Loading AI tools
মঙ্গোল শাসক উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হালাকু খান(মঙ্গোলীয়: Хүлэгу хаан; চাগাতাই: ہلاکو; ফার্সি: هولاکو خان; চীনা: 旭烈兀; আনুমানিক ১২১৮ – ৮ ফেব্রুয়ারি ১২৬৫) ছিলেন একজন মঙ্গোল শাসক। তিনি পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল জয় করেছিলেন। তিনি তোলুইয়ের ছেলে এবং চেঙ্গিস খানের নাতি। আরিক বোকে, মংকে খান ও কুবলাই খান তার ভাই।
তার বাহিনী মঙ্গোল সাম্রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিম অংশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। তিনি পারস্যের ইলখানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বে মঙ্গোলরা মুসলিম ক্ষমতার কেন্দ্র বাগদাদ ধ্বংস করে। বাগদাদের ধ্বংসের ফলে মামলুক শাসিত কায়রো মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র হয়ে উঠে।
হালাকু খান ছিলেন চেঙ্গিস খানের অন্যতম পুত্র তোলুইয়ের সন্তান। তার মা সোরগাগতানি বেকি ছিলেন একজন প্রভাবশালী কেরাইত শাহজাদি। সোরগাগতানি ছিলেন একজন নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান। হালাকু খানের স্ত্রী দকুজ খাতুন এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সেনাপতি কিতবুকাও খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে হালাকু খান বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।[1][2] কয়য়ে বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ থেকে বৌদ্ধধর্মে তার আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়।[3]
হালাকু খানের কমপক্ষে তিনজন সন্তান ছিল। তারা হলেন আবাকা খান, তাকুদার ও তারাকাই। আবাকা খান ১২৬৫ থেকে ১২৮২ সাল পর্যন্ত পারস্যের দ্বিতীয় ইলখান ছিলেন। এরপর তাকুদার ১২৮২ থেকে ১২৮৪ পর্যন্ত ইলখান ছিলেন। তারাকাইয়ের পুত্র বাইদু ১২৯৫ সালে ইলখান হন।[4] ১৫শ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ মীর খাওয়ান্দ আরো দুই সন্তানের নাম উল্লেখ করেছেন তারা হলেন হিয়াক্সামাত ও তানদুন। হিয়াক্সামাত প্রথমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এবং তানদুন দিয়ারবাকির ও ইরাকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন।[5] তাদের জন্মের ধারাবাহিকতার তালিকাটি এভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে: আবাকা, হিয়াক্সামাত, তানদুন তাকুদার ও তারাকাই। হালাকু খানের পুত্রবধু আবশ খাতুন ১২৬৩ সালে শিরাজ শাসনের দায়িত্ব পান।[6]
হালাকু খানের ভাই মংকে খান ১২৫১ সালে খাগান হন। ১২৫৫ সালে তিনি হালাকুকে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম অঞ্চল জয়ের জন্য প্রেরণ করেন। হালাকু খানের অভিযানের সময় হাসাসিনদের ধ্বংস করা হয় এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন হয়।[7]
মংকে খানের আদেশে সাম্রাজ্যে দুই-দশমাংশ যোদ্ধা হালাকুর বাহিনীতে যোগ দেয়।[8] তিনি লুরদের পরাজিত করেন। আলামুতের হাসাসিনরা বিনাযুদ্ধে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
১২৫৭ সালের নভেম্বরে হালাকুর বাহিনী বাগদাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শহরের কাছে পৌছে তিনি তার বাহিনীকে বিভক্ত করে দজলা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। হালাকু খান আত্মসমর্পণ দাবি করলে খলিফা আল-মুসতাসিম তা ফিরিয়ে দেন। খলিফার বাহিনী লড়াইয়ে পরাজিত হয়। বাহিনীর অধিকাংশ মঙ্গোলদের হাতে পরাজিত হয়।
১২৫৮ সালের ২৯ জানুয়ারি চীনা সেনাপতি গুয়ো কানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা শহর অবরোধ করে।[9] তারা পরিখা খনন করে এবং অবরোধ ইঞ্জিন ও কেটাপুল্ট ব্যবহার করে। পরে খলিফা আলোচনা করতে চাইলে মঙ্গোলরা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ১০ ফেব্রুয়ারি বাগদাদ আত্মসমর্পণ করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গোলরা শহরে ঝাপিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ের উপর লিখিত অগণিত বই ধ্বংস হয়ে যায়। বেঁচে যাওয়ারা জানায় যে বই নদীতে ফেলে দেয়ার কারণে দজলা নদীর পানি কালির কারণে কালো হয়ে গিয়েছিল।
এসময় নিহতের সংখ্যা সঠিক গণনা করা সম্ভব নয়। সর্বনিম্ন ৯০,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ২,০০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০ নিহত হয়েছে এমন হতে পারে।[10][11] কয়েক প্রজন্ম ধরে গড়ে উঠা মসজিদ, প্রাসাদ, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল ইত্যাদি মঙ্গোলরা ধ্বংস করে দেয়। খলিফাকে বন্দী করা হয়। মার্কো পোলোর ভ্রমণকাহিনীতে খলিফাকে অভুক্ত রেখে মেরে ফেলা হয়েছে লেখা থাকলেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুসলিম বিবরণ ও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, খলিফাকে কম্বলে মুড়ে তার উপর ঘোড়া চালিয়ে দেয়া হয়। বাগদাদ এরপর জনশূন্য হয়ে পড়ে। অন্যান্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো হালাকুর অধীনতা স্বীকার করে নেয়। ১২৫৯ সালে তিনি সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। আইয়ুবীয়দের পরাজিত করার পর তিনি গাজা পর্যন্ত অনুসন্ধানকারী দল পাঠান।
১২৬০ সালে মঙ্গোলদের সাথে খ্রিষ্টান সিলিসিয়ার আর্মেনীয় এবং ফ্রাঙ্করা যোগ দেয়। এই বাহিনী আইয়ুবীয় শাসিত সিরিয়া জয় করে। ১২৬০ সালে তারা আলেপ্পো দখল করে। সেই বছরের ১ মার্চ খ্রিষ্টান সেনাপতি কিতবুকা দামেস্ক অবরোধ করেন।[14][15][16]
এই অভিযানের ফলে আইয়ুবীয়রা ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ আইয়ুবীয় সুলতান আন-নাসির ইউসুফকে হালাকু খান ১২৬০ সালে হত্যা করেন।[17] ফলে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্র কায়রোতে চলে যায়।
মামলুকদের সাথে লড়াই করার জন্য হালাকু খান ফিলিস্তিনের মধ্যে দিয়ে কায়রো যেতে মনস্থির করেন। তিনি মামলুক সুলতান কুতুজকে একটি চিঠি লিখে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং না করলে বাগদাদের মত কায়রো ধ্বংস করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেন। তবে সেসময় মংকে খানের মৃত্যুর খবর পৌছার ফলে হালাকু খান নতুন খাগান হিসেবে উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য মঙ্গোলিয়া ফিরে যান। এসময় তিনি কিতবুকার অধীনে প্রায় ২০,০০০ সৈনিক রেখে গিয়েছিলেন। সুলতান কুতুজ এরপর একটি বাহিনী নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হন। বাইবার্স এসময় তার সাথে যোগ দেন।
মঙ্গোলরা এসময় আক্কা কেন্দ্রিক ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের সাথে মিলে ফ্রাঙ্কিশ-মঙ্গোল জোট গঠন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু পোপ চতুর্থ আলেক্সান্ডার এতে সম্মতি দেননি। এছাড়া সাইদার শাসক জুলিয়ানের কারণে কিতবুকার এক নাতির মৃত্যুর ফলে দুই পক্ষে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। রাগান্বিত হয়ে কিতবুকা সাইদা আক্রমণ করেন। আক্কার ব্যারনের সাথে মামলুক ও মঙ্গোল উভয় পক্ষ যোগাযোগ করে। মামলুকরা ফ্রাঙ্কদের পুরনো শত্রু হলেও ফ্রাঙ্করা মঙ্গোলদের সাথে হাত না মিলিয়ে মামলুকদেরকে ক্রুসেডার এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ দেয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মঙ্গোলদের অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়ার পর সুলতান কুতুজ তাদের মোকাবেলা করার জন্য আইন জালুতের দিকে অগ্রসর হন। এখানে দুই পক্ষের মধ্যে আইন জালুতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাইবার্স যুদ্ধে হিট-এন্ড-রান কৌশল ব্যবহার করেছিলেন যাতে মঙ্গোলরা পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে মামলুকদের অনুসরণ করে। বাইবার্স ও কুতুজ পাহাড়ের আড়ালে নিজেদের সেনাদের লুকিয়ে রাখেন। মঙ্গোল সেনাপতি কিতবুকা মামলুকদের অনুসরণ করেন এবং বাহিনীর পুরো শক্তি নিয়ে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা মামলুকদের আক্রমণের সীমানায় এসে পড়ার পর আক্রমণের সম্মুখীন হয়। যুদ্ধে সেনাপতি কিতবুকাসহ অধিকংশ সৈনিক নিহত বা বন্দী হয়। যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজয়ের ফলে পূর্ব ও দক্ষিণে তাদের অভিযান থেমে যায়।
খাগান হিসেবে কুবলাই খানের ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর ১২৬২ সালে হালাকু খান ফিরে আসেন। আইন জালুতের পরাজয়ের বদলা নেয়ার জন্য তিনি মনস্থির করেন। একই সময় তিনি বাতু খানের ভাই বারকা খানের সাথে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বারকা খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করার কারণে তার উপর বিরূপ হন। বারকা খান মামলুকদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। তিনি নোগাই খানকে হালাকুর অঞ্চলে অভিযানের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ১২৬৩ সালে ককেসাসের উত্তরে একটি অভিযানের সময় হালাকু খান পরাজিত হন। এটি ছিল মঙ্গোলদের মধ্যকার প্রথম উন্মুক্ত যুদ্ধ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্ক-মঙ্গোল মৈত্রী গঠনের জন্য হালাকু খান বেশ কয়েকবার ইউরোপের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ১২৬২ সালে তিনি তার সচিব রাইকাইদাসকে ইউরোপ পাঠান। তবে সিসিলির রাজা মেনফ্রেড তাদের বন্দী করেন। মেনফ্রেডের সাথে মামলুকদের মিত্রতা ছিল এবং তিনি পোপ চতুর্থ আরবানের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। এরপর রাইকাইদাস ফিরে আসেন।[18]
১২৬২ সালের ১০ এপ্রিল জন দ্য হাঙ্গেরিয়ানের মাধ্যমে ফ্রান্সের নবম লুইয়ের কাছে মিত্রতা স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান।[19] তবে এটি তার কাছে পৌঁছেছিল কিনা তা অস্পষ্ট।[20] হালাকু খান এতে লিখেন যে, তিনি পোপের লাভের জন্য জেরুজালেম দখল করতে চান এবং মিশরের বিরুদ্ধে লুইয়ের কাছে নৌবহর পাঠানোর আবেদন করেন। তবে এসকল চেষ্টা সত্ত্বেও দুইপক্ষে মৈত্রী স্থাপিত হয়নি।
১২৬৫ সালে হালাকু খান উর্মিয়া হ্রদের শাহি দ্বীপে মারা যান। এরপর তার ছেলে আবাকা খান তার উত্তরসূরি হন।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.