Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ (PSYWAR-psychological warfare) অথবা আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক অভিযানসমূহের (PSYOP-psychological operations) মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও বেশ কিছু নামে জানা যায়, যেমন MISO (Military Information Support Operations), Psy Ops, রাজনৈতিক যুদ্ধবিগ্রহ (Political Warfare),"হার্টস এবড মাইন্ডস" এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা (propaganda)।[১] এই শব্দটি দ্বারা "জনগণের মাঝে পরিকল্পিত মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করার লক্ষ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার (psychological method) সাহায্যে করা কোন কার্যকে" নির্দেশ করা হয়ে থাকে।[২] এক্ষেত্রে লক্ষ্যে থাকা শ্রোতাদের মূল্যবোধ ব্যবস্থা (value system), বিশ্বাস ব্যবস্থা, আবেগ, প্রেরণা, যুক্তি অথবা আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহৃত হয়। এটিকে স্বীকারোক্তি দানে প্ররোচিত করতে, প্রস্তুতকারীর লক্ষ্যের জন্য অনুকূল মনোভাব ও আচরণকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়। কখনও এর সাথে ব্ল্যাক অপারেশন বা ফলস ফ্ল্যাগ কৌশলও যুক্ত হয়। শত্রুদলের মানসিক অবস্থাকে দমানোর জন্য তাদের মনোবল ধ্বংসের কৌশল হিসেবেও এটি ব্যবহার করা হয়।[৩][৪] লক্ষ্যে থাকা শ্রোতা সরকার, সংস্থা, দল বা ব্যক্তি যেকোন কিছু হতে পারে, এটি কেবল সৈন্যেদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বৈদেশিক অঞ্চলের বেসামরিক ব্যক্তিরাও প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে, যাতে সেই দেশের শত্রুরা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।[৫]
জ্যাক এলিল তার প্রোপাগান্ডা: দ্য ফরমেশন অব মেনস এটিট্যুডস -এ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহকে পরোক্ষ আক্রমণ বা আগ্রাসন হিসেবে জাতিসমূহের দ্বারা চর্চিত সাধারণ শান্তি নীতি হিসবে বর্ণনা করেছেন। এইধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার দ্বারা বিরোধি শাসনের আওতাভুক্ত অঞ্চলের জনমত পরিবর্তন করা হয় ও সেখান থেকে জনমতের উপর উক্ত শাসনের ক্ষমতাকে সরিয়ে নেয়া হয়। এই ধরনের আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করা কঠিন, কারণ কোনও আন্তর্জাতিক ন্যায়রক্ষক আদালত এই এরকম মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে সক্ষম নয়, কারণ আইনত এটা নিয়ে ন্যায়নির্ণয় বা বিচারপূর্বক কিছু স্থির করা যায় না। "এখানে প্রোপাগান্ডিস্টগণ বৈদেশিক প্রতিকূলতা নিয়ে কাজ করে যেখানে প্রতিপক্ষের মনোবল মনস্তাতাত্ত্বিক উপায়ে ধ্বংস করা হয় যাতে তারা তাদের বিশ্বাস বা কার্যের বৈধতা নিয়ে সন্দেহপোষণ করে"।[৬][৭]
ইতিহাসপূর্ব সময় থেকেই (ইতিহাস রচনার পূর্বের সময়) সেনাপতি এবং প্রধানগণ প্রতিপক্ষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ভয় তৈরি করার গুরুত্ব স্বীকার করতেন। মুখোমুখি সেনাদল যুদ্ধের পূর্বে চিৎকার করত, একে অপরকে অপমান করত, এবং নিজেদের অস্ত্র বর্মে আঘাত করে শব্দ শোনাত। এসব কিছুই তৈরি হয়েছিল শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য। এইসময় নিশ্চিতভাবেই শত্রু বা বিদ্রোহী জনগণকে তাদের বিদ্রোহ ত্যাগ করতে প্রভাবিত করার জন্য গণহত্যা এবং অন্যান্য নৃশংসতা প্রথম শুরু হয়।
সমর্থকদের থেকে সাহায্য আদায় করাটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহের আরেকটি দিক। মহান আলেকজান্ডার ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশ স্বার্থকভাবে বিজয় করেছিলেন। তার মত অনেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয় লাভের জন্য স্থানীয় অভিজাতদেরকে নিজেদের ক্ষমতার আওতায় নিয়ে নেন, যেমন আলেকজান্ডার স্থানীয় অভিজাতদেরকে গ্রীক প্রশাসন এবং সংস্কৃতির আওতায় সংযোজিত করতেন। আলেকজান্ডার তার কিছু লোককে তার বিজিত দেশে রেখে যেতেন যাতে তারা সেখানে গ্রীক সংস্কৃতির পরিচয় ঘটান এবং ভিন্নমতসমূহকে দমন করেন। তার সৈন্যরা এই সাংস্কৃতিক আত্তীকরণকে উৎসাহিত করতে স্থানীয়দেরকে বিয়ে করার জন্য[৮] অনেক সময় যৌতুক দান করতেন।
১৩ শতকের মঙ্গোল সাম্রাজ্যের নেতা চেঙ্গিস খান এতটা সূক্ষ্ম কৌশল ব্যবহার করতেন না। আক্রমণের পূর্বে শত্রুর ইচ্ছাকে পরাজিত করা এবং একটি সম্মতিসূচক বন্দোবস্তে পৌঁছানোকে প্রকৃত যুদ্ধের চেয়ে শ্রেয়তর ভাবা হত। মঙ্গোল সেনাপতিগণ খানের কাছে শত্রুদের বশ্যতা দাবী করতেন, এবং তারা পরাজয় অস্বীকার করলে প্রাথমিকভাবে দখল করা গ্রামসমূহে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হবে বলে হুমকি দিতেন। যদি তারা বশ্যতা স্বীকার না করে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে মঙ্গোলরা তাদের হুমকিকে বাস্তবায়িত করতেন এবং গ্রামগুলোতে গণহত্যা ঘটাতেন। এই গণহত্যার কথা পাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ত তখন সেখানে জনমনে অনিরাপত্তার জন্ম হত, আর এর ফলে মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ প্রতিরোধের আর কোন সম্ভাবনা থাকত না।[৯]
খানরা তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে যত সেনা আছে, এর চেয়েও যাতে বেশি সংখ্যক সেনা আছে বলে মনে হয় তাই তারা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করতেন। রাতের অপারেশনের সময় প্রত্যেকটি সৈন্যকে তিনটি করে মশাল জ্বালাতে বলা হত যাতে অনেক বেশি শত্রুসৈন্যের একটি বিভ্রম সৃষ্টি হয় এবং শত্রু স্কাউটরা তা দেখে ভীত হয়ে যায়। এছাড়াও ঘোড়ার লেজের সাথে একটি বস্তুকে বেঁধে রাখা হত যাতে মুক্ত ও শুষ্ক মাঠের উপর দিয়ে ঘোড়া দৌঁড়ে যাবার সময় ধুলার মেঘের তৈরি হয় এবং শত্রুদের মনে হয় যে প্রচুর সংখ্যক সৈন্য আছে। সৈন্যরা বাঁশির শব্দ তৈরি হয় এমনভাবে তীর তৈরি করত, যাতে বাতাসের মধ্য দিয়ে এই তীর যাবার সময় ভয়ঙ্কর শব্দ হয়।[১০]
মঙ্গোলরা আরেকটি কৌশল পছন্দ করত। তা হলে মানুষের মস্তক ধর থেকে আলাদা করে শহরের দেয়ালে নিক্ষেপ করা। এর ফলে শহরের অধিবাসীরা ভীত হত এবং অবরুদ্ধ শহরের বদ্ধ পরিবেশে অসুখ ছড়িয়ে যেত। এই পদ্ধতিটি পরবর্তীতে বিশেষ করে তুর্কো-মঙ্গোল প্রধানদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
মুসলিম খলিফা উমর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে কম সৈন্যের নতুন দল (reinforcements) পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তার এই দলের ধরন ছিল একধরনের অবিরাম প্রবাহ, যেখানে সৈন্যদলের ভেতরে সৈন্যের অবস্থান পরিবর্তিত হতে থাকে। এটি একটি বড় সৈন্যদলের বিভ্রম তৈরি করেছিল যাদেরকে খুব দ্রুতগতিতে শেষ না করে দিলে খুব দ্রুত আগের সৈন্যদলের সাথে এই বিশাল সৈন্য একীভূত হবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গ্রীক সন্ন্যাসী বিয়াস অব প্রিয়েনে (Bias of Priene) সফলতার সাথে লিডিয়ান রাজা আলিয়াত্তেসকে প্রতিরোধ করেছিলেন। বিয়াস একজোড়া খচ্চরকে খাইয়ে মোটা করে অবরুদ্ধ শহরের বাইরে পাঠান।[১১] যখন আলিয়াত্তেস এর দূতকে প্রিয়েনেতে পাঠানো হয়, তখন বিয়াস বালুর স্তুপকে শস্য দিয়ে ঢেকে দেন যা দেখে মনে হয় তাদের কাছে প্রচুর সম্পদ (খাদ্যবস্তু যা দিয়ে অনেক দিন তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখলেও কোন সমস্যা নেই) আছে।
এই ছলনাটি মধ্যযুগের ইউরোপে খুব পরিচিত ছিল। কোন প্রাসাদ বা শহরের রক্ষকগণ ভেতর থেকে বাইরে খাদ্য নিক্ষেপ করত, যা দেখে অবরুদ্ধকারীদের মনে হয় যে ভেতরে প্রচুর সম্পদ আছে। এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে লেডি কারকাসের (Lady Carcas) কিংবদন্তি। লেডি কারকাস এভাবে অবরুদ্ধকারী ফ্র্যাংকদেরকে পাঁচ বছরের অবরোধ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য করেন। এর ফলে শহরটির নাম হয় কারকাসোন (Carcassonne)।
যুদ্ধে আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। সেই সময়ে পাশ্চাত্য সমাজগুলোতে অনেক বেশি শিক্ষিত ও শহুরে ছিল, আর গণমাধ্যম ব্যাপক পরিমাণে সংবাদপত্র ও পোস্টার নিয়ে বিস্তৃত ছিল। তখন বিমানের মাধ্যমে আকাশ থেকে পাঠানো লিফলেট এর মাধ্যমে বা মোডিফাইড আর্টিলারি বা মর্টার রাউন্ড এর মত প্রেরক ব্যবস্থার সাহায্যেও শত্রুদের মাঝে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা (propaganda) ছড়ানো সম্ভব ছিল।[১২]
যুদ্ধের শুরুর দিকে উভয় পক্ষই, বিশেষ করে ব্রিটিশ ও জার্মানরা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে শুরু করে, রাষ্ট্রের ভেতরে এবং ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজ চলেছিল। ব্রিটিশদের বেশ কিছু সুবিধা ছিল যা তাদের বৈশ্বিক মত আদায়ের যুদ্ধে সফল হতে সুবিধা দান করে। বিশ্বের সবচেয়ে স্বনামধন্য সংবাদ ব্যবস্থা তাদের ছিল, যাদের কাছে অনেক আন্তর্জাতিক ও আন্তসাংকৃতিক যোগাযোগে অনেক বেশি অভিজ্ঞতা ছিল, আর তারা সমুদ্রের নিচের ক্যাবল সিস্টেমের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করত। এই সক্ষমতাগুলো যুদ্ধের মোর ঘুরিয়ে দেয়।
ব্রিটিশদের কাছে একটি কূটনৈতিক সেবা ছিল যা বিশ্বের অনেক জাতির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করত, কিন্তু জার্মানি কূটনৈতিক দিক দিয়ে অতটা অগ্রসর ছিল না।[১৩] জার্মান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ যেমন আয়ারল্যান্ড ও ভারতে বিপ্লব উষ্কে দেবার চেষ্টা করলে তা অকার্যকর হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে ব্রিটিশদের প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল, যার কারণে তারা সফলতার সাথে আরবদের অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবে উষ্কে দেয়।
১৯১৪ সালের আগস্টে ডেভিড লয়েড জর্জ চার্লস মাস্টারম্যান এমপিকে ওয়েলিংটন হাউজের প্রোপাগান্ডা এজেন্সির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। সাহত্যিক প্রতিভার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণও এই কার্যে জড়িত ছিলেন। এর সদস্যদের মধ্যে আর্থার কোনান ডয়েল, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, জি কে চেস্টারটন, থমাস হার্ডি, রুডইয়ার্ড কিপলিং এবং এইচ জি ওয়েলস ছিলেন। ১,১৬০ এরও বেশি পুস্তিকা যুদ্ধের সময় প্রকাশিত হয়েছিল এবং এগুলো নিরপেক্ষ দেশসমূহে ও একসময় জার্মানিতেও বিতরণ করা হয়।
প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ১৯১৫ সালের রিপোর্ট অন এলেজড জার্মান আউটরেজেস। সারা বিশ্ব জুড়ে সাধারণ মতামত তৈরিতে এই পুস্তিকাটির একটি বিশাল প্রভাব ছিল। এই পুস্তিকাটিতে বেলজিয়ামের সাধারণ জনগণের উপরে জার্মানির প্রকৃত ও অভিযুক্ত উভয় প্রকার নৃশংসতা তুলে ধরা হয়। লুইস রেমেকারস নামের একজন ডাচ চিত্রকর উচ্চমাত্রার আবেগজনিত চিত্র তৈরি করেন যেগুলো পুস্তিকাটিতে প্রকাশ করা হয়েছিল।
১৯১৭ সালে, এই ব্যুরোতে ডিপার্টমেন্ট অব ইনফরমেশন অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং টেলিগ্রাফ যোগাযোগ, রেডিও, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং চলচ্চিত্রের জন্য এর আলাদা আলাদা শাখা খোলা হয়। ১৯১৮ সালে শত্রুদেশগুলোতে প্রোপাগান্ডার পরিচালক হিসেবে ভিসকাউন্ট নর্থক্লিফকে নিযুক্ত করা হয়। এই ডিপার্টমেন্ট দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি জার্মানির বিরুদ্ধে যা এইচ জি ওয়েলস এর দ্বারা গঠিত হয়, আরেকটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যা উইকহাম স্টিড এবং রবার্ট উইলিয়াম সেটন-ওয়াটসন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। শেষোক্তটির মনোযোগ ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের জাতিগত সংশক্তির অভাবের উপর এবং তারা ক্রোয়াট ও স্লোভেনদের মত সংখ্যালঘুর অসন্তোষকে উষ্কে দেয়। ভিট্টোরিও ভেনেটোর যুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত ভাঙ্গনে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল।[১২]
জার্মান পরিখাসমূহের উপরে বিমানবাহী লিফলেট ফেলা হয় যেখানে যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা, আত্মসমর্পণ বিজ্ঞপ্তি এবং কাইজার (জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম) এবং জার্মান জেনারেলদের বিরুদ্ধে সাধারণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বিবরণ সংবলিত পোস্টকার্ড ছিল। যুদ্ধ শেষ হতে হতে এমআই৭বি প্রায় ২৬ মিলিয়ন লিফলেট বিতরণ করে ফেলেছিল। জার্মানরা লিফলেট ফেলা পাইলটদের গুলি করা শুরু করেছিল, যার ফলে ব্রিটিশরা মানবহীন লিফলেট বেলুন তৈরি করে যা নো-ম্যানস ল্যান্ড দিয়ে চালিত হত।
অন্তত এই লিফলেটগুলোর প্রতি সাতটির একটি সৈন্যদের দ্বারা তাদের ঊর্ধ্বতনদের কাছে পৌঁছায় নি, যদিও ঊর্ধ্বতনদের কাছে এগুলো না সমর্পন করার জন্য অনেক কঠিন শাস্তি ছিল। এমনকি জেনারেল হিন্ডেনবার্গ স্বীকার করেছিলেন, "সন্দেহাতীতভাবেই, হাজার হাজার সৈন্য বিষ পান করেছিল"। যুদ্ধবন্দীরা স্বীকার করে যে তারা প্রোপাগান্ড লিফলেটগুলো থেকে মোহমুক্ত ছিল যেখানে জার্মান সৈন্যদের নিছক নিষ্কর্মা (cannon fodder) সৈন্য হিসেবে দেখানো হয়। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশরা জার্মানদের দখলে থাকা ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বিমান থেকে নিয়মিত লিফলেট সংবাদপত্র Le Courrier de l'Air ফেলা শুরু করে।[১৪]
যুদ্ধের শুরুতে, ফরাসী সরকার নেতিবাচক সংবাদ প্রচারণাকে দমন করার জন্য গণমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কেবল ১৯১৬ সালেই, মাইসন ডে লা প্রেস এর স্থাপনার সাথে তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্যে একই রকম কৌশল অনুসরণ করা শুরু করে। এর একটি অংশ ছিল "সারভিস ডে লা প্রোপাগান্ডে এয়ারলেন" (এরিয়াল প্রোপাগান্ডা সারভিস) যার পরিচালক ছিলেন প্রফেসর টোনেলা এবং জ্যাঁ জ্যাক ওয়াল্টজ (আলসেশিয়ান চিত্রকর যিনি "হানসি" কোডনেম ব্যবহার করতেন)। ফরাসীরা কেবল চিত্র সংবলিত লিফলেটই বিতরণ করত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা ফরাসীদের দ্বারা বিমানের মাধ্যমে বিতরিত হয়েছিল। এর কারণ ছিল জার্মানরা উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা পচুর পরিমাণে পরিবর্তন করে জার্মান সংবাদপত্রসমূহে প্রচার করে।[১৫]
কেন্দ্রীয় শক্তি (জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া নিয়ে গঠিত ১ম বিশ্বযুদ্ধের একটি পক্ষ) এই কৌশলসমূহ ব্যবহারে ধীর ছিল, কিন্তু যুদ্ধের শুরুতে জার্মানরা অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানকে এই যুদ্ধকে পাশ্চাত্য বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে বা জিহাদ বলে ঘোষণা করতে প্ররোচিত করতে সফল হয়। তারা আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান ও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উষ্কে দেবারও চেষ্টা করেছিল। জার্মানদের সবচেয়ে বেশি সফলতা ছিল জার দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের পর রুশ বিপ্লবী লেলিনকে সুইজারল্যান্ড থেকে ফিনল্যান্ডে বদ্ধ ট্রেইনে ট্রানজিট দেয়া। এর ফলে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটে এবং রাশিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। [১৬]
এডলফ হিটলার ব্রিটিশদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা মনস্তাত্ত্বিক কৌশল দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়েছিলেন, আর সৈন্যদের উপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার প্রভাবের কারণেই জার্মানির পরাজয় হয় বলে দাবী করেন। তিনি সামনের দশকগুলোতে গণ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা ব্যবহার করে জার্মান জনসাধারণের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করার জন্য ব্রতী হন। যখন হিটলার ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসেন, জোসেফ গোয়েবলসকে প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, আর তিনি হিটলারকে জার্মানির উদ্ধারের জন্য একজন দেবদূতের ন্যায় ব্যক্তিতে পরিণত করেন। প্রভাবিত করার জন্য হিটলার এর সাথে তার বক্তৃতায় অনুনাদ হওয়া আওয়াজকেও ব্যবহার করত।
জার্মানির চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণের ফল গ্রান পরিকল্পনায় চেকোস্লোভাক সাধারণ নাগরিক, সরকার ও বিশেষ করে চেকোস্লোভাকদের মিত্রদের লক্ষ্য করে বানানো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ একটি বিশাল ভূমিকা রাখে।[১৭] তারা সফলতার সাথে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, জার্মানি আপিজমেন্টের মাধ্যমে যুদ্ধ ছাড়াই চেকোস্লোভাকিয়া দখল করার সমর্থন লাভ করেছে, মিউনিখ চুক্তির পূর্বে সর্বনিম্ন ক্ষতির জন্য এখানে কেবল গুপ্ত যুদ্ধ করা হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে ব্রিটিশরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা তৈরি ও ছড়ানোর জন্য পলিটিকাল ওয়ারফেয়ার এক্সেকিউটিভ বা রাজনৈতিক যুদ্ধবিগ্রহ কার্যনির্বাহী তৈরি করে। শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের সাহায্যে সমস্ত ইউরোপ জুড়েই এর প্রচার সম্ভব হত। রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে সেফটন ডেলমার একটি সফল কৃষ্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডার ব্যবস্থা করেছিলেন। এইসব রেডিও স্টেশনগুলো জার্মান সৈন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। জার্মান সৈন্যদের মনোবল দুর্বল করে দেয়ার জন্য এর ব্যবহার হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জার্মানদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার জন্য রেডিও প্রচারণার ব্যবহার করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশরা ভীষণরকমের প্রতারণার ব্যবহার করে। এর জন্য তারা অনেক নতুন কৌশল ও তত্ত্ব তৈরি করেছিল। এই সময়কার প্রধান প্রোপাগান্ডিস্ট ছল 'এ' ফোর্স, যা ১৯৪০ সালে ডাডলি ক্লার্ক এবং লন্ডন কন্ট্রোলিং সেকশন এর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় এবং। ১৯৪২ সালে এটি জন বেভানের তত্ত্বাবধানে চলে যায়।[১৮][১৯] ক্লার্ক অনেক সামরিক প্রতারণার (military deception) পথিকৃৎ ছিলেন। তার যুদ্ধের কাল্পনিক ক্রমসমূহের একত্রিকরণ, দৃশ্যমান ছনলা এবং ডাবল এজেন্ট এর ধারণা মিত্রপক্ষের সামরিক প্রতারণার কৌশলকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে, যার জন্য তাকে "দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের মহানতম প্রতারক" বলে আখ্যায়িত করা হয়।[২০]
মিত্রপক্ষের নরমান্ডি আক্রমণের সময় মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহের অনেক নতুন নতুন কৌশল তৈরি করা হয়। অপারশন বডিগার্ডের জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণের সঠিক তারিখ ও অবস্থানের ব্যাপারে জার্মান হাই কমান্ডকে ভুল পথে চালিত করা। ১৯৪৩ সালের প্রারম্ভে লন্ডন কনট্রোলিং সেকশন (LCS) এর অধীনে পরিকল্পনা শুরু হয়। তেহরান সম্মেলনে প্ল্যান জায়েল নামে একটি খসরা কৌশল মিত্রপক্ষের হাই কমান্ডের কাছে পেশ করা হয়। অপারেশন ফরটিচুডের লক্ষ্য ছিল জার্মানদেরকে বিশ্বাস করাতে যে মিত্রপক্ষের সামরিক শক্তি অনেক বেশি। কাল্পনিক ফিল্ড আর্মি, আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য নকল অপারেশন এবং মিত্রপক্ষের যুদ্ধের ক্রম ও যুদ্ধ পরিকল্পনার ব্যাপারে ফাঁস হওয়া মাধ্যমে এটা করা হয়।
ইংলিশ চ্যানেলে বর্ধিত নৌ-প্রতারণাসমূহ (অপারেশন গ্লিমার, ট্যাক্সেবল এবং বিগ ড্রাম) ব্যবহার করা হয়।[২১] ছোট জাহাজ এবং বিমান নিয়ে ফ্রান্স এর পাস ডে ক্যালেইস, কাপ ডি'এন্টিফার এবং পশ্চিম অংশে নকল আক্রমণ (simulated invasion) করা হয়।[২২] একই সাথে অপারেশন টাইটানিকে রয়াল এয়ার ফোর্স নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং এর পূর্বে ও পশ্চিমে নকল প্যারাট্রুপারদের নিচে নামায়।
এই প্রতারণাসমূহ ডাবল এজেন্ট, রেডিও ট্রাফিক এবং দৃশ্যমান প্রতারণার সাহায্যে প্রয়োগ করা হত। যুদ্ধের শুরু থেকেই ব্রিড়িশ "ডাবল ক্রস" এন্টি-এসপিয়নেজ অপারেশনগুলো সফল প্রমাণিত হয়,[২৩] এবং এলসিএস ডাবল এজেন্টদের দিয়ে মিত্রপক্ষের আক্রমণ পরিকল্পনা সম্পর্কিত ভুল তথ্য পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল।[২৪] উত্তর আফ্রিকা অভিযানে নকল ট্যাংক এবং অন্যান্য নকল সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে দৃশ্যমান প্রতারণার ব্যবহার করা হয়। বডিগার্ড এর জন্য নকল সরঞ্জাম তৈই করা হয়েছিল, বিশেষ করে কালাইসের পাশে আক্রমণ হচ্ছে এটা বোঝাবার জন্য ডামি ল্যান্ডিং ক্রাফট তৈরি করা হয়েছিল।
অপারেশনটি সফল হয়েছিল এবং নরমান্ডি ল্যান্ডিং এর ব্যাপারে জার্মান প্রতিরোধ ব্যবস্থা সতর্ক ছিল না। পরবর্তী প্রতারণাসমূহের ফলে হিটলার ক্যালেইস অঞ্চলে নতুন সৈন্য পাঠাতে প্রায় সাত সপ্তাহ দেরি করে ফেলে।[২৫]
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ কর্মসূচী গ্রহণ করে। ফোনিক্স প্রোগ্রাম এর দুটো লক্ষ্য ছিল, একটি হল
এনএলএফ (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট) কর্মকর্তাদেরকে গুপ্তহত্যা করা এবং অপরটি হল সাম্ভাব্য সহানুভূতি তৈরিকারক বা পরোক্ষ সমর্থনকারীদেরকে ভয় দেখানো। দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারের চিউ হয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে এনএলএফ সদস্যদের দলত্যাগ করতে প্ররোচিত করা হয়।
যখন পিআরজি এর সদস্যদেরকে গুপ্তহত্যা করা হয়, সিআইএ এবং স্পেশাল ফোর্স কর্মকর্তাগণ কলিং কার্ড হিসেবে মৃতদের মুখে তাস খেলার কার্ড রেখে দিয়েছিল। ফোনিক্স প্রোগ্রামের সময় ১৯,০০০ এরও বেশি এনএলএফ সদস্যকে হত্যা করা হয়।[২৬] যুক্তরাষ্ট্র বিকৃত মানব শব্দের রেকর্ডিং রাতের বেলায় ভিয়েতনামের সৈন্যদের শোনাতে যাতে তারা মনে করে, মৃতরা প্রতিশোধের জন্য ফিরে এসেছে।
সিআইএ নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা সরকারকে ভেঙ্গে দেবার জন্য প্রচুর পরিমাণে কনট্রা সৈন্যের ব্যবহার করে।[২৭] লাইসেন্সবিহীন টিভি সম্প্রচারের মাধ্যমে সিআইএ পানামাবাসীদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ কৌশল ব্যবহার করত। ফ্লোরিডার মায়ামি ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল টিভি মার্টির মাধ্যমে সিআইএ প্রচুর পরিমাণে প্রোপাগান্ডা সম্প্রচার করে। কিন্তু কিউবা সরকার টিভি মার্টির সিগনাল জ্যামিং করতে সফল হয়েছিল।
ইরাক যুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি সেনাবাহিনীর যুদ্ধের ইচ্ছাকে নষ্ট করে দিতে "শক এন্ড অ" অভিযান শুরু করে।
সামাজিক গণমাধ্যম ডিজইনফরমেশন বা ভুল তথ্যকে আরও বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ২০১৪ সালের ইউক্রেমে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত ভুল পথে চালনাকারী ছবি ব্যবহারের সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা কাজ করতে পারে।[২৮]
নিম্নোক্ত আধুনিক সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়:
এই কৌশলগুলোর বেশিরভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা এর পূর্বে তৈরি করা হয়েছিল, এবং তখন থেকে প্রত্যেকটি সংঘর্ষে এগুলোকে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহাত করা হয়। ডেনিয়েল লারনার ওএসএস-এ (যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এর পূর্ব রূপ) কাজ করেছিলেন এবং তার বইতে তিনি, এই কৌশলসমূহ কিরকম কার্যকরী তা বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেন। তিনি উপসংহার টানেন যে, জয় নিশ্চিত - এমন অবস্থায় লাউডস্পিকারে পরাজয় স্বীকারের নির্দেশনা ব্যতীত এদের প্রত্যেকটিই নাটকীয়ভাবে সফল ছিল। তবুও লক্ষণীয় যে, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহের সাফল্য বা ব্যর্থতার পরিমাপ করা অনেক কঠিন, কারণ এগুলোর প্রয়োগের অবস্থাটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ ব্যবস্থার ধারে কাছে থাকে না।
লারনার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ অপারেশনসমূহকে তিওটি ভাগে ভাগ করেন:[৩১]
লারনার দেখান যে ধূষর এবং কৃষ্ণ অপারেশনগুলোতে চূড়ান্তভাবে অনেক মূল্য দিতে হয়, এক্ষেত্রে লক্ষ্যে থাকা জনগণ একসময় না একসময় একে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা হিসেবে টের পেয়ে যায় এবং এর উৎস্যকে তীরষ্কার করে। তিনি লেখেন, "এটা কিছু মতবাদের মধ্য একটি যা সাইকেওয়ারিয়রগণ (মানসিক যোদ্ধা) উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ব্যবহার করেন: প্ররোচিত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। কোন মানুষকে আপনি যা বলবেন তা করানোর পূর্বে, আপনি যা বলেন তাকে তাতে বিশ্বাস করাতে হবে।"[৩১]:২৮ এই ধারনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের কৌশলে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সত্য ব্যবহার করা হত।
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, শত্রুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আক্রমণ করা গণচীনের সামরিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।[৩২] এধরনের যুদ্ধবিগ্রহের ধরন সুন জু এর দ্য আর্ট অব ওয়ার এবং থার্টি-সিক্স স্ট্রাটাজেম এ উল্লিখিত রয়েছে। প্রতিপক্ষ সামলানোর ক্ষেত্রে, চীনকে সাম্যবাদী লয়ালিস্টদেরকে সচল করতে মার্ক্সবাদ ব্যবহার করতে দেখা যায় এবং চীনের স্বার্থে অন্যান্য জাতিকে প্ররোচিত করার জন্য এর অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে দেখা যায়। চীন সরকার দেশের জনগণের জন্য শক্তভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ব্যবহার করতে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।[৩২]
জার্মান বুন্দেসহোয়েরে (জার্মান সেনাবাহিনী), জেন্ট্রাম অপারেস্টিভ ইনফরমেশন এবং এর অধীনস্থ ব্যাটেলিয়ন ফার অপারেটিভ ইনফরমেশন ৯৫০ সাইঅপ (PSYOP - মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন) প্রচেষ্টার (জার্মান ভাষায় অপারেটিভ ইনফরমেশন বলা হয়) জন্য দায়বদ্ধ। কেন্দ্র এবং ব্যাটেলিয়ন উভয়ই নতুন স্ট্রেইটক্রাফটেবেসিস (জয়েন্ট সারভিস সমর্থন কমান্ড, এসকেবি) এর অধীনস্থ, এবং এদের একসাথে প্রায় ১,২০০ সৈন্য রয়েছে যারা আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মাধ্যম প্রযুক্তিতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জার্মান সাইঅপ এর একটি প্রোজেক্ট হচ্ছে রেডিও স্টেশন স্টিমে ডার ফ্রেইহাইট (সদা-ই আজাদি, ভয়েস অবন ফ্রিডম),[৩৩] যা হাজার হাজার আফগান শুনেছিল। আরেকটি হচ্ছে কসভো এবং আফগানিস্তানে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন প্রচার করা, যেখানে জার্মান সৈন্যগণ ন্যাটোর সাথে কাজ করে।
ব্রিটিশরা ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ ব্যবহার করা প্রথম সামরিক শক্তিদের মধ্যে একটি। বর্তমান ব্রিটিশ আর্মড ফোর্স, মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনসমূহ ট্রাই সারভিস ১৫ সাইকোলজিকাল অপারেশনস গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। (আরও দেখুন এমআই৫ এবং সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সারভিস)। সাইকোলজিকাল অপারেশন গ্রুপে ১৫০ এরও বেশি কর্মকর্তা রয়েছে, এদের মধ্যে প্রায় ৭৫ জন নিয়মিত আর্মড সারভিস এর এবং ৭৫ জন বিকল্প হিসেবে থাকেন। এই গ্রুপটি অপারেশনাল ও কৌশলগত পরিবেশে মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনের জন্য কমান্ডার নিয়োগ করে।[৩৪][৩৫]
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে এই গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করা হয়,[৩৬] এরপর থেকে অপারেশনাল প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য এটির আকার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়,[৩৭] এবং ২০১৫ সাল থেকে ৭৭তম ব্রিগেডের একটি সাব-ইউনিট, যা পূর্বে সিকিউরিটি এসিস্টেন্স গ্রুপ নামে পরিচিত ছিল।[৩৮] এমওডি এর ডিরেক্টর অব ডিফেন্স কমিউনিকেশনস এবং যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিউনিকেশনস কমিটির প্রাক্তন চেয়ার (২০১৩-১৫) স্টিফেন জলিকে ব্রিটিশ ডিফেন্সে সবচেয়ে সিনিয়র সাইঅপস অফিসার হিসেবে জানা যায়।
২০১৫ সালের জুনে, গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড কর্তৃক প্রকাশিত এনএসএ ফাইলসমূহে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি জিসিএইচকিউ এর জেটিআরআইজি গ্রুপ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হয় যেখানে অনলাইন কমিউনিটিকে গোপনে প্রভাবিত করার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ছিল।[৩৯] এটা জেটিআরআইজি এর লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেটি হল: শত্রুদেরকে তিরস্কার, ভুল তথ্য দিয়ে, এবং তাদের যোগাযোগ বন্ধ করার মাধ্যমে তাএরকে "ধ্বংস করা, অস্বীকার করা, ক্ষয় করা, এবং চূর্ণবিচূর্ণ করা"।[৪০]
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহ শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে বলে ধারণা করা হয়।[৪১] ইউনাইটেড স্টেটস জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ বিস্তারিতভাবে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহকে সংজ্ঞায়িত করেন, যেখানে বলা হয়, "মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহে শত্রুদের মনকে প্রভাবিত করার জন্য যেকোন অস্ত্রকে ব্যবহার করে। অস্ত্রগুলো নিজেই অস্ত্র, সেজন্য এগুলো মনস্তাত্ত্বিক নয়, বরং এরা যে প্রভাব তৈরি করে তার জন্যই এরা মনস্তাত্ত্বিক।"[৪২] বর্তমানে ইউ.এস. ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স এভাবে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধবিগ্রহকে সংজ্ঞায়িত করে:
"উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা এবং অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক কার্যের পরিকল্পিত ব্যবহার যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য শত্রুভাবাপন্ন বৈদেশিক দলসমূহের মতামত, আবেগ, ভাব এবং আচরণকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যাতে জাতীয় লক্ষ্য অর্জন সমর্থিত হয়।"[৪৩] T
এই সংজ্ঞাটি নির্দেশ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনসমূহের একটি বিশিষ্ট উপাদান হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা এবং প্রতি-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বা কাউন্টারপ্রোপাগান্ডা। বিদেশে উদ্ভূত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতি-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার জন্য জনসংযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার জন্য জয়েন্ট পাবলিকেশন ৩-৫৩ একটি নির্দিষ্ট নীতি প্রতিষ্ঠা করে।[৪৪]
যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনসমূহের উদ্দেশ্য হল যুকরাষ্ট্রের লক্ষ্যের পক্ষে কোন লক্ষ্যে থাকা ব্যক্তি বা দলের আচরণকে প্রভাবিত বা শক্তিশালী করা। স্পেশাল এক্টিভিটিজ ডিভিশন (এসএডি) হচ্ছে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) এর ন্যাশনাল ক্লানডেস্টাইন সারভিসের (জাতীয় চোরাগোপ্তা সেবা) একটি বিভাগ, যা গুপ্ত কার্য এবং "বিশেষ কার্য" সম্পাদিত করে থাকে। এই বিশেষ কার্যসমূহের মধ্যে গুপ্ত রাজনৈতিক প্রভাব (যার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনও অন্তর্ভূক্ত) এবং প্যারামিলিটারি অপারেশন রয়েছে।[৪৫] এসএডি এর রাজনৈতিক প্রভাব দল হচ্ছে একমাত্র ইউএস ইউনিট যা এই অপারেশনসমূহ গুপ্তভাবে পরিচালনা করার জন্য অনুমোদিত এবং এক্ষেত্রে একেই প্রাথমিক একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৪৫]
যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে নিবেদিতপ্রাণ মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন ইউনিট রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস নেভিও সীমাবদ্ধ সাইঅপ মিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সাইঅপ ইউনিট এবং সামরিক বাহিনীর সকল শাখার সৈন্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের মধ্যকার যুক্তরাষ্ট্রীয় নাগরিকদের লক্ষ্য করে মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন পরিচালনা করা নিষিদ্ধ (এক্সেকিউটিভ অর্ডার এস-১২৩৩, ডিওডি ডিরেক্টিভ এস-৩৩২১। ১, এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিসিশন ডিরেক্টিভ ১৩০)। অন্তর্বর্তী সামরিক মিশন পরিচালনার বেলায় যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সাইঅপ (PSYOP) ইউনিট অ-মনস্তাত্ত্বিক অপারেশনে সাহায্য করতে পারে, তারা কেবল বৈদেশিক শ্রোতাদেরকে টারগেট করতে পারে।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে একজন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী ফিল্ড ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয়, সামরিক অপারেশনসমূহ পরিচালনা, বর্ণনা এবং নির্দেশনা দেবার জন্য কার্যসমূহ সম্পর্কে জানানো এবং প্রভাবিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য সম্পর্কিত বিষয়সমূহ নিয়ে "পরিকল্পনা তৈরি, একীভূতকরণ এবং সুসংগতি দানের" জন্য অনেক সেনাবাহিনী বিভাগের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে নিযুক্ত করা হয়।[৪৬]
ন্যাটো
যুক্তরাষ্ট্র:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ:
সোভিয়েত ইউনিয়ন:
সম্পর্কিত:
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.