Loading AI tools
ভারতের নদী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সরস্বতী নদী হল ঋগ্বেদে ও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য এবং বেদ-পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত একটি দেবত্বারোপিত নদী।[1] বৈদিক ধর্মে এই নদীটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী। ঋগ্বেদের চতুর্থ মণ্ডল ছাড়া সব ক’টি মণ্ডলে এই নদীর নাম উল্লিখিত হয়েছে।
বাস্তব নদী হিসেবে ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশগুলিতে সরস্বতী নদীটিকে বর্ণনা করা হয়েছে "উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি বৃহৎ ও পবিত্র নদী" হিসেবে।[2] কিন্তু ঋগ্বেদেরই মধ্যকালীন ও পরবর্তীকালে রচিত অংশগুলিতে এটিকে "একটি প্রান্তিক হ্রদে (সমুদ্রে)" গিয়ে মেশা ছোটো নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[3][lower-alpha 2] দেবী সরস্বতী ও "সরস্বতী" শব্দের অন্যান্য দ্যোতক শব্দগুলি বেদ-পরবর্তীযুগে স্বাধীন পরিচয়ে বিকাশ লাভ করেছিল।[4] বেদে অবশ্য দেবী সরস্বতীকে এক শক্তিশালী নদী ও মহতী বন্যার রূপেও বর্ণনা করা হয়েছে।[5] হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সরস্বতী নদী এখনও বিমূর্ত রূপে বিদ্যমান এবং এই রূপেই তা ত্রিবেণী সঙ্গমে অপর দুই পবিত্র নদী গঙ্গা ও যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।[6] মাইকেল উইটজেলের মতে, "অমরত্ব ও স্বর্গীয় পরলোকের পথ" হিসেবে দৃষ্ট স্বর্গীয় নদী আকাশগঙ্গা বৈদিক সরস্বতী নদীর উপরিস্থাপিত হয়েছে।[7]
বর্তমান কালের নদনদীগুলিকে অথবা প্রাচীন নদীখাতগুলিকে চিহ্নিতকরণের প্রস্তাব দেওয়ার কাজে ঋগ্বৈদিক ও পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থগুলি ব্যবহৃত হয়। ঋগ্বেদের নদীস্তুতি সূক্তে (১০.৭৫) বলা হয়েছে সরস্বতী নদীটি পূর্বে যমুনা ও পশ্চিমে শতদ্রু নদীর মধ্যভাগে অবস্থিত; অন্যদিকে সপ্তম মণ্ডলে (৯৫.১-২) বলা হয়েছে যে সরস্বতী নদী সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়েছে। বর্তমানে সমুদ্র শব্দটির "সাগর" করা হলেও[lower-alpha 3] বৈদিক সংস্কৃতে এটির অপর অর্থ ছিল "হ্রদ"।[3][8][9][10][lower-alpha 4] তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ ও জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের মতো পরবর্তীকালীন বৈদিক সাহিত্যে এবং মহাভারতেও উল্লিখিত হয়েছে যে সরস্বতী নদী একটি মরুভূমিতে শুকিয়ে গিয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অসংখ্য গবেষক এই তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন যে সরস্বতী নদীটি হল অধুনা উত্তরপশ্চিম ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঘগ্গর-হকরা নদী ব্যবস্থা। এই নদীটি যমুনা ও শতদ্রুর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থর মরুভূমিতে সমাপ্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক ভূপদার্থবৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে যে ঘগ্গর-হকরা প্রত্ন-গতিপথের কথিত ভাটিটি প্রকৃতপক্ষে শতদ্রুর প্রত্ন-গতিপথ, যা গিয়ে মিশত সিন্ধু নদের বদ্বীপ প্রণালী নর নদীতে। ১০,০০০-৮,০০০ বছর আগে শতদ্রু গতিপথ পরিবর্তন করলে এই প্রণালীটি পরিত্যক্ত হয় এবং তার ফলে ঘগ্গর-হকরা নদী ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র বর্ষার জলে পুষ্ট এমন এক নদী ব্যবস্থায় পরিণত হয় যা সমুদ্রে পৌঁছায় না।[11][12][13][14]
প্রায় ৫,০০০ বছর আগে যখন নদীগুলিকে পরিপুষ্টকারী বর্ষার অবনতি ঘটে তখনই সিন্ধু সভ্যতার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।[11][13][15][lower-alpha 5] ইসরোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতার কালীবঙ্গা (রাজস্থান), বনাবলী ও রাখীগঢ়ী (হরিয়াণা), ধোলাবীরা ও লোথাল (গুজরাত) প্রভৃতি নগরকেন্দ্রগুলি এই নদীগুলির অববাহিকাতেই অবস্থিত ছিল।[16][web 1] প্রায় ৪,০০০ বছর আগে নদীগুলিকে পরিপুষ্টকারী বর্ষার আরও অবনতি ঘটলে হকরা শুকিয়ে গিয়ে একটি সবিরাম নদীতে পরিণত হয় এবং নগরাঞ্চলীয় হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে স্থানীয় স্তরে ছোটো ছোটো কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে।[11][lower-alpha 6][13][12][14]
ঋগ্বেদ রচিত হওয়ার বহু আগেই ঘগ্গর-হকরা শুকিয়ে গিয়েছিল বলে একটি প্রকাণ্ড বাস্তব ঋগ্বৈদিক সরস্বতী নদীকে ঘগ্গর-হকরা নদী ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয়।[17][18][lower-alpha 6][13][12][14] উইলকে ও মোবাসের কথায়, যে সময়ে বৈদিক জাতি উত্তর-পশ্চিম ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল সেই সময় সরস্বতী "মরুভূমিতে একটি ছোটো নিরানন্দময় ক্ষীণধারা"-য় পরিণত হয়েছিল।[19] তাছাড়া বাস্তব নদী হিসেবে ঋগ্বেদে সরস্বতীর উল্লেখ এটাই ইঙ্গিত করে যে নদীটি "ইতিমধ্যেই জলের প্রধান প্রবাহটিকে হারিয়েছিল এবং মোটামুটি ৩০০০ বছর আগেই নিশ্চয় একটি প্রান্তিক হ্রদে (সমুদ্র) গিয়ে মিলিত হয়েছিল[3][lower-alpha 2] [এবং] আধুনিক কালের পরিস্থিতির বিচারে সরস্বতী তার জলধারার অধিকাংশটাই হারিয়েছে।" [20][lower-alpha 2][21] ঘগ্গর-হকরার নদীপথের সঙ্গে সরস্বতীর ঋগ্বৈদিক বিবরণ সামঞ্জস্যপূর্ণও নয়।[22][23]
"সরস্বতী" নদীটিকে দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ বা হরাক্ষবতী নদী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।[24] বৈদিক জাতিগোষ্ঠীগুলি পাঞ্জাব অঞ্চলে বসতি স্থাপনের পর এই নদীটির নামই সম্ভবত ঘগ্গর-হকরা নদীর নামকরণের সময় সংস্কৃত ভাষায় পুনঃব্যবহৃত হয়েছিল।[22][24][lower-alpha 7] এছাড়াও ঋগ্বেদে সরস্বতী বলতে সম্ভবত দু’টি স্বতন্ত্র নদীকে বোঝানো হয়েছে, পারিবারিক মণ্ডলগুলিতে (দ্বিতীয়-সপ্তম মণ্ডল) সরস্বতী অর্থে হেলমান্দ নদীকে বুঝিয়েছে, অপর দিকে অধিকতর সাম্প্রতিক দশম মণ্ডলে সরস্বতী অর্থে বুঝিয়েছে ঘগ্গর-হাকরা নদীকে।[24]
ঘগ্গর-হকরা নদী ব্যবস্থাটিকে সরস্বতী নদী হিসেবে চিহ্নিতকরণের বিষয়টি একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নতুন তাৎপর্য বহন করে আনে।[25] এই সূত্র ধরে কেউ কেউ মনে করে ঋগ্বেদ আরও পূর্ববর্তী যুগে রচিত হয়েছিল। তাঁরা মনে করেন, সিন্ধু সভ্যতার নাম রাখা উচিত "সরস্বতী সংস্কৃতি", "সরস্বতী সভ্যতা" বা "সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা",[26][27][28] যা এমন ইঙ্গিত বহন করে যে সিন্ধু উপত্যকা ও বৈদিক সংস্কৃতিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করা যায়।[29] এই গবেষকেরা এই মতের প্রেক্ষিতেই ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ তত্ত্বটিকে অস্বীকার করেন, যে তত্ত্ব মতে ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষী জাতিগোষ্ঠী আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ ও ১৪০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়া ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছিল।[lower-alpha 8][lower-alpha 9]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.