Loading AI tools
ভারতে ইসলামী অতীন্দ্রিয়বাদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতে সুফিবাদের ইতিহাস ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হয়েছে। [1] ভারতে সুফিবাদের উপস্থিতি ইসলামকে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। [2] ৮ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলামের প্রবেশের পর, ১০ম এবং ১১শ শতাব্দীর দিল্লি সালতানাতের সময় এবং তার পরে ভারতে সুফি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। [3] দিল্লি সালতানাতের প্রাথমিক পর্যায়ে তুর্কি এবং আফগান ভূমি থেকে আগত শাসকরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। [4] এই পারসিক প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম, সুফি চিন্তা, সমন্বয়মূলক মূল্যবোধ, সাহিত্য, শিক্ষা এবং বিনোদন নিয়ে আসে, যা আজকের ভারতে ইসলামের উপস্থিতিতে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। [5] সুফি প্রচারক, বণিক এবং ধর্মপ্রচারকরা সামুদ্রিক যাত্রা ও বাণিজ্যের মাধ্যমে গুজরাতের উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী হয়েছিলেন।
সুফি তরিকাগুলির বিভিন্ন নেতা, তরিকা, স্থানীয় মানুষদের সুফিবাদের মাধ্যমে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথম সংগঠিত কার্যক্রম শুরু করেন। সুফি ব্যক্তিত্ব এবং পৌরাণিক কাহিনী প্রায় ক্ষেত্রেই ভারতের গ্রামীণ জনপদগুলোতে হিন্দু জাতি সম্প্রদায়গুলির কাছে সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করেছিল। [5] সুফিবাদের শিক্ষাগুলি - দেবতাত্মক আধ্যাত্মিকতা, মহাজাগতিক সাদৃশ্য, প্রেম এবং মানবতা - সাধারণ মানুষের সাথে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং আজও তা করে। [6][7] নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুটি সুফিবাদের বিস্তার এবং ইসলামের একটি আধ্যাত্মিক বোঝাপড়ার সহায়ক বিভিন্ন প্রভাবগুলি নিয়ে আলোচনা করবে, যা আজকের দিনে ভারতে সুফি সংস্কৃতির একটি সমকালীন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করেছে।
৭১২ খ্রিষ্টাব্দে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে মুসলমানরা ভারতে প্রবেশ করে সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল বিজয় করেন। এই ঐতিহাসিক অর্জন দক্ষিণ এশিয়াকে মুসলিম সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করে।[8][9] একই সময়ে, আরব মুসলমানদের ব্যবসা ও বাণিজ্যের জন্য হিন্দুস্তানি (ভারত) সমুদ্রবন্দরগুলিতে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তৎকালীন খলিফার ইসলামি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ভারতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এই বাণিজ্য পথটি ভারতকে ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্ব এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত করে রেখেছিল ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়কালে, আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০ – ১২৫৮) বাগদাদে অবস্থিত ছিল; এই শহরটি সুফিবাদের জন্মস্থানও, যেখানে আব্দুল কাদির জিলানি, হাসান আল বাসরি এবং রাবেয়া বসরীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ছিলেন।[10]
৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই বাণিজ্য পথটি ভারতকে ভূমধ্যসাগরীয় বিশ্ব এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত করে রেখেছিল।[11] এই সময়কালে, আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০ – ১২৫৮) বাগদাদে বিরাজ করছিল; এই শহরটি সুফিবাদের জন্মস্থানও, যেখানে আব্দুল কাদির জিলানী, এবং হাসান আল বসরির মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা বসবাস করতেন।[12][13]
বাগদাদ থেকে পারস্য এবং আফগানিস্তান হয়ে কাশ্মীরে বিভিন্ন আক্রমণের মাধ্যমে ইসলামের মরমী ঐতিহ্য উল্লেখযোগ্যভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ৯০১ খ্রিষ্টাব্দে, তুর্কি সামরিক নেতা সবুক্তগিন গজনিতে একটি তুর্কো-পারসিয়ান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র মাহমুদ গজনভি ১০২৭ খ্রিষ্টাব্দে তাদের শাসন ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে সম্প্রসারিত করেন।[14] পাঞ্জাব থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ও ধন-সম্পত্তি গজনির কোষাগারে জমা করা হত যা দিয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিজেদের শাসন আরও প্রসারিত করেন।[15] ১১শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, গজনভিরা ভারতের সীমানায় অসংখ্য মুসলিম পণ্ডিত প্রেরণ করেন, যারা সেখানে পূর্বের আরব প্রভাবের পর প্রথম পারস্য-অনুপ্রাণিত মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে।[16]
১১৫১ খ্রিষ্টাব্দে, আরেকটি মধ্য এশীয় দল, যারা ঘুরি রাশবংশ নামে পরিচিত ছিল, গজনভিদের- যারা ভারতে তাদের ভূমি পর্যবেক্ষণ তেমন মনোযোগী ছিল না, পরাজিত করে তাদের ভূমি দখল করে।[17] তুর্কি বংশোদ্ভূত গভর্নর মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ ঘুরি, ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান, ভারতে একটি বড় আক্রমণ শুরু করেন যার মাধ্যমে তিনি পূর্ববর্তী গজনভিদের শাসনকে দিল্লি এবং আজমির পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, উত্তর ভারত ছিল অদৃশ্যমান; বাগদাদের বিশ্বজনীন সংস্কৃতি গজনি আদালতের পারস্য-তুর্কি ঐতিহ্যের সাথে মিশে সুফি বুদ্ধিজীবিতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।[18] মধ্য এশিয়া এবং ইরানের পণ্ডিত, কবি এবং সুফি ব্যক্তিরা ভারতে একীভূত হয়ে যায়। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, ঘুরিরা বেনারস (বারাণসী), কনৌজ, রাজস্থান এবং বিহারে শাসন প্রতিষ্ঠা করে, যার ফলে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন ঘটে।[15]
আরবি ও পারস্য পাঠ্য (কুরআন, হাদিসের সংকলন, সুফি সাহিত্য) স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের ওপর জোর দেওয়া ইসলামিকরণের গতি বাড়িয়েছিল ভারতে।[19] বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, সুফিরা পূর্ববর্তী বহুঈশ্বরবাদী জনসংখ্যার মধ্যে ইসলামকে উদারভাবে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। ফলস্বরূপ, পণ্ডিতদের মধ্যে সাধারণ ঐকমত্য হল যে এই প্রাথমিক ইতিহাস সময়কালে কখনও কোনো প্রকারের জোরপূর্বক গণ ধর্মান্তরের ইতিহাস নেয়।[20] ১২শ শতাব্দীর শেষ এবং ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে, সুফিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো উত্তর ভারতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[21]
১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালটি দিল্লি সালতানাত হিসাবে পরিচিত।[17][22] এই সময়সীমায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি পৃথক রাজবংশ শাসন করেছিল, এগুলো হল মামলুক বা দাস, খিলজি, তুগলক, সৈয়দ এবং লোদি রাজবংশ। ইতিহাসে, দিল্লি সালতানাত সাধারণত পরবর্তী মুঘল সাম্রাজ্যের তুলনায় কম গুরুত্ব পেয়েছে।[23] দিল্লি সালতানাতের সবচেয়ে ভালো সময়ে তারা উত্তর ভারত, আফগান সীমান্ত এবং বাংলাকে শাসন করত। মঙ্গোলরা যখন ১২০৬ থেকে ১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দ, এ সময়কালে মধ্যে এশিয়ার অন্যান্য অংশে নিজেদের শাসন বিস্তৃতি করছিল তখন দিল্লি সালতানাত নিজেদের অঞ্চলকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।[24] মঙ্গোলরা যখন আক্রমণ মাধ্যেমে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করে, তখন পালিয়ে আসা শরণার্থীরা নিরাপদ গন্তব্য হিসাবে ভারতকে বেছে নিয়েছিল।[25] পণ্ডিত, শিক্ষার্থী, শিল্পী এবং সাধারণ মানুষ মামলুক-দিল্লি সালতানাতের প্রথম রাজবংশ, শাসকদের সুরক্ষার অধীনে চলে আসে। দিল্লির দরবারে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারস্য এবং মধ্য এশিয়া থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মীয়তা এবং সাহিত্যের বিশাল আগমন ঘটে; যেগুলোর মধ্যে সুফিবাদ ছিল অন্যতম প্রধান উপাদান। মধ্যযুগের এই সময়ে, সুফিবাদ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তুগলক রাজবংশের (১২৯০ – ১৩৮৮) শাসনের বিস্তৃতির সাথে সাথে দাক্ষিণাত্য মালভূমিতেও সুফিবাদ প্রভাব বিস্তার শুরু করে।[17][26] এই সময়কালে, সালতানাতের মুসলিম শাসকরা অপরিহার্যভাবে প্রথাগত ইসলামের অনুসারী ছিলেন না; তবুও, তারা শক্তিশালী বলে বিবেচিত হতেন। রাজবংশীয় সুলতানদের উপদেষ্টাদের মধ্যে মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিত (উলামা) এবং বিশেষ করে মুসলিম মরমী ব্যক্তিত্ব (মাশাইখ) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।[27] যদিও সুফি সাধকরা সাধারণত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা রাখতেন না, সৈয়দ রাজবংশ এবং লোদি রাজবংশের (১৪১৪ – ১৫১৭) নৈতিক শাসনের অবনতির কারণে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়েছিল।[28]
৯০১ থেকে ১১৫১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, গজনভিদের শাসনকালে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ শুরু হয়, যা মসজিদের সাথে সংযুক্ত এবং সংশ্লিষ্ট ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মােনের এই ব্যাপকতা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে।[20] তৎকালীন পণ্ডিতরা কুরআন এবং হাদিস পাঠের গুরুত্ব প্রচার শুরু করেন, যা উত্তর-পশ্চিম ভারত খেকে শুরু হয়েছিল।[29] দিল্লি সালতানাতের সময়, মঙ্গোল আক্রমণের কারণে ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক বৈচিত্র্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ইরান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা দিল্লির রাজধানীর সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য জীবনকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন।[30]
সালতানাত আমলে ধর্মীয় অভিজাতদের মধ্যে দুটি প্রধান শ্রেণিবিন্যাস ছিল। উলামা ছিলেন বিশেষভাবে ধর্মীয় পণ্ডিত, যারা ইসলামি আইনের নির্দিষ্ট শাখায় পারদর্শী ছিলেন। তারা শরিয়া-ভিত্তিক ছিলেন এবং মুসলিমদের ইবাদত ও আচার- আচরণের বিষয়ে অনেক বেশি প্রথাগত ছিলেন। অন্য শ্রেণিটি ছিল সুফি মরমী সাধক বা ফকির। এই দলটি ছিল অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অন্য ধর্মের ঐতিহ্যগুলির প্রতি প্রায় ক্ষেত্রেই সহনশীল ছিলেন। যদিও শরিয়া অনুশীলনের প্রতি প্রতিশ্রুতি সুফিবাদের একটি ভিত্তি, এই অঞ্চলের প্রথম দিককার সুফিরা ভারতে সেবা কাজের মাধ্যমে প্রচার এবং দরিদ্রদের সাহায্য করার উপর মনোনিবেশ করেন।
দিল্লি সলতানাতের সময়, সুফিবাদের উদীয়মান মরমী দৃষ্টিভঙ্গি মাদ্রাসা শিক্ষার বা প্রথাগত পাণ্ডিত্যের বিকল্প ছিল না।[31] সুফিবাদের শিক্ষা কেবল মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছিল। সুফিবাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল "ঈশ্বরীয় চেতনার উন্নতি, ধর্মভীরুতা বৃদ্ধিকরণ এবং মানবতাবাদী মনোভাবের শিক্ষা, স্রষ্ঠারস্বরুপ উন্মোচন, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ" বিষয়ক জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত করে।[31]
ভারতে ইসলাম আরও বেশি জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল খানকাহের প্রতিষ্ঠা। খানকাহ (এছাড়াও খানেগাহ বা খানেকাহ (যেমন বর্ণান্তরিত ফার্সি: خانقاه ), এটি রিবাট নামেও পরিচিত ( رباط ) - অন্যান্য পরিভাষার মাঝে - এটি এমন একটি একটি ভবন বা দালান যা বিশেষত একদল সুফি সম্প্রদায় বা তরিকা জমায়েতের জন্য ডিজাইন করা এবং এটি আধ্যাত্মিক দীক্ষা এবং চারিত্রিক দিক সংস্কারের জন্য একটি জায়গা।[15][24] অতীতে এবং বর্তমানে কিছুটা কম পরিমাণে তারা সালেক (সুফি ভ্রমণকারী), মুরিদ (দীক্ষিত) এবং তালিবদের (ইসলামী শিক্ষার্থীদের) আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহার করত।[21][23] খানকাহগুলি বেশিরভাগ সময়ে দরগাহ (সুফি সাধুদের মাজার), মসজিদ এবং মাদ্রাসা (ইসলামী বিদ্যালয়) এর সাথে সংযুক্ত থাকে। যদিও কিছু খানকাহ প্রতিষ্ঠা রাজকীয় অর্থায়ন বা পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে ছিল, অনেকগুলোই তাদের পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের জন্য ওয়াকফ এবং দাতাদের অনুদান পেতো।[15][32] সময়ের সাথে সাথে, সুফিবাদ ভারতে দৃঢ় হওয়ার সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী সুফি খানকাহের কার্যক্রমও বিবর্তিত হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে, সুফি খানকাহে পীর-মুরিদ এবং তাদের ভক্তদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ফলপ্রসূ সম্পর্কের উপর জোর দিত।[31] উদাহরণস্বরূপ, খানকাহের ভক্তরা একসাথে ইবাদত, জিকির করতেন, গবেষণা করতেন এবং সাহিত্য পড়তেন।[33] মাদ্রাসায় শেখানো ফিকাহ এবং ধর্মতাত্ত্বিক কাজের পাশাপাশি সুফি সাহিত্যে একাডেমিক বিষয়ে আরা গভীর ও সুক্ষ্ম আলোচনা করা হয়।[31] দক্ষিণ এশিয়ায় আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান বিষয়ে গবেষণা করা হত: তাজকিরা বা পীরের জীবনীরচনা, পীরের বাণী এবং মুরশিদের চিঠিপত্র।[31] এছাড়াও, সুফিরা ইসলামের বিভিন্ন নির্দেশিকাও অধ্যয়ন করতেন যা ইসলামিক শিষ্টাচার (আদব) সম্পর্কিত ছিল। আসলে, পারস্যের সুফি সাধক নাজম আল-দীন রাজীর লেখা "পাথ অফ গড'স বন্ডসম্যান ফ্রম অরিজিন টু রিটার্ন" নামক গ্রন্থটি লেখকের জীবদ্দশায়ই ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।[24] এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ভারতেও সুফি চিন্তাধারা অধ্যয়নের জন্য ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এমনকি আজও সংরক্ষিত মরমী সাহিত্য সুফি মুসলমানদের ধর্মীয় এবং সামাজিক ইতিহাসের অমূল্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।[31]
খানকাহের আরেকটি প্রধান কাজ ছিল একটি কমিউনিটি শেল্টার বা আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা।[23] ভারতে চিশতিয়া তরিকার সুফিরা সর্বোচ্চ বিনম্র আতিথেয়তা এবং উদারতার সাথে খানকাহগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।[34] "অতিথি স্বাগত" নীতিকে বজায় রেখে, ভারতের খানকাহগুলো সকলের জন্য উন্মুক্ত আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, মানসিক সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদান করতো।[15][21] আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষুধার্ত এবং হতাশাগ্রস্ত সদস্যদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করত এবং প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো।[23] এইভাবে, সুফিরা তাদের ভালবাসা, আধ্যাত্মিকতা এবং ঐক্যের শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে বর্ণবাদী সমাজে সমতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সুফি ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের উদাহরণই মানুষকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করেছিল।[23] অল্প সময়ের মধ্যেই এই খানকাহগুলো সমস্ত জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গের মানুষের জন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।[15][35] খানকাহের সেবার মাধ্যমে, সুফিরা এমন এক ধরনের ইসলাম উপস্থাপন করেছিলেন যা নিম্নবর্ণের হিন্দুস্তানিদের মধ্যে স্বেচ্ছায় ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরের পথ তৈরি করেছিল।[36]
১৪শ থেকে ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত, ভারত থেকে মুসলিম দরবেশরা উসমানীয় সাম্রাজ্যে আসেন এবং সাম্রাজ্যের বড় বড় শহরগুলোতে সুফি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। উসমানীয় তুর্কি ভাষায় এই খানকাহগুলোকে বলা হতো 'হিন্দি তেক্কেলর'। ইস্তাম্বুলের হোরহোর তেক্কে হল সবচেয়ে পুরনো হিন্দি তেক্কে। ইস্তাম্বুলে তাদের বংশধরদের বলা হয় 'হিন্দি' (হিন্দিলার), যারা তুর্কি ভাষায় কথা বলত এবং তুর্কি সংস্কৃতির সাথে সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়েছিলেন।[37][38][39][40][41][42]
তরিকা (বা তরিকাহ; আরবি: طريقة ṭarīqah) বলতে সুফিবাদের একটি ধারা বা মতাদর্শকে বুঝায়, অথবা হাকীকত লাভের উদ্দেশ্যে এই জাতীয় ধারার নিগূঢ় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি ধারণাকে বুঝায়।
তরিকাতে একজন মুর্শিদ বা পীর বা ইমাম থাকেন যিনি আধ্যাত্মিক নেতার ভূমিকা পালন করেন। তরিকার অনুসারীদেরকে মুরিদ বলা হয়। মুরিদ বা ভক্তরা পীরের দরবারে আসেন তাদের আর্শীবাদের জন্য এবং স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য দীক্ষা গ্রহণ করতে।
মাদারিয়া তরিকা উত্তর ভারত, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ, মেওয়াত অঞ্চল, বিহার, গুজরাত ও পশ্চ৮িমবঙ্গে জনপ্রিয় এবং একইসাথে নেপালে ও বাংলাদেশেও জনপ্রিয় সুফি তরিকা, যা প্রচলিত প্রথা ভাঙা, বাহ্যিক ধর্মীয় অনুশীলনের উপর শিথীলতা এবং আত্ম যিকিরের উপর জোর প্রয়োগের করনে সুপরিচিত। এটি প্রখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ বদিউদ্দীন জিন্দা শাহ মাদার (ওফাত ১৪৩৩খ্রি:) কর্তৃক প্রবর্তিত সূফি তরিকা এবং উত্তরপ্রদেশের কানপুর জেলার মকানপুরে তার মাজার কেন্দ্রিক পরিচালিত তরিকা। তিনি তেরো শতকে আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনাণী সহ ভারতে আগমন করেন।[43]
তাঁর পীর বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক বায়াজীদ তায়ফুর আল-বোস্তামি কর্তৃক প্রবর্তিত তৈয়ফুরিয়া তরিকা থেকে উৎপত্তি হয়ে মাদারিয়া তরিকা ১৫ থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি মুঘল আমলে বিশেষ গৌরব অর্জন করেছিল এবং শাহ মাদারের শিষ্যদের মাধ্যমে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা, বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এ তরিকা ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ সুফি তরিকার মতই এটি প্রতিষ্ঠাতা শাহ মাদারের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা মাদারিয়া তরিকা নামে পরিচিত।[44][45][46][47][48]
কাদেরিয়া (আরবি: القادريه) হল একটি সুফি তরিকা। আবদুল কাদের জিলানির নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। এর বেশ কিছু শাখা রয়েছে। আরবভাষী অঞ্চলসহ তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বলকান, ফিলিস্তিন, চীন,[49] পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকাতে এর বিস্তার রয়েছে।[50] তরিকাটি সুন্নি ইসলামী আইনের মৌলিক বিষয়গুলি মেনে চলার উপর দৃঢ়ভাবে নির্ভর করে থাকে বলে জানা গেছে।
পশ্চিম ভারতে কাদিরিয়ার প্রসারে সুলতান বাহু অবদান রেখেছিলেন। তিনি নিজের লেখার মাধ্যমে এ তরিকাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।[51] তিনি যিকিরের পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিলেন এবং জোর দিয়েছিলেন যে সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছানোর উপায় তপস্বী বা অত্যধিক বা দীর্ঘ প্রার্থনার মাধ্যমে নয় বরং সৃষ্টিকর্তাকে নিঃস্বার্থে ভালবাসার মাধ্যমে অর্জিত হয়, একে তিনি ফানা বলে অভিহিত করেন।
রায্যাক্বীয়্যাহ্ তরিকা পৃথিবীর প্রাচীনতম সুফি তরিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। রায্যাক্ব আলী গিলানীর (১০৯৩-১২০৮খৃঃ) নাম থেকে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। গিলন ইরানের একটি প্রদেশের নাম এবং এর অধিবাসীদের গিলানী বলা হয়ে থাকে। এই তরিকা ইসলামি বিশ্বে সর্বাধিক বিস্তৃততম সুফি তরিকাগুলো একটি এবং মধ্য এশিয়া, হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে এই তরিকার অনুসারী রয়েছে। অনেকেই এই তরিকাকে "জালালী" তরিকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, কারণ এই তরিকায় জিকির (স্রষ্ঠাকে স্মরণ করা) জালালতভাবে করা হয়ে থাকে যদিও অন্যান্য তরিকাগুলোতে উচ্চস্বরে বা হালকা উচ্চস্বরে জিকির করা হয়ে থাকে।
শাযিলিয়া তরিকা হল আবুল-হাসান-আশ-শাযিলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকা। এই তরিকার মুরিদরা (অনুসারী) প্রায়শ শাযূলিয়া নামে পরিচিত। ফাসিয়া তরিকা, শাযিলিয়া তরিকার একটি শাখা, মক্কার ইমাম আল ফাসি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই তরিকার অসংখ্য অনুসারী সৌদি আরব, মিশর, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে রয়েছে।
এটি ভারতে আনা হয়েছিল কায়ালপট্টনমের শেখ আবুবকর মিসকিন সাহিব রাযি এবং মাদুরাইয়ের শেখ মীর আহমদ ইব্রাহিম রাযি দ্বারা। মীর আহমদ ইব্রাহিম হলেন মাদুরাই মাকবারায় চর্চিত তিনজন সুফি সাধকদের মধ্যে প্রথমজন। শাযিলিয়ার ৭০ টিরও বেশি শাখার মধ্যে ফাসিয়াতুশ শাযিলিয়া হল সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অনুশীলিত তরিকা।[52]
চিশতিয়া তরিকা মধ্য এশিয়া ও পারস্য থেকে উদ্ভূত হয়। এই তরিকার প্রথম সুফি ছিলেন আবু ইসহাক শামী (৯৪০-৪১) যিনি আফগানিস্তানের চিশত-ই-শরিফে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[53] চিশতিয়ার প্রসার ঘটে ভারতের বিখ্যাত সুফি মইনুদ্দিন চিশতির (ওফাত ১২৩৬) মাধ্যমে, যিনি ভারতে এই তরিকার প্রচার করেন এবং এটি ভারতের বৃহত্তম সুফি তরিকাগুলোর একটি হয়ে ওঠে।[54] গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে তিনি আংশিকভাবে আবু নাজিব সোহরাওয়ার্দীয়ার শিষ্য ছিলেন।.[55] খাজা মইনুদ্দিন চিশতি মূলত সিস্তান (পূর্ব ইরান, দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তান) থেকে এসেছিলেন এবং মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক জায়গায় ভ্রমণকারী একজন পণ্ডিত ছিলেন।[56] তিনি ১১৯৩ সালে দিল্লিতে পৌঁছান এবং ঘুরিদের শাসনের শেষের দিকে রাজস্থানের আজমির এ স্থায়ী হন। মইনুদ্দিন চিশতির সুফি এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম অজমিরকে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ইসলামীকরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে অভিহিত করেছিল।[55]
চিশতিয়া তরিকা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য খানকাহ তৈরি করেছিল, যার ফলে দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতে ইসলাম প্রচার প্রসার বেড়েছে দরবেশদের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, রক্তপাত বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে নয়।[21] তবে এটি এমন কোন কিছু বোঝায় নাই যে চিশতিয়া তরিকার অনুসারিরা ইসলামের চিরায়ত রাীতিনীতির প্রশ্নে কখনো উলামার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এমন নয়। চিশতিয়া তরিকার অনুসারিরা খানকাহ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং মানবতা, শান্তি ও উদারতার সরল শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এই গোষ্ঠী আশেপাশের নিম্ন ও উচ্চ বর্ণের অসংখ্য হিন্দুকে আকর্ষণ করেছিল।[55] মইনুদ্দিন চিশতির বিখ্যাত মাজারে মুসলমান এবং অমুসলিম উভয়েই যান; এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন এবং তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (ওফাত ১৬০৫) মইনুদ্দিন চিশতির বিখ্যাত মাজারে প্রায় জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রায়ই যেতেন, যা তার প্রজাদের জন্য একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল।[57] খাজা মইনুদ্দিন চিশতির প্রচুর বিখ্যাত উত্তরসূরি রয়েছেন, যাদের মধ্য বিখ্যাত আটজন সুফি যাদেরকে মধ্যযুগীয় চিশতিয়া তরিকার আট বিশিষ্ট সুফি হিসাবে বিবেচিত করা হয়। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (ওফাত ১২৩৩, আজমির, ভারত), কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (ওফাত ১২৩৬, দিল্লি, ভারত), ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার (ওফাত ১২৬৫, পাকপাতান, পাকিস্তান), নিজামুদ্দিন আউলিয়া (ওফাত ১৩৩৫, দিল্লি, ভারত), নাসিরউদ্দিন চিরাঘ দেহলভি[58], বন্দে নেওয়াজ (ওফাত ১৪২২, গুলবার্গা, ভারত)[59], সৈয়দ বকাউল্লাহ শাহ কারিমি সাফিপুর, উন্নাও (১২৬৯ হিজরি-১৩৬২ হিজরি), আখি সিরাজ আইন-এ-হিন্দ (ওফাত ১৩৫৭, বেঙ্গল, ভারত)[60], আলাউল হক পাণ্ডভি, [61] শাহ আবদুল্লাহ কিরমানি (খুশতিগিরি, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ), আশরাফ জাহাঙ্গীর সেমনানি (ওফাত ১৩৮৬, কিচাউচা, ভারত)।[62]
এই সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল-ওয়াহিদ আবু নজিব আস-সোহরাওয়ার্দী (মৃত্যু ১১৬৮)।[63] তিনি মূলত আহমদ গাজ্জালীর শিষ্য ছিলেন, যিনি আবার আবু হামিদ গাজ্জালীর ছোট ভাই। আহমদ গাজ্জালীর শিক্ষা এই সিলসিলার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সিলসিলা মধ্যযুগীয় ইরানে প্রসিদ্ধ ছিল, বিশেষ করে মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় পারস্য থেকে ভারতে অভিবাসনের পূর্বে।[24] তবে, এই সিলসিলাকে মূলধারায় আনতে সাহায্য করেছিলেন আবু নজিব আস-সোহরাওয়ার্দীর ভাতিজা।[64] আবু হাফস উমর আস-সোহরাওয়ার্দী (মৃত্যু ১২৪৩) সুফি তত্ত্বের উপর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো "গিফট অফ ডিপ নলেজ: আওয়ারিফ আল-মা'আরিফ" নামক গ্রন্থটি, যা এতই জনপ্রিয় ছিল যে এটি ভারতীয় মাদ্রাসাগুলিতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহৃত হতো।[63] এটি সোহরাওয়ার্দীয়া সিলসিলার সুফি শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছিল। আবু হাফস তার সময়ের একজন বৈশ্বিক দূত ছিলেন। বাগদাদে শিক্ষা প্রদান থেকে শুরু করে মিশর ও সিরিয়ার আয়্যুবিদ শাসকদের মধ্যে কূটনীতিতে জড়িত ছিলেন আবু হাফস। ইসলামি সাম্রাজ্যের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আবু হাফসের অনুসারীরা ভারতে তার নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সুফি সিলসিলার রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সমর্থন করেছিলেন।[63]
এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবুল জানাব আহমদ, যিনি নাজমুদ্দীন কুবরা (মৃত্যু ১২২১) নামে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।[65] এই সুফি সাধক ছিলেন একজন বিখ্যাত শিক্ষক, যিনি তুরস্ক, ইরান এবং কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন। তার তরিকত ও মারেফাতের শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে তিনি অনেক শিষ্য গড়ে ওঠেন, যারা নিজেরাই পরবর্তীকালে তার থেকে খেলাফত প্রাপ্তি মাধ্যম সুফি সাধক হন।[24]
এই সিলসিলা ১৪শ শতাব্দীর শেষের দিকে কাশ্মীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।[66] কুবরা এবং তার ছাত্ররা সুফি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তারা মরমী লেখা, মরমী মনস্তত্ত্ব, এবং নির্দেশমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেমন "আল-উসুল আল-আশারা" এবং "মিরসাদ উল ইবাদ"।[67] এই জনপ্রিয় গ্রন্থগুলো আজও ভারত এবং অন্যান্য স্থানে সুফি অনুসারীদের মধ্যে অত্যন্ত পছন্দের এবং অধ্যয়নে ব্যবহৃত হয়। কুবরাভিয়া সিলসিলা এখনও কাশ্মীর-ভারত এবং চীনের হুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমান।[24]
এই সিলসিলার উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় খাজা আবু ইয়াকুব ইউসুফ হামদানি (মৃত্যু ১৩৯০) থেকে, যিনি মধ্য এশিয়ার ইরানের হামাদান প্রদেশের বুজানজিড়ে জন্মগ্রহণ করেন করতেন।[24][68] পরবর্তীতে এই তরিকাটির সূচনা মূলত হয়েছে শায়খ বাহাউদ্দীন নকশবন্দীর মাধ্যমে।[24] তাকে সাধারণত নকশবন্দি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাজা মুহাম্মদ আল-বাকি বিল্লাহ বেরাং (মৃত্যু ১৬০৩) নকশবন্দিয়া সিলসিলাকে ভারতে পরিচয় করিয়ে দেন।[24][54] এই সিলসিলা মুঘল সাম্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল, কারণ এর প্রতিষ্ঠাতা খাজা আল-হামাদানির সঙ্গে বংশগত সম্পর্ক ছিল।[69] [70]
১৫২৬ সালে দিল্লি সালতানাত জয় করার আগে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ইতিমধ্যেই নকশবন্দি সিলসিলায় দীক্ষিত হয়েছিলেন। এই রাজকীয় সম্পর্ক সিলসিলার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।[17] এই সিলসিলাকে সুফি সিলসিলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সর্বজনগৃহীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মুজাদ্দিদিয়া তরিকা মুজাদ্দিদে আলফে সানি খ্যাত আহমেদ সিরহিন্দি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি সুফি তরিকা। এটি নকশবন্দি তরিকা থেকে উদ্ভুত হয়েছে। এ তরিকায় সুফিবাদে প্রচলিত গজল, কাওয়ালী ও সামা শুনা নিষিদ্ধ। আহমেদ সিরহিন্দির খলিফাদের নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ইতিহাসে উল্লেখ নেই। তবে তিনি উপমহাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে খলিফাগণের প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। তার অন্যতম দুজন খলিফা যাদের মাধ্যমে মুজাদ্দিদিয়া সিলসিলার প্রসিদ্ধি পেয়েছে এবং ভারতবর্ষে সূলুক, তরবিয়াত দ্বারা জনসাধারণের ঈমান-আকিদা পরিশুদ্ধ করেছেন তারা হলেন; খাজা মাসুম ও আদম হুসাইনী বানুরী। তারা মাসুমিয়্যা সিলসিলা ও আহসানিয়া’ সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা। এ তরিকার বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার হয়েছে শাহ গুলাম আলী বাটালভীর মাধ্যমে। ভারতবর্ষের এমন কোন শহর ছিলো না যেখানে তার মুরিদ ছিলো না। কেবল আম্বালা শহরে তার পঞ্চাশ জন খলিফা ছিলো। এ তরিকার অন্যতম সিলসিলা আহসানিয়া, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, শাহ আবদুল আজিজ এবং তার থেকে সৈয়দ আহমদ বেরলভি ও মিয়াজি নূর মুহাম্মদ খেলাফত প্রাপ্ত হোন।[71][72]
সরওয়ারী কাদেরিয়া সিলসিলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুলতান বাহু দ্বারা, যা কাদেরিয়া সিলসিলার একটি শাখা। এই সিলসিলা মূলত কাদেরিয়া সিলসিলার পথ অনুসরণ করে, তবে বেশিরভাগ সুফি সিলসিলার মতো নির্দিষ্ট পোশাক বিধি, নির্জনতা, বা অন্যান্য দীর্ঘ সময় ধরে চলা সাধনা এরা অনুসরণ করে না। এর মূলধারার দর্শন সরাসরি ক্বলবের সাথে সম্পর্কিত এবং আল্লাহর নামের উপর ধ্যান করা, অর্থাৎ, الله (আল্লাহ) শব্দটিকে নিজের ক্বলবে ধারণ করে তার উপর ধ্যান করা।[73]
ফিরদৌসী বা ফিরদৌসিয়া সিলসিলা হল সোহরাওয়ার্দীয়া সিলসিলার একটি শাখা। এটি শেখ বদরুদ্দিন সামারকান্দি দ্বারা শুরু হয়েছিল, তবে এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরির সময়কালে।[74] এই সিলসিলা মূলত বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের এলাকায় প্রসার লাভ করে।
বারকাতিয়া সিলসিলা হল কাদেরিয়া সিলসিলার একটি শাখা, যা প্রায়শই কাদেরি-বারকাতি নামে লেখা হয়। এটি উত্তর প্রদেশের মারেহারার শাহ বারকাতুল্লাহ মারেহারবি দ্বারা শুরু হয়েছিল।[75]
মধ্যযুগীয় ভারতে আধ্যাত্মিকতা কেবল ইসলাম এবং সুফিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভক্তি আন্দোলন, যা হিন্দু ধর্মের একটি ভক্তিমূলক পুনর্জাগরণ, এই অঞ্চলে আধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলি ছড়িয়ে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।.[76] ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ ভারতে উদ্ভূত হওয়া এই আন্দোলনটি ভক্তিমূলক উপাসনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল এবং ভক্তদের সঙ্গে তাদের দেব-দেবীর মধ্যে আবেগময় সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছিল, যা প্রায়ই গান ও কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।[76] এই আন্দোলনটি আঞ্চলিক ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে একত্রিত করেছিল, যা এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
ভক্তি আন্দোলনের ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাগুলির সাথে সুফিবাদের দর্শনের উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য ছিল, যা হিন্দু ও মুসলিম অনুশীলনের মধ্যে পার্থক্যকে ম্লান করে দিয়েছিল। উভয় ঐতিহ্যই একটি গভীর, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর জোর দেয় এবং পার্থিব জগতের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। ভক্তি দর্শন, ঠিক যেমন সুফি শিক্ষা, মনে করত যে এই জগৎ একটি মায়া এবং উচ্চতর বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য অপরিহার্য (হিন্দুধর্মে মোক্ষ, যা সুফি ধারণার আখিরাত বা পরকালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ)।[77]
সুফিবাদ দিল্লি সুলতানাতের আফগান শাসকদের বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক একীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুফি সাধুরা, যারা অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল একীভূত সংস্কৃতির প্রচার করেছিল, একটি স্থিতিশীল সমাজের বিকাশে অবদান রেখেছিল যা আঞ্চলিক সাহিত্য এবং ভক্তিমূলক সঙ্গীতে সমৃদ্ধ ছিল। এই ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ভারতে একটি অনন্য মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটিয়েছিল।[78]
সপ্তদশ শতাব্দীতে সুফি সাধক সাইয়িদ মুহাম্মদ গউস গওয়ালিওরি সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে মোরাকাবা মোশাহেদার (ধ্যান) অনুশীলন জনপ্রিয় করেছিলেন, যা সুফিবাদ ও হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মধ্যে আরও সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিল।[79] এছাড়াও, একেশ্বরবাদের ওপর গুরুত্বারোপকারী ভক্তি আন্দোলনের সাহিত্য ঐতিহাসিকভাবে একত্রীকৃত সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
যদিও এই ঐতিহাসিক সংমিশ্রণ থাকা সত্ত্বেও, ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলি মাঝে মাঝে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে, যা আজও ভারতের কিছু অংশে বিরাজমান। তবুও, এই সংমিশ্রিত আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকার এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ, আন্তঃসংযুক্ত আধ্যাত্মিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।[78]
সুফিবাদের অন্যতম জনপ্রিয় আচার হল সুফি সাধুদের মাজার পরিদর্শন যাকে সুফিবাদের ভাষায় জিয়ারত বলা হয়ে থাকে। মাজারগুলো ধীরে ধীরে সুফি দরগাহে রূপান্তরিত হয়েছে এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এগুলোর ব্যাপকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে কোনও পবিত্র স্থান পরিদর্শন করার আচারকে বলা হয় "জিয়ারত"। এর সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ হল সৌদি আরবের মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা, মসজিদে নববী পরিদর্শন করা।[80]
একজন সুফি সাধকের মাজার একটি অত্যন্ত সম্মানীয় স্থান, যেখানে কিছু মানুষের বিশ্বাস মতে, বরকত বা আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ মৃত পবিত্র ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে থাকে এবং এটি জিয়ারতকারী ভক্তদের জন্য উপকারে আসে। সুফি সাধুদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য রাজা ও অভিজাতরা বড় বড় দান বা ওয়াকফ প্রদান করতেন, যা মাজারগুলিকে সংরক্ষণ এবং স্থাপত্যগতভাবে সংস্কার করতে সাহায্য করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই দান, আচার এবং বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানগুলি (উরস) গৃহীত নিয়মের একটি বিস্তৃত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল।[81]
এই ধরনের সুফি অনুশীলন নির্দিষ্ট তারিখগুলিতে মাজারের চারপাশে আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।[82] যদিও অনেক কট্টরপন্থী ইসলামীরা এই মাজার জিয়ারত এবং সুফি সাধুদের কাছ থেকে বরকত পাওয়ার প্রত্যাশাকে নিন্দা (শিরক) করে থাকে, তবুও এই আচারগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে এবং এখনও শক্তভাবে টিকে আছে।[82]
ভারতীয় সব ধর্মেই সঙ্গীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সবসময়ই উপস্থিত ছিল।[83] চিন্তা ও দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে, সঙ্গীত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতের শ্রোতারা ইতোমধ্যেই স্থানীয় ভাষায় ভক্তিগীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই কারণে সুফি ভক্তিগীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে তৎক্ষণাৎ সাফল্য অর্জন করে। সুফি আদর্শ সঙ্গীতের মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সুফিবাদে, সঙ্গীতকে "সামা -সুফিদের একটি আচার অনুষ্ঠান, যা জিকির নামক ধ্যান ও প্রার্থনার অংশ হিসেবে পালন করা হয়" বা সাহিত্যের শ্রবণ বলা হয়। এখানে কবিতা বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গাওয়া হত; এই আচার প্রায়ই সুফিদের আধ্যাত্মিক উন্মত্ততায় নিয়ে যেত। সাদা পোশাকে আবৃত ঘূর্ণায়মান দরবেশদের চিত্রটি "সামা"র সঙ্গে মিলে যায়।[83]
অনেক সুফি প্রথায় শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কবিতা ও সঙ্গীতকে উৎসাহিত করা হয়। সুফিবাদের শিক্ষা ও দর্শন জনপ্রিয় কাওয়ালি সঙ্গীতের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৃহৎ জনগণের কাছে পৌঁছায়। মহিলারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন; মহিলারা তাদের সমাবেশে সুফি গান গাইতেন।[33] বর্তমানে সুফি গানের সমাবেশগুলি "কাওয়ালি" নামে পরিচিত। সঙ্গীতের সুফি ঐতিহ্যে সবচেয়ে বড় অবদানকারীদের একজন হলেন আমির খসরু (মৃত্যু ১৩২৫)। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য হিসেবে পরিচিত আমির খসরু প্রাচীন মুসলিম যুগের ভারতের সবচেয়ে প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী ও কবি হিসেবে পরিচিত। তাকে ভারতীয়-মুসলিম ভক্তিমূলক সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। "ভারতের তোতা" নামে পরিচিত আমির খসরু এই উদীয়মান জনপ্রিয় সুফি সংস্কৃতির মাধ্যমে চিশতিয়া তরিকাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।[83]
ভারতে ইসলামের ব্যাপক ভৌগোলিক উপস্থিতির কারণ হিসেবে সুফি প্রচারকদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[84] সুফিবাদ দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সুফি সাধুরা ইসলামের এই আধ্যাত্মিক রূপটি প্রবর্তন করেন।[85] বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সুফি পণ্ডিতরা ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।[86][87]
প্রধান শহর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রগুলিতে সুফিবাদের প্রচার ছাড়াও, সুফিরা গ্রামীণ দরিদ্র এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে স্থানীয় উপভাষায়, যেমন উর্দু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ভাষায় ধর্ম প্রচার করেন, যা ফারসি, তুর্কি এবং আরবির বিপরীতে ছিল।.[84] সুফিবাদ "নৈতিক এবং সামগ্রিক সামাজিক-ধর্মীয় শক্তি" হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, যা হিন্দুধর্মের মতো অন্যান্য ধর্মীয় ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।[88][89]
সুফিদের ভক্তিমূলক চর্চা এবং সরল জীবনের ঐতিহ্য সব শ্রেণীর মানুষের আকর্ষণ ছিল। মানবতা, আল্লাহ এবং নবীর প্রতি ভালোবাসার তাদের শিক্ষা আজও আধ্যাত্মিক গল্প এবং লোকগানে পাওয়া যায়।.[84] সুফিরা ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে দৃঢ়ভাবে বিরত ছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।[87] তাদের চারিত্রিক মাধুর্য, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, ধর্মনিষ্ঠতা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে সুফিবাদ আজও ভারতে আধ্যাত্মিক ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.