ককেশাস
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ককেশাস বা ককেসিয়া ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত একটি অঞ্চল। মূলত কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের মাঝে এর অবস্থান। ককেশাস পর্বতমালা এই অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে রয়েছে ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এলব্রুস পর্বত, ৫,৬৪২ মিটার (১৮,৫১০ ফুট), যা বৃহত্তর ককেশাস পর্বতশ্রেণীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বৃহত্তর ককেশাস পর্বতশ্রেণী একটি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, যা পূর্ব ইউরোপ হতে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ট্রান্সককেসিয়া ও আনাতোলিয়া অঞ্চলকে প্রাকৃতিক ভাবে বিভক্ত করে।
ককেশাস | |
---|---|
![]() ককেশাসের ভূসংস্থানিক মানচিত্র | |
দেশসমূহ | |
স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ও ফেডারেল অঞ্চলসমূহ | রাশিয়া
|
বিশেষণ | ককেসিয়ান |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি+০২:০০, ইউটিসি+০৩:০০, ইউটিসি+০৩:৩০, ইউটিসি+০৪:০০, ইউটিসি+০৪:৩০ |
ককেশাস অঞ্চলটি উত্তর ও দক্ষিণভাগে বিভক্ত – উত্তর অংশটি উত্তর ককেশাস (সিসককেশাস) এবং দক্ষিণ অংশটি ট্রান্সককেশাস নামে পরিচিত। বৃহত্তর ককেশাস পর্বতমালা অঞ্চলটির উত্তরভাগে অবস্থিত যা রাশিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে লেসার ককেশাস পর্বতশ্রেণী জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান প্রভৃতি কতগুলো স্বাধীন দেশের মধ্যে বিভক্ত। ট্রান্সককেসিয়া পূর্বদিকে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তরপশ্চিমে ইরান এবং পশ্চিম দিকে তুরস্কের উত্তরপূর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত।[১][২]
এই অঞ্চলটি তার ভাষাগত বৈচিত্রের জন্য সুপরিচিতঃ ইন্দো-ইউরোপিয় ও তুর্কী ভাষা ছাড়াও কার্টভেলিয়ান এবং উত্তরপশ্চিম ককেসিয় ও উত্তরপূর্ব ককেসিয়র মতো দেশীয় ভাষা পরিবার এই অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়।
নামকরন
সারাংশ
প্রসঙ্গ
প্লিনি দ্যা এল্ডারের ন্যাচারাল হিস্টোরি (৭৭-৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) বই অনুযায়ী ককেশাস নামটি এসেছে স্কিথিয় ক্রোয়-খাসিস (উজ্জ্বল বরফ, সাদা তুষার) শব্দ থেকে।[৩] জার্মান ভাষাবিদ পল ক্রেটস্চমের উল্লেখ করেছেন লাটভিয় শব্দ ক্রুভেসিস অর্থও বরফ।[৪][৫]
প্রাচীন লোককথা (১১১৩ খ্রিষ্টাব্দ) অনুযায়ী, পুরাতন পূর্ব স্লাভিক ভাষা Кавкасийскыѣ горы (কাভকাসিজস্কি গোরি) এসেছে প্রাচীন গ্রিক Καύκασος (কাফকাসোস) থেকে।[৬] এম. এ. ইয়ুয়ুকিনের মতে, এটি একটি যৌগিক বাক্য, যার অর্থ হতে পারে শঙ্খচিলের পর্বত (καύ-: καύαξ, καύηξ, ηκος ο, κήξ, κηϋξ "এক ধরনের গাঙ্গচিল" + *κάσος η এর পুনর্গঠন "পর্বত" বা "শিলা", যেটি ব্যক্তি বা স্থানের নাম হিসেবে বহুল ব্যবহৃত)।[৭]
জার্মান ভাষাবিদ অটো শ্রাডার এবং আলফোন্স এ. নেহরিং এর মতে, প্রাচীন গ্রিক শব্দ Καύκασος (কাফকাসোস) গোথিক শব্দ হাউহস (উচ্চ) এবং লিথুয়ানিয় শব্দ Kaũkas ("হিলোক") ও কাউকারার (পাহাড়, চূড়া) সাথে সংযুক্ত।[৬][৮] ব্রিটিশ ভাষাবিদ আদ্রিয়ান রুম বের করেন যে পেলাসজিয় ভাষায় কাউ- অর্থ পর্বত।[৯]
ট্রান্সককেশাস অঞ্চল ও দক্ষিণ দাগেস্তান ছিল প্রথমে পার্থিয় এবং সাসানীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের শেষ সীমা। অন্যদিকে বৃহত্তর ককেশাসের উত্তর প্রান্ত ছিল প্রায় দুর্গম। ধারণা করা হয়, ইরানীয় পণ্ডিতদের দ্বারা রহস্যাবৃত পৌরণিক কাফ পর্বত এই অঞ্চলেই অবস্থিত এবং এটি ককেশাসকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সীমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, নাখ ভাষায় Ков гас (কোভ গাস) অর্থ স্টেপ অঞ্চলের প্রবেশপথ।[১০]
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী নামসমূহ
বিভিন্ন ভাষায় অঞ্চলটির বর্তমান নামটি একই অর্থবহন করে এবং সাধারনভাবে তা কাভকাজ বা কাওকাজ নামেই পরিচিত।
- আবখাজ: Кавказ Kavkaz
- টেমপ্লেট:Lang-ady Kʺaukʺaz/s
- আজারবাইজানি: Qafqaz
- আরবি: القوقاز al-Qawqāz
- আর্মেনীয়: Կովկաս Kovkas
- আভের: Кавказ Kawkaz
- চেচেন: Кавказ Kavkaz
- জর্জীয়: კავკასია K'avk'asia
- জার্মান: Kaukasien
- গ্রিক: Καύκασος Káfkasos
- হিব্রু ভাষায়: קווקז Qavqaz
- ইঙ্গুশ ভাষায় Kawkaz
- টেমপ্লেট:Lang-krc Kavkaz
- কুর্দি: Qefqasya/Qefqas
- টেমপ্লেট:Lang-lbe Kkawkkaz
- লেজগিয়: Къавкъаз K'awk'az
- টেমপ্লেট:Lang-xmf K'avk'acia
- অসেটীয়: Кавказ Kavkaz
- ফার্সি: قفقاز Qafqāz
- রুশ: Кавказ Kavkaz
- টেমপ্লেট:Lang-rut Kavkaz
- তুর্কি: Kafkaslar/Kafkasya
- ইউক্রেনীয়: Кавказ Kavkaz
- টেমপ্লেট:Lang-arm Kovkasy
রাজনৈতিক ভূগোল
সারাংশ
প্রসঙ্গ
উত্তর ককেশাস অঞ্চলটি মূলত সিসককেশাস নামে পরিচিত। অপরদিকে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চল ট্রান্সককেশাস নামে পরিচিত।

সিসককেশাসের মধ্যে মূলত বৃহত্তর ককেশাসের পার্বত্য অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে উত্তর ককেসীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রসমূহ সহ রাশিয়ার দক্ষিণাংশ, জর্জিয়ার উত্তরাংশ এবং আজারবাইজান। সিসককেশাসের পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগর, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর এবং উত্তর সীমানায় রাশিয়ার দক্ষিণের ফেডারেল জেলা সমূহ অবস্থিত। উত্তর প্রান্তে রাশিয়ার এই ফেডারেল জেলা দুটি সম্মিলিতভাবে দক্ষিণ রাশিয়া নামে পরিচিত।
ট্রান্সককেসীয়া বৃহত্তর ককেশীয়ার সীমানাকে চিনহিত করে। এর উত্তর সীমান্তে রয়েছে রাশিয়ার দক্ষিণাংশ, পশ্চিমে রয়েছে কৃষ্ণ সাগর ও তুরস্ক, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর এবং দক্ষিণে ইরান। লেসার ককেসীয় পর্বতশ্রেণী এবং তাকে ঘিরে থাকা নিম্নভূমিসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। সম্পূর্ণ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান (সর্ব উত্তরের অংশ বাদে) এবং জর্জিয়া (সর্ব উত্তরের অংশ বাদে) দক্ষিণ ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত।
বৃহত্তর ককেশাসের সংলগ্ন জলবিভাজিকা ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যবর্তী দীমাবেখা হিসেবে কাজ করে। ককেশাস অঞ্চলের সর্বোচ্চশৃঙ্গ এলব্রুস পর্বত পশ্চিম ককেশাসে অবস্থিত এবং একে ইউরোপের সর্বোচ্চচূড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ককেশাস অঞ্চল তার ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত জাতিরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র জর্জিয়া (আদজারা অন্তর্ভুক্ত), আজারবাইজান (নাখচিভান অন্তর্ভুক্ত), আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ান ফেডারেশন। ককেশাসের অন্তর্ভুক্ত রাশিয়ার বিভাগগুলো হলো দাগেস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশেটিয়া, উত্তর ওশেতিয়া-আলানিয়া, কাবারদিনো-বাল্কারিয়া, কারাচে-চেরকেসিয়া, আদিজিয়া, ক্রাস্নোদার ক্রাই এবং স্তাভ্রোপোল ক্রাই।
এই অঞ্চলের তিনটি এলাকা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, কিন্তু তারা জাতিসংঘের দ্বারা স্বীকৃত নয়। এলাকা তিনটি হলো আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র, আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওশেতিয়া। অধিকাংশ দেশ আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওটেশিয়াকে জর্জিয়ার অংশ এবং আর্টসাখকে আজারবাইজানের অংশ বলে মনে করে।
- আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান
- আজারবাইজানের রাজধানী বাকু
জনসংখ্যা উপাত্ত

এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের অনেক ভাষা ও ভাষা পরিবার রয়েছে। অঞ্চলটিতে প্রায় ৫০টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে।[১২] এখানে কমপক্ষে তিনটি ভাষা পরিবার এমন রয়েছে যাদের এই অঞ্চল ব্যতীত অন্য কোথাও দেখা যায় না। এছাড়াও এই অঞ্চলে মানুষেরা বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা, যেমনঃ আর্মেনীয় ও ওশেতিয় ভাষা এবং বিভিন্ন তুর্কী ভাষা, যেমন আজারবাইজানি ও কারাচয়-বালকার ভাষায় কথা বলে। উত্তর ককেসিয় অঞ্চলে যোগাযোগের প্রধান ভাষা হিসেবে রুশ ভাষা ব্যবহৃত হয়।
উত্তর ও দক্ষিণ ককেসীয়ার জনগণ ধর্মীয়ভাবে সাধারনত সুন্নি মুসলিম, ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান বা আর্মেনীয় খ্রিস্টান হয়ে থাকে। আজারবাইজান হতে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটির দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে অনেক টুয়েল্ভার শিয়া মতবাদের অনুসারী দেখা যায়।
ইতিহাস
সারাংশ
প্রসঙ্গ
তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার সীমানায় অবস্থিত ককেশাস অঞ্চলটি শত শত বছর ধরে রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সম্প্রসারনবাদের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। দীর্ঘ ঐতিহাসিক কাল জুড়ে ককেশাস অঞ্চলটি ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[১৩] উনবিংশ শতকের শুরু দিকে রাশিয়ান সাম্রাজ্য ইরানের কাজার সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে ককেশাস দখল করে নেয়।[১৩]
প্রাগৈতিহাসিক সময়

আদিম প্রস্তর যুগ হতেই ককেশাস অঞ্চলটি হোমো ইরেক্টাসের বাসস্থান ছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৯৯১ সালে জর্জিয়ার দমানিসি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে একটি ১.৮ মিলিয়ন বছরের পুরাতন আদি মানব ফসিল (হোমিনি) পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা জীবাশ্বের অস্থিগুলো একত্রিত করে সেটিকে হোমো ইরেক্টাস জর্জিকাসের উপজাতি হিসেবে শ্রেণিবিভাগ করেছেন।[১৪]
আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে প্রারম্ভিক মানুষের অস্তিত্বের প্রথম স্পষ্ট প্রমাণ এই স্থানেই পাওয়া যায়;[১৫] এবং দমানিসি হলো আফ্রিকার বাইরে প্রাপ্ত মানব খুলিগুলোর মধ্যে পাঁচটি প্রাচীনতম হোমিনি, যার ফলে আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে মানব অভিবাসনের সাম্ভাব্য সময়কাল পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।[১৬]
প্রাচীন কাল
বর্তমান দক্ষিণ ককেশাস (জর্জিয়ার পশ্চিমাংশ ব্যতীত), উত্তরপশ্চিম ইরান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ককেশাস, তুরস্কের পূর্বাঞ্চল হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৫০০ হতে ১০০০ কিমি এলাকা খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত কুরা-আরাক্সেস সংস্কৃতির অংশ ছিল।
আশুরবানিপলের রাজত্বকালে (৬৬৯-৬২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত অসিরীয়া সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ কর। পরবর্তীতে, এই অঞ্চলের প্রাচীন রাজ্যগুলোর মধ্যে আর্মেনিয়া, আলবেনিয়া, কলচিস এবং আইবেরিয়া আসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই রাজ্যগুলো পরবর্তীতে বিভিন্ন ইরানীয় সাম্রাজ্য যেমনঃ মেডেস, হাখমানেশী সাম্রাজ্য, পার্থিয়া এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, যারা একত্রে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ককেশাস অঞ্চল শাসন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৯৫-৫৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল আর্মেনীয় সম্রাট মহান টাইগ্রানেসের শাসনাধীন ছিল। এসময়ে আর্মেনিয়া রাজ্য বিভিন্ন অন্যান্য রাজ্য যেমনঃ সামন্ত আইবেরিয়া, আলবেনিয়া, পার্থিয়া, আট্রোপাটেনে, মেসোপটেমিয়া, কাপ্পাডোসিয়া, সিলিসিয়া, সিরিয়া, নাবাতাইয় রাজ্য এবং জুডিয়ার রাজ্যের সাথে একত্রীত হয়ে আর্মেনীয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর দিকে জরাথুস্ট্রবাদ এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মে পরিণত হয়, যদিও পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে আরো দুইটি ধর্মীয় পটপরিবর্তন ঘটে। পারস্য ও রোমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে এই অঞ্চল বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। পরবর্তীতে, এই অঞ্চল বাইজেন্টাইনদের হাতে আসে, যদিও শেষ পর্যন্ত তারাও এই অঞ্চল ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি।
মধ্যযুগ

৩০১ খ্রিষ্টাব্দে আর্মেনিয়ার আর্সাসিদ সাম্রাজ্যই (পার্থিয় আর্সাসিদ সাম্রাজ্যের একটি শাখা) হলো প্রথম রাজ্য যারা খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। এসময়ে ককেসীয় আলবেনিয়া এবং জর্জিয়া খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। ফলে, এই অঞ্চলে জরাথুস্ট্রবাদ এবং পৌত্তলিকদের বিপরীতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের বিরাট অংশ আরবদের শাসনাধীন হয়ে যায় এবং এই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করে।[১৭]
১০ম শতাব্দীতে আলানিগণ (প্রোটো-ওশেতিয়)[১৮] ককেশাসের উত্তরাঞ্চলে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। যেটি, বর্তমান সিরকাসিয়ার এবং অধুনিক উত্তর ওশেতিয়া-আলানিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১২৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলদের আক্রমণের ফলে রাজ্যটি ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাচীন আর্মেনীয় রাজ্যের পতনের পর মধ্যেযুগে বাগ্রাতিদ আর্মেনিয়া, তাশির-জোরাগেট রাজ্য, সিউনিক রাজ্য এবং খাচেনরা বিভিন্ন সময় স্থানীয় আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করে বাইরের হুমকির হাত থেকে এই অঞ্চলকে রক্ষা করে। আরমেনিয়ার সাথে ককেসীয় আলবেনিয়া সর্বদা একটি সুসম্পর্ক বজায় রাখে এবং আর্মেনীয় এপোস্টলিক চার্চের মতো ককেসীয় আলবেনিয়ার চার্চও একই খ্রিস্টান ধর্মমত প্রচার করতো। ককেসীয় আলবেনিয়ার ক্যথলিকরা নিযুক্ত হতেন আর্মেনিয় চার্চ দ্বারা।
১২ শতকে জর্জিয় রাজা ডেভিড জর্জিয়া থেকে মুসলিমদেরকে বের করে দেন এবং জর্জিয়া রাজ্যকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলেন। ১১৯৪ হতে ১২০৪ সালের মধ্যে জর্জিয়ার রাণী তামারের সৈন্যবাহিনী রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ প্রান্ত হতে সেলজুক তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিহত করে এবং দক্ষিণ আর্মেনিয়ার সেলজুক তুর্কিদের নিয়ন্ত্রিত রাজ্যে বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করে। জর্জিয়া রাজ্য ককেশাস অঞ্চলে ক্রমাগত সৈন্য অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। রাণী তামারের সৈন্য অভিযান এবং ১২০৪ সালে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সাময়িক পতনের ফলে জর্জিয়া সম্পূর্ণ নিকট প্রাচ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী খ্রিস্টান রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এসময়ে উত্তর ইরান এবং উত্তরপূর্ব তুরস্ক থেকে শুরু করে উত্তর ককেশাস অঞ্চল জর্জিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তীতে ককেশাস অঞ্চল অটোমান, মঙ্গোল, কিছু স্থানীয় রাজ্য এবং খানাত রাজ্যের দ্বারা বিজিত হয় এবং একসময় এই অঞ্চল পুনরায় ইরানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
- আর্মেনিয়ায় অবস্থিত ৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এটচমিয়াদজিন ক্যাথিড্রাল, আর্মেনিয়ার একটি ধর্মীয় কেন্দ্র। এটি ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
- জর্জিয়ায় অবস্থিত ৪র্থ শতকে নির্মিত স্ভেতিত্সখোভেলি ক্যাথিড্রাল, এটি ছিল রাজকীয় জর্জিয়ার একটি প্রার্থনা কেন্দ্র। এটি ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
- ৮ম হতে ১০ম শতকে ব্যবহৃত আলানিয়া অঞ্চলের উত্তরপশ্চিম ককেশীয় কাফতান (বিশেষ ধরনের পোশাক)।
আধুনিক কাল
উনবিংশ শতাব্দির প্রথমভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ ককেশাস এবং দক্ষিণ দাগেস্তান পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮১৩ হতে ১৮২৮ সালের মধ্যে যথাক্রমে গুলিস্তান চুক্তি এবং তুর্কমেনচাই চুক্তির মাধ্যমে ইরান দক্ষিণ ককেশাস এবং দাগেস্তান রুশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।[১৯] এই অর্জনের পরবর্তী বছরগুলোতে রাশিয়ানরা অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে বেশ কিছু যুদ্ধ করে এবং পশ্চিম জর্জিয়া সহ অবশিষ্ট দক্ষিণ ককেশাস দখল করে নেয়।[২০][২১]
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে রুশ সাম্রাজ্য উত্তর ককেশাস অঞ্চলও দখল করে। ককেসীয় যুদ্ধের সময় রাশিয়ানরা স্থানীয় সির্কাসিয়ানদের উপরে জাতিগত নিধন অভিযান চালায় এবংন অধিকাংশ সির্কাসিয়ানকে তাদেরকে তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করে অটোমান সাম্রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য করে।[২২][২৩]
১৯৪০ এর দশকে প্রায় ৪৮০,০০০ চেচেন ও ইঙ্গুস, ১২০,০০০ কারাচাই-বাল্কার ও মেস্খেতিয় তুর্কি, হাজার হাজার কাল্মিক এবং ২০০,০০০ নাকচিভান কুর্দি ও ককেসীয় জার্মানদেরকে মধ্য এশিয়া ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। এর ফলে তাদের প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।[২৪]
সমগ্র দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চল দুইবার রাজনৈতিকভাবে একত্রীত হয়েছে। প্রথমবার রুশ গৃহযুদ্ধের সময় ৯ এপ্রিল ১৯১৮ হতে ২৬ মে ১৯১৮ পর্যন্ত ট্রান্সককেশীয় গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র হিসেবে। দ্বিতীয়বার, ১২ মার্চ ১৯২২ হতে ৫ ডিসেম্বর ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত শাসনাধীন ট্রান্সককেশিয়ান এসএফএসআর হিসেবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর হতে এই অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধ (১৯৮৮-১৯৯৪), পূর্ব প্রিগোরোডনি সংঘর্ষ (১৯৮৯-১৯৯১), আবখাজিয়ার যুদ্ধ (১৯৯২-৯৩), প্রথম চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৪-১৯৯৬), দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৯-২০০৯) এবং দক্ষিণ ওশেতিয়ার যুদ্ধ (২০০৮) ইত্যাদি অন্যতম।
পুরাণ
গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী ককেশাস বা কাউকাসোস ছিল বিশ্বকে ধরে রাখা স্তম্ভগুলোর একটি। প্রমিথিউস (বা জর্জিয় সংস্করণ অনুযায়ী আমিরানি) আগুনের উপহারের সাথে মানুষকে পরিবেশন করার পর, জিউস প্রমিথিউসের স্পর্ধা দেখে তাকে শিকল দ্বারা আবদ্ধ করেন এবং তাকে শাস্তি দেন যে একটি ঈগল প্রতিদিন প্রমিথিউসের কলিজা ছিড়ে খাবে।
পারস্যের পুরাণ অনুযায়ী ককেশাস সম্ভবত কাল্পনিক কাফ পর্বতের সাথে সম্পর্কিত, যেটি বিশ্বজগতের চারপাশ বেষ্টন করে আছে। পারস্যের পুরাণ অনুযায়ী এই অঞ্চলটি সাওশিয়ান্তের যুদ্ধক্ষেত্র এবং সিমুর্ঘের আবাস ছিল।
রোমান কবি অভিডের মতে ককেশাস স্কিথিয়ায় অবস্থিত এবং তিনি একে ঠান্ডা ও পাথুরে পর্বত হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা ব্যক্তিত্বের ক্ষুধার ঘর। গ্রিক বীর জেসন সোনালি ফ্লিচের আশায় ককেশাসের পশ্চিম উপকূলে যাত্রা করেন এবং সেখানে কলচিসের রাজা এইটেসের কন্যা মেডেয়ার সাক্ষাৎ পান।
বাস্তুসংস্থান

ককেশাস অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানিক গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বব্যপি যে ৩৪টি অঞ্চলকে জীববৈচিত্রের হটস্পট হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ককেশাস অঞ্চল তার মধ্যে একটি।[২৫][২৬] এই অঞ্চলে প্রায় ৬৪০০ প্রজাতির উঁচু বৃক্ষ দেখা যায়, তার মধ্যে ১৬০০টি প্রজাতি এখানকার স্থানীয়।[২৭] এই অঞ্চলে বসবাসকারী বন্যপ্রাণীদের মধ্যে রয়েছে পারসীয় চিতাবাঘ, বাদামী ভাল্লুক, নেকড়ে, বাইসন, মারাল হরিণ, সোনালী ঈগল এবং ফণাওয়ালা কাক ইত্যাদি। অমেরুদণ্ডীদের মধ্যে এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০০ প্রজাতির মাকড়সাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[২৮][২৯] অধিকাংশ আরথ্রোপড জীববৈচিত্র বৃহত্তর এবং লেসার ককেশাসের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত।[২৯] এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ স্থানীয় বৃক্ষ ও মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাণী রয়েছে। যার ফলে, ককেশাস পার্বত্য এলাকায় সর্বশেষ বরফ যুগের সময় টিকে যাওয়া উদ্বাস্তু বনভূমি দেখা যায়। বরফ যুগের সময়ে টিকে যাওয়া ককেশাসের এই বনভূমি পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলের বৃহত্তম বনভূমি।[৩০][৩১] এই অঞ্চলে বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যারা পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ এবং এমনকি উত্তর আমেরিকায় প্রাপ্ত বেশ কিছু উদ্ভিদ প্রজাতির নিকটতম আত্মীয়।[৩২][৩৩][৩৪] এই অঞ্চলে প্রায় ৭০টিরও অধিক স্থানীয় শামুক প্রজাতির দেখা পাওয়া যায়।[৩৫] ককেশাস অঞ্চলে বসবাসকারী বিচ্ছিন্ন ভার্টিব্রেট প্রজাতির প্রানিদের মধ্যে রয়েছে ককেসীয় পারস্লে ব্যাঙ, ককেসীয় স্যালাম্যান্ডার, রবার্টস তুষার ইঁদুর এবং ককেসীয় হাঁস ইত্যাদি। এছাড়াও, এখানে সম্পূর্ণ স্থানীয় ডারেভস্কিয়া বর্গের টিকটিকি প্রজাতির প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণভাবে, এই অঞ্চলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা জীবগুলো স্বতন্ত্র প্রজাতির এবং অন্যান্য পশ্চিম ইউরোপীয় রিফুজিয়া প্রজাতি সমুহের থেকে আলাদা।[৩১] ককেশাস অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যতে মিশ্র বন পরিলক্ষিত হয়, যেখানে বৃক্ষসাড়ির উপরে দৃঢ়কায় পাথুরে ভূমি দেখা যায়। ককেশাস পর্বতমালা ককেসীয় শেফার্ড (রুশঃ কাভ্কাজস্কায়া অভচার্কা কুকুর) প্রজাতির কুকুর প্রজননের জন্যও পরিচিত। ভিন্সেন্ট ইভান্স উল্লেখ করেছেন যে, কৃষ্ণ সাগরে মিঙ্কে তিমির বিচরণ নথিভুক্ত করা হয়েছে।[৩৬][৩৭][৩৮]
পর্যটন
শক্তি ও খনিজ সম্পদ
ককেশাসে অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের শক্তি ও খনিজ সম্পদ রয়েছে। যেমন, এলানাইট, স্বর্ণ, ক্রোমিয়াম, তামা, আকরিক লোহা, পারদ, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, সীসা, টাংস্টেন, ইউরেনিয়াম, জিংক, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, এবং কয়লা (এন্থ্রাসাইট ও লিগনাইট উভয়ই)।
খেলাধুলা

২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজক ছিল রাশিয়ার সোচি শহর। ক্রাসনায়া পলিয়ানা — একটি জনপ্রিয় মাউন্টেইন স্কিইং কেন্দ্র এবং এটি ২০১৫ ইউরোপিয়ান গেমসের একটি স্নোবোর্ড ভেন্যু ছিল। এসময় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আজারবাইজানে ইউরোপিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়।
মাউন্টেইন-স্কিইং কমপ্লেক্সসমূহঃ
- আল্পিকা সার্ভিস মাউন্টেইন রিসোর্ট
- মাউন্টেইন রাউন্ডএবাউট
- রোসা হাতোর
- তসাঘকাদজোর স্কি রিসোর্ট, আর্মেনিয়া
- শাহদাগ উইন্টার কমপ্লেক্স, আজারবাইজান
আজারবাইজানে অবস্থিত আজারবাইজান গ্র্যান্ড প্রিক্স (মোটর রেসিং) ভেন্যুতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফর্মুলা ওয়ান অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালে জর্জিয়ায় অনূর্ধ্ব-২০ রাগবি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্র
আরও দেখুন
উৎসসমূহ
আরো পড়ুন
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.