাতাই হলো সেই দেশগুলিতে আন্তর্জাতিক মানের ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ ভোট না হতে পারার সাধারণ কারণ, কেননা সেসব দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় থাকা সরকার অনাধিকার হস্তক্ষেপ করে থাকে। যতই জনগণের মতামত তাদের অপসারণের পক্ষে থাকুক স্বৈরাচারী শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রশাসনিক (পুলিস, সামরিক আইন, সেন্সরশিপ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পেশীশক্তির ব্যবহার প্রভৃতি) ক্ষমতার অপব্যবহার করে। নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী গোষ্ঠী যাতে তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে না পারে তার জন্য আইনসভায় কোনো একটি গোষ্ঠী গরিষ্ঠতা অথবা চরম গরিষ্ঠতার ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। যেমন, ফৌজদারি আইন পাস করা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া, প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা ও ভোগোলিক সীমার ক্ষেত্রেও হেরফের ঘটানো ইত্যাদি। পেশী শক্তির ব্যবহার, মৌখিকভাবে ভীতি প্রদর্শন অথবা ভোটদান বা ভোটগণনায় জালিয়াতি ইত্যাদি দ্বারা বেসরকারী ও স্বতন্ত্র সত্তাগুলিও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। যেসব দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের ঐতিহ্য রয়েছে সেখানেও নির্বাচনী জালিয়াতির মাত্রা ন্যূনতম করে আনা ও নজরদারি বা পর্যবেক্ষণ হলো একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো একটি নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু ও অবাধ’ করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলি বিভিন্ন স্তরে দেখা দিতে পারে:

খোলাখুলি রাজনৈতিক বিতর্কের অথবা একটি ওয়াকিবহাল নির্বাচক মণ্ডলীর অভাব
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অভাব, রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণের কারণে সংবাদ মাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতার অভাব অথবা সঠিক খবর পাওয়া ও রাজনৈতিক মাধ্যম যথাযথ হাতে না পৌঁছানোর ফলে বিভিন্ন ইস্যু অথবা প্রার্থী সম্পর্কে হয়তো নির্বাচকমণ্ডলীর কম জানা, বোঝা থাকতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করতে গিয়ে অথবা রাষ্ট্রের মতবাদের পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে কখনও কখনও রাষ্ট্রের মাধ্যমে বাক-স্বাধীনতাও খর্ব হতে পারে।
অন্যায় নিয়ম

গেরিম্যান্ডারিং (নির্বাচনে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে অন্যায় সুবিধাদানের জন্য অসদুপায় অবলম্বন করা), নির্বাচিত হবার যোগ্যতা থেকে বিরোধী প্রার্থীদের বাদ দেওয়া, নির্বাচনী সাফল্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে ভোটদান প্রক্রিয়াকে নিজের পক্ষে সুবিধাজনক করা। এগুলি সেই উপায়গুলির মধ্যে পড়ে যার মাধ্যমে একটা নির্বাচনকে কোনো নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী বা প্রার্থীর পক্ষে বদলে দেওয়া যায়।

প্রচারে অনাহুত হস্তক্ষেপ

নির্বাচন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার অথবা তাকে খুন করে, প্রচার কাজ দমন করে (বক্তৃতা, পোস্টার, সম্প্রচার, বিজ্ঞাপন), প্রচার সদর দপ্তর জোর করে বন্ধ করে, অপরাধমূলক প্রচার চালিয়ে, প্রচার কর্মীদের হেনস্থা ও মারধর করে। ভোটারদের হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়ে বা বাস্তবেই হিংসা চালিয়ে।

নির্বাচন ব্যবস্থায় গরমিল

কীভাবে ভোট দিতে হবে সে সম্পর্কে ভোটারদের বিভ্রান্ত করে বা ভুল বুঝিয়ে, গোপন ব্যালট ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটিয়ে, ছাপ্পা ভোট দিয়ে, ভোট যন্ত্রে গরমিল করে, বৈধ ভোটকে নষ্ট করে, ভোটারদের মারধর করে, ফলাফল সারণিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করে এবং ভোটকেন্দ্রে পেশীশক্তির ব্যবহার অথবা মৌখিক হুমকি দেয়।

সারা বিশ্বের নির্বাচন

তথ্যসূত্র

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

Loading related searches...

Wikiwand - on

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.